অমিত রায় এর সকল পোস্ট

অমিত রায় সম্পর্কে

আমি আগন্তুক, আমি জনগণেশের প্রচণ্ড কৌতুক। খোলো দ্বার, বার্তা আনিয়াছি বিধাতার। মহাকালেশ্বর পাঠায়েছে দুর্লক্ষ্য অক্ষর, বল্‌ দুঃসাহসী কে কে মৃত্যু পণ রেখে দিবি তার দুরূহ উত্তর।

হারিয়ে যাওয়া

আমাদের ছোট বেলায় ক্যাসেট টেপ ছিলো ভিডিও টেপ ছিলো । তারো আগে রেকর্ড ছিলো । কুকুরের ছবি দেওয়া রেকর্ড ছিলো । হারিয়ে যাচ্ছে অনেক কিছু । রেকর্ড নিয়ে আমার তেমন অভিজ্ঞতা নেই । ক্যাসেট টেপ বা ভিডিও টেপ নিয়ে আছে । ভিডিও বা ক্যাসেট টেপ এর
সমস্যা ছিলো মাঝে মাঝে এসব ব্যবহার না করলে ফাংগাস জন্মে । বিশেষ করে ভিডিও টেপ বাতেসের আদ্রতার কারনে খুব অল্প সময়া নষ্ট হবার সম্ভাবনা থাকে ।
ভিডিও বা ক্যাসেট টেপ এর সাথে মানুষের মগজের (যাকে অনেকে ব্রেইন বলে ) খুব মিল আছে । দুটিই নিয়মিত মাঝে মাঝে না বাজালে বা মনে করলে ফাংগাস জমে ।
তারপর একদিন ডিলিট হয়ে যায়। হারিয়ে যায় কালের অতল গহব্বরে ।
ইদানিং আবার রেকডের জনপ্রিয়তা বাড়ছে । একারনে উৎপাদন বন্ধ থাকা রেকড আবার রেকড উৎপাদন শুরু করছে । এখানে দেখুন
হেরে যাওয়া মানে থেমে যাওয়া নয় ,কোন একদিন আবার ফিরে আসার সম্ভাবনাও রেখে যায় ।

প্রখর তপনতাপে

প্রখর তপনতাপে আকাশ তৃষায় কাঁপে,
বায়ু করে হাহাকার।
দীর্ঘপথের শেষে ডাকি মন্দিরে এসে,
“খোলো খোলো খোলো দ্বার॥
বাহির হয়েছি কবে কার আহ্বানরবে,
এখনি মলিন হবে প্রভাতের ফুলহার॥
বুকে বাজে আশাহীনা ক্ষীণমর্মর বীণা,
জানি না কে আছে কিনা, সাড়া তো না পাই তার।
আজি সারা দিন ধ’রে প্রাণে সুর ওঠে ভরে,
একেলা কেমন ক’রে বহিব গানের ভার॥

লিরিকঃরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রাগ: মূলতান-ভীমপলশ্রী
তাল: দাদরা
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): জ্যৈষ্ঠ, ১৩২৯
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1922
স্বরলিপিকার: দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর
কন্ঠঃসাগর সেন

বজ্র-মানিক দিয়ে গাঁথা

বজ্র-মানিক দিয়ে গাঁথা

বজ্র-মানিক দিয়ে গাঁথা
আষাঢ় তোমার মালা।
তোমার শ্যামল শোভার বুকে
বিদ্যুতেরি জ্বালা।

তোমার মন্ত্রবলে
পাষাণ গলে, ফসল ফলে,
মরু বহে আনে তোমার পায়ে ফুলের ডালা।
মরমর পাতায় পাতায়
ঝরঝর বারির রবে,
গুরু গুরু মেঘের মাদল
বাজে তোমার কী উৎসবে।

সবুজ সুধার ধারায় ধারায়
প্রাণ এনে দাও তপ্ত ধরায়,
বামে রাখ ভয়ংকরী
বন্যা মরণ-ঢালা।

যে আঁখিতে এত হাসি লুকানো

যে আঁখিতে এত হাসি লুকানো
কুলে কুলে তার কেন আঁখি ধার
যে মনের আছে এত মাধুরী
সে কেন চলেছে বয়ে ব্যথা ভার।।

দীপের শিখায় এত আলো যে
তবু কেন কাজলে সে কালো যে
একেলার ভালো লাগা কি আসে
কেঁদে কেঁদে হতে চাই দুজনার।

সাগর কখনো চেয়ে দেখেনা
বুকে তার কি রতন রয়েছে
কাঙালের মত তীরে তীরে সে
ফিরে ফিরে অবহেলা সয়েছে।
প্রেম যদি ভরে এত সুধা গো
তবু কেন হৃদয়ের ক্ষুধা গো
যে মেঘে রয়েছে এত মমতা
কেন তার বিদ্যুতে হাহাকার।

কণ্ঠঃ শ্রীকান্ত আচার্য্য।

আমি তোমার মাঝে পেলাম খুঁজে বাঁচার এ নিশানা

আমি তোমার মাঝে পেলাম খুঁজে বাঁচার এ নিশানা
তোমার আলোয় চোখ রেখেছি প্রাণের অভিধানে
নতুন চোখে পড়ে নিলাম এই জীবনের মানে ।।
আমি ঝড়ের মুখে শপথ পেয়ে সর্বনাশের
নতুন পাতা উল্টে গেলাম ইতিহাসের
আমি নতুন আকাশ খুঁজে পেলাম সূর্যের সন্ধানে ।।
ভালবাসার স্রোতে কখন নিভলো পরম তৃষা
পথ হারানো মনকে দিলাম পথে চলার দিশা
আমি অবিশ্বাসী এই পৃথিবীর বুকের মাঝে
শুনতে পেলাম অঙ্গীকারের কি সুর বাজে
আমি পৌঁছে দিলাম বাঁচার খবর বিস্মিত মোর প্রাণে ।।

গালি নিয়ে গলাগলি

গান এবং গালির মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য থাকলেও দুটোর মধ্যে এক চমৎকার মিল আছে। গান সবাই যেমন গাইতে পারে না তেমনি গালিও সবাই দিতে পারে না। গানে যেমন সুর তাল লয় আছে তেমন গালিতেও আছে।

আমার স্কুল জীবনের এক বন্ধু সুন্দর গালি দিতে পারতো আমরা তাঁর গালি শুনে খুব মজা পেতাম। গালিতে সে এমন কিছু শব্দ ব্যবহার করতো যা এখনো অন্য কারো মুখে শুনিনি। কাউকে গালি দিতে গিয়ে সে শুধু বাবা মায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতো না। তা বিস্তৃত হতো পুর্ব পুরুষ পর্যন্ত এমন কি জন্মের পর যিনি আজান দিয়েছিলেন উনার বাবা মাকেও নিয়ে আসতেন। এ তো গেল তাঁর গালির দিক তাঁর আরেকটি ভাল গুন ছিলো সে ভালো গানও করতে পারতো। সেই কতো কাল আগের কথা খুব মনে পড়ে।

গালির মধ্যে খুব কমন হচ্ছে “শালা”, “শালার পুত”, সম্বন্ধীর পুত”। আপাত দৃষ্টিতে গালি মনে হলেও আসলে তা গালি নয় এগুলো আমাদের আত্মীয়তার সম্পর্ক। সমস্যা হয় তখনি যখন অনাত্মীয় কাউকে এসবে সম্বোধন করা হয়।

কুকুর, বিড়াল, গাধা র বাচ্চাকে কুকুরের বাচ্চা, বিড়ালের বাচ্চা বা গাধার বাচ্চাই তো বলা হয়। মানুষের বাচ্চাকে কুকুরের বাচ্চা বা গাধার বাচ্চা বলা হলেই তা গালি হয়ে যায়।

যে সব পশুপাখিকে গালি দিতে ব্যবহার করি তাঁর মধ্যেও শ্রেণী ভেদ আছে। কাউকে “গাধার বাচ্চা” বললে খুব মন খারাপ করবেন সেই একই ব্যক্তিকে “বাঘের বাচ্চা” বলুন খুব খুশি হবে।

গালি দিতে আমরা পশু পাখি ছাড়াও দেশের নামও ব্যবহার করি। আমাদের ছোট বেলায় রাজনৈতিক দলগুলোর এক পক্ষ শ্লোগান দিতো “রুশ ভারতের দালালেরা সাবধান”। আবার অন্য পক্ষ বলতো “আমেরিকার দালালেরা সাবধান”। মনে হতো আমরা সবাই দালালের জাতি কেউ রুশের কেউ বা আমেরিকার !

আর যাই হোক পশুর নাম নিয়ে গালি দেওয়া ঠিক নয়। ওরা আমাদের মতো পরিবেশ বিপন্ন করে না। আমরাই ওদের নিরাপদ ভূমিতে প্রমোদ ভবন গড়ি। আমাদের মতো বৈধ অবৈধ পথে আগামীকালের জন্য সঞ্চয় করে না। ওরা দিনে আনে দিনে খায়। ওদের ইন্টারনেট মোবাইল বা পত্রিকা নেই তবু ওরা বিপদের আঁচ করতে পারে।

হুমায়ুন আহমেদের নাটকে পাখিকে গালি দিতে দেখেছিলাম “তুই রাজাকার”, একদিন পশু পাখিরা আমাদের গালি দেবে “মানুষের বাচ্চা” বলে। হতে পারে এখনো দিচ্ছে। আমরা তো ওদের ভাষা বুঝি না।

মাঝে মাঝে মনে হয় অনেক কিছু না বোঝাই ভালো। সব কিছু বুঝতে গেলে বা পাড়লে কষ্ট পেতে হয়। মানুষের সাথে পশুর পার্থক্য হচ্ছে ওরা আদর্শের জন্য মরতে পারে না আমরা পারি।

শেষের কবিতা

নিজের সম্পর্কে জানানোর জন্য ভর করলাম রবি ঠাকুরের উপর

অমিত রায় ব্যারিস্টার। ইংরেজি ছাঁদে রায় পদবী “রয়” ও “রে” রূপান্তর যখন ধারণ করলে তখন তার শ্রী গেল ঘুচে কিন্তু সংখ্যা হল বৃদ্ধি। এই কারণে, নামের অসামান্যতা কামনা করে অমিত এমন একটি বানান বানালে যাতে ইংরেজ বন্ধু ও বন্ধুনীদের মুখে তার উচ্চারণ দাঁড়িয়ে গেল– অমিট রায়ে।
অমিতর নেশাই হল স্টাইলে। কেবল সাহিত্য-বাছাই কাজে নয়, বেশে ভূষায় ব্যবহারে। ওর চেহারাতেই একটা বিশেষ ছাঁদ আছে। পাঁচজনের মধ্যে ও যে-কোনো একজন মাত্র নয়, ও হল একেবারে পঞ্চম। অন্যকে বাদ দিয়ে চোখে পড়ে।
ওর বোনেরা ওর যে অভ্যাসটা নিয়ে ভারি বিরক্ত সে হচ্ছে ওর উলটো কথা বলা। সজ্জনসভায় যা-কিছু সর্বজনের অনুমোদিত ও তার বিপরীত কিছু-একটা বলে বসবেই।

একদা কোন্‌-একজন রাষ্ট্রতাত্ত্বিক ডিমোক্রাসির গুণ বর্ণনা করছিল; ও বলে উঠল, “বিষ্ণু যখন সতীর মৃতদেহ খণ্ড খণ্ড করলেন তখন দেশ জুড়ে যেখানে-সেখানে তাঁর একশোর অধিক পীঠস্থান তৈরি হয়ে গেল। ডিমোক্রাসি আজ যেখানে-সেখানে যত টুকরো অ্যারিস্টক্রেসির পুজো বসিয়েছে; খুদে খুদে অ্যারিস্টক্রাটে পৃথিবী ছেয়ে গেল– কেউ পলিটিক্সে, কেউ সাহিত্যে, কেউ সমাজে। তাদের কারো গাম্ভীর্য নেই, কেননা তাদের নিজের ‘পরে বিশ্বাস নেই।”

একদা মেয়েদের ‘পরে পুরুষের আধিপত্যের অত্যাচার নিয়ে কোনো সমাজহিতৈষী অবলাবান্ধব নিন্দা করছিল পুরুষদের। অমিত মুখ থেকে সিগারেট নামিয়ে ফস করে বললে, “পুরুষ আধিপত্য ছেড়ে দিলেই মেয়ে আধিপত্য শুরু করবে। দুর্বলের আধিপত্য অতি ভয়ংকর।”

সভাস্থ অবলা ও অবলাবান্ধবেরা চটে উঠে বললে, “মানে কী হল।”

অমিত বললে, “যে পক্ষের দখলে শিকল আছে সে শিকল দিয়েই পাখিকে বাঁধে, অর্থাৎ জোর দিয়ে। শিকল নেই যার সে বাঁধে আফিম খাইয়ে, অর্থাৎ মায়া দিয়ে। শিকলওয়ালা বাঁধে বটে, কিন্তু ভোলায় না; আফিমওয়ালী বাঁধেও বটে, ভোলায়ও। মেয়েদের কৌটো আফিমে ভরা, প্রকৃতি-শয়তানী তার জোগান দেয়।”

একদিন ওদের বালিগঞ্জের এক সাহিত্যসভায় রবি ঠাকুরের কবিতা ছিল আলোচনার বিষয়। অমিতর জীবনে এই সে প্রথম সভাপতি হতে রাজি হয়েছিল;
একজন সেকেলেগোছের অতি ভালোমানুষ ছিল বক্তা। রবি ঠাকুরের কবিতা যে কবিতাই এইটে প্রমাণ করাই তার উদ্দেশ্য। দুই-একজন কলেজের অধ্যাপক ছাড়া অধিকাংশ সভ্যই স্বীকার করলে, প্রমাণটা একরকম সন্তোষজনক।

সভাপতি উঠে বললে, “কবিমাত্রের উচিত পাঁচ-বছর মেয়াদে কবিত্ব করা, পঁচিশ থেকে ত্রিশ পর্যন্ত। এ কথা বলব না যে, পরবর্তীদের কাছ থেকে আরো ভালো কিছু চাই, বলব অন্য কিছু চাই। ফজলি আম ফুরোলে বলব না, “আনো ফজলিতর আম।’ বলব, “নতুন বাজার থেকে বড়ো দেখে আতা নিয়ে এসো তো হে।’ ডাব-নারকেলের মেয়াদ অল্প, সে রসের মেয়াদ; ঝুনো নারকেলের মেয়াদ বেশি, সে শাঁসের মেয়াদ। কবিরা হল ক্ষণজীবী, ফিলজফরের বয়সের গাছপাথর নেই।… রবি ঠাকুরের বিরুদ্ধে সব চেয়ে বড়ো নালিশ এই যে, বুড়ো ওঅর্ড্‌স্‌ওঅর্থের নকল করে ভদ্রলোক অতি অন্যায়রকম বেঁচে আছে। যম বাতি নিবিয়ে দেবার জন্যে থেকে থেকে ফরাশ পাঠায়, তবু লোকটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েও চৌকির হাতা আঁকড়িয়ে থাকে। ও যদি মানে মানে নিজেই সরে না পড়ে, আমাদের কর্তব্য ওর সভা ছেড়ে দল বেঁধে উঠে আসা।
আমাদের মণিভূষণ চশমার ঝলক লাগিয়ে প্রশ্ন করলে, “সাহিত্য থেকে লয়ালটি উঠিয়ে দিতে চান?”

“একেবারেই। এখন থেকে কবি-প্রেসিডেণ্টের দ্রুতনিঃশেষিত যুগ। রবি ঠাকুর সম্বন্ধে আমার দ্বিতীয় বক্তব্য এই যে, তাঁর রচনারেখা তাঁরই হাতের অক্ষরের মতো– গোল বা তরঙ্গরেখা, গোলাপ বা নারীর মুখ বা চাঁদের ধরনে। ওটা প্রিমিটিভ; প্রকৃতির হাতের অক্ষরের মক্‌শো-করা। নতুন প্রেসিডেণ্টের কাছে চাই কড়া লাইনের, খাড়া লাইনের রচনা– তীরের মতো, বর্শার ফলার মতো, কাঁটার মতো। ফুলের মতো নয়, বিদ্যুতের রেখার মতো। ন্যুর৻ালজিয়ার ব্যথার মতো। খোঁচাওয়ালা কোণওয়ালা গথিক গির্জের ছাঁদে, মন্দিরের মণ্ডপের ছাঁদে নয়।

রবি ঠাকুরের ভক্ত আরক্তমুখে বলে উঠল, “ভালো জিনিস যত বেশি হয় ততই ভালো।”

অমিত বললে, “ঠিক তার উলটো। বিধাতার রাজ্যে ভালো জিনিস অল্প হয় বলেই তা ভালো, নইলে সে নিজেরই ভিড়ের ঠেলায় হয়ে যেত মাঝারি।… যে-সব কবি ষাট-সত্তর পর্যন্ত বাঁচতে একটুও লজ্জা করে না তারা নিজেকে শাস্তি দেয় নিজেকে সস্তা করে দিয়ে। শেষকালটায় অনুকরণের দল চারি দিকে ব্যূহ বেঁধে তাদেরকে মুখ ভ্যাংচাতে থাকে। তাদের লেখার চরিত্র বিগড়ে যায়, পূর্বের লেখা থেকে চুরি শুরু করে হয়ে পড়ে পূর্বের লেখার রিসীভস্‌ অফ স্টোল্‌ন্‌ প্রপার্টি।
সেদিনকার বক্তা বলে উঠল, “জানতে পারি কি, কাকে আপনি প্রেসিডেণ্ট করতে চান? তার নাম করুন।”

অমিত ফস্‌ করে বললে, “নিবারণ চক্রবর্তী।”

সভার নানা চৌকি থেকে বিস্মিত রব উঠল– “নিবারণ চক্রবর্তী? সে লোকটা কে।”

“আজকের দিনে এই-যে প্রশ্নের অঙ্কুর মাত্র, আগামী দিনে এর থেকে উত্তরের বনস্পতি জেগে উঠবে।”

“ইতিমধ্যে আমরা একটা নমুনা চাই।”

“তবে শুনুন।” বলে পকেট থেকে একটা সরু লম্বা ক্যাম্বিসে-বাঁধা খাতা বের করে তার থেকে পড়ে গেল–

আনিলাম
অপরিচিতের নাম
ধরণীতে,
পরিচিত জনতার সরণীতে।
আমি আগন্তুক,
আমি জনগণেশের প্রচণ্ড কৌতুক।
খোলো দ্বার,
বার্তা আনিয়াছি বিধাতার।
মহাকালেশ্বর
পাঠায়েছে দুর্লক্ষ্য অক্ষর,
বল্‌ দুঃসাহসী কে কে
মৃত্যু পণ রেখে
দিবি তার দুরূহ উত্তর।

শুনিবে না।
মূঢ়তার সেনা
করে পথরোধ।
ব্যর্থ ক্রোধ
হুংকারিয়া পড়ে বুকে,
তরঙ্গের নিষ্ফলতা
নিত্য যথা
মরে মাথা ঠুকে
শৈলতট-‘পরে
আত্মঘাতী দম্ভভরে।

পুষ্পমাল্য নাহি মোর, রিক্ত বক্ষতল,
নাহি বর্ম অঙ্গদ কুণ্ডল।
শূন্য এ ললাটপট্টে লিখা।
গূঢ় জয়টিকা।
ছিন্ন কন্থা দরিদ্রের বেশ।
করিব নিঃশেষ
তোমার ভাণ্ডার।
খোলো খোলো দ্বার।
অকস্মাৎ
বাড়ায়েছি হাত,
যা দিবার দাও অচিরাৎ।
বক্ষ তব কেঁপে উঠে, কম্পিত অর্গল,
পৃথ্বী টলমল।

ভয়ে আর্ত উঠিছে চীৎকারি
দিগন্ত বিদারি,
“ফিরে যা এখনি,
রে দুর্দান্ত দুরন্ত ভিখারি,
তোর কণ্ঠধ্বনি
ঘুরি ঘুরি
নিশীথনিদ্রার বক্ষে হানে তীব্র ছুরি।”

অস্ত্র আনো।
ঝঞ্ঝনিয়া আমার পঞ্জরে হানো।
মৃত্যুরে মারুক মৃত্যু, অক্ষয় এ প্রাণ
করি যাব দান।
শৃঙ্খল জড়াও তবে,
বাঁধো মোরে, খণ্ড খণ্ড হবে,
মুহূর্তে চকিতে,
মুক্তি তব আমারি মুক্তিতে।

শাস্ত্র আনো।
হানো মোরে, হানো।
পণ্ডিতে পণ্ডিতে
ঊর্ধ্বস্বরে চাহিব খণ্ডিতে
দিব্য বাণী।
জানি জানি
তর্কবাণ
হয়ে যাবে খান খান।
মুক্ত হবে জীর্ণ বাক্যে আচ্ছন্ন দু চোখ–
হেরিবে আলোক।

অগ্নি জ্বালো।
আজিকার যাহা ভালো
কল্য যদি হয় তাহা কালো,
যদি তাহা ভস্ম হয়
বিশ্বময়,
ভস্ম হোক।
দূর করো শোক।
মোর অগ্নিপরীক্ষায়
ধন্য হোক বিশ্বলোক অপূর্ব দীক্ষায়।

আমার দুর্বোধ বাণী
বিরুদ্ধ বুদ্ধির ‘পরে মুষ্টি হানি
করিবে তাহারে উচ্চকিত,
আতঙ্কিত।
উন্মাদ আমার ছন্দ
দিবে ধন্দ
শান্তিলুব্ধ মুমুক্ষুরে,
ভিক্ষাজীর্ণ বুভুক্ষুরে।
শিরে হস্ত হেনে
একে একে নিবে মেনে
ক্রোধে ক্ষোভে ভয়ে
লোকালয়ে
অপরিচিতের জয়,
অপরিচিতের পরিচয়–
যে অপরিচিত
বৈশাখের রুদ্র ঝড়ে বসুন্ধরা করে আন্দোলিত,
হানি বজ্রমুঠি
মেঘের কার্পণ্য টুটি
সংগোপন বর্ষণসঞ্চয়
ছিন্ন ক’রে মুক্ত করে সর্বজগন্ময়॥

নিশিদিন মোর পরানে প্রিয়তম মম

নিশিদিন মোর পরানে প্রিয়তম মম
কত-না বেদনা দিয়ে বারতা পাঠালে ॥
ভরিলে চিত্ত মম নিত্য তুমি প্রেমে প্রাণে গানে হায়
থাকি আড়ালে ॥

লিরিকঃরবীন্দ্র সঙ্গীত
কন্ঠঃ রুপা গাঙ্গুলী
রাগ: আশাবরী
তাল: ত্রিতাল
রচনাকাল (বঙ্গাব্দ): 1322
রচনাকাল (খৃষ্টাব্দ): 1916