সৌমিত্র চক্রবর্তী এর সকল পোস্ট

সৌমিত্র চক্রবর্তী সম্পর্কে

পরিচিতিঃ জন্ম বিহারের এক অখ্যাত বনাঞ্চলে বাবার চাকরীস্থলে। রসায়নে স্নাতকোত্তর এবং ম্যানেজমেন্ট পাশ করে কিছুদিন সাংবাদিকতা। বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকারী উচ্চপদস্থ কর্মচারী। একাধারে নাট্যকার, কবি এবং গল্পকার। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, পুস্তক পর্যালোচনা, বিভিন্ন ধরনের লেখা ছড়িয়ে আছে দেশ বিদেশের অসংখ্য পত্র পত্রিকায় ও সংবাদপত্রে। উৎপল দত্ত সহ বহু বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্বের কাছে শিখেছেন থিয়েটার। বহু বিচিত্র ও ব্যাপ্ত ময় তাঁর জীবন। বন, জঙ্গল, পশু, পাখি, বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সাথে তাঁর দীর্ঘকালের নিবিড় ও অন্তরঙ্গ পরিচয়। কবিতা ও বিভিন্ন লেখা লেখিতে তিনি মস্তিস্কের থেকে হৃদয়ের ভুমিকাকে বড় করে দেখেন। কবিতা, গল্প, নাটক এবং মুক্তগদ্য মিলিয়ে এ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা নয়। প্রকাশিত গ্রন্থগুলি হলো বইছে লু, থিয়েটার কথা, তিতলিঝোরা, নীলপাখিকে উড়ো চিঠি, রাত্রি আমার নৈশপ্রিয়া, ব্রিজের নীচে বৃষ্টি, ২ একাঙ্ক, প্রতিলিপি এবং বেবুশ্যে চাঁদ, খণ্ড ক্যানভাস। ইতিপূর্বে অঙ্গন সহ কয়েকটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। বর্তমানে অক্ষর বৃত্ত পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। নেশা ফটোগ্রাফি ও ভ্রমণ।

টুক্কি ফুক্কি ছুঃ

3yy

ঘোরাল পথে
বোড়াল গেলাম
বেড়াল কেমন
জানতে।
মেট্রো দিল
পেট্রো ডলার
নীল বিল্লি
আনতে।

জম্মো কেমন
ধম্মো কেমন
গন্ধ কেমন
বোটকা?
শপিং মলে
কিম্বা স্টলে?
অর্ডার পেয়েই
খটকা।

বিল্লি পেতে
দিল্লি যেতে
তিন্দিন তিন্রাত
পার।
পালাম থেকে
কালাম হেঁকে
জাহাজ ওড়ে
মক্কার।

তন্নতন্ন
অবসন্ন
সৌদি আমির
তুর্কি।
ইরান ইরাক
ব্যারাক শিরাক
হেগ বার্লিন
চর্কি।

কোথায় বিল্লি
চিল্লাচিল্লি
ছায়াও যে নেই
অল্প।
অবাক ধোঁকা
বেবাক বোকা
বিল্লি নীলার
গল্প।

হ্যারি পটার
সরিয়ে গিটার
বেড়াল আবার
হয় নীল!
থ্রিডি ভিশন
অ্যানিমেশন
স্রাগ কল্লো গেটস
বিল।

অ্যাঞ্জোলিনা
ক্যাটরিনা
এককাট্টা সব
স্টার।
নীল নয়না
দিল চুরানা
আমরা বিল্লি
পরদ্বার।

জলও শেষ
স্থলও শেষ
আকাশ হলো
অন্ত।
ঘাড় লটপট
ব্রেন খটখট
ছিরকুটে যায়
দন্ত।

সফর শেষ
ফিরছি দেশ
চমকে দেখি
গাড়িতে –
বিল্লি ব্যাকে
মুচকি দ্যাখে
জড়ানো নীল
শাড়িতে।

কেমন আছি

কেমন ছিলাম? কে জানে! চক্ষুহীন-আত্মমগ্ন,
হঠাৎ কিসের ছোঁয়া এসে জাগিয়ে তোলে
কে জানে!

যেমন ছিলাম, এদিক ওদিক, আকাশ পাতাল, ধানের গাছ, সূর্যাস্ত সূর্যোদয়,
গভীর অতল জলের মাছ।যেমন ছিলাম-তেমন ছিলাম,
সুরকি পথের ছোট্টো নুড়ি, পায়ের ঘায়ে জগৎ চেনা,
হরিণ-বাঘ-পুকুর ঘাট, চরকা কাটা চাঁদের বুড়ি।
কেমন ছিলাম? ভাল ছিলাম?
কে জানে!

হঠাৎ কিসের ছোঁয়া লেগে…
কিছু ছবি-একটু গান, হাল্কা কথা ভারী কথা, সংস্কারের আঁতুরকথা-
কোথায় যেন নাড়ীর টান। কিসে যেন সময় কাটে, ঘুনপোকাতে?
পাইনা টের
সময় গুলো কোথায় যে যায়! কোন চুলোতে,
কোন মেলাতে! গল্প শিখি
রাত বেলাতে নিজের মাঝে ডুব দিয়ে।
কেমন ছিলাম! দূর ছাই
সব, যেমন ছিলাম-তেমন ছিলাম।

হঠাৎ কিসের…
দেখতে হবে কেমন আছি, বয়স যেন পর্ণমোচী, পাতার নিচে
পাতার ভ্রুণ, রঙের গায়ে রঙ লাগে। আমি আছি-
আমিও আছি, আছি-আছি-থাকব বলে। এখন আছি, ভাল আছি।
ভাল আছি…! সত্যি আছি!
ভালো আছি? কে জানে…!

মশা ঘনুবাবু ও ছটা বিয়াল্লিশ

চটাস করে এক চড় নিজেরই ডান পায়ের গুলফের ওপর কষালেন ঘনুবাবু। চলন্ত ট্রেনে যে এত মশা কি করে থাকে! আশ্চর্য! হালকা সাদা আলোয় হাতটা চোখের সামনে তুলে এনে দেখলেন নাহ মরেনি ব্যাটা। মশা মারায় ঘনু একেবারেই অপদার্থ। গিন্নীও হামেশাই বলেন সেকথা। অবশ্য এই একটাই কথা বলেন না। বলতে গেলে সারাদিনই অসহ্য নাকচাবি পরা বোয়াল মাছের মত জাবদা মুখখানা চলছে তো চলছেই। সেই সাতসকালে শুরু হয়ে এই কথার চর্বিতচর্বণ চলতেই থাকে অবিরাম। তাকে থামায় কার বাপের সাধ্যি। আর সব কথার সার হল, ঘনুবাবু অতি অকর্মণ্য। ভাগ্যিস বহু তপস্যা করে তাঁর মত একপিস বউ পেয়েছিলেন তাই বর্তে গেছেন। নইলে যে ঘনুর কি হতো, ভাবলেও তিনি শিউরে ওঠেন। পাড়ার আর পাঁচটা বউকে দেখুক ঘনু, তাহলেই বুঝবে সে কি রত্ন পেয়েছে। শুধু পাড়ার বউদেরই নয়, তার সাথে নিজের অকালকুষ্মান্ড পরিবারের অন্য মেয়ে বউ দেরও দেখুক। তাহলেই হাড়ে হাড়ে বুঝবে তার নিজের বউ কত্তো গুনী। এটসেট্রা…এটসেট্রা…

পাড়ার বউদের যে দেখেন না ঘনু, তা নয়। বরং কাছেপিঠে বউ নেই দেখলেই বেশ ভালো করেই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেন। চব্ব্যচোষ্য করেই চেটেপুটে দেখেন। আর শুধু দেখাই নয়, অনেককিছু কল্পনাও করেন। মাঝেমধ্যে অবশ্য বউএর অবস্থানটা দেখে নিতে হয়। এখন এই মাঝবয়সে পাড়া কেন দুনিয়ার তাবৎ অন্যলোকের বউ কেই দেখার কি যে সুখ! আহা! চলতি ট্রেনেই মুচকি হাসি ভেসে ওঠে তাঁর দুঠোঁটের মাঝে। পাশের লোকটার এক ঠেলা খেয়ে একটু কাত হয়ে পড়তেই সংবিত ফিরে এল তাঁর।

-“আস্তে রে ভাই! আস্তে আস্তে”।
এই ছটা বিয়াল্লিশের লক্ষীকান্তপুর লোকালের আশি পার্সেন্ট প্যাসেঞ্জারই ডেইলি। তাই মোটামুটি সবাইই মুখ চেনা। বীভৎস ভীড় হয় এসময়টায়। শেয়ালদা থেকে ছাড়ার সময়েই ভীড় কামরা ছাড়িয়ে রড ধরে ঝুলতে থাকে। সবই ছোটখাট চাকরীজীবী কিম্বা হকার, ছোট দোকানদার। সারাদিনের পেটের বন্দোবস্ত করে ফিরে চললো নিজের গ্রামের বাড়ীতে। এই ভীড় ঠেলে ওঠা বা নামা দুইই বেশ কসরতের কাজ। বছরের পর বছর রীতিমত ঠোক্কর খেয়ে তাঁকে শিখতে হয়েছে ওঠা-নামা- দাঁড়িয়ে থাকার কায়দা কানুন। যদিও খুব বেশিদূর যাতায়াত নয় তাঁর। শেয়ালদা থেকে মাত্র খান চারেক স্টপেজ পরেই বাঘাযতীন। বাসেও যেতে পারেন, কিন্তু সিগন্যালে ঠেক খেতে খেতে বাসের প্রায় ঘন্টা দেড়েক লাগে। তাছাড়া শেয়ালদা থেকে এদিকের বাস পাওয়াও সমস্যা। অনেকক্ষণ দাঁড়ালে তবে একটা ভীড়ঠাসা বাস আসে। অনেক ভেবেচিন্তে এই ট্রেনলাইনই বেছে নিয়েছেন তিনি। হোক ভীড় তবু মিনিট পনেরোর মধ্যেই পৌঁছে যাওয়া যায়। আর বছর সাতেক চাকরী আছে। চালিয়ে নেবেন এভাবেই। একটা স্টেশন এল। উঁকি মেরে দেখলেন পার্কসার্কাস।

-“দাদারা, বোনেরা, মিস্টার এন্ড মিসেসেরা, এই চলন্ত ট্রেনে অনেক হকারই আপনাদের কাছে আসে। রোজই তাদের দেখেন। অনেকেই খুব পরিচিত হয়ে গেছে আপনাদের”।

এই ঠাসা ভীড়ের মধ্যে কিভাবে যে এই হকাররা যায়, সেটা একটা ম্যাজিক। শুধু যাতায়াত করাই নয়, কাউকে বিরক্ত না করেই দিব্যি নিজের প্রোডাক্ট নিয়ে বকবক করে গছিয়ে টাকা পয়সা নিয়ে চলেও যায় ফের। আর কি না বিক্রী করে ওরা! সেফটিপিন থেকে জলের বোতল, গামছা থেকে ডাব। ভাবা যায় না। ওই ভারী জিনিসগুলো বয়ে অনায়াসে এ কামরা সে কামরা করে বেড়ায় ওরা। ঠিকই বলেছে এই নতুন হকার, বহু হকারই ডেলি প্যাসেঞ্জারদের পরিচিত হয়ে গেছে।

একটু স্বস্তি পেয়ে, ভালো করে হকারের দিকে তাকালেন ঘনুবাবু। বাপরে! এই লোকালে রীতিমত সাদা শার্ট, প্যান্ট, টাই পরে সেজেগুজে উঠেছে লোকটা। টাই দেখলেই ঘনুবাবু বেশ সম্ভ্রমের চোখে তাকান। তিনি জীবনে কখনো ওই জিনিসটা ছুঁয়েও দেখেন নি। আসলে টাই এর কোনো দরকারই পরেনি তাঁর। টাই বাঁধতে গেলে যে জিনিস টা দরকার, সেই স্যুটও নেই তাঁর। থাকতোও যদি তাহলেও ওই অফিস-বাড়ী-বাজারের পরিক্রমায় তিনি কিছুতেই সেটা পরতেন না প্যাঁক খাবার জন্যে। অথচ এই হকার তো দিব্যি পুরোদস্তুর অফিসার মার্কা চেহারা আর সাজগোজ নিয়েও চলে এসেছে। এঁকে তো আগে কোনোদিন দেখেননি তিনি। অন্য ডেইলিদের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলেন তারাও কেমন হাঁ করে তাকিয়ে রয়েছে ওই হকারের দিকে।

এ নিশ্চয়ই খুব শিক্ষিত কেউ। অবস্থার চাপে পড়ে আজ হকারি করতে এসেছে। মনে মনে ভাবলেন ঘনু। এবার মন দিলেন ওর কথায়।

-“ দাদারা- বৌদিরা! আপনারা রোজই হরেক সমস্যায় বিব্রত। সারাদিন হাড়ভাঙা খটুনির পরে সন্ধেয় বাড়ী ফিরে চলেছেন একটু শান্তির আশায়। নিঝুম সন্ধ্যায় ক্লান্ত পাখীরা কুলায় ফিরছে সারাদিনের শেষ হয়ে যাওয়া এনার্জি লেভেল বাড়ীর শান্তিতে একটু ঘুমিয়ে বাড়িয়ে নিয়ে আগামীকাল ফের ঝাঁপিয়ে পড়বেন জীবন যুদ্ধে।

কিন্তু ভাবুন তো দাদারা-বৌদিরা, বাড়ী ফিরে সেখানে শান্তি পাবেন কি? বাড়ীতে ঢুকে হাত মুখ ধুয়ে যেই একটু বিশ্রামের জন্যে জলখাবারের প্লেট হাতে মাদুরে কিম্বা চেয়ারে কিম্বা টুলে কিম্বা বিছানায় বসবেন, ওমনি প্যাঁক… ইয়াব্বড় ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জ হাতে আপনার জন্যে অপেক্ষা করছে কয়েক লক্ষ মশা। কোথায় পালাবেন? রান্নাঘরে- মশা, বাথরুমে- মশা, ক্লাবে- মশা, রাত্তিরে বিছানায় থইথই করছে মশাবাহিনী। আর কি না রোগ বয়ে আপনার শরীরে ঢুকিয়ে দিতে ওঁত পেতে বসে আছে ওরা। ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, এনকেফেলাইটিস, এনসেফেলাইটিস, ফাইলেরিয়া আরো কত হাজার রোগ। একটা মশা কামড়ানো মানে আপনার কাজ বন্ধ, ডাক্তারের কাছে বা হাসপাতালে ছোটাছুটি। টাকার শ্রাদ্ধ”।

এত রোগের ফিরিস্তি শুনে যেন ঘনুর শরীর টা খারাপ লাগতে শুরু করলো। আজ সকালেই বাজারে শুনে এসেছেন আজাদগড়ে একজন ডেঙ্গুতে মারা গেছে। ডেঙ্গু না কি ডেঙ্গি তাও জানেন না তিনি। কেমন জঙ্গি জঙ্গি মনে হয় শব্দটা। ডেঙ্গু হলে কি করে লোকে মরে যায় পটাস করে তাও তাঁর অজানা। কিন্তু শব্দটা শুনলেই গায়ে কাঁটা দেয়।

-“আপনারা এতদিন বহু কোম্পানির অনেক নামী দামী প্রোডাক্ট ব্যবহার করেছেন। কিন্তু একবারও ভেবেছেন কি, সেইসব কয়েল বা লিকুইড বা ম্যাটের সাইড এফেক্ট কি? জানেন কি এগুলো দিনের পর দিন ব্যবহার করলে হাঁপানি, চর্মরোগ, এমন কি ক্যান্সারও হতে পারে!”

ঘনুর অবস্থা এখন রীতিমত করুণ। ক্যান্সার! ওরেবাবা! অফিসের এক পিওন সদ্য পটল তুললো ওই রোগে। শুনেছেন ভয়ংকর যন্ত্রণা পেয়ে দগ্ধে দগ্ধে মরতে হয়। গরমে নাকি ভীড়ের চাপেই দরদর করে ঘামতে থাকেন ঘনু।

-“ আমি আজ আপনাদের কাছে হকারি করে জিনিস বিক্রী করতে আসিনি দাদারা-বৌদিরা। আমি এসেছি বিখ্যাত বিজ্ঞানী নিধিরাম নস্করের তৈরী এক অনবদ্য ওষুধ এই প্রথম পরীক্ষামূলক ভাবে আপনাদের কাছে পৌঁছে দিতে। কিছুদিনের মধ্যেই পেটেন্ট এসে যাচ্ছে। এরমধ্যেই হামলে পড়েছে দেশ বিদেশের বড় বড় নামী দামী কোম্পানী। ওদের হাতে এর স্বত্ত্ব চলে গেলেই আকাশছোঁয়া দামে বিক্রী করে বিপুল লাভ করবে ওরা”।
পেটেন্ট টা কি ব্যাপার! কাল অফিসে জানতে হবে অম্লানের কাছে। ভাবলেন ঘনু।

-“এই জগতবিখ্যাত ওষুধের কোনো সাইড এফেক্ট নেই। একটা ওষুধ সুতোয় বেঁধে ঘরে ঝুলিয়ে দিলেই মশারা পিলপিল করে পাড়া ছেড়ে পগাড়পার। কোনো রোগ নেই, কোনো অস্বস্তি নেই, আর দামও আপনার হাতের নাগালেই”।

-“পরে এই ওষুধের কি দাম হবে জানিনা। কিন্তু এখন প্রথম আমার দেশকে প্রনাম জানাতে বিজ্ঞানী নস্কর এই ওষুধের দাম রেখেছেন প্যাকেট প্রতি মাত্র পাঁচ টাকা – পাঁচ টাকা – পাঁচ টাকা। প্রায় জলের দরে কিম্বা ফ্রী বলতে পারেন। আর শুধুমাত্র আপনাদের জন্যেই আছে একটা স্পেশাল অফার। তিনটে একসাথে যেকোন বড় দোকানে পরে কিনতে গেলে আপনার পড়বে প্রায় একশো টাকা। কিন্তু আপনাদের জন্যে, শুধুই আপনাদের জন্যে আজ একসাথে এই তিন প্যাকেট নিলে দাম পড়বে মাত্র দশ টাকা – দশ টাকা – দশ টাকা। আমার কাছে আজ বেশি প্যাকেট নেই। পরীক্ষামূলকভাবে মাত্র কয়েক পিস এনেছি। যদি কারো দরকার লাগে তাহলে দয়া করে হাত বাড়ান”।

দেখতে দেখতে লোকটার ব্যাগ খালি হয়ে গেল। ঘনু শুধু নেবার সময় আস্তে জিজ্ঞেস করেছিলেন-“দাদা কাজ হবে তো?” লোকটা ভুবনমোহন হাসি হেসে বললে-“ বহু টাকাই তো জলে যায় দাদা, এটা একবার ব্যবহার করে দেখুন। তারপরে আবার আমাকে খুঁজে বেড়াবেন”। বেশ গর্বিত হাসি হেসে ঘনু প্যাকেট তিনটে তাঁর ছেঁড়া রঙচটা ক্যাম্বিস ব্যাগে ঢোকালেন।

#
অন্যদিন মশা তাঁকে খোঁজে, আজ বিছানায় বসে তিনি মশা খুঁজছেন। এখনো পর্যন্ত দেখতে পাননি। সদ্য রাতের বরাদ্দ রুটি আর আলু বিহীন পেঁপের তরকারি খেয়ে বিছানায় বসে মেজাজে একটা বিড়ি ধরিয়েছেন। গিন্নী এখন রান্নাঘরে ব্যস্ত থালাবাসন ধোবার কাজে। রাতের বাসন ধুয়ে না রাখলে সকালে ফের রান্না করতে অসুবিধা হয় তাঁর। সন্ধেয় বাড়ীতে ফিরে বেশ মেজাজে ব্যাগ থেকে প্যাকেট তিনটে বার করে তার গুণাগুণ বোঝাতে শুরু করেছেন, অমনি এক ঝামটা দিয়ে তাঁকে থামিয়ে দিয়েছিলেন গিন্নী।

-“দয়া করে ওসব কেরামতি না দেখিয়ে এখন হাত মুখ ধুয়ে খেয়ে আমাকে উদ্ধার কর। আবার রাতের রান্না আছে”।

বেজার মুখে পড়তে বসে উৎসুক তাকিয়ে থাকা মেয়েকেই চুপিচুপি বুঝিয়ে উঠে পড়েছিলেন ঘনু। গিন্নীর যে তাঁর ওপর এতটুকু আস্থা কেন নেই কে জানে!

মেয়ে আগেই পাশের ঘরে শুয়ে পড়েছে। কাল ওর ক্লাসটেস্ট আছে। তিনটে প্যাকেট ওই খুলে সুতো দিয়ে টাঙিয়েছিল খেতে যাবার আগে। হাসি হাসি মুখে বেশ প্রশ্রয়ের ভঙ্গীতেই দেখছিলেন ঘনু। গিন্নী এলেন হাতের কাজ চুকিয়ে।

-“কি গো মশারী না টাঙিয়েই শুয়ে পড়েছ যে? বাঘাযতীনের বাঘা মশা কি তোমাকে ছেড়ে দেবে ওই পুরিয়াগুলো দেখে?”
-“হে হে, দেখ, এখনো পর্যন্ত একটাও মশা নেই”।
আর কথা না বাড়িয়ে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়েছিলেন ঘনুজায়া।

এপাশ ওপাশ করতে করতে সবে ঘুম আসছিল, তখন মনে হল পায়ে একটা কিছু কামড়ালো। পা টা চুলকে নিলেন ঘনু। মনের ভুল হয়তো। ভাবতে না ভাবতেই চারদিক থেকে সাঁড়াশী আক্রমন। এদিকে কামড়ায়, ওদিকে কামড়ায়। উঠে আলো জ্বালাতেই দেখেন গৃহিণী আগেই উঠে বিছানায় বসে আছেন।

-“রইলো তোমার এই পাগলের সংসার। কাল সকালে উঠেই আমি বাপের বাড়ী চলে যাব। আর সহ্য হচ্ছে না। থাক তুমি এ ঘরে তোমার পুরিয়া আর মশাদের নিয়ে, আমি মেয়ের ঘরে চললাম”।

রেগে গজগজ করতে করতে পাশের ঘরে চলে গেলেন তিনি।
আলোয় ঘরটা দেখে ঘনুর চোখ কপালে। গিজগিজ করছে মশা। ঘরের মশা বাইরে যাওয়া তো দূরের কথা, মনে হচ্ছে বাইরের যত মশা ঘরের মধ্যে চলে এসেছে। উঠে পাশের ঘরে উঁকি দিলেন তিনি। অন্ধকারে আবছা আলোয় দেখলেন মেয়ে আগেই মশারী টাঙিয়ে নিয়েছে। ভীষণ রেগে ঘরে ফিরে এলেন ঘনু। একটানে সুতো ছিঁড়ে নামিয়ে আনলেন প্যাকেট টা। আজ হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বেন তিনি। দেখবেন কি মহামহৌষধ আছে ওতে।
প্যাকেট মানে ফুটো ফুটো প্লাস্টিকে মোড়া একটা পুরিয়া। সেটা ছিঁড়তেই ভেতরে আরেকটা কাগজের পুরিয়া। সেটা খুলতে বেরোল আরেকটা ছোট কাগজের পুরিয়া। উত্তরোত্তর রাগ বাড়ছে। এটাও খুললেন ঘনু। ভেতরে মোড়া একটা সাদা কাগজ। তাতে লেখা-

“মশারী টাঙান। এর কোনো সাইড এফেক্ট নেই।– ইতি বিজ্ঞানী নিধিরাম নস্কর”।

মধ্যরাত্রির কথা

মাঝে মাঝে কথা বলতে হয়। এমনিতে আমি খুব বেশী কথা বলতে পারি না। কেউ ফোন করলে তিনিই কথা বলেন, আমি সঙ্গত করে যাই। কথা বলার ভয়ে খুব ঘনিষ্ঠ কেউ না ডাকলে কবি সাহিত্যিকদের সম্মেলনে যাই না। ফেনিয়ে ফেনিয়ে প্রচুর কথা বলা তো দূরের কথা, দু একটা কথার পরে কী বলব খুঁজে পাই না। বন্ধুদের আড্ডায় হাসি আর একটু আধটু ফোড়ন দিয়ে চালিয়ে নিই।

কিন্তু কথা বলতে হয় মাঝেমধ্যে। নিজের সঙ্গে, সঙ্গোপনে, মাঝ রাত্তিরে কথার খই ফোটে। সবটুকুই মনে মনে। একটা শব্দও বাইরে আওয়াজ হয়ে বেরিয়ে আসে না। নিজের মনে, নিজের সঙ্গে কথা বলায় আমি খুব স্বতঃস্ফূর্ত। কিন্তু আশ্চর্য জানালার বাইরে কালোর নানারকম প্রজাতির রাত্রি আমার সব কথা বোঝে। হঠাৎ হাওয়ায় ঝোঁক বুঝতে পারে কী বলছি। ওরাও উত্তর দেয়, আমি শুনি। আমি বলি, ওরা শোনে। গাছের ঘুমন্ত ডালে, কোটরে মাঝঘুমে ডুবে থাকা পাখিরা, ছোট ছোট আনুবীক্ষণিক পোকামাকড়ের দল, গাছের পাতা, শেকড়ের দল ঘুমের মধ্যেই এক কান খাড়া করে শুনে নেয় আমার কথা। ওরা বলে না কিছু, তরঙ্গ পাঠায় আমার ষষ্ঠেন্দ্রিয়ে।

সেইসব কথা চলতে চলতে কখনো বিষাদমালা, কখনো উদ্দাম রক। কথারা কথা থাকে কথার দাগে। আমি শুনতে পাই আগাছার প্রশ্বাস। কুঁড়িদের কচি গলা। আগামীকাল ঝরে পড়ার জন্য তৈরী হতে থাকা হলুদ পাতার শেষ ইচ্ছা। কথা চলে, রাত বৃদ্ধ হয়। মনে মনে আমি লিখতে থাকি আমার শেষ ইচ্ছার উইল।

কেমন আছি

index

আমি কেমন আছি ভাবতে গেলেই
চারপাশ গুলিয়ে যায়
ছোট ছোট তারা চোখের সামনে
নাচতে নাচতে বুদবুদ হয়।

কাগজ কল থেকে ছাঁটাই হওয়া দাদু
কবেই মরে ভুত হয়েছে
ধুঁকতে ধুঁকতে মরে গেছে
জুট মিল থেকে ছাঁটাই জ্যাঠা।

বিএসসি পাশ দাদা এখন সাইকেলে
রোজ কয়লা পাচার করে, সন্ধ্যেয়
চুল্লুর ঠেকে কাটিয়ে রাস্তার ধারেই
শুয়ে পড়ে রাতের তারা গোনে।

দাদার প্রেম করা বউ
এক সময়ে খুব রূপসী ছিল, আজও
জেল্লার টানে দাদার বন্ধুরা আসে, তারাই
দেখে বৌদিকে, বিরিয়ানির গন্ধে ম ম করে ওদের আকাশ।

আমি চুল্লু খেতে পারিনা, সকাল বিকেল
হরিদার চায়ের দোকান, ধারে এক ভাঁড়
ভয়ঙ্কর মিষ্টি চা, কখনো শস্তার মোবাইলে
ফেসবুকের মায়া জগৎ, বছরে একবার টেট।

স্পঞ্জ আয়রন থেকে ছাঁটাই বাবা লক্ষ
টাকা চোখে দেখেনি কোনোদিন
আমি চাকরির পরীক্ষা দিই দিতে হবে বলে
লক্ষ্মীভাণ্ডারের পাঁচশ টাকা হাত পেতে নিই।

কেমন আছি জিজ্ঞেস করলেই
গোল বৃত্তাকার ধূসর ঝালর নেমে আসে
আমার চারপাশে, আস্তে আস্তে ফেড হয়ে কালো
আমিও একসময় মিলিয়ে যাই কালোর অতলে।

রায়

প্রোমোটারের যে মাফিয়াটি মন্ত্রীর ছাতার তলায় ছিল
তাকে মৃত্যুদণ্ড দিলাম,
অভাবী সংসারের যে মেয়েটি ধার করে টাকা দিয়েছিল
মন্ত্রীর শাগরেদদের, সেই মন্ত্রীকে মৃত্যুদণ্ড দিলাম,
চাল নেই বলে যে বউটি মন্ত্রীর চামুণ্ডের রুগ্ন শিস্ন দ্বারা ধর্ষিত হয়েছিল
সেই মন্ত্রীকে মৃত্যুদণ্ড দিলাম,
আমার রাষ্ট্রের, আমার রাজ্যের প্রতি সেকেন্ডে যারা রক্ত শুষে নিচ্ছে
তাদের মৃত্যুদণ্ড দিলাম,
আমিই ভোটার, আমিই ধর্মাবতার, কলমের নিব ভেঙে আদর করলাম আমার দেশকে।

অস্থায়ী রঙ্গমঞ্চ

3175

যারা ভালবাসে তারা থাকে না
একে একে যাত্রীবাহী বাস আসে
একে একে হাত নেড়ে উঠে যায়
নির্মোহী আত্মজনেরা
যারা স্নেহ দেয়, তারা থাকে না কিছুতেই।

নির্দিষ্ট সময় এলেই
রঙ্গমঞ্চ ঘুরে যায়
রোদ বৃষ্টি মেঘ ছায়া অতিক্রম করে
বাজ পড়ে বোধন সময়ে
প্রবেশ ও প্রস্থান কান্না শোনে না।

কত রঙ, কত হাসি, কত আদানপ্রদান
হিসাবের খাতায় ক্লোজিং ব্যালান্স
মস্ত গোল এক শূন্য এঁকে যায়
প্রিয় মুখ প্রস্থান করলে
মঞ্চ গুটিয়ে অন্যত্র গামী হয় যাযাবর দল।

.
(কবি প্রণব বসুরায় স্মরণে)

এক জীবনে

ehy

এক জীবনে অনেক চাওয়া পেয়ে ওঠা যায় না
এদিক টেনে ওদিক খোলে লাথখোর যাপন, উড়ে যাওয়া ময়না

মনখারাপি রঙ বাদুড় কিম্বা কল্পনা
শ্মশানে আলেঢালে দুই পাখা স্বল্প না

জুলপি আর গোঁফের খাঁজে রূপোর নক্সী আলপনা
ক্লাসবেঞ্চে জীবন লক্ষ্য এখন অলীক জল্পনা

আঁকার খাতায় নদী – মেয়ে -পাহাড় – সূর্য মনটানা
উড়তে গিয়ে পঙ্খ কেটে ফিনিক্স এখন গল্প না

আগের অনেক কিছুই এখন ভাল্লাগে না ভাল্লাগে না
মিলিমিটারের এক জীবনে কিছুই করা যায় না

এখন তখন

IMG-20 এখন আর রেডিও লাগে না। হাতের মোবাইলে প্লে স্টোরে লাখ লাখ অ্যাপস্ এর মধ্যে প্রচুর পারফেক্ট বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ইয়া দেবী সর্বভূতেষু করেই চলেছেন বছরের যে কোনো সময়ে।

আগে লোকেরা বেশী রাত্রি পর্যন্ত জাগতো না। এন্টারটেইনমেন্ট এর গণ্ডী ছিল সীমাবদ্ধ। হলে সিনেমা, রেডিওতে নাটক বা ছায়াছবির আসর কিম্বা বিনাকা গীত মালা আর খবর। ব্যস্। দশটা, সাড়ে দশটা, বড়জোর এগারটার পরে উঁচু ক্লাসের কয়েকজন পড়ুয়া বাদে সবাই ঘুমের দেশে চলে যেত। যে যত তাড়াতাড়ি ঘুমোত সে তত তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে উঠে পড়ত।

এখন সে সবের বালাই নেই। পাঁচ থেকে পঁচানব্বই রাত্রি দুটো, তিনটে অবধি ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ, টুইটার, ইউ টিউব, অনলাইন শপিং বোঁ বোঁ করে ঘুরেই চলেছে। হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া কেউই রাত বারোটার বর্ডারের এপারে বিছানার দিকে তাকায় না। ফলে ভোর চারটেয় ঘুম থেকে উঠে মহালয়া শোনার গল্প এখন মিথ।

হরেকরকম অসুবিধা এখন নেই হয়ে গেছে মাইক্রো চিপসের কল্যাণে। রেডিও সারানোর জন্যে মিস্ত্রির দরজায় ধর্ণা দেওয়া নেই। আকাশছোঁয়া দাম দিয়ে চার কিম্বা ছয় ব্যাটারি কেনার হৃদয় বিদারক ধাক্কা নেই।

ইলেকট্রিক্যাল কানেকশনের মাঝপথে নেই হয়ে গিয়ে জিভের তোড়ে ইলেকট্রিক দপ্তরের শ্রাদ্ধ শান্তির সম্ভাবনা নেই। মহালয়া শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লে হাহুতাশ করতে করতে আরও এক বছর অপেক্ষা করা নেই। চ্যানেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পারফেক্ট আওয়াজ বার করে আনার যুদ্ধ নেই। মহালয়া থেকেই পূজোর দিন গোনার দিনও ফুরিয়ে আসছে দ্রুত। মফস্বলে এখনো ততটা নয়, বিশেষ করে বড় যান্ত্রিক শহরে মহালয়ার দিনই বড় পূজোর উদ্বোধন হয়ে রাস্তায় নেমে পড়ছে হুজুগে পাবলিক, তাই সেখানে পূজোর দিন গোনার মিষ্টি আনন্দ নেই।

সত্যিই অসুবিধা গুলো প্রায় নেই বললেই চলে। আর এতসব নেই এর ধাক্কায় আনন্দটাও কখন পেছনের দরজা খুলে নেই হয়ে গেছে, সেটা কেউই জানতে পারে নি।

ধর্মাধর্ম

30 একটা বিশাল প্রাসাদ ছিল। কী ছিল না সেখানে! বড় বড় হলঘরের মত শোবার ঘরই যে কতগুলো, তার হিসাব রাখতে রীতিমতো মোটা মোটা জাবদা খাতা লাগত। ছিল চকমিলান বারান্দা, বিস্তৃত খোলা আকাশ মাথায় উঠান, জাঁকজমক ওয়ালা ঝকমকে জলসাঘর, অজানা প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রার্থনার ঘর। ছিল, অনেক কিছুই ছিল। ছিল না শুধু স্বার্থপর আমার আমি। কখন যে চুপিসারে লোভের ময়াল ঢুকে পড়ল সেই প্রাসাদের অন্দরমহলে কেউ বুঝতে পারেনি।

একে একে আমাদের প্রত্যেককে গিলে ফেলতে শুরু করল সেই সাপ, সেই খাওয়া এখনো চলছে। ময়ালের পেটের ভেতরে গিয়ে আমরা ভাগ করা শিখলাম। টুকরো করতে শুরু করলাম আমাদের খাবার জায়গা, শোবার জায়গা, খেলার জায়গা, গল্প করার আর শোনার জায়গা, আদর করার জায়গা। আমাদের সবার প্রার্থনার জায়গা ভেঙে ছত্রখান হয়ে ছোট ছোট খুপরি হয়ে গেল। সেই খুপরিতে কোনক্রমে হাঁটু মুড়ে বসে আমরা তৈরী করে নিলাম আলাদা আলাদা ঈশ্বর, আলাদা আলাদা ধর্ম, আলাদা আলাদা আচার – বিচার – কুসংস্কার – নিয়ম – কানুন – ঘৃণা। আমাদের প্রার্থনার জায়গা থেকে উবে গেল ভালোবাসা।

কে হিন্দু, কবে থেকে হিন্দু, কীভাবে হিন্দু না জেনেই আমরা হিন্দু হলাম। ঠিক সেভাবেই আমরা হয়ে গেলাম মুসলমান, খ্রীষ্টান, ইহুদি, পার্শি, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ আরও কত কী! আমরা নানারকম তকমা এঁটে আমরাই শ্রেষ্ঠ সেটা প্রমাণ করার জন্যে হাতে তুলে নিলাম ধারালো থেকে তীব্রগতির শাণিত নানান অস্ত্র। যার যার শরীরে আমার মতই একই রঙের রক্তস্রোত বইছে, তাদের মাথা কেটে ফেলার চেষ্টা করতে লাগলাম। আমরা চোঙা ফুঁকে চিৎকৃত হলাম, “আমরা আধুনিক”।

আমরা শ্রীমদ্ভগবতগীতা পড়িনি। দেখেছি আমাদের টুকরো ঘরের কেউ মারা গেলে চিল চিৎকার করে কাঁদতে হয়, টিকি নাড়া মানুষের নিদান মত সিদ্ধ ভাত, কাচকলা খেতে হয়, মৃতের সম্পত্তির হিসাব নিতে হয় তড়িঘড়ি। আর অন্তিম দিনে পান, সুপারী, পৈতে, নগদ একটা টাকার কয়েন আর দশকর্মা ভাণ্ডার থেকে কেনা যত কম দামী সম্ভব একটা চটি গীতা নামের খেলনা বই দিতে হয় কিছু মনুর বংশধরকে। সেই চটি বই যাকে দেওয়া হয়, সেও পড়েনা। অথচ দেওয়া নেওয়া চলে কারন এটাই নাকি নিয়ম, এটাই নাকি ধর্মীয় আচার। সুতরাং ওই বিশালদেহী শ্রীমদ্ভগবতগীতা নামের বইটা আমরা পড়িনা। তার ভিতরে কী লেখা আছে আমরা জানিনা, জানতে চাই না।

আমরা শ্রীকৃষ্ণ জানি টিভির সিরিয়াল দেখে, জন্মাষ্টমীর দিন গুগুল ইমেজের হ্যাপি জন্মাষ্টমী ছবি থেকে, ইউটিউবে আমার মতই অন্য আরেক বেরাদরের আপলোড করা ভিডিও দেখে, ফেসবুকের অর্বাচীন পোস্ট দেখে, ইন্সটাগ্রাম বা ট্যুইটার বাণী দেখে। ঠিক এভাবেই আমরা রামায়ণ না পড়েই রাম চিনি, রাবণ চিনি, পুরাণ না পড়েও শিব চিনি, দুর্গা চিনি, মহাভারত না পড়ে দ্রৌপদী চিনি, কিছু না পড়ে বা না বুঝেই ঈশ্বর চিনি। আমরা আদতে কখনো কোনো বই পড়িনা। বেদ, উপনিষদ বলে কিছু আছে সেটা জেনেছিলাম ছোটবেলার পাঠ্যবই পড়ে। আমরা ধর্ম চিনি রাজনৈতিক হুহুঙ্কারে।

ছোট ছোট ঘরে থাকি নিজেকে আর নিজের পরিবারকে নিয়ে। কিন্তু নিজের ওইটুকু ঘরের অন্যদের সম্পর্কেও সদ্ভাবনা নেই আমাদের। হাজার কুচি কুচি অংশে নিজেদেরই কেটেছি ছিঁড়েছি। এ শূদ্র ও চণ্ডাল, এ ব্রাহ্মণ ও ধোপার বউ, এ কুলীন ও নাপিতের মেয়ে এরকম নাক উঁচু হাজার হাজার ভাগ। অথচ আমরা জানিই না যে শাস্ত্র বলে ‘জন্মে ব্রাহ্মণ হয় না, কর্মে ব্রাহ্মণ হয়’। জাতপাতের নোংরা অন্ধকারে নিজেদের গায়ে নিজেরাই পরম আদরে হাত বুলাই।

পাশের ঘরের প্রতিবেশীকে চিনিনা, জানিনা, জানার চেষ্টাও করিনা কখনো। প্রতিবেশীরাও আমাদের মতই কোরাণ, বাইবেল, জিন্দাবেস্তা, ত্রিপিটক নিজে পড়েনি। আমাদের মতই কারো মুখে শুনে যতটুকু জানা তার বাইরে যে কিছু থাকতে পারে তাই জানা হয় নি কোনদিন। তারাও নিজেদের ক্ষুদ্র ঘরের ক্ষুদ্র পরিসরে নানান ভাগে ভাগ হয়ে থাকতে ভালোবাসে। হীনযান – মহাযান, ক্যাথলিক – প্রোটেস্ট্যান্ট, শিয়া – সুন্নি – সুফি – মোহাজির টুকরো টুকরো অংশ এ ওকে সহ্য করতে পারে না, সে তাকে।

রাজনৈতিক ক্ষমতার লোভে রাজারা লড়াই করেছে। আমরা তাদের সৈন্য হয়ে ক্রুসেড লড়েছি, ধর্মযুদ্ধের নামে অন্যের ঘর দখলের চেষ্টা করেছি, জিহাদী হয়ে কাফেরের মাথা কেটেছি এটা জেনে যে একটা শত্রুর মাথা কেটে ফেলতে পারলেই স্বর্গে বা হেভেনে বা বেহেস্তে সুন্দরী হুরিদের বিছানায় পাব, ভালো ভালো খাবার পাব। আমরা একদিন যারা শুধুমাত্র মানুষ ছিলাম আজ মুখে হিংস্র রক্ত মেখে হিন্দুরাজ বানাতে চাই, ইসলামরাজ বানাতে চাই, খ্রীষ্টানরাজ বানাতে চাই। আমরা ভাবি আমাদের রাজ প্রতিষ্ঠা হয়ে গেলেই আর কোনো অভাব থাকবে না আমাদের।

আমরা পড়ি না। পড়ে সময় নষ্ট করি না। নিজের ধর্মের বই পড়ি না। অন্যের ধর্মের বইও পড়ি না। অন্যের ধর্মের কথা কানে এলে দু হাত কানের ওপরে চেপে ধরি, যাতে অন্যের ধর্মের কোনো ভালো শব্দ আমাদের কানে ঢুকে আমাদের বিধর্মী না করে দিতে পারে। যে বদ্ধ পাঁকে আমাদের জন্ম আমরা সেখানেই ক্রমাগত আরও দুর্গন্ধ হতে থাকা পাঁকের ভিতরে চোখ – কান বন্ধ করে জীবন কাটিয়ে দিই। সেই আমাদের পছন্দের নরক, সেই আমাদের প্রিয় দোজখ। আসলে আমরা জানি না যেখানে জ্ঞান থাকে সেটাই স্বর্গ, সেটাই হেভেন, সেটাই বেহেস্ত। আর নরক বা দোজখ জ্ঞানহীন কালো অন্ধকার ছাড়া আর কিছু নয়।

আসলে আস্তে আস্তে চোরাবালির ভিতরে ডুবতে ডুবতে, ডুবছি সেটা না বুঝেই আমরা ধর্ম না জেনেও ধর্মরাজ হতে চাই।

.
(লেখা ©Soumitra Chakraborty, ছবি কৃতিত্ব এই দুঃসময়েও যে মুষ্টিমেয় কয়েকজন সত্যিকারের মানুষ আছেন তাঁদের মধ্যে দুজন Intekhab Alam এবং নিধি কামদারের সৌজন্যে প্রাপ্ত।)

আর নয় নাগাসাকি আর নয় হিরোসিমা

শোনো-
ঘরের কোণে নির্জীব
চতুঃস্পার্শে তৈরী করা
আপাত ভঙ্গুর শান্তি ভাঙতে না চাওয়া
মানুষের দল-
শোনো এক গল্প বলি-
রক্তাক্ত সে কলঙ্ক শুনে যদি ক্ষুব্ধ হও
দুঃখ আসে,ক্রোধে ফেটে পড়তে চায় মন
জানিও তা পরে।

সে দিনটা ছিল টাকা রং সূর্যের
স্নেহাশীষে ধোয়া,
অগনিত ফুটফুটে শিশু
সোনালী গমের ক্ষেতে
বিকিরণ করে সুখ খেলায় খেলায়-
তরুণী গৃহিনী জল সন্ধানে-
চাষীরা এসেছে মাঠে-
মজুর গিয়েছে কলে-
শিক্ষিকা একাগ্র অধ্যাপনায়-
কে জানতো এত সুখ
প্রকৃতির ভালবাসা এ সৌন্দর্য
কেড়ে নিতে মানুষই পাঠাবে দূত
জীবন্ত শয়তান…!!

হঠাৎ বিস্ফোরণে
চারিদিক কালো হয়ে আসে,
মাটির গভীরে ফাটল,
ধোঁয়ার কুণ্ডলী, আগুনের লেলিহান শিখা,
আকাশ এসেছে নেমে
সমতলের মাংস ছিঁড়ে নিতে।

সময় চলে তার আপন গতিতে
ধোঁয়ামেঘ সরে.আগুনের ধিকিধিকি,
অনেকেই বেঁচে নেই।

দগ্ধ গলিত সেই শবস্তুপ মাঝে
কোনো মানবসন্তান হেঁটে আসে
জীবন্ত কংকাল হয়ে-
হাড় আছে, মাংস নেই-
তলপেটে ঝুলন্ত থলথলে নাড়ী-
নাক নেই, ঠোঁট নেই-
চোখে তার পাতা নেই-
গায়ে পোড়া চামড়া কোথাও বা ঝুলছে-
দু কদম হেঁটে এসে
বিস্মিত ঘৃণা ছুঁড়ে
মাটিতে লুটিয়ে পড়ে
আর ওঠে না।

এই হলো নাগাসাকি
এই হলো হিরোসিমা
এই হলো পরমাণু
যুদ্ধের বিভীষিকা।
শোনো বিশ্বের আপামর মানুষ-
তোমরা কি চাও, এভাবে ধ্বংস হোক
গর্বের সভ্যতা?

পাঁচশো কোটি প্রাণ ধ্বংসে মেতে উঠুক
পাঁচশত খামখেয়ালী শয়তান?
বন্ধু,আজকের এ রণাঙ্গনে
সজোরে একযোগে হাঁক দাও-
আমরা চাই না যুদ্ধ
বন্ধ হোক রণদামামা
বন্ধ হোক মারণবোমা
আকাশযুদ্ধ-মিসাইল দৌড়!
আমরা অন্ন চাই, বস্ত্র চাই
মাথার ওপরে চাই একখণ্ড আচ্ছাদন,
আমরা বাঁচতে চাই,
বন্ধ হোক এ তাণ্ডবের বীভৎস লীলা…!

সে তূর্যনিনাদে কেঁপে উঠবে
ঔপনিবেশিক ভিত,
সাম্রাজ্যবাদী প্রভুরা চুরমার হবে
শব্দের অমোঘ আঘাতে,
যুদ্ধলিপ্সার শিকড়
উপড়ে বিলীন হবে
মহাকাশের অন্ধকারাচ্ছন্ন গর্ভে।

তারপর!-
সোনালী গমের ক্ষেতে
আবার খেলবে শিশু,
তরুণীর ঠোঁটে হাসি
ফিরে এসে হবে বিদ্যুচ্চমক,
এ সুন্দর গোলকে ভাসবে
অপার শান্তির নীলিমতা,
মানুষ উঠবে বেঁচে
প্রকৃত মানুষ হয়ে।

বাঘ

ma

আয়নার সামনে দাঁড়ালে কাগুজে বাঘের চশমা দেখা যায়
নোনা ধরা ছাদের শতচ্ছিন্ন আঁচল
পরিপাটি কিছু কথা
সুচিত্রা স্টাইলের সুললিত রবীন্দ্রসঙ্গীত আর
বিশ ত্রিশ কোটির বাগানে
হাতের চার আঙুলে আলতো
অযোধ্যা পাহাড়ের মহুয়ার সাজানো গল্প

খাঁটি স্কচ, না ছোঁয়া ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স
রাত বাড়লে আয়না বমি করে কাগজের
হাতি, শেয়াল, ধূর্ত হায়না আর চশমা
পড়া কাগুজে বাঘের এডিটোরিয়াল
দেখতে দেখতে ভেনিসের জলে মেশে
হাওয়াই দ্বীপের আগ্নেয় ছাই
পৃথিবীর শেষ অস্ত্রব্যবসায়ী

এইমাত্র সই হওয়া ডিলের বদলে উপহার দেয়
তরতাজা ময়শ্চারাইজড শরীর
চশমা মাটিতে পড়ে দু টুকরো হলে
নেশা জমে ওজন স্তরেও …

নোট নাট্য

ED-1

নোটের আমি নোটের তুমি
নোট আইডি তে চেনা
নোটানোটি চুলোচুলি
নোট কি কারো কেনা!

আজকে নোট তেনার কাছে
কালই ইডিখানায়
আধেক নোট ইধার ওড়ে
বাকি ধানাই পানাই।

গেরুয়া নীল সবজে সাদা
নোটের নানান কিসিম
সাদা নোট প্যাংলা রোগা
কালোর প্রতাপ অসীম।

কোথায় আছে হারানো নোট
খুঁজতে নামে ইডি
ছ পার্সেন্ট মাত্র ইধার
রেস্ট বিদেশী সিডি।

আম পাবলিক হাহুতাশে
বিক্রি মাইনাস দামে
রাত ফুরালেই লাইন মারে
ব্যাংকে এটিএমে।

আসল নোট তো ছুপারুস্তম
রিয়েল এস্টেটিয়ার
মন্ত্রী শান্ত্রি রাজা গজা
তাদের স্পেশাল ডিয়ার।

সবার জন্য দুহাজারী
পাঁচহাজারী শাসন
মন্ত্রী সখীর হুকুমতে
কোটি নোটের রোশন।

কালোবাজারী ম্যাংগো পিপল্
তাদের কাজে ত্র্যস্ত
তুঘলকি রাজ সবই সাদা
আদার্স চোর মস্ত।

নোটানোটি ছোটাছুটি
নোটের বাজির ধুম
নোটের খবর খাচ্ছে গিলে
আম পিঁপড়ের ঘুম।

মা বুলি

aW1

বিহান বেলায় প্যাটের ভিতর টুঁ টুঁ কর্ য়্যা কাইনতে থাকে
খিদা…খিদা…জগতটকে সাপুটে খায়্যেঁ ফেলার লেগ্যে
মনট তখন হাটুর পাটুর…

ছুটুবেলার ইস্কুলঘরের ছামুটে যুন লাল ধুলার রাস্তাট সিদ্যা
জঙ্গলের কালা আন্ধারে সিঁধাইনছে
উয়ার অগল বগলে মাঠ গুডু (দিকুরা যাকে ইন্দুর বলে)
খাম আলু দুচার পেইলেই দিন পুরা রাত পুরা লিসচিন্দি।

ইস্কুলঘরে ছুটুবেলাট বডই হিচিকিচানো,
সর্দি নাকে সিলেট পিনসিল আর আঁখ লাল
ম্যাস্টরগুলান খালি মারে দিকুদিগের বুলি না বইললেই…

গাঁওবুড়া বইলথ এমন দিন আইসবেক রে আইসবেক
আপন আপন অলচিকিতেই লিখা পড়া
বেটা বিটি গুলাও বাঁইচবেক দিকু দিগের বুলি থিক্যে!

আজও সেই ইস্কুলঘর, আজও সেই সর্দি নাকের ছুটু ছুটু মানুষগুলা
আজও সেই বাবুদের ঘরের লাল চোখ ম্যাস্টর,

দু টাকা কিলো চালও উরাই ল্যায়
দিকু বুলিও উরাই সিখাই জবরদস্তি
আজও সেই লেংটি পইরে ইস্কুলঘরের পাস হয়্যাঁ
গুডু খুঁজা, খাম আলু খুঁজা…

মরন ইস্তক আমার ছামুতে মা বুলি অলচিকি
সিলেটে লিখ্যা হয়্যেঁ এখনো এলো নাই গ মহাজন!