শাকিলা তুবা এর সকল পোস্ট

এগুলো কবিতা কি?

এগুলো কবিতা কি?

১.
আয়নার ভেতর একটা অবাক প্রতিফলন
কেমন ঘোরলাগা, নীল নীল
অনেকটাই গোলমেলে এইসব ভ্রান্তি
তবু আপেক্ষিক প্রতিসরণ হতে থাকে বৃন্তচ্যুত
পেট্রলের মত মিঠেকটু গন্ধের দিকে
ধাবিত হতে হতে আয়নায় আবারো দেখে ফেলি কারো মুখ।

২.
আমার সবই ছিল, তবু মনে হত নাই নাই
যার কিচ্ছু ছিল না
যার মনে হত আরো কিছু প্রয়োজন
সে যখন আমাকে পেল
সে যখন আমাকে পেল, তার মনে হল
সে আসলে কিচ্ছু পায়নি
আর আমি ততক্ষণে বুঝে গেছি
আমার সব আছে, অনেক বেশীই আছে।

৩.
কার টেরিটরি কোনটা, না বুঝেই গর্তে পড়ে গেলাম
পায়ের নীচে ইঁদুর, গায়ে গায়ে সাপ
মাথার উপর একটা মাত্র চিল
নিজের অবস্থান সম্পর্কে ধারনা এসেছে
তবু নিজের জায়গাটুকু নিয়েই পড়েছি বিভ্রাটে।

৪.
দুনিয়া নাকি নিষ্ঠুর, শুনে শুনেই বড় হলাম
তুষারপাত বা সাদা বৃষ্টি ঝরা দেখবার পর
আদতেই পৃথিবীটাকে নরক বলে মনে হয়
হয়তো একদিন গ্যাব্রিয়েলের পাখাটা দেখে নেব
বিস্ময়কে মেঘের মোড়কে চকলেট বানিয়ে ছুঁড়ে দেব
এবং পুরো স্তবক পাঠান্তে হয়তো বলেও উঠব,
হা ঈশ্বর! পাখাটা তবে আমারই পুড়েছিল!

৫.
আমার হৃদয় তার মুখের ভেতর
তখন আমি তার হৃদয়ে মুখ লুকিয়ে ডুকরাচ্ছি
তখন সে আমার হৃদয় চিবুচ্ছিল, কচমচ কচ
আমি অপলক তাকিয়ে ছিলাম গোধুলীর দিকে
হৃৎপিন্ডের রঙ কণে দেখা আলোয় পীতাভ হচ্ছে
আমি গাছের ক্লোরোফিলে নিজের লজ্জা লুকালাম
আরো পরে হৃদয়ের রঙ সবুজ হবে
যদি কেউ সবজি ভেবে খেতে চায় আমিও উদার হব
কচকচে শব্দটায় নেশা আছে, যেমন আছে ফোঁপানো কান্নায়।

৬.
এখনো কৃতজ্ঞ আছি তাঁদের প্রতি
যারা চুমুক দিয়ে পানি পান করেন
এখনো যারা চিবুতে শেখেননি
তাঁরা যেন শিখে ফেলেন যাদুবিদ্যা
দেশ-জাতি রসাতলে যাবার আগেই
স্বচ্ছতা বিষয়ে জ্ঞানার্জন অতীব জরুরী।

এপ্রিলের ফুল

এপ্রিল এলেই মনে হয় জন্ম নেবার এখনই সময়
এক নারীর প্রসব সুখে লু্কনো অসুখ
লিকলিকে হাতে স্পষ্ট শিশুর উল্লাস
মনে পড়ে যায়, এপ্রিল আমার জন্মমাস।

কবে যেন মা বলেছিল, যুদ্ধের দিনে জন্ম বলেই
অমনিতর খাপছাড়া তলোয়ার আমি
চশমাটা হাতে নিলে কেবলি দু’টো গোল্লা দেখি, ফ্রেম আঁটা
অথচ নাকি দেহধারনকালে আমার চোখ ছিল বাদামী।

পিতা আর ফেরেননি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে
শোনা হয়নি, ‘আয় খুকু আয়’ বলে কোনো ডাক
তবু এপ্রিল এলেই তেজী এই পুরুষের শার্ট চেপে ধরি আর বলি,
যুদ্ধে যাবি না ছেলে, খবরদার।

এপ্রিল শেষতক দুর্বিনীত বর্ধাপণ দিনের অপর নাম
প্রতি মূহুর্তেই জন্ম নেবার, আঁতুরঘরের গন্ধ শোঁকার অদম্য সময়
এ মাসেই বাকিংহাম প্যালেস ঠিকরে আলো চমকায়
এপ্রিল বড় অদ্ভুত মাস, এলিয়টের ক্রুয়েলেস্ট মান্থ; আমার জন্মমাস।

সংযোগ

তোমার সাথে আমার আর দেখা হবে না
হবেনা মানে হবেইনা
তুমি ডান দিকের দরজা খুলে বাঁদিকে ঢুকবে
আকুলি বিকুলি করবে
কি কি ভুল হয়েছিল মনে করবার চেষ্টা করবে
তোমার সব মনযোগ জুড়ে থাকব আমি
আমার অবশ্য খুব একটা ক্ষতি হয়নি
তুমি অবিবেচকের মতো চলে গিয়েছিলে, এই তো
এটা আর এমন কি ক্ষতি বলো!

আস্তে আস্তে তোমার মনে পড়তে থাকবে
ওই দিনটার কথা
যেদিন আমাকে বাজে কথা বলেছিলে
সবিতা নামের মেয়েটার কথা গোপন করেছিলে
আর আমাকে বিশ্রীভাবে একঘেঁয়ে বলেছিলে
তোমার সব মনে পড়তে থাকবে।

আমি যেহেতু সব ভুলে গেছি
আমি যেহেতু তোমাকেও ভুলে গেছি
আমার মন খুব একটা খারাপ হবেনা।

তুমি দরজা খুলে আলো দেখাবার ছলে আমাকে
দেখতে চাইবে
তুমি সেতারের বাজনাটুকু নতুন করে শোনাবে
আর আমরা দুজনেই সুরে মগ্ন হতে হতে ভাববো
ভাগ্যিস আমরা কখনো ব্যবচ্ছিন্ন হইনি
তাই তোমার সাথে আমার আর দেখা হবেনা
হবে না মানে হবেইনা।

পরবাসী ভালবাসা

tyui

আমি গরম দেশের মেয়ে
এপ্রিল থেকে আগস্ট পেরিয়ে
যখন চৌচির হতে শুরু করে মাটি
তখনও থাকতে জানি
নির্বিকার- জল কাদায় হাঁটাহাঁটি।

আমার ছেলেও তেমন
অথচ দূরদেশ ওকে বার্তা পাঠালো,
এই দেশে আয়, আয় ছেলে আয়-
অমন হিমের ভেতরে ও’ নির্দ্বিধায় হেঁটে গেল
আমাদের ছেড়ে কেমন নিরুপায়, ভবিতব্য সনাতন।

ভিডিওকলে ফারের টুপি চিত্রিতমুখ
আর অভিনয়ের হাসিমাখা ছবি দেখে
ঠিকই টের পাই
শীতের দেশের উত্তাপহীনতা,
কিছুই করার থাকেনা, এপারের দীনতা।

মাঝরাতে কুকুরের কান্না শুনি কান পেতে
মায়ের মন অনুবাদ করতে চায় যাবতীয় ভাষা,
অকল্যাণকর সব ইশারা
ছেলেটা কাজ সেরে ক্লান্ত বিছানায় শুন্য বেসমেন্টে
কি নিয়ে বাঁচি? দুরাশার দোলাচলে এক ফোঁটা আশা।

বালাই ষাট, বালাই ষাট
ছেলে আমার পরদেশ
মনে হয় সবাইকে বলি,
ও’ আমার ভীষন ভালো
রক্ত কথা বলে, নির্ঘাত।

কেবল একটু ছেলেমানুষ
নেই কোনো মন্দ অভ্যাস
ও পরদেশ, ভুল বুঝে কষ্ট দিওনা
মায়ের চোখহারা ছেলে-
আহারে পরবাস।

এই গরমেও দেখো, পায়ে মোজা আমার
সব শীত, সব তুষার বুকে জমুক নিরাকার
ছেলে, ও ছেলে, কেন তোরা পরদেশে যাস!
মেনে, বুঝে, জেনে নিস- পাথরেই কল্পিত ঘাস,
এদিকে আছি আমরা চার প্রাণ, আমরাই তোর নিঃশ্বাস…

স্বস্তি বাচন মন্ত্র

তোমাকে খুঁজতে গিয়ে হারিয়ে এসেছি কোন হাহাকারের ভেতর
কত ঘুম লুকিয়ে পড়েছে প্রাচীরের পর প্রাচীর পেরিয়ে একেকটা রাতের পারে
তোমাকে শুইয়ে দিয়েছি কোমল ধবল তুষারে
কোনদিন জেগে উঠবে কি?
বলবে কি ডেকে, “মায়াবতী রাজকন্যাগো চন্দ্রালোকিত জলে
তুমিও লেগে গেছো চাঁদের মতো করে
তোমার সুবাস পাই এত দূর থেকেও
এসো, কাছে এসো।”
কে কার কাছে যায় বলো?
চোখের মতন চোখ হলে মন ছোঁয়া যায়
মনের মতন চোখ উড়ে যায়, যায়ই
তুমি জানো, তুমি জানো আর কোত্থাও তুমি নেই তো।

যদি ফেরো রাজহাঁসের বুক থেকে মেলে দেব নম্র ওম
দুইহাতের তালুতে তুলে নেব কঠিন চিবুক তোমার
মায়ায় জড়িয়ে রাখব আরও বিরাশি বছর
এবং ফিসফিস করে বলে দেবো, “হারিয়ে যাও ফের”
ঋণ করে ভালো থাকতে ভালো লাগেনি কখনো আমার

যে সমাধি গড়ে উঠেছে বুকের ভেতর
সেখানে তোমার শব রাখা নেই কোনো
আছে শান্ত এক নির্জন পরিণতি
ফিরে যাও, এখানে হাহাকার ছাড়া; শূন্যতা ছাড়া আর কিছু নেই
সমাধিক্ষেত্র পেছনে ফেলেই মানুষ চলে যায় সামনের দিনে
সুশীতল ঝরনায় প্রবহমান চারুজলের দিকে
যেখানে পরীদের মেয়েগুলো সাঁতার কাটে
এই জন্মে তাদের জন্যে তুমি বহমান নদী হয়ো
কাউকে খুঁজতে খুঁজতে তোমার হাহাকার ঢেউ হয়ে ছুটে যাক
সাথে ছুটে যাক বিষাদজ্বালাগুলো এদিক থেকে ওদিক, সেদিক
শত শত ঘুম তোমার আইরিশ সমাধিতে প্রোথিত হয়ে আছে।

দূরে দূরে কাছাকাছি

খুব কাছে গেলে যে মুখটা অচেনা হয়ে যায়
সবাই তাকে গোল্লাছুট ভাবুক
সে তো কেনা হয়ে আছে কবেই
সে যখন ভাবে ভ্রমন
তুমি ভেবে নিও রেডিও
যা ইথার ছাড়িয়ে ছড়িয়ে যেতে পারে অনেকদূর।

সে যখন দেখতে আকাশের মতো
সে যখন ভেজা গাছ, বৃষ্টিময় রোদ
তোমার দৃষ্টি পথে সে যখন পোড় খাওয়া জন
তার জন্যে মায়া রেখো না কোনো
সে তখন শহরের পথে ইউটার্ন
সে তখন ভ্রমনশূন্য মহাকাশ।

সর্পশাপ

গাছগুলো ভিজে শেষ।
এমনদিনে সেও যেন একলা থাকে কোনোদিন
এই আকাশের সারিমেঘ
শীত শীত ব্যাকুল বাতাস আর
ভেজা মন নিয়ে
সেও যেন কাঁদে আরো কয়েকবার

যে হারায় সে হারায়
যে জানে সত্যিকারের ভাসান দিতে
সে ডাকেনা কাউকে আর
ফিরে ফিরে আসে হাহাকার
বুক ভরা অভিমান
দিকছাড়া ক্ষ্যাপাটে শোক

যাকে শোক দিয়েছে সে তারই মতন
সেও অবিশ্বাসী এক, সাজাপ্রাপ্ত
কষ্ট সাঁতরে সে যেন অবিরাম
ব্যথায় পরিশ্রান্ত, বারবার দিয়ে যায় ডাক
এই মেঘলা দিন, মৃদু বৃষ্টি আর ইষৎ জ্বালা
হে মহাযোগ, তাকেও দিও কষ্ট এমন!

অরুন উৎসব

Wi

কত কথা চলে গেছে কার অতলে
বদলে গেছে সেইদিন, এইদিন
আমাদের দিন আর রাত।

জ্বরের কিনারে শর্তহীন তার প্রলাপ
এগিয়ে দিয়েছে বুকভরা ঘুম লিস্ট
নজরের উল্কিকাটা চোখ আর
মজার সব নক্সায়
খুলে গেছে বুঝি কল্যাণের স্বরলিপি।

যে চেয়েছিল গোপনে বাঁচতে
মৃত্যু তাকে পুড়িয়ে গেছে শতবার
মিথ্যে তার গ্রীবা সহসা ডুবে যেতেই
কি অসাধারণ শষ্যভারে জেগে উঠছে জ্যোতি
শুরুটা আসলে এখান থেকেই হয়।

একজন আজ কানামাছি, ছুঁয়ে যাচ্ছে আন্দাজে
বনবিথী তার তাতানো সিগনেচার;
শুক আর সারির জড়োয়া গহীন।

জল তার কবেকার বলে গেছে কথা
মেঘ তার সবেধন এঁকে দিল ছবি।

ইনভিজিবিলিটি

gD

রাতগুলো কান্নার মতন এমন জরুরী নয়
এখানকার রঙ ওখানে ছড়িয়ে
কতই আর চিহ্নহীন হবে সাগর!

লোনা ঢেউছন্দ উঠে আসবে আরো কাছে
না চাইলেও ভাবতে হবে
ছিল না কেউ এখানে।

করুণ আর্তি যেটুকু দাঁড়ানো চোখের দরজায়
তাকে দেখা হয়নি এতকাল
যদিও দূরত্ব এক চোখ থেকে অন্য হাসি পর্যন্ত।

মিলিয়ে যাবে হাওয়ার কণ্ঠলগ্ন কাল
নেমে আসবার সময়ে দেখা হয়ে যাবে ফের
পাহাড় থাকবে শরীরে, মন সমতলে।

জাগানি

যদি জেগে থাকো মেলা রাত অব্দি
যদি কথা রাখতে ইচ্ছে হয়
সূর্য মেলে দিও রাত আঁধারে
ভয় থেকে টেনে নামিও
একজোড়া চোখ নিজের দিকে।

এখানে তো এখনো কত কথা জমে থাকে
শীতভোরের কুয়াশাচ্ছন্ন মায়ায়
কত অভিমান খেজুরের রসে হাঁড়ি ভরেছে
কত হাহাকার বাতাসে মিশেছে
যদি জেগে থাকো ভোর দেখিও।

সময়ের ঘোড়া দেখো সোনালী কেশরে
ছুটে যাচ্ছে যমুনার স্রোতে
কত শত নদী এমনি গড়িয়ে গেছে পা ছুঁয়ে
চলে গেছে বেহুলার কয়েকটা বাসরভেলা
কথার আঁটি মাথায় চাপিয়ে দিয়ে চলে যেওনা।

যদি জেগে থাকো সারারাত জলপট্টি হয়ে
আরামের সেঁকে হতে পারো মনোরম
কথা দিয়ে কথা রাখব ভুল হবে না
যদি জেগে থাকো কথা নয় ভালবাসায় বুঝিও
যেন পারি পথ চলতে কখনো দুজনে দুজনায়।

একঘরে সরোজ

1611

নিবিড় ভোর
ঘন শীত কুয়াশা
ওপারে কাঞ্চন ব্রীজ আরেকটু এগোলেই সেই টিনের ঘর
হাতে হাতে কল্কি
জানিনা কি নেশায়
বিলীয়মান বাসের ভেতর তাকাই
কাদের যেন ছেলে এক হুহু করে চলে যাচ্ছে
কোমরে সমরাস্ত্র যুদ্ধাংদেহী
কি তার ভাব! গরম গরম!
অথচ চোখ দুটো দেখো স্বচ্ছ কেমন
কাঞ্চন ব্রীজের অদূরে শুয়ে থাকা নদী যেন
আমি সেই নর’কে দেখি
একেকটা সকাল
একেকটা বাসে
চলে যায় কত মানুষ, কত পুরুষ
শুধু তাকে দেখি না
কক্ষনো দেখিনি
সেই সে পুরুষ
রূপকথার পুরুষ
কখনো দেখিনি যারে
কত ট্রেন, কত বাস চলে গেল ইত্যবসরে

একটা লোকমা তুলে দেয়া হাত
আর নদীর সবটা জলে টইটম্বুর চোখ
এটুকুই চেয়েছি জীবনে শুধু
আমিই পাইনি নাকি প্রভাত কুয়াশা
রেখেছে ঢেকে
এইসকল ভোর আর নবান্নের অগ্রহায়ণ!

শেষ হয়ে আসে ঊষা
কুয়াশা চিরে যারা এখনো বেরুতে পারেনি
তারা চলে যাক যথা ইচ্ছা তথা
অপেক্ষারা তো মরে গেছে জন্মের পরেই।

আলোকিতরশ্মি

যে কোনো দিন তুমি বোন আমার, শুনবে
মৃত্যু কেমন করে উজ্জীবিত করেছিল আমাকে
সাদা ফকিরের খাঁচা বিষয়ক গানটির মত
আমি মুছে দিয়েছিলাম প্রিয় ভাইটির কপাল
সিঁথি আর সিঁদুর লেপন
নির্বিরোধী আমি তাই খাঁচাটা ভাঙ্গতে চেয়েছি
বরাবর নিজের শরীর থেকে।

অপরাধ নিও না বোন আমার
কান্না মানে আমি কখনো চোখ বুঝিনি
তোমার বুকের ঠিক মাঝখানে ঢেউতোলা
স্রোতস্বি সমুদ্দুরটাকে বুঝেছি
জানোতো আমিও লোভীই ছিলাম ভীষন
এপার ওপার বন্ধনের নদীও আমাকে
বাঁধতে পারেনি কখনো; কুলহীন সমুদ্রের
সামনে দাঁড়িয়ে পরাজিত হতেই চেয়েছি বারবার।

বোন আমার, তোমার ঘরে চোর ঢুকেছিল কালরাতে
জেনেও আমি চুপ থেকেছি। বাঁধভাঙ্গা ক্ষুধার মুখে
ওই এক আঁজলা নেওয়ালা আর কতটুকুই বা
নিবারণ করবে প্রেক্ষাপট!
ভুল বুঝোনা আমাকে, বোন আমার
খাঁচাগুলো সব বর্জ্য বুননের হতে পারে
আমি আর তুমি তো সেই একই, কফিনে
শুয়ে শুয়ে হেঁটে যাচ্ছি শামুক পথের রেখায়।

তোমার মতন আমারো একটা
মেধাবিহীন ক্যালেন্ডার ছিল
লাল দাগগুলোতে আমিও নকশি আঁকা
রঙিন দীর্ঘশ্বাসের জড়োয়া সাজাতাম
আর হুটু-টুটসির অকারন যুদ্ধগুলোর মত
কিছু হারাতাম, কিছু পাবার জন্যে উন্মুখ থাকতাম
মূলতঃ তোমারই ভাগ্য বোন, কিছুই পেতাম না
আমিও, শুধুই আজীবনের এই যুদ্ধসাজ ছাড়া।

আমরা প্রশ্নসারি থেকে খুঁজে পেতে পারি উত্তরমালা
বোন আমার, আমরা এসো পরস্পরের শরীর
বৃত্তাকারে ঘুরে দেখে আসি যাবতীয় হাহাকার
আমরা পরস্পরের ছায়া হই, খুঁজে আনি
ভেতর থেকে একেকটা দুরন্ত ঘোড়া
অনিবার্যকে পেছনে ফেলে যে ঘোড়াটি
মূহুর্তে ডিঙাতে পারে তূর পাহাড়।

চিরায়ত

বন্দী বিনিময় শুরু হয়ে গেছে। একজন আসবে, একজন যাবে।

দূরে বিস্তীর্ণ ভূমি, কি দারুণ বিস্তৃত। রোদ থেকে ঝলসে উঠছে কাকলী, প্রাণের কাকলী। বাতাসে শিস দিচ্ছে দুলে ওঠা কচি ধানের সবুজ। নরম ভাপ ওঠা রোদ। লোকটা বারান্দায় বসে এসব দেখে আর ভাবে, ভাবে আর দেখে। পাখির কিচিরমিচিরেও স্থির হয়ে আছে যে স্তব্ধতা সেটুকুই এখন তার সম্বল। ভালো লাগে উনার, ভালো লাগে পেরিয়ে আসা একটা জীবন।

কত বয়স ছিল যখন জেঠুর পিঠে চড়ে নিজেকে তুর্কী বীর সৈনিক মনে হতো? ভাবতেন বিশাল তলোয়ার ঝোলাবেন কোমরে সাথে থাকবে শিরস্ত্রাণ। কিংবা কোরবানীর হাটে বাবার আঙুলে আঙুল জড়িয়ে পশু নির্বাচন! ঈদ আসতো যেন অসহ্য এক খুশী নিয়ে। গোলাম রহমান, আতাউল্লাহ, মাঈদুল সবাই আসতো ঈদের নামাজ শেষে। বীরেনটাও আসত। কেউ তো বলেনি কখনো, ‘ওরে বীরেন তুই এলি কেন, তুই না হিন্দু?’ মা বসে থাকতো হরেক রকমের খাবার আগলে। দাওয়ায় পা লম্বা করে পিঠ সামনের দিকে ঈষৎ বাঁকিয়ে আলুথালু বসে থাকা মায়ের সেদিন আর অবসর হতো না ওভাবে বসে জিরোবার। বাবা, দাদু, জেঠুর রসনা তৃপ্ত হলে ফের ওদের নিয়ে ব্যাস্ত হতো মা। সরু চালের ভাত আর গরুর গোশতের ঝাল তরকারী, খাসীর গোশতও থাকতো বীরেনের জন্য সাথে কত রকমের পিঠা, কত তার নকশা। খেতে খেতেও উনারা যেন ক্লান্ত হয়ে পড়তেন। তখন উনার বয়স ছিল কত?

এরপরে এক সময়ে গ্রামের এই বাড়ী ছেড়ে ঢাকায় পাড়ি জমানো। ততদিনে দাদু, জেঠু নেই। ততদিনে উনি জানেন তলোয়ারের চেয়েও ধারালো এ.কে ফোরটি সেভেন। কাঁধ আঁকড়ে ঝুলে থাকে কাটা রাইফেল অথবা কোমরে শোভা পায় পিস্তল, উনি জানেন। জেঠুর প্রয়োজন এখানেই শেষ হয়ে যায় অন্য কোনো জীবন শুরুর বিনিময়ে। হলের জীবন তো সহজ জীবন নয় কেবল বাড়ীর বড়দের শাসনের কঠোরতা নেই এখানে। অবাধ স্বাধীনতা। কত মিছিল, কত মিটিং। ইউনিভার্সিটির ক্লাসই জীবনে মুখ্য নয় উনি জেনে যান গ্রামের চেয়েও বড় এক জীবনে উনি ঢুকে পড়েছেন। তিনি উৎফুল্ল, তিনি আনন্দিত। গোলাম রহমান বা আতাউল্লাহর কাঁধে হাত পেঁচিয়ে যেভাবে মাঠ ঘাট চষে বেড়াতেন, নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতারের কম্পিটিশন দিতে দিতে প্রাণপনে একে অপরকে ডেকে উঠতেন বন্ধু বন্ধু বলে। এখানে জীবন তেমন নয়। এখানে আছে প্রিন্স, অভি, মামুন যারা সবাই ওর দোস্ত। এখানে গলা জড়িয়ে ধরা নেই। প্রাণ দিয়ে বন্ধু বলে ডেকে ওঠা নেই। ওসব করে ক্ষ্যাতরা, উনি এখন সব জানেন। পকেটে টাকা না থাকলেও যাও আজিজ সুপারে, খেতে হলে মৌলী, সিলভানা নাহলে আড্ডা দাও মধুর ক্যান্টিন, ক্যাফেটেরিয়া বা ক্যাম্পাস শ্যাডোতে, ডাস বা টিএসসিতে। টাকা ভূতে যোগায়, টাকা অস্ত্রের জোর জোগায়।

কেমন কেমন করে জীবনের এই সময়টুকুও তার পার হয়ে যায়। চুকে যায় পড়াশোনার পাট। ঝুটা কাপড়ের ব্যাবসাতেও বাতাস লাগে যেন। দোস্তদের সাহায্য নিয়ে কি করে টিকে থাকতে হয় উনি জানেন, জেনে যান। অন্যের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে হয় ব্যাবসা তিনি জানেন। টেন্ডারে কিভাবে জিতে নেয়া যায় সব অলিগলি তিনি ঠিক ঠিক জানেন। ইউনিভার্সিটির জুনিয়র, রূপবতী মেয়ে দিনাও হয়ে যায় তার ছায়া। এরপরে কি আর পেছন ফিরে তাকায় কেউ? বড় ভাইকেও নিয়ে নেন নিজের সাথে ব্যাবসায়। বাবা মা খুশী। গ্রামের বাড়ি পড়ে থাকে বাড়িতেই। বাবা মা ভাই ভাবী আর দিনাকে নিয়ে মধুর এক সংসার। এরপরে তো পরপর তিনটি ছেলের জন্ম। ভাইভাবীর আবার উলটো তিন মেয়ে এক ছেলে। ততদিনে সবার আলাদা বাড়ি। বাবা মাও চলে গেছেন না ফেরার জগতে। এখন ঈদ মানেই সেমাই জর্দা, পোলাও বিরিয়ানী, মাটন কারি, রোস্ট আরো কত কি! সবই অভিজ্ঞ বাবুর্চির রান্না। পরিপাটি, সুস্বাদু। এছাড়া আছে শপিং। উনার এত সময় কই? এসব কেনাকাটা তো কম ঝামেলার নয়। প্রায় সাত দিন ধরে অফিসের ম্যানেজার তার দলবল নিয়ে সব কিনে টিনে আনে। লোকটাকে কিছুই ভাবতে হয়না। উনার ভাবী আর দিনাই ছোটাছুটি করে সব ম্যানেজ করে। গ্রামের একে এই দাও, তাকে সেই। নিজের বাচ্চাদের তো কথাই নেই। একেকজন জন্মদিনে গাড়ি পায়, দামী মোবাইল ফোন বা দামী ভিডিও গেইম প্লেয়ার পায় আর চলে রাতভোর পার্টি। সেইসব পার্টিতে চলে দেশ বিদেশের নানা খাবার। পিজ্জা, লাজ্জানিয়া, পাস্তা, কাচ্চি, নান, ফ্রায়েড চিকেন, আইসক্রিম, ফ্রেশজুসসহ আরও কত কি! বড়দের জন্য অন্য রকম পানীয়। আবার অনেকসময় দেশে পোষায় না, চলে যান সবাইকে নিয়ে দেশের বাইরে। পালটে গিয়েছে জীবনযাত্রা, সবই উপভোগ করেন তিনি। লোকটা বুদ্ধিমান। তিন ছেলেকেই বিদেশে পড়িয়েছেন। এখন একজন দেশে, অন্য দুজন বিদেশে থেকে ব্যাবসা সামলায়। দিনা মারা যাবার পর নিজেকে তিনি নির্বাসন দিয়েছেন বাবা মায়ের রেখে যাওয়া এই গ্রামের বাড়িটিতে। জীবন নিয়ে তার কোনো আক্ষেপ নেই, চাওয়া পাওয়া নেই। সুখি এক মানুষ। শুধু মাঝে মাঝে ছেলেদের কাজে বা ব্যাবসার প্রয়োজনে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এর দায়িত্বটুকু তাঁর কাঁধে এসে পড়ে। তিনি সানন্দে তাঁর যোগাযোগের তারগুলো দিয়ে ছেলেদেরকে আরো ভালোভাবে আঁটোসাটো করে বেঁধে দেন। উন্নতি আর উন্নতিতে ছেলেরাও ভরে উঠছে। ছেলেরা বাবাকে অনুযোগ করে, ডাকে, ‘বাবা চলে আসো। নাহয় তোমার নিজের এপার্টমেন্টেই থাকো কিংবা আমাদের কারো সাথে আর তা না পোষালে বিদেশের ভাইয়ের কাছে, আসবে?‘ লোকটা হাসেন।

লোকটা তার গ্রামের বাড়ীটাকে গড়েছেন যেন রাজপ্রাসাদ। দোতলা ডুপ্লেক্স। এসি, জেনারেটর, আরাম আয়েস কি নেই তার? হ্যাঁ একটা জিনিস নেই। নেই গোলাম রহমান, আতাউল্লাহ, বীরেন কেউই। তাদেরকে ডাকলেও তারা আর আসেনা, এলেও কেমন জড়োসরো। তাদের কাঁধে হাত পেঁচিয়ে নদী পাড়ি দিতে ইচ্ছে জাগে তাঁর। গলাগলি করে হেঁটে যেতে ইচ্ছে করে মাঠের পর মাঠ। ভুলে যেতে চান এতদিনের দূরত্ব, ব্যাবধান। সময় এমনই এক ঘাতক। কখন নিহত করে রেখে গেছে তার ছেলেবেলাকে, ছেলেবেলার বন্ধুদেরকে উনি টেরই পাননি। এই কিছুদিন আগেও তো মাঈদুলটাকে যাকাতের টাকা পাঠাতো তাঁর বউ দিনা, সাথে শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা জোড়ায় জোড়ায়। ‘আহা ওরাই তো হক্কদার,’ এটা ছিল দিনার ভাষ্য। তিনি কৃতজ্ঞ হতেন দিনার প্রতি। ভাবতেন, ‘দেখো কান্ড! কতদিকে চোখ আমার বউটার।‘ তারপরও এখানে এসে দেখেন তিনি, তাঁর নিজের উচ্চতায় এতটাই বাড় যে উনার বন্ধুরা আর তাঁর নাগাল পায় না। এমনকি মোসাহেবী করবার জন্যেও যতটা লম্বা হতে হয় উনার বন্ধুরা তার চেয়েও অনেক নীচে পড়ে গেছে। লোকটা তাই একা। তবু তাঁর ভালো লাগে এই গ্রাম। এসি রুম ছেড়ে উনি বসে থাকেন নীচতলার খোলা বারান্দাটায়, যেখান থেকে দেখা যায় দূরের রূপালী নদী। ঝাপসা হয়ে আসা কালচে সবুজ গাছপালা। বাসার সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়া মানুষ বা শিশুদের কলতান দেখতে উনার ভালো লাগে। ভালো লাগে জীবনের এই বেঁচে থাকা।

কদিন আগে ইটালী থেকে এসেছেন উনি। ছেলেদের ডাকে, ব্যাবসার প্রয়োজনে যেতে হয়েছিল। ওখানেই শুনেছেন কোভিড ১৯ বা করোনার কথা। এসব নিয়ে ছেলেরা তাকে বিস্তর জ্ঞান দিয়েছেন কেননা উনি এখন টিভি দেখেননা, ফেইসবুকিং করেন না। উনি কাজের লোক ছিলেন। এসবের জন্য সময় ব্যয় করাটা তার অপচয় বলে মনে হয়। তারপরও ছেলেরা তাকে হোয়াটসএপে এই রোগের নানা তথ্য পাঠায়। উনি একা মানুষ। বাসায় কিছু কাজের লোক ছাড়া আর তো কেউ নেই। তাই আইসোলেশনের কথা ভেবে উনি হাসেন। আর তাছাড়া ইতিমধ্যে একুশ দিন তো পার হয়েই গেছে! পরশু বীরেনটা এসেছিল। খুব কাঁচুমাচু মুখে কিছু টাকা চাইতে। ঢাকায় নাকি লকডডাউন শুরু ঝয়ে যাবে। তাই ওর ছেলে টাকা পাঠাতে পারছে না। বেতন পাওয়া না পাওয়া নিয়ে ছেলেটা নাকি নিজেই দোটানায় আছে। অনেক ইচ্ছে করছিল বীরেনের সাথে আড্ডা দিতে। কিনতু কি আড্ডা দেবেন? সামনে বসে থাকা চাষাভুসা মার্কা এক বৃদ্ধ যার শিক্ষাগত যোগ্যতা ম্যাট্রিক ফেল তার উপর সে এসেছে দয়া চাইতে, তার সাথে কি আর আড্ডা জমে? উনি বীরেনের প্রত্যাশার চেয়েও বেশী টাকা গুঁজে দেন ওর হাতে আর নরম স্বরে বলেন, ‘আমি তো আছিই। ছেলেকে বলিস চিন্তা না করতে। যখনই টাকা লাগবে চলে আসিস।‘ বীরেন নত চোখে, নত হাতে টাকা নিয়ে চলে যায়। আর উনি ভাবতে বসেন, এতটা আশ্বাস দেয়াটা ঠিক হলো কি? শেষে তো এরা অলস হয়ে উঠবে! নাহ এরপরে আর এতটা আস্কারা দেয়া ঠিক হবে না। আবার ভাবতে বসেন বীরেনের ছেলেটাকে তার কোনো প্রতিষ্ঠানে ঢুকিয়ে দেবেন কিনা। তাহলে অফিসে নিজেদের লোকদের পাশাপাশি একেবারে নিজস্ব কিছু স্পাইও তৈরী করে রাখা যায়। কে কি করছে, কি হচ্ছে কোন অফিসে সেগুলোও ছেলেরা সব খবরাখরর রাখতে পারবে। কারণ ইদানীং বড় ভাইয়ের মেয়েজামাই আর ছেলেটার সাথেও ভালোই গোলমাল চলছে উনার ছেলেদের। পরক্ষণেই মনে হয়, কি দরকার! অযথা গ্রামের এইসব লোকজনকে নিয়ে এত টানাটানি করবার? যার যার জীবন তার তার কর্মফলের দান। তিনি কে এসব ঠেকাবার? বরং খামোখা ছেলেরা বিরক্ত হবে। বলবে, ‘বাবা গ্রামে গিয়ে সমাজসেবার পাশাপাশি যতসব ছাইপাঁশ করে বেড়াচ্ছে।‘ কিংবা হেসে হেসে বলবে, ‘বাবা এবার কি তুমি রাজনীতিতে আবার সক্রিয় হবে?

ইলেকশন/টিলেকশনে দাঁড়াবে নাকি? তাহলে কিনতু মন্দ হয় না!’ এসব ভাবতে ভাবতেই উনার মাথাটা কেমন ভার ভার লাগে আর শরীরটা এত দুর্বল বোধ হয় যেন আর উঠে দাঁড়াতেই পারবেন না। তবু উনি উঠে দাঁড়ান। কোনো রকমে টলতে টলতে দোতলায় উঠে যান আর বেডরুমে রুমে ঢুকে নিজেকে বিছানায় এলিয়ে দেন। একটু ঘুমালেই সব ঠিক হয়ে যাবে, লোকটা ভাবে।

ঘুম যখন ভাঙ্গে তখন সন্ধ্যা কি রাত টের পাননা। শুধু টের পান কেমন জ্বর জ্বর লাগছে। উনার সাথে চার জন কাজের লোক থাকে। সবাই পুরুষ, নানা বয়সের, নানা যোগ্যতার। একজন শেফ, একজন বাটলার, একজন ক্লিনার আর একটা তরুন ছেলে নাম আরিফ। ছেলেটা গ্রাজুয়েট। উনার পিএস। ছেলেটা সারাক্ষণ উনার আশেপাশেই থাকে। উনি জানেন আরিফ উনার দরজার বাইরেই আছে তবু ওকে ডাকবার শক্তিও যেন উনার নেই। কোনোরকমে হাত বাড়িয়ে বেল টেপেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘরের দরজা খুলে আরিফ ভেতরে ঢোকে। আলো জ্বালিয়ে উনার দিকে তাকায় আর উদ্বিগ্নস্বরে ‘স্যার কি হয়েছে? খারাপ লাগছে? স্যার?’ বলতে বলতে খাটের দিকে ছুটে আসে। উনি কেবল বলতে পারেন, আমি টয়লেটে যাব।

এর পরের কয়েকটা দিন অন্যদের জন্য অনেক দ্রুত কাটলেও উনার জন্য সেটা হয়ে ওঠে ভয়াবহ। ঘুম আর জাগরণে উনি কঠিন সময়ের ভেতর দিয়ে এগুতে থাকেন। জ্বর, কাশি, পেটে ব্যথা, মাথা ব্যথা সব মিলিয়ে অসহ্য বিষয়। আর শ্বাসকষ্ট যেন ক্রমেই বাড়ছে। নিঃস্বাস নিতে এত কষ্ট? উনি দেখেন বাসার প্রেক্ষাপটও যেন কেমন বদলে গেছে। অফিসের বেশ কিছু লোক চলে এসেছে উনার বাসায়। উনার রুমের বাইরে তাদের ত্রস্ত আনাগোনা টের পান উনি যদিও কাজের লোকজনও খুব একটা সামনে আসেনা। এলেও সবার মুখে মাস্ক। অক্সিজেন সিলিন্ডার থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে উনার নাকেমুখে ঢুকছে অক্সিজেন। তবু যেন আরাম নেই। অনেক কষ্টে ফ্যাঁসফ্যাঁসে গলায় উনি ম্যানেজারকে বলেন, ‘আমার ছেলেরা কই? ওরা আসেনি? ছেলেদেরকে খবর দাও, এখানে আসতে বলো।‘ ম্যানেজার একটু অস্বস্তি নিয়ে তোতলাতে থাকে। আরিফ এসে বোঝায়, ‘স্যার এখন উনারা কিছুতেই আসতে পারবেন না। ঢাকায় লকড ডাউন চলছে। প্লেন থেকে শুরু করে গাড়ি ঘোড়া পথ ঘাট সব বন্ধ স্যার। একটু ধৈর্য্য ধরুন।‘ ভিডিও কলে আরিফ উনাকে ছেলেদের সাথে কথা বলিয়ে দেয়। বড় ছেলে অনুযোগ করে, ‘তোমাকে নিষেধ করেছিলাম বাবা ওখানে থাকতে, শুনলে না আমাদের কারো কোনো কথা। এখন ওখানে, ওই গন্ডগ্রামে কি করে চিকিৎসা করাব তোমার, বলো?’ আবার কখনো নাতি নাতনীরা কথা বলে, ‘গ্র্যান্ডপা গেট ওয়েল সুন’ উনি ঘোলা চোখে তৃষ্ণার্তের মতন ল্যাপটপ বা ফোনের ডিসপ্লের দিকে তাকিয়ে থাকেন।

কদিন গেছে উনি জানেন না। উনি এখন হসপিটালে এটা বুঝলেন কি বুঝলেন না কে জানে! উনি দেখলেন সারা শরীরে কি সব পরা, হেলমেট লাগানো অনেকগুলো নারী পুরুষের ছোটাছুটি। আরিফ বলেছে, ছেলেরা চীন থেকে ডাক্তার, নার্স আনিয়েছে। উনার ভালো চিকিৎসা চলছে। কেন জানিনা শারিরীক এত কষ্টের ভেতরও উনি গোঁ গোঁ করে বললেন, ‘একবার আইমানকে আসতে বলো, ওকে দেখতে ইচ্ছে করছে’ আইমান উনার ছোট ছেলে। আরিফ বলে, ‘স্যার অফিসের সবাই আমরা আছি এখানে। আপনি চিন্তা করবেন না। আর আপনার নাতি নাতনীদের সেইফটির জন্যে আপনার ছেলেরা আসতে পারছে না। ডাক্তারের নিষেধ আছে।‘ উনি হতাশ হলেন কি?

আজ লোকটা চলে যাবেন। তার বুকের ভেতর এতটুকু নিঃশ্বাস অবশিষ্ট নেই। উনি তার কিছুই জানেন বা বোঝেন না। স্নেহের কোনো হাত উনার কপালে পড়েছে কি না তা নিয়েও নেই কোনো মাথাব্যাথা। শুধু ডাক্তাররা আর আশেপাশে যারা রয়ে গেছে তারা জানে উনি চলে যাচ্ছেন। কিনতু লোকটা তখন মাকে ডাকছে। দাওয়ায় বসে মা চিকন চালের ভাত আর ঝাল গরুর গোশত বেড়ে দিচ্ছে কালাই করা বাসনে। উনি বলছেন, আমার কষ্ট হচ্ছে মা। মা উনার কপালে হাত রাখলো। মায়া মায়া হাত। উনি বুঝলেন, মা ছাড়া আসলে এক জীবনে আর কেউই থাকেনা যে শুধুই ভালবাসে। উনি তখন মায়ের শরীরের ভেতর আরো ঘণ হয়ে ঢুকে পড়েন। উনি যেন মায়ের পেটের ভেতর চলে যেতে চান, এমনই ইচ্ছে জাগে মনে। বাইরে তখন প্রবল বৃষ্টি। উনি দেখতে চাইলেন জানালাটা বৃষ্টির ছাঁটে ভিজছে কিনা। কাউকে ডাকতে হবে, জানালা আটকাতে হবে, এইসব ভুলে উনি তখন বৃষ্টি কণাগুলোর সাথে সারা গ্রামময় ঘুরতে শুরু করলেন।

অনেক দূরে তখন মায়ের পেটের ভেতর একজন কাতরাচ্ছে ব্যথায়। যে শরীর সে চেনে না সেই শরীরের ব্যথাবোধ তাকে অবাক করছে। সে পরিচিত হচ্ছে কষ্টের সাথে, ব্যথার সাথে। সে তখন বাইরে আসবার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টায় ব্যাস্ত। সে ভাবছে, হয়তো একবার বাইরে বেরুলেই এই ব্যথা থাকবে না আবার ভাবছে যদি থেকেই যায়? সে বোঝে এইসব ব্যথা নিয়েই তাকে নামতে হবে পৃথিবীর বুকে। পরে কি হবে সেটা পরে ভাবা যাবে। আপাততঃ পৃথিবীই গন্তব্য। পৃথিবী আসলে কেমন? জীবনই বা কি? অনেক মানুষের উল্লাস, হাসি আনন্দ শুনতে শুনতে সেও কেমন ঘোরলাগা চোখে তাকায়। সে দেখে জল। সে দেখে বৃষ্টি কণাগুলোর হাত ধরে কেউ যেন চলে যাচ্ছে। ছায়া ছায়া কেউ। চলে যাচ্ছে ভেজা ভেজা হয়ে দূরে আরো দূরে। যে যাচ্ছে সে যেন হাসছে মুক্তির আনন্দে। সে তাকিয়ে থাকে অপসৃয়মান ছায়াটার দিকে। আর তার কান্না পায়, ভীষন কান্না। বন্দিত্বের যন্ত্রনায়, নতুন পৃথিবী কেমন জায়গা, ভয় কি তাহলে এটাই? এসব ভাবতে ভাবতে তারস্বরে সে চীৎকার করে ওঠে। বাইরে তখনো প্রবল বৃষ্টি।

একটি শিশু মায়ের নিরাপদ কোলে। সে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। দূরে বিস্তীর্ণ ভূমি, কি দারুণ বিস্তৃত। রোদ থেকে ঝলসে উঠছে কাকলী, প্রাণের কাকলী। বাতাসে শিস দিচ্ছে দুলে ওঠা কচি ধানের সবুজ। নরম ভাপ ওঠা রোদ। পাখির কিচিরমিচিরেও স্থির হয়ে আছে যে স্তব্ধতা, যে নীরবতা তার ভালো লেগে যায়, ভালো লাগতে শুরু করে সব কিছু, ভালো লেগে যায় নতুন এই জীবন। সে হাসে।

অভিমুখ

চারকোণা মেঘ
সরে উড়ে যাচ্ছে কই!
নানুবাড়ি বুঝি? কোন গ্রাম?

শেকল সরিয়ে পায়রা উড়িয়ে
আকাশের নীচে তুমি, তুমি ওই
বাড়ি নেই, ঘর নেই। যাও কই?

আকাশ আছে মেঘ নেই
মেঘ আছে আদরবাড়ি নেই
বড় হয়ে আকাশ নয়, মাটি ছুঁয়েছো শেষে!

বিরহ কাল

আমাদের ভ্রমণ শুরু হবার আগেই
তুমি, তুমি যেন পিছলে গেলে
সন্ধ্যা লাগি লাগি সময়ে
তোমার গালের ট্রান্সপারেন্ট আঁচিল
যাকে একফোঁটা পানি মনে করে
আমি চুমু খেতে চেয়েছি অনেকবার

তোমার ঢেউ ঢেউ ঠোঁট
আমাকে কম্পমান খরগোশের
নরম শরীরকে মনে করিয়ে দিয়েছে প্রতিবার
অথচ তুমি পিছলে গেলে
তোমার পতন দেখা হলো না
দেখা হলো না কত দ্রুত তুমি লাল হয়ে ওঠো

একটু আগে সামনের ঐ রাস্তা টপকে
হাত ধরাধরি করে যার সাথে তুমি চলে গেলে
ঐ ছেলেটাকে আমি, আমি চিনিনা