সমস্ত ব্ল্যাকবক্সকে

বাবার অসুখ বিপদসীমা ছুঁই ছুঁই, তাই তুমি ভেঙে পড়তে চাইছো। ছেলের সঙ্গে যোগাযোগের সুতো ছিঁড়তে বসেছে, সুতরাং চিকিৎসা থামিয়েছ নিজের। তোমার হাজব্যান্ডের ব্যবহার অপমানজনক ব’লে একবেলা খাওয়া বন্ধ করলে।

পরিস্থিতি লড়াই দাবি করছে, কিন্তু তুমি হয়তো যুদ্ধের এই মাঠগুলোকে চেনো না। শুধু অন্যের জন্যে গলা উঁচু করতে শিখেছ; সেই কবে থেকে একটা দর্শনের সঙ্গে এক-ছাদের নিচে বাস — ইউনিভার্সিটির উঁচু কড়িবরগার অধীনস্থ বইয়ের পুরনো আলমারি আর পুলিশের গুলি খাওয়া ক্লাসমেট তোমাকে প্রতি পায়ে সাহায্য করে সেখানে; অথচ নিজের মানুষের মুছে যাওয়া বা আপনজনের কাছে নিজেকে “বাড়ন্ত” দেখে ফেলার ভয় তোমার সত্তায় বৃশ্চিক হয়ে দেখা দিল।

ইচ্ছে করে, এক পাখিজাগা হেমন্তের ভোরে তোমাকে হাত ধরে একটা অশথগাছের বেদিতে বসাই; কাঁধের কাছে চাদরটা টেনে দিয়ে বলি, চোখ বুঁজে ভাবো তো, কোন কোন জীবউপাদান জড়উপাদানে তৈরি তুমি? ঈশ্বর বা নাস্তিকতা, সৃষ্টি না সাফল্য, প্রেম-যৌনতা, ঘেন্নার অবসাদ, অত্যাচার অথবা মুক্তিকামনা?

এই যে খুঁজতে শুরু করলে, এ সারাক্ষণ আমারও হাতড়ে বেড়ানো। কখনও মনে হয়, সব কিছুই একটু একটু মিশেছে এসে নিজের মধ্যে। তারপর ভাবি, ভেতরে মেশেনি, ওপরে জমা হল — গুহার গায়ে খনিজ লবণ।

পরমাণুর যেমন কেন্দ্র, আমাদের সত্তাও তো ভারি হয়ে আছে শূন্যতায়, যার তড়িৎআধান সব সময় ধনাত্মক। ওজনদার তাই স্থির, শূন্য তাই উড়তে পারে। জন্মের মধ্যে দিয়ে এসে জীবনের ওপর একচক্র কেটে মৃত্যুর দিকে পাখসাট বাড়াবে।

সব সম্পর্ক, সব কাজ শুধু আমার অবয়বের সংজ্ঞা তুলে দেয় পৃথিবীর হাতে। আর আমাকে কী দিল সে — জরা থেকে অভিবাসন? দুঃখ থেকে ছুটকারা? আঘাত থেকে চন্দ্রাতপ? উঁহু! নিঃসঙ্গতা মোছে, কিন্তু কেউ এসে একাকিত্ব ছুঁতে পারে কই — বোধ, ভারসাম্য যেখানে সোনার কৌটোয় মুড়ে রাখা!

অস্তিত্বের সেই কোর সেক্টরকে তুমি একবার আলাপ করিয়ে দিও আকাশের সঙ্গে। দেখবে, যত অন্ধকারের শব্দ নুরানি হয়ে যাচ্ছে…।

চুম্বিত হতে হতেও ভুলে যেও না ভালোবাসা আসলে ভ্যানিশিং-ইংক; আয়নার দিকে তাকিয়ে পড়ে নিও বয়েসের নুপূরশব্দ; তবু মনে রেখো, শেষ যুদ্ধটা বাদে বাকি সব লড়াই কিন্তু মানুষই জেতে — সত্তার সৈনিকেরা। হাসপাতাল থেকে বারবার সার্থকভাবে বাড়ি ফেরার অ্যাম্বুলেন্সে বসাই বডদাকে, নির্দিষ্ট সন্ধেয় বের করে ফেলি কবিতার বই, বাপমায়ের দোষ মিথ্যে করে সন্তান নিজের সাহসেই নাভি পর্যন্ত হেসে ওঠে।

তাই আমার দুহাতের অনুনয়, বাইরের ভেঙে পড়াকে কুড়িয়ে এনো না তোমার স্থির আগুন ঢেকে দেবে বলে। যা নিয়েছ, তাকে বাইরের ঘরে রেখো —- যে ঘর হাসিমুখে সব ফিরিয়ে দিতে তৈরি। ওষুধের জোর কতটুকু, যদি সাড়া না দাও? অন্য সবাই সাহায্যকারী, কেবল তুমিই তোমার নবী হতে পারো। জীবনই একমাত্র ধর্মমত যাকে আজ প্রতিষ্ঠা করে যাওয়া চাই।

জেনো, যতদিন বেঁচে আছি, আমরা মৃত্যুহীন। অমরত্বের চারপাশে গুলঞ্চের বেড়া দেওয়া বলেই এত তীব্র এই পরমায়ু! জীবনের যে কোনও রুপোলি ডানা লুফথানসা অথবা লুপ্তহংস বিমানের মতো পাহাড়ের মাথাতেই ভেঙে পড়ুক আর তলিয়ে যাক প্রশান্ত মহাসাগরে, তোমার সত্তা সেই ব্ল্যাকবক্স — তুষারঝড়ের ঠোক্কর খেতে খেতে, সামুদ্রিক শ্যাওলায় জড়িয়ে গিয়েও আলো পাঠাচ্ছে, বিপ-বিপ শব্দে গুনগুন করছে, কই কিছু শুনতে পাচ্ছো না?

তুফান তো আনা হ্যায়
আ কর চলে জানা হ্যায়
বাদল হ্যায় ইয়ে কুছ পল কা
ছা কর ঢল জানা হ্যায়
পরছাঈয়াঁ রহ জাতী
রহ জাতী নিশানী হ্যায়…

6 thoughts on “সমস্ত ব্ল্যাকবক্সকে

  1. চিঠির মতো করে জীবনের সার অংশ পড়লাম প্রিয় চন্দন দা। ভালো থাকুন।

    1. অনেক ধন্যবাদ জানবেন, আজাদ ভাই। আপনি আমার লেখালিখির স্থায়ি প্রেরণার মতো।

  2. আপনি সন্দেহাতীত ভাবে ভালো লেখেন। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    কিন্তু অনুভূতি জেনে নিজের অনুভব জানাতে চান না। এটা কষ্টদায়ক। পারষ্পরিক মিথস্ক্রিয়া না হলে ব্লগিং নিরর্থক।

    ভালো থাকুন। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gif

    1. ঠিক বলেছেন মামুনভাই। কিন্তু কী করি বলুন তো! আমি জীবিকা নিয়ে এত ব্যস্ত যে আর কোনও যোগাযোগ তৈরির সময়ই থাকে না হাতে। মুরুব্বি সম্যক জানেন আমার অবস্থাটা। এ-ছাড়া আমি খুব মিশুকেও নই। তাহলে কি ব্লগটা বন্ধ করে দেওয়াই ঠিক হবে? আপনাদের মতামত চাইছি।

    2. আপনি ভুল বুঝছেন।
      আমি আপনার প্রতি ভালোবাসা এবং আপনার লেখার ভিতরের অনুভব ও সেটা থেকে লেখবার ক্ষেত্রে আমার নিজেকে কিছু শিখে আপগ্রেড করার প্রেক্ষিতে তুলে ধরেছি আপনার কাছেই।

      না, আপনি যেভাবে আমাদের জন্য লিখছেন, সেভাবেই লিখুন। আমাদেরকে আমার কথায় কষ্ট পেয়ে আপনার লেখা থেকে বঞ্চিত করবেন না।

      আপনার প্রতি অনেক ভালোবাসা।
      ভালো থাকুন, চন্দন দা’। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।