রবীন্দ্রনাথের গান: কখন ‘জাগে’, কখন ‘জাগে’ না

রবীন্দ্রনাথের গান: কখন ‘জাগে’, কখন ‘জাগে’ না

এক
কিশোরকালে যখন বলপূর্বক রবীন্দ্রনাথ শোনানো শুরু হয়, তিন টুকরো করে কেটেছিলাম ওই সংগীতকেক। প্রথম ভাগে গেয়ে গেয়ে পচে ওঠা, গেয়ে গেয়ে গভীরতা খুইয়ে শিশুদের দখলে চলে যাওয়া গানগুলো। যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তাহলে যা হবে আর কি। তার পেছনে ওঠানামার বিদ্যুতহীন একঘেয়ে অনেক দিয়েছ নাথ ধর্মসংগীত। আর শেষ ছোট অংশটা আনকোরা চমকলাগা। কোনও কোনও গোধূলিতে রবি ঠাকুর তুমি সন্ধ্যার মেঘমালার আড়াল থেকে বেশ আধুনিক এক্সাইটিং ব্যাপার-স্যাপার পাঠিয়ে দিতে!

পয়লা আর দোসরা গুচ্ছের গানগুলো গলায় তুলতে ইচ্ছেই করতো না। মা উচ্ছেভাজা দিলে যেমন ভাতের ঢিবিতে লুকিয়ে রেখে “খেলাম তো”, গুরুজিও টের পেতেন আমি কী জিনিস গুরু!

আসলে, গান শেখার জন্যে যতটা বড় হতে হয়, গান শোনার জন্যে অপেক্ষা করতে হয় অনেক বেশি। মানে দাঁড়াল, গাইয়ে বাচ্চেলোগ আর শুনিয়ে সিনিয়ার সিটিজেন। তাই ভালো গায়ক তুমি পাবে, তৈরি শ্রোতা পাবে না।

এর চেয়েও গভীর উপভোগের একটা সাম্রাজ্য আছে। সেখানে গায়ক আর শ্রোতা দুই মিলেই পরিপূর্ণ সংগীতসত্তা। তাই যে গাইতে নাচার, সে পুরোপুরি শুনতেও শেখেনি; এবং পালটা সরগমও সত্যি।

দুই
এবার শ্রোতার যত বোঝার বয়েস বাড়ে, সে তার গায়কসত্তাকে কাজে লাগিয়ে টের পায় হাজার-লক্ষবার গলাদলিত গানগুলোর শরীরে এখনও বহু বহু এরোজেনাস জোন, কেউ ছুঁয়েই দ্যাখেনি!

পঞ্চাশ বয়েসের গ্রীষ্মসন্ধেবেলা এমনি কচুকাটা এক রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে মেঝেয় বাবু হয়ে বসুন দেখি, সামনে সুমনকে ডিফাই ক’রে খাতার পাতা উড়ছে, বাঁহাত হারমোনিয়ামের ওপর ছড়ানো — আস্তে আস্তে সেই গান প্রেমিকা থেকে বউ হওয়ার মতো কোল ঘেঁষে বসবে আপনার।
শ্রোতা সব সময়ই অন্য গায়কের চশমা কিছুটা প’রে থাকে, নিজের পাওয়ার-এর সঙ্গে পুরো ম্যাচ করুক চাই না করুক। কিন্তু শুনিয়েবাবু, আপনি গাইয়েবাবা হয়ে এখন নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছেন তো গানটার কাঁধের গোলাপি তিল, পায়ের বুড়ো আঙুলের বাঁক, কনুইয়ের কালো দাগও — যেসব এতদিনের চেনাশোনা সত্ত্বেও কোনও সাগর সেন জর্জ বিশ্বাস আপনার কানে তোলেনি?

আরও একভাবে এই ক্লিশে হয়ে ওঠা গানগুলোর পুনরুজ্জীবন হয়। ভারতীয় সংগীত তো মেলোডিনির্ভর, নির্দিষ্ট অক্টেভের ওপর দাঁড়ানো। রাগ-রাগিনীতে আবার বারো থেকে বেছে মাত্র পাঁচ-সাত স্বর নিয়ে কারুকার্য। কাজেই একটা লুপ তৈরিই থাকে সুরের কাঠামোয় আর গায়কদের স্টেজে বসেই তাই শ’য়ে শ’য়ে হাতে-গরম সরগম সাপ্লাই দেওয়া সম্ভব হয়!

লুপ বলতে আবর্তন। শুধু রাগসংগীত নয়, যে-কোনও ঠিকঠাক গানেই সুরের চলনকে মন দিয়ে অনুসরণ করলে তার প্যাটার্ন আবিষ্কার করা যাবে। চোখে দ্যাখা যাবে সুরের গোটা মানচিত্রের মধ্যে কীভাবে গানটা বসানো। এর সঙ্গে কথার অর্থ মিলিয়ে নিলে গায়কির অর্ধেক গড়ে উঠল। বাকি অর্ধেকটা গাইয়ের গলা, উচ্চারণের ঢং এইসব নানাখানা দিয়ে তৈরি।

লুপ মানে অন্তঃস্পন্দন, রবীন্দ্রগানের চার স্তবককে জুড়ে দিচ্ছে আত্মীয়তায়, ফুলের ভেতর দিয়ে সুতো গিয়ে যেমন মালার জন্ম। কাজেই যতই বহুশ্রুত হোক সেই সংগীত, তার সুরের দোলনকে এই লুপ-চেনা-আলোয় নতুন ক’রে পাওয়া যাবে। আরও আকর্ষণীয় বিষয় হল, আবর্তনে সাড়া দেওয়ার ধরণ প্রত্যেক গায়কের বেলায় হবে আলাদা, তার নিজের স্বভাব অনুযায়ী।

গানকে নিঃশেষ করে গাওয়া চাই — রাতভ’র বৃষ্টির পরে দেহ যেমন; পলকা, ধবল, কাগজের মতো। হাফ নোট, সিকি নোট, মিড়, পাশাপাশি দুমাত্রাকে দেড় আর আধা-তে ভাগাভাগি — যে-কোনও গানের মতোই রবীন্দ্রসংগীতের প্রত্যেক সুরবৈশিষ্ট্যকে সাবাড় ক’রে গাইতে হবে — যেভাবে আপনি স্ট্র ডুবিয়ে ডাবের চূড়ান্ত জল টেনে নেন।

(আর এতটাই বাকি)

3 thoughts on “রবীন্দ্রনাথের গান: কখন ‘জাগে’, কখন ‘জাগে’ না

  1. সঙ্গীত বিষয়ক রম্য কাহিনি মর্মে গেঁথে নিলাম প্রিয় চন্দন দা। বাকি অংশের অপেক্ষা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_smile.gif

  2. সবসময়ই অসাধারণ করে লেখেন আপনি দাদা। ভাল লাগে।

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।