স্টিফেন হকিং আর লিওনার্দ লোদিনো-র লেখা “দ্য গ্র্যান্ড ডিজাইন”

[স্টিফেন হকিং আর লিওনার্দ লোদিনো-র লেখা “দ্য গ্র্যান্ড ডিজাইন” বইয়ের ‘হোয়াট ইজ রিয়ালিটি’ প্রবন্ধের কিছু অংশের অনুবাদ করেছিলাম দু’তিন বছর আগে। তার অল্প কিছুটা…]

বাস্তবতা কী?

কয়েক বছর আগে ইতালির মোনজা শহরের পৌরসভা গৃহপালিত পশু-পাখির মালিকদের গোল পাত্রে গোল্ডফিশ রাখার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। ব্যবস্থাগ্রহণকারী তার পদক্ষেপের আংশিক ব্যাখ্যা দেন এই বলে যে কোনও মাছকে বক্রতল-বিশিষ্ট পাত্রে রাখা একরকম নিষ্ঠুরতা, কেননা বাইরের দিকে তাকালে মাছ বাস্তবের একটা বিকৃত চেহারা দেখছে।

কিন্তু আমরা কী করে জানতে পারলাম যে আমাদের কাছেই বাস্তবের সত্য ও অবিকৃত চেহারাটাই আছে? এমন নয় তো যে আমরাই রয়েছি বড়ো গোল্ডফিশ-পাত্রের ভেতর আর একটা বিশালাকায় লেন্স আমাদের দৃষ্টি বিকৃত করে দিচ্ছে? গোল্ডফিশের বাস্তবের প্রতিচ্ছবি আমাদের চেয়ে আলাদা, কিন্তু আমরা কি নিশ্চিত হতে পারি যে সেটা কম বাস্তব?

গোল্ডফিশের দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের সঙ্গে মেলে না, তবুও তারা বৈজ্ঞানিক নিয়মের সূত্র আবিষ্কার করতে পারে যার সাহায্যে পাত্রের বাইরে দেখা বস্তুর গতিবেগ শাসন করা যায়। উদাহরণ হিসেবে, বিকৃতির জন্যে একটা স্বাধীন ভ্রমণশীল বস্তু যেটা আমাদের চোখে সরলরেখায় চলছে বলে মনে হয়, ওদের চোখে বক্ররেখা অনুসরণকারী হিসেবে ধরা দেবে। সে যাই হোক না, সোনালিমাছ তাদের বিকৃত দৃশ্য-বাস্তবতা থেকেই বৈজ্ঞানিক সূত্র প্রণয়ন করতে পারে যেটা সবসময় সত্যি হবে এবং যার জন্যে পাত্রের বাইরের বস্তুর ভবিষ্যত গতির ব্যাপারে অনুমান করতেও সক্ষম হবে তারা। আমাদের দৃশ্যজগতের নিয়মগুলো থেকে ওদেরটা আরও জটিল হবে, কিন্তু সরলতা তো কেবলমাত্র রুচির ব্যাপার। কোনও সোনালিমাছ এমন থিয়োরি তৈরি করলে তার দৃষ্টিভঙ্গিকে বাস্তবের অকাট্য ছবি হিসেবে আমাদের মেনে নিতেই হবে।

বাস্তবের পৃথক ছবির একটা উদাহরণ হল মহাজাগতিক বস্তুর গতি বর্ণনার জন্যে ১৫০ খ্রিস্টাব্দে আনা টলেমি-র (৮৫ এ.ডি.-১৬৫ এ.ডি.) মডেল। টলেমি তার আবিষ্কারটি প্রকাশ করেছিলেন ১৩ খণ্ডের ভল্যুমে সাধারণত যা আরবি “আলমাজেস্ট” নামেই পরিচিত। আলমাজেস্ট শুরু হচ্ছে — পৃথিবীর যে গোলকের মতো আকারের, নিশ্চল, ব্রহ্মাণ্ডের মাঝখানে বসে আছে আর মহাকাশের সঙ্গে দূরত্বের তুলনায় তার চেহারা হিসেবে না আসার মতোই ছোট — এর কারণ ব্যাখ্যার ভেতর দিয়ে। আবার কোপার্নিকাস ১৫৪৩ খ্রিস্টাব্দে এমন এক পৃথিবীর বর্ণনা দিলেন যেখানে সূর্য স্থির আর গ্রহগুলো বৃত্তাকার পথে তার চারদিকে ঘুরছে।

এখন, কোনটা বাস্তব, টলেমি না কোপার্নিকাসের নকশা? যদিও মানুষজনের পক্ষে এটা বলা অস্বাভাবিক নয় যে কোপার্নিকাস টলেমিকে ভুল প্রতিপন্ন করলেন, আসলে তা সত্যি নয়। যেমন আমাদের স্বাভাবিক দেখা বনাম সোনালিমাছের দেখা, যে কেউ এর কোনও একটা ছবি ব্যবহার করতে পারে ব্রহ্মাণ্ডের মডেল হিসেবে, কেননা মহাকাশ সম্পর্কে আমাদের পর্যবেক্ষণকে পৃথিবী বা সূর্য, যে কোনও একটিকে কেন্দ্রে রেখেই ব্যাখ্যা করা যায়। আমাদের মহাবিশ্বের প্রকৃতি বিষয়ে দার্শনিক বিতর্কে এর যাই ভূমিকা হোক না কেন, কোপার্নিকাসের ছাঁচের আসল সুবিধে হল স্রেফ এটুকু যে গতিবেগের সূত্রগুলোর সমীকরণ সেই ফ্রেম অফ রেফারেন্সে অনেক সরল যেখানে সূর্য স্থির অবস্থায় আছে।

এক ভিন্ন ধরণের বিকল্প বাস্তবতা দেখা গিয়েছে সায়েন্স ফিকশান সিনেমা “দ্য ম্যাট্রিক্স”-এ, যেখানে মানুষ নিজের অজান্তে বুদ্ধিমান কম্পিউটারের তৈরি এক সিমুলেটেড ভার্চুয়াল বাস্তবতার মধ্যে বাস করছে যাতে তারা শান্ত আর সন্তুষ্ট থাকে আর সেই ফাঁকে কম্পিউটার মানুষের জৈব-বৈদ্যুতিক শক্তি (সে জিনিসটা যাই হোক না কেন) শুষে নেয়। এই ভাবনা হয়তো খুব বেশি কষ্টকল্পিত নয়, কেননা অনেক মানুষ ওয়েবসাইটগুলোর অনুকারক বাস্তবতার মধ্যে সময় কাটাতে পছন্দ করে যেন এটা তাদের দ্বিতীয় জীবন।

কীভাবে জানলাম যে, কম্পিউটারের তৈরি একটা সোপ অপেরাতে আমরা জাস্ট কয়েকটা চরিত্র নই? যদি আমরা একটা কৃত্রিম কাল্পনিক জগতে বাস করতাম, ঘটনার কোনও যুক্তিগ্রাহ্যতা বা ধারাবাহিকতা থাকত না, তারা মেনে চলত না কোনও নিয়মও। ভিনগ্রহের প্রাণী যাদের নিয়ন্ত্রণে আমরা, আমাদের প্রতিক্রিয়া তাদের আরও বেশি মজার লাগত। ধরুন, পূর্ণ চাঁদ ভেঙ্গে অর্ধেক হয়ে গেল অথবা পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষের কলার ক্রিম পি-র ওপর সামলানো-যায়-না এমন এক ভয়ানক লোভ তৈরি হয়েছে। কিন্তু যদি অন্য গ্রহের প্রাণীরা নতুন কোনও নিয়ম প্রণয়ন করে থাকে, আমরা কোনওভাবেই তাদের জানাতে পারব না যে এই ছদ্মবেশী বাস্তবের বাইরেও একটা বাস্তবতা ছিল। অ্যালিয়েনরা যে পৃথিবীতে বাস করে সেটাকেই “সত্যি” বলা ঠিক হবে আর কৃত্রিম পৃথিবীকে “মিথ্যে”। কিন্তু আমাদের মতো সিমুলেটেড জগতের সত্তারা বাইরে থেকে যদি তাদের ব্রহ্মাণ্ডকে দেখতে না পায়, তাদের নিজেদের মনের ছবিকে সন্দেহ করার কোনও কারণই থাকবে না। এটা হল সেই চিন্তার আধুনিক চেহারা যে আমরা প্রত্যেকেই অন্য কারও স্বপ্নের অংশ।

3 thoughts on “স্টিফেন হকিং আর লিওনার্দ লোদিনো-র লেখা “দ্য গ্র্যান্ড ডিজাইন”

  1. সিমুলেটেড জগতের সত্তারা বাইরে থেকে যদি তাদের ব্রহ্মাণ্ডকে দেখতে না পায়, তাদের নিজেদের মনের ছবিকে সন্দেহ করার কোনও কারণই থাকবে না। এটা হল সেই চিন্তার আধুনিক চেহারা যে আমরা প্রত্যেকেই অন্য কারও স্বপ্নের অংশ। ___ অসাধারণ আয়োজন। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gif

  2. সোনালিমাছ তাদের বিকৃত দৃশ্য-বাস্তবতা থেকেই বৈজ্ঞানিক সূত্র প্রণয়ন করতে পারে যেটা সবসময় সত্যি হবে এবং যার জন্যে পাত্রের বাইরের বস্তুর ভবিষ্যত গতির ব্যাপারে অনুমান করতেও সক্ষম হবে তারা। আমাদের দৃশ্যজগতের নিয়মগুলো থেকে ওদেরটা আরও জটিল হবে, কিন্তু সরলতা তো কেবলমাত্র রুচির ব্যাপার। একমত দাদা।

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।