লোকাল ট্রেনে রোদ ধুলো আর ভিড়। কিন্তু রোদ ধুলো বোঝা যায় না — ভিড় ভিড় ভিড়। আমার সামনে এক তরুণ বাবা, তার বাঁ কাঁধে ভারি ব্যাগ, ডান কোলে পুঁচকি মেয়ে। মেয়ে কলকল করতে করতে হঠাৎ থেমে গেল — আমি ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করে গলায় ঢালছি।
তার একদৃষ্টি দেখে বললাম, খাবি?
ঘাড় কাত করতেই ক্যাপ খুলে হাতে বোতল ধরিয়ে দিয়েছি। ছোট মুখটায় ঠোঁট লাগিয়ে চকচক করে টানতে লাগল।
বাবা ধমকে উঠেছে, মুখ লাগিয়ে খাচ্ছিস কেন!
বললাম, আপনি কি পাগল হলেন! ওইটুকুন বাচ্চা উঁচু করে খেতে পারে?
হাসল সে, আর বলবেন না, জল জল করে সত্যিই মাথা খারাপ করে দেয়। এই দেখুন …।
তো দেখলাম ছেলেটার কাঁধঝোলার সাইডের খোপে এক লিটারের সবুজ ফেট্টি লাগানো বোতল। দাদু নাতি আর হাতি সিনেমাটার মতো বাপ মেয়ে এবং বিসলেরি… তিনে মিলে চলল কোথায়?
কোথায় আবার, ছেলেটার পরিষ্কার কামানো গালের দিকে তাকিয়ে মনে হল — নির্ঘাৎ শ্বশুরবাড়ি! কাল জামাইষষ্ঠী তো।
— ওর মা কোথায়, সঙ্গে আসেনি?
দুহাতে দুটো ভার, ছেলেটার বেশ কষ্ট হচ্ছিল এই ঠ্যালাগুঁতোর মধ্যে দাঁড়াতে।
— ভেতরদিকে বসার একটা সিট পেয়ে গেছে।
এ হল আমার উচ্চারিত প্রশ্নের উত্তর। তারপর সে অনেকখানি সুখী আর অল্প বিপন্ন মুখ করে কন্যায় আড়চোখ মেলে আমার না-বলা বাণীর জবাব দিল :
যতক্ষণ বাড়িতে আছি, এক সেকেন্ডের জন্যে কোল ছাড়বে না!
তখন আদুরে মেয়ে বাপের বুকের ওপর হামাগুড়ি দিয়ে কাঁধের ঝোলার দিকে হাত বাড়াচ্ছে। আমি গল্পটা টের পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে বিসলেরির বোতল টেনে নিয়ে ঢাকনি খুলে ওর হাতে ধরিয়ে দিয়েছি। আবার সেই চকচক।
বাবা হতবাক হয়ে বলল, এখুনি না খেলি! কতবার জল লাগে?
ডান হাতের উলটো পিঠে মুখ মুছে মেয়ে এবার চোখ পাকিয়েছে। তখন থেকে জল জল করছ কেন, পানি বলো পানি।
গব্বরের গুলির পরের সন্নাটা নেমে এল এক মুহূর্তে। চুপসে গেছে কচি বাবা। যেন সে এতক্ষণ বুকপকেটে চোরাই মালের মতো একটা চোরাই শব্দ লুকিয়ে নিয়ে ঘুরছিল, এইমাত্র ফাঁস!
আমি তাড়াতাড়ি পুঁচকির দিকে তাকিয়ে একই লাইন রিপিট করতে লাগলাম, “পানি আর জল একই। পানি মানেই জল, বুঝেছিস?” তারপর মনে হল, আসলে ঘাবড়ে আছে তো ওর বাবা। “যা জল তাই পানি” — ছেলেটার বাঁ কাঁধে আমার হাত উঠে এল।
চলন্ত ট্রেনে এসব সংলাপের কোনও শ্রোতা ছিল না। শুধু ভিড়ের গুনগুনের মধ্যে একজন চেঁচিয়ে উঠেছে, শালা তিনদিন হয়ে গেল বৃষ্টি নেই!
সত্যিই তো! স্বয়ংক্রিয়ভাবে আমার হাত আবার চলে গেছে নিজের পিঠব্যাগের ভেতরে।
জল খেতে খেতে শুনতে পেলাম বাপসোহাগীর হি হি হাসি:
এমা! আব্বু দ্যাখো, আমার মতন ক’রে পানি খাচ্ছে!
সংক্ষেপ বুঝবার জন্য দু'বার পড়লাম। আপনার এই লিখাটিও আমার ভালো লেগেছে।
সাধারণত দুঃখ বেদনা বিরহ নিয়ে অণুলেখা গুলো গড়ে উঠে। ঠিক তারই ভীড়ে এমন লিখা পড়লে মন আপনা আপনাই ভালো হয়ে যায়। শুভেচ্ছা প্রিয় চন্দন দা।
বাহ্ দারুণ তো !!!!! শ্রদ্ধা প্রিয় কবি চন্দন দা।
ডান হাতের উলটো পিঠে মুখ মুছে মেয়ে এবার চোখ পাকিয়েছে। তখন থেকে জল জল করছ কেন, পানি বলো পানি।
কল্পনার চোখে দেখলাম। ভীষণ ভলেো লাগার মতো লিখা।
আপনার লিখাকে আমি মন থেকে পছন্দ করি। শুভেচ্ছা জানবেন।
অদ্ভুত সুন্দর অণুলিখা।