খইয়ের অভিবাদন

এক
মৃত্যুর ঘোলাটে কেবিনে এই প্রথম পা রাখা হল
বসার গদিটা দেখছি জীবনেরই মতো —
ঘরোয়া, অগোছালো, কোনওরকমের।
কেবিন বলতে পারো, বা নীচে চাকা লাগানো সিনেমামহল, এবং গোটা ঘরটা মৃতের শিল্প-নির্দেশনার ভেতর দিয়ে ছুটে যাচ্ছে
ধড়াদ্ধড় হুটার বাজিয়ে
প্রয়াতের কীসের এত তাড়া, তার কোথায় পৌঁছোতে দেরি হয়ে যাবে আমি, স্বয়ং মরহুম, বুঝতে পারি না

দুই
পিঠে হাত রেখে যারা ট্রাকে তুলে দিল, তাদের
আঙুলে কনকচাঁপা, পকেটে খুচরোর বওছার।
তারা একটা টিম হিসেবে কাজ করে; সে গাড়ির
পেছন ধরে আসা হোক গঙ্গা পর্যন্ত,
কি জগদ্দল গেটে থেমে ভুয়ো চা, ভেজিটেবিল প্যাটিস; আর এখানেই মরুভূমির শিল্পাঞ্চল মিশতে থাকে কৃষিযোগ্য কান্নাকাটির সঙ্গে।
চিরকাল দেখেছি হাসপাতাল থেকে সকালের
একটা ফোনেই সন্ত্রাসবাদের শুরু; যেহেতু
মৃত জীবিতের মাঝখানে তেমন কোনও
ম্যাকমোহন লাইন নেই;
শুধু আজকের নেতার দিকে মুষ্টিবদ্ধ খইয়ের অভিবাদন; রাজনীতি এভাবেই আগুন কিম্বা মাটিপন্থী হল, ঘাসিরাম কোতল হল
নাটকের পাঁচমা দৃশ্যে এসে

তিন
যারা কাছের মানুষে পায়নি, কুকুরের চোখে
খুঁজছে বিশ্বাস। কাছের দোকানে পায়নি যারা
সাদা থান, রেল গেট পেরিয়ে যেতে যেতে
ভাবছে লেভেল ক্রসিংও একটা মৃত্যু…।
আমরা যে পুশ করলাম এত এত ফোয়ারা,
আর শরীরের ভেতর মনিটারে
ফুটে উঠল রামধনু…
অসুখ ধর্ষণ হলে সভ্যতা ধর্ষণান্তে খুন আমি
বলতে চাইনি কিন্তু জিভ সুড়সুড় করছে।
সরি, বিজ্ঞানের সঙ্গে আমার
উনষাট বছরের যৌনতা, কিন্তু শেষ মুহূর্তের পর
সে এভাবে বুকের ভেতর থেকে বের করে নেবে
পুরুষপাইপ, ভাবিনি মাইরি
যে কানে আসবে — রিল গোটাও, প্যাক আপ,
ভরো বিল, গাড়ি লাগাও…

চার
যাওয়ার আগে অসহায়তাকে একবার
নমস্কার করি, একবার সহানুভূতিকে। সবাই
যেন বলে ব্যবহার ভাল ছিল,
এইটুকুই তো থাকবে।
যাওয়ার আগে এই-পথ-যদি-না গাইছে
দূষিত ডানলপ-বরানগর, আমার ভাইয়ের রক্তমাংসহাড় মানে একুশবাইশতেইশে ফেব্রুয়ারি
ভুলতে পারছি না গো!
রাস্তায় ডাগর ডাগর আলো, আকাশের চুল পর্যন্ত
ঝকঝক করছে, বাকি সব অন্ধকার…
স্তম্ভের নৃমুণ্ডে আলো, কুয়াশার হোর্ডিং জ্বলে,
বাকি সব অন্ধকার…
আর আগেও বলেছি, চিরনিদ্রা এত জোরে ছুটছে
যেন বিধানসভার মুখ্য সচেতক;
‘শব্দ’ উচ্চারণ করলেই প্রতিবার
‘শবদেহ’ হয়ে যাচ্ছে কেন!

পাঁচ
পায়ের বুড়ো আঙুলে আঙুলে গিঁট বেঁধে দিয়ে
লিফটে নামিয়ে সাদা খামে মুড়ে সেলোটেপ এঁটে
বাড়ির বেল বাজিয়ে নিজের হাতের পেন
বাড়িয়ে দিয়ে গিফট হিসেবে যাকে রিসিভ করিয়ে নিল, তুমি সেই সোনাদার কাছে এক উত্তরায়ণ
বাস করেছিলে — যখন হাফপ্যান্ট ছুটছে পৃথিবীর বিকেলের ফুটবলমাঠে, হাফ প্যাডাল
ফুল প্যাডালে পরিণত হচ্ছে, দূরদেশে যার
অসহায় স্কুল পুড়ে ছাই নকশালতায়।
দহনের সেই গল্প ফিরে এল সুবীভৎস ঢাকে — কালীথানের আরতি, বুক থেকে স্টেথো তুলে
মাথা নাড়ানোর পরেও ট্রেনের ফুরনো মান্থলি
এই সর্ববারোয়ারি জিভ…!
খুলে নাও, ছিঁড়ে ফ্যালো, মুখ তুলে
দ্যাখো বলশালী —
যে ডেথ সার্টিফিকেট সে-ই পাটকাঠির সাপ্লাই
সে-ই ৯০৬ টাকার রসিদ সে-ই ঘটপুরোহিত
সে-ই বিশ্বকর্মাধিপতি সে-ই খোলা মাঠের নীচে
ফোলা ক্যারামবোর্ড

ছয়
রাস্তা দেখি। একটা মেয়ের স্তন এক মিলিমিটারও
নিচু হয়নি শোকে, পেচ্ছাপরতের প্যারাবোলা কোনও কষ্টে কেঁপে উঠছে না।
এতদিন বেঁচে ছিল সে-সবুদ গুছিয়ে রেখেছ? আজ যে পুড়িয়ে দেবে কই তার প্রণামযোগ্য প্রমাণেরা? এই ভর রাত্রিকালে ময়লাকালো তিল, বুড়ো আলোচাল, পচকুটে ঘি, নদীর পাঁকের জল মুখে দিচ্ছ; ভুলে গেলে বারবার কীরকম শ্বাসকষ্ট পেটখারাপ হতো? কী রকম ফিটফাট
চুল-আঁচড়ানো বাবু, দার্জিলিং চা-টি ছিল,
হ্যাঁ রে ভুলে গেলি…‌!

সাত
প্রত্যেক পুরুষ রাজত্ব করেছে পরিবারে, তারপর
যুবরাজকে কোলে তুলে বসিয়েছে সিংহাসনে, এবং তার পরেও ধমকাতে ছাড়েনি। তাই কখনও বাপকে বন্দী করে বক্সা দুর্গে নিক্ষেপ করেছি। তবু ওই ভূতপূর্ব রাজা ভূত ব’নে যাওয়ার আগেই দেবতা হয়েছে সমবেত কান্না আর হাতপাছোঁড়ায়। দেখে প্রত্যেকের এক মিনিটের জন্যে সূক্ষ্মভাবে দেবত্বের ইচ্ছে পায় — যেভাবে সামান্য সুতোয় ভর দিয়ে শূন্য থেকে শূন্যে উঠে যায় মাকড়সা

আট
যারা পোড়া কয়লা থেকে নম্রমুখে বেলচা মেরে
তুলল বকশিশ, যারা বন্ধুর বিনা-ডাকে ছুটে এসে
হাসপাতালে দাঁড়ায়, ওদের বাইক ছড়িয়ে পড়ুক
শেষরাতের শহরে। যারা নদীকে এতদিন নৌকো
ব’লে জেনেছে, আবিষ্কার করুক সেটি
নাভি-গোরস্থান। মৃত্যুর ভেতরে এইটুকু পাওয়া — ইহুদির মতো শোকার্তকে বুকে চেপে ধরে অচেনা মেয়েরা। ধর্মের বোবাঘট ভেঙে দেখব আর কী জমানো ছিল…নিকটে অন্ধ দেখলে মুদ্রাদোষে পাঞ্জাবির পকেটে ডুবে যাওয়া হাতের আঙুল?

নয়
চিহ্ন রেখে গেল, ছিন্ন রেখে গেল সন্তানসত্যকে। আবার ছানা কাটবে দই জমবে ধীরে, গলায়
টাই বাঁধবে অশৌচেরা।
আমরা একার ইতিহাস, আমাদের পাঠকও একজনা — উবেরওলার কাছে ইয়াদ নেহি, শাড়ির দোকানে খোঁজ সেই সামনের পুজোয়।
মৃত্যুর শোক ঢাকের শব্দের কাছে হারে, পার্টির পথসভা অতিক্রম করতে পারে না। পৃথিবী বলতে রাস্তার ধুলো ছাড়া আমাকে অন্য কিছু বোঝাতে এসো না। বাঁচা বলতে শূন্যতাসঙ্গম। গড়িমসি করি প্রেমে, শুধু মনমতো বহুতল খুঁজে জীবন কাটল।
জীবনের বাসস্থানে একটা ঝাঁপ দেওয়ার
ঘর চাই কিনা? আমার মৃত্যুর মুখ আমি-টাইপের;
আমার মৃত্যুর হাত একটু বেশি ক্লান্ত, এই যা!

দশ
তোমার বাড়ির কাছে কৃষ্ণগহ্বর আছে, তোমার পাড়ায়, দেখতে পাও না। যখন রাস্তা দিয়ে হাঁটো,
শাড়িতে লেগে যায় ব্ল্যাকহোলের ছাইরঙ কাদা,
পেছল ইঁট… আর ছায়া। এপার-ওপার ছায়া,
এ-জেলা থেকে ও-জেলা পর্যন্ত। ভেবো না কালো গর্তে আলো নেই, হলুদ বাল্বের নীচে সেই ক্যারামবোর্ড পাতা।
দেওয়ালের উপত্যকায় ঘেরা পৃথিবী, দেয়ালেই
ছোটবড় মানমন্দির। এক পাঁচিলের আড়ালে শব নামিয়ে রাখো, এক ব্যারিকেড তৈরি হয়েছে মাথাঠোকা কান্না রেখে দিতে।
ক্যারামবোর্ডের দুপাশে লোকদুটো মুখ তুলছে না। শুধু উল্টোদিকের বাক্যহীন কাঠচাপা গুটি টেনে আনছে সেকেন্ড পকেটে, সেন্টারের রেড নিখুঁত এ্যাঙ্গেল করছে, আর কেউ থমথমে গলায়
ব’লে উঠল : গুড শট।
গুটি পড়ে যেতে যেতে বলে গেল নাকি?
গুঁড়ো গুঁড়ো হলুদ আলো পা ধুতে
নেমে যাচ্ছে কৃষ্ণগহ্বরে…।

[উৎসর্গ : সোনাদা]

2 thoughts on “খইয়ের অভিবাদন

  1. অসামান্য মানের একটি উৎসর্গ প্রিয় কবি চন্দন ভট্টাচার্য।

    যেহেতু মৃত জীবিতের মাঝখানে তেমন কোনও
    ম্যাকমোহন লাইন নেই;
    শুধু আজকের নেতার দিকে মুষ্টিবদ্ধ খইয়ের অভিবাদন;
    রাজনীতি এভাবেই আগুন কিম্বা মাটিপন্থী হল,
    ঘাসিরাম কোতল হল
    নাটকের পাঁচমা দৃশ্যে এসে।
     https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।