সক্রেটিসের আবির্ভাবের সাথে সাথেই পশ্চিমা সাহিত্য এবং আধুনিক দর্শনের আমুল পরিবর্তন সাধিত হয়। যদিও সেটা সক্রেটিসের মৃত্যুর পর টের পেতে শুরু করে। হেলিনিস্টিক শতককে বলা হয় গ্রীকদের জন্য স্বর্নসময়। এসময় সক্রেটিস, প্লেটো ও এ্যারিস্টটলের কাজগুলো আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করে এবং তার পথ ধরে আর্কিমিডিস টলেমি ত্বরান্বিত করেন গ্রীক দর্শন ও ধর্ম চেতনা, মধ্য আফ্রিকা থেকে পারস্য এমনকি হিমালয়ের পাদদেশ, হিন্দুকুশ অতিক্রম করে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
তখন গ্রীক সমাজে দাসপ্রথা বেশ প্রচলিত এবং সাধারন ব্যাপার ছিলো। সমাজের উচুশ্রেনী সবসময় নিজেদেরকে একটু আলাদা করে চলতেন। প্লেটো তার রিপাবলিক ও ল বইতে একটি আদর্শ রাস্ট্রের ধারনা দিয়েছিলেন। যদিও এ যুগে এই আদর্শ রাস্ট্রের ধারনা শুনলে সবাই তেড়ে আসবে কিন্তু প্লেটোর এই ধারনা তখনকার সমসময়িক সময়ে বেশ প্রভাব ফেলে এবং এ্যারিস্ট টল এর সমূহ সমালোচনাও করেন। প্লেটোর আদর্শ রাস্ট্রে দু শ্রেনীর মানুষ থাকবে যার মধ্যে একদল শাসক আরেকদল হবে শোষিত। শাসক দল আবার দু ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগে পড়বে অভিভাবক বা তত্বাবধায়ক শ্রেনী এবং পরবর্তী ভাগ হবে তাদের সাহায্যকারী। প্লেটোর মতে বিয়ে হচ্ছে প্রকৃতি ও মানুষের শত্রূ যা শুধু সভ্যতার ধ্বংস ডেকে আনে। যেহেতু রাস্ট্র পরিচালনা করার অধিকার একমাত্র অভিভাবক বা তত্বাবধায়ক শ্রেনীর সেহেতু তাদের মধ্যে যারা বীর তারা সবচেয়ে সুন্দরী ও উর্বরা নারীদের মাধ্যমে তাদের সন্তানের জন্ম দেবে। এখানে কোনো সন্তান জানবে না তার পিতা কে, কোনো পিতা জানবে না তার সন্তান কে। এই গ্রুপের মধ্যে যে সবচেয়ে দুর্বল এবং অযোগ্য তার ভাগ্যে পড়বে কোনো কুশ্রী, দুর্বল নারী। তাদের সন্তানও হবে দুর্বল, বিকলাঙ্গ অথবা অযোগ্য শ্রেনীর। যারা একবারেই বিকলাঙ্গ তাদেরকে আলাদা করে সতর্ক ও মানবিক উপায়ে ছেটে ফেলতে হবে। এর ফলে যিনি শাসক হবেন তার ধন সম্পদ নিয়ে লোভের মাত্রা কমবে। যেহেতু তার সন্তান কে তা তিনি জানেন না সেহেতু তার জন্য সম্পদের পাহাড় বা প্রশাসনে তার জন্য স্বজনপ্রীতি বা দুর্নীতি করার সুযোগ থাকবে না। তাই রাস্ট্রপরিচালনায় তিনি নিরপেক্ষতা ও ন্যায়বিচারের আশ্রয় নিতে পারবেন। আর যেহেতু সন্তান জানবে না যে তার পিতা কতটা ক্ষমতাধর বা উচুপদে আসীন সেহেতু তাকেও নিজেকে তৈরী করতে হবে আরও উচু পদের জন্য। তাকে দেয়া হবে দার্শনিক জ্ঞান যাতে করে সে নিজেকে দর্শনের আধ্যাত্মবাদের গুরু হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন।
যদিও প্লেটো সাথে সাথে এও বলে গেছেন এরকম আদর্শ রাস্ট্র একমাত্র স্বর্গেই সম্ভব, পৃথিবীতে সম্ভব নয়, কিন্তু জন্মগতশ্রেষ্ঠত্ব ব্যাপারটা এখনও মানুষ তার অজান্তেই বহন করে। প্লেটোর এই আদর্শ রাস্ট্রের ধারনা নিষ্ঠুর, বর্বর এবং যত যাই বলি না কেন, আজ আমরা যে গনতান্ত্রিক পরিবার তন্ত্রে বসবাস করছি সেখানে সরকারী বা বিরোধী দলীয় পার্টির প্রধানেরা প্লেটোর এই জন্মগত ধারায় বিশ্বাসী হয়েই চলছে। কিছু দিন আগে ভারতে নির্বাচন হয়ে গেলো এবং সমালোচিত, নিন্দিত একইসাথে নন্দিত মোদী ফের নির্বাচিত হলেন এবং ভারতে ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতির যুগ আরও দীর্ঘস্থায়ী এবং পাকাপোক্ত হতে শুরু করলো। সেই সাথে কংগ্রেসের ভরাডুবি হলেও রাহুল গান্ধীর অযোগ্যতাকে কেও পাত্তাই দিলো না। বরংচ পার্টি হেরে যাক, পরিবারততন্ত্র বেচে থাকুক। যদিও বিজেপিতে এই পরিবার তন্ত্র নেই, তবে ধর্মনিরপেক্ষতার ঐতিহ্য বেশ ক্ষতিগ্রস্থ হলো।
পরিবারতন্ত্র বা জন্মসূত্রে শাসক হওয়ার ব্যাপারটা সৌদী আরবেও দেখা যায়। আমাদের দেশের প্রধান বিরোধী দলে তো রীতিমত আয়োজন করে সবাই পূজো করে।
প্লেটোর ছাত্র এ্যারিস্ট টল বিয়ে ও রাজনীতি নিয়ে তার বিপরীত আদর্শের চিন্তাভাবনা বেশ সুন্দর ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তার মতে “পুরুষ মাত্রই রাজনৈতিক প্রানী”। এর অর্থ হলো মানুষ জন্মগত ভাবে রাজনৈতিক মতাদর্শ নিয়ে বেড়ে ওঠে। সামাজিক জীব হবার কারনে গোষ্ঠীর বাইরে বেড়ে ওঠার কথা চিন্তা করা যায় না বলেই গোষ্ঠীর উচিত প্রতিটি মানুষকে তার স হজাত উপায়ে বেড়ে উঠার সুযোগ করে দেয়া। যদিও এ্যারিস্ট টল একটি রাস্ট্রের সরকার কি কি রূপ নিতে পারে তার একটা সরলীকৃত সংজ্ঞা দিয়ে গেছেন কিন্তু এই একবিংশ শতাব্দিতে এসেও তার এই সংজ্ঞা আমাদের সামনে খুব সহজেই ধরা দেয়। যদি একজন শাসক সবার কথা চিন্তা করে রাস্ট্র শাসন করেন তাহলে সেটা হবে রাজতন্ত্র আর যদি সে শাসক নিজের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে শাসন করেন তাহলে সেটা হবে স্বৈরতন্ত্র। যদি শাসকশ্রেনী সমাজের একটি নির্দিষ্টশ্রেনীর হয় এবং সবার স্বার্থে শাসন করে তাহলে সেটা হয় অভিজাততন্ত্র আর যদি সেই নির্দিষ্ট শ্রেনীর শাসক নিজেদের কথা চিন্তা করে তাহলে সেটা হবে গোস্ঠী শাসনতন্ত্র। আর সংখ্যাগরীষ্ঠতার ভিত্তিতে শাসক নির্বাচিত হয়ে সবার স্বার্থে কাজ করে তাহলে সেটা হবে রাস্ট্র শাসনব্যাবস্থা বা পলিটি। আর যদি সংখ্যাগরীষ্ঠতার ভিত্তিতে নির্বাচিত হয়ে নিজেদের স্বার্থে কাজ করার অর্থ হলো গনতন্ত্র। এ্যারিস্টটলের মতে সর্বোত্তম রাস্ট্রব্যাবস্থা হলো রাজতন্ত্র যার পরেই লাইনে আছে অভিজাততন্ত্র। যেহেতু বেশীরভাগ ক্ষেত্রে রাজতন্ত্র ও অভিজাততন্ত্র একসময় একনায়কতন্ত্র ও গোষ্ঠিশাসনতন্ত্রে পরিনত হয়, সে হিসেবে সবচেয়ে নিরাপদ ও ভালো অবস্থা হলো পলিটি বা রাস্ট্রশাসনব্যাবস্থা।
সে সূত্রে এ্যারিস্টটল প্লেটোর অস্থায়ী বিয়ে বা জন্মসূত্রে গোষ্ঠীর অংশ হওয়াটার বিরোধীতা করেন। তিনি পরিবারকে রাস্ট্রের অংশ হিসেবে দেখেন এবং প্রতিটা পরিবারের বিকাশ রাস্ট্রের অগ্রগতীর ধারক বলে মনে করেন। সে সূত্রে পুরো রাস্ট্রটাই হবে সকল পরিবারের রাস্ট্র যেখানে প্লেটোর রাস্ট্র হবার কথা এক পরিবার রাস্ট্র।
আসলে বিয়ে, রাস্ট্র, রাজনীতি নিয়ে এসব কথা এজন্যই বললাম আজ পত্রিকায় একটা খবর চোখে আসলো। ভগ্নীপতি তার স্ত্রীর বড় ভাইকে ফোন করে বললেন যে তার বোনের আত্মচিৎকার শুনতে। এই বলে তাকে বেদম প্রহার করতে লাগলেন। এরকম প্রহার এই প্রথম ছিলো না। বাবার মৃত্যুর পর ছোটবোনকে কোনো মতে মানুষ করে পরে তাকে বিয়ে দেয়া হয়। বিয়ের সময় যৌতুক দেয়া হয় ৩ লাখ টাকা ন গদ। কিন্তু যার সাথে বিয়ে দেয়া হয় তার দাবী ছিলো আরও বেশী। সে ঘরে এক পুত্র সন্তানের জন্মও হয়। তারপরও যৌতুকের বাকি টাকার জন্য এরকম বেদম প্রহার দিয়ে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
এরকম ঘটনা আজই প্রথম নয়, আবহমান কাল থেকেই চলছে। অনেক ক্ষেত্রে এসব প্রহারে অংশ নেন শ্বাশুড়ী ননদ এমনকি শ্বশুড় সাহেবও। প্রাচীন আব্রাহামিক ধর্মের নিয়মানুসারে আপনাকে মেয়েকে অর্থ দিয়ে বিয়ে করতে হবে এবং তার বাকী জীবনের ভরনপোষনের দায়িত্ব নিয়ে হবে। তার বদলে একজন স্ত্রী তার সতীত্ব ও গর্ভ পুরোটাই স্বামীর জন্য বরাদ্দ রাখবেন। এর অন্যথা হলে ব্যাভিচার স হ নানা শাস্তির ব্যাবস্থা আছে। যদিও আব্রাহামিক ধর্মের সর্বেশষ সংস্করন ইসলামের প্রসার এ অঞ্চলে ব্যাপক প্রসার ঘটলেও একটি মেয়ের পিতাকে অর্থ দিয়ে তাকে বিয়ে করার চল তেমন একটা দেখা যায় না। তবে নারীর সতীত্ব ও গর্ভের অধিকারের বেলায় এ অঞ্চলের মানুষের তারা কড়ায় গন্ডায় ওসুল করে ছাড়ে। সেখানে ধর্মের কড়া নিয়ম কানুন যেগুলো কিনা ক্ষেত্রবিশেষে জীবনসংহারী সেগুলো পালনেও কেও পিছপা হয় না।
এক্ষেত্রে আরো যে ব্যাপারটা আশ্চর্য লাগে আমাদের দেশে গনতন্ত্রের নামে অলিগার্কি বা গোষ্ঠীশাসনতন্ত্রের সুবাদে নারী দ্বারা সুদীর্ঘ সময় দেশ পরিচালিত হলেও নারীরা আজও অবহেলিত।
এই পারস্পরিক দ্বন্ধপূর্ন ব্যাপারগুলো আমাকে বেশ আগ্রহী গড়ে তোলে এই ভেবে যে আমাদের স্বজাতীর নৈতিকতাবোধ বানর বা শিয়ালের ডায়াস্পরার সাথে মেলে কিনা! যখন কোনো বাঙ্গালী বিদেশের মাটিতে নিজেদের সংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়ে বড় কথা বলে, তখন আমার বড্ড হাসি পায়।
এটা কি আমার দোষ? আমি আসলেই জানতে ইচ্ছুক।
নৈতিকতাবোধ নিয়ে আমাদের গর্ব করার কিছু নেই। আপনার পোস্টে উল্লেখিত দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার সংবাদটি অনুসরণ করলাম। পড়লাম জানলাম। খুব বেশী অজানাও নয়। এভাবেই চালিয়ে নিতে হবে নিজেকে। অভ্যস্ত করে নিতে হবে। ভালো থাকুন স্বপ্ন।
দিন যত যাচ্ছে বাংলাদেশের পত্রিকা খুললে পুরো দিনটাই মেজাজ বিগড়ে থাকে। এরকম নৃশংসতা, হানাহানি এখন আফ্রিকাতেও নেই। তাদের যেকোনো দেশে গেলে প্রথমেই ধাক্কা খাবেন তাদের স্মার্ট সিটি আচার আচরন কর্পোরেট কালচার সব অন্য রকম। আর সেখানে আমাদের সমাজের অবস্থা এখনো ৭০ এর দশকের মতো সেই আদিম। কিভাবে সম্ভব এমন নিষ্ঠুর হওয়া এই সময়ে?? সহ্য করা অনেক কঠিন
লেখার মধ্যে অতীত ও বর্তমান সময়ের মধ্যে সম্ভবত: একটি যোগসূত্র তৈরী করার চেষ্টা করেছেন কিন্তু তার যৌক্তিতা খুঁজে পেতে আমি ব্যর্থ হয়েছি। তবে ভিন্ন ভাবে পড়লে দুই সময়ের দু’টি তথ্য ভাল লেগেছে। আব্রাহামী ধর্মের অনুসারীদের যে বেহিসেবী হিসেব দিয়েছেন তা সত্যি হিসেবী হয়েছে।
এটা আপনার ব্যার্থতা নয়, পরিষ্কারভাবে ফুটিয়ে তুলতে না পারার অক্ষমতা আমার নিজের। দুঃখ প্রকাশ করছি
প্রথম দিকের অংশ বিশেষ পড়ে বিশেষ জ্ঞানপ্রাপ্ত হয়েছি। শেষের দিকে আপনার প্রশ্ন আছে ঠিকই তবে সম্ভাব্য উত্তর কি হতে পারে ভাবছি। সূত্র খুঁজে পাচ্ছি না। ব্যর্থ হলাম ভাই। সরি।
এখানে ব্যাক্তির দুঃখ প্রকাশের কোনো কারন দেখছি না। রাস্ট্রের সরকার, ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারীগন নিজেদের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি টিকিয়ে রাখার জন্য মিথ্যার পাহাড় গড়ে তোলে এবং এতবার উচ্চারিত করে যে তাদের ভুলগুলো চাপা পড়ে যায়। কিন্তু ভুলগুলো হারায় না, এসব ভুল একদিন বদলা নেয়, নানা ভাবে। আমরা মিথ্যার উপাসনা করি বলেই সে ভুলের প্রতিশোধ আমাদেরকে নির্মমভাবে স্পর্শ করে এবং এটাই চরম সত্য
পরামর্শ নেই। তবে আপনার লেখা বারবার করে পড়তে ইচ্ছে করে। সুন্দর।
আপনার মন্তব্য পড়ে কি উত্তর দেবো, শব্দসংকটে পড়ে গেলাম
এক্ষেত্রে আরো যে ব্যাপারটা আশ্চর্য লাগে আমাদের দেশে গনতন্ত্রের নামে অলিগার্কি বা গোষ্ঠীশাসনতন্ত্রের সুবাদে নারী দ্বারা সুদীর্ঘ সময় দেশ পরিচালিত হলেও নারীরা আজও অবহেলিত। —->>> এই কারণ ছাড়াও আরো অনেক কারণ আছে। ভালো থাকবেন। শুভেচ্ছা রইল। +
বহু কারনগুলো নিয়ে আলোচনা করার সময় কি হয়নি!!
রকম ঘটনা আজই প্রথম নয়, আবহমান কাল থেকেই চলছে। অনেক ক্ষেত্রে এসব প্রহারে অংশ নেন শ্বাশুড়ী ননদ এমনকি শ্বশুড় সাহেবও। প্রাচীন আব্রাহামিক ধর্মের নিয়মানুসারে আপনাকে মেয়েকে অর্থ দিয়ে বিয়ে করতে হবে এবং তার বাকী জীবনের ভরনপোষনের দায়িত্ব নিয়ে হবে। তার বদলে একজন স্ত্রী তার সতীত্ব ও গর্ভ পুরোটাই স্বামীর জন্য বরাদ্দ রাখবেন।
ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য
বিবিধ ঘরানার লিখা। কথায় যুক্তি আছে। এবং আত্ম জিজ্ঞাসা আসতেই পারে।
কিন্তু এখন উত্তর বা সমাধান জরুরী। পৃথিবীর বয়স হচ্ছে, আমরা বার্ধক্যে উপনীত। আমাদের সন্তানেরা কেন ভুলের মাসুল গুনবে?
যদি শাসকশ্রেনী সমাজের একটি নির্দিষ্ট শ্রেনীর হয় এবং সবার স্বার্থে শাসন করে তাহলে সেটা হয় অভিজাততন্ত্র আর যদি সেই নির্দিষ্ট শ্রেনীর শাসক নিজেদের কথা চিন্তা করে তাহলে সেটা হবে গোষ্ঠী শাসনতন্ত্র।
ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য