করোনায় আক্রান্ত প্রবাসী ছেলের মা‘কে চিঠি

72177259

বিভিন্ন দেশের, বিভিন্ন ভাষার, বিভিন্ন গোত্রের, সাদা কালো বর্ণের আটজন রোগী আছে এই ওয়ার্ডে। তার মধ্যে বাংলাদেশের মাত্র আমি একজন। কেউ কাউকে চিনি না, কেউ কাউকে জানি না শুধু একে অন্যের মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি দেখলে মনে হবে সবাই যেন দয়ামায়াহীন, বৃদ্ধ যুবক সবাই যেন নিস্তেজ ও প্রাণহীন। সবার চোখে অজানা এক আতংক সবার চোখে বেঁচে থাকার আকুল আবেদন বিশ্ব অধিপতির দরবারে।

মা‘গো আপনি তো জানেন আপনার ছেলে বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী ও ক্ষমতাবান ক্ষুদ্র এক জীবাণুর সাথে বাঁচা-মরার লড়াইয়ে লিপ্ত গ্রিসের রাজধানী এথেন্সের অনেক নামকরা ও আধুনিক হাসপাতালের বিছানায়। আপনার এবং আপনার বউমার এক অভিন্ন অভিযোগ আমি অসুখ-বিসুখের কথা বাড়িতে বলি না। বলি না এই জন্য যে, আপনারা চিন্তা করবেন তাই। এখানে মানুষের জীবন মান অনেক অনেক উন্নত যেটা বাংলাদেশের রাজধানীসহ অজপাড়ার মানুষ কল্পনাও করতে পারবে না।

অথচ এখন ছোট্ট একটা ভাইরাসে কুপোকাত হয়ে চারিদিকে নীরব নিস্তব্ধ পরিবেশ। আজ সবাই পরম শক্তিমান ঈশ্বরের কাছাকাছি নশ্বর জীবনকে বাঁচিয়ে রাখতে। এরা জ্ঞান এবং বিজ্ঞান মনুষ্য কল্যাণে এমনভাবে প্রয়োগ করেছে যে প্রতিটি কর্মই জনকল্যাণে নিহিত। আর এখন এই ভাইরাস হতে বাঁচার সমাধান খুজতে বাধ্য হচ্ছে আসমানে। তাই মনে হয় আমি আর বাঁচতে পারবো না, মা‘গো আমার সমস্ত পাপ পূণ্য আপনার চরণে। হাসপাতাল হতে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে, ইচ্ছে করে কাদা মাটির ভাঙ্গা রাস্তা দিয়ে রিক্সায় চড়ে কোনো এক সন্ধ্যায় আপনাকে জড়িয়ে ধরে বলতে এই দেখো মা তোমার ছেলে তোমার বুকে আর তুমি তখন আনন্দ অশ্রুজলে বুক ভাসাতে। রোজ আমি স্বপ্ন দেখি মা, আপনি সেজদায় পড়ে কান্না করেন আর বলেন আপনার জীবনের বিনিময় যেন আমি সুস্থ হয়ে উঠি।

তখন আমি বিছানায় ছটফট করি মা। আমি জানি আমিই মায়ের সাত রাজার ধন, গলা ছেড়ে গেয়ে উঠি “মায়ের মত এমন দরদী ভবে আর কেউ নাই”। আমার এমন বেসুরোর আওয়াজে নীরব পরিবেশে ভারী চোখে সবাই দেখতে থাকে এবং বুঝতে চেষ্টা করে যদিও ভাষাগত কারণে সবাই চুপ থাকে। তখন আমি মানি ব্যাগে থাকা সাদাকালো ছোট্ট ফটোটা উচিয়ে ধরি। একটু দূরে থাকা পাঁচ/ছয় বছরের বাচ্চাটা এসে ছবির উপর হাত বুলিয়ে জানতে চায় এই ছবির মহিলা আমার কী হয়। বাচ্চাটা আজ সকালে নতুন এসেছে মাত্র। এই ছোট্ট বাচ্চা মায়ের কোলে থাকার কথা অথচ সে লড়াই করছে নিঃসঙ্গ সৈনিক হয়ে এটম বোমার সাথে। আমি তার কথার উত্তর দিতে যাবো এই সময় শুরু হয় প্রচণ্ড কাশি সাথে অ্যাজমার কষ্ট। বাচ্চাটা দৌড়ে দূরে সরে আমার কাছ থেকে। মা, জানো হাসপাতালের ডাক্তার নার্স সবাই সেবা এবং ভালোবাসায় খুবই আন্তরিক তাই এখনো বেঁচে আছি। তবে কোন ঔষধ দিলে রোগ সারবে তা নির্ধারণে হিমসিম খাচ্ছে ডাক্তারগণ।

(দ্বিতীয় কিস্তি)।

2 thoughts on “করোনায় আক্রান্ত প্রবাসী ছেলের মা‘কে চিঠি

  1. অসুস্থ্য হয়ে হাসপাতালে অথবা দণ্ডিত হয়ে কারাগারে … দুটোই মানুষকে একাকী করে দিতে জুড়ি ভর করে না। প্রবাসকে আমি তৃতীয় স্থানে রাখতে চাই। কেননা প্রবাসখাটা মানুষ আমিও। এই একাকীত্ব যে কতটা নির্মম সহজে সবাইকে বলে বোঝাতে পারবে না। 

    যাদের মধ্যে অক্ষর জ্ঞানের কালির লালিমা আছে; তারা এমনি করে লিখতে পারবেন। যেমন আপনি পেরেছেন মি. ফয়জুল মহী। গল্পচ্ছলে হলেও নিদারুণ সত্যকে তুলে আনছেন। :(

    1. ধন্যবাদ সুপ্রিয় ভাই আপনার এমন মূল্যবান মন্তব্যের জন্য, শুভ কামনা ও ভালোবাসা রইলো অফুরান।

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।