ভানুসিংহের পদাবলী

ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত একটি কাব্যগ্রন্থ। রবীন্দ্রনাথ কৈশোর ও প্রথম যৌবনে “ভানুসিংহ” ছদ্মনামে বৈষ্ণব কবিদের অনুকরণে কিছু পদ রচনা করেছিলেন। ১৮৮৪ সালে সেই কবিতাগুলিই ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী নামে প্রকাশিত হয়। কবিতাগুলি গ্রন্থাকারে প্রকাশের পূর্বে বিভিন্ন সময়ে ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। কবিতাগুলি রচনার ইতিহাস পরবর্তীকালে জীবনস্মৃতি গ্রন্থের ভানুসিংহের কবিতা অধ্যায় বিবৃত করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

পদাবলী শব্দের অর্থ :

পদাবলী শব্দের উৎস জয়দেবের ‘মধুরকোমলকান্তপদাবলী’। ‘পদসমুচ্চয়’ অর্থে পদাবলী শব্দের প্রয়োগ প্রথম পাওয়া যায় সপ্তম শতাব্দীতে, আলঙ্কারিক আচার্য দণ্ডী-র কাব্যাদর্শে। বাংলায় সুদীর্ঘ কাল ধরে পদাবলীকে যোগরূঢ় অর্থে গানের পর্যায়ভুক্ত করবার প্রচলন চলে আসছে। পদাবলী ভারতীয় গীতিকবিতার সমৃদ্ধ ভাণ্ডারের মধ্যে অন্যতম। বৈষ্ণব সাহিত্যের অন্তর্গত এই গীতিকবিতাগুলি রাধাকৃষ্ণের প্রেম বিষয়ক। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বৈষ্ণব মতের আধিপত্যের সময় সেই অঞ্চলের বৈষ্ণব পদকর্তারা মিথিলা অঞ্চলের লৌকিক ভাষা মৈথিলীতে বৈষ্ণব পদ রচনা শুরু করেন। পরবর্তী কালে মৈথিলীর সঙ্গে অন্যান্য লৌকিক ভাষার সংমিশ্রণে একটি কৃত্রিম সাহিত্য সৃষ্টির ভাষার উদ্ভব হয় যা ব্রজবুলি নামে পরিচিত। বৈষ্ণব পদাবলিতে প্রাচীন সংস্কৃত কাব্য প্রভাবিত ছন্দের প্রাধান্য দেখা যায়, ভান বা ভানিতা অর্থাৎ পদের মধ্যে পদকর্তার নামের উল্লেখ বৈষ্ণব পদাবলীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

প্রাচীন বৈষ্ণব কবিদের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তরুণ রবীন্দ্রনাথ আনুমানিক ১৬ থেকে ২৫ বছর বয়সকালের মধ্যে ‘ভানুসিংহ’ এই ছদ্মনামে যে ২১ টি পদ রচনা করেন, তাই ভানুসিংহের পদাবলী নামে পরিচিত। আঙ্গিক ও সুর সংযোজনার বিচারে এই পদাবলী রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীত সৃষ্টির এক অন্যতম বিশিষ্ট সম্পদ।

‘জীবন-স্মৃতি’ র ‘ঘরের পড়া’ পরিচ্ছেদে কবি জানিয়েছেন, অক্ষয়চন্দ্র সরকার ও সারদাচরণ মিত্র সম্পাদিত প্রাচীন কাব্যসংগ্রহ সেই বয়সেই তার বিশেষ প্রিয় ছিল। ১২৮১ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণ মাস থেকে এই পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে মাসে মাসে বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, গোবিন্দদাস, রামেশ্বর প্রমুখ প্রাচীন বৈষ্ণব কবির পদাবলী টীকা সহ প্রকাশিত হতে থাকে ১২৮৩ অবধি। কবি জানাচ্ছেন, বাড়ির গুরুজনেরা এগুলির গ্রাহক হলেও নিয়মিত পাঠক ছিলেন না বলে এগুলো জড়ো করে আনতে বালক কবিকে বেশি কষ্ট পেতে হত না। জ্যতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে এই সংগ্রহের অনিয়মিত ভাবে প্রকাশিত খণ্ডগুলি আসত। গুরুজনদের পড়া হলে বালক কবি এগুলো সংগ্রহ করে নিতেন। বিদ্যাপতির দুর্বোধ্য বিকৃত মৈথিলী পদগুলি অস্পষ্ট বলেই বেশি করে কবির মনোযোগ টানত। কবি টীকার ওপর নির্ভর না করে নিজে বুঝবার চেষ্টা করতেন, বিশেষ কোনো দুরূহ শব্দ ও ব্যাকরণের বিশেষত্বগুলি কবি তার বালক বুদ্ধি অনুসারে যথাসাধ্য নোট করে রাখতেন একটা ছোট বাঁধানো খাতায়। এই খাতার নোট অবলম্বনে রচিত বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ, প্রাচীন কাব্য সংগ্রহ – বিদ্যাপতি, প্রাচীন কাব্য সংগ্রহ – উত্তর প্রত্যুত্তর, বিদ্যাপতির পরিশিষ্ট, প্রভৃতি ভারতী পত্রিকায় যথাক্রমে ১২৮৮ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ, ভাদ্র এবং কার্তিক সংখ্যায় পত্রস্থ হয়।

‘জীবন-স্মৃতি’ র ‘ভানুসিংহের কবিতা’ পরিচ্ছেদ থেকে জানা যায় প্রাচীন কাব্যসংগ্রহের মৈথিলীমিশ্রিত ভাষা বালক রবীন্দ্রনাথের কাছে দুর্বোধ্য ছিল বলেই তিনি বিশেষ আগ্রহ ও অধ্যবসায়ের সাথে তার মধ্যে প্রবেশের চেষ্টা করেছিলেন।

সূচনা :

রবীন্দ্রনাথ গ্রন্থের সূচনায় লেখেন:
অক্ষয়চন্দ্র সরকার মহাশয় পর্যায়ক্রমে বৈষ্ণব পদাবলী প্রকাশের কাজে যখন নিযুক্ত হয়েছিলেন আমার বয়স তখন যথেষ্ট অল্প। সময়নির্ণয় সম্বন্ধে আমার স্বাভাবিক অন্যমনস্কতা তখনো ছিল, এখনো আছে। সেই কারণে চিঠিতে আমার তারিখকে যাঁরা ঐতিহাসিক বলে ধরে নেন তাঁরা প্রায়ই ঠকেন। বর্তমান আলোচ্য বিষয়ের কাল অনুমান করা অনেকটা সহজ। বোম্বাইয়ে মেজদাদার কাছে যখন গিয়েছিলুম তখন আমার বয়স ষোলোর কাছাকাছি, বিলাতে যখন গিয়াছি তখন আমার বয়স সতেরো। নূতন-প্রকাশিত পদাবলী নিয়ে নাড়াচাড়া করছি, সে আরো কিছুকাল পূর্বের কথা। ধরে নেওযা যাক, তখন আমি চোদ্দয় পা দিয়েছি। খন্ড খন্ড পদাবলীর প্রকাশ্যে ভোগ করবার যোগ্যতা আমার তখন ছিল না। অথচ আমাদের বাড়িতে আমিই একমাত্র তার পাঠক ছিলুম। দাদাদের ডেস্ক্ থেকে যখন সেগুলি অন্তর্ধান করত তখন তারা তা লক্ষ্য করতেন না। পদাবলীর যে ভাষাকে ব্রজবুলি বলা হোত আমার কৌতুহল প্রধানত ছিল তাকে নিয়ে। শব্দতত্ত্বে আমার ঔৎসুক্য স্বাভাবিক। টীকায় যে শব্দার্থ দেওয়া হয়েছিল তা আমি নির্বিচারে ধরে নিই নি। এক শব্দ যতবার পেয়েছি তার সমুচ্চয় তৈরি করে যাচ্ছিলুম। একটি ভালো বাঁধানো খাতা শব্দে ভরে উঠেছিল। তুলনা করে আমি অর্থ নির্ণয় করেছি। পরবর্তীকালে কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ যখন বিদ্যাপতির সটীক সংস্করণ প্রকাশ করতে প্রবৃত্ত হলেন তখন আমার খাতা তিনি সম্পূর্ণ ব্যবহার করতে পেরেছিলেন। তার কাজ শেষ হয়ে গেলে সেই খাতা তাঁর ও তাঁর উত্তরাধিকারীর কাছ থেকে ফিরে পাবার অনেক চেষ্টা করেও কৃতকার্য হতে পারি নি। যদি ফিরে পেতুম তা হলে দেখাতে পারতুম কোথাও কোথাও যেখানে তিনি নিজের ইচ্ছামত মানে করেছেন ভুল করেছেন। এটা আমার নিজের মত। তার পরের সোপানে ওঠা গেল পদাবলীর জালিয়াতিতে। অক্ষয়বাবুর কাছে শুনেছিলুম বালক কবি চ্যাটার্টনের গল্প। তাঁকে নকল করার লোভ হয়েছিল। এ কথা মনেই ছিল না যে, ঠিকমত নকল করতে হলেও শুধু ভাষায় নয়, ভাবে খাঁটি হওয়া চাই। নইলে কথার গাঁথনিটা ঠিক হলেও সুরে তার ফাঁকি ধরা পরে। পদাবলী শুধু কেবল সাহিত্য নয়, তার রসের বিশিষ্টতা বিশেষ ভাবের সীমানার দ্বারা বেষ্টিত। সেই সীমানার মধ্যে আমার মন স্বাভাবিক স্বাধীনতার সঙ্গে বিচরণ করতে পারে না। তাই ভানুসিংহের সঙ্গে বৈষ্ণবচিত্তের অন্তরঙ্গ আত্মীয়তা নেই। এইজন্যে ভানুসিংহের পদাবলী বহুকাল সংকোচের সাথে বহন করে এসেছি। একে সাহিত্যের একটা অনধিকার প্রবেশের দৃষ্টান্ত বলেই গণ্য করি। প্রথম গানটি লিখেছিলুম একটা স্লেটের উপরে, অন্তপুরের কোণের ঘরে––
গহনকুসুমকুঞ্জমাঝে
মৃদুল মধুর বংশি বাজে।
মনে বিশ্বাস হল চ্যাটার্টনের চেয়ে পিছিয়ে থাকব না। এ কথা বলে রাখি ভানুসিংহের পদাবলী ছোটো বয়স থেকে অপেক্ষাকৃত বড়ো বয়স পর্যন্ত দীর্ঘকালের সূত্রে গাঁথা। তাদের মধ্যে ভালোমন্দ সমান দরের নয়।

রচনা :

কৈশোরে রবীন্দ্রনাথ অক্ষয়চন্দ্র সরকার ও সারদাচরণ মিত্র সম্পাদিত প্রাচীন কাব্য সংগ্রহ গ্রন্থের মধ্যযুগীয় মৈথিলি কবিতাগুলির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। জীবনস্মৃতি গ্রন্থে ভানুসিংহের প্রথম কবিতা রচনার যে ইতিহাসটি বর্ণিত হয়েছে তা নিম্নরূপ:

“একদিন মধ্যাহ্নে খুব মেঘ করিয়াছে। সেই মেঘলাদিনের ছায়াঘন অবকাশের আনন্দে বাড়ির ভিতরে এক ঘরে খাটের উপর উপুড় হইয়া পড়িয়া একটা শ্লেট লইয়া লিখিলাম ‘গহন কুসুমকুঞ্জ-মাঝে’। লিখিয়া ভারি খুশি হইলাম।” রবীন্দ্রনাথ ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী উৎসর্গ করেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী কাদম্বরী দেবীর স্মৃতির উদ্দেশ্যে। উৎসর্গপত্র থেকে জানা যায়, রবীন্দ্রনাথের নূতন বৌঠান কাদম্বরী দেবী তাঁকে ভানুসিংহের কবিতাগুলি ছাপাতে অনুরোধ করেন। উল্লেখ্য, এই গ্রন্থ প্রকাশের পূর্ববর্তী বছরেই আত্মহত্যা করেছিলেন কাদম্বরী দেবী। পরবর্তীকালে ভানুসিংহের পদগুলিতে কবি প্রচুর সংশোধনী আনেন।

ভানুসিংহের পদাবলী :

সূচীপত্র

১- বসন্ত আওল রে। ২- শুন লো শুন লো বালিকা। ৩- হৃদয়ক সাধ মিশাওল হৃদয়ে। ৪- শ্যাম রে, নিপট কঠিন মন তোর। ৫- সজনি সজনি রাধিকা লো। ৬- বঁধুয়া, হিয়া-পর আও রে। ৭- শুন, সখি, বাজই বাঁশি। ৮- গহন কুসুমকুঞ্জ-মাঝে। ৯- সতিমির রজনি, সচকিত সজনী। ১০- বজাও রে মোহন বাঁশি। ১১- আজু, সখি, মুহু মুহু। ১২- শ্যাম, মুখে তব মধুর অধরমে। ১৩- বাদরবরখন, নীরদগরজন। ১৪- সখি রে, পিরীত বুঝবে কে। ১৫- হম, সখি, দারিদ নারী। ১৬- মাধব না কহ আদরবাণী। ১৭- সখি লো, সখি লো, নিকরুণ মাধব। ১৮- বার বার, সখি, বারণ করনু। ১৯- হম যব না রব, সজনী। ২০- কো তুঁহু বোলবি মোয়। ২১- মরণ রে তুঁহুঁ মম শ্যামসমান।

4 thoughts on “ভানুসিংহের পদাবলী

  1. পোস্টটির সৌকর্য, পরিবেশনা এবং তথ্যাদি অসাধারণ ভাবে বিধৌত হয়েছে।
    আমার দৃষ্টিতে লিখাটিকে বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ মনে হয়েছে।

    বিশেষ করে জ্ঞান ভাণ্ডারকে যারা সমৃদ্ধ করতে ইচ্ছুক তাদের পাঠ অবশ্যক।
    গতানুগতিকের বাইরে উপস্থাপনের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ প্রিয় কবিবন্ধু। ধন্যবাদ। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_smile.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।