পালাকীর্তন ও বাউল গান পঞ্চম অধ্যায়

পালাকীর্তন ও বাউল গান পঞ্চম অধ্যায়

আজকের আলোচনার বিষয় পদাবলী কীর্তন গান ও পদাবলী কীর্তনের সংক্ষিপ্ত সারকথা

পদাবলি কীর্তনের সূচনা : বৈষ্ণব সাহিত্য ৩ প্রকার যথা – জীবনীকাব্যঃ, বৈষ্ণবশাস্ত্র ও পদাবলী কীর্তন। বাঙালি কবি জয়দেব কে বৈষ্ণব পদাবলী কীর্তন এর প্রথম পদকর্তা বলা হয়। রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা অবলম্বনে রচিত “গীতগোবিন্দম” কাব্য টি আদি বৈষ্ণব পদাবলীর নির্দশন । তবে তা বাংলায় নয় সঙস্কৃততে। মিথিলার কবি বিদ্যাপতি কে মৈথিল কোকিল বলা হয়, কারণ মিথিলার রাজসভার কবি বিদ্যাপতিও মৈথিলি ভাষায় সুন্দর পদাবলি ও অন্যান্য গীতিকবিতা রচনা করে সবাইকে মুগ্ধ করেছিলেন।

পদাবলি কীর্তনের অভিসার : প্রেমিক বা প্রেমিকা যখন গোপনে কোনো একটা নির্দিষ্ট স্থানে পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হবার জন্য যাত্রা করে তাকে অভিসার বলে। বৈষ্ণব পদাবলী কীর্তন এ কৃষ্ণের নিকট রাধার অভিযাত্রা নিয়েই অধিকাংশ অভিসার পদ রচিত হয়েছে। পদাবলী কীর্তন এ ৮ প্রকার অভিসার এর কথা বলা হয়েছে যথা – জোৎসনাভিসার, তামসী অভিসার, বর্ষা অভিসার, দিবা অভিসার, কুজঝটিকা অভিসার, তীর্থযাত্রা অভিসার, উন্নত্তঅভিসার, সঞ্চরঅভিসার ।

পদাবলি কীর্তনের বিরহ : পদাবলী কীর্তন এ ‘ বিরহ ‘ প্রেমেরই একটি বিশেষ পর্যায় যা পূর্ণ করে তোলে মিলনের আনন্দ ধারাকে। রাধা কৃষ্ণের মধ্যে সাময়িক বিষাদ জনিত অবস্থাকে বিরহ বলা হয়। যা বৈষ্ণব পদাবলী কীর্তনের ভাষায় ” বিপ্রলম্ভ শৃঙ্গার ” নামে পরিচিত। মাথুর পদাবলির চির বিরহের আর্তিমূলক পদাবলী কীর্তন কংসকে বধের জন্য কৃষ্ণ তার প্রিয় লীলাভুমি বৃন্দাবন ত্যাগ করে মথুরায় চলে গেলেন। রাধার সঙ্গে আর দেখা হয় না। কৃষ্ণকে হারিয়ে রাধা বেদনার করুন ক্রন্দনে ভেঙে পড়েছেন, এ বিষয় নিয়ে রচিত হয় মাথুর পদাবলী কীর্তন।

কীর্তনের প্রেমবৈচিত্র :প্রেমাবিষ্ট হৃদয়ের একটি বিশিষ্ট ভাবকে প্রেমবৈচিত্র বলা হয়। প্রেমিকের নিবিড় সানিদ্ধে থাকা সত্তেও প্রেমিকার মনে হয় এই বুঝি প্রেমিক চলে যাচ্ছেন, কিংবা প্রেমিককে তিনি হারাচ্ছেন। এই সংশয়পূর্ণ অনুভুতি হলো প্রেমবৈচিত্র। কীর্তনে কৃষ্ণের প্রধান প্রেমিকা শ্রীরাধাকে নায়িকা বলা হয়। পদাবলী কীর্তন নায়িকার আটটি অবস্থা যথা -অভিসারিকা, বাসকসজ্জা, উৎকণ্ঠিতা, বিপ্রলব্ধা, খণ্ডিতা,কোলহান্ত, রিতা, প্রোষিতভর্তিকা ও সাধীনভর্তিকা । বৃন্দাবনে শ্রীরাধা ললিতা, বিশাখা, চন্দ্রাবলী সমর্থ নায়িকা এদের মধ্যে শ্রীরাধা হলেন সর্বশ্রেষ্ঠ। গোপীদের ভক্তির অনুসরণে অন্যরা যখন কৃষ্ণকে ভক্তি করেন তাকে ” রাগানুরাগ” ভক্তি বলে ।

বাংলার ইতিহাসের প্রাচীন লোকসংস্কৃতির ধারায় অনেক খানি জুড়ে রয়েছে পদাবলী কীর্তন গান। রাঢ় বাংলার গ্রামে গ্রামে ক্রমশ হারাতে বসেছে পদাবলী কীর্তন গান। হারিয়ে যাচ্ছে প্রাচীন রীতির গায়ক ও গায়কি। এক সময় পদাবলী কীর্তন গেয়ে দেশ- বিদেশে নাম কিনে এনেছিল রথীন ঘোষ, বীরভূমের ময়নাডালের প্রভাত মিত্র ঠাকুররা। গৌড় লীলার ইতিহাস খ্যাত, নিজস্ব শৈলীতে বাংলা জয় করেছিলেন গৌরীশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।

এখনও জগৎ জোড়া নাম রয়েছে সন্তোষ ভট্টাচার্যদের। তাঁর সুযোগ্য পুত্র সুমন ভট্টাচার্যও বাংলার পদাবলী কীর্তন গানকে দেশ ও বিদেশের জনদরবারে পৌঁছে দিয়ে যাচ্ছেন। এ সময় বাংলার জনদরবারে বাংলার কীর্তন গানকে পৌঁছে দিচ্ছেন সুপ্রিয়া হালদার, চৈতালি চট্টরাজ, কৃষ্ণ পাল, নদীয়ানন্দন মিশ্র, অঞ্জন ভট্টাচার্য, মলয় ঘোষ, কানাই মুখোপাধ্যায়, ননীগোপাল পাণ্ডে, বিনদবিহার মুখোপাধ্যায়, গৌড়গোপাল ব্রহ্মচারীরা।

এছাড়াও অনেক কীর্তন শিল্পী রয়েছেন যারা বাংলা, উড়িষ্যার বিভিন্ন গ্রামে বসবাস করছেন। ঝাড়খণ্ডের বিভিন্ন গ্রামেও রয়েছে কীর্তন শিল্পী। ওপাড় বাংলার কুষ্টিয়া, সিলেট, চট্টগ্রাম অঞ্চলে রয়েছেন পদাবলী কীর্তন শিল্পীরা। রাঢ় বাংলার বাঁকুড়া, বীরভূম, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে মিলিয়ে রয়েছে হাজার দশেকেরও বেশি কীর্তন শিল্পী। যাঁরা মূলত পদাবলী কীর্তন গানই করে বেড়ায় বিভিন্ন গ্রামের চব্বিশ প্রহর, হরিনাম, অষ্টপ্রহরের আসরে। তবে সে বাজারে ক্রমশ পড়তে বসেছে, জানা যাচ্ছে বিভিন্ন কীর্তন শিল্পীদের সঙ্গে কথা বলে।এছাড়াও ব্যপক ব্যয় ভারের জন্য, অনেক গ্রামেই ১৫০- ২০০ বছরের প্রাচীন কীর্তনের আসর ক্রমশ বন্ধ হতে শুরু করেছে।

এই মন্দার বাজারেও পূর্ব বর্ধমানের বেশকিছু গ্রামে আজও বসছে পদাবলী কীর্তনের আসর। পূর্ব বর্ধমানের আউশগ্রামের রামনগর অঞ্চলের গোপালপুর উল্লাসপুর গ্রামের উদ্যোগে বসেছে তিন দিনের পদাবলী কীর্তনের আসর ও নামযোগ্য। সেই সঙ্গে অনাথ, এবং সাধারণ মানুষকে দু’ বেলা অন্নছত্র দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। উদ্যোক্তাদের প্রধান পরিধন কর্মকার জানান,” ১৫ বছর ধরে আমরা মানুষের কাছে ভিক্ষা করে, দুই গ্রাম মিলে পদাবলী কীর্তনগানের আসর ও নামযোগ্য, সেই সঙ্গে নরনারায়ণ সেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। বাংলার নানা প্রান্তের মানুষ এসে আমাদের এখানে পদাবলী কীর্তন গান শুনতে আসেন।”

পূর্ব ও পশ্চিম বর্ধমানের বিভিন্ন গ্রামে এই চৈত্র মাস থেকে শ্রাবণ মাস পর্যন্ত বসে কীর্তন গানের আসর। তবে গেটা দশ বছরে বীরভূম, বর্ধমান, বাঁকুড়া জেলায় বিভিন্ন গ্রাম মিলিয়ে প্রায় শতাধীক কীর্তন গানের আসর বন্ধ হয়ে গেছে। বাংলার বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে ছিল পদাবলী কীর্তন গানের চর্চা। রামনগরের অধিকারী বংশের সেই রেওয়াজ বন্ধ হয়ে গেছে। কেতুগ্রামের ঞ্গানদাস কান্দরা, দধিয়াবৈরাগী তলায়, মঙ্গলকোটের কাশেমনগরের বৈষ্ণবদের বৈঠকী কীর্তন গানের আসরও উঠে যেতে বসেছে। বীরভূমের ময়নাডালের রাজশাহী কীর্তন ঘরানাতেও ভাটা পরেছে। নদীয়ার বিভিন্ন গ্রামের কীর্তন শিল্পীরাও চিরাচরিত প্রথা ছেড়ে চলে যাচ্ছে অন্য পেশায়। বাংলার বিভিন্ন গ্রামের লোক পদাবলী কীর্তন শিল্পীদের অভিযোগ, আমরা এখনও সরকারি কোনো সাহায্য পায়নি। পায়নি শিল্পীকার্ডও।

আজকের বিষয় বাউলগান
কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

বাউল গান বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা

বাউলগান বাউলসম্প্রদায়ের সাধনসঙ্গীত। বাউলদের ধর্মবিশ্বাস ও জীবনচরণের সঙ্গে এই গনা সম্পৃক্ত। এই গানের প্রবক্তাগণের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ফকির লালন শাহ্, পাঞ্জু শাহ্ এবং দুদ্দু শাহ্। এঁরা বাউলমতালম্বী ফকির ছিলেন। তাঁদের এবং অন্যান্য বাউলসাধকদের বিরচিত গান গ্রামাঞ্চলে ‘ভাবগান’ বা ‘ভাবসঙ্গীত’ নামে পরিচিত ছিল। কেউ কেউ এসব গানকে ‘শব্দগান’ ও ‘ধুয়া’ গান নামেও অভিহিত করেছেন। এখানে উল্লেখ্য, বাউলগান পরিবেশনায় সাধারণত দুটি ধারা লক্ষ্য করা যায়। একটি, আখড়াআশ্রিত সাধনসঙ্গীত। এখানে গানের ঢং এবং সুর শান্ত এবং মৃদু তালের। অনেকটা হামদ্, গজল কিংবা নাত অনুসারী। লালন ফকিরের আখড়ায় ফকিরেরা বসে বসেই এইসব গান করে থাকে। অপর ধারা, আখড়ার বাইরে অনুষ্ঠানাদিতে, জনসমক্ষে_এই গান চড়া সুরে গীত হয়। তখন একতারার সঙ্গে যুক্ত হয় ডুগী, খমক এবং প্রেমজুড়ি, কখনো ঢোলক, সারিন্দা কিংবা দোতারা। তাল: দাদরা, কাহারবা; কখনো ঝুমুর, একতালা কিংবা ঝাঁপতাল। শিল্পীরা নেচে নেচে গান করে। কখনো গ্রামে অসুখ-বিসুখের প্রাদুর্ভাব হলে ভাবসঙ্গীতের মাধ্যমে নিরাময়ের জন্য প্রার্থনা করা হয়। বাউলেরা কখনো একক আবার কখনো দলগতভাবে সঙ্গীত পরিবেশন করে। বাউল বা ভাবগানের একজন মূল প্রবক্তা থাকে। তার গানের সঙ্গে অন্যেরা ধুয়া বা ‘পাছদুয়ার’ ধরে। তাদের কারও কারও হাতে থাকে খমক, জুড়ি ইত্যাদি।

প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে বাউলগানে নাচের প্রচলন রয়েছে। লালন ফকিরের গানেও তা বিদ্যমান। এসব গানে নাচের কোনো মুদ্রা প্রদর্শিত হয় না। এটা সুফিদের ‘হাল’ এবং বাউল প্রভাবিত বৈষ্ণবগানের ‘দশা’র সঙ্গে তুলনা করা চলে। বাউলগানে নাচের প্রবর্তন কবে হয়েছে সে সম্বন্ধে কোনোকিছু তেমন জানা যায় না। শান্তিদেব ঘোষের মতে এই নাচের উৎস হলো গ্রামীণ পাঁচালীগান। ‘গম্ভীরা’ গানেও নাচের প্রচলন রয়েছে। আমাদের দেশে লাঠিখেলা নৃত্যসহযোগে অনুষ্ঠিত হয়। এখানে তাল ও সুর নৃত্যের অনুষঙ্গী।

যাহোক, বাউলগানের নাচ কোনো বিশেষ রীতিতে বাধাধরা নাচ নয়। বাউল যেখানে যে ছন্দ পেয়েছে তাই-ই সে গ্রহণ করেছে অত্যন্ত সহজভাবে। চেষ্টাকৃত কোনো নৃত্যছন্দ সে পছন্দ করেনি। গান গাইবার রীতিতে সে যত প্রকার ছন্দ পেয়েছে তাকেই সে নৃত্যরূপ দিতে চেষ্টা করেছে। যার নাচতে ভালো লেগেছে, সে নেচেছে। যার ইচ্ছা করেনি। সে নাচেনি। বাউলগানের নাচ তাই সঙ্গীতের অবশ্যকরণীয় কিছু নয়। এ গানে নাচে অন্তর্ভুক্তি জনগণের মনোরঞ্জনের কারণেই আখড়া আশ্রিত সাধনসঙ্গীতে এর প্রচলন নেই। সেখানে সাধক নিবেদিত প্রাণ_ অনেকটা ধ্যানীর ভূমিকা। কিন্তু আখড়ার বাইরে হাজার মানুষের সম্মুখে বাউল প্রায়শ চড়া সুরে নৃত্যভঙ্গিমায় গান পরিবেশন করে থাকে। যশোরের কানাই ক্ষ্যাপা, মহেন্দ্র গোঁসাই বাউলগানে নৃত্যের অন্তর্ভুক্তি করেছিলেন। তবে একটি বিশেষ পর্যায়ে এসে বাউলগানকে তার গানের দাবিতেই দেহকে নৃত্যসর্বস্ব করে তোলে। বাউলগীতির শ্রেণিবিন্যাস সাধারণত দুই প্রকার : দৈন্য এবং প্রবর্ত। এই দৈন্য এবং প্রবর্ত ভেঙে রাগ দৈন্য এবং রাগ প্রবর্ত। এখানে ‘রাগ’ শাস্ত্রীয় সংগীতের ‘রাগ’ নয়, ভজন সাধনের রাগ। বৈষ্ণব রসশাস্ত্রের মতো বাউলগানে ‘রাগ’ শব্দটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এখানে ‘রাগ’ অর্থ ‘অভিমান’ এবং প্রেমের নিবিড়তা বোঝায়। ইষ্টের প্রতি নিবেদিত প্রেমের প্রগাঢ় ও পরিপক্ব অবস্থার নামই ‘রাগ’। ‘রাগ দৈন্য’ এমন ভাব লক্ষণীয়। রাগের সাথে বাউলের ভাবগত সংযোগ আছে। সুফি আশেকের সঙ্গে মাশুকের যে প্রেম ও অভিমান, তাই-ই ‘রাগ’। বাউলেরা তাদের সাধনপন্থাকে ‘রাগের করণ’ বলে অভিহিত করে থাকে। লালনের কথায় :

আমরা হয় না সে মনের মতো মন

আগে জানব কি সে রাগের করণ।

বাউলগানে কেউ কেউ শাস্ত্রীয় রাগসঙ্গীতের প্রভাবের কথা বলেছেন। বাউলগান মূলত ধর্মীয় লোকসঙ্গীতের পর্যায়ভুক্ত। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের উন্মেষ ও বিকাশ লোকসঙ্গীতের অনেক পরবর্তীকালে। আধুনিক সঙ্গীতশিল্পীদের কণ্ঠে কখনো কখনো রাগের ব্যবহার দেখা যায়, তবে তা সর্বক্ষেত্রে অপরিহার্য নয়।

বাউলগান সচরাচর যেভাবে গাওয়া হয়ে থাকে, তাতে দুই প্রকার সুর লক্ষ্য করা যায়। প্রথম কলি অর্থাৎ আস্থায়ীতে এক সুর, অন্য সব কলিতে সে সুর বেশকিছুটা ভিন্ন। সবশেষে পুনরায় দ্রুতগতিতে দ্বিতীয় কলির অংশবিশেষ গীত হয়ে থাকে। বাউলগানে আস্থায়ী এবং অন্তরাই প্রধান। আস্থায়ীকে কখনও ধুয়া বা মহড়া বলা হয়। আরম্ভের জন্য কোনো নির্দিষ্ট সুর নেই। প্রতি অন্তরার পরে আস্থায়ী গাইতে হয়। কোনো কোনো বাউলগানে সঞ্চারী লক্ষ্য করা যায়। বাউলগানে, বিশেষ করে লালনের গানে সৈন্যপদে কখনো একটা টানা সুর লক্ষ্য করা গেলেও লালনের গান প্রায়ই দ্রুতলয়ের।

বাউলগানে যে নাচের প্রচলন রয়েছে তা সুফিদের ‘হাল’-এর সাথে তুলা করা চলে। কিছু কিছু বাউলগান কীর্তন-আশ্রিত। বৈষ্ণবপ্রভাবের ফলে এমনটি হয়েছে। তবে বাউলগানে সুফিভাবনাই প্রবল। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, পশ্চিমবাংলা (ভারত) এবং বাংলাদেশের বাউলগানে সুরের পার্থক্য রয়েছে। পশ্চিমবাংলায় সহজিয়া বৈষ্ণব সুরের আধিক্য, বাংলাদেশে সুফি গজলের_ যার একটি দেশজরূপ: ভাব ও শব্দগান। তবে বাউলের গানে একটি উদাসীন ভাবনা লক্ষ্য করা যায়। একটি বেদনার ছোঁয়া যেন তার সুরের পরতে পরতে। না-পাওয়ার বেদনা কেবলই তার কণ্ঠে বাজে। বাউলগানের একটি বড় সম্পদ তার গায়কী বা গায়নশৈলী। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বাউলগান একটি বিশেষ অঞ্চলে রচিত হলেও সঙ্গীতশিল্পীদের কারণে অঞ্চলবিশেষের প্রভাব তার উপর পড়ে। ফলে সুর এবং গায়কীতেও আসে পরিবর্তন। কখনো কখনো শব্দেও পরিবর্তন ঘটে যায়।

অতীতে বাউল কিংবা লালনের গানে ঢালাও জাতীয় সুর ছিল, যার কোনো নির্দিষ্ট সাঙ্গীতিক বাঁধন ছিল না। কিন্তু পরবর্তীতে লালনশিষ্য মনিরুদ্দিন ফকির এবং তার শিষ্য খোদা বখস্ এই গানের একটি ‘ছক’ বাঁধার প্রচেষ্টা নেন। খোদা বখসের শিষ্য অমূল্য শাহ একজন বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন। তিনি বাউল তথা লালনগীতির একটি সংগীতকাঠামো নির্মাণ করেন বলে জানা যায় এবং তার শিষ্য বেহাল শাহ্, শুকচাঁদ, দাসী ফকিরানী, গহর, নিমাই শাহ, মহেন্দ্র, কানাই ক্ষ্যাপা, মতি ফকিরানী এই গানের শ্রীবৃদ্ধি ঘটান। পরবর্তীতে মহিন শাহ, খোদা বখ্স শাহ, ঝড়ু শাহ্, করিম, বেল্লাল, ফকির চাঁদ, জোমেলা, খোরশেদ ফকির, লাইলি, তক্কেল ও ইয়াছিন শাহ্ প্রমুখ এর আরও উৎকর্ষ সাধন করেন। বেতার ও টেলিভিশন শিল্পী মকছেদ আলী শাহ বাউল ও লালনগীতির আধুনিকীকরণ করেন এবং শিষ্য ফরিদা পারভীন বর্তমানে লালনগীতির সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় শিল্পী_বাউল ও লালন গানে নতুন মাত্রা ও সুর সংযোজন করেছেন।

এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কথা এসে যায়। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, তিনি প্রায় গানে বাউলের সুর গ্রহণ করেছেন। কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীতে কীভাবে তার অন্তর্ভুক্তি হল সে সম্বন্ধে তিনি কিছু বলেননি। এ সম্পর্কে শান্তিদেব ঘোষ বলেন : ‘বাংলার নিজস্ব সুর এবং ঢঙে রচিত গুরুদেবের গানের আর একটি নতুন সৃষ্টির প্রকাশ আমাদের কাছে ধরা পড়ে, যাকে আমি বলি রাবীন্দ্রিক কীর্তন বা রাবীন্দ্রিক বাউল_ অর্থাৎ আচার ইত্যাদি বর্জিত, বাউলের প্রভাবযুক্ত ও গুরুদেবের শান্তিনিকেতনের জীবনে যার সূত্রপাত। সেই গান আসলে কীর্তন ও পূর্ববঙ্গের বাউলদের সুরের মিশ্রণে উদ্ভুত এক বিশেষ সুরের গান। জীবনের শেষ পর্বেই এই গান তিনি সবচেয়ে বেশি রচনা করেছেন। এই গানে বাউল সারিগানের মতো জলদ লয়ের ছন্দ পায়; কিন্তু তা কেবল বাউলের মতো চার বা তিন মাত্রা ছন্দে ও তালে বাঁধা নয়; এতে তেওড়া, ঝাঁপতালও স্থান পেয়েছে। কিন্তু ত্রিতাল, চৌতাল ইত্যাদি উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের তালগুলো একেবারেই এ গানে স্থান পায়নি।’ আমরা জানি, রবীন্দ্রনাথ রচিত আমাদের জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ এই গানটি শিলাইদহ (কুষ্টিয়া) অঞ্চলের বাউল গগন হরকরা রচিত এবং গীত ‘আমার মনের মানুষ যে রে আমি কোথায় পাব তারে’ এই সুরে গাওয়া। এমনিভাবে নজরুলের অনেক গান বাউলসুর প্রভাবিত বলে আমরা জেনে আসছি। এখানেও সেই একই সমস্যা। হাজার বছর আগে চর্যাপদে কী সুর ব্যবহৃত হতো, তা আমাদের জানা নেই। কোনো কোনো পদে রাগরাগিণীর কথা বলা হয়েছে সত্য, কিন্তু তার চেহারা বুঝবার উপায় এখন আর নেই। এভাবেই আমাদের লোকসঙ্গীতের অনেক সুর হারিয়ে গেছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বাউল গান মূলত বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গীত, বৃহত্তর কুষ্টিয়া এবং যশোর জেলায় এ সঙ্গীতের উদ্ভব এবং বিকাশ। এ অঞ্চলে নদীর সংখ্যা তেমনি বেশি নয়।

তথ্যসূত্র: দৈনিক জনতা

লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী সম্পর্কে

লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী –নামেই কবির পরিচয়। কবির বাড়ি পশ্চিমবঙ্গে বর্ধমান জেলার পাথরচুড় গ্রামে। প্রকৃতির সাথে পরিচয় ছোটবেলা থেকেই। বর্তমানে কবি বাংলা কবিতার আসর, বাংলার কবিতা ও কবিতা ক্লাবের সাথে যুক্ত। অবসর সময়ে কবি কবিতা লেখেন ও স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেন। কাব্যচর্চার সাথে সাথে তিনি সাহিত্যচর্চাও করেন। গল্প ও রম্য রচনা আর ছোট গল্প লিখেন। বহু একাঙ্ক নাটকও তিনি লিখেছেন। অন্ধকারের অন্তরালে, সমাজের শত্রু ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও বহু যাত্রাপালা -সোনা ডাকাত, শ্মশানে জ্বলছে স্বামীর চিতা উল্লেখযোগ্য। কবির অভিনয় প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে বিচারক মণ্ডলী তাঁকে বহু সম্মানে ভূষিত করেছেন। লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী একাধারে কবি ও অপর দিকে লেখক। তার লেখা “আমার গাঁ আমার মাটি”, আমার প্রিয় শহর জামুরিয়া, আমার প্রিয় শহর কুলটি, আমার প্রিয় শহর আসানসোল, আমার প্রিয় শহর রাণীগঞ্জ বহু পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী প্রকৃতপক্ষে হিন্দু ধর্মাবলম্বী হয়েও তিনি অন্য ধর্মকেও শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করেন। তিনি বিশ্বাস করেন সব মানুষই ঈশ্বরের সন্তান। তাই ধর্মে আলাদা হলেও আমরা সবাই ভাই ভাই।

12 thoughts on “পালাকীর্তন ও বাউল গান পঞ্চম অধ্যায়

  1. লিখাটি শেয়ার করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ মি. ভাণ্ডারী। এমন পোস্টে মন্তব্য কম হবে এটা সহজে অনুমান করা যায়, তাই বলে পকাশনা বন্ধ করা চলবে না। সংশ্লিষ্ট বা উৎসুক যারা তারা নিশ্চয়ই আপনার পোস্ট অফলাইন অথবা অনলাইনের পাঠক হবেন। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

    1. প্রেমবৈচিত্র। কীর্তনে কৃষ্ণের প্রধান প্রেমিকা শ্রীরাধাকে নায়িকা বলা হয়। পদাবলী কীর্তন নায়িকার আটটি অবস্থা যথা -অভিসারিকা, বাসকসজ্জা, উৎকণ্ঠিতা, বিপ্রলব্ধা, খণ্ডিতা,কোলহান্ত, রিতা, প্রোষিতভর্তিকা ও সাধীনভর্তিকা   বৃন্দাবনে শ্রীরাধা ললিতা, বিশাখা, চন্দ্রাবলী সমর্থ নায়িকা এদের মধ্যে শ্রীরাধা হলেন সর্বশ্রেষ্ঠ। গোপীদের ভক্তির অনুসরণে অন্যরা যখন কৃষ্ণকে ভক্তি করেন তাকে ” রাগানুরাগ” ভক্তি বলে 

      আপনার মন্তব্যে অনুপ্রেরণা পাই
      সতত সাথে থাকবেন
      প্রত্যাশা রাখি
      জয়গুরু!

    1. আপনার মন্তব্যে অনুপ্রেরণা পাই।

      ধন্যবাদ জানাই প্রিয় কবিবর।
      সতত সাথে থাকবেন।
      প্রত্যাশা রাখি।
      জয়গুরু!

  2. আলোচ্য টপিকস্ এ চোখ বুলিয়ে নেয়া যেতে পারে। কিন্ত মনে রাখা কঠিন।

    1. আপনার সুন্দর মন্তব্যে অনুপ্রেরণা পেলাম।

      আন্তরিক প্রীতি আর শুভেচ্ছা জানাই।
      সতত সাথে থাকবেন।
      প্রত্যাশা রাখি।
      জয়গুরু!

  3. শেয়ারে শুভেচ্ছা কবি ভাণ্ডারী দা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

    1. আপনার সুন্দর মন্তব্যে অনুপ্রেরণা পেলাম।আন্তরিক প্রীতি আর শুভেচ্ছা জানাই।
      সতত সাথে থাকবেন প্রিয় কবি প্রতীম।
      প্রত্যাশা রাখি।
      জয়গুরু!

    1. আপনার সুন্দর মন্তব্যে অনুপ্রেরণা পেলাম। 

      আন্তরিক প্রীতি আর শুভেচ্ছা জানাই।
      সতত সাথে থাকবেন প্রিয় কবি।
      প্রত্যাশা রাখি।
      জয়গুরু!

  4. খুব দামি পোস্ট। এই পোস্টের কন্টেন্টের কারণে আগেরগুলি সময় করে পড়ে নেয়ার আগ্রহ জন্মালো। 

    সাধুবাদ জানাচ্ছি!

    1. পাতায় সুস্বাগতম প্রিয় কবিবর। আপনার আন্তরিকতায় ধন্য হলাম।
      আপনার সুন্দর মন্তব্যে অনুপ্রাণিত হয়ে নতুন করে ভালো লেখার
      অনুপ্রেরণা পেলাম।সতত সাথে থাকবেন

      প্রত্যাশা রাখি
      জয়গুরু!

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।