পালাকীর্তন ও বাউলগান দশম অধ্যায়
সংগ্রহ ও সম্পাদনা- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
রাধা-কৃষ্ণ লীলা কীর্তন
প্রেম মানুষের একটি ‘দৈব গুণ’। দেবকুলেও এই প্রেমের সদর্প পদচারণা, যার বিরহ ব্যথায় কাতর হয়েছিলেন রাধা-কৃষ্ণও। হিন্দু পুরাণমতে, উভয়েই ঈশ্বরের ইচ্ছায় মর্তে মানবরূপে জন্ম নিয়েছিলেন। কৃষ্ণ পাপী কংস রাজাকে বধ করার জন্য দেবকী ও বাসুদেবের সন্তান হিসেবে জন্ম নিয়েছিলেন। কংস কৃষ্ণকে হত্যা করতে পারে- এই ভয়ে কৃষ্ণের জন্মমাত্র বাসুদেব গোপনে তাকে অনেক দূরে বৃন্দাবনে জনৈক নন্দ গোপের ঘরে রেখে আসেন। সেখানেই দৈব ইচ্ছায় আরেক গোপ সাগর গোয়ালার স্ত্রী পদ্মার গর্ভে জন্ম নেয় রাধা।
দৈব নির্দেশেই বালিকা বয়সে নপুংসক (ক্লীব) অভিমন্যু বা আইহন বা আয়ান গোপের (ঘোষের) সঙ্গে রাধার বিয়ে হয়। আয়ান গোচারণ করতে গেলে বৃদ্ধা পিসি বড়ায়ি রাধার দেখভাল করত।
রাধা ঘর থেকে বের হয়ে অন্য গোপীদের সঙ্গে মথুরায় দই-দুধ বিক্রি করতে যায়। বড়ায়ি তার সঙ্গে যায়। বৃদ্ধা বড়ায়ি পথে রাধাকে হারিয়ে ফেলে এবং রাধার রূপের বর্ণনা দিয়ে কৃষ্ণকে জিজ্ঞেস করে, এমন রূপসীকে সে দেখেছে কি-না। এই রূপের বর্ণনা শুনে রাধার প্রতি কৃষ্ণ পূর্বরাগ অনুভব করে। সে বড়ায়িকে বুঝিয়ে রাধার জন্য পান ও ফুলের উপহারসহ প্রস্তাব পাঠায়।
কিন্তু বিবাহিত রাধা সে প্রস্তাব পদদলিত করে।
এরপর একদিন দই-দুধ বিক্রির জন্য মথুরাগামী রাধা ও গোপীদের পথ রোধ করে কৃষ্ণ। তার দাবি- নদীর ঘাটে পারাপার-দান বা শুল্ক দিতে হবে, তা না হলে রাধার সঙ্গে মিলিত হতে দিতে হবে।
রাধা কোনোভাবেই এ প্রস্তাবে রাজি হয় না। এদিকে তার হাতে কড়িও নেই! সে নিজের রূপ কমানোর জন্য চুল কেটে ফেলতে চাইল এবং বেয়ারা কৃষ্ণের হাত থেকে বাঁচার জন্য বনে দৌড় দিল! এরপর থেকেই রাধা, কৃষ্ণকে এড়িয়ে চলে।
কৃষ্ণ নদীর মাঝির ছদ্মবেশ ধারণ করে। একজন পার করা যায় এমন একটি নৌকায় রাধাকে তুলে সে একদিন মাঝনদীতে নিয়ে নৌকা ডুবিয়ে দেয় এবং রাধার সঙ্গ লাভ করে। নদীতীরে উঠে লোকলজ্জার ভয়ে রাধা সখীদের বলে, নৌকা ডুবে গেছে, কৃষ্ণ না থাকলে সে নিজেও মরত। কৃষ্ণই তার জীবন বাঁচিয়েছে।
এ ঘটনার পর রাধা আর বাড়ির বাইরে আসে না। শাশুড়ি বা স্বামীকে কিছু বলেও না লজ্জায়।
এদিকে রাধা অদর্শনে কৃষ্ণকাতর। সে বড়াইকে দিয়ে রাধার শাশুড়িকে বোঝায়, ঘরে বসে থেকে কী হবে, রাধা দুধ-দই বেচে ক’টি পয়সা তো আনতে পারে!
শাশুড়ির নির্দেশে রাধা বাইরে বের হয়। প্রচণ্ড রোদে কোমল শরীরে দই-দুধ বহন করতে গিয়ে সে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এ সময়ে কৃষ্ণ ছদ্মবেশে মজুরি করতে আসে। পরে ভার বহন অর্থাৎ মজুরির বদলে রাধার আলিঙ্গন কামনা করে!
রাধা এই চতুরতা বুঝতে পারে। সেও কাজ আদায়ের লক্ষ্যে মিথ্যা আশ্বাস দেয়। কৃষ্ণ আশায় আশায় রাধার পিছু পিছু ভার নিয়ে মথুরা পর্যন্ত যায়। দুধ-দই বেচে এবার মথুরা থেকে ফেরার পালা। কৃষ্ণ তার প্রাপ্য আলিঙ্গন চাইছে। রাধা চালাকি করে বলে, ‘এখনো প্রচণ্ড রোদ। তুমি আমাদের ছাতা ধরে বৃন্দাবন পর্যন্ত চলো। পরে দেখা যাবে।’ কৃষ্ণ ছাতা ধরতে লজ্জা ও অপমান বোধ করছিল। তবু আশা নিয়ে ছাতা ধরেই চলল। কিন্তু তার আশা পূর্ণ করেনি রাধা।
একদিন রাধা ও গোপীরা যমুনায় জল আনতে যায়। কৃষ্ণ যমুনার জলে নেমে হঠাৎ ডুব দিয়ে আর ওঠে না। সবাই মনে করে কৃষ্ণ ডুবে গেছে। এদিকে কৃষ্ণ লুকিয়ে কদম গাছে বসে থাকে। রাধা ও সখীরা জলে নেমে কৃষ্ণকে খুঁজতে থাকে। কৃষ্ণ নদীতীরে রাধার খুলে রাখা হার চুরি করে আবার গাছে গিয়ে বসে। পরে কৃষ্ণের চালাকি রাধা বুঝতে পারে। হার না পেয়ে রাধা কৃষ্ণের পালিতা মা যশোদার কাছে নালিশ করে। কৃষ্ণও মিথ্যে বলে মাকে। সে বলে, আমি হার চুরি করব কেন, রাধা তো প্রতিবেশী সম্পর্কে আমার মামি।
এদিকে বড়াই সব বুঝতে পারে এবং রাধার স্বামী আয়ান হার হারিয়ে ফেলায় যাতে রাগান্বিত বা ক্ষুব্ধ না হয় সেজন্য বলে, ‘বনের কাঁটায় রাধার গজমোতির হার ছিন্ন হয়ে হারিয়ে গেছে।’
মায়ের কাছে নালিশ করায় কৃষ্ণ রাধার ওপর ক্ষুব্ধ। রাধাও কৃষ্ণের প্রতি প্রসন্ন নয়। এ অবস্থায় বড়াই বুদ্ধি দিল, কৃষ্ণ যেন শক্তির পথ পরিহার করে মদনবাণ বা প্রেমে রাধাকে বশীভূত করে। সে মতে কৃষ্ণ পুষ্পধনু নিয়ে কদমতলায় বসে। রাধা, কৃষ্ণের প্রেমবাণে মূর্ছিত ও পতিত হয়। এরপর কৃষ্ণ রাধাকে চৈতন্য ফিরিয়ে দেয়। রাধা কৃষ্ণপ্রেমে কাতর হয়ে কৃষ্ণকে খুঁজে ফেরে। রাধাকে আকৃষ্ট করার জন্য সময়-অসময়ে কৃষ্ণ বাঁশিতে সুর তোলে। কৃষ্ণের বাঁশি শুনে রাধার রান্না এলোমেলো হয়ে যায়, মন কুমারের চুল্লির মতো পুড়তে থাকে, রাতে ঘুম আসে না, ভোরবেলা কৃষ্ণ অদর্শনে রাধা মূর্ছা যায়।
বড়াই রাধাকে পরামর্শ দেয়, সারা রাত বাঁশি বাজিয়ে সকালে কদমতলায় কৃষ্ণ বাঁশি শিয়রে রেখে ঘুমায়। তুমি সেই বাঁশি চুরি কর, তাহলেই সমস্যার সমাধান হবে। রাধা তা-ই করে। কৃষ্ণ বুদ্ধিমান। বাঁশি চোর কে তা বুঝতে তার কোনো কষ্ট হয় না। কৃষ্ণ রাধার ওপর উদাসীন। এদিকে মধুমাস সমাগত। রাধা বিরহ অনুভব করে। রাধা বড়াইকে বলে কৃষ্ণকে এনে দিতে। দই-দুধ বিক্রির ছল করে রাধা নিজেও কৃষ্ণকে খুঁজতে বের হয়। অবশেষে বৃন্দাবনে বাঁশি বাজানো অবস্থায় কৃষ্ণকে খুঁজে পাওয়া যায়। কৃষ্ণ রাধাকে বলে, ‘তুমি আমাকে নানা সময় লাঞ্ছনা করেছ, ভার বহন করিয়েছ, তাই তোমার ওপর আমার মন উঠে গেছে।’ রাধা বলে, ‘তখন আমি বালিকা ছিলাম, আমাকে ক্ষমা করো। আমি তোমার বিরহে মৃতপ্রায়। তির্যক দৃষ্টি দিলেও তুমি আমার দিকে তাকাও।’ কৃষ্ণ বলে, ‘বড়াই যদি আমাকে বলে যে তুমি রাধাকে প্রেম দাও, তাহলে আমি তোমার অনুরোধ রাখতে পারি।’ অবশেষে বড়াই রাধাকে সাজিয়ে দেয় এবং রাধা-কৃষ্ণের মিলন হয়।
২৪ প্রহর ব্যাপী অখন্ড মহানামযজ্ঞে কীর্তন পালাগান
শ্রী চৈতন্যদেবের আগে শ্রী জয়দেব,বড়ু চন্ডীদাস,বিদ্যাপতির পদাবলীতে কীর্তনের দেখে মেলে। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের মঙ্গলকাব্যের আঙ্গিকও কীর্তনের ঢঙে। মঙ্গলকাব্য যেমন-চন্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল,মনসামঙ্গল,শীতলামঙ্গল কীর্তনের রস পরিবেশন হতো, এখনো হয়ে থাকে। একইভাবে বৌদ্ধগানও কীর্তনের আঙ্গিকে পরিবেশিত হয়।
গেরুয়া রঙের প্যান্ডেল। নিচে চাটাই বিছানো। চারপাশে বাঁশ দিয়ে ঘেরা। ছোট্ট একটা মন্দিরের সামনে ষড়ভুজ বা প্রায় গোলাকার মঞ্চ। উপরে লেখা “হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে, হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে। মন্দিরে একটা বিগ্রহ দেখা যাচ্ছে। একজন গায়েনকে ঘিরে ঢোল, হারমোনিয়াম, করতল, বাশি বাজাচ্ছে যন্ত্রীরা। তাদের বেশভূষাও গেরুয়া।গায়েনের সাথে কখনো কখনো গলা মিলাচ্ছেন সঙ্গীরা। কখনো দু’হাত উপরে তুলে আকুতি জানাচ্ছেন।আবার,বেদনাক্লিষ্ট মুখে হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়ছেন, মাটিতে শুয়ে পড়ছেন।এই গায়কদের একজন বলেন, এটা তাদের আত্ম নিবেদন। কিন্তু তারা কীর্তন নিয়ে বেশি কথা বলতে নারাজ। যারে শুধু নামে মেলে তার আবার ব্যাখ্যা কি।
শ্রোতাদের অধিকাংশ নারী। তারা যেন আত্মহারা। একজন বলছিলেন, তিনি যেন নিজের না বলা কথা শুনতে পান। আত্মা ঠান্ডা হয়। কীর্তনের করুণ সুরে কি যেন দুঃখ লেখা আছে,পাওয়া-না পাওয়ার দুনিয়াবী দুঃখ না,তারও উধ্বে আরো কি যেন রয়ে যায়।ধরা যায় আবার ধরা যায় না।
কীর্তনকে আমরা গান বলছি, কিন্তু ধর্মীয়ভাবে একে ‘নামসুধা’ বলা হয়।‘শ্রী শ্রী নামসুধা’।কয়েকজন মিলে যে দল,তাকে বলা হয় সম্প্রদায়।এটা নির্দিষ্ট অঞ্চলে কোন মন্দিরকে ঘিরে তৈয়ার হয়।সম্প্রদায়ের দীক্ষা গুরু থাকেন একজন। কীর্তন হলো কোন দেব-দেবীর নাম বা গুণাবলী বা কীর্তিকাহিনী নিয়ে রচিত। একে সঙ্কীর্তন বা কেত্তন নামেও ডাকা হয়।শ্রীকৃষ্ণ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পান্ডব ভাইদের পক্ষ নিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি এমনই একজন সনাতনী আবতার যিনি তার সমস্ত লীলায় যুদ্ধের চেয়ে প্রেমকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তার প্রেমময় চরিত্র নিয়ে রচিত হয়েছে বাংলার কীর্তন। শ্রী চৈতন্য মনে করেন ক্ষয়িষ্ণ হিন্দু ধর্মকে বাচাতে পারে প্রেমভাব। প্রেমে ভক্তি প্রেমেই মুক্তি। এই পবিত্র গঙ্গার প্রবাহমান জলের মতো, ধুয়ে দিতে পারে মনের সকল কালিমা।
কীর্তন দু’প্রকার- নামকীর্তন বা নামসংকীর্তন এবং লীলাকীর্তন। হরি বা বিষ্ণুকে সম্বোধন করে ‘হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে’ এই ষোল পদ নিয়ে নামকীর্তন৷ এই বোল ছাড়াও অবশ্য নামকীর্তনের আরো বোল আছে। অন্যদিকে, রাধা কৃষ্ণ এবং গোপী নিয়ে শ্রীকৃষ্ণের কাহিনী অবলম্বনে যে পালাগান তাকে বলে লীলা কীর্তন। এছাড়া গৌরাঙ্গ বা শ্রী চৈতন্যের কাহিনী নিয়ে লীলা কীর্তনের প্রচলন আছে। পশ্চিমবঙ্গে কালীকীর্তন নামে আরেক প্রকার কীর্তন আছে, এটা মূলত শাক্তপদাবলীর গীতরূপ।
২৪ প্রহর ব্যাপী অখন্ড মহানামযজ্ঞে কোন বিরতি নাই।প্রতি প্রহরে কোন না কোন সম্প্রদায় কীর্তন পরিবেশন করে যাচ্ছেন। সেই সময় নামযজ্ঞে ছিলেন নদীয়ার শ্রী গৌরহরি সম্প্রদায়। তাদের গানের কথাগুলো স্পষ্ট বুঝা না গেলেও, কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে স্পষ্ট ধরতে পারা যায় ও ভক্তিরস আস্বাদন করা যায়।
বেলা তিনটার পরে মন্দিরের পাশের ছাউনী দেয়া অংশ আর গলিপথে লোকজন সারি করে বসে গেছেন। সবার সামনে এলুমিনিয়ামের বাসন।খিচুড়ী আর সবজি।কয়েকজন এসে পাতে পাতে খাবার তুলে দিচ্ছিলেন।চারদিকে খাবারের গন্ধ ভাসছে।সবাই তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছেন নিরামিষ।একে খাবার বলা হয় না।বলা হয় অন্নপ্রসাদ।এর আলাদা গুন,ভক্তি ও গুরুত্ব আছে।এই অন্নপ্রসাদ খেলে পূণ্য হয়,এই বিশ্বাস অনেকের।আশে পাশের হিন্দু বাড়িতে এই চারদিন রান্না হয় না।এই কয়দিন সবাই সেবাশ্রমের সৌজন্যে অন্ন প্রসাদ গ্রহন করেন।মহিলারা বটিতে করে খাবার নিয়ে খাচ্ছেন।বাড়ির যেসব লোক আসতে পারেন নাই,তাদের জন্য এই ব্যবস্থা।সেবাশ্রমের সেবা থেকে কেউ বঞ্চিত নন।
বৈশাখ মাসে ২৪ প্রহর ব্যাপী অখন্ড মহানামযজ্ঞ হরিনাম সংকীর্তন গান আরম্ভ হয়। তিন রাত্রি পালাকীর্তন হয়ে থাকে। প্রথম দিবস গন্ধদিবস। সেই দিন থেকেই কীর্তন গান অর্থাত্ পালাকীর্তন শুরু হয়।প্রথম রজনীতে হয় কীর্তন পালাগান।পরে দ্বিতীয় দিবস অবসানে দ্বিতীয় রজনীতে হয় কীর্তন পালাগান। তৃতীয় ও শেষ রজনীতে হয় রাসলীলা পালা। পরদিন প্রভাতে কুঞ্জভঙ্গ। কুঞ্জভঙ্গ শেষে হরিবাসর সমাপ্ত হয়। কোথাও কোথাও আবার সেই দিন রাতে বাউলগান বা যাত্রাপালা গানের আসর বসে।
বাংলার সংস্কৃতি বাউল গান ও লোকগীতি
সংগ্রহ ও সম্পাদনা- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী
গত কয়েক দশকে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে লোকগানকে বাঁচানোর জন্য তেমন কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি৷ এ জন্য আক্ষেপ করে এই শিল্পী ও গবেষক বলেন, ‘‘বাম সরকারের ভূমিকা এ ক্ষেত্রে হতাশাজনক৷ লোকশিল্পীদের জন্য কিছু করার তাগিদ থাকা উচিত ছিল কমিউনিস্ট পার্টির৷ কিন্তু তাঁরা এত বছর ধরে শিল্পীদের শুধু ভোটার ভেবেছেন৷”
পশ্চিমবঙ্গ সরকার এখন লোকশিল্পীদের নাম নথিভুক্ত করে তাঁদের পরিচয়পত্র দিচ্ছে৷ তাঁদের জন্য মাসিক ভাতারও ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ এতে কি কিছুটা সুরাহা হবে? শুভেন্দু মাইতি বলেন, ‘‘এতে শিল্পীদের আর্থিক সুবিধা নিশ্চয়ই হয়েছে৷ কিন্তু তাতে লোকগানের কোনও উপকার হচ্ছে না৷ তাছাড়া সরকার সাংস্কৃতিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়লে তাতে বিপদ বাড়বে৷”
লোকগানের অন্যতম জনপ্রিয় রূপ ‘গম্ভীরা’ কতটা সংকটে পড়েছে, তা ডয়চে ভেলে জানতে চেয়েছিল গম্ভীরা শিল্পী অমর মণ্ডলের কাছে৷ মালদহের ইংরেজবাজারের একটি গম্ভীরা দলের প্রধান এই শিল্পী জানান, ‘‘এই গানের শিল্পীরা যথাযথ মর্যাদা পাননি৷ প্রত্যেকেই আলাদা পেশার সঙ্গে জড়িত৷ তার পাশাপাশি গম্ভীরায় অভিনয় করেন, কেউ গান করেন বা বাজনা বাজান৷” তবে বিশিষ্ট এই লোকশিল্পী স্বীকার করেছেন, রাজ্য সরকারের আর্থিক সহায়তায় উপকার হয়েছে৷
এখন কলকাতার মঞ্চে অনেক বেশি গান গাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে৷ যদিও অন্যান্য লোকগানের মতো গম্ভীরার আধুনিকীকরণ না হওয়ায়, তার মূল রূপটি অক্ষুন্ন রয়েছে৷ স্বস্তিতে রয়েছেন পালাকার ও মূল গায়েন অমর মণ্ডল৷ তবে সব লোকশিল্পীই এমন স্বস্তিতে নেই বলে জানালেন কবি জয়দেবের স্মৃতিজড়িত কেন্দুলির ‘মনের মানুষ বাউল ফকির কালচারাল সোসাইটি’র তন্ময় বাউল৷ বিশিষ্ট এই বাউল জানালেন, ‘‘লোকগীতি, লোকবাদ্য ও লোকনৃত্যের সমন্বিত রূপই লোকসংগীত৷ গীত, বাদ্য ও নৃত্য সহযোগে পরিবেশিত হয় বলে বাউল লোকসংগীতের সবচেয়ে প্রকৃষ্ট উদাহরণ৷ তাই মানুষ চিরকালই সাধকদের বাউলগান পছন্দ করেন৷”
এ যুগের মানুষের কাছে বাউল গানের আবেদন কেমন? তন্ময় বাউল এ প্রশ্নের উত্তরে জানালেন, ‘‘বাউল গানের চর্চা নিঃসন্দেহে বেড়েছে৷ তাল-বাদ্য ও সুরের সবটাই যে সবাই বুঝতে পারেন, তা নয়৷ আবার বাউলগানের অন্তর্নিহিত অর্থও যে সবাই বুঝতে পারেন, এমনও না৷ কিন্তু কখনও সুর, তো কখনও গৌণ অর্থ ধরেই ৮০ শতাংশ মানুষ বাউলগানের শ্রোতা৷ ইদানীংকার শহুরে সংস্কৃতিতে যেভাবে বাউলগানকে পরিবেশিত করা হয়, তাতে বাউলগানের অপভ্রংশ হচ্ছে যেমন, পাশাপাশি জনপ্রিয়তাও বাড়ছে৷”
লালন, রবীন্দ্রনাথের পরে পূর্ণদাস বাউল, পবনদাস বাউল নিঃসন্দেহে বাউলগানকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিয়েছেন৷ আবার বিশ্বের দরবারে রঙচঙে পোশাক পরে একতারা, দোতারা, খঞ্জনির মতো বাদ্য ছেড়ে গিটার ধরে অনেকে আবার বাউল গান গাইছেন৷ এসব নিয়ে ‘মনের মানুষ’ আখড়ার তন্ময় বাউল জানালেন, ‘‘সাধনদেব বৈরাগী আমাদের গুরু৷ এটা আমরা মোটেও সমর্থন করি না৷ বাউলের মতো গভীর বোধের গানকে এভাবে পয়সার জন্য বেচতে আমরা পারব না৷ নিজেদের বোধ এবং সংস্কৃতি থেকেই আমরা বাউলগানের যেমন চর্চা করি, তেমনই করে যাব৷ আধুনিকতার সঙ্গে কম্প্রোমাইজ করব না৷”
একদিন মুখে মুখে প্রচলিত কথাতেই বাঁধা হয়েছিল বাংলার লোকগান৷ প্রজন্মের পর প্রজন্ম বাংলার গ্রামীণ জনতা তাঁদের বিভিন্ন লোকাচার ও উৎসবের সঙ্গে এই স্বয়ম্ভু সংগীতের ধারাকে জুড়ে রেখেছেন৷ এমনই কোনও মানুষের খোঁজে ডয়চে ভেলে পৌঁছে গিয়েছিল নদিয়ার কুর্শি গ্রামে৷ খুঁজে পাওয়া গেল সুশীল সর্দারকে৷ তথাকথিত সভ্য সমাজ তাঁকে শিল্পী না বলুক, আদতে গানই তাঁর জীবন৷ আদিবাসী সম্প্রদায়ের যে কোনও উৎসবে নৃত্য-গীতের আয়োজন থাকে, সেখানে সুশীলই মূল গায়েন৷ গান গাইতে গাইতে বিভোর হয়ে যান মধ্যবয়স্ক মানুষটি৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘গান আমাদের শিখতে হয় না৷ ছেলেবেলা থেকে শুনে শুনে গান শিখে যাই৷ আমাদের সব পরবেই তো গান থাকে৷”
সুশীলের মতো মানুষ, যাঁর ঠোঁটে হাজারও অজানা লিরিক ও সুর খেলা করে, যাঁকে কোনও ক্যাসেট কোম্পানি শিল্পীর মর্যাদা দেয়নি, তাঁর মতো মানুষ আজও সভ্যতার শিকড়ে লোকগান ও সংস্কৃতিকে পুষ্টি জোগান দেন৷
শুভেন্দু মাইতি এই সুশীলদেরই ‘শিকড়’ বলে চিহ্নিত করেছেন৷ তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের সমাজ একটা বৃক্ষের মতো, যার মাটির উপরিভাগের অংশ হচ্ছে আমাদের নাগরিক সংস্কৃতি৷ মাটির উপরে যতটুকু অংশ থাকে, ততটাই অংশ থাকে মাটির তলায়৷ এই শিকড়ের অংশটুকুই আমাদের লোকসংস্কৃতি৷ সেটি দৃশ্যমান না হলেও গাছকে বাঁচিয়ে রাখে৷ এই শিকড় শুকিয়ে গেলে গাছের পাতা আর সজীব থাকবে না, হলুদ হয়ে যাবে৷ তাই শিকড়কে বাঁচিয়ে রাখা আমাদের দায়িত্ব৷”
কীর্তন পালাগান ও বাউল গান বিভাগটির শেষ অধ্যায় প্রকাশিত হল। এবার প্রতিদিন কয়েকটি পরিচ্ছেদ নিয়ে শুরু হবে নতুন বিভাগ। শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রও তাঁর বানী (প্রথম পরিচ্ছেদ) আগামীকাল থেকে প্রকাশিত হবে।
থাকবে শ্রী শ্রী ঠাকুরের জীবনী ও বানী নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা।
সকলের সহযোগিতা প্রার্থনা করি।
জয়গুরু!
বিনীত- লেখক
সংগ্রাহক এবং সম্পাদক হিসেবে অভিনন্দন জানাই মি. লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী। ধন্যবাদ।
শেয়ার করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ কবি ভাণ্ডারী দা।
পড়তে পারলাম না। ব্যস্ততায় এমন বড় সাবজেক্ট পড়া হলো না। দুঃখিত দাদা।
অভিনন্দন কবি লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী দা।
বড় লেখা। এখন থেকে ছোট ছোট করে পর্যায়ক্রমে দিন কবি দা। পড়তে সুবিধা হবে।