পৌষমাসে টুসু পূজা…….. টুসুর বন্দনা লোকগান নবম পর্ব

পৌষমাসে টুসু পূজা…….. টুসুর বন্দনা লোকগান
নবম পর্ব।

তথ্য সংগ্রহ ও সম্পাদনা আর সম্পাদকীয় কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

শহুরে মানুষদের কজনই বা খোঁজ রাখেন টুসু পরবের কথা, যে উৎসব রাড় বাংলার একটা বিরাট অংশের মাটির সঙ্গে জুড়ে থাকা মানুষদের কাছে শুধু ধর্মীয় রীতিনীতির আবদ্ধতার বাইরে গিয়ে একটি যথার্থ হৃদয়ের উৎসব।

‘আমাদের’ বলতে এই আমরা যারা নিজেদের ভদ্রলোক শ্রেণির মধ্যে পড়ি বলে মনে করি তাদের ‘টুসু ’ নামে কোনো আরাধ্য দেবী নেই। এক মাস ধরে এই রাঢ় বাংলার, বিশেষ করে মানভূম অঞ্চলে পূজিত হবার পরে মকর সংক্রান্তির দিন যে টুসু প্রতিমাকে কে খড়কাই , সুবর্ণরেখা , কাঁসাই , গেঁদাই , শীলাই নদীতে বিসর্জন দেওয়া হবে তার সঙ্গে আমাদের তথাকথিত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সম্পর্ক আমরা তেমন করে স্বীকার করি না। সুরেন্দ্র মোহন ভট্টাচার্য মহাশয় রচিত সাম , যজু ও ঋক বেদের থেকে সংগৃহীত সর্ব প্রকার পূজাপাঠের যে একমাত্র ম্যানুয়ালটি পাওয়া যায় তাতে এই টুসু পূজার জন্যে কোনো মন্ত্র নির্দিষ্ট করা নেই। কারণ টুসু উৎসব এক অবৈদিক, অস্মার্ত, অপৌরাণিক এবং অব্রাহ্মণ্য উৎসব। আমাদের পাঁজিতে এ উৎসবের নির্ঘণ্ট দেওয়া থাকে না।
টুসু নামের উৎপত্তি নিয়ে একাধিক গল্প প্রচলিত আছে। তার মধ্যে একটা হচ্ছে ধানের তুষ , শীতের সময় যা জ্বালিয়ে আমাদের গ্রামে গঞ্জে লোকেরা আঁচ পোহায় , সেই তুষ থেকেই টুসু নামটি এসেছে।ফুল বেল পাতা নয় এই তুষ দিয়েই এ পূজার ডালি সাজানো হয়।

টুসু এক কুমারী কন্যা। এর পূজাও করেন কুমারী কন্যারা। আমরা যাদের নিম্নবর্গের মানুষ বলি সেই তাদের বাড়ির কুমারী কন্যারা। কিন্তু এ পূজার কোনো মন্ত্র তন্ত্র , নেই নির্ধারিত ক্রিয়া-কর্ম , কোনো বিশেষ উপাচারও নেই। অঘ্রান মাসের শেষ দিন থেকে পৌষ মাসের শেষ দিন অবধি রাঢ় বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামে গ্রামে এই টুসু পূজিত হন ।যে হেতু মন্ত্র তন্ত্র নেই , তাই এ পূজায় কোনো ব্রাহ্মণের প্রয়োজন হয় না। সন্ধ্যাবেলায় গ্রামের ‘অশিক্ষিত’ মেয়েরা নিজেদের সাজানো রঙিন কাগজের চৌদলের উপর প্রতিষ্ঠিতা পোড়ামাটির টুসুর মূর্তির সামনে বসে নানা রকমের গান বাঁধেন আর সেই গান করেন কখনো সম্মিলিত কখনো একক কণ্ঠে। সে গানে টুসুর মহিমা কীর্তন শুধু নয়, থাকে তাদের যাপিত জীবনের সাধ আহ্লাদ, আশা নিরাশ, ঠাট্টা তামাশার কথা। এবং তাতে ছায়া ফেলে তাদের ঘিরে থাকা আধুনিক সময়, এবং তাদের গাঁ-ঘরের পারিপার্শ্বিক।

কখনো থাকে ক্ষোভ প্রতিবাদ, কখনো থাকে দুঃখ বিষাদ। এক মাস ধরে এই মন্ত্রহীন পূজার শেষে মকর সংক্রান্তির দিন ব্যথিত হৃদয়ে তাদের ঘরের মেয়ের প্রাণের প্রতিমা কে তারা বিসর্জন দিয়ে আসে তাদের কাছের কোনো এক নদী অথবা পুকুরে। কোল, মুন্ডা, ওরাওঁ, সাঁওতাল, মুন্ডা, ভূমিজ, ভুঁইয়া, কুর্মি, মাহাতো, বাউরী বাগদী মহিলারা এই পুজো করেন। কিন্তু আশ্চর্য লাগে এই ভেবে গোটা পূজার্চনার ব্যাপারটা পরিচালিত হয় এই শ্রেণীর মহিলাদের দ্বারা আর এই উৎসবের প্রধান আকর্ষণ এই মেয়েদের তাৎক্ষনিক ভাবে রচিত রচিত গান। নতুন ফসল ঘরে আসার খুশি উদযাপনের এর চেয়ে সুন্দর রূপ আর কি বা হতে পারে।

এ তাদের প্রাণের গানের ভাষা আর সে গানে কখনো তাদের টুসু একেবারে আটপৌরে মেয়ে,
তাদেরই মতন –
‘টুসু সিনাচ্ছেন, গা দলাচ্ছেন,
হাতে তেলের বাটি
নয়ে নয়ে চুল ঝাড়ছেন
গলায় সোনার কাঠি…’
আবার কখনো তাকে নিয়ে গ্রাম্য কোন্দল –
আমার টুসু মুড়ি ভাজে, চুড়ি ঝনঝন করে গো
উয়ার টুসু হ্যাংলা মাগি, আঁচল পাইত্যে মাগে গো।

গাঁয়ের মেয়ে যখন শহরে চলে যায় লেখা পড়া শিখতে তখন সে কিছুটা শহুরে হয়ে যায় , হয়তো তার গ্রামের প্রতি টান কমে যায়, তেমনি একটা অভিমানের জায়গা থেকে গান বেরিয়ে আসে –
‘না রহিবেন গাঁয়ে টুসু যাবেন ইবার শহরকে
আলতা চরণ জুতায় ঢেকে দিবে না পা ডহর কে
গীত গাহিবেন অবাক কলে , পান কিনিবেন দোকান লে
বছর বছর সাধ জাগিলে আসতে পারেন উখান লে
গঙ্গা সিনান , সিনেমা টকি , গড়ের মাঠ আর কালীঘাট
বতর পাইলে লেখাপড়ায় হরেক কিসিম লিবেন পাঠ ‘

আবার টুসু যেন তাদের প্রিয় সখী, তাকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার আহ্বান –
‘চল টুসু খেলতে যাবো রানীগঞ্জের বটতলা
অমনি পথে দেখাই আইনব কয়লাখাদের জল তুলা
উলোট পালট ফুলুট বাঁশিতে
আমার মন মানে না ঘরেতে …’

আবার এ গানেরই শেষের লাইনে সেই জীবিকার সন্ধানে গ্রাম ছেড়ে শহরে যাওয়ার ব্যথা, টুসুর কাছে কিন্তু কোনো চাওয়া নেই , রূপণ দেহি , ধনং দেহি নেই , জমিতে ধান না হওয়ার জন্যে কোনো অভিযোগ নেই , বরং তাকে সঙ্গী করেই চলুক জীবন সংগ্রাম –
‘ চল টুসু চল টাটা যাবো
ধান হইল না কি খাবো ’

রোদ বৃষ্টির মধ্যে বনে জঙ্গলে যাদের বেঁচে থাকার রসদ সংগ্রহ করতে হয় তাদের দেবতাকে তো নেমে আসতে হবে তাদের সঙ্গে বনে জঙ্গলে। তাই টুসুর গানে উঠে আসছে-
বড় বোনের লতা পাতা
ছোটো বোনের শাল পাতা
কুন বনে হারালো টুসু
সোনার বরণ লালছাতা
চিড়কা রোদে ধরেছে মাথা।

তথ্যসহায়তায়: আনন্দবাজার পত্রিকা

লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী সম্পর্কে

লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী –নামেই কবির পরিচয়। কবির বাড়ি পশ্চিমবঙ্গে বর্ধমান জেলার পাথরচুড় গ্রামে। প্রকৃতির সাথে পরিচয় ছোটবেলা থেকেই। বর্তমানে কবি বাংলা কবিতার আসর, বাংলার কবিতা ও কবিতা ক্লাবের সাথে যুক্ত। অবসর সময়ে কবি কবিতা লেখেন ও স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেন। কাব্যচর্চার সাথে সাথে তিনি সাহিত্যচর্চাও করেন। গল্প ও রম্য রচনা আর ছোট গল্প লিখেন। বহু একাঙ্ক নাটকও তিনি লিখেছেন। অন্ধকারের অন্তরালে, সমাজের শত্রু ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও বহু যাত্রাপালা -সোনা ডাকাত, শ্মশানে জ্বলছে স্বামীর চিতা উল্লেখযোগ্য। কবির অভিনয় প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে বিচারক মণ্ডলী তাঁকে বহু সম্মানে ভূষিত করেছেন। লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী একাধারে কবি ও অপর দিকে লেখক। তার লেখা “আমার গাঁ আমার মাটি”, আমার প্রিয় শহর জামুরিয়া, আমার প্রিয় শহর কুলটি, আমার প্রিয় শহর আসানসোল, আমার প্রিয় শহর রাণীগঞ্জ বহু পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী প্রকৃতপক্ষে হিন্দু ধর্মাবলম্বী হয়েও তিনি অন্য ধর্মকেও শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করেন। তিনি বিশ্বাস করেন সব মানুষই ঈশ্বরের সন্তান। তাই ধর্মে আলাদা হলেও আমরা সবাই ভাই ভাই।

12 thoughts on “পৌষমাসে টুসু পূজা…….. টুসুর বন্দনা লোকগান নবম পর্ব

  1. বাংলার ঐহিত্য এবং সংস্কৃতি শব্দনীড়ে শেয়ার করার জন্য আপনাকে শুভেচ্ছা কবি। :)

    1. সুন্দর মন্তব্যে মুগ্ধ হলাম।
      শুভ নববর্ষের আন্তরিক প্রীতি আর শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন।
      পরমপ্রেমময় ঈশ্বর আপনাকে সুস্বাস্থ্য, সুখ এবং শান্তি দান করুন।
      শুভ ও সমৃদ্ধিময় নববর্ষ- ২০২০ নতুন বছরের প্রতিটি দিন হোক সুন্দর।

    1. ইংরাজী শুভ নববর্ষের আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা গ্রহণ করুন।
      বছরের প্রতিটি দিন সুন্দর কাটুক। শুভ কামনা রইলো।
      জয়গুরু!

    1. নতুন বছর যেমন নতুন আশা নিয়ে আমাদের কাছে আসছে,
      প্রতিটি মুহুর্তটি 365 দিন ধরে দেখার জন্য বর্ষবরণ করতে হয়,
      আসুন, এই আনন্দের নতুন বছর উদযাপন করি
      শুভ নববর্ষ 2020

    1. সুন্দর মন্তব্যে মুগ্ধ হলাম। শুভ নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাই।
      নতুন বছরের প্রতিটি দিন সুন্দর ও আনন্দময় হয়ে উঠুক।
      শুভকামনা রইলো। জয়গুরু!

    1. সুন্দর মন্তব্যে মুগ্ধ হলাম। শুভ নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাই।
      নতুন বছরের প্রতিটি দিন সুন্দর ও আনন্দময় হয়ে উঠুক।
      শুভকামনা রইলো। জয়গুরু!

  2. অনেক অনেক প্রীতি ও শুভেচ্ছা  প্রিয় কবি দাদা। শুভ নববর্ষ।

    1. সুন্দর মন্তব্যে মুগ্ধ হলাম। শুভ নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাই।
      নতুন বছরের প্রতিটি দিন সুন্দর ও আনন্দময় হয়ে উঠুক।
      শুভকামনা রইলো। জয়গুরু!

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।