বিশ্বত্রাস করোনা পৃথিবী জেলখানা যাত্রাদলের অবক্ষয় (দশম পর্ব)

বিশ্বত্রাস করোনা! পৃথিবী জেলখানা।
যাত্রাদলের অবক্ষয় (দশম পর্ব)

তথ্যসংগ্রহ ও কলমে- লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

কুয়াশাচ্ছন্ন শিশিরভেজা শীতের রাত। অঘ্রাণের নবান্নের পর ধানকাটা ন্যাড়া মাঠ। অন্ধকার। তারই মাঝে টিউব, বাল্ব, টুনির আলোয় বৃত্তাকারে অথবা বর্গক্ষেত্রাকারে ঘেরা একটি প্রশস্ত অঞ্চল। মেলা বসেছে। বাংলার গ্রামীণ মিলনোৎসব। উপলক্ষ্য ধর্মীয় হতে পারে বা সামাজিক। তবে লক্ষ্য একটাই – যাত্রাপালা।

মেলার আলোর ঘেরাটোপের মধ্যিখানে তিনদিক খোলা বাঁশ আর পাটাতন দিয়ে তৈরি মাচা বা মঞ্চ। মাচার চাঁদোয়া সংলগ্ন বাঁশে পার লাইট, পিসি লাইট বাদুর ঝুলন্তিস। ঝুলছে বারো – চোদ্দোখানা মাইক্রোফোন। মঞ্চে বহুস্তর বিশিষ্ট রস্ট্রাম। মঞ্চের দুদিকে বাজনদাররা সিন্থেসাইজার, অক্টোপ্যাড, ঢোল, তবলা, ফ্লুট, কর্ণেট নিয়ে প্রস্তুত। মাইকে অ্যানাউন্সমেন্ট চলছে – “আজকের সাড়াজাগানো সূপার-ডুপার হিট যাত্রাপালা………”

অন্ধকার মাঠের আল বেয়ে বেয়ে জোনাকির আলোর মতো মিটমিটে টর্চ জ্বেলে গ্রাম গ্রামান্তর থেকে মানুষের ভীড় এসে জড়ো হয় যাত্রা আসরে। বাদাম, ঘটিগরম, চিপস বিক্রেতারা খদ্দের ধরতে নেমে পরে। জায়গা দখলের বচসা, বাচ্চার কান্না, ছোকরার সিটি সব মিলিয়ে শব্দকল্পদ্রুম। এমন সময়ে তিনবার ঢং – ঢং – ঢং করে ঘন্টা বেজে ওঠে। কনসার্ট শুরু। টাইটেল কনসার্ট। তারপরেই শুরু পালা।

করোনার আবহে থমকে গিয়েছে চিতপুরের যাত্রাপালা। কবে হবে ফের তাদের পালা তা তারা নিজেও জানে না। কেবলমাত্র অনাহারই নয়,যে অনিশ্চয়তার মেঘ ওদের জীবনে এসে পড়েছে তাতে করে সেই মেঘ যে কবে কাটবে তা নিয়ে রীতিমতো দ্বন্দ্বের মধ্যে দিন গুজরান করছেন ওরা। মানে যারা চিতপুরের যাত্রাপালার সঙ্গে যুক্ত, কেউ একা নয়,যতগুলো অপেরা আছে সকলেরই একই অবস্থা।

যাত্রাপাড়ায় গেলে অনেক হতাশ মুখের সাক্ষী হতে পারেন। নিয়মমাফিক রংবেরঙের পোস্টার সাজিয়ে বসে আছেন বিভিন্ন দলের ম্যানেজাররা। কিন্তু দিনের শেষে পকেট ভরছে কই? অধিকাংশ ম্যানেজারের বক্তব্য, লোকসানে চলছে চিৎপুর। কোনওরকমে টিকিয়ে রাখা হয়েছে যাত্রাপাড়াকে। এমনকী এখন টিকিট বিক্রি করে যাত্রা শো খুব কম হয়। অধিকাংশ যাত্রাই আজকাল ফ্রি-তে হচ্ছে, যা আর্থিক দিক থেকে অনেকটা পিছিয়ে দিয়েছে বাংলার এই আদি লোকসংস্কৃতিকে। একদিকে এনআরসি, অপরদিকে করোনা। এই দুইয়ের ধাক্কায় জেরবার চিৎপুরের যাত্রাপাড়া। এনআরসি নিয়ে অসম এবং ত্রিপুরায় অস্থির পরিস্থিতি। যার ফলে পেরিয়ে গেছে দুটো মাস। সেখানে যেতে পারেনি চিৎপুরের কোনও দল। হয়নি কোনও বায়না। প্রতি বছর রথের দিন যে বায়নার দৃশ্য চোখে পড়তো চিৎপুরের গদি ঘরগুলোতে সেখানে এবারে থাবা বসিয়ে ছিল এনআরসি। আর এখন মরশুমের মাঝে হঠাৎই হাজির করোনা!

অন্য বছরগুলোতে এই দুটো রাজ্যেই দুমাস ধরে চিৎপুরের যাত্রাপালা নিয়ে ঘুরে বেড়ান বিভিন্ন দলগুলি। যার থেকে তাঁদের রুজি রোজগারও হয় বেশ ভালোই। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। পার্শ্ববর্তী দুই রাজ্য অসম ও ত্রিপুরায় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে যাত্রাপালা। যার ফলে ধুঁকতে থাকা বাংলার যাত্রাশিল্পে তা একটা বেশ বড় ধাক্কা বলেই মনে করছেন যাত্রা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত কলাকুশলীরা। তার ওপরে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো এসে হাজির হয়েছে নভেল করোনা ভাইরাস। সতর্কতা হিসেবে বড় ধরণের জমায়েতের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার। বন্ধ হবে গেছে সব ধরণের খেলা ও বিনোদনের অনুষ্ঠান।

সেই পরিস্থিতিতে যাত্রা শিল্পেও পড়েছে এর প্রভাব। সরকারি নির্দেশে বন্ধ হতে চলেছে সব ধরণের শো। আর শো বন্ধ হওয়া মানেই পেটে টান পড়া। তাই কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের এই নিষেধাজ্ঞার জেরে এখন চিন্তার ভাঁজ চিৎপুরের ছোট বড় সব যাত্রা পালার কাছে। ইতিমধ্যেই এবছরের বায়না নেওয়া হয়ে গিয়েছে। যাত্রাপালার দলগুলিও ঘুরছে রাজ্যজুড়ে। কিন্তু সেইখানেই রীতিমতো মাথায় হাত তাঁদের। আগামী ৩১ তারিখ পর্যন্ত কোনও রকম বড় ধরণের জমায়েতে নিষেধাজ্ঞা জারির ফলে যাত্রাপালাও করা যাবে না।

কারণ সেই একটাই করোনা ভাইরাস। যে শিল্প হারিয়ে যাচ্ছে যে শিল্প শেষ হতে বসেছে, যাকে এখনও ভালোবেসে তারা বুকে আগলে ধরে এগিয়ে চলছেন তার ওপরে এই অযাচিত বাধায় ঘুম ছুটেছে পালাকারদের। রাজ্য সরকার যাত্রা শিল্পকে পুনরুদ্ধারের চেষ্টার মধ্যেই এই ধরণের বাধাতে এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত কলাকুশলীদের কাছে যে বিশাল ধাক্কা সে কথা অকপটে স্বীকার করে নিচ্ছেন তারাই। চিৎপুরের আনন্দলোক অপেরার খোকন পোড়েল রবিবার কলকাতা টিভিকে একান্ত সাক্ষাৎকারে জানালেন তাঁদের এই আশঙ্কার কথা। সকলের সুস্থতা চিন্তা করে সরকারের এই উদ্যোগে সমর্থন জানালেও তাঁদের মনের কোণে কিন্তু এখনও উঁকি মারছে আশঙ্কার কালো মেঘ।

লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী সম্পর্কে

লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী –নামেই কবির পরিচয়। কবির বাড়ি পশ্চিমবঙ্গে বর্ধমান জেলার পাথরচুড় গ্রামে। প্রকৃতির সাথে পরিচয় ছোটবেলা থেকেই। বর্তমানে কবি বাংলা কবিতার আসর, বাংলার কবিতা ও কবিতা ক্লাবের সাথে যুক্ত। অবসর সময়ে কবি কবিতা লেখেন ও স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেন। কাব্যচর্চার সাথে সাথে তিনি সাহিত্যচর্চাও করেন। গল্প ও রম্য রচনা আর ছোট গল্প লিখেন। বহু একাঙ্ক নাটকও তিনি লিখেছেন। অন্ধকারের অন্তরালে, সমাজের শত্রু ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও বহু যাত্রাপালা -সোনা ডাকাত, শ্মশানে জ্বলছে স্বামীর চিতা উল্লেখযোগ্য। কবির অভিনয় প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে বিচারক মণ্ডলী তাঁকে বহু সম্মানে ভূষিত করেছেন। লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী একাধারে কবি ও অপর দিকে লেখক। তার লেখা “আমার গাঁ আমার মাটি”, আমার প্রিয় শহর জামুরিয়া, আমার প্রিয় শহর কুলটি, আমার প্রিয় শহর আসানসোল, আমার প্রিয় শহর রাণীগঞ্জ বহু পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী প্রকৃতপক্ষে হিন্দু ধর্মাবলম্বী হয়েও তিনি অন্য ধর্মকেও শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করেন। তিনি বিশ্বাস করেন সব মানুষই ঈশ্বরের সন্তান। তাই ধর্মে আলাদা হলেও আমরা সবাই ভাই ভাই।

3 thoughts on “বিশ্বত্রাস করোনা পৃথিবী জেলখানা যাত্রাদলের অবক্ষয় (দশম পর্ব)

  1. সরকারী পৃষ্টপোষকতায় আবারও জেগে উঠুক বাঙ্গালী সমাজের আদি এই বিনোদন। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

  2. গত পর্বেও দারুন তথ্য সম্ভার ছিল। আজকেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতি আপনার লেখনির মাধ্যমে নতুন করে সাহিত্য জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করবে বলে আশাবাদী।

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।