ভাদুগান ও ভাদু উত্সব- ২০২০ (ষষ্ঠ পর্ব) ভাদুর কাহিনী, আলোচনা ও গীত সংকলন

ভাদুগান ও ভাদু উত্সব- ২০২০ (ষষ্ঠ পর্ব)
ভাদুর কাহিনী, আলোচনা ও গীত সংকলন

তথ্যসংগ্রহ ও কলমে-লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী

কাশীপুরে দেখে আইলাম / দালান কোঠায় টিকটিকি / এমনই বাবার বিবেচনা / এক জামাইকে দুই বিটি। লালপাড় শাড়ি পরে কোমর দুলিয়ে ঢোলের নিখুঁত বোলের সঙ্গে গাইছেন শঙ্করী দাস, কুমকুম দাসরা। কাটোয়ার চুড়পুনি গ্রামের দাসপাড়ার অন্ত্যজ সম্প্রদায়ের মহিলারা বছর বছর ভাদ্র মাসের সংক্রান্তির দিন ভাদু গাইতে বেরিয়ে পড়েন। মাটির তৈরি ভাদু ঠাকরুণকে নিয়ে। কাটোয়া মহকুমার নানা গ্রাম ঘুরে পয়লা আশ্বিন গঙ্গায় স্নান করে ঘরে ফেরেন।

ভাদু গানের মতো পুরনো লোকগানকে আজও বাঁচিয়ে রেখেছে চুরপুনি দাসপাড়া। বিভিন্ন জায়গায় ভাদু দলে পুরুষরা মেয়ে সেজে গান–নাচ করেন। কিন্তু চুড়পুনির ভাদু গাওনার পুরো দলটিই মহিলাদের। দিন আনা দিন খাওয়া পরিবারের ১৩ জন মহিলার দলটি ভাদ্র মাস পড়লেই সংসারের যাবতীয় কাজ সামলে মহড়া শুরু করে দেন। মূল গায়েন শঙ্করী দাস গান ধরেন, মাটি ফুঁড়ে জল সরে / ভাদুকে কে সাজাইছে। দলের অন্যান্য সদস্য সুমিত্রা দাস, কুমকুম দাসরা ধরতাই দেন, সেই জলে জমি আবাদ হছে / ভাদুকে কে সাজাইছে।

কাটোয়ার লোকসংস্কৃতি গবেষক রণদেব মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘ভাদুকে সামনে রেখে গাওনার দলের সদস্যরা তাঁদের রাগ–দুঃখ–জ্বালা–অভিমান–আনন্দ গানের মাধ্যমে তুলে ধরেন। এই গানে গ্রামীণ সমাজব্যবস্থার প্রকৃত ছবিটা ধরা পড়ে। শস্যকন্যা ভাদুর মধ্যে নিজেকে খোঁজার এই ধারাটিই ভাদু গানের নজরটানা বৈশিষ্ট্য। শুধু কাটোয়া মহকুমাই নয়, দক্ষিণবঙ্গের বীরভূম, নদিয়া, মুর্শিদাবাদ, পুরুলিয়া জেলাতেও ভাদ্র মাসজুড়ে ভাদু গানের উৎসব চলে।’ গায়িকা শঙ্করী–কুমকুমরা প্রশাসনকে কুর্নিশ জানিয়েছেন। তঁারা বলেন, ‘আমাদের দলে সকলে মহিলা।

কিন্তু আমরা নিরাপদেই গ্রামে গ্রামে ঘুরতে পারছি। এটা খুবই ভাল ব্যাপার।’ ভাদুকে ফসলের প্রতীক হিসেবে মান্যতা দেওয়া হয়। শ্রাবণ মাসে ধান রোয়া–সহ চাষবাস শেষ হয়ে যায়। ভাদ্র মাসটা কৃষক পরিবারের সদস্যদের কাছে অখণ্ড অবসর। সেই অবসর যাপনের জন্য বিনোদন হিসেবে ভাদু গানের উৎপত্তি বলে মনে করেন লোক গবেষকরা। ভাদু–মূর্তিকে সামনে রেখে ফসল ভাল হওয়ার প্রার্থনা করেন শিল্পীরা। অঝোর বৃষ্টি চান গানে গানে, চল্ ভাদু চল্ / মেঘে এল জল / ভিজে গেল দামি শাড়ি / ভেঙে গেল মল। কাটোয়ার বিধায়ক রবীন্দ্রনাথ চ্যাটার্জি বলেন, ‘বর্তমান রাজ্য সরকার ভাদু–সহ বাংলার বিভিন্ন লোকসংস্কৃতি বঁাচাতে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছেন। লোকশিল্পীদের মাসোহারার ব্যবস্থা করেছেন। বাংলার লুপ্তপ্রায় লোকসংস্কৃতির শাখাগুলিকে বঁাচাতে এমন পদক্ষেপ এর আগে কেউ নেয়নি।’

ভাদু গান গেয়ে ঘুরে বেড়ানোর শিল্পীরা কোনও পারিশ্রমিক দাবি করেন না। যার যা মন চায় দেন শ্রোতা–দর্শকরা। তাতেই খুশি শিল্পীরা। তবে দক্ষিণা দাবির কৌশলটিও বেশ। দাবি করা হয় গানের কলিতেই, ভাদু লে লে লে পয়সা দু’আনা / কিনে খাবি মিছরিদানা। সেই আবেদনে পয়সার বটুয়া উপচে পড়ে। শিল্পীদের হাসি চওড়া হয়। টিভি–মোবাইলের যুগেও মানুষ ভাদু গান শুনছেন, এটাই শিল্পীদের প্রাপ্তি। সেই প্রাপ্তির আনন্দই গানে গানে ঝরে, এক পিঠ চুল ভাদুর / পিঠের পরে রহে না/ শাশুড়িতে তেল দেয় না / চুলের যতন জানে না।

www.youtube.com/watch?v=6hhY_72Olx0

লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী সম্পর্কে

লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী –নামেই কবির পরিচয়। কবির বাড়ি পশ্চিমবঙ্গে বর্ধমান জেলার পাথরচুড় গ্রামে। প্রকৃতির সাথে পরিচয় ছোটবেলা থেকেই। বর্তমানে কবি বাংলা কবিতার আসর, বাংলার কবিতা ও কবিতা ক্লাবের সাথে যুক্ত। অবসর সময়ে কবি কবিতা লেখেন ও স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেন। কাব্যচর্চার সাথে সাথে তিনি সাহিত্যচর্চাও করেন। গল্প ও রম্য রচনা আর ছোট গল্প লিখেন। বহু একাঙ্ক নাটকও তিনি লিখেছেন। অন্ধকারের অন্তরালে, সমাজের শত্রু ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও বহু যাত্রাপালা -সোনা ডাকাত, শ্মশানে জ্বলছে স্বামীর চিতা উল্লেখযোগ্য। কবির অভিনয় প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে বিচারক মণ্ডলী তাঁকে বহু সম্মানে ভূষিত করেছেন। লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী একাধারে কবি ও অপর দিকে লেখক। তার লেখা “আমার গাঁ আমার মাটি”, আমার প্রিয় শহর জামুরিয়া, আমার প্রিয় শহর কুলটি, আমার প্রিয় শহর আসানসোল, আমার প্রিয় শহর রাণীগঞ্জ বহু পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী প্রকৃতপক্ষে হিন্দু ধর্মাবলম্বী হয়েও তিনি অন্য ধর্মকেও শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করেন। তিনি বিশ্বাস করেন সব মানুষই ঈশ্বরের সন্তান। তাই ধর্মে আলাদা হলেও আমরা সবাই ভাই ভাই।

1 thought on “ভাদুগান ও ভাদু উত্সব- ২০২০ (ষষ্ঠ পর্ব) ভাদুর কাহিনী, আলোচনা ও গীত সংকলন

  1. সিরিজটি কন্টিনিউ করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ কবি লক্ষ্মণ ভাণ্ডারী। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।