৩৯।
তাড়াতাড়ি মালপত্র আর দুই বোতল পানি নিয়ে ভাবীর পিছে পিছে বের হয়ে সামনে পার্ক করে রাখা গাড়িতে বসল। ড্রাইভিং সিটে ভাবী, তার পাশে ফিরোজ আর পিছনে মনিরার পাশে রাশেদ সাহেব। ভাবী বসে ম্যাপটা দেখে ফিরোজের সাথে রাস্তা সম্পর্কে কি কি যেন আলাপ করে নিল। পিছনে তাকিয়ে ফিরোজ জিজ্ঞেস করলো-
-ওখানে আমি কখনো যাইনি, কাছে গেলে তুমি চিনতে পারবে তো?
-হ্যাঁ আমি এই না এক বৎসর আগেই এসে গেলাম। আশা করি ভুলে যাই নি। তাছাড়া তোমাদের দেশ কি আর আমাদের দেশের মত? এখানে রাস্তায় কত সাইনপোস্ট দেয়া আছে না? তাই দেখেই তো যেতে পারবে, আর তুমি এত চিন্তা করছে কেন? মাস্টারনির পাশে বসে তোমার এতো চিন্তা কিসের? দেখি রোড ম্যাপটা দেখি
ম্যাপটা নিয়ে খুঁজে পেয়ে বললো-
-গত বার হিথরো থেকে যখন গিয়েছিলাম তখন এম ফাইভ দিয়ে যায়নি, সম্ভবত এম ফোর দিয়ে গেছে। এম ফাইভ গেছে স্ট্রাউডের উত্তর দিয়ে, এইতো গ্লস্টারসায়ার, ওখানে কাছে গেলেই আমি চিনব, চলো। ভাবী চলেন।
শেফালী গাড়ি ছেড়ে দিল। শহর থেকে বের হয়ে এম ফাইভ ধরে নব্বই পঁচানব্বই মাইল বেগে চালিয়ে ঘণ্টা খানিকের মধ্যেই রাশেদ বাম দিকে স্ট্রাউডের সাইন দেখে বললো-
-ভাবী দেখেছেন? স্ট্রাউড বাম দিকে।
-হ্যাঁ ভাই দেখেছি।
-তাহলে আর চিন্তা কি এগিয়ে চলেন। ভাবী, ভাগ্য ভাল যে আপনি চালাচ্ছেন, না হলে ইশারায় ফিরোজকে দেখিয়ে বললো এই মিয়া যে কোথায় নিয়ে যেত কে জানে!
-ঠিকই বলেছেন ভাই, লং রুটে ও চালাতেই চায় না, বলে আমি সাইন দেখে পড়ে নিতে পারি না। এত জোরে গাড়ি চালাচ্ছে বলে মনিরা ভয় পেয়ে বললো-
-চুপ কর ভাবীর সাথে কথা বলো না উনি নিজেই চিনে যেতে পারবে।
এর মধ্যেই ভাবী বায়ে টার্ন নেয়ার ইন্ডিকেটর জ্বালিয়ে দিয়েছে, আস্তে আস্তে বায়ের লেনে চলে আসছে। এবারে স্ট্রাউডের সাইন দেখেই বাম দিকে টার্ন নিতেই সামনে দেখা গেলো স্ট্রাউড মাত্র বিশ মাইল দূরে। স্ট্রাউড ছোট্ট একটা শহর। কাছে এসে রাশেদ ডান বাম বলে কিছু ক্ষণের মধ্যেই তার ভাইয়ের বাসার সামনে এসে দাঁড়ালো। গাড়ি থেকে মালপত্র নামিয়ে বাসার কলিং বেলের সুইচ টিপে দিল একটু পরে দরজার সাথের স্পিকারে শোনা গেলো,
-হু ইজ দেয়ার?
মনিরা এগিয়ে মাইকের সামনে বললো-
-আমি ভাবী, দরজা খোল।
দরজা খুলছে না। প্রায় দশ মিনিট কেটে গেলো, কি ব্যাপার? আবার বেল বাজাল, না, কোন শব্দ নেই। ফিরোজ, ভাবী এরা সবাই এ ওর মুখের দিকে দেখছে। আসার সময় গাড়ির ড্যাশ বোর্ডে দেখেছে তাপমাত্রা ০ ডিগ্রী। এই ঠাণ্ডার মধ্যে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যায়? মনিরা রাশেদ সাহেব উভয়ে উভয়ের দিকে তাকাচ্ছে, উভয়ের মুখে অব্যক্ত প্রশ্নের ছাপ কিন্তু কেও কিছু বলতে পারছে না। এভাবে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যায়? অপেক্ষা যে মৃত্যুর চেয়েও ভয়ংকর যন্ত্রণা দায়ক বিশেষ করে এই রকম পরিস্থিতিতে। প্রচণ্ড শীতে হাড়ে কাঁপুনি ধরার উপক্রম হয়েছে। নিজেদের গাড়িতে আসছে বলে তেমন গরম কাপড় গায়ে দিয়ে আসেনি।
আরও প্রায় মিনিট পাঁচেক পর রাশেদ সাহেবের ভাই এসে দরজা খুলে ফিরোজ আর তার স্ত্রীকে দেখে অবাক কি জানি হয়তোবা একটু লজ্জাও পেয়েছিলো। আগে ওদের দেখেনি তবে অনুমানে বুঝে নিল বড় ভাইয়ের যে বন্ধু লন্ডনে থাকে, হয়তো ইনিই সেই ফিরোজ ভাই। কোথা থেকে যেন একটু হাসি ধার করে এনে মুখে লাগিয়ে বললো আসুন ভিতরে আসুন। ফিরোজ রাশেদের সাথে মালামালগুলি নিয়ে ভিতরে ঢুকল। বাসার ভিতরে ঢুকেই মনিরা দেখল ওদের একমাত্র এগার বছরের মেয়েটি আগন্তুকদের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মনিরা বুকে টেনে নিয়ে বললো-
-আমাকে চিনেছ, বলত আমি কে?
-বড় চাচী।
রোজার দিন বলে ওর বৌ রান্না ঘরে ইফতার বানাচ্ছিল। মনিরা ভাবীকে নিয়ে রান্না ঘরেই চলে গেলো, রাশেদ ফিরোজকে নিয়ে বসার ঘরে বসিয়ে রেখে রান্না ঘরে ঢুকে মনিরার কোল থেকে ভাতিজিকে বুকে নিয়ে সেও মনিরার মত জিজ্ঞেস করলো-
-আমাকে চিনতে পেরেছ মা? বলত আমি কে?
-বড় চাচা।
ফিরোজ ওর সাথে আলাপ করছিলো, প্রথমে রাজনীতি নিয়ে আলাপ শুরু সে আবার এখানকার ডিসট্রিক্ট কাউন্সিলর।
-তোমাদের এই জায়গাটা তো বেশ সুন্দর, পাহাড়ি এলাকা। মাঝে মাঝে জঙ্গল চার দিকের দৃশ্য বেশ সুন্দর। আমি গাড়িতে বসে তাই ভাবছিলাম এই এলাকায় এসে বাড়ি করব কিনা, লন্ডনে একদম থাকতে ইচ্ছা করে না।
প্রায় পনের বিশ মিনিট পর শেফালি আর মনিরা রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে বসার ঘরে এসেই রাশেদ সাহেবকে ডেকে বাইরে বারান্দায় নিয়ে এলো। বারান্দা না ঠিক তবে দুই ঘরের মাঝের ফাঁকায় দাঁড়িয়ে
শেফালি বললো-
-ভাই কিছু মনে করবেন না, এখানে আপনাদের থাকা হবে না, এক্ষুনি উঠে পরুন। চলেন লন্ডনে ফিরে যাই।
-কি ব্যাপার ভাবী?
-বলব লন্ডন যেয়ে সব বলব আপনি এক মিনিটও দেরি করবেন না। মালপত্র যা নামিয়েছেন নিয়ে আবার গাড়িতে উঠে পরুন।
রাশেদ সাহেব কিছু বুঝতে না পেরে ভাবীর পিছনে মনিরাকে জিজ্ঞেস করলো, -কি ব্যাপার ভাবী কি বলছে?
-যা বলেছে তা তুমি স্পষ্টই শুনতে পেরেছ, যা বলেছে তাই কর পরে ভাবীই সব বলবে, দেরী করোনা, ইফতারির সময় হয়ে গেছে।
শুনেই রাশেদ সাহেবের মুখটা কাল আঁধার হয়ে গেলো, চোখ ভিজে গেলো, পায়ের তলা থেকে কে যেন টান দিয়ে মাটি গুলি সরিয়ে নিয়ে গেলো, বুকটা ছ্যাঁত করে কেঁপে উঠলো, গলা শুকিয়ে জিহ্বা আড়ষ্ট হয়ে গেলো। আর কোন কথা তার মুখ দিয়ে বের হলো না। মনিরা হতবিহবলের মত থমকে দাঁড়িয়ে রইল। মেয়েটা তখনো রাশেদের কাছে দাঁড়িয়ে একে একে সবার দিকে অবাক চোখে তাকাচ্ছে।
ভাবী আবার তাগিদ দিয়ে বসার ঘরে গিয়ে ফিরোজকে নিয়ে এসে কি সব আলাপ করলো। ফিরোজ রাশেদকে বললো-
-চলো তাড়াতাড়ি কর।
বলেই মালামাল যেখানে নামিয়ে রেখেছিলো সেখানে এসে দাঁড়িয়ে হঠাৎ কি যেন মনে করে পিছনে ঘুরে রাশেদকে বললো ওদের জন্য কি কি এনেছ সেগুলি বের করে দিয়ে যাও।
-না থাক, কি হবে ওসব দিয়ে, সময় নেই। ভাবী বলছে তাড়াতাড়ি করতে, চলো পরে কখনো সুযোগ হলে দেয়া যাবে।
দুজনে মিলে যে ভাবে এনেছিলো যেই ভাবে আবার গাড়িতে তুলে রেখে এসে দেখে মনিরার বুকে বাচ্চা মেয়েটা ভাবছে এর মধ্যে এমন কি হলো যে বড় চাচা চাচী এসেই আবার চলে যাচ্ছে! পৃথিবীতে ওর এই মাত্র এগার বৎসর বয়সের অভিজ্ঞতা দিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে। কোন কূল কিনারা পাচ্ছে না। পৃথিবীর কোন কাঠিন্যের ছোঁয়া ওকে এখনও স্পর্শ করতে পারেনি তাই ঠিক কোন সমাধান পাচ্ছে না। ফিরোজ এগিয়ে বসার ঘরে গিয়ে রাশেদের ভাইকে বললো-
-তাহলে আমরা আসি!
-বসেন এখনি যাবেন কেন একটু চা খেয়ে যান।
-না না চা খেতে হবে না, পরে কখনো এলে তখন হবে, এখন আসি।
মনি মেয়েটাকে ছেড়ে দিয়ে বললো-
-আসি মা, ভাল থেক, আমরা চললাম।
বলেই কোন রকমে ঘড় থেকে বের হয়ে গেলো। সামনে শেফালি পিছনে রাশেদ সাহেব আর তার পিছনে ফিরোজ। রাশেদ সাহেবের মনে হচ্ছিল তার পায়ে লোহার জুতা আর সে হেঁটে যাচ্ছে কোন চুম্বক বিছানো পথ দিয়ে। অনেক কষ্ট করে পা টেনে নিতে হচ্ছে, চুম্বক যেন তার পাগুলিকে আটকে ধরে রেখেছে সে পা চালাতে পারছে না।
ভালো লাগছে, তাই পড়ছি! চলুক পর্ব। সাথে আছি সারাক্ষণ। কবিকে শুভেচ্ছা।
শুভ কামনা আপনাকেও দাদা। ভাল থাকুন।
ভালোবাসা সালাম প্রিয় বন্ধু।
সালাম জনাব। কয়েকদিন আপনি না থাকায় সবকিছু কেমন বিড়াণ মনে হতো।
Very good!