ওরা দুজন এইমাত্র সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আগষ্টেরে প্রথম দিন আফ্রিকায় থাকবে। শেষ বয়সে মধুচন্দ্রিমা আর কি! আজ ২৬ জুলাই; কাল ২৭, তারপর ৩১ জুলাই; এইভাবে একদিন ১ আগস্ট হবে! কতোদূর —- !
-আগে কোন দেশে যাবো?
নোরিন জানতে চাইলো। সুতপা নোরিন। নাভিদ আদনানের স্ত্রী।
-কেনিয়া
নাভিদ জবাব দিল।
সে বিশেষ পাসপোর্টের অধিকারী; তাই ভিসা কোন বড় বিষয় না।
-ওখানে কি কি দেখবো?
-রিফটভ্যালি প্রভিন্সের টুরকানায় যাবো; লোকিচোগিয়ো বাদ দিয়ে বাকি মেজর এলাকাগুলিতে। এজন্য লডোয়াতে অবস্থান করতে হবে। আদিমানুষ এবং ওদের ডাইভারসড কালচার তোমার ভালো লাগেবেই। লেক টুরকানা দেখবো এবং অন দ্যা ওয়ে, ইকুয়েটর অতি অবশ্যই
-ওসব তুমি দেখেছ?
-হ্যাঁ। কেনিয়াতে যখন পোস্টিং ছিল কাজের জন্য বহুবার গিয়েছি। রিফটভ্যালি প্রভিন্সের এলডোরেট যথেষ্ট গ্রীন; বাকিটুকু ডেজার্ট। কেউ যেতে না চাইলেও আমার খুব আগ্রহ ছিল। এলাকাটা উদ্ধার করতে যাওয়ার উছিলায় ওসব উপভোগ করেছি। কী যে দারুণ সব কৃষ্টি কালচার ! এথনোগ্রাফিক স্টাডির জন্য ওখানে অসাধারণ সব বিষয় রয়েছে।
-ইকুয়েটর নিয়ে একটু বল।
-ওটা রিফ্টভ্যালি বা লডোয়ার পথেই পড়বে; নাইরোবি থেকে বেশি দূরে নয়। লডোয়া যেতে আমি অধিকাংশ সময় ফ্লাই করেছি। এর আড়াই তিনদিন আগে অফিসিয়াল ভেহিকল বাইরোডে গিয়ে লডোয়াতে উপস্থিত থাকতো। আকাশ পথে ঘণ্টা দেড়েক; কিন্তু বাইরোডে আড়াইদিনই লাগে। প্রথম যেবার বাইরোডে যাই ইকুয়েটর মিস করেছিলাম। আমার কাঠখোট্টা ড্রাইভার গাইড করেনি। পরে অবশ্য প্রতিবারই থেমেছি। যাওয়ার পথে থামলে ডান পাশের একটা ঘর থেকে একজন লোক বের হয়ে আসতো। কিছু ডলার বা কেনিয়ান শিলিং দিলে লোকটা ইকুয়েটরের ম্যাজিক দেখাতো
-ম্যাজিকটা কি?
-এখন দেখাই? নাভিদ মুচকি হাসলো
-না।
নাভিদের বুকে দুটো কিল মেরে নোরিন ইকুয়েটরের ম্যাজিক বলার জন্য তাগিদ দিল।
-ইকুয়েটরের বাংলা আমার মনে নেই। ওটা একটা ক্লিয়ার কাট স্ট্রেইট লাইন। এই লাইন থেকে নর্দান হেমিস্ফেয়ারের দিকে বিশ মিটার দূরে গিয়ে পানি ভর্তি গামলায় লোকটা একটা কাগজের টুকরা রাখলো। সাথে সাথে কাগজটা স্পিডে ক্লক-ওয়াইজ ঘুরতে লাগলে। সাউদার্ন হেমিস্ফেয়ারে একই দূরুত্বে এর ঠিক উল্টো ঘটলো; অর্থাৎ কাগজটি এন্টিক্লক ওয়াইজ ঘুরতে লাগলো। আর ইকুয়েটর লাইনে কাগজটি স্থির রইলো। ওই লাইনে তোমার ওজন ৬২ কেজি হবে যা প্রকৃত ওজন থেকে ৩% কম।
যাহোক, এরপর বনের মতোন এরিয়া; প্রচুর মধু। আমি নাম দিয়েছিলাম হানিফরেস্ট। যেতে যেতে এক সময় এলডোরেট শহর পড়বে। ওখানে আমার বন্ধু আছে। সাউথ সুদানে আমার চার বছরের মধ্যে ওকে তিন বছর পেয়েছি।
-মহিলা?
একটু উদ্ভিগ্ন হয়ে নোরিন জানতে চাইলো
-না। রিচার্ড এর কথা তোমাকে আগে বেশ কবার বলেছি।
যাহোক, পথে প্রচুর পাহাড় পাবে। পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে একেবেকে পথ গেছে। মন ভরবেই। যতোবেশি এগুবে; সবুজ কমতে থাকবে। এক সময় দেখবে, একে-৪৭ কাঁধে ৬ ফুটাধিক লম্বা কোন যুবতী; ডেজার্টে গরু, ছাগল, উট দেখভাল করছে। একটু যদি তাকাই দোষ দিবেনা তো?
-ঘুষি দেব
-তা দাও। ওদের ছবি ওঠাবেনা কিন্তু; গুলি করে দেবে। একটা ঘটনা বলি।
কেনিয়াতে প্রথম যেবার গেলাম; নাইরোবিতে ইসরাইল এমব্যাসির বিপরীতে যে হোটেলটা আছে ওখানে অফিস আমার একরাতের জন্য থাকার ব্যাবস্থা করেছিল। যতদূর মনে পড়ে ওটা বিশপ রোডে। হোটেলটা এক্সপেন্সিভ কিন্তু সুবিধা কম। কমপ্লেমেন্টারি কিছু ছিলোনা। আড়াই ডলার দিয়ে আধা লিটার জল কিনেছিলাম। এর সপ্তাহ দুয়েক পর আমি লডোয়াতে যাই একটা রোগের এপিডেমিক ইনভেস্টিগেশনের জন্য। সাথে অন্য একজন ভিনদেশি কলিগ ছিল। “মিস্টার টি-কাট” চুলের সাড়ে ছয় ফুটের মতো লম্বা যুবতীর হাতে একে-৪৭ দেখে সে পুলকিত হয়। লোভী কলিগটা ক্যামেরায় ক্লিক করতেই সেই যুবতী তার দিকে বন্দুক তাক করেছিল। মেরেই ফেলবে। তখন পাশ থেকে একজন পরামর্শ দিয়েছিলে অর্ধেক ভরা বোতলটা দিয়ে দিতে। নাইরোবির সেই হোটেলটাতে এক বোতল পানির দাম আড়াই ডলার যা দিয়ে লডোয়া কিংবা টুরকানা সাউথে একটা ছোট সাইজের ছাগল কেনা যায়।
-ছাগলের কথা বলছ কেন?
-ইন্টারন্যাশনাল বর্ডার থেকে ওরা বন্দুকগুলি কিনে। ডলার পাবে কোথায়? তাই বিনিময় মাধ্যম হিসেবে ওরা ছাগল ব্যাবহার করে
-পরে তোমার কলিগের কি হয়েছিল?
-ওই অর্ধেক বোতল জলই সমাধান ছিল
-ভেরি ইন্টারেস্টিং।
নোরিন মন্তব্য করলো।
-হ্যাঁ; একটা একে-৪৭ সমান মাঝারি বা বড় সাইজের একটা ছাগল; যার বাজার দাম দিয়ে ইসরাইল এমব্যাসির বিপরীত থেকে দুই লিটার জলও কিনতে পারতাম না।
এই জল নিয়ে আমার কিছু কাহিনি আছে; আজ একটা শোনাই। তার আগে বলি, লডোয়া আসলে টুরকানা সেন্ট্রালের কাউন্টি হেড কোয়ার্টার। এখন অবশ্য জেলা বলে; কাউণ্টি না। তো সেন্ট্রাল থেকে টুরকানা সাউথে যাচ্ছিলাম। আমার নিরাপত্তা প্রধানের নাম ছিল জন; বেশ ইন্টিলিজেন্ট। উপতক্যার মধ্যে পাথুরে পথ দিয়ে ঝাঁকুনি খেতে খেতে এগুচ্ছিলাম। সামনে হঠাৎ একে-৪৭ ধারী ২০-৩০ জনের একদল যুবক পথ আগলে দাঁড়াল। বাম দিক থেকে একই সংখ্যক বন্দুকধারী দৌঁড়ে আসছিল। জন ওর নিজের বাহিনীকে বন্দুক নামিয়ে ফেলতে বললো। পেছনের গাড়িতে আমি অতিভয়ে একেবারে ভয়শূন্য হয়ে পড়লাম।
-পরে কি হয়েছিল?
-জন নিগেশিয়েট করেছিল; জল দিয়ে।
মরুভূমিতে জলের বড় আকাল। ওখানে জায়গায় জায়গায় মরা নদির চিহ্ন আছে; লাঘা বলে। উগান্ডায় বৃষ্টি হলে লাঘায় প্রাণ আসে; ফ্ল্যাশ ফ্ল্যাড প্রাণ কেড়ে নেয়। নিজ চোক্ষে দেখেছি। কোন কোন এলাকায় ওই লাঘা খুঁড়ে খুঁড়ে ওরা চামড়া রঙের যেটুকু জল পায় তা দিয়েই দিন চালায়। শতকরা তিরাশি ভাগ লোক যাযাবর। কোথাও একটু জলের খবর পেলে ওরা সেখানে যায়। ফুরিয়ে গেলে আবার নতুন এলাকার খোঁজ করে। ওদের জীবনে জল নেই; প্রেম নেই।
সত্যি বলছি, ওরা প্রেম বুঝেনা। টুরকানায় যেয়ে তুমি যদি কোন কিছুকে প্রেম হিসেবে চিহ্নিত কর; সেটার দাম কমপক্ষে চার ইউনিট পোষা প্রাণী। যার প্রতিটি ইউনিটে তিরিশটা গরু বা ছাগল বা ভেড়া বা উট থাকে।
আবার বলি, ওখানে প্রেম মানে কমপক্ষে ১২০ টা প্রাণি।
-বুঝিয়ে বল
-আজ না ময়না; আগামিকাল বলবো। তবে জানিয়ে রাখি, সবসময় সাথে জল রাখবে। মেইন লাইট অফ করে নীল লাইটটা অন করতে করতে নাভিদ দুষ্টুমি মাখানো হাসি দিলো।
এখন ওদের নিঃশব্দে কথা বলার সময়; তাই বাকি কাহিনি কাল হবে। এখন নোরিন বেশ উতলা হয়ে আছে; নাভিদ ততোধিক।
ঘর ভরা নীল জোছনা; এখনই কী বৃষ্টি নামবে?
কয়েকবার চোখ পিছলে গেলেও আবার প্রথম থেকে শুরু। গল্পে গল্পে ভ্রমণের দেশে বেড়িয়েছি আপনার সাথে। আমার দেখা ভ্রমণ গল্পের মধ্যে আপনার এই আয়োজন আমার স্বতন্ত্র লেগেছে।
আপনার মন্তব্য আমার ভালো লেগেছে।
কমপ্লিমেন্টের জন্য ধন্যবাদ!
লিখাটি আমি গতকালই পড়েছি। বিদ্যুৎ বিপর্যয়ে আর ফেরা হয়নি। কৈফিয়তটুকু না দিলেও চলতো; দিলাম যে অসাধারণ এই উপস্থাপনায় সর্ব প্রথম স্বাগত বরণ আমি পারিনি। ধন্যবাদ মি. মিড ডে। সঞ্চালক নির্বাচিত হওয়ায় অভিনন্দন। এখন আপনি শব্দনীড় এর ফুল ডে ডেজারট। গুড লাক। শুভ সকাল।
মনের বিশালত্ব থেকে সম্ভবত বিনয় আসে। কৈফিয়ত এবং এই বিনয়ের মধ্যে পার্থক্য ব্যাপক। এখানে সুস্পষ্টভাবেই দ্বিতীয়টা। জনাব মুরুব্বী, এজন্য আপনাকে সম্মান জানাচ্ছি।
এই লেখাটার জন্য অল্পশব্দে বড় করে আমাকে কমপ্লিমেন্ট দিয়েছেন। এটার গভীরতায় আমি আনন্দিত! আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।
"বিশেষ নির্বাচনে" এই পোস্ট বেছে নেয়ায় শব্দনীড় এবং সঞ্চালকের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। গল্পের ঢঙ্গে লিখলেও এর প্রতিটা বিষয়ই সত্য; আধাবোতল পানির বিনিময়ে প্রাণরক্ষা পাওয়াসহ সবকিছু।
চমৎকার প্রতি-উত্তর করেছেন। ভালো লাগলো। ধন্যবাদ।

* আপনার উপস্থাপনা স্টাইলটা আমার কাছে বেশ স্বতন্ত্র মনে হয়েছে।
সুন্দর…
এটা আমার জন্য বড় কমপ্লিমেন্ট। আনন্দিত হয়েছি!
অনেক ধন্যবাদ!
"ওটা একটা ক্লিয়ার কাট স্ট্রেইট লাইন। এই লাইন থেকে নর্দান হেমিস্ফেয়ারের দিকে বিশ মিটার দূরে গিয়ে পানি ভর্তি গামলায় লোকটা একটা কাগজের টুকরা রাখলো। সাথে সাথে কাগজটা স্পিডে ক্লক-ওয়াইজ ঘুরতে লাগলে। সাউদার্ন হেমিস্ফেয়ারে একই দূরুত্বে এর ঠিক উল্টো ঘটলো; অর্থাৎ কাগজটি এন্টিক্লক ওয়াইজ ঘুরতে লাগলো। আর ইকুয়েটর লাইনে কাগজটি স্থির রইলো। ওই লাইনে তোমার ওজন ৬২ কেজি হবে যা প্রকৃত ওজন থেকে ৩% কম"……ইন্টারেস্টিং!
বোঝা গেলো "মধ্য দুপুরের মরুভূমি" নামের অন্তর্নিহিত অর্থ!
আপনার মন্তব্যে অন্যরকমের আনন্দ পেলাম; খু-উ-ব!
অনেক ধন্যবাদ !