বাবা নেই অনেক দিন হলো। দেড় যুগ পেরিয়ে গেছে। মাঝেমধ্যে মনে হয় কে যেন নাম ধরে ডাক দেয়। ঠিক বাবার কণ্ঠের মতো। রাশভারি গলা। আমি হুড়মুড় করে উঠে বসি বিছানায়। ঘুম ভাঙ্গলে দেখি গলা শুকিয়ে গেছে। দ্বিপ্রহর রাত। টেবিলের ওপর রাখা মগ থেকে ঢকঢক করে পানি পান করি। বড় রাস্তায় তখন এক-দুইটা গাড়ি চলাচল করছে। কিছুক্ষণ পর পরই প্যাঁ-পুঁ আওয়াজ। পাশে শুয়ে থাকা ছেলের দিকে তাকাই। নিষ্পাপ একটা মুখ। কতো যত্ন করে গড়ে দিয়েছেন বিধাতা। ঠিক আমার বাবার মতো দেখতে! অজান্তেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে বাবার মুখ। সেই মায়াময় হাসিমুখে যেনো আমাকে ডাকছেন। বাবা অদৃশ্য হয়ে যান ধীরে ধীরে। বাবা চোখের দৃষ্টি থেকে হারিয়ে গেলে টের পাই চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। অশ্রু মুছি না। অনেকটা ইচ্ছে করেই। এভাবে বাবা প্রায়ই আসেন। পাশে বসেন। কথা বলেন। মন্ত্রমুগ্ধের মতো আমি শুনি। শুধু তাঁকে ছুঁয়ে দিতে পারি না আগের মতো।
আমিও তো আমার সন্তানের বাবা! সেও কি আমার কথা মনে করে এভাবে রাত জেগে থাকবে? এমন করে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাবে কি ওর? আমার বাবার মতো আমিও কি তাঁকে ডাকবো? যখন সে বেভুল ঘুমে ঘুমিয়ে থাকবে।
বাবা নেই। কিন্তু তার ছোঁয়া লেগে আছে বাড়ির সব জায়গায়। এইযে আমার শাহাদৎ আঙুল, যে আঙুলটি বাবা তার হাতের মুঠোয় পুরে নিয়ে আমায় হেঁটে নিয়ে বেড়াতেন। ঝুল বারান্দায় ঝুলিয়ে রাখা বাজারের ব্যাগ, বাবার পানি পান করার জন্য বড় কাঁচের গ্লাস, হাতলওয়ালা কাঠের চেয়ার, ঘরের এককোণায় অবহেলায় পড়ে থাকা ভাঙ্গা হ্যারিকেন, তিন ব্যাটারির লাইটটিও আছে। কাঠের ডান্ডাওয়ালা ছাতাটিও আছে। আছে বাবার হাতের লাঠিটাও। সবকিছুতেই তাঁর হাতের পরশ লেগে আছে। শুধু তিনিই নেই।
তবুও বাবা আছেন। সব বাবারা আসে – যায়। অসীম শূল্যতা থেকে ডাকেন। কারণে – অকারণে। যা লিখে রাখে মহাকাল তার সবকিছুই সত্য নয়। মাকে দেখেছি, বাবা চলে যাবার পর অভিমানের কাঁটা গলায় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন সদর দরজায়। অপেক্ষা; এক পতিত সময়ের নাম। মাকে বুঝাতে পারিনি তখন। শ্বাস-প্রশ্বাস দীর্ঘ থেকে দীঘ হতে থাকে। মনে রাখিস, মৃত্যুতে মানুষের মুক্তি আসে বা বলতে পারিস মৃত্যুর আরেক নাম মুক্তি। বাবা বলেছিলেন। অথচ আমরা ক্রমশ বন্দি হয়ে যাই বাবার ছায়ার ভেতর।
সমস্ত দুপুর জুড়ে এখন থৈ থৈ রোদ। বাবা যেখানে বসতেন সেই কাঁঠাল গাছের ছায়াটাও উধাও। ঘুণপোকা খেয়েছে তার জলচৌকিটাও। হাতের লাঠিটারও কোন খোঁজ নেই দীর্ঘদিন। সবুজের ছাদে এখন বিরান ভূমি। পূর্ণিমা উড়ে এসে বসেছিল যে ঘরে সেখানে শুধু এখন শূন্যের হাহাকার। হায় রুদ্রপথ! তুমি কেমন করে রপ্ত করেছ বশীকরণ মন্ত্র। হাওয়া ঘরে এখন কালশীটে মেঘ। বাবার মস্ত বড় অভিমান। কতো বছর কেটে গেছে। দেখা নেই, কথা নেই। অথচ আমরা সবাই কেমন দিব্যি আছি। বেঁচে আছি। খাচ্ছি, ঘুরছি, ঘুমাচ্ছি। না, ঘুমাচ্ছি না। বাবা বলতেন, ঘুমের আরেক নাম মৃত্যু। ঘুম থেকে জেগে ওঠা মানে হলো মৃত্যুর কাছাকাছি থেকে ফিরে আসা।
কি করলে শোধ হয় রক্তঋণ? এই প্রশ্ন জুড়ে দিয়েছিলাম মায়ের আঁচলে। মা শুধু মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন, বড় হ বাবা। অনেক বড়। তারপর মাও অন্তর্ধ্যানে চলে গেলেন। আমি বড় হতে থাকি। আমার মাথায় মায়ের হাত। কপালে আদর রেখা। অতঃপর অপেক্ষা। নাতিদীর্ঘ বছর। মায়ের হাত আর সরে না মাথার ওপর থেকে। আমি কি তবে বড় হয়নি আজও?
শাব্দিক প্রকাশে অসাধারণ এক মুগ্ধতা … অসাধারণ এক বিষণ্নতায় মনটা ভরে উঠলো।
কাব্যানুভূতির অনন্য প্রকাশ কবি।