প্রাবন্ধিক সুশান্ত বর্মন। প্রত্ননিমগ্ন ‘পাখি তীর্থ দিনে’… সুশান্ত বর্মন। প্রথম অংশ।
কানাডা প্রবাসী মাসুদ খান পেশায় একজন প্রকৌশলী। যন্ত্রজীবী কবি যন্ত্র, ধাতু, বস্তু, জড়, কৃত্রিম, অপ্রাণজ বিজ্ঞানের দিকে তাকালে দ্বিধাহীন হয়ে যান। যন্ত্রের ভিতরের যন্ত্রটিকে তিনি নিমেষে বুঝে ফেলেন। তবে তিনি যন্ত্রবাদী নন। তাই তাঁর রচনায় বিজ্ঞান উপস্থিত হয় নিজস্ব সত্যবোধ ও ন্যায়নিষ্ঠতা নিয়ে। ফলে তাঁর কবিতা সমৃদ্ধ হয়েছে, লাভ করেছে আধুনিক যুগের নৈকট্য। তিনি বাংলা কবিতার গতিপথে একটি নতুন পথ যেমন তৈরি করতে পেরেছেন তেমনি কবিচরিত্র বা কবিত্বের সংজ্ঞা সম্পর্কেও তৈরি করেছেন নতুন দর্শন।
তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন আধুনিক যুগের কবিদের ভাববাদী হওয়াটা ততোটা জরুরি নয় যতোটা জরুরি প্রয়োজন বিজ্ঞানসচেতন হওয়ার। বিজ্ঞানের যুগে বাস করে যে কবি ভাববাদী হয়ে ওঠে সে তো পুরনোবাদী, তাকিয়ে থাকে অতীত গহ্বরের দিকে। তিনি জানেন এমন কোনো শর্ত নেই যে কবিদের বিজ্ঞানসচেতন হওয়া যাবেনা। তাহলে একালে বাস করে কেনো বিজ্ঞানবিমুখ থাকা; কেনোই বা বিজ্ঞান থেকে মুখ ফিরিয়ে প্রাচীন চেতনার দাসত্বে নিজেকে বন্দি করা।
সমকাল সম্পর্কে যে মানুষ অসচেতন সে নিজেই তো যান্ত্রিক, মৃত। এই সচেতনতার জন্যই তাঁর কবিতায় বিভিন্ন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সংশ্লিষ্ট শব্দ বারবার এসেছে। প্রতিদিনের যাপিত জীবনকে তিনি এড়িয়ে যেতে চাননি। ‘অকটেন’, ‘ম্যাঙ্গানিজ’, ‘প্রাণীবিজ্ঞান’, ‘স্বর্ণ’, ‘প্লাস্টিক’, ‘ফ্লাডলাইট’, ‘পারদস্তম্ভ’, ‘অম্লজান’, ‘সোডিয়াম’, ‘সিলিকন’, ‘রেডিও তরঙ্গ’, ‘ইঞ্জিন’, ‘গিয়ার’, ‘স্পিডোমিটার’, ‘ভূগোল’, ‘ইলাস্টিক’, ‘সুপারনোভা’, ‘গ্রাফাইট’, ‘ব্লাকহোল’, ‘ইলেকট্রন’ প্রভৃতি শব্দগুলি জীবনের প্রাত্যাহিক পরিচিতি নিয়েই তাঁর কবিতায় এসেছে।
তিনি জানেন বিজ্ঞানচেতনা মানে যন্ত্র ব্যবহারে পারদর্শীতা নয়, যন্ত্রের মৌলদর্শনকে ধারণ করা। তাঁর বিজ্ঞানসচেতনতা কোনো লোক দেখানো বিষয় নয়। তাই আধ্যাত্মিক নয় বরং বৈজ্ঞানিক সৃষ্টিতত্ত্বকে তিনি ধারণ করেন মনেপ্রাণে। ঐতিহাসিক বস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করেন সমাজকে। এজন্যই তিনি অকপটে বলে যান প্রাণীর সৃষ্টিতত্ত্ব ও মানুষের সামাজিক ইতিহাস-
“ডাঙায় প্রথমে খ’সে গেলো বাঁকা লেজের অহং
ধীরে ধীরে গুল্মীভূত হলো দেহ।
কামারশালার গনগনে কান্তলোহা,
আগুনের ফুল আর ফুলকার অক্সিজেনে সখ্য হলো।”
এই ইতিহাস আমাদের অচেনা নয়। কিন্তু একালে বসে মাসুদ খান বেদনার সাথে দেখেন-
“কংকালের লোভে ব’সে ব’সে ঝিমোচ্ছে
পৃথিবীর নিঃস্ব প্রাণীবিজ্ঞান
পাঠাগার থেকে চোখ মুছে ফেরে ব্যাধ”। (ত্রিজ)
মহাকালের সামনে দাঁড়িয়ে কবি দেখেন-
“ধর্ম ও বীর্যবাসনা প্রবল হ’লে জাগে টান…
ক্ষুধায় ধর্মলালায় যৌনে ও প্রেমে
হরিণ ও চিতার রূপচিত্রগতি অবিরল চকচকে যুগ্ম ট্রাজেক্টরি।”
(একটি চিত্রিত হরিণের পেছনে একটি চিত্রিত বাঘ ছুটছে)
আপাতদৃষ্টিতে মানুষ যূথপ্রেমী হলেও প্রধানত সে নিঃসঙ্গ। সমাজের একক মানুষের জীবন জীবনব্যাপী সঙ্গীহীন সাথীহীন। শত কোলাহলের মাঝেও মানুষের একাকিত্ব কাটেনা। পরিজন বেষ্টিত জীবনেও মানুষ নিরন্তর একা হয়ে থাকে। আত্মবাদী বর্তমানকালে মানুষ নিরন্তর নিজেকে আবিষ্কার করতে চায় সামাজিক ও অর্থনৈতিক সাফল্যের চূড়ায়। কিন্তু প্রতিষ্ঠার স্বীকৃতিও মানুষের অন্তর্মুখীতা দূর করতে পারেনা। সাফল্যছোঁয়া মানুষ তাই বুঝে ফেলে এই বিজন জীবন তার নিজেরই মাত্র। এই মিত্রহীন মানুষ অনবরত খুঁজে বেড়ায় একাকিত্ববিরোধী বিভিন্ন বস্তুমালা। একাকিত্বের নিঃসীম অন্ধকারে দাঁড়িয়ে মানুষ খুঁজে নেয় যূথধারণার মৌলিক দর্শনটিকে। “ঐ বাঁধে নির্জন সভাপতি থাকে। সন্ধ্যাভাষা জানে।”
মাসুদ খানের কবিকীর্তির অনবদ্য উপহার উপমা বৈচিত্র। তাঁর কবিতার উপমা ও রূপকগুলো বাংলা শব্দভাণ্ডারে একাধিক নতুন শব্দবন্ধ সংযুক্ত করেছে। ‘কীটপুত্র’, ‘ঐশী পর্যটন’, ‘অণ্ডআত্মা’, ‘আলকাতরার জলাশয়’, ‘ক্রোমোজমের উল্লাস’, ‘রাত্রিগ্রস্ত’, ‘শাদা হিংসা’, ‘ছাইরঙা সন্ন্যাস’, ‘অগ্নিপাহাড়’, ‘অন্তরঙ্গ রোম’, ‘ঘন চৈত্রদুপুর’ প্রভৃতি উপমা/ রূপক বাংলা সাহিত্যে একেবারে মৌলিক।
‘চেরাগজন্ম’ কবিতায় সমসময়ের চাপে বাংলার এক চারণের জন্ম বৃথা যায়। এর ফলে যে মহাবিপর্যয় ঘটে তার রূপক অভিনব ও অভূতপূর্ব।
“চারণ, তোমার চেরাগজন্ম বৃথা যায়
মন্দ গাহিছে লোকে দিকে দিকে পুনর্বার
চিমনি চিড় খায় আজ উন্মার্গ জলের ছিটায়
চিমনি চিড়ে যায় আজ চক্রবাল থেকে
তেড়ে আসা অভিশাপে, ভৎর্সনায়।”
তাঁর রচনায় ‘চারণ’, ‘শ্রমণ’, ‘নিষাদ’, ‘ব্যাধ’, ‘শুদ্র’, ‘হরপ্পা’, ‘ধীবর’, ‘টোটেম’ প্রভৃতি প্রত্নইতিহাস ও নৃবিজ্ঞান সংশ্লিষ্ট শব্দগুলো বারবার এসেছে। এই শব্দগুলো শত অতীত মনে হলেও তা পুরান, রূপকথা, অলৌকিক, মীথ বা পরকালবাসী কোনো শব্দ নয়। এই শব্দগুলো প্রাক্তন মনে হলেও পরদেশী নয়। সেমেটিয় নীতিবোধের অবাধ প্রচলন আমাদের প্রান্তিক সমাজে যে স্থায়ী রাত্রিকালের সৃষ্টি করেছে তার প্রতি তিনি আশরীর ক্রোধ ও আমাদের নিজস্ব অর্থাৎ নিষাদ, শবর, অষ্ট্রোলয়েডদের জীবনের প্রতি প্রবল আগ্রহ বোধ করেন।
তাই তাঁর মননে প্রত্নইতিহাস কোনো সেমিনার কেন্দ্রিক শব্দচিত্র সাজায় না। তিনি নিজের রক্তের দিকে, কোষের দিকে, ক্রোমোজম-ডিএনএ’র দিকে তাকিয়ে নিজেকেই খোঁজেন। প্রতিষ্ঠিত স্ববিরোধীতা ও ভণ্ডামোর রাজত্বে বাস করতে করতে ক্লান্ত তিনি অতঃপর সচকিত হয়ে ওঠেন। দেখেন প্রত্নমানুষেরা আজ আর পরাজিত নয়।
কারণ আজ এসেছে ‘উর্ধ্বগমনের দিন’-
“পুরাতন বস্তু থেকে উত্থিত সেই কবেকার
ব্রাত্য সংকেতেরা এতোদিন পর আজ কেন ধেয়ে আসছে
তীব্র জ্বরকম্পন নিয়ে রেডিও তরঙ্গে তরঙ্গে।
এই কায়া, এই নিঃসীম বিভ্রান্তি,
ছায়াসহ, কোথায় লুকিয়ে রেখে
তবে যাই উর্ধ্বগমনে ?”
প্রত্নপ্রেমিক কবি জানেন-
“হরপ্পার কোষে খুব হাতুড়ি-গর্জন, হ্রেষা, সিংহের বৃংহণ শাবল মোহর শিশু সিন্ধু সুরকি পাখি লেদ লায়ারের মিশ্রিত কূজন আরো বহু শব্দ ছিলো।”
এমন বিপর্যস্ত সমাজে বাস করেও কবি মোটেও আশাহীন নন। কারণ-
“শ্রীকৃষ্ণকে মাঝে মাঝে তাই লীলাকৃত্য ফেলে
উষাকাল থেকে
বিবিধ আমিষ ও অ্যামিনো অম্লের সামনে দাঁড়াতে হয়
নিষ্পলক, নিয়তিবাধিত।
দেখে যেতে হয়
আমিষে এসিডে ঠিক কখন উন্মেষ, প্রথম স্পন্দনের।” (স্রোত)
এই সমসময়ের বাস্তবতা হচ্ছে-
“ইতিহাস-কারাভাঁচ্যুত পশু ও মানুষ
আবার নতুন কার কাটা মুষ্ককোষ ঘিরে আবর্তিত
কালে কালে হাড়ের কাঠামো অতিক্রম ক’রে
ছলকে ছলকে ওঠে মাংশ
পচনপ্রবণ, শুধু মাংশের ছোবল।
পঙ্গু ভিখারির বিষন্ন আত্মমৈথুনের মতো
কাঁটাতারে হঠাৎ আটকে যাওয়া ভুবনচিলের
লালদীর্ঘ চিৎকারের মতো।” (স্বকাল)
এই অপার্থিব অমানবিকতার ধারাবাহিকতা ক্রমান্বয়ে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ ধারণ করছে। মানুষ এখন আর মানুষের নেই। শত হিংসাজর্জর। তিনি জানেন যুগে যুগে ভূমিজ মানুষেরা অপশক্তির হাতে নির্যাতিত হয়েছে, প্রতারিত হয়েছে। বিভিন্ন রঙের-ঢঙের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিরা ভূমিপুত্রদের ধ্বংস করতে চেয়েছে। তাই বলে তারা কখনও পরাজিত হয়নি। কালের ইতিহাস আমাদের এই সত্যই শেখায় যে সভ্যতা ও সংস্কৃতি সবসময়ই জয়ী হয়। তাই তিনি প্রত্যাশা করেন-
“সব উদ্বৃত্ত নিদ্রা আর আচ্ছন্নতা
পরিত্যাগ ক’রে কন্যা একসময় গাত্রোত্থান করবে,
সকন্যা আমাদের উজ্জ্বল গৃহযাত্রা হবে-
সেই দুর্মর অভিলাষ ঘিরে এই সাধ্যসাধনা নিরন্তর।” (কন্যাসংহিতা)
তাঁর এই আশাবাদ কোন অলৌকিক স্বপ্ন নয়। কষ্টকল্পিত চেতনার বহিঃপ্রকাশও নয়। তাঁর একান্ত প্রার্থনা-
“এইবার এই অবেলায়, হে জ্ঞাতি, হে রহস্যের উপজাতি,
অন্তহীন শিবলিঙ্গের প্রহরী,
গলমান গ্রাফাইট স্তরের ওপর গড়াগড়ি দাও
পুনর্বার পাপ ক’রে ফিরে এসো
পুনর্বার মুদ্রণযন্ত্র ভেঙে ভূমিসাৎ ক’রে দাও হে অর্জুন
স্মৃতিভ্রষ্ট ব্যাধ, স্মরণকালের হে অবিস্মরণীয় ব্যাধি।” (সার্কারামা)
মাসুদ খান মানুষের সার্বিক মুক্তির স্বপ্নটিকে অনিশ্চিত ভাবেননা। তিনি জানেন এই হিংসাকাতর যাপিত জীবন মূলত বৃত্ত মাত্র। এক মহাকালিক বৃত্তের ফাঁদে বন্দি আমরা-
“বৃত্ত ঘোরে মহাবৃত্ত
বিনাশ, মহামারী নৃত্য
মনুকুলের শেষকৃত্য
প্রাণী এবং পতঙ্গের সাথে।” (সার্কারামা)
বস্তুবাদী কবির উপলব্ধি বড়ই অমোঘ ও নির্মোহ। তাই প্রাত্যাহিক জীবনের শত দুঃখ-ক্ষোভ-যন্ত্রণা থেকে আড়াল পেতে আমাদেরকে প্রতিনিয়ত জপ করার জন্য প্রদান করেন একটি সত্যমন্ত্র-
“শ্রবণ বধির ক’রে দিয়ে বয় মহাবৃত্তের হাওয়া
বস্তুর থেকে বিকশিত ফের বস্তুতে ফিরে যাওয়া।”
কবিঃ মাসুদ খান ( জন্মঃ জয়পুরহাট ২৯/০৫/১৯৫৯ )
কৃতজ্ঞতা প্রকাশঃ সুশান্ত বর্মন। প্রাত্যাহিক পায়চারি ব্লগ।
থেকে সবিনয়ে শেয়ার করা হলো।