দেহ বস্ত্রে ভাব চেতনায় অনর্থক ধনী মানুষের কাতারে না ফেলে সাধারণ একজন সচ্ছল সংসারি মানুষ ভাবলে আমাকে বুঝে নিতে অনেকের সহজ হবে। আর দশটা রোজগেরে মানুষের মতো আমার সংসারেও মাসের পঁচিশ তারিখে অভাব এসে ঘর বাঁধে। বাচ্চাদের পড়াশুনা স্কুল খরচা গৃহ শিক্ষদের টিউশন ফি নিজের ঔষধ থেকে শুরু করে তেল নুন আটা চাউল বিদ্যুৎ গ্যাস সবই জগদ্দল পাথরের মতো বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। দীর্ঘ প্রবাস এবং সঞ্চিত অর্থ তাঁতীর লোভের মতো সহযোগি ব্যবসায় আর শেয়ার মার্কেটে ওয়ানওয়ে হয়ে ঢুকে বসে আছে। দীর্ঘ তিন চার বছর অপেক্ষায় থেকে এখন আশা ছেড়ে দিয়েছি। এই কাহিনী আমার সবচেয়ে কাছের; এমনকি এই শব্দনীড় ব্লগ বন্ধু ঘনিষ্ঠ যারা রয়েছেন তারাও ওয়াকিবহাল হয়েছেন। একটু গৃহকোণ গোত্রীয় মানুষ বলেই জীবনের সত্য কথা গুলোন আমি সহজেই বন্ধুদের বলে দেই। এমনও সময় আসে নেট বিল এর দেড় হাজার টাকাও আমার কাছে অসহনীয় পর্যায়ে চলে যায়। বিব্রত বোধ করি।
ভালো মন্দ মিলায়ে ভালোই চলছিলো সময়। জীবনের পরে কোন অভিযোগ ছিলো না। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের সাথে মাঝে মধ্যে হাই হ্যালো্ ছাড়া সম্পর্ক গুলোন ক্ষয়ে যেতে যেতে এখন আর ঠিক সম্পর্ক বলা চলে না; বলা যায় ছেঁড়া সুতোয় ঝুলে থাকা স্মৃতির বরফ খণ্ড। স্মৃতির খাতায় ঝাপসা হয়ে উঠা একেকটা গল্প। তবে স্বতন্ত্র নয়। জট বাঁধা সুতলি। জট ছড়ানো মানা।
কেউ কেউ থাকেন গা ঘেঁষা টাইপের। জীবনের এতোটা পথ পেরিয়ে এসে এটুকু অন্তত বুঝেছি; হয় সে সাহায্য চাইবে নইলে বেশী মাত্রার উৎসুক এবং মিশুক দুটোই হতে পারে। মিশুক এক বন্ধুই ঝুলে ছিলো বহুদিন। প্রয়োজনটা তার। প্রয়োজন আমাকে। ফলাফল দীর্ঘ সাতটি বছর আমি তার নয়; তার সন্তানের প্রয়োজন মিটিয়েছি। বন্ধু কন্যার দেহে রক্ত প্রয়োজনে নিয়মিত পাশে থেকেছি। বন্ধুর চাইতে বন্ধুর কন্যার প্রয়োজন শুনলেই নিজেকে বাঁধা দিতে পারতাম না। ছুটে চলে যেতাম। শুধু বলতাম – কবে লাগবে সেইটা বল। কেননা অর্থ সমৃদ্ধি না থাকলেও যেটা আমার আছে তা আমি বিনা শর্তে দিতে পারি। রক্ত। বন্ধু নয় বন্ধুর কন্যার সাথে তৈরী হয়ে যায় আমার রক্ত সম্পর্ক। পরিবারের বাইরে স্বতন্ত্র কিছু।
সপ্তম শ্রেণী পড়ুয়া তের বছরের মেধাবী এই কিশোরীকে দু মাস পরে রক্ত শূন্যে ফুলে উঠা হলদেটে মুখটা দেখলে বুকটা মোচড় দিয়ে উঠতো। গরম রক্ত শরীরে যাবার ঘন্টা দুয়েক পরে মেয়েটার ভুবন ভোলানো হাসিই আমার আমিকে সবচেয়ে সুখি অভাববোধহীন একজন মানুষে পরিণত করে ফেলতো। খেয়াল করলাম এখন আর দুই মাস মেয়েটার সেই হাসি স্থায়ী হয় না। দেহের আকৃতি পরিবর্তনের সাথে সাথে চাহিদা তার বাড়ছে। বরফ সুত্র জনা কয়েক বন্ধুদের সাথে আলাপ করে মেয়েটার স্থায়ী একটা ব্যবস্থার সাহায্য চাইলাম। উৎফুল্ল ঝকঝকে বন্ধুদের চেহারা হঠাৎ অমাবস্যার নিষ্প্রভতায় ভরে উঠতেও দেখলাম। আশ্বস্ত বাণী আর প্রতিশ্রুতি নিয়ে ফিরে এলাম। জগতে সবাই ব্যস্ত। এই তো সেদিন খুব খুব যোগাযোগ হতো। চরম কর্ম ব্যস্ততায় ফোনের রিসিভ বাটনে চাপ দিয়ে কেমন আছিস শব্দটি বলবার মতো সময় এখন হারিয়েছে। তাদেরই কাকে যেন দেখলাম কি এক অধিকার আর সাম্যের শোভাযাত্রার প্রথম সারিতে।
বেসরকারিতে নেয়া গেলো না। সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই গন্তব্য। বড় বড় সব প্রফেসররা এখানে বাধ্য দায়িত্ব নিয়ে কাজ করেন। কোর্ট কাচারিতে টাকা স্যালাইনের ফোঁটার মতো বিন্দু বিন্দু যায়, সেখানে হাসপাতালের খরচা যায় বালতি বালতি। সীমিত সাহায্য, বন্ধুর জমি বিক্রয়ের সঞ্চয় আর নিজের যা ছিলো তা দিয়েই অপারেশন করানো হলো। অপারেশন সাকসেস। আনন্দে চোখ ভিজে উঠলো। যোগাযোগ সম্ভব সাহায্যকারীদের জানিয়ে দিলাম খুশির সংবাদ।
চব্বিশ ঘন্টা না যেতেই অপারেশনে ইনফেকশন। প্রফেসর অথবা অপারেশন যারা অপারেট করেছেন তাদের দুয়েকজনকে মুখে চিনলেও বাকিদের সাক্ষাৎ পেলাম না। চলতে থাকলো এন্টিবায়োটিক আর এন্টিবায়োটিক। শেষ দূর্ঘটনার আগের দিন ৩রা জুলাই বুধবার। কাঁচের রুমের আড়াল থেকে দেখে রোগীর ভালো মন্দ বুঝতে পারলাম না। রোগীর কোন উন্নতি অবনতির খবর কর্তব্যরত ডা. জানান নাই। জিজ্ঞাসা করতে নার্স এবং সহকারী ডা. জানালেন বিষয়টা স্যার (প্রফেসর) জানেন। মেয়েটির বাবা-মা না খেয়ে বসে আছে। হাতে এক গাদা প্রেসক্রিপশন। বাসা থেকে খাবার ক্যারিয়ার নিয়ে গিয়েছিলাম। ক্ষুধার্ত পেটে ক্যারিয়ার খালি হতে সময় নিলো না। হাসপাতালের ভাণ্ডারে প্রেসক্রিপশনের ঔষধ নেই। আছে শুধু প্যারাসিটামল। মেডিসিন দোকানি এ কয়দিন যাওয়া আসায় মুখ চেনা খরিদ্দার হিসেবে চিনে নিয়েছে। ঔষধ নিলাম। বললাম দামটা আগামীকাল দেবো। আর যদি কিছু লাগে দিবেন। টাকার সমস্যা হবে না। ০৩.০৭.১৩
পরের দিন বৃহস্পতিবার প্রবাসী দুই বন্ধুর বড় একটা এমাউন্ট পেয়েই ছুটলাম। বড় দুঃসংবাদটা সেখানেই অপেক্ষা করছিলো। এন্টিবায়োটিক গতকাল যতগুলোন কিনে দিয়ে এসেছিলাম তার সবই রোগীর শরীরে না দিয়ে নার্স অথবা অন্য কেউ চুরি করে বাইরে বিক্রী করে দিয়েছে। যাকে ধরি সেই ই বলে ডিউটিতে সে ছিলো না। মাথায় রক্ত চড়ে গেলো। হন্যে হয়ে প্রফেসরের খোঁজে পাগলের মতো ছুটলাম। স্যার আছেন ছুটিতে। কোন কন্টাক্ট নাম্বার দেয়া সম্ভব নয়। অনেক ক্লিনিকে তিনি বসেন সেখান থেকে পারলে সংগ্রহ করুন। আফসোস। মনটায় অদৃশ্য অশুভ এক ডাক শুনতে পেলাম। পারলাম না বাঁচাতে মা !!
কেউ কেউ রেডিও আবেদন এবং শিফট করার পরামর্শ দিলেন। অভ্যর্থনা টেবিলে অনুরোধটা করতেই প্রফেসর স্যার এর লিখিত অনুমতি ছাড়া সম্ভব নয় বলে শাসিয়ে দিলেন বদরাগী নার্স ডাক্তাররা। ইচ্ছে করছিলো মেয়েটাকে নিয়ে পালিয়ে আসি। অক্সিজেন টিউব আর মুখ দিয়ে ফুসফুস পর্যন্ত পাইপ ঢুকিয়ে রাখা মানুষকে নিয়ে পালানো সম্ভব নয় বুঝলাম। এবার ডবল ডবল এন্টিবায়োটিক পুনরায় কিনতে যেয়ে সব বেড়িয়ে গেলো হাতে যা ছিলো। চোখের সামনে পুশ করালাম ঠিকই; বাকিটা আবার রয়ে গেলো ঔষধ চোর দলের আওতায়। আইসিইউ থেকে সিসিইউ। নিবিড় পর্যবেক্ষণ থেকে অতি নিবিড়ে প্রবেশ। গভীর জল।
ঘরের বাচ্চাদের রোজ দুইবেলা স্কুলে আনা নেয়ার জন্য নিজের মোটর বাইকটা বিক্রয় করে দিলাম। হাতে এখন টাকা আছে। মনটা বেশ প্রফুল্ল। টাকার সমস্যা আর রইলো না। ফেসবুকে দুই তিনজন বন্ধু জানালেন : নিজে এবং তাঁদের পরিচিত বন্ধুদের সাথে বিষয়টি নিয়ে তাঁরা স্বেচ্ছায় আলোচনা করেছেন। পরশু তরশু কিছু সাহায়্য পাঠাবেন। আমি স্পষ্ট এবং লিখিত ভাবে জানিয়ে দিয়েছি : আমার তো আর টাকা লাগবে না। আমার কাছে এখন আছে। তারপরও পরামর্শ দিলেন বাচ্চাটার জন্য না হোক; পরিবারটির জন্যেও তো লাগতে পারে। স্মিত হাসির ইমো ব্যবহার করে সমর্থন দিয়ে বলেছি … এটা তো ভুলে গিয়েছিলাম। মন্দ বলেন নি। আচ্ছা ঠিক আছে। আজ সেই পরশু তরশু পেরিয়েছে। আমার কোন দুঃখবোধ নেই। সবারই নিজস্ব কাজ আছে এবং থাকে। সকাল সন্ধ্যার যান্ত্রিক জীবনে ইচ্ছে থাকলেও সম্ভব হয় না। যেমনটি তাঁদের সম্ভব হয়নি।
গত রাত থেকেই কেমন জানি অস্থির লাগছে। আজ ৭ তারিখ একটু সকালেই বেড়িয়ে সোজা হাসপাতাল। মেয়েটা গভীর ঘুমে। এক হাতে রক্ত পুশের সিরিঞ্জ অন্য হাতে স্যালাইন। প্যাথিডিনের প্রভাবে অচেতন দেহ। ফোঁটা ফোঁটা রক্তের সাথে বুক ভতি পুঁজ মিশে যাচ্ছে শরীরে। আমি বুঝে গেলাম এখন আর সরে যাওয়া যাবে না। একে নিয়েই বাড়ি ফিরতে হবে যখন তখন। বন্ধুকে বললাম ভ্যান ঠিক করো। প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাক চোখে তাকিয়ে রইলো। মাথা নিচু করে চলে গেলো সামনে থেকে। মেয়ের মা বাড়ি গেছে সকালেই। দীর্ঘ কয়েক রাত জেগে নিজেই অসুস্থ্য। শরীর আর কত সয়। ক্লান্তির কাছে মেয়ে মায়া খানিকটা ফিকে।
দুপুর ২: ৪০। নার্স এসে বললো আপনারা কেউ আসুন। গেলাম। অচেতন মেয়েটা হাসি মুখে তাকিয়ে। সে চোখে যেন দৃষ্টি নেই। মেয়েটি চলে গেছে। চিরতরে। অবাক চোখে তাকিয়ে থাকলাম। ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে মনিটরিং কেবল থেকে শুরু করে সব খুলে নিয়েছে নার্স। ডা, বললেন তাড়াতাড়ি নিয়ে যাবার ব্যবস্থা নিন। পায়ের মাটি যেন সরে গেছে। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। একটা বেড এর হাতল ধরে কোনক্রমে থাকলাম। কি হলো। সব বৃথা গেলো। কেন এমন হয় ?
এক বন্ধুকে ফোনে কাফনের কাপড় কিনে চলে আসার অনুরোধ জানিয়ে চাদরে মুড়িয়ে ভ্যানে করে গ্রামের বাড়ি পৌঁছালাম। যে কান্না আমি শুনতে পারি না। সে ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ঘটলো মায়ের কান্না। আত্মীয় স্বজনের কান্না। ছোট ভাইটির কান্না। আমি কাঁদতে পারি না। আমার চোখে জল আসে, বুক আটকে দম বন্ধ হয়ে আসে, ফুঁপিয়ে উঠি বারবার কিন্তু চোখে জল আনতে পারি না। ঠাঁয় বসে রইলাম এক কোণে। গ্রামের মানুষ তড়িত কাজ শুরু করে দিলো। দুর্গন্ধের ভয়ে সবাই যেন মাটি চাপা দিতে চাইছে। সংক্ষিপ্ত অল্প কজন লোক নিয়ে জানাজা হলো। শেষ সময়ে এই কয়েকদিনের যন্ত্রণায় আরো ছোট হয়ে আসা রুগ্ন দেহ দুহাতে পাঁজকোলা করে সাড়ে তিন হাত মাটিতে যাতে ব্যাথা না পায় শুইয়ে দিলাম। নিয়ম ভেঙ্গে দড়ি আলগা করার সময় একপলক মেয়েটার শেষ গোসল করানো চেহারাটা শেষ একবার দেখলাম। মাথা নাড়লাম। মোমের আলোয় শেষ দেখা।
শুভ্র বসনে সে যেনো আমায় অপরাধী করে গেলো হেসে।
ডায়েরির মতো করে এই লিখাটির চার ভাগের তিন ভাগ লিখে রেখেছিলাম অপেক্ষা শিরোনামে। একটা সুসংবাদ ঠিক পাবো সেদিন প্রকাশ করবো এই আশায়। আমার কোন আশা সহজে পূরণ হয় না। বড়ই দুর্ভাগা আমি। আমি তাকে বাঁচাতে পারিনি। আমায় আপনারা ক্ষমা করবেন। তার আত্মা শান্তিতে থাক।
ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন। আমীন।
প্রাসঙ্গিক পূর্বকথন : প্লীহা অপারেশনে অর্থ সাহায্যে যারা হাত বাড়ালেন তাঁদের নাম আপডেট:: ঐচ্ছিক সাহায্য পাঠাবার আজই শেষ দিন।
বিরতি : দিয়েছি অনেক … নিয়েছো তার চেয়ে বেশী।