**
আজ ট্রেনে সামনে বসলো চরম সুন্দরী এক অস্ট্রেলিয়ান মেয়ে। অবশ্য ওরা অনেকেই ভীষন সুন্দর। লালচে সোনালী চুলের মিশেলে মেয়েটার হাত পা সবকিছু এতো সুন্দর। চোখে পড়েছে সিলভার কালারের চশমা। ওর ওভারকোট, ব্যাগের রঙ জুতোর কালার এক।
আমি ওর দিকে একটু পর পর তাকাচ্ছি আর ভাবছি ওর মা নিশ্চয়ই খুব সুন্দরী। আশ্চর্য যে, ওর পাশেই বসেছে এক ঘন কৃষ্ণবর্ণের মেয়ে। সাথে ওর বাচ্চা। দুজনই এতো কালো যে কালোর যেন দ্যুতি ছড়াচ্ছে। ওরা দুজন পাশাপাশি বসাতে আমি দুজনের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম ওদের দুজনের মনের মধ্যেকার ভাবনা চিন্তা না জানি কেমন ! আমি এখানে কোনো কালো মেয়েকে খুব উচ্ছ্বল হয়ে হাসতে দেখিনি। খুব যেন মন খারাপ। কারো দিকে তাকায় না। শুধু নিজস্ব ঘরানার মানুষজনের সাথেই কথা বলে।
আচ্ছা ওরা হাসে না কেন ? ওরা কি অন্যদের মনের ভাষা বোঝে ?
মানুষ তো আসলেও রেসিস্ট। রেসিসিজম থেকে মুক্তি নেই।
আমি কালো মেয়ের বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে হাসলাম। ওর বয়েস মাত্র একবছর বা তার বেশি কিছু হতে পারে। আশ্চর্য এটুকু বাচ্চা আমার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লো। নিশ্চয়ই এই ছেলে জিনিয়াস হবে। মানুষের চোখের ভাষা মনের ভাষা বোঝার ক্ষমতা তো বড়দেরই হয় না। আর শিশু !!
**
নেডা – নামে যে ল্যাঙ্গুয়েজ শিক্ষক আমাদের ক্লাস নিচ্ছেন – ভদ্রমহিলার বয়েস মিনিমাম ৭৫ হবে। ছয় ফিট লম্বা প্রায় -স্লিম। শরীর শক্ত পোক্ত হলেও প্রায় বাঁকা হয়ে গেছেন মহিলা। কিন্তু খুব উদ্যমী। ওরা এন্থোয়াসিয়াসটিক শব্দটাকে খুব গুরুত্ব দেয়। তাই প্রতিটা জবের পাশে এই উদ্যম শব্দটা খুবই আবশ্যিক ভাবে থাকে। উনি লেকচারের মাঝখানে প্রায় নিজের ফ্যামিলি, ছেলেমেয়ের গল্প করেন। তার মেয়ে আইটি প্রফেশনাল। কথায় কথায় এখানে ধনী, গরীব এবং মধ্যবিত্তের একটা ফারাকের কথা বলেন। ধনীদের এটা সেটা, মধ্যবিত্তের এই প্রবলেম সেই প্রবলেম ইত্যাদি। গর্বের সাথে জানালেন ওনার মেয়েকে কোনো প্রাইভেট স্কুল বা কলেজে পড়াননি। সরকারী স্কুল কলেজে আর দশজনের মতো পড়িয়েছেন। বুঝলাম যে এখানেও বাংলাদেশের মতো ধনী গরীবের স্কুল আছে। কিন্তু ধনীর স্কুল কেমন গরীবের স্কুল কেমন খুব জানতে ইচ্ছে করছে। তবে প্রতিটা স্কুলের সামনেই বড় সবুজ মাঠ আছে। সেই মাঠ আবার প্রতিদিন যত্ন করে ঘাস কেটে একে সবুজ মসৃণ আদল দেয়া হয়। বাচ্চারা হইচই করে খেলে, ইচ্ছামত দৌড়াদৌড়ি করে। দেশের বাচ্চাদের কথা ভাবলে কষ্টই লাগে। ঢাকা চিটাগাং বড় শহরগুলোতে বাচ্চাদের জন্য খেলার মাঠই নেই।
ভালো হলো অস্ট্রেলিয়া এখন মিক্সড মানুষের দেশ। কত সংস্কৃতি কত দেশের মানুষ যে এখানে আসছে – এসেছে – দেখলে অবাকই হতে হয়। সিরিয়ান রিফ্যুজিদের এখানে অভয়ারণ্য, রোহিংগা প্রচুর। আমাদের ক্লাসে আছে এক কোরিয়ান মেয়ে। ওর নাম জেনি। আমি ওকে জিজ্ঞেস করছিলাম তোমার দেশ কোথায় – সে এমনভাবে কোরিয়া শব্দটাকে বললো আমি শুনলাম ক্রিয়া – ওরে বার বার জিজ্ঞেস করলেও সে একই ভাবে ক্রিয়া বলল। মনে মনে এই ক্রিয়া দেশ কোথায় আছে সেটা ভাবছিলাম। এরপর বললো সে এসেছে তার পার্টনারের কাছে। তার পার্টনারের বাসায় পার্টনারের মা-বাবার সাথে থাকে। ওর মা এর আবার আগের হাজব্যান্ডের সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। তার হাজব্যান্ড তার চাইতে দশ বছরের ছোট এবং আগের ঘরের ছেলে পরের ঘরের আর একটা মেয়ে এবং ছেলের গার্লফ্রেন্ড এবং স্বামী সহ চমৎকারভাবে মিলে মিশে আছেন। জেনিকে একদিন জিজ্ঞেস করলাম -জেনি তুমি কি তোমার বয়ফ্রেন্ডকে বিয়ে করবা ? সে বলে যে -নো – কেন জিজ্ঞেস করলে সে বলে যে নো মিন্স নো –
আমি চুপ করে গেলাম – বাংলাদেশের কাদামাটি লেগে আছে গায়ে – ভাবনার চেঞ্জ আনতে হবে চিন্তা করছিলাম –
**
আজ দুপুরে বেরোতেই উষ্ণ বাতাস, রোদের তেজ – বুঝলাম একদিনেই শীত চলে গেলো বলে এখানে – কেউ কেউ এখনো ফুল হাতা সোয়েটার, জ্যাকেট পড়েছে। আহা বসন্ত – বসন্তের শুরুতেই হাড়ের ভেতর ফুটে যাওয়া শীতকে বিদায় জানাতে পেরে এতো ভালো লাগছিলো। এখানের শীত কাতরই করে আমাকে। নেভিটাস থেকে বের হলে কয়েক গজ সামনে একটা বড় মাঠ পড়ে। মাঠের সামনেই ব্যাঙ্কসটাউন লাইব্রেরী। মাঠের পাশে পাশে বেঞ্চি দেয়া আছে। আর গাছের এতো নুয়ে পড়া। মনই কেমন করে আমার – আজ বেরোতে বেরোতে সন্ধ্যা হলে বের হয়ে এমন চমৎকার বাতাস আর সন্ধ্যার আলো-আঁধারী পরিবেশে মনই ভালো হয়ে গেলো। এরকম সময়ে উচ্চ দার্শনিক চিন্তাই মনে আসে। আহা এই পৃথিবীতে মানুষ আসবে মানুষ যাবে। আর আমরা সব মানুষ খাওয়া পড়া বাঁচার জন্য সংগ্রাম করতে থাকবো করতেই থাকবো – ইত্যবসরে জীবন পার হয়ে একদিন বলবে এই পৃথিবী তোমার জন্য নয়।
না হোক – তবু এই সময় পাখির কোলাহলে এমন ঝিম ধরা আনন্দ হলো। চোখের চারপাশে উপরে নীচে আশে পাশে নিরব নির্জন মাঠে এক দৌড়ে পার হয়ে ছেলেবেলার মত মনে হলো ছুঁয়ে যাই সব আনন্দ। আহা জীবন – এতো ছোট কেন ! এত সংকীর্ণ কেন ?
তবু মন কেমন করা এই আকাশ বাতাসে বেঁচে থাকা আর একবার সার্থক মনে হলো ।
মনোরম পরিবেশ আর একজন একাকী মানুষ।
কারো অপেক্ষায় বেঞ্চিগুলো।
মনোরম পরিবেশ অথচ একক একজন মানুষের দেশ বৈদেশ এর অভিজ্ঞতা জানলাম। ধারাবাহিক হিসেবে দারুণ হবে। আগের পর্ব মনে আছে। নবমীর শুভেচ্ছা বোন।
ধন্যবাদ সৌমিত্র । শুভেচ্ছা জানবেন । নবমীর শুভেচ্ছা রইলো
পরবাস জীবন। দিন দিন অভিজ্ঞতার ঝুলি বড় হতেই থাকবে দিদি ভাই।
সেই দিদি । বড় হতে হতে ঝুলে পড়বে – হা হা
দেশ বৈদেশ এর এই নিকট অভিজ্ঞতা একদিন গ্রন্থ হয়ে প্রকাশ পাবে নিশ্চিত। পাঠক জানবেন, পড়বেন, অনুধাবন করবেন কখনোবা একাকী এই লিখকের ভাবনা।
ধন্যবাদ মুরুব্বী । একসময় মনে হলে বই করবো ইনশাল্লাহ ।
ভালো থাকবেন । শুভেচ্ছা জানবেন ।
আপা, কালোদের সম্পর্কে একটা ভুল ধারনা পোষ করেছেন। ওরা আসলে অত্যন্ত রসিক শ্রেণীর এবং যার সংগে আলাপ হয় তাদের সাথে বেশ ইয়ার্কি হাসি তামাশা করতে জানে কিন্তু সাদারা অসম্ভব রকমের অহংকারি। কয়েকদিন গেলে লক্ষ করবেন বাসে বা ট্রেনের দুই সিটের এক সিটে আপনি বসেছেন কিন্তু একজন সাদা এসে দাঁড়িয়ে থাকবে অথচ আপনার পাশে বসবেনা। কালোদের এই রোগ নেই। সাদাদের বাচ্চাকে কখনও কোলে নেয়া বা ছুয়ে আদর করার ইচ্ছা জাগলেও করবেননা। কালোদের নিগ্রো বললে ওরা মনে আঘাত পায়, blacky বললে ওই আঘাতটা পায়না। আমি ইউরোপ জুরে যা দেখেছি তাই বললাম। আশা করি ভুল বুঝবেননা।
ওহ আচ্ছা । আমি জানতাম না । এখানে ওরা খুব কথা বলে না নিজেদের কম্যুনিটি ছাড়া । কিন্তু অস্ট্রেলিয়ায় সাদাদের মধ্যে এরা অনেকে আইরিশ । আবার নিউজিল্যান্ড বা এসব এলাকার । এজন্য হয়তোবা একদম সাদাদের মতো না ।
ভালো থাকবেন ভাই । শুভেচ্ছা জানবেন ।