নীল রক্ত (ছোট গল্প)

একটা খুন করতে ইচ্ছে করে আমার – যেমন সেটা ছুরি দিয়ে হতে পারে অথবা হতে পারে ধাক্কা দিয়ে পাঁচতলা অথবা বারো তলা থেকে ফেলে দিলে বেশ হয় –
আচ্ছা সে যদি উলটে পড়ে যায় কেমন করে তার মুখ দিয়ে রক্ত বের হবে –
কেমন করে ছিটকে পড়বে মগজ ?
অথবা ভেংগে হাটু ভাঙ্গা দ এর মতো পড়ে থাকবে –
এরপর চারদিকে মানুষের জমায়েত – কেউ একপলক দেখবে কেউ ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করবে – কেউ ভয়ে দূর থেকে সরে যাবে আমার মতো –
আমি আসলে র নামের দস্যুটার কথা ভাবছিলাম।
সে আমার জীবন অস্থির করে দিয়েছে।
যেমন আজ সন্ধ্যাবেলা সে আমার আংগুলে কাঁটা ফুটিয়ে দিয়ে বলেছে কেমন লাগে তানু মনি ?

আবার দুপুর বেলা টেনে হিঁচড়ে ঘর থেকে বের করে সবার সামনে ধুম করে ধাক্কা দিয়ে পাশের ড্রেনে ফেলে দিলো। আমার সারা গায়ে নোংরা জল লেগে গেলে আমি কিছু বলতে পারলাম না। শুধু চোখে জল এলো । মানুষজন আজকাল রোবট হয়ে গেছে। তারা কেউ কিছু বললো না। এমনকি আমার পাশের বাসার যে মহিলার বেড়ালকে আমি তিন বেলা খেতে দিয়েছি সেও কিছু বললো না। শুধু একপলক আমাকে দেখলো
এরপর মাছের চোখ নিয়ে চলে গেলো।
আমি যে র কে কিছু বলতে পারি না তার কারণ আবিষ্কার করতে আমার কত যুগ লেগে যাবে সে জানিনা —
র একদিন আমার হাতে হাত রেখে চোখে চোখ রেখে বলল আমি তোমাকে ভালোবাসি তানুমনি। এরপর সে একটা কাঁচি এনে আমার চুল গুলো কেটে দিলো এবরো থেবরো করে –
তখনো আমি কিছু বলতে পারিনি।
চোখ ছলো ছলো করে শুধু তার দিকে তাকালাম –
সে খিক খিক করে হাসতে হাসতে আমাকে চুমু খেলো – সমস্ত শরীরে ঝড় ওঠালো। ক্লাসিক আবেদনে আমি ওর সব দোষ মাফ করে দিলাম। এত কষ্ট দেবার পরেও ওর ছোঁয়াতে আমি থর থর করে কেঁপে উঠি।
মনে মনে একলক্ষবার ‘ভালোবাসি ভালোবাসি বলি। সে কি বোঝে সে তিল তিল করে খুন করলেও আমি তাকে ছেড়ে যাবো না ?
আশ্চর্য টানা মায়াভরা চোখ ওর। ওর চোখ দেখে বার বার আমি খান খান হয়ে যাই !!

দুপুরটা কেমন যেনো মায়ায় ভরা। কেউ নেই ঘরে। উত্তর থেকে এই শীতের শুরুতে যে বাতাস বয় তাতে শরীরে অন্যরকম শান্তি হয়। আমি বিছানা ছেড়ে জানালার পাশে বসি। আকাশ দেখি। পাখিদের উড়ে যাওয়া দেখি।
র এর দেয়া কষ্ট ভুলে যাই। আনমনে গাই ‘তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা,
এ সমুদ্রে আর কভু হব নাকো পথহারা।। অথচ এ মিথ্যে। কেউ আমার ধ্রুবতারা নয় জীবনে।
আমার তো কেউ নেই। র’ নেই, বাবা নেই, মা নেই – কোনো আত্মীয় স্বজন নেই – এতো একা মানুষ কি করে থাকে ?

আমি ছাদে উঠলাম – এটা বারো তলা বাড়ি – ছাদ হলো তাহলে তেরোতলায় –
নীচের দিকে তাকালেই গা হিম হয়ে আসে —
র আমাকে ছাদের কিনারে এনে বললো দেখো তো তানু কত উঁচু বাড়ি !!
তোমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেই এখান থেকে বলে সে আমাকে প্রায় উলটে ফেলে দেয় আর কি !!
ভয়ে আতংকে আমার গা কাঁপতে লাগলো -চোখে জল এলো –
তবু র কে আমি কিছু বললাম না – ওর চোখে চোখ রেখে শুধু বললাম র আমি তোমাকে ভালোবাসি —
তুমি কেন এত নিষ্ঠুর আমার সাথে ?
র গান ধরলো – সে চমৎকার গায়
তুমি বিনে আকুল পরান
থাকতে চায় না ঘরেতে –
সোনা বন্ধু ভুইলো না আমারে
আমি এই মিনতি করি রে
সোনা বন্ধু ভুইলো না আমারে
র এর কন্ঠ, গলায় আবেগ অসাধারণ – তার গানের সাথে আমি নেশায় আকুল- ভুলে গেলাম সব
সে ফের গাইতে লাগলো
সাগরে ভাসাইয়া কুলমান
তোমারে সঁপিয়া দিলাম আমার দেহ মন প্রাণ –
সর্ব সাধন করিলাম দান
তোমার চরণের তলে রে
ভুইলো না আমারে —
আমার মনে হলো আমিও সেরকম তার চরণে নিজেকে সঁপে দিয়েছি –
আমার কন্ঠ রুদ্ধ – আবেগ সাপের মত বিষ হয়ে কন্ঠাকে চেপে ধরেছে —
র গাইতে গাইতে বিল্ডিং এর দেয়ালের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে – আমি পেছন থেকে বাতাসে উড়তে থাকা তার পাঞ্জাবীর কোনাকে বেসামাল হতে দেখি। ওর চমৎকার চুল শির শির করছে বাতাসে। কি সুন্দর তার সুঠাম শরীর।
তবু ওকে ঘৃণা করি। ভালোবাসি। প্রতিদিন একবার করে প্ল্যান করি খুন করার জন্যে।
আমি এক পা দুপা করে র এর কাছে এগিয়ে যাই — র চলে এসেছে একদম রেলিং এর শেষ প্রান্তে – যদিও প্রায় এই তেরোতলা উপর থেকে নীচে সব দেখলে শরীর ভয়ে ঠান্ডা হয়ে আসে –
র আমার উপস্থিতি মনে হয় ভুলেই গেছে। প্রায় চোখ বন্ধ করেই গাইছে —
আমারে ছাড়িয়া যদি যাও
প্রতিজ্ঞা করিয়া বলো
আমার মাথা খাও —
আহা ! এত রিদম ! এত আবেগ ! আমার চোখে জল এলো –
কিন্তু —-
আমি পা টিপে টিপে তার পেছন পেছন এসে তার পিঠের মাঝ বরাবর হাত দিলাম যেখান থেকে ধাক্কা দিলে একদম সে নীচে পড়ে যাবে — ভারসাম্য রাখার মতো কিছু থাকবে না –
আচ্ছা সে যদি পড়ে যায় তেরো তলা থেকে তখন কি তার রক্ত নীল হয়ে যাবে ?????
————

10 thoughts on “নীল রক্ত (ছোট গল্প)

  1. সাইকোলজিকেল কাহিনী। দুই তিনবার পড়লাম ছোট গল্পটি। আমার এই অবাধ্য মগজ বারবার জানতে চেয়েছে র'এর মধ্যে এমন মানসিকতা আসলো কোথা থেকে। কেন কিছু একটা করতে চায় !!

    শুভ সকাল আপা।

    1. হা হা  । সে যে কি করতে চায় সেই জানে । এরকম চরিত্র আমাদের সমাজেই  ঘোরাফেরা করে মুরুব্বী । ভালো থাকবেন । এখানে রাত । তাই শুভ রাত্রি । 

  2. আমার একটা খুন করতে ইচ্ছে করে। এটাতো ভয়ংকর ইচ্ছা দিদি ভাই। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Razz.gif.gif

    1. হুম ভয়ংকর তো বটেই রিয়া । ভালো মানুষকে কি কারো খুন করতে ইচ্ছে করে ? 

      ভালো থেকো প্রিয় । 

  3. লেখাটার নানান কিছু নিয়ে ভাবলাম।  মিঃ মুরুব্বী এবং রিয়া দি আমার ভাবনার কিয়দংশ  বলে দিয়েছেন।  

    1. ভাবনার কিয়দংশ না হয় আপনিই বলে দিতেন মিড ডে ডেজারট । 

      https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_whistle3.gif ভালো থাকবেন । 

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।