বাংলাদেশ সমবায় শিল্প সংস্থায় পাট বেলিং এবং পাট শ্রমিকদের বর্তমান দিনকাল

নারায়ণগঞ্জ সিটি ১০ নং ওয়ার্ড গোদনাইল। এই এলাকাটির অবস্থান নারায়ণগঞ্জ শহর থেকে ৪ কিলোমিটার উত্তরে সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন। বর্তমানে এই গোদনাইলে গড়ে উঠেছে যত্রতত্র বহু শিল্প প্রতিষ্ঠান। এসবের মধ্যে রয়েছে রপ্তানিমুখী নীট গার্মেন্ট, ডাইং ইন্ডাস্ট্রিজ, রি-রোলিং মিলস্ সহ শতাধিক নামী দামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কোনও একসময়ের এশিয়া মহাদেশের বিখ্যাত দুটি বস্ত্র শিল্পও (টেক্সটাইল মিলস্) এই গোদনাইল এলাকায় ছিল। যা এখন একটি পুরোপুরি বন্ধ। আর একটিতে প্লট আকারে গড়ে উঠতে শুরু করছে পল্লী টেক্সটাইল। গোদানাইল এলাকায় আগেও ছিল পাট রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান, যা এখনও আছে। বাংলার সোনালি আঁশ পাট আর বস্ত্র শিল্পই একসময় নারায়ণগঞ্জকে এনে দিয়েছিল প্রাচ্যের ডান্ডি উপাধি।


বাংলাদেশ সমবায় শিল্প সংস্থার প্রেস ঘর। সামনে প্রেসের কয়েকজন কর্মচারী।

আগে নারায়ণগঞ্জে যত্রতত্র দেখা যেত বিশাল বিশাল পাটের গোডাউন। দেখা যেত পাটকে বেলিং করার মতো কয়েটা জুট প্রেস। এখন আর সেসব পাটের গোডাউন আর পাট বেলিং করার জুট প্রেসও নেই। আছে মাত্র দুই একটা। জানামতে পাট বেলিং(জুট প্রেস) একটা আছে নিউ মেট্রো সিনেমাহল সংলগ্ন কুমুদিনী “ওয়েল ফেয়ার ট্রাস্ট অফ বেঙ্গল” অপরটি হলো গোদনাইল এলাকায়। গোদানাইল এলাকাটি হলো প্রাচ্যের ডান্ডি নারায়ণগঞ্জের সুনাম অর্জনকারী শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম পাড়ে।

শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব পাড় হলো বন্দর থানাধীন এলাকা। এই এলাকাতেও ছিল বস্ত্রশিল্প, জুট বেলিং(জুট প্রেস), নৌযান মেরামতের জন্য ডকইয়ার্ড, কদম রসূল মাজার সহ আরও অনেককিছু। এসবের মধ্যে পবিত্র কদম রসূল মাজারটি এখনও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই পবিত্র মাজারে প্রতিবছরই ঈদ-এ- মিল্লাদুন নবী উপলক্ষে ৩দিনব্যাপী ওরস মোবারক অনুষ্ঠিত হয়। যাক সেই কথা। এসব নিয়ে আরেকটা পোস্টে আলোকপাত করার ইচ্ছে আছে। এবার আসি মূল কথায়।

আমরা জানি নারায়ণগঞ্জে সূতা ও রং-এর জন্য সারাদেশে এখনও সুখ্যাতি বহাল আছে। বাংলাদেশের যেখানেই টেক্সটাইল মিল আর ডাইং ইন্ডাস্ট্রিজ থাকুক-না-কেন, সূতা রং নারায়ণগঞ্জ থেকেই নিতেই হবে। তা ছাড়া আর উপায় নাই। যদিও কালের বিবর্তনের ফলে বস্ত্রশিল্পের বিলুপ্তি ঘটেছে, রয়ে গেছে পাট বেলিং জুটপ্রেস, পাট যাচাই-বাছাই সহ পাট আমদানি রপ্তানিকারক সংস্থা। এমন একটি জুটপ্রেসের সাথেই সবাইকে পরিচয় করিয়ে দিতে আর পাট শ্রমিক তথা পাটের একাল-সেকাল নিয়েই আমার আজকের এই আয়োজন। আশা করি সবাই সাথে থাকবেন। জুট প্রেসটি হলো নারায়ণগঞ্জ সিটি ১০ নং ওয়ার্ডে অবস্থিত। নাম- “বাংলাদেশের সমবায় শিল্প সংস্থা(সীঃ)”।


বাংলাদেশ সমবায় শিল্প সংস্থার ভেতরে থাকা সারিবদ্ধভাবে পাট রাখার গোডাউন।

বাংলার সোনালী আঁশের কথা সেই ছোটবেলা থেকেই পাঠ্যপুস্তকে আমরা অনেক পড়েছি। এখনও এই প্রজন্মের ছেলেপেলেরাও পাঠ্যপুস্তক হতে পাট সম্বন্ধে বিস্তর তথ্য জ্ঞান অর্জন করছে। বাংলার সোনালী আঁশ আমাদের গর্ব, পাটের জন্য আমরা গর্বিত। তা আজ থেকে নয়! পাটের জন্য আমরা গর্বিত হয়েছি সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই। তাই ছোট-বড় ছেলে-বুড়ো সবাই জানে বাংলার সোনালী আঁশের কথা। প্রাথমিক শিক্ষা পাঠ্যপুস্তক থেকেই সোনালী আঁশের শিক্ষা শুরু হয়, বাংলার গৌরব গাঁথা এই সোনালী আঁশের ইতিহাস। এই পাটই বাংলার শত বর্ষের ঐতিহ্য। বিভিন্ন তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়; পাট মূলতঃ দুই ধরনের জন্মায়- (১) corchorus capsularis (সাধা পাট) এবং (২) corchorus olitarius (তোষা পাট ); পাট Tiliaceae পরিবারের অন্তর্গত একটি উদ্ভিদ। পাটকে আরো একাধিক নামে ডাকতে শোনা যায়। যেমন- দেশী পাট, কেনাফ পাট, মোস্তা পাট ও বগি পাট। আর ইংরেজি নামতো সবারই জানা (jute) জুট। কিন্তু আমরা অনেকেই জানিনা কীভাবে এই বাংলার খ্যাতনামা পাটকে বেলিং করে বাজারজাতকরণ করা হয়। আর এই গৌরব গাঁথা সোনালি আঁশ রক্ষণাবেক্ষণকারী কৃষক শ্রমিকরা-ই-বা কী সুখে থাকছে! পাট শ্রমিকদের সুখদুঃখ নিয়ে পরে আলোচনা করবো। আগে আলোচনায় আসি কীভাবে পাট শ্রমিকেরা পাট বেলিং করে।

পাট একটি বর্ষজীবী ফসল। এর জীবনকাল ১০০ থেকে ১২০ দিন পর্যন্ত। চৈত্র-বৈশাখ থেকে আষাঢ় শ্রাবণমাস পর্যন্ত। পাট একটি লাভজনক ফসল, যা অধিকতর বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহকারী একটি কৃষিজাত ফসল। এই পাট শুধু আমাদের দেশেই বেশি জন্মায়, এবং দেশের সব জেলায়, সবখানেই জন্মায়। এই পাটের সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের দেশের হাজার হাজার নারী-পুরুষ শ্রমিক ও কৃষক-কৃষাণীর আত্মা ও জীবিকা। আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে কৃষকেরা জমি থেকে পাটগাছ কেটে আঁটি বেঁধে পানিতে জাঁক দিয়ে ডুবিয়ে রাখে। ১০ থেকে ১২ দিন পর পানি থেকে খুব যত্ন সহকারে ডোবানো পাটগাছের আঁটিগুলো উঠিয়ে আনে। ১০/১২ দিনে পানিতে ডুবিয়ে রাখার ফলে আঁটি বাঁধা পাট পঁচে যায়।

আসলে কিন্তু পাটগাছের পাট পঁচে যায়নি, দীর্ঘদিন পানির নীচে থাকার কারণে গাছ থেকে পাট নরম হয়ে যায়। নরম হওয়ার কারণেই খুব সহজে গাছ থেকে পাট বা আঁশকে আলাদা করা যায়। (পাটগাছ থেকে পাটের আঁশ আলাদা করার পর, সেই গাছ হয়ে যায় পাটখড়ি। এই পাটখড়ি দিয়েও অনেক কাজ হয়, পাটখড়ি জ্বালানির কাজে ব্যবহৃত হয়, আবার ঘরের বেড়া তৈরির কাজে লাগে। আবার বর্তমান আধুনিক যুগে পাটখড়ি দিয়ে অনেক নামীদামী বোর্ড তৈরি হয়। যেসব বোর্ড দিয়ে ফ্যামিলি ফার্নিচারের আসবাবপত্র তৈরি হয়)। পচনধরা পাটগাছ কৃষক কৃষাণী এই মূল্যবান পাট সংগ্রহ করে। এরপর পাট রোদে শুকিয়ে বাজারে নিয়ে বিক্রি করে তাদের জীবিকা উপার্জন করে। কৃষকের কাছ থেকে কিনে নেয় দেশের বড় বড় পাট ব্যবসায়ীরা।


বাংলাদেশ সমবায় শিল্প সংস্থা (সীঃ) পাট বেলিং করার নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান।

সেই পাট কিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে চালান করে, কিংবা ব্যবসায়ীদের নিজস্ব মিলে বা গোডাউনে জমা রাখে। এরপর বিদেশে রপ্তানী করার জন্য শুরু হয় যাচাই-বাছাইয়ের কাজ। যাচাই-বাছাইয়ের পর বিদেশে রপ্তানীর আগে এই পাটকে বেল আকারে তৈরি করার জন্য দরকার হয় জুটপ্রেসের। জুট প্রেস হলো, পাটকে বেল আকারে তৈরি করার স্থান। যেই জুট প্রেসের নাম আগেই বলে রেখেছি। একটি হলো নারায়ণগঞ্জ শহরে নিউ মেট্রো সিনেমাহল সংলগ্ন “কুমুদিনী ওয়েল ফেয়ার ট্রাস্ট ওফ বেঙ্গল”। অপরটি হলো নারায়ণগঞ্জ সিটি ১০নং ওয়ার্ড “বাংলাদেশ সমবায় শিল্প সংস্থা(সীঃ)। আলোচনা করবো “বাংলাদেশ সমবায় শিল্প সংস্থা নিয়ে। কারণ এই সংস্থাটির সাথে আমার অনেক দিনের সংপৃক্ততা। এই সংস্থার প্রতিটি পাট শ্রমিক আমার আপন ভাইয়ের মতো। একসময় প্রতিদিন প্রতিক্ষণ এই সংস্থার ভেতরে বাইরেই ছিল আমার প্রেম, ভালোবাসা, আড্ডা, জীবিকা সহ জীবনের সবকিছু।


নৌকা থেকে পাটের বোজা আমদানি শ্রমিকরা মাথায় করে গোডাউনে নিয়ে যাচ্ছে।

এই সংস্থাটি পাট বেলিং এর জন্যই খ্যাত এবং সুনাম অর্জনকারী। এই সংস্থাটি অনেক পুরানো। এই সংস্থার অভ্যন্তরে আছে পাট রাখার বিশাল বিশাল গোডাউন। আছে পাট বেল করার জন্য সেই প্রাচীন আমলের প্রেস মেশিন। পাটের ভরা মৌসুমে দেশের বিভিন্ন জেলা, উপ-জেলা থেকে এখানে পাট আসে নৌপথে ও স্থলপথে। আগে এই সংস্থা সাথে রেল যোগাযোগও ছিল। বর্তমানে রেল যোগাযোগ নেই, আছে নৌপথ আর স্থলপথ। নৌকা ও ট্রাক থেকে এই পাটকে নামানো হয় নারী-পুরুষ শ্রমিক দ্বারা। তাঁদের বলা হয় আমদানি শ্রমিক।


ট্রাক আসা পাট আমদানি শ্রমিকরা ট্রাক থেকে নামিয়ে গোডাউনে নিয়ে রাখছে।

তাদের পারিশ্রমিক দেওয়া হয় দৈনিক মজুরী হিসেবে। এই কাজই হলো পাট বেলিং করার প্রথম ধাপ। নৌকা বা ট্রাক থেকে আমদানি শ্রমিকেরা পাট নামিয়ে নিয়ে যায় গোডাউনে। সেখান থেকে শুরু হয় পাটের ওজন সহ যাচাই বাছাই-এর কাজ। যারা পাট ওজন করে তাদের বলা হয় কয়েলি। গোডাউনে পাটকে কয়েক ভাগে ভাগ করা হয়। করা হয় পাটের গোড়া ছাটাই। যারা পাটের গোড়া বাছাই করে তাদের বলা হয় খাতাদার। তাদের কাজই শুধু পাটের শক্ত গোড়া কেটে, ৫০ কেজি করে বোজা বেঁধে রাখা।


বোজা শ্রমিক পাটের বোজা মাথায় করে জুট প্রেসে যাচ্ছে। এরপর পাট বেল আকারে তৈরি হবে।

এরপর পাট বেলিং হওয়ার জন্য যাবে প্রেসে। যারা গোডাউন থেকে ৫০কেজি পাটের বোজা মাথায় করে প্রেসে নিবে তাদের বলা হয় বোজাওয়ালা বা বোজা শ্রমিক। প্রেসে যেসব শ্রমিক কাজ করে সেসব কাজের ভিন্ন ভিন্ন নাম থাকে। যেমন; বোজা শ্রমিক, কয়েলি, খালাসি, শিক গাঁথা, কাঁচা-পাকা ও রপ্তানি শ্রমিক। বোজা শ্রমিক পাটের বোজা নিয়ে যাবে প্রেসের উপরে, সেখানে কয়েলি (যিনি পাট ওজন করে ) ১৮৫ কেজি করে আলাদা-আলাদাভাবে রাখে। সেখান থেকে খালাসি শ্রমিক ওজন করা পাট টেনে নিয়ে ফেলে প্রেসের বোঙ্গায় (বিশাল গর্ত। গর্তের নীচে থাকে হাউস। হাউসে থাকে মবিল তৈল)। তখন প্রেস ড্রাইভার (যিনি প্রেস চালায়) গিয়ার চেপে দিলে নীচ থেকে আস্তে আস্তে মবিল তৈলের প্রেশারে ১৮৫ কেজি পাটকে একটা বেল আকারে তৈরি করে ফেলে।


পাকা শ্রমিকরা পাটের বেলটাকে রশি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিচ্ছে। এরপর ফেলে দিবে বোঙ্গায়।

এই বেলটাকে বলে কাঁচা বেল। যারা এই কাজ করে তাদের বলে কাঁচা শ্রমিক। তারপর বেলটা যায় পাকা করার জায়গায়। যারা বেলটাকে পাকা করবে, তাদের বলে পাকা শ্রমিক বা খালাসি শ্রমিক। সেখানেই বেলটাকে আরো একটু বেশি টাইট করে রশি দিয়ে পেঁচানো হয়। তাই বলা হয় পাকা। মানে পাট বেলা হবার এটাই শেষ ধাপ। পাটের বেলটাকে শক্ত করে বাধার জন্য যিনি রশি তৈরি করে দিচ্ছে, তাকে বলে শিকগাঁথা শ্রমিক। খালাসি শ্রমিক বেল তৈরি সম্পূর্ণ করে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় বোঙ্গায়। বোঙ্গা হলো উপর থেকে নীচ পর্যন্ত সরু একটা ড্রেনের মতো রাস্তা। তৈরিকৃত বেলটা বোঙ্গা দিয়ে নেমে আসে নীচে। নীচে প্রস্তুত আছে রপ্তানি শ্রমিক। বেলটা উপর থেকে বোঙ্গা থেকে বের হবার সঙ্গে সঙ্গে রপ্তানি শ্রমিকরা তৈরিকৃত বেলটা টেনে ট্রলিগাড়িতে উঠিয়ে দিবে।


রপ্তানি শ্রমিকরা প্রেস থেকে আসা, পাটের বেল বোঙ্গার সম্মুখ থেকে টেনে ট্রলিগাড়িতে উঠিয়ে দিচ্ছে। এরপর যাবে গোডাউনে অথবা নৌকায়, নাহয় ট্রাকে।

রপ্তানি শ্রমিক সেই তৈরিকৃত বেলটাকে প্রথমে নিয়ে যায় গোডাউনে নয়-তো-বা সরাসরি ডেলিভারি দেওয়ার জন্য ট্রাকে না-হয় নৌকায় নিয়ে উঠিয়ে দেয়।। এরপর পাটের বেলগুলো চলে যায় দেশের বিভিন্ন জেলার জুটমিলে বা দেশের বাইরে কোনো অজানা গন্তব্যে। বিনিময়ে আমাদের দেশে আসে বৈদেশিক মুদ্রা। এবার বলি পাট শ্রমিকদের সুখদুঃখ নিয়ে কিছু কথা …


রপ্তানি শ্রমিকরা পাটের তৈরিকৃত বেল গোডাউন থেকে ট্রাকে উঠায়।

যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের বিনিময়ে বিদেশ থেকে দেশে আসে বৈদেশিক মুদ্রা, তাঁরা বেশি একটা সুখে নেই শান্তিতে নেই। প্রাচ্যের ডান্ডি নারায়ণগঞ্জে পাট শ্রমিক ইউনিয়ন থাকলেও, শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য পাওনা বিধিমালার ধারেকাছেও ভিড়তে পারে না বা পায়ও না। পাট শ্রমিকরা দিন মজুরিতে কাজ করে। কাজ করলে মুজরি, কাজ না করলে তার মুজরি নেই। ১৮৫কেজি পাট উঠানামা করানোর সময় অসাবধানতা বশত অনেকেরই হাত-পা ভেঙে যায়। প্রেসে কাজ করার সময়ও অনেকে দুর্ঘটনাক্রমে আহত হয়। হাত ভাঙে, পা ভাঙে, হাতের আঙুল কেটে যায়, পায়ের আঙুর কেটে যায়। যখন এরকম দুর্ঘটনার শিকার হয়, তখন দৈনিক নামমাত্র মুজরি আর হাসপাতালের ১০টাকা টিকেটের চিকিৎসা ছাড়া অন্যকিছু তাদের কপালে জোটে না। জানা যায় মিল ইন্ডাস্ট্রিজে কাজ করার সময় যদি কোনও শ্রমিকের হাত-পায়ের আঙুল বা দেহের অন্য কোন অঙ্গহানি হয়, তাহলে আহত শ্রমিক তাঁর অঙ্গহানির ক্ষতিপূরণ পাবে। বা প্রতিষ্ঠানের মালিক বা সরকারি প্রতিষ্ঠান হলে সরকার আহত শ্রমিককে দিতে বাধ্য।

কিন্তু দুঃখের কথা হলো, বাংলার সোনালি আঁশ পাট শ্রমিকরা কর্মরত অবস্থায় আহত নিহত হলে নামমাত্র চিকিৎসা ছাড়া আর কিছুই পায় না। এই লেখায় যেই সংস্থাটির কথা উল্লেখ করেছি, এই সংস্থায় এমনও শ্রমিক আছে যে, তাদের পূর্বপুরুষরা এই সংস্থায় কাজ করতে করতে বুড়ো হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। তাদের সন্তানরাও বুড়ো হয়ে যাচ্ছে। তাদের কোনও ধরনের সুবিধাদি নেই বা পায়ও না। আছে শুধু সংস্থা অভ্যন্তরে মুরগির খামারের মতন ছোট একটা বাসা। যেই বাসায় পরিবারবর্গ নিয়ে একসাথে থাকা খুবুই দুষ্কর। তাও কারোর বাসা আছে আবার কারোর নেই। আবার কোনও কারণ বশত যদি একসাথে একমাস কাজ করা থেকে বিরত থাকে, তাহলে তাকে সংস্থার ভেতর থেকে বিতাড়িত করা হয়। তবুও খেয়ে না খেয়ে বাংলার সোনালি আঁশ পাট শ্রমিকরা নিরুপায় হয়ে কাজ করে যাচ্ছে, বাংলার গৌরব অক্ষত রাখার জন্য। সরকার আসে সরকার যায়, কিন্তু কোনও সরকারই পাট শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার ন্যায্য পাওনা আনায় আনায় বুঝিয়ে দেয় না। তাই আজ বাংলার গৌরব গাঁথা সোনালি আঁশ পাট শ্রমিকরা কাজ করে অতি কষ্টে দিনাতিপাত করছে। পাট শ্রমিকদের দেখার কেউ নেই, তাদের দাবি আদায় করে দেওয়ারও কেউ নেই। ওরা আজ বড় অসহায়।

নিতাই বাবু সম্পর্কে

নিতাই বাবু ২০১৫ সালে তিনি শখের বশে একটা ব্লগে রেজিষ্ট্রেশন করে লেখালেখি শুরু করেন।তিনি লিখতেন নারায়ণগঞ্জ শহরের কথা। লিখতেন নগরবাসীর কথা। একসময় ২০১৭ সালে সেই ব্লগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ব্লগ কর্তৃক ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র জনাব সাঈদ খোকন সাহেবের হাত থেকে ২০১৬ সালের সেরা লেখক সম্মাননা গ্রহণ করেন। সাথে নগর কথক উপাধিও পেয়ে যান। এরপর সেই ব্লগে লেখালেখির পাশাপাশি ২০১৮ সালের জুলাই মাসে তিনি শব্দনীড় ব্লগে রেজিষ্ট্রেশন করেন। শব্দনীড় ব্লগে উনার প্রথম লেখা "আমি রাত জাগা পাখি" শিরোনামে একটা কবিতা। তিনি চাকরির পাশাপাশি অবসর সময়ে লেখালেখি পছন্দ করেন এবং নিয়মিত শব্দনীড় ব্লগে লিখে যাচ্ছেন।

6 thoughts on “বাংলাদেশ সমবায় শিল্প সংস্থায় পাট বেলিং এবং পাট শ্রমিকদের বর্তমান দিনকাল

  1. 'বাংলার সোনালি আঁশ পাট শ্রমিকরা নিরুপায় হয়ে কাজ করে যাচ্ছে, বাংলার গৌরব অক্ষত রাখার জন্য। সরকার আসে সরকার যায়, কিন্তু কোনও সরকারই পাট শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার ন্যায্য পাওনা আনায় আনায় বুঝিয়ে দেয় না।'

    আজকে আপনার পোস্টে স্পষ্টত ভাবে সরকারের নিস্পৃহতা উঠে এসেছে। যেমনটা গতকাল আমার মন্তব্যে সামান্য আভাষ দেবার চেষ্টা করেছিলাম। আমি কিন্তু হতাশ।

    পাটশিল্পের প্রতি বাংলাদেশ সরকারের কোন মমতা ছিলো কিনা আমার সন্দেহ আছে। বিশেষ করে পঁচাত্তরে মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোকে যখন ঢালাওভাবে রাষ্ট্রীয়করণ করা হয়, সম্ভাবনার দুয়ার তখনই বন্ধ হয়েছে। পরবর্তীতে যে সেক্টরে আর নার্সিং হয়নি।

    ক্ষমতা ভাগাভাগি হয়েছে তথাকথিত সরকারী আশ্রয়ের শ্রমিক নেতা যাদের উদর হঠাৎ ফুলে ফেঁপে ওঠায়। এখন যারা পাট শিল্পে রয়ে গেছেন, তারা অসহায় থেকে আরও অসহায়ত্ব বরণ করবেন। এটা অভিশাপ নয়; ভবিষ্যত। দুঃখজনক এই ঐতিহ্য। :(  

    1. আমার মনে হয় সব সরকারই ঐতিহ্য বিলুপ্তির আশাই করে থাকে। কেননা, এশিয়া মহাদেশের মধ্য শ্রেষ্ঠ জুটমিল ছিলো আমাদের নারায়ণগঞ্জের আদমজী জুটমিল । বস্ত্রশিল্পের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিল আমাদের নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানাধীন ১নং ঢাকেশ্বরী কটন মিলস্। ছিল চিত্তরঞ্জন কটন, লক্ষ্মীনারায়ণ কটন, আদর্শ কটন, বাওয়ানি কটন, বাংলাদেশ টেক্সটাইল সহ  আরও ছিল কয়েকটা নামীদামী জুটপ্রেস। এসব  কোনও সরকারই রক্ষা করতে পারেনি। পেরেছে শুধু বন্ধ করে দিয়ে নিজেদের মানুষের কাছে লিজ দিতে। এসব মিল ফ্যাক্টরিতে লক্ষলক্ষ মানুষ কাজ করে জীবিকা উপার্জন করে সংসার চালাতো। অনেকের কথা বাদ-ই দিলাম, আমরা সপরিবারও এর আওতায় ছিলাম।

      যখন আদর্শ কটন মিল সরকার বন্ধ করে দেয়, তখন কতো কষ্ট যে করেছি; তা আর লিখে শেষ করা যাবে না। আমাদের মতন আরও সহস্র লোক অতি কষ্টে দিনাতিপাত করেছে। সরকার কি ইচ্ছে করলে এসব মিল ফ্যাক্টরিগুলো রক্ষা করতে পারতো না? পারতো! কিন্তু করেনি । বিলুপ্তিই করে দিয়েছে। কৃষক শ্রমিকের মঙ্গল কামনায় যদি সব সরকার উদাসিন হতো, তবে আমাদের দেশের কৃষক শ্রমিকরা আর শান্তিতে থাকতে পারতো বলে আমি মনে করি। 

      ধন্যবাদ শ্রদ্ধেয় কবি দাদা। আপনার মূল্যবান মন্তব্যের জন্য আপনার সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল কামনা করি।

       

       

  2. 'সরকার আসে সরকার যায়, কিন্তু কোনও সরকারই পাট শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার ন্যায্য পাওনা আনায় আনায় বুঝিয়ে দেয় না।'

    দুঃখজনক। :(

    1. সত্যি দুঃখজনক শ্রদ্ধেয় রিয়া দিদি। আমরা দুখের সাথেই জীবনধারণ করছি। বলবেন, কেন? আপনি কি শ্রমিক? হ্যাঁ শ্রদ্ধেয় দিদি, আমিও একজন টেক্সটাইল মিলের শ্রমিক ছিলাম। আমি একজন বস্ত্র করিকর ! যেই বস্ত্র ছাড়া এই পৃথিবীর ছোটবড় কারোর ইজ্জত রক্ষা হয় না। আমি সেই বস্ত্রশিল্পের একজন দক্ষ কারিকর ।

      ধন্যবাদ শ্রদ্ধেয় রিয়া দিদি। আশা করি ভালো থাকবেন ।

  3. এমন সব প্রতিষ্ঠানে সহস্র বঞ্চনার ইতিহাস থাকে নিতাই দা। আমাদের পশ্চিম বাংলায় এমন অনেক কল-কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। :(

    1. তাতো হবেই শ্রদ্ধেয় দাদা। এটা যুগের পরিবর্তন!  পুরানো সবকিছুই বিলুপ্তি হয়ে যাবে। আসবে নতুনকিছু। 

      ধন্যবাদ শ্রদ্ধেয় দাদা। আশা করি ভালো থাকবেন। 

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।