তিন পয়সার তিনটি সদাই–এখন তখন এখনো না তখনো না?-৩
তৃতীয় পর্বের শেষাংশ:
উজির আর কোনও কথা বললেন না, মাথা নেড়ে যাবে বলে জানিয়ে দিলেন। হিরা রাজার কাছ থেকে তিন পয়সা নিয়ে পকেটে ভরলো। এরপর উজিরকে সাথে নিয়ে বাজারের দিকে রওনা দিলো।
হিরা উজির সাহেবকে সাথে নিয়ে রাজবাড়ীর গেইটের বাইর হলো। তাঁদের সাথে নেওয়া হলো সদাই রাখার জন্য একটা বড়সড় টুকরিও। হিরা উজির সাহেবকে বললো, ‘উজির সাহেব আপনি আমার আগে আগে হাঁটুন, আমি আপনার পিছনে পিছনে হাঁটি। বাজারে টুকরিটাও আমার সাথে থাকুক। আপনি বুড়ো মানুষ। কষ্ট করার দরকার কী! আপনি শুধু আমাকে আপনাদের এখানকার ধারে কাছে একটা বাজারে নিয়ে চলুন!’ হিরা’র কথা শুনে রাজার উজির খুবই খুশি হলেন। আবার বেজারও হলেন। বেজার হয় তখন, যখন থাপ্পড়ের কথা মনে পড়ে তখন। সেই থাপ্পড়ের কথা মনে পড়লেই, উজিরের আর ভালো লাগে না। তবুও রাজার হুকুম বলে কথা। তাই আর রাগ থাকতেও রাগ করতে পারছে না, হিরা’র কথা মতোই চলতে হচ্ছে।
এদিকে রাজদরবারে বসে কোতোয়াল সাহেব রাজাকে বললো, ‘হুজুর, চেনা নেই জানা নেই, অচেনা অজানা একটা ছেলের হাতে তিনটি পয়সা দিয়ে দিলেন! কাজটা কি ঠিক হলো?’ রাজা হেসে বললো, ‘এই ছেলে মাত্র তিন পয়সার পাগল নয় বলে আমার বিশ্বাস। এই কারণেই এমন কঠিন সদাই তিনটি কিনে আনার জন্য বলেছি। আমি জানি এই সদাই তিনটি ছেলেটা কিছুতেই আনতে পারবে না। যদি সদাই তিনটি না আনতে পারে, তাহলে আমার করণীয় কাজ করে ফেলবো। চলে বলে কলে কৌশলে, যেভাবেই হোক, আমি ছেলেটাকে আমার রাজদরবারে গোলামের মতো করে রেখে দিবো।’ কোতোয়াল জানতে চাইলেন, ‘আর যদি ছেলেটা সদাই তিনটি কিনে এনে দিতে পারে, হুজুর?’ রাজা বললেন, ‘আমি জানি ছেলেটা তা পারবে না। আর যদি আনতেই পারে, তাহলেও তা হবে না। আমি যা-ই বলবো, তাইতো হবে।’ এই বলেই রাজা দরবারে থাকা দেয়াল ঘড়ির দিকে রাজা তাকালেন। তখন সময় বিকাল চারটার কাছাকাছি বাজতে লাগলো। রাজা ভাবছে, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই উজির-সহ ছেলেটা বাজার থেকে ফিরে আসছে। রাজা সেই অপেক্ষাতেই বসে থাকলেন।
উজির-সহ হিরা যেই বাজারে যাবে, সেই বাজারের নাম রাজবাড়ি বউ বাজার। এই বাজারে গ্রামের বউঝিরা কেনাবেচা বেশি করে থাকে বলে, বাজারটার নাম রাজবাড়ি বউ বাজার। উজির আগে হিরা উজিরের পিছনে পিছনে। বাজারে ঢুকতেই একজন জিলাপি বিক্রেতা জিলাপি ভেজে ডালার উপর সাজিয়ে রেখেছে। হিরা তা দেখে উজিরকে ডাক দিল, ‘উজির সাহেব, উজির সাহেব।’ উজির পিছন ফিরে দেখলো ছেলেটা ডাকছে। উজির হিরা’র সামনে এসে বললো, ‘কী ব্যাপার! ডাক দিলে কেন?’ হিরা উজিরকে বললো, উজির সাহেব, অনেকদিন ধরে গরম গরম জিলাপি খাই না। আজ হাতের কাছে যখন পেয়েছি পোয়া খানিক জিলাপি দুইজনে মিলেমিশে খেয়ে নিই। কি বলেন উজির সাহেব?’
উজির হিরা’র কথা শুনে মনে মনে বলতে লাগলো, ‘শালার পো, তোমাকে রাজা তিন পয়সা দিয়েছে তিনটি সদাই করার জন্য। সেই পয়সা থেকে তুমি জিলাপি কিনে খেতে চাইছ। আবার আমাকেও খাওয়াতে চাচ্ছো। তাহলে সদাই নিবে কী করে?’ এই বলেই উজির হিরা’কে বললো, ‘না রে বাবা রে, আমার পেট ভালো না। আমি জিলাপি টিলাপি খাবো না। খেতে মন চাইলে তুমিই খাও!’ হিরা বললো, ‘আচ্ছা ঠিক আছে উজির সাহেব, আমিই খাবো। তো আপনি দামদর করে কিনে দিন। আপনাদের এখানকার বাজারের ভাবসাব তো আমি বুঝবো না। এঁরা আমার কাছ থেকে দাম বেশি নিবে।’
হিরা’র কথামতো উজির জিলাপি বিক্রেতাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘এই বেটা জিলাপি কি গরম না ঠান্ডা রে?’ জিলাপি বিক্রেতা বললো, ‘আরে হুজুর, এখন ভাজলাম এখন। একেবারে টাটকা জিলাপি।’ উজির বললো, ‘তাহলে ঠিক আছে। তো কত করে সের বিক্রি করছো হে?’ জিলাপি বিক্রেতা বললো, ‘আজ্ঞে হুজুর, মাত্র চার পয়সা সের।’ উজির সাহেব বললো, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। একপোয়া জিলাপি দাও তাড়াতাড়ি করে।’ জিলাপি বিক্রেতা দাঁড়িপাল্লা দিয়ে একপোয়া জিলাপি মেপে উজিরের হাতে দিলো। উজির সেই জিলাপি হিরা’র হাতে দিয়ে বললো, ‘দে বাবা এক পয়সা জিলাপির দাম দিয়ে দে।’ হিরা তাঁর প্যান্টের পকেট থেকে এক পয়সা বের করে জিলাপি বিক্রেতার হাতে দিয়ে সামনে এগুতে থাকলো। হিরা হাঁটছে আর মনের আনন্দে জিলাপি খাচ্ছে। এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। বাজার দেখছে। দোকানপাট দেখছে। আর জিলাপি খাচ্ছে, হাঁটছে।
এমন সময় এক ভিখারি হিরা’র সামনে এসে হাত পেতে বসলো। হিরা গরিবের সন্তান হলেও মানুষের প্রতি হিরা’র খুব মায়া। মানুষের কষ্ট হিরা সহজে সইতে পারে না। তাই যখন ভিখারি হিরা’র কাছে ভিক্ষা চাইল, তখন হিরা সাথে সাথে ও-ই ভিখারিকে এক পয়সা ভিক্ষা দিয়ে দিলো।
হিরা’র এইরকম দরদী কারবার দেখে, উজির সাহেব মনে মনে বলছে, ‘ছাইরা দে মা কাইন্দা বাঁচি। হায়! হায়! করছে কি! রাজা দিলো সদাই কেনার জন্য। আর ও করছে দান খয়রাত! জিলাপি খায়, ফকিরকে দেয়। বাঃ দারুণ তো! দেখি, আর আছে এক পয়সা। এই এক পয়সা দিয়ে ছেলেটা কী করে, তা দেখেই দিবো এক দৌড়।’
ফকিরকে এক পয়সা দিয়ে হিরা উজিরকে বললো, ‘উজির সাহেব, মানুষের কষ্ট আমার সহ্য হয় না। তাই ফকিরটা যখন ভিক্ষা চাইলো, তখন এক পয়সা ফকিরটাকে দিয়ে দিলাম। এর জন্য আল্লার দরবারে একটু হলে ছোয়াব জমা রেখে গেলাম। কি বলেন উজির সাহেব?’ উজির বললো, ‘ভালো করেছিস বাবা। একেবারে বুদ্ধিমানের কাজ। তো রাজার সদাই কিনতে হবে না? এভাবে ঘুরলে কি হবে? তাড়াতাড়ি কর বাবা। সন্ধ্যা যে হয়ে গেল। বাড়ি ফিরতে হবে।’
হিরা বললো, ‘উজির সাহেব, রাজা হুজুর যেই সদাই তিনটা কিনতে বলেছে, তাতো আপনাদের এই বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি তো ঘুরে ঘুরে সদাই খুঁজে বেড়াচ্ছি। দেখি সামনে পাওয়া যায় কি-না?’ এই বলেই হিরা সামনে এগুতে লাগলো। হিরা’র পিছনে উজির বোকার মতো হাঁটছে আর ভাবছে। ‘হায়রে রাজা, কাকে দিলি পয়সা! এই ছেলেটা কি আর রাজবাড়ি ফিরে যাবে? মনে হয় না! রাজার এক গৃহস্থের এক বছরের খাজনা মাইর!’ উজির ভাবলেন।
একটু সামনে যেতেই হিরা দেখলো মানুষ গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাজনার শব্দে পুরো বাজার মুখরিত হয়ে উঠছে। হিরা ভাবলো হয়তো সাপুড়িয়ারা সাপের খেলা দেখাচ্ছে। এই ভেবে হিরা গোল হয়ে দাঁড়ানো মানুষজন ঠেলেঠুলে ভেতরে ঢুকলো। উজির টুকরি হাতে বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছে, ‘কার সাথে যে বাজারে আসলাম রে আল্লাহ! এ দেখি বড় বাটপার। রাজার কাছ থেকে বাটপারি করে তিন পয়সা এনে কি না করতেছে। পরের পয়সা খরচ করতে তো আর গা জ্বলে না। তাই জিলাপি খায়, ফকিরকে দেয়। এখন আবার রূপবান গান দেখার জন্য গোলচক্করে ঢুকছে। দেখি কী করে!’
এই বলেই উজির সাহেবও ভেতরে ঢুকলো। ভেতরে রূপবান গান গেয়ে এক হিজরা ড্যান্স দিচ্ছে। ড্যান্সের তালে তালে হিরাও নাচতে দিতে শুরু করলো। ড্যান্স শেষ হলে উপস্থিত সবাই এক পয়সা দুই পয়সা করে হিজরাকে বকশিস দিতে লাগলো। হিরাও ড্যান্সার হিজরাকে এক পয়সা বকশিস দিয়ে দিলো। উজির সাহেব তা দেখে বললো, ‘খাইছে রে আমারে।’ খাইছে খাইছে বলতে বলতেই হাতের টুকরি ওখানেই রেখে সোজা এক দৌঁড় রাজবাড়ির দিকে। হিরা এখন উজিরকে খুঁজছে। উজির সাহেব নেই। কোথাও নেই। অথচ টুকরি পড়ে আছে, উজির নেই। হিরা বুঝতে পেরেছে উজির সাহেব ভয় পেয়েছে। তাই আগেভাগে উনি রাজদরবারের উদ্দেশে রওনা দিয়েছে। হিরাও বাজার থেকে আস্তে ধীরে হেলেদুলে রাজবাড়ির উদ্দেশে হাঁটতে শুরু করলো।
উজির সাহেব হাঁপাতে হাঁপাতে রাজবাড়ির গেইটের সামনে গেলো। গেইটে টোকা দিলো। প্রহরী গেইট খুলে দিলো। উজির সাহেব ভেতরে ঢুকলো। গেইটে থাকা প্রহরী উজির সাহেবকে জিজ্ঞেস করলো, ‘উজির সাহেব ছেলেটা কোথায়?’ আপনারা গেলেন দুইজন মিলে, অথচ আপনি আসলে একা!’ উজির ধমক দিয়ে বললো, ‘দূর! বাটপার, বাটপার! রাজার মাথা খারাপ হয়েছে রে, রাজার মাথা খারাপ হইছে। কারে দিয়েছে তিন পয়সা রে।’ প্রহরী আবার জিজ্ঞেস করলো, ‘হুজুর, আসল ঘটনাটা কী?’ উজির বললো, ‘আরে বেটা, রাজার পয়সা দিয়ে জিলাপি খায়। ফকিরকে ভিক্ষা দেয়। রূপবান গানের ড্যান্স দেখে বকশিস দেয়। এসব কি একটা কাজ? যাচ্ছি রাজার কাছে। ঈশ! আমার থাপ্পড়ের বিচারটা পেলাম না রে!’
এই বলেই উজির রাজদরবারের দিকে রওনা হলো। বাইরে থেকে গেইটে টোকা লাগলো। প্রহরী গেইট খুলেই দেখে হিরা’কে। প্রহরী হা করে হিরা’র মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। হিরা জিজ্ঞেস করলো, ‘কী ব্যাপার? এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন যে?’ প্রহরী বললো, ‘না, মানে উজির সাহেব বললো তুমি আর আসবে না। তাই অবাক হলাম!’ হিরা জিজ্ঞেস করলো, ‘উজির সাহেব কোথায়?’ প্রহরী বললো, ‘এইতো এইমাত্র রাজদরবারের দিকে চলে গেলো। তুমি নাকি জিলাপি খাও, ফকিরকে ভিক্ষা দাও, রূপবান গান শুনো?’ হিরা জিজ্ঞেস করলো, ‘এসব আপনার কাছে কে বলেছে?’ প্রহরী বললো, ‘কেন, উজির সাহেবই বলেছে! নাহয় আমি শুনবো কোত্থেকে?’ হিরা বললো, ‘উনি ঠিকই বলেছে।’ প্রহরী বললো, ‘তো রাজা যে তিন পয়সা দিলো সদাই আনতে, সদাই কোথায়?’ হিরা বললো, ‘তিন পয়সা দিয়ে কি আর সদাই আনা যায়? বাজারে জিনিসপত্রের যেই দাম! তবুও কিছু সদাই কিনেছিলাম। উজির সাহেব সব সদাই গুলো বাজারে রেখে চলে এসেছে। তাই আর পয়সার কেনা সদাই গুলো আনা হলো না। কী আর করা! যাই দরবারে।’ হিরা চললো রাজদরবারের দিকে।
তিন পয়সার তিনটি সদাই–এখন তখন এখনো না তখনো না?-৫ শেষ পর্ব
চলবে…
রাজা উজির হিরা। প্রত্যেকটি চরিত্রই আগ্রহ নিয়ে পড়ছি মি. নিতাই বাবু। ধন্যবাদ।
উৎসাহ দেওয়ার জন্য অশেষ ধন্যবাদ জানাচ্ছি, শ্রদ্ধেয় দাদা।
তিন পয়সা খরচা হলো। রাজার কাছে হিরার এবার কি ব্যাখ্যা হবে কে জানে।
হিরা'কে তো রাজার কাছে অবশ্যই ব্যাখ্যা দিতে হবে। হিরা সেই ব্যাখ্যা দিতে পারবে বলেও মনে করি। সেইসাথে আশা করি গল্পের শেষ পর্ব পর্যন্ত সাথে থাকবেন, শ্রদ্ধেয় দাদা।
ভীষণ আনন্দ পাচ্ছি আপনার এই ধারাবাহিকটি পড়ে। কৌতূহল নিয়ে থাকি।
শুনে খুবই খুশি হলাম, শ্রদ্ধেয় কবি রিয়া দিদি।
পিসি শাট ডাউন দিতে দিতে থেমে গেছি। লেখাটি না পড়ে গেলে ভাল লাগবে না। পড়ে নিলাম। এখন শান্তির ঘুম না হলেও টেনশনের ঘুম হবে। টেনশন আগামী পর্বের।
শীঘ্রই শেষ পর্ব নিয়ে হাজির হচ্ছি, শ্রদ্ধেয় দিদি। আশা করি গল্পের শেষ পর্ব পর্যন্ত সাথে থাকবেন।
দারুণ কবি নিতাই বাবু। জিলাপি ভিখারী নৃত্য তিনটি ঘটনা।
মনে হয় কেইসটা ঠিকই ধরতে পেরেছেন, শ্রদ্ধেয় কবি দাদা। এরপরও চমৎকার কিছু খেলা থাকবে। আশা করি গল্পের শেষ পর্ব পর্যন্ত সাথে থাকবেন।
শুভে জানবেন শ্রদ্ধেয় কবি দাদা
পড়লাম কবি।
শুনে খুবই খুশি হলাম শ্রদ্ধেয় কবি দিদি। আশা করি গল্পের শেষ পর্ব পর্যন্ত সাথে থাকবেন।
গল্পটার আগের পর্বগুলো পড় হয়নি । তবুও ভালো লাগলো লেখার ধরন এবং শৈল্পিক উপস্থাপনে ।
সময় করে পড়ে নিবেন বলে আশা রাখি, শ্রদ্ধেয় কবি দিদি। আশা করি ভালো থাকবেন।
দাদা শুভকামনা রইল