স্মৃতিতে মুড়ির টিন বাস

প্রিয় বন্ধুরা, কোনোএক সময়ে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে চলা যাত্রীবাহী মুড়ির টিন বাসের কথা আপনাদের মনে আছে কি? আমার মনে হয় আমার সমবয়সী যারা আছেন, কেবলমাত্র তাদেরই মনে আছে বলে আমার বিশ্বাস! আর যাদের ১৯৮৪-৮৫ সালের পর জন্ম হয়েছে, তারা সেই সময়কার ঐতিহ্যবাহী মুড়ির টিন বাসের নামই শুধু শুনেছে। কিন্তু কখনই মুড়ির টিন বাসে চড়ে দেখেনি এবং ওই ঐতিহ্যবাহী যানবাহন মুড়ির টিন বাসের ইতিহাসও অজানা।

তবে আমি মনে করি বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির যুগে কারোর কাছে কোনোকিছু অজানা থাকার কথা নয়! কারণ বর্তমান যুগে সবার হাতে হাতেই অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেম মোবাইল ফোন। অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল মানেই সারা দুনিয়া হাতের মুঠোয়। আর এই অ্যান্ড্রয়েড মোবাইলে বিশ্ববিখ্যাত সার্চ ইঞ্জিন গুগলে ‘ক’ লিখে সার্চ করলেই, ‘ক’র মর্মার্থ জানা হয়ে যায়। আর দুনিয়ার সবকিছু অজানা খবর তো মোবাইল স্ক্রিনে নিমিষেই ভেসে উঠেই। তারপরও যাদের কাছে সেই সময়কার ঐতিহ্যবাহী মুড়ির টিন বাসের ইতিহাস অজানা, তাদের জন্যই আজকে আমার এই লেখা। তাই আজকে কোনোএক সময়ের বাংলার ঐতিহ্যবাহী যানবাহন মুড়ির টিন বাসের কিছু স্মৃতি, কিছু জানা-অজানা ইতিহাস সবার মাঝে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।আশা করি সবাই সাথে থাকবেন।

মনে পড়ে সে-সময়ের মুড়ির টিন বাসের কথা। ওই মুড়ির টিন বাস স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ও ঢাকার বিভিন্ন রুটে চলাচল করতো। আর সেসময় নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা শ্যামবাজার হয়ে সদরঘাট যাওয়ার একমাত্র জনপ্রিয় যানবাহন-ই ছিলো, ঐ মুড়ির টিন। ঐ বাসটাকে আবার অনেকেই স্টার্ট বাসও আলতো। কারণ ঐ মুড়ির টিন বাস হাতে হ্যান্ডেল মেরে স্টার্ট দেওয়া হতো। তাই মুড়ির টিনের পাশাপাশি অনেকে ঐ বাসটাকে স্টার্ট বাসও বলতো। ১৯৮৪ সালের দিকেও এই মুড়ির টিন বাসে চড়ে পঞ্চবটী, ফতুল্লা, পাগলা, পোস্তগোলা, শ্যামবাজার হয়ে সদরঘাট যেতাম। শুধু আমিই নয়, আমার মতো এমন হাজারো মানুষ ঐ মুড়ির টিন বাসে চড়েই ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ আসা-যাওয়া করতো।

একসময় আমি আর আমার বড় দাদা ফতুল্লা কাঠের পুল মিলন টেক্সটাইল মিলে কাজ করতাম। তখন আমাদের ফ্যামেলি বাসা ছিলো, নারায়ণগঞ্জ গলাচিপা গোয়াল পাড়া। ফতুল্লা মিলন টেক্সটাইল থেকে আমাদের বাসার দূরত্ব ছিলো প্রায় ৪ কিলোমিটার। প্রতিদিন এই ৪ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে আসা-যাওয়া করা সম্ভব ছিলো না। আবার তখনকার সময়ে নারায়ণগঞ্জ-টু-ঢাকা যাত্রীবাহী মুড়ির টিন বাসে ০.৬০ পয়সা খরচ করে আসা-যাওয়া করাও ছিলো ব্যয়বহুল খরচ! তবুও সময় সময় পয়সার মায়া ত্যাগ করে সময়মত মিলের ডিউটি জন্য মুড়ির টিনে বসে করেই ফতুল্লা পর্যন্ত আসতে হতো।

যদিও তখন নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা সদরঘাট পর্যন্ত মুড়ির টিন স্টার্টবাসে জনপ্রতি ভাড়া ছিলো ১.৫০ পয়স। নারায়ণগঞ্জ থেকে ফতুল্লা পোস্ট অফিস পর্যন্ত ভাড়া ছিলো ০.৬০ পয়সা। তবুও এই ০.৬০ পয়সা করে আসা-যাওয়ায় জনপ্রতি ১.২০ পয়সা খরচ করা কিছুতেই আমাদের মত গরিব মানুষের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব ছিলো না। কারণ প্রতিদিন দুইজনের আসা-যাওয়ায় খরচ ২.৪০ পয়সা তখনকার সময়ের জন্য ছিলো অনেককিছু।বলছিলাম ১৯৮৪ সালের কথা।

তখন ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে দুই রকমের যানবাহন চলাচল করতো। একটা হলো, সূপিয়ার কোচ, মানে বড় বাস। আরেকটা হলো, মুড়ির টিন নামের স্টার্ট বাস। সুপিয়ার কোচ চলাচল করতো, নারায়ণগঞ্জ থেকে গুলিস্তান ফুলবাড়িয়া পুরাতন রেলস্টেশন। আর মুড়ির টিন স্টার্ট বাসের রুট ছিলো, নারায়ণগঞ্জ কালির বাজার হাইস্কুল থেকে ফতুল্লা, পাগলা, পোস্তগোলা হয়ে সদরঘা পর্যন্ত। তখনকার সময়ে আবার অনেকে যাতায়াত খরচ বাঁচানোর জন্য নারায়ণগঞ্জ থেকে পায়ে হেঁটে ফতুল্লা থেকে লঞ্চে ঢাকা সদরঘাট আসা-যাওয়া করতো। আর যারা ব্যাবসা করতো, তারা সবসময় মুড়ির টিন স্টার্ট বসেই বেশি যাতায়াত করতো।

এর কারণ হলো, নারায়ণগঞ্জ, ফতুল্লা, নিতাইগঞ্জ’র যত ব্যাবসায়ী ছিলো, তারা সকলেই ঢাকা শ্যামবাজার থেকে মালামাল ক্রয় করতো। তাদের ক্রয় করা সেই মালামালগুলো মুড়ির টিন বসে করে ফতুল্লা নারায়ণগঞ্জ নিয়ে আসতো। কেউ কেউ আবার সদরঘাট থেকে লঞ্চে করে ফতুল্লা পৌঁছতো। এভাবেই তখনকার সময়ে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বড় বড় ব্যবসায়ীরা দুই পয়সা খরচ বাঁচানোর জন্য এ-পথে সে-পথে আসা-যাওয়া করতো। তো এবার আসি মুড়ির টিন স্টার্ট বাসের ইতিহাস নিজের স্মৃতিতে থাকা বিস্তারিত কিছু আলোচনায়।

সে সময়কার মুড়ির টিন স্টার্ট বাস যাঁরা দেখেননি, তারা হয়তো মনে মনে ভাবছেন! ‘মুড়ির টিন’ বাস আবার কেমন? এর ইতিহাসই বা কী? হ্যাঁ, অবশ্যই মুড়ির টিন স্টার্ট বাসের ইতিহাস আছে। একসময় আমাদের বাংলাদেশে, বিশেষ করে ঢাকা নারায়ণগঞ্জে পাবলিক বাসের যাত্রা শুরু হয় মুড়ির টিন স্টার্ট বাস দিয়ে। এই মুড়ির টিন বাসের ইতিহাস বা কাহিনী শুনেছিলাম, আমার বাবা ও কাকার মুখে।

একসময় আমার বাবা ও কাকা নারায়ণগঞ্জ শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্বপাড় বন্দর থানাধীন লক্ষ্মণ খোলা গ্রাম সংলগ্ন আদর্শ কটন মিলের চাকরি করতো। বাবা অথবা কাকা ছুটিতে বাড়ি গেলে প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা বাড়ির উঠানে বসে স্বপ্নের ঢাকা নারায়ণগঞ্জ শহরের গল্প শুনতো। বাবা ও কাকার মুখে শুনেছিলাম, ঢাকা নারায়ণগঞ্জের ঐতিয্যবহী মুড়ির টিন স্টার্ট বাসের ইতিহাস।

মুড়ির টিন স্টার্ট বাসের গল্প বা ইতিহাস হলো, ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত ছয় বছর ধরে চলা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন শেষ হয়, তখন এ অঞ্চলে মিত্রবাহিনীর ব্যবহৃত কিছু যানবাহন ইংরেজরা এদেশের কিছু বিত্তশালীদের কাছে নিলামে বিক্রি করে দেয়। সেসব যানবাহনের মধ্যে ছিলো, মালা-মাল পরিবহনের ট্রাক, জিপগাড়ি, কাসিম বা কচ্ছপ মার্কা টেক্সি-সহ আরও অন্যান্য তাদের কিছু ব্যাবহারিক ভাঙাচোরা গাড়ি। এসব ভাঙাচোরা গাড়িগুলো তখনকার সময়ের বিত্তশালীরা ইংরেজদের কাছ থেকে কমদামে কিনে রাখে।

তারপর বিত্তশালীরা ওইসব ভাঙাচোরা কাঠের বডি ট্রাকগুলো বাসের আদলে তৈরি করে একধরনের নাকবোঁচা বাস। ভাঙাচোরা ট্রাকগুলোর বাইরের দিকে কাঠের বডির ওপর মুড়ে দেওয়া হয় টিন। একটা ছৈয়া ( ছাউনি) নৌকা যেভাবে বানানো হয়, ঠিক সেভাবেই টিন দিয়ে ট্রাকের চারদিক মুড়িয়ে দেওয়া হয়। যাতে চলন্ত পথে বৃষ্টি এলে যাত্রীরা ভিজে না যায়। সেই থেকেই বাসগুলোর নাম হয় মুড়ির টিন।

আবার ওইসব মুড়ির টিন বাসগুলো হাতে হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে স্টার্ট দেওয়া হতে বলেই, এগুলোর আরেক নাম ছিলো স্টার্ট বাস। যা দেখতে একরকম গৃৃহস্তের ঘরে থাকা মুড়ির টিনের মতনই দেখা যেতো। তাই অনেকেই ঐ বাস গুলোকে মুড়ির টিন বাস বলতো। আবার অনেকে মুড়ির টিন বাসের নাম নিয়ে অন্যমতও পোষণ করে থাকে। তাদের মতে, গৃৃহস্তরা একটা মুড়ির টিনে যেভাবে ঠাসা ঠাসা করে মুড়ি ভরাট করে রাখতো, ঠিক তখনকার সময়ে মুড়ির টিন বসে সেভাবেই ঠাসা ঠাসা করে যাত্রী ভরা হতো বলেই, বাসটির নাম হয় মুড়ির টিন।

কালের বিবর্তনে সেই ঐতিহ্যবাহী মুড়ির এখন অনেকের স্মৃতিতে নেই বলেই মনে হয়। এখন ঢাকায় সিটিং সার্ভিস বাস, এই বাস, সেই বাস, ননস্টপ বাস, বিরতিহীন বাস, গেইট লক সার্ভিস বাস, এসি বাস, বলভো বাস, কলম্বো বাস, সরকারি বিআরটিসি বাস-সহ আরও কতরকমের বাস আর বাস। এতো এতো বাসের ভীড়ে সেই সময়কার ঐতিহ্যবাহী যাত্রীবাহী মুড়ির টিন বাস কোথায় যে হারিয়ে গেলো, তা আর নিজের স্মৃতিতেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু সময় সময় নারায়ণগঞ্জ থেকে যেকোনো বাসে চড়ে যেকোনও স্থানে গেলে সেই সময়কার মুড়ির টিন বাসের কথা মনে পড়ে যায়।

পোস্টের ছবি কালেক্ট: ফেসবুক বন্ধু “শাহ আলম শরাফতী” দাদার পোস্ট থেকে।

নিতাই বাবু সম্পর্কে

নিতাই বাবু ২০১৫ সালে তিনি শখের বশে একটা ব্লগে রেজিষ্ট্রেশন করে লেখালেখি শুরু করেন।তিনি লিখতেন নারায়ণগঞ্জ শহরের কথা। লিখতেন নগরবাসীর কথা। একসময় ২০১৭ সালে সেই ব্লগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ব্লগ কর্তৃক ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র জনাব সাঈদ খোকন সাহেবের হাত থেকে ২০১৬ সালের সেরা লেখক সম্মাননা গ্রহণ করেন। সাথে নগর কথক উপাধিও পেয়ে যান। এরপর সেই ব্লগে লেখালেখির পাশাপাশি ২০১৮ সালের জুলাই মাসে তিনি শব্দনীড় ব্লগে রেজিষ্ট্রেশন করেন। শব্দনীড় ব্লগে উনার প্রথম লেখা "আমি রাত জাগা পাখি" শিরোনামে একটা কবিতা। তিনি চাকরির পাশাপাশি অবসর সময়ে লেখালেখি পছন্দ করেন এবং নিয়মিত শব্দনীড় ব্লগে লিখে যাচ্ছেন।

4 thoughts on “স্মৃতিতে মুড়ির টিন বাস

    1. সুন্দর মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। সাথে রইলো শুভকামনা ।

       

  1. স্বাধীনতা পরবর্তী সময় ঢাকার রাস্তায় অদ্ভুতদর্শন কিছু কিছু গাড়ির কথা আমারও মনে আছে। মুড়ির টিনকে আমি পেয়েছিলাম বাহাদুর শাহ্ পার্কের কর্নারে। দেখতাম, ঐতিহ্যবাহী এই মুড়ির টিন গুলিস্তান-নবাবপুর-সদরঘাট আর নারায়ণগঞ্জ করতো।

    জগন্নাথ কলেজের চিপায়, (তখনও ইউনিভার্সিটি হয়নি) ভাড়ায় চালিত মাথা হলুদ কালো দেহী অ্যাম্বাসেডার (নীল আকাশের নীচে সিনেমার) ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে থাকতো। আরও দেখতাম ব্যঙ্গের চেহারা সদৃশ মিনি-কার ভোক্সওয়াগেন গাড়ি। ভাড়া-ভুড়া ঠিকঠাকই পেলাম এখানে। :) বাকি স্মৃতি আপনি অসাধারণ ভাবেই তুলে এনেছেন। :yes:

    1. ওইসব আমিও অনেককিছু দেখেছি দাদা। যা লেখায় আরও বিস্তারিত নিয়ে আলোচনা করতে পারিনি। যা বলার আপনিই বললেন।

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।