নারায়নগঞ্জ নগরখাঁন পুরে বাসা ভাড়া নিলাম, বাড়িওয়ালা আমাদের হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক, নাম শ্যামসুন্দর সাহা। বাসা ভাড়া মাত্র ১৫০/=টাকা, আমার পরিবারের সদস্য বলতে আমি আর আমার মা। চাকরি করতাম কিল্লার পুল ফাইন টেক্সটাইল, বেতন মোটামুটি ২০০০/=টাকা। তখন চাউলের মূল্য ছিল প্রতি কেজি ৫/= টাকা। সময়টা বোধহয় ১৯৮৪ সালের প্রথম দিকের কথা। বড়দাদার সাথে আয়-রোজগার নিয়ে কথা কাটাকাটি করে নারায়নগঞ্জ নগর খাঁনপুরে বাসা ভাড়া নিলাম, থাকবো মা’কে নিয়ে। যেদিন বাসায় ঢুকবো, সেদিন ছিল শুক্রবার, তারিখটা মনে নেই।
ঠিক দুপুরবেলা হতে দাদার বাসা থেকে কিছু দরকারী মালামাল নিয়ে ভাড়া করা বাসায় আসলাম, মালামালের মধ্যে তেমন কোন দামী মাল বা দামী আসবাবপত্র নেই, তারপরেও মোটামুটি যা আছে গরিব সমাজে চলনসই। নুন আনতে যাদের পান্তা ফুরায়, তাদের তো এর বেশি কিছু থাকার কথাই না, আমার বেলায়ও তাই। রিকশা করে এই মালগুলি আনলাম, বাসার সামনে যখন রিকশা রাখলাম তখন অমার চোখ পড়ল ঐ বাড়িতে থাকা একটা মানুষের উপর।
মানুষটা খুবই সুন্দর ও রূপসী, গায়ের রং ফর্সা, মায়াবী চেহারা, যেন হাতে গড়া এক মাটির মূর্তি দেবী দূর্গা। অটল চেরা চোখ, হাঁটু পর্যন্ত তাঁর মাথার কেশ, অপরূপ এক রূপবতী। আমাদের দিকেই শুধু মেয়েটার নজর, খানিক পরপর শুধু এদিকেই ওর আনাগোনা।
রিকশা-ভ্যান থেকে এই সামান্য মালামাল আর নামাতে ভাল লাগছিল না, লজ্জায়। লজ্জা লাগার কারণও আছে, কারণটা হলো, যেই বাড়িতে বাসা ভাড়া নিলাম, সেই বাড়িতে আরো দুই-তিন ফ্যামিলি ভাড়াটিয়া আছে, তাঁরা সবাই ছোটখাট ব্যবসায়ী। তাদের ঘরে জিনিসের অভাব নাই, তাদের সাথে তো আমার মত গরিব মানুষের খাপ খাবে না, তাই হচ্ছে লজ্জা।
রিকশার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছি কী যে করি! আমার সাথে আছে আমার এক হেলপার, নাম কানাই লাল। ওর বাসাও এই নগর খাঁনপুরে, বহু আগে থেকে ওরা সপরিবারে এই এলাকায় থাকে। ওর অনুরোধেই আবার আসলাম এই এলাকায় মা’কে নিয়ে।
এর বহু আগেও আমরা এই নগর খাঁনপুরেই ভাড়া ছিলাম সপরিবারে, সেই আগের চেনাজানা বলেই আবার বহুদিন পর এই এলাকায় আসলাম বাসা ভাড়া নিয়ে। কানাই শুধু বলছে, কি রে! মালগুলি ধর, ঘরে নিয়ে যাই তাড়াতাড়ি করে। খানিক পর তো আবার সন্ধ্যা হয়ে যাবে, আবার বাজারে যেতে হবে না? নতুন বাসা, কত জিনিসপত্রের দরকার হবে! সবই তো তোর আস্তে আস্তে কিনতে হবে, বলছিল কানাই লাল।
একটু পরে ঐ রূপবতী রূপসী মেয়েটা আমাদের সামনে আসলো, সামনে এসেই বললো, আপনারা দুইজনে না পাড়লে আমি আপনাদের সাহায্য করতে পারি। মামা আমাকে পাঠিয়েছে আপনাদের সাহায্য করতে। আমি একেবারে চুপ করে রইলাম, কোন কথা’ই বলছি না। কানাই বললো না না থাক তোমার লাগবে না, যা আছে সেটা আমরা দুইজনেই পারবো, তুমি যাও। তারপরেও মেয়েটা হাড়ি-পাতিলের বস্তাটা হাতে করে বাড়ির ভিতরে নিয়ে রাখলো, আমি যেই ঘরটা ভাড়া করেছি সেই ঘরে। বাকী মালপত্র কানাই আর আমি মিলে নিলাম, সাথে রিকশাওয়ালাও আছে। আমার মা আসলো বিকালবেলা। মা আসার পূর্বেই ঘরের ভিতরে সব গোছগাছ করে রেখেছি দুইজনে। মালপত্রগুলি গোছানোর সময়ও মেয়েটা বারবার একটু পরপর আমাদের সাহায্য করার জন্য আসছে আমার ঘরে। একটু পরে মা বললেন, যা রান্না করার জন্য কিছু বাজার-সদাই করে নিয়ে আয়। মাকে বললাম বাজারের ব্যাগটা দিন, আর কী কী আনবো বলেন। কী কী লাগবে মা বললেন, ব্যাগ নিয়ে বেরুলাম আমরা দুইজনে বাজারের উদ্দেশ্যে।
রাতের খাবারে কানাইকে নিমন্ত্রণ দিলাম, কানাই ঠিক সময় এসে হাজির হলো আমার ঘরে। মা ভাত খেতে দিলেন দুইজনকে, ভাত খাচ্ছি দুইজনে। এমন সময় আবার মেয়েটা এসে মাকে বললো মাসিমা কী রান্না করলেন এত তাড়াতাড়ি? ইরি চাউলের ভাত, মুশরের ডাইল- মা জবাব দিলেন। মেয়েটা ওদের ঘরে গিয়ে তাড়াতাড়ি করে একটা কাঁসার বাটি করে কিছু তরকারি এনে দিলেন মায়ের হাতে। মা প্রথমে রাখতে চায়নি, মেয়েটা অনুরোধ করলো রাখার জন্য, তখন মা ওর অনুরোধে রাখলো। সেই তরকারি আমাদের দুইজনকে ভাগ করে দিলেন, আমরা দুইজন খেলাম। খাওয়া দাওয়া সেরে হাত-মুখ ধুয়ে বাহিরে বেরুলাম দুইজনে দোকানে যাওয়া জন্য। বাড়ির সাথেই চা দোকান, মুদি দোকান আছে যা রাত বারোটা পর্যন্ত খোলা থাকে সবসময়, মহল্লার দোকান তো তাই।
কানাই লালকে জিজ্ঞেস করলাম যে, মেয়েটা কে? কোথায় বাড়ি, তাঁরা কয় ভাই, কয় বোন ইত্যাদি ইত্যাদি। কানাই লাল বিস্তারিত বললো- মেয়েটার নাম মণিকা, (ছদ্মনাম) ৷ মেয়েটির বাবা নাই, মেয়েটা এই বাড়িওয়ালার এখানে থেকে কাজ করে। বাড়ি মুন্সিগঞ্জ। ওরা একভাই একবোন, মা জীবিত আছে, ওর মাও অন্য একজনের বাসায় কাজ করে। কানাই লাল জিজ্ঞেস করলো, কেন জানতে চাইলি মেয়েটার জীবনী! বললাম একজন কি অন্য আরেক জনের জীবনী সমন্ধে জানতে পারে না? মেয়েটা সারা বিকাল আমাদের খেদমত করার জন্য প্রায় অস্থির, আর শুধু মেয়েটার জীবনী, মেয়েটা কে, মেয়েটা ধনী না গরিব, সেটা জানা কী অপরাধ হবে? কানাই বললো না, কোন অপরাধ হবে না।
রাতে বাসায় ঘুমাতে গেলাম, কানাই ও গেল ওদের বাসায় ঘুমানোর জন্য ৷ওদের বাসা আর আমাদের বাসা পাশাপাশি, তবে বাড়িওয়ালা ভিন্ন। আমি যখন ঘুমানোর জন্য বাসায় আসি মেয়েটা তখন দাঁড়ানো ছিল বাড়িওয়ালার ঘরের সামনের বারান্দায়। আমাকে দেখে বললো এত রাত অবধি বাহিরে থাকবে না, বিপদ হতে পারে। মেয়েটার কথার জবাবের কোন প্রত্যুত্তর দেইনি, সোজাসুজি আমি আমার ঘরে চলে গেলাম। আমি আর সেদিন ঘুমাতে পারলাম না, বিছানায় শুয়ে শুধু ভাবছি, মেয়েটির কথা।
পরদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে হাত-মুখ ধুতে গেলাম বাড়ির সামনে থাকা পুকুর ঘাটে। ঘাটের সামনে গিয়ে দেখি মেয়েটা থালা-বাসন ধোয়ায় কাজ করছে আপন মনে। আমি বোতলে করে বিক্রী করা দন্তমাজন দিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে পুকুর ঘাটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, হাত-মুখ ধোবার আশায়। মেয়েটাকে দেখে সহসা আর নামছি না ঘাটে, আমি আবার অত্যন্ত লাজুক টাইপের একটা মানুষ, আবার সময় মত নির্লজ্জ মানুষও হয়ে যাই। মিলের ডিউটির সময় হয়ে যাচ্ছে, দেরি করা যাচ্ছে না, কানাই সকালের নাস্তা করে ডিউটি ধরার জন্য প্রস্তুত হয়ে আসছে এই পুকুরপাড় দিয়েই। কানাই আমাকে দেখেই রেগে-বেগে অস্থির, সামনে এসে বললো কিরে, এখনো দাঁড়িয়ে আছিস! ডিউটিতে যাবি না? বললাম হ্যাঁ যাবো, কানে-কানে বললাম, মেয়েটা ঘাট থেকে তো উঠছে না, আমি অনেকক্ষণ যাবৎ দাঁড়িয়ে আছি। কানাই রেগে-বেগে মেয়েটাকে বললো ওই মেয়ে উঠ শিগ্গির, দেখিসনা দাঁড়িয়ে আছে মুখ ধোয়ায় জন্য! উঠ শিগ্গির উঠ। মেয়েটা মুখ কালো করে পুকুরঘাট হতে উঠে আসলো, আমি ঘাটে নামলাম মুখ ধোয়ার জন্য। মুখ ধুয়ে, বাসায় গিয়ে, জামাকাপড় পড়ে, কানাইকে সাথে নিয়ে মিলে রওনা হলাম। সেদিন আর মিলে আগের মত কাজে মন বসলোনা, একটু কাজ করেই দোকানে চলে আসি চা পান করার জন্য, এভাবে দুপুর এক ঘটিকা পর্যন্ত, তারপর হলো দুপুরবেলার লাঞ্চ টাইম, বাসায় ফিরে সেদিন আর মিলে যাওয়া হলো না।
এমন এক শুক্রবার বিকালবেলা আমি বাড়ির সামনে পুকুরপাড় বসে আছি একা একা, মেয়েটা আমাকে পুকুরপাড় বসা দেখে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো, খানিক পর বললো কথা আছে আপনার সাথে। মেয়েটার কথা শুনে আমার শরীর ছম্ছম্ করতে লাগলো, সাথে ভয়। আমি ভয়ে মেয়েটার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছি না, যদি বাড়িওয়ালা বা অন্য কেহ দেখে ফেলে তো মান-সম্মান বলতে কিছুই থাকবে না এই মহল্লায়। আবারও মেয়েটা বলছে কী শুনতে পান না! ঘাড় ফিরিয়ে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললাম আমাকে কিছু বলছো? মেয়েটা বলে উঠলো এতক্ষণে! হ্যাঁ আপনাকেই বলছি কথা আছে। আমি বললাম বলো কী বলবে, ঝটপট বলে ফেল। মেয়েটি বললো, বাড়ির ভিতরে আসেন তারপর বলছি। আমি তখন একপ্রকার রাগ হয়ে গেলাম, বললাম তোমার সাথে আমার এমন কোন কথা নেই যে, বাড়ির ভিতরে গিয়ে তোমার কথা শুনতে হবে, তুমি এখন যেতে পার। একপর্যায়ে মেয়েটি আমার হাত ধরে টানতে লাগলো বসা থেকে উঠানোর জন্য, আমি ভয়ে তো একেবারে কাতর হয়ে গেছি মেয়েটির কাণ্ড দেখে। উঠে দাঁড়ালাম আমি, একটু দূরে ছিল একটা দোকান, দোকানদার পরিচিত তা আবার বন্ধুর মত, নাম দিপক সাহা। দিপক দূর থেকে আমাকে দেখছে আমি কী করছি আর মেয়েটা কী করছে। উপায়ান্তর না দেখে মেয়েটির সাথে বাড়ির ভিতরে আসলাম, বাড়িওয়ালা শ্যামসুন্দর সাহা ও তার পরিবার সেদিন বাড়িতে নেই, শুক্রবার হওয়াতে সপরিবারে কোথায় যেন বেড়াতে গেছেন। আমার মাও বাসায় নেই, বড়দাদাকে দেখতে শহরের নন্দিপাড়ায় গেছেন, আরো যে দুই তিন ফ্যামিলি ভাড়াটিয়া থাকে তাদের ঘরেও তালা দেওয়া, মোটকথা বাড়ি খালি একেবারে শূন্য শুধু আমরা দুইজনে বাড়িতে।
বাড়িওয়ালার ঘরে গিয়ে আমি দাঁড়িয়ে আছি হাবার মত, মেয়েটি ধমকের সুরে বললো দাঁড়িয়ে আছেন কেন বসেন। আমি তখন ভয়ে কাঁপছি, মেয়েটি জোর করে টেনে একটা চেয়ারে বসালো আমাকে। আমি বললাম আচ্ছা কী ব্যাপার কী হয়েছে তুমি বলো আমাকে, আমার কাজ আছে এক্ষণি আমাকে একটা জরুরী কাজে মিলে যেতে হবে, না হয় চাকরিটাই থাকবে না আমার। মেয়েটি বললো আপনাকে ভালো লাগে আমার, আমাকে আপনার বিয়ে করতে হবে, প্লাস ভালবাসতে হবে। আমি বললাম আমি গরিব মানুষ, কিছুই নাই আমার, আর তুমি বলছো তোমাকে বিয়ে করতে হবে, ভালবাসতে হবে। এটা আমার দ্বারা সম্ভব নয়। মেয়েটি বললো দোহাই আপনার, আমাকে নিরাশ করবেন না, আমি আপনার কাছে আমার সব ঘটনা খুলে বলছি, শুনুন!
আমরা একভাই একবোন, ভাই আমার ছোট, আমি বড়, বাবা বেঁচে নেই, মা আছে। মা শহরে এক লোকের বাসায় কাজ করে। আমাদের গ্রামের বাড়ি বিক্রমপুর দিঘীরপাড়, পদ্মানদীর ভাঙ্গনে আমাদের ঘরবাড়ি বিলীন হয়ে গেছে বহুবছর আগে, তখন আমি খুব ছোট ছিলাম। পড়া-লেখা তেমন কিছুই করতে পারিনি অভাব-অনটনের কারণে, আমার পড়া-লেখার জন্য মায়েরও বেশি ইচ্ছা ছিল না, তাই পড়া-লেখা আমার ভাগ্যে জুটেনি। এই বাড়িতে কাজ করছি প্রায় তিনবছর গত হয়ে গেল, আমার মায়ের সাথে বাড়িওয়ালার কথা আমাকে বিয়ে-শাদি দিয়ে দিবে বিনিময়ে কোন টাকাকড়ি আমি বেতন হিসেবে পাবো না। গত একমাস আগে আমার জন্য একটা বর (ছেলে) দেখেছে বাড়িওয়ালা, ছেলে মানসিক প্রতিবন্ধী, তার উপর গরিব। আমি রাজি হইনি, আমার মা এক সরল-সোজা মানুষ যে যেভাবে মাকে বোঝায় আমার মা সেভাবে বোঝে। বাড়িওয়ালার কথা, আমাকে ওই ছেলের কাছে বিয়ে দিয়ে ছেলেটাকে বাড়িওয়ালার মুদি দোকানে কাজ করাবে, আর সারাজীবন আমাকে উনার বাড়িতে গৃহকাজে রেখে দিবে, এই হলো বাড়িওয়ালার ইচ্ছা বা ফন্দি। আমি আপনার ব্যাপারে সমস্ত কিছু জেনেছি, জেনে শুনেই আপনাকে মনে-মনে আপন করে নিয়েছি, আপনি আমাকে নিরাশ করবেন না, কথা দিন, এইসব কথা বলতে বলতে মেয়েটি কাঁদতে লাগলো। আমি আর কিছুই বললাম না, শুধু শুনছিলাম মন দিয়ে। মেয়েটির কান্না আমাকে বিমর্ষ করে ফেলেছিল মুহুর্তে, আমি আর কিছুই বলতে পারলাম না মেয়েটিকে, ভয়ে আর দুঃখে এমন হয়ে গেছি যে, একপ্রকার বোবা মানুষের মত। মেয়েটির কথা শুনে শুধু বললাম তোমাকে পরে বলবো যা কিছু বলার, এখন আমি যাই, এই বলে মেয়েটির কাছ থেকে বিদায় নিলাম।
বিকেল গড়িয়ে যখন সন্ধ্যা হলো, কানাই লাল আমাকে খুঁজতে লাগলো কোথাও যাবে বলে। আমি মেয়েটির কথা শোনার পর সোজাসুজি চলে গেলাম মিলের সামনে কিল্লার পুল ৷ সেখানে চার-পাঁচখানা চা দোকান ও হোটেল আছে যা সারারাত পর্যন্তই খোলা থাকে ৷একটা চা দোকানে গিয়ে বসলাম, এমন সময় কানাই লাল এসে হাজির আমার সামনে, বললো তোকে অনেক্ষণ ধরে খুঁজছি। আমি কিছুই বলছি না, মন খারাপ করে বসে আছি এক ধ্যানে। কানাই মন খারাপের কারণটা জানতে চাইলো কেন হঠাৎ মনটা খারাপ। কানাইর কাছে খুলে বললাম সবকিছু, কানাই আমাকে জিজ্ঞেস করলো তোর এখন মতটা কী? বললাম- না, মেয়েটা যা বলছে সেটা এই মুহুর্তে আমার দ্বারা সম্ভব নয়।
পরদিন সকালবেলা মিলে আসার সময় মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে পুকুরপাড়ে আমার আগমনের আশায়, হয়তো অনেক্ষণ ধরেই অপেক্ষা করছিল আমার জন্য। মেয়েটিকে পাশকাটিয়ে আমি যখন যাচ্ছিলাম মিলের কাজে, মেয়েটি বললো কিছু বললেন না যে! আমি বললাম, পরে বলবো এখন নয়। মেয়েটি বললো, তাহলে তো আর হবে না মনে হয়, কারণ: সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে এখন শুধু পিঁড়িতে বসার পালা। বুঝতে পারিনি মেয়েটির কথা, সোজা চলে গেলাম মিলে, কানাই বললো কিরে এত দেরি করে আসলি? বললাম হ্যাঁরে একটু কাজ ছিলো তো তাই দেরি হয়েছে। কানাই অনুরোধ করতে লাগলো বারবার, বলনা কেন তোর মনটা এমন খারাপ, খুলে বলনা আমার কাছে। খুলে বললাম বিস্তারিত কানাইর কাছে। ওতো শুনে হতবাক! জিজ্ঞেস করলো তোর অভিমত কী? আমি কী মাসিমা’র কাছে কিছু বলবো? বললাম- আরে না, কী দরকার, জানিনা শুনি না, এক বিকেলের দেখা, তাতেই এতকিছু! আর আমার তো এখনো বিয়ের বয়স’ই হয়নি, আবার মা’কে বলবি! এ লজ্জা রাখবো কোথায় বল। কানাই আমাকে ওস্তাদ হিসেবে যথেষ্ট সম্মান করে সবসময়, ও আর কোন কথা বললো না আমার মুখের উপর। কাজ শেষ করে দুপরবেলা বাসায় এলাম লাঞ্চ করার জন্য।
মা আমাকে ভাত বেড়ে দিচ্ছে আর বলছে, বাড়িওয়ালার ঘরে কাজ করে মেয়েটার বিয়ে আগামি শুক্রবার, তুই কী জানিস? বললাম না তো! মা বললেন গরীব মানুষের মেয়ের বিয়ে, আমাদের নিমন্ত্রণ দিয়েছে খাওয়া-দাওয়া করার জন্য। আমি আর কোন কথা বললাম না মায়ের সাথে, কোনরকম একটু-আধটু খেয়ে তাড়াতাড়ি গেলাম কানাইদের বাড়ি, কানাই কেবল ভাত খাচ্ছে। আমাকে দেখে কানাইর মা আমাকে বসতে দিয়ে বললেন কী রে, নিতাই বিয়েতে কী দিবি? না জানার ভান করে বললাম কার বিয়ে মাসিমা? বললো কেন রে, তোদের বাড়িওয়ালার বাসায় কাজ করে সেই মেয়েটার! জানিস না বুঝি! বললাম না মাসিমা না, মোটেও জানিনা। কানাই হয়তো মাসিমাকে ব্যাপারটা বলেছিল, মাসিমা আমাকে বললেন, মেয়েটিতো বেশ সুন্দর ছিলো রে, তোর সাথে মানাতো বেশ। মেয়েটা গরিবের মেয়ে সংসারিক হতো, এখন যেই ছেলের কাছে বিয়ে দিচ্ছে, মেয়েটার জীবন শেষ করার একটা পন্থা। আমি আর দেরি করলাম না, বসা থেকে উঠে চলে এলাম বাহিরে পুকুরপাড়ে। দূর থেকে দেখি, মেয়েটি ওদের পুকুরঘাটে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আমিও তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম অনেক্ষণ। একটুপরে কানাই বাসা থেকে বাহির হলো, কানাইকে নিয়ে একসাথে দুজন হেঁটে আসছি পুকুরপাড় দিয়ে, ঠিক যখন মেয়েটির সামনে আসলাম তখন মেয়েটি শুধু বললো ভালো থাকবেন সারাজীবন প্রার্থনা করি প্রভুর নিকট। কথা শুনে কানাই আর শুধু তাকিয়ে থেকে মেয়েটার কাছ থেকে সরে গেলাম, একটু দূরে গিয়ে কানাই বলছিলো মেয়েটা অসহায় ছিল রে!
আমি মনে মনে বলছিলাম মেয়েটাকে তো আমারও ভালো লেগেছিলো রে, কিন্তু সময় তো পাইনি কিছু করার। এত অল্পসময়ে কী আর করা যায় কার জন্যে, এখানে যদি বছর খানেক থাকতাম, আর মেয়েটির জন্য কিছু করার এক বছর সময় পেতাম, তাহলে কিছু একটা করা যেতো। এই মুহুর্তে মেয়েটি অসহায় নয়, অসহায় হয়ে গেলাম আমি নিজে, কিছুই করতে পারলাম না মেয়েটির জন্য। শুক্রবার আসতে আর মাত্র তিনদিন বাকী আছে, মিল থেকে ৫০০/=টাকা অগ্রীম নিয়ে নিলাম মেয়েটার বিয়ের নিমন্ত্রণে যাওয়ার জন্য। বিয়ের দুদিন আগে বাড়িওয়ালা শ্যামসুন্দর দাদাকে বললাম দাদা, ওর বিয়ের শাড়িটা যদি আমি দেই, তাতে কোন সমস্যা হবে? শ্যামসুন্দর দাদা বললেন না না কোন সমস্যা হবে না। আমরা তো দশজনের কাছ থেকেই সাহায্য উঠিয়ে মেয়েটাকে পাড় করছি, বিয়ের শাড়ি অন্য একজনে দিবে বলেছিল, তাকে না হয় বলবো অন্য কিছু দিতে। মিল হইতে ৫০০/=টাকা আর ঘরে ছিল ৫০০/=টকার মত, সেই টাকা নিযে নারায়নগঞ্জ শহরের কালীর বাজার হতে ৮৫০/=টাকা দিয়ে একটু বিয়ের শাড়ি কিনে আনলাম। বাড়ির সবাই সেই শাড়িখানা দেখে প্রশংসা করলো, বললো খুব সুন্দর মানাবে মেয়েটাকে। শাড়িখানা এনে আমার মায়ের হাতে দিয়ে বললাম, মা এই শাড়িখানা আমি এনেছি মেয়ে’টিকে দিবো বলে, তুমি মা কী রাগ করেছো? মা বললেন না রে, আমি আরো খুশিই হয়েছি, ভাল একটা কাজ করেছিস তুই। মা তাড়াতাড়ি করে শ্যামসুন্দর দাদার স্ত্রীর কাছে নিয়ে গিয়ে বললো, বউমা এই শাড়িখানা আমার ছেলে এনেছে মেয়ে’টিকে দেওয়ার জন্য, আর এই শাড়িই হবে ওর বিয়ের শাড়ি। সাথে সাথে শাড়িখানা নিয়ে মেয়েটিকে দেখালো শ্যামসুন্দর দাদার স্ত্রী, বললো দেখতো তোর পছন্দ হয়েছে কিনা! মেয়েটি শাড়িখানা বুকে ধরে অঝরে কাঁদছে।
শুক্রবার বিয়ের দিন, আগের দিন গেল আদিবাস। বিয়ের দিন ভোরবেলা সবাই ঘুমে থাকতেই আমি বাসা থেকে সোজা মিলে চলে যাই। মিলের সামনে চা দোকানে সকালের কিছু হালকা নাস্তা করলাম, চা পান করলাম, ভাল লাগছিলো না। দোকানেই বসে বসে সময় আটটা পর্যন্ত প্রায় তিনকাপ চা সেরে ফেললাম, সকাল আটটা বাজার সাথে সাথে কানাই এসে হাজির আমার সামনে। ও আমাকে বললো আজ আর কাজ করতে পারবো না, চল মহল্লায় যাই, আজ ত এমনিতেই ওভার টাইম, করলে মজুরী পাবো, না করলে মজুরী পাবো না। বললাম ম্যানেজার সাহেব তো রাগ করবে, কানাই বললো চল ছুটি নিয়ে আসি ম্যানেজারের কাছ থেকে। গেলাম ম্যানেজারের কাছে ছুটির জন্য। ম্যানেজার সাহেব ছুটি দিলেন।
সারাদিন কানাইদের বাসায় ঘুমাইলাম, রাত আট ঘটিকার সমর ব্যান্ডপার্টির বাজনার শব্দ, বরযাত্রী হয়তো আসছে শ্যামসুন্দর দাদার বাড়িতে। রাত এগারটায় বিয়ের লগ্ন নির্ধারণ করা আছে যা যথারীতি হবে। মেয়েটি তখন ছোট একটা বাচ্ছা ছেলেকে পাঠিয়েছে আমাকে খুঁজে বের করে বলতে বাড়িতে আসার জন্য। ছেলেটা আমার খুব আদরের তাই ও আমার ঠিকানাটা জানে যে, আমি কোথায় আছি। ছেলেটা আমার সামনে গিয়ে বললো কাকা তোমাকে দিদি ডাকছে। তুমি আস বাড়িতে, আমার মাও আমাকে খুঁজছে দুপুর থেকে, কোথাও পায়নি। আমাদের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিয়েতে বিয়ের পিঁড়িতে বসার আগে মালা বদল হয়, যা মেয়ে ছেলেকে পড়িয়ে দেয়, আবার ছেলে মেয়েকে পড়িয়ে দেয়। ছেলে এবং মেয়েকে বিয়ের পিঁড়িতে করে আলাদা আলাদা করে চার-পাঁচজনে মিলে মাথার উপরে উঠিয়ে নাচতে থাকে, এর মধ্যেই মালা বদল করা হয়। সেই পিঁড়িটাই আমাকে ধরার জন্য মেয়েটার ইচ্ছা। বর আসলো, বরযাত্রীদের খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ হলো, পুরোহিত মহাশয় মালা বদলের অনুমতি দিলেন। মেয়েটাকে সবাই কোলে তুলে আনতে গেলেন, কিন্তু না, মেয়েটি আসছে না কারো সাথে। কী ব্যাপার কেই জানে না মেয়েটি এমন করছে কেন! বাড়িওয়ালা শ্যামসুন্দর দাদা, রেগে-বেগে যখন বললো কী ব্যাপার তুমি উঠছো না কেন? উঠো তাড়াতাড়ি করে লগ্ন পাড় হয়ে যাবে। তখন মেয়েটির সোজাসুজি কথা, নিতাই দাদা কোথায়! উনি না আসলে আমি উঠবো না। এই কথা শোনার পর পুরো বাড়িতে তখন হৈ হাল্লা লেগে গেল, আমার মা ভয়ে কাঁপছে, না জানি কী হয় আজকে। সবাই আমাকে খুঁজতে লাগলো, আমি আর কানাই বাসা থেকে একটু দূরে একটা চা দোকানে বসে কথা বলছিলাম, সেখানে আমাকে পেয়েছে সবাই। আমার হাত ধরে জোর করে টেনে বিয়ে বাড়িতে নিয়ে এলো সবাই, কারণটা জানতে চাইলাম কী ব্যাপার, এত জোরাজুরি কেন? উত্তরে সবাই বললো তোকে ছাড়া বিয়ে হবে না। আসলাম তাদের সাথে, কানাইও আছে পিছনে পিছনে, বাড়িতে আসার পর শ্যামসুন্দর দাদা হেসে দিলে বললো যা’তো তাড়াতাড়ি মেয়ে’টিকে ঘর থেকে বাহির কর, মালা বদল করার জন্য। আমার মাও বললেন যা শিগ্গির তাড়াতাড়ি করো। গেলাম মেয়েটার সামনে, আমার পিছনে আরো দশবার জন লোক, আমি সামনে যাওয়ার পরই মেয়েটি উঠে এসে আমাকে ধরে শুধু কাঁদছে হাউমাউ করে, যা দেখে সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। আমিও আর আমার কান্না ধরে রাখতে পারলাম না, কাঁদছি সমান তালে ৷ এই দৃশ্য দেখে আমার মাও কাঁদছে, বাড়ির সবাই কাঁদছে আমাদের এই দৃশ্য দেখে, শ্যামসুন্দর দাদাও কেঁদে কেঁদে বললো, আর কী করা বুঝতে পারি নাই আমি, যা হবার হয়েছে এখন বিয়ের আসরে নিয়ে যা, বললো বাড়ির সবাই। আমি কোলে করে ঘরের বাহির করলাম মেয়ে’টিকে মালা বদল করার জন্য, সাথে কানাই আরো অনেকে মেয়ে’টিকে পিঁড়ির উপড় বসিয়ে, মাথার উপর নিয়ে নাচতে লাগলাম। মালা বদল শেষে পিঁড়িখানা পুরোহিতের সামনে বসিয়ে দিলাম, ছেলেকেও বসিয়ে দিলো সামনাসামনি করে। ধান, দূর্বা, ফুল, তুলসী, আর চন্দ্র সূর্যকে সাক্ষী রেখে মেয়ে’টির বিয়ে সম্পাদন হয়ে গেল, আজ থেকে প্রায় ত্রিশ বছর আগে, কিন্তু এখনো মনে পড়ে সেই দিনগুলির কথা। প্রেম করিনি, শুধু ভাল লেগেছিল, তবু যেন ভুলে থাকা যায় না।
চমৎকার প্রকাশ।
সুন্দর মন্তব্যের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি, প্রিয় দাদা।
পর্ব পর্ব করে লিখা আত্মজীবনীর এই লিখাটির সাথে আমার পরিচয় হয়েছিলো আপনারই কল্যাণে। যতবারই পড়ি না কেন, নিজেকে গুলিয়ে ফেলি। মনে হয় আমার নিজ জীবনের কথা গুলোই রিপিটেড হচ্ছে। ভালো লাগে। স্মৃতিটুকু থাক প্রিয় কবি নিতাই বাবু।
জীবনের স্মৃতিটুকু এই শব্দনীড়েও স্মৃতি হয়ে থাকুক। ভালো থাকবেন শ্রদ্ধেয় দাদা।
জীবনের এই গল্প নিয়ে সম্ভবত আর একটি লেখা পড়েছিলাম আপনার বেশ ভালো লেগেছিল এই গল্পটাই কিনা আমি জানিনা তবে আজকের লেখাটাও অন্যরকম লাগলো বেশ ভালো। অনেক অনেক শুভকামনা আপনার জন্য।
লেখাটা অনেক পুরনো। যা সম্ভবত ২০১৬ সালে কোনোএক ব্লগে লিখেছিলাম। তখন আমি সবেমাত্র লেখালেখিতে ছিলাম একেবারেই নতুন। তাই হয়তো দেখতে পারছেন যে, লেখায় সাধু চলিত ভাষায়র সংমিশ্রণ এবং ভুলভালে ভরা। আজকে ঐ ব্লগ থেকে লেখাটি কপি করে এই শব্দনীড়ে পোস্ট করেছি। উদ্দেশ্য স্মৃতি করে রাখার জন্যে। পড়েছেন জেনে খুবই খুশি হলাম এবং সুন্দর মন্তব্যের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম। শুভকামনা থাকলো।