ইরাবতী (একজন হত্যাকারীর গল্প)

ঐ যে বিল্ডিংটা দেখছেন, ওখানে একটি ছেলে থাকে। আমি প্রতিদিন বিকালে ছাদে যাই ওকে দেখার জন্য। ওর সাথে আমার প্রেম নয়, আমার ভাল লাগা। এ ভাল লাগার কথা ছেলেটি জানেও না, হয়তো কোনদিন জানবেও না। ও যখন জানালার পাশে এসে দাড়ায়, আমি দেখি, ওর চোখ, ওর চুল, ওর মুখ।
ওর মুখ দেখলে মনে পরে রবিঠাকুরের কবিতা-

যদি প্রেম দিল না প্রাণে
কেন ভোরের আকাশ ভরে দিলে এমন গানে গানে?কেন তারার মালা গাঁথা,কেন ফুলের শয়ন পাতা,কেন দখিন হাওয়া গোপন কথা জানায় কানে কানে?।
যদি প্রেম দিলে না প্রাণে
কেন আকাশ তবে এমন চাওয়া চায় এ মুখের পানে?তবে ক্ষণে ক্ষণে কেন
আমার হৃদয় পাগল হেন,তরী সেই সাগরে ভাসায় যাহার কূল সে নাহি জানে?।

আরে! আমার নামই তো বলা হল না।
আমি ইরা। আমার বাবার ইরাবতী। প্রতিটি বাবার কাছে তাদের মেয়ের একটি নিজস্ব নাম থাকে। ইরা নামটি সম্ভবত আমার মায়ের দেয়া। এ নামের কারন আমার জানা নেই তবে ইরাবতী নামের অর্থ আমি জানি। ইরা অর্থ -দক্ষের কন্যা, কশ্যপের স্ত্রী, এবং ইরাবতী – উত্তরের কন্যা, পরীক্ষিতের স্ত্রী ।
হুম…পরীক্ষিতের স্ত্রী!!
আমিও স্ত্রী, তবে পরীক্ষিত কিনা তা জানি না। আমার বর জামান চৌধুরী। এক সময় আমার মায়ের বন্ধু ছিলেন। আমার মায়ের বন্ধু শুনে অবাক হচ্ছেন?
ঠিক, মায়ের বন্ধু না বলে আমার বাবার পত্নীর বন্ধু বললে যথার্থ হবে। কারন আমার মা মারা যাবার পরে বাবা যাকে বিয়ে করেন তাকে আমাদের সামাজিক ভাষায় সৎ মা বলে। তাহলে বলা যেতে পারে জামান চৌধুরী আমার সৎ মায়ের বন্ধু ছিলেন ।
জামান চৌধুরী আর আমার বয়সের ব্যবধান বছর ত্রিশেক হবে, ধরুন আমার বয়স ২২ হলে তার ৫২। তাতে কি? আমার সৎ মায়ের ভাষ্য মতে, আমার ভাগ্যটা অনেক ভাল। কারন অনেক ধনাঢ্য প্রানীর সাথে বিয়ে হয়েছে আমার। এত বড় ব্যবসা! আচ্ছা প্রানী বললাম রাগ করেননি তো? পুরুষ কি প্রানী হতে পারে? মেয়েদের পুরুষকে দেখে সর্বদা সামলে চলতে হয়। পুরুষ বলে কথা!! না হলে রক্তাক্ত হতে হবে। হোক সেটা শারীরিক অথবা মানসিক।
আর রক্ত? ওতো প্রতি মাসেই ঝরে। সে যাই ঝরুক পুরুষের জৈবিক চাহিদা মেটাতেই হবে, ওসব রক্ত-ফক্ত কিছু না।

তাহলে কিছুটা পুরনো কথা দিয়ে শুরু করি-
আমার মা মারা যাওয়ার বছর খানেক পরে আমার বাবা আরেকটা বিয়ে করেন। তার কিছুদিন পরে জামান চৌধুরীর আগমন ঘটে। উদ্দেশ্য ছিল বাবা ডুবে যাওয়া ব্যবসাকে সফল করা। এ নিয়ে আমার সৎ মায়ের হট্টগোলের শেষ ছিল না। অনেকবার বাবাকে শুনতে হয়েছে -“আজ আমার বন্ধু না থাকলে তোমাকে রাস্তায় ভিক্ষা করতে হত “
দিন দিন জামান চৌধুরীর আসা যাওয়া বাড়তে থাকে। বাবা বাসায় না থাকা অবস্থায়ও দেখতাম তিনি বাসায় আসতো কিন্তু কিছু বলার সাহস ছিল না আমার।

একদিন বাবা এবং সৎ মা কোন এক অনুষ্ঠানে যায়, আমাকে এসব যায়গায় নেয়া যায় না বলে একা বাসায় থাকতে হয়। এমন সময় বাসায় আসে জামান চৌধুরী। আমি তাকে ড্রইং রুমে বসতে দিয়ে আমার রুমে চলে যাই। হঠাৎ জামান চৌধুরী আমার রুমে আসে, চেপে ধরে হিংস্র বাঘের মত, তার ক্ষিপ্ত বাসনা পূরণ করে, বিশ্বাস করুন সেদিন আমার অসহায় মুখ যদি আপনাকে দেখাতে পারতাম! আমার মর্ম, আত্মা, আমার চিত্ত, চেত সেদিনই মারা গিয়েছিল। আমার মায়ের মুখটা অনেক মনে পড়ে, মা থাকলে এমন হত?
চলে যায় জামান চৌধুরী, শুধু বলে যায়- কাউকে কিছু বললে বাবাকে হারিয়ে ফেলবো!
পড়ে থাকি আমি, পরে থাকে আমার দেহ, আর কিছু রক্ত …
মাস ছয়েক পরে একদিন জানতে পারলাম, জামান চৌধুরীর সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। আমার বাবার সম্মতি না থাকলেও তার কিছু করার ছিল না, কারন বাবার ব্যবসার অবস্থা ছিল শোচনীয়। বাবার ব্যবসা বাঁচাতে আমাকে বলির পাঠা হতে হয়।
এক বৃষ্টি বিকেলে আমার বিয়ে হয়। সেদিন প্রথম বাবার চোখে পানি দেখেছিলাম। আমার মায়ের মৃত্যুর দিনও বাবা কাদেঁনি। তবে আজ কি হল বাবার?

বিয়ের রাত। মানে বাসর রাত। জামান মদ খেয়ে এসেছিল সেদিন, ঘরে ঢুকে তার প্রথম কথা ছিল- “তারাতারি কাপড় খুলে বিছানায় আয় মাগী, এত ঢং করার কি আছে? সবতো দেখে নিয়েছি “
জানেন, ঐদিন থেকে আর কখনো কাঁদিনি, কারন প্রতিটিদিন ছিল একই রকম নরক যন্ত্রণার। আমাকে সব সময় তৈরী থাকতে হত নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার জন্য। কে বলে, মেয়েদের সৌন্দর্য তার চুলে, চোয়ালে, ঠোঁটে? সেটাতো আমার আঘাতের স্থান। এ ঘরের প্রতিটি দেয়াল জানে আমার আর্তনাদ, আমার চিৎকার!
কিন্তু আজ থেকে আর শুনতে হবে না সেগুলো। ঐ যে দেখেন জামানের নিথর দেহ পড়ে আছে!
হ্যাঁ আমি!!! আমি একটু আগে জামানকে খুন করেছি! আজ আমার প্রথম বিবাহ বার্ষিকী ছিল। আমি জানি এসব জামানের মনে থাকার কথা নয়। আজও জামান মদ খেয়ে এসেছিল। এখনো তার গন্ধ আমার শরীরে লেগে আছে। রান্না ঘরের বড় ছুড়িটা এনে রেখেছিলাম। জামান যখন ঘুমালো, আমি ওর সামনে গিয়ে দাড়ালাম। একবার শুধু ওর মুখটা দেখেছিলাম তারপর নিজেকে থামাতে পারিনি, চোখ খুলে দেখি শুধু রক্ত, অনেক রক্ত!
এ রক্ত আমার নয়! এ রক্ত একজন পুরুষের! এ রক্ত একজন মানুষের!

অনেক কথা বললাম, ঐ সিলিং ফ্যানের দড়িটা আমার জন্য অপেক্ষা করছে, আমি মায়ের কাছে যাব। যেতে আমাকে হবেই, ঐ যে মা আমাকে ডাকছে …..

পবিত্র হোসাইন সম্পর্কে

মাঝে মাঝে নিজেকে আঠেরো শতাব্দীর অঘোষিত, সাফল্যহীন কবি মনে হয়। যার কিছু লেখা নামহীন বাজারি পত্রিকায় ছাপা হয়ে ছিল কিন্তু কেউ তা পড়ে দেখিনি।

23 thoughts on “ইরাবতী (একজন হত্যাকারীর গল্প)

  1. বেদনাহত হলাম গল্পটি পড়ে। আমাদের নারীদের কত কষ্টই না সইতে হয়। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Frown.gif.gif

    1. প্রিয় আপুনি, আপনি ব্যথিত হয়েছেন জেনে বিষন্ন বোধ করছি, একদম সত্যি কথা বলেছেন-নারীদের অনেক কষ্ট সইতে হয় আমাদের সমাজে 

  2. ইরাবতী'র জন্য দুঃখ পেলাম। গল্পের এমন বাস্তবতা অসত্য নয় পবিত্র ভাই। স্বাগতম।  

    1. মন্তব্য করার জন্য অশেষ ধন্যবাদ দাদা, আমাদের জীবনে অনেক অপ্রিয় সত্য ঘটনা ঘটে চলেছে যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। 

      -অনেক অনেক ভালোবাসা রইলো আপনার প্রতি

  3. ইরাবতী ভুল করেনি। পাওনা মিটিয়ে দিয়েছে। 

    1. ইরাবতীরা ভুল করতে শেখে না , পরিস্থিতি তাদের বাধ্য করে পাওনা মিটিয়ে দিতে 

      -লেখাটি পড়ার জন্য অশেষ ধন্যবাদ 

  4. গল্পের পুরুষ চরিত্রটির প্রতি অভিশাপ দিতে মন চাইছে। :(

    1. আমাদের আশেপাশে এমন অনেক গল্পের পুরুষ চরিত্রটি আছে , কত জনকে অভিশাপ দিতে পারবো আমরা ? আমাদের প্রতিরোধ করতে হবে এসবের বিরুদ্ধে 

      -অশেষ ধন্যবাদ প্রিয় সাজিয়া আফরিন আপুনি 

  5. ম্যাচিউরড বা পরিপক্ক বা পাকা হাতের সরচনা। স্বাগতম পবিত্র হোসাইন ভাই।

    1. এভাবে বলবেন না এখনো অনেক কিছু শেখার আছে, আপনারা পাশে থাকে অবশ্যই ভালো কিছু করতে পারবো 

      -আপনার মন্তব্য আমার লেখার অনুপ্রেরণাকে বাড়িয়ে দিলো

    1. বুবুনি, তোমার মন্তব্যে মনের মধ্যে অদ্ভুত এক আনন্দ অনুভব করছি , হয়তো এটাই লেখকের জন্য বড় পাওনা।  তোমার ছোট্ট মন্তব্যের ব্যাখ্যা যে অনেক।  

  6. অসাধারণ উপস্থাপনা মি. পবিত্র হোসাইন। শব্দনীড় এ আপনাকে সুস্বাগতম। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_smile.gif

    1. দাদা আপনি আমার প্রিয় ব্লগারদের মধ্যে একজন, শব্দনীড়ে পড়তে পড়তে কখন যে তার মায়ায় পরে গেছি বুঝতে পারিনি 

      -অনেক লিখতে চাই তাই আপনার পাশে থাকাটা ভীষণ জরুরি 

    1. লেখা পড়ে ভালো লেগেছে জেনে আনন্দিত হলাম ,

      -অশেষ অশেষ ধন্যবাদ প্রিয় ভাইটিকে  

  7. পরিচিত লেখকের পরিচিত পোস্ট, সামু ব্লগ।

    1. বাহ্ ! আপনকে এখানে পেয়ে খুশি হলাম  

  8. লেখা ভাল হয়েছে। রবী ঠাকুরের কবিতার পর প্যারা গ্যাপ দিকে ভাল হতো। প্রতি প্যারার পর একটা করে গ্যাপ দিন। 

    এ রক্ত আমার নয়! এ রক্ত একজন মানুষেরও নয়! এই রক্ত পুরুষ নামের একটা নরপশুর!   

    আমিও আছি এখানে। ভাল লাগল আপনাকে পেয়ে।

    আপ্নার গুরুজী @ নীল আকাশ।

    1. গুরুজী আপনকে এখানে পেয়ে ভাল লাগছে 

      কেমন আছেন আপনি? সামুতে এক ইডিয়েট আছে যার জন্য সব ব্লগাররা অতিষ্ট, এটার কিছু করেন !

      1. ওকে এভয়েড করুন। খোদ মডারেটর একে প্রশয় দেয়। কিছু করা সম্ভব না। এর জন্য আমার সাথে মডারেটর এর খুব খারাপ সর্ম্পক হয়ে গেছে। এর পক্ষে সাফাই গায় এসে কি করব বলুন? 

        পোস্টে মন্তব্য দেখা মাত্র ডিলিট করে দিবেন। ২ বা ৩ বার ডিলিট করে দিলে আর বিরক্ত করতে আসবে না।

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।