সব চরিত্র কাল্পনিক

জানিস মন কাল সারা রাত ঘুমাই নি। জ্বরে কেঁপেছি। ছটফট করেছি। আমি ছোট্ট থেকেই জ্বর হলে খুব ঘ্যানঘ্যান করি। অনেক বছর আগে বিরক্ত করে মারতাম দাদুকে। দাদু ছাড়া আর কেইই বা ছিলো বল আমাকে সহ্য করার মতো। দাদুর পরে আর তুই। জানিস, ছোট্টবেলায় জ্বর হলে বাড়ির সবার কোলে কোলে ঘুরে বেড়াতাম। দাদু, জেঠু, কাকাই, ঠাম্মা, বড়মা সব্বার। আর আমার যত জ্বর হতো ঠিক annual পরীক্ষার সময়ে। তখন পড়তে ইচ্ছে করে বল? তাই আমি পড়তেই বসতাম না জ্বরের মধ্যে।

বাবা সকালে অফিসে যাওয়ার আগে বাড়ির সব্বাইকে বলে যেতো, কেউ যেন আমাকে পড়তে বসতে না বলে। তাইতো আমি কোলে কোলে ঘুরতাম। আর সন্ধ্যেবেলা বাবা বাড়ি ফিরে, পরের দিন যে subject এর পরীক্ষা থাকতো, সেই বই এনে আমার সামনে গল্পের মতো করে পড়তো। আর আমি বাবার কোলে মাথা রেখে চুপ করে শুনে যেতাম। বাবা বুঝিয়ে দিতেন, অবিকল তাই লিখে আসতাম। আর এখন মাঝে মাঝে অসহ্য লাগে সবকিছু। এইরকম বেঁচে থাকার থেকে মরে যাওয়াই ভালো রে।

জানিস কাল সারারাত ভেবেছি, মাঝে মাঝে মনে হয় আমি জোড় করে তোর সাধনার মধ্যে ঢুকে পড়লাম না তো? তবে কি আমার প্রতি তোর শুধুই করুণা? মাঝে মাঝে যে এড়িয়ে চলিস বুঝতে অসুবিধা হয়না আমার। নিশ্চয়ই কিছুটা বুঝেছিস যে বিনিময় প্রথা আজও আমি শিখিনি। ভালোবাসার অভিনয়ও রপ্ত হয়নি আমার। বলেছি তো তোর আর আমার সম্পর্ক আলেকজান্ডার আর পুরুর মতো। মিনিমাম সততা রাখিস। করুণা নয়, যদি ভালো না বাসিস সেটাও অকপটে জানিয়ে দিস।

এখনো বুকের অনেক কুঠুরি খালি আছে, তারমধ্যে আর একটা কষ্ট অনায়াসে থাকতে পারবে। জানিস আজও আমি আমার দুঃখগুলোর রাখাল। দিনের বেলায় তারা সবাই এদিকে ওদিকে ঘুরে বেড়ায়। আর ঠিক সন্ধ্যে হলেই তারা একে একে গুটি গুটি পায়ে আমার কাছে এসে হাজির হয়। আমিও তাদের ধুয়ে মুছে যত্ন করে রেখে দিই জায়গা মতো কুঠুরিতে। আমি তাদের ছাড়তে চাইলেও তারা আমায় ছেড়ে যাবেই না।

জানিস রোজ খুব ভোরে আমি বেড়োই। রাস্তা অনেক ফাঁকা তখন। ইচ্ছে করেই বাড়ির সামনে থেকে বাসে উঠি না। কিছুটা রাস্তা হেঁটে যাই। ভালো লাগে। চারিদিকে পাখিদের ডাক, শান্ত করে দেয় মন। জানিস, আজকাল তো উন্নয়নের জোয়ারে গাছেদের বলি দেওয়া হচ্ছে। আমাদের কি এসে যায় বল? তারা কি আমাদের ঘরের সন্তান যে তাদের মৃত্যুর জন্য শোক করবো! গাছেদের প্রাণ আছে, তাতে কি হল। আমার মতো কত মানুষ যে জীবন্ত লাশ হয়ে বেঁচে আছে। তার বেলা?

জানিস, যখন ভীষণ ভেঙে যাই, ছিন্ন বিছিন্ন হয়ে যাই, দাদু ঠাম্মার ছবির সামনে গিয়ে দাঁড়াই। কাল জ্বরে, মাথা যন্ত্রনায় ভীষণ কষ্ট হচ্ছিলো। দাদুর ছবির সামনে মাথা রেখে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিলাম, বলেছিলাম দাদু, একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে? ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে। আমার যত না বলতে পারা কথা, যত অভিমান, অভিযোগ, চোখের জলের হিসেব আজও দাদুকেই দিই। আজও দাদু সব শোনে, শুধু তার কোলে মাথা রাখতে পারিনা এখন।

দাদুর সাথে যেদিন দেখা হবে সেদিন দেখিস ভীষণ ঝগড়া করবো আমি, এইভাবে কেউ একা রেখে যায়! দেখা হবেই আর পাঁচ, সাত বছর পরেই। একটা সাঙ্ঘাতিক দ্বায়িত্বের বন্ধনে আবদ্ধ আমি। আর সাত বছর পরেই সেই দ্বায়িত্বের অবসান। তারপর আর এক মুহুর্তের জন্যও থাকতে চাই না। এই পৃথিবীতে। জানিস মৃত্যু প্রকৃত প্রেমিক, ভীষণ লয়াল। কিছুতেই আমাকে ছেড়ে থাকতে পারবে না। সে আসবেই। আর সে যেভাবেই আসুক তাকে আলিঙ্গন করতে আমি প্রস্তুত।

ভাবছিস বুঝি মাথাটা গেছে, সারাদিন সাইকোলজি পড়াতে পড়াতে নিজেই বুঝি পাগল হয়ে গেলাম। আরে নাহ, আমার এই পাগলামী মনোবিজ্ঞানের অভিধানেও নেই। তোর প্রতি আমার যে পাগলামী, এটা থাকবে আমরণ। জানিস, ভীষণ কান্না পাচ্ছে। জ্বর এলেই ছোট থেকেই আমার ভীষণ কান্না পায়। তোর কোলে মাথা রাখতে ইচ্ছে করছে ভীষণ। দিবি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে, দাদুর মতো?

4 thoughts on “সব চরিত্র কাল্পনিক

  1. সব চরিত্র কাল্পনিক হলেও এই সব চরিত্র বেশ আপন এবং পরিচিত মনে হয়। মনে হয় এ যেন আমারই কথা। কাল্পনিক হোক আর নিজের হোক অসাধারণ রচনাশৈলী।

    অভিনন্দন প্রিয় শব্দ বন্ধু রিয়া রিয়া। :)

  2. রিয়া দাদু, বর্ণনাশৈলী অপূর্ব। ধারাবাহিকতা সামন্জস্যপূর্ণ। বাবার সাথে এক সময় কার সুসম্পর্কের স্মৃতি কথার প্রষ্ফুটন দারুণ। চলুক তোমার সুন্দর লিখা। ভালো থেকো দাদূ। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।