মাঙ্গলিক রবীন্দ্রনাথ …
প্রেমিকদের মূল মন্ত্র হল ‘প্রেম’। উপনিষদে এই ‘প্রেম’ শব্দটির সমার্থক শব্দ হল ‘আনন্দ’। এই প্রেম আর আনন্দের মধ্যে এক নিবিড় যোগ আছে আর তা হল সত্য। প্রেমের যা দুঃখ একজন প্রকৃত প্রেমিকের কাছে তা পরম আনন্দ। এর সঙ্গে সৌন্দর্যকেও যোগ করে নিতে হবে। কেননা সৌন্দর্যের আশ্বাস মনে প্রেমের জন্ম দেয় আর তার থেকেই আসে আনন্দ আর সেই আনন্দই চিনিয়ে দেয় পরম সত্যকে। এবং এই ভাবের থেকেই ‘মঙ্গল’ শব্দটি মনে আসে। কিন্তু গভীর মরমী চেতনায় সৌন্দর্য, প্রেম, আনন্দ, সত্য এই সমস্ত ভাবের স্তরই একটি পূর্ণতা নিয়ে সৃষ্টি হয়। কিন্তু ‘মঙ্গল’ শব্দটির মধ্যে পূর্ণতা থাকে না। কারন মঙ্গল মানেই অমঙ্গলের অস্তিত্ব। আমরা পরম করুণাময় ঈশ্বর কে মঙ্গলের অধীশ্বর বলে মনে করি তাহলে তো অমঙ্গলের অধীশ্বর হিসেবে শয়তানকে মানতে হয়। তবে তো ‘মঙ্গল’ পূর্ণতা পেল না। তবে প্রকৃতপক্ষে যিনি যেমন মানুষ তার ঈশ্বরকেও তেমনই রূপ দেন। তাই যিনি মানব সত্যের সাধনায় স্বয়ং পূর্ণসত্তায় উত্তীর্ণ হচ্ছেন একমাত্র তাঁর পক্ষেই জগতের পরম একক সত্তাকে উপলব্ধি করা সম্ভব।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আমরা মঙ্গলময় ঈশ্বরের প্রতি তাঁর বিশ্বাসের কথা জানতে পারি।
১. “সত্যমঙ্গল প্রেমময় তুমি, ধ্রুবজ্যোতি তুমি অন্ধকারে।
তুমি সদা যার হৃদে বিরাজ দুখজ্বালা সেই পাশরে-
সব দুখজ্বালা সেই পাশরে।।“
২. “আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্যসুন্দর।।
…… বহে জীবন রজনীদিন চিরনূতনধারা,
করুনা তব অবিশ্রাম জনমে মরনে।।
স্নেহ প্রেম দয়া ভক্তি কোমল করে প্রাণ,
কত সান্ত্বন কর বর্ষণ সন্তাপহরনে।।“
৩. “চিরবন্ধু, চিরনির্ভর, চিরশান্তি
তুমি হে প্রভু-
তুমি চিরমঙ্গল সখা হে তোমার জগতে,
চিরসঙ্গী চিরজীবনে।।“
আমরা এই কবিতাগুলি থেকে তিনটি সিদ্ধান্তে আসতে পারি-
১. কবি এখানে সত্য ও পূর্ণের পাশেই ‘মঙ্গল’ কে স্থান দিয়েছেন, সুতরাং তাঁর কাছে সত্য, মঙ্গল সমার্থক।
২. ঈশ্বর শুধু মঙ্গলময় নন, তাঁর করুনা শুধু জীবনে নয় মরনের মধ্যে দিয়েও বর্ষিত হচ্ছে। ঈশ্বর ইহজীবনে নানানভাবে হৃদয়ে সান্ত্বনা বহন করে আনছেন এবং প্রতিনিয়ত দুঃখ হরণ করছেন।
৩. ঈশ্বর সর্বময়ই মঙ্গল। তাঁর মধ্যে ‘অমঙ্গলের’ কোন স্থান নেই ।
আমরা জানি পার্থিব যন্ত্রণার চূড়ান্ত ঘটনা হল মৃত্যু। প্রতিটি মানুষের মধ্যে চেতনালাভের প্রথম দিনটি থেকেই মৃত্যু নামের মধ্যে দিয়ে একটা ভয় কাজ করে। নিজের অহং বিনাশের ভয়, প্রিয়জনের সাথে চিরবিচ্ছেদের ভয়। কিন্তু কবি এই মৃত্যুকে ভয় বলে মানতে রাজি নন। তিনি মৃত্যুর মধ্যে দিয়েই অমৃতের কাছে পৌঁছতে চেয়েছেন। তাই তো তিনি বলেছেন-
“ দুঃখের তিমিরে যদি জ্বলে তব মঙ্গল-আলোক
তবে তাই হোক।
মৃত্যু যদি কাছে আনে তোমার অমৃতময় লোক
তবে তাই হোক।।“
‘বৃহহদারন্যক’ উপনিষদে যে শাশ্বত বানী আছে।–
“অসতো মা সদ-গময়
তমসো মা জ্যোতির্গময়
মৃত্যোর্মা অমৃতং গময়।।“
এখানে যেমন মৃত্যু থেকে অমৃতে উত্তরনের কথা বলা হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঔপনিষদিগের ঋষিদেরই সার্থক উত্তরসুরি হিসেবে উপলব্ধি করেছেন। তাই তিনিই বলতে পারেন-
“আমি ভুলবো না সহজেতে, সেই প্রানে মন উঠবে মেতে
মৃত্যু মাঝে ঢাকা আছে যে অন্তহীন প্রাণ।।“
রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুর মধ্যে দিয়েই মঙ্গলকে প্রত্যক্ষ করতে চেয়েছেন। পাশাপাশি ব্যবহারিক জগতের অমঙ্গলকে তিনি সহায়ক রূপে গ্রহন করেছেন। কবির নিজের জীবনও নানান দুঃখ, বেদনায় জর্জরিত ছিল। এতো দুঃখ জ্বালার মধ্যেও তিনি স্থির বিশ্বাসে অবিচল থেকেছেন। ব্যাক্তিগত দুঃখের দিনে, সমাজের অবক্ষয়ের দিনে, অমঙ্গলের জয়ডঙ্কার দিনে কবি ‘সত্যমঙ্গল প্রেমময়’কেই শুধু স্মরণ করেছেন। তিনি বলেছেন-
“হিংসায় উন্মত্তপৃথ্বী, নিত্য নিষ্ঠুর দ্ধন্দ্ব;
ঘোর কুটিল পন্থ ইহার, লোভজটিল বন্ধ ।।……
ক্রন্দনময় নিখিল হৃদয় তাপদহনদীপ্ত
বিষয়বিষবিকারজীর্ণ খিন্ন অপরিতৃপ্ত।
দেশ দেশ পরিল তিলক রক্তকলুষগ্লানি,
তব মঙ্গলশঙ্খ আন, তব দক্ষিনপানি-
তব শুভসঙ্গীতরাগ, তব সুন্দর ছন্দ।
শান্ত হে, মুক্ত হে, হে অনন্তপুণ্য,
করুনাঘন, ধরনীতল কর কলঙ্কশূন্য।।“
“অমৃত’ কে জীবনের সার্থকরূপে ছেনে তোলবার সাধনাই ছিল কবি রবীন্দ্রনাথের কর্মযোগের প্রধান লক্ষ্য। কর্মের ক্ষেত্র দুটি; একটি মানস ক্ষেত্র, অপরটি বাস্তবক্ষেত্র। মানসক্ষেত্রের পরম সত্তার সাথে কবির প্রেমের যোগ আর বাস্তব ক্ষেত্রের পরম সত্তার সাথে তাঁর কল্যাণের যোগ। তাই তো সমাজের কল্যাণের মধ্যে দিয়েই পূর্ণের সুসমঞ্জস্য রূপটি কবি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাই তো তিনি বলেছেন,- “ জগতের মধ্যে সামঞ্জস্য তিনি শান্তম, সমাজের মধ্যে সামঞ্জস্য তিনি শিবম, আত্মার মধ্যে সামঞ্জস্য তিনি অদ্বৈতম।।“
যে মানুষ সমাজের মঙ্গলের জন্য নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেন তিনি যদি পরমেশ্বরকে চান তবে তিনি ব্যাক্তিগত ভাবে তাঁর দিকে অগ্রসর হতে পারেন। এখানে তিনি যেমন ব্যাক্তিসাধনায় পরমের দিকে অগ্রসর হন, তেমনি তাঁর একটি বিশ্বগত সাধনার দিকও থাকে আর সেই সাধনার ক্ষেত্র হল সমাজ। সর্বমানবের মধ্যে আপন আত্মার মিলন না হলে নিখিলাত্মা তাঁর মধ্যে প্রস্ফুটিত পদ্মের মতো বিকশিত হতে পারে না।
বিবেকানন্দও এই কারনেই শুধু নিজের মুক্তি চান নি। সমাজের প্রতিটি মানুষের মন মুক্ত না হলে বন্ধন দশা কাটবে না বলেই স্বামীজি মনে করতেন। কবিও এই ধারাতেই ভেবেছিলেন’-
“যারে তুমি ফেল নীচে সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে
পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে।
অজ্ঞানের অন্ধকারে
আড়ালে ঢাকিছ যারে
তোমার মঙ্গল ঢাকি গড়িছে সে ঘোর ব্যবধান।।“
সুতরাং মানবাত্মার মুক্তি খুঁজতে হবে সাধারন মানুষেরই মধ্যে। এখান থেকে ছাড়পত্র না পেলে ‘নিখিল’-এর শতদলের পাপড়ি বন্ধই থেকে যাবে। তাই কবি সমাজের শ্রমজীবী মানুষের কর্মকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে মুক্তির রাস্তা খুঁজে পেতে চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেছেন।–
‘তিনি গেছেন যেথায় মাটি কেটে
করছে চাষা চাষ-
পাথর ভেঙ্গে কাটছে যেথায় পথ
খাটছে বারোমাস।
রৌদ্র জলে আছেন সবার সাথে,
ধুলা তাহার লেগেছে দুই হাতে;
তারি মতন শুচি বসন ছাড়ি
আয়রে ধুলার ‘পরে।
মুক্তি?
ওরে কোথায় পাবি,মুক্তি কোথায় আছে।
আপনি প্রভু সৃষ্টি বাধন প’রে
বাঁধা সবার কাছে।।“
সমাজ ও মানব কল্যানের জন্য একমাত্র হাতিয়ার হল নিঃস্বার্থ কর্ম। তিনি লিখেছেন।– “আনন্দের ধর্ম যদি কর্ম হয় তবে কর্মের দ্বারাই সেই আনন্দস্বরূপ ব্রহ্মর সঙ্গে আমাদের যোগ হতে পারে। গীতায় একেই বলে কর্মযোগ।“
গীতায় কর্মযোগে বলা হয়েছেঃ
“তস্মাদসক্তঃ সততং কার্যং কর্ম সমাচর।
অসক্তো হ্যাচরন্ কর্ম পরমাপ্নোতি পুরুষ।।“
অর্থাৎ আসক্তি শূন্য হয়ে কর্ম সম্পাদন করলে পুরুষ পরমকে প্রাপ্ত হন। এখানে কবি গীতার কঠিনতা কে অনেকটাই মাধুর্য দিয়ে পূর্ণ করেছেন।‘অনাসক্তি’র প্রকৃত যে তিক্ততা নয় তা যে শুধু ভোগাকাঙ্খা ত্যাগ, সেই কথাটা রবীন্দ্রনাথের আনন্দ মিমাংসার দ্বারা আমরা স্পষ্ট উপলব্ধি করতে পারি। তাঁর কবিতার মধ্যে দিয়েই সেই তত্ত্ব উপলব্ধির সজীবতা প্রকাশিত হয়েছে-
“কর্ম করি যে হাত লয়ে কর্মবাঁধন তারে বাঁধে,
ফলের আশা শিকল হয়ে জড়িয়ে ধরে জটিল ফাঁদে।
তোমার রাখী বাঁধো আঁটি- সকল বাঁধন যাবে কাটি,
কর্ম তখন বীনার মতো বাজবে মধুর মূর্ছনাতে।।“
“আনন্দরূপমমৃতং যদ্বিভাতি’, মানব কল্যান- সমাজ সেবা- কর্মযজ্ঞ- রবীন্দ্রনাথের ‘ব্যাক্তি আমি’তেই সমস্ত উপলব্ধির মূল শিকড় কিন্তু এই মঙ্গলময় ‘পরম আমি’র মধ্যেই নিহিত আছে।
“মানসক্ষেত্রের পরম সত্তার সাথে কবির প্রেমের যোগ আর বাস্তব ক্ষেত্রের পরম সত্তার সাথে তাঁর কল্যাণের যোগ। তাই তো সমাজের কল্যাণের মধ্যে দিয়েই পূর্ণের সুসমঞ্জস্য রূপটি কবি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন।”
কবি বেঁচে থাকুন সহস্র সহস্র বছর। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অনুভবে।
সুন্দর উপস্থাপনা
অনুভবের লেখা