বিরসিংহের সিংহ পুরুষের আজ জন্মদিন!

বিরসিংহের সিংহ পুরুষের আজ জন্মদিন!

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন-
‘তাঁহার মহত্ চরিত্রের যে অক্ষয় বট তিনি বঙ্গভূমিতে রোপণ করিয়া গিয়াছেন তাহার তলদেশ জাতির তীর্থস্থান হইয়াছে।’

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১২ই আশ্বিন ১২২৭ সাল) ১৮২০ খ্রী: ২৬শে সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত বীরসিংহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বংশীয় পদবী ছিল বন্দ্যোপাধ্যায়। বাবা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ঠাকুরদা রামজয় তর্কভূষণ।বিদ্যাসাগরের অজেয় পৌরুষ, মনুষ্যত্ব, স্বকীয়তা, মানবিক ঔদার্য, স্বতন্ত্র চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, অনমনীয় দৃঢ় ব্যক্তিত্ব ও আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে তুলনা করার মতো বাঙালি চরিত্র খুবই কম আছে। বাংলা গদ্য সাহিত্য যার হাতে পেল গতি ও শ্রুতি।

তিনি হলেন ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর। ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর উনিশ শতকে অবিভক্ত বাংলায় শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। তিনি হিন্দু সমাজে বিধবা বিবাহ প্রথা চালু করেন। তার প্রচেষ্টায় ২৬ জুলাই ১৮৫৬ সালে বিধবা বিবাহ আইন পাস হয়। নিজের ছেলের সঙ্গে এক বিধবা কন্যার বিয়ে দিয়েছিলেন। যাতে অন্যান্য হিন্দুরাও উৎসাহ বোধ করে। বিদ্যাসাগরের এ আইনের ফলে বঙ্গ-ভারতের কোটি কোটি বিধবাদের স্বামীর ঘরে আশ্রয় হয়েছিল। ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর কলকাতা মেট্রোপলিটন কলেজের প্রতিষ্ঠাতা। এ কলেজের বর্তমান নাম ‘বিদ্যাসাগর কলেজ’, কর্মজীবনে ঈশ্বর চন্দ্র ছিলেন কলেজশিক্ষক। তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিত ছিলেন। এরপর তিনি সংস্কৃতি কলেজের সহকারী সম্পাদক ও সংস্কৃতের অধ্যাপক হন। কিছু দিন পর তিনি সংস্কৃত কলেজের প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করেন।

সাহিত্যিক হিসেবেও ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের রয়েছে যথেষ্ট অবদান। তিনি সাহিত্যে সৃজনী প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি যখন অধ্যাপক ছিলেন, তখন বাংলায় উন্নত পাঠ্যপুস্তকের অভাব বোধ করেছেন। নিজের সাহিত্য প্রতিভাবলে বাংলা গদ্যের অভাব পূর্ণ করেছেন। তার জন্যই বাংলা গদ্যরীতি আপন পথ খুঁজে পায়। আর এ জন্যই ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরকে বাংলা গদ্যের জনক বলা হয়। তার বিখ্যাত কয়েকটি গ্রন্থ হলো- শকুন্তলা, বোধোদয়, আখ্যান মঞ্জুরী, কথামালা, বেতাল পঞ্চবিংশতি ও সীতার বনবাস। শিশু শিক্ষার মান ও পাঠ সহজ করার জন্য লিখলেন ‘বর্ণ পরিচয়’, সংস্কৃত ভাষা সহজ ও সরলভাবে উপস্থাপনের জন্য লিখলেন ‘ব্যাকরণের উপক্রমনিকা’, ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের এ সব গ্রন্থ দিয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য হয়েছে পরিপূর্ণ।মায়ের প্রতি ছিল বিদ্যাসাগরের অগাধ শ্রদ্ধা। মাকে তিনি দেবীর মতো শ্রদ্ধা করতেন। মায়ের প্রতিটি ইচ্ছা অকাতরে পূরণ করতেন। মায়ের ইচ্ছা পূরণ করতে গিয়ে ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর দামোদর নদী সাঁতার কেটে পার হয়েছিলেন। তাও আবার ছিল ভরা বর্ষায়।

বাংলা সাহিত্যে বিদ্যাসাগরের এই মৌলিক অভিধার জন্যই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে আমার যদি কোন কৃতিত্ব থাকে তবে এর দ্বার উদঘাটন করেছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।’ প্রথমেই বিদ্যাসাগরের চারিত্রিক দৃঢ়তার কথা বলেছিলাম। তার কয়েকটি উদাহরন দিই।

১. সংস্কৃত কলেজ থেকে চাকরি ছাড়ার সময় অনেকেই বলেছিলেন, ‘খাবেন কী করে?’ উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘আলু-পটল বিক্রি করে খাব, কিন্তু যেখানে মর্যাদা নেই, সেখানে থাকব না।’

২. হিন্দু কলেজের অধ্যক্ষ মি. কার সাহেব টেবিলের ওপর জুতাসুদ্ধ পা তুলে পাইপ টানতে টানতে আলাপ করছিলেন। প্রতিদানে বিদ্যাসাগরও অনুরূপভাবে আলাপ করেছিলেন। শিক্ষা পরিষদের সেক্রেটারি এই আচরণের কৈফিয়ত্ চাইলে বিদ্যাসাগর উত্তরে বলেছিলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম এদেশীয় নেটিভ অসভ্য, ভদ্রতা ও ভব্যতা জানি না। কার সাহেবের সঙ্গে সেদিন দেখা করতে গিয়ে তার কাছেই আমি এই আচরণ শিখেছি। একজন সুসভ্য ইউরোপীয়ের আচরণ এমন অশোভনীয় হতে পারে, আমার ধারণা ছিল না। আমি ভাবলাম এই বোধ হয় আপনাদের অভ্যর্থনার রীতি। তাই আমি এদেশি রীতিতে তাকে অভ্যর্থনা না করে, তার কাছে শেখা অনুযায়ী সেদিন তাকে অভ্যর্থনা করেছি। যদি কোনো অন্যায় হয়ে থাকে, এর জন্য আমি দোষী নই।’

৩. ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর খদ্দরের চাদর পরতেন। শীত বা গ্রীষ্ম যাই হোক না কেন গায়ে শুধু চাদর আর কাঠের খড়ম পরেই সংস্কৃত কলেজে ক্লাস নিতে যেতেন। মাঘ মাসের শীতের সময় প্রতিদিন সকালে এভাবে ঈশ্বর চন্দ্রকে ক্লাস নিতে যেতে দেখে প্রায়ই হিন্দু কলেজের এক ইংরেজ সাহেব যাওয়ার পথে বিদ্যাসাগরকে ক্ষ্যাপানোর জন্য বলতেন, “কি হে,বিদ্যার সাগর, বিদ্যার ভারে বুঝি ঠান্ডা লাগে না তোমার?” বিদ্যাসাগর প্রতিদিন কথা শুনতেন, কিন্তু কিছু বলতেন না। একদিন শীতের সকালে ঠিক একইভাবে তিনি ক্লাস নিতে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে আবার সেই ইংরেজের সাথে দেখা। আবার সেই একই প্রশ্ন। এবার সঙ্গে সঙ্গে ঈশ্বর চন্দ্র তার ট্যামর থেকে একটা কয়েন বের করে বললেন, “এই যে গুজে রেখেছি, পয়সার গরমে আর ঠান্ডা লাগেনা। এবার হলো তো?

সমসাময়িক অন্যরা ছিলেন পোশাকে আধুনিক আর বিদ্যাসাগর ছিলেন মননে ও চিন্তা-চেতনায় আধুনিক। দেবতা হওয়া সহজ। কিন্তু মানুষ হওয়া যে কঠিন, এর প্রমাণ বিদ্যাসাগর। কারন ত্যাগ, সাধনা ও সততা দিয়ে মানুষ হতে হয় বিদ্যাসাগর আমাদের বুঝিয়েছেন। বিদ্যাগাসর তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তা পেয়েছিলেন বাবা ও মায়ের কাছে। এ জন্যই বিদ্যাসাগর বলেছেনঃ- ‘যদি আমার দয়া থাকে তা পেয়েছি মা’র কাছে আর যদি বুদ্ধি থাকে তবে তা পেয়েছি বাবার কাছে।’ রামমোহন রায় মূর্তি পুজো করতেন না বলে তার মা আদালতে পুত্রের ছিন্ন মস্তক চেয়েছিলেন। আর

বিদ্যাসাগরের মা তাকে বলতেনঃ
‘যে দেবতা আমি নিজ হতে গড়িলাম, সে আমাকে উদ্ধার করবে কি করে? বাঁশ, খড় ও মাটি দিয়ে গড়া মূর্তিতে কী প্রকৃত দেবতা হয়! জীবন্ত মানুষই তো প্রকৃত দেবতা।’
তাঁর বাবা বললেন—
‘বাবা, ধরিবার পূর্বে বাবা ভাবা উচিত। ধরেছ তো ছেড়ো না, প্রাণ পর্যন্ত স্বীকার করিও।’

বিদ্যাসাগরের প্রকৃত মূল্যায়ন করেছেন মধূসূদন-
The man to whom I have appeal has the generosity and the wisdom of an ancient sage, the energy of one Englishman and the heart of a Bengali Mother.

14 thoughts on “বিরসিংহের সিংহ পুরুষের আজ জন্মদিন!

  1. বিরসিংহের সিংহ পুরুষের জন্মদিনে আমাদের শব্দনীড় পরিবারের বিনম্র শ্রদ্ধা। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

  2. বিরসিংহের সিংহ পুরুষকে জানাই শুভ জন্মদিন! https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gifমনে করিয়ে দেওয়ার জন্য দিদি আপনাকে অভিনন্দন। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

  3. যুগে যুগে এমন এক একজন আসে যারা সব কিছু পরিবর্তণ করে দিতে পারেন।

  4. রেঁনেসাপুরুষ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রতি রইলো শ্রদ্ধা । এতো পরিশ্রম করে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে নিয়ে  সুন্দর প্রবন্ধ লিখলে সেজন্য আর একবার তোমাকে ধন্যবাদ । ভালো থেকো আপু । 

    1. অসংখ্য ধন্যবাদ দিদি ভাই। খুশি হলাম আপনার কাছে প্রায়োরিটি পেয়েছে।

  5. যার লেখা পুস্তক দিয়ে বাংালির বর্ন পরিচয় আরম্ভ হয় তাকে নিয়ে কিছু বলার সাধ্য কি আরআমার আছে দিদি?

    কিছু অজানা তথ্য জানিয়েছেন। শুভকামনা।

  6. ‘তাঁহার মহত্ চরিত্রের যে অক্ষয় বট তিনি বঙ্গভূমিতে রোপণ করিয়া গিয়াছেন তাহার তলদেশ জাতির তীর্থস্থান হইয়াছে।’

     

    * জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধা…

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।