আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ সুকুমার রায়, জন্মদিনে শ্রদ্ধা।
হাঁস ছিল, সজারু, (ব্যাকরণ মানি না),
হয়ে গেলে “হাঁসজারু” কেমনে তা জানি না।
বক কহে কচ্ছপে “বাহবা কি ফুর্তি!
অতি খাসা আমাদের বকচ্ছপ মূর্তি।”
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ শিশুসাহিত্যিক ও ভারতীয় সাহিত্যে “ননসেন্স্ রাইমের” প্রবর্তক। তিনি একাধারে ছিলেন লেখক, ছড়াকার, রম্যরচনাকার ও নাট্যকার। ৩০শে অক্টোবর ১৮৮৭ সালে কলকাতার এক ব্রাহ্ম পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। জনপ্রিয় শিশুসাহিত্যিক, বিজ্ঞান লেখক, চিত্রশিল্পী, সুরকার ও শৌখিন জ্যোতির্বিদ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরি ও ব্রাহ্ম সমাজের দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের মেয়ে বিধুমুখী দেবীর দ্বিতীয় সন্তান অর্থাৎ সুকুমার রায় জন্মেছিলেন বাঙালি নবজাগরনের স্বর্ণযুগে। সুবিনয় রায় ও সুবিমল রায় ছিলেন তাঁর দুই ভাই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন উপেন্দ্রকিশোরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, এছাড়াও পারিবারিক বন্ধু ছিলেন জগদীশ চন্দ্র বসু, আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়। ছোটদের জন্য অনেক মজার ছড়া লিখে গেছেন। যেগুলো আজও সমান ভাবে বড়দের মধ্যেও জনপ্রিয়।
“মাথায় কত প্রশ্ন আসে, দিচ্ছে না কেউ জবাব তার-
সবাই বলে, “মিথ্যে বাজে বকিসনে আর খবরদার!”
অমন ধারা ধমক দিলে কেমন করে শিখব সব?
বলবে সবাই “মুখ্য ছেলে”, বলবে আমায় “গো গর্দভ!”
কেউ কি জানে দিনের বেলায় কোথায় পালায় ঘুমের ঘোর?
বর্ষা হলেই ব্যাঙের গলায় কোত্থেকে হয় এমন জোর?
গাধার কেন শিং থাকে না, হাতির কেন পালক নেই?”
এমন আজগুবি অথচ সার্থক রচনা ছিলো সুকুমার রায়ের।‘আবোলতাবোল’ গ্রন্থের ভূমিকায় নিজেই লিখেছিলেন, ‘যাহা আজগুবি, যাহা উদ্ভট, যাহা অসম্ভব, তাহাদের লইয়াই এই পুস্তকের কারবার। ইহা খেয়াল রসের বই, সুতরাং সে রস যাঁহারা উপভোগ করিতে পারেন না, এ পুস্তক তাঁহাদের জন্য নহে।’
১৮৯৫ সালে মাত্র আট বছর বয়সে সুকুমারের প্রথম কবিতা ‘নদী’ প্রকাশিত হয় ‘মুকুল’ পত্রিকায়। এরপর ন’বছর বয়সে ‘টিক্ টিক্ টং’ লেখেন ইংরাজি শিশুপাঠ ‘Hickory,Dickory,Dock’-এর অনুবাদ হিসাবে। ১৯০৪ সালের নভেম্বর মাসে মাত্র ১৭ বছর বয়সে ‘বয়েজ ওন পেপার’-এর দ্বারা শ্রেষ্ঠ আলোকচিত্রী হিসাবে পুরস্কৃত হন তিনি। এরপর ১৯০৬ সালে রসায়ন ও পদার্থবিদ্যায় বি.এস.সি (অনার্স) পাশ করেন কলকাতার প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে এবং তারপরেই প্রতিষ্ঠা করেন ‘ননসেন্স ক্লাব’ ১৯০৭-এ। এর মুখপাত্র ছিল ‘সাড়ে বত্রিশ ভাজা’ নামের একটি পত্রিকা। এই সময় থেকেই তাঁর আবোল-তাবোল ছড়ার আত্মপ্রকাশ।
“হেড অফিসের বড়বাবু লোকটি বড় শান্ত,
তার যে এমন মাথার ব্যামো কেউ কখনো জানত ?
দিব্যি ছিলেন খোসমেজাজে চেয়ারখানি চেপে,
একলা বসে ঝিম্ঝিমিয়ে হঠাৎ গেলেন ক্ষেপে !
আঁৎকে উঠে হাত পা ছুঁড়ে চোখটি ক’রে গোল,
হঠাৎ বলেন, “গেলুম গেলুম, আমায় ধরে তোল !”
তাই শুনে কেউ বদ্যি ডাকে, কেউবা হাঁকে পুলিশ,
কেউবা বলে, “কামড়ে দেবে সাবধানেতে তুলিস।”
আমাদের বয়স বাড়ার সাথে সাথে চিন্তার ধরণও পাল্টে যায়। বড় এবং ছোটদের চিন্তা এক হওয়া কখনও সম্ভব নয়। বড়দের ভাবনা জটিল হলেও ছোটদের ভাবনা সহজ-সরল। ছোটদের জগত ভিন্ন, আলাদা। শিশু ও কিশোর মনের সাথে তালমিলিয়ে যে সাহিত্য রচিত হয় মূলত তা-ই শিশু সাহিত্য। সপ্তম শতকে ল্যাটিন ভাষায় আদি শিশু সাহিত্য রচিত হয়। ঊনবিংশ শতকে জার্মান রূপকথা, এডওয়ার্ড লিয়ারের book of nonsense, লুইস ক্যারলের alice in wonderland প্রভৃতি শিশু সাহিত্যে এক অনন্য সংযোজন। ১৯১১ সালে সুকুমার রায় ‘গুরুপ্রসন্ন ঘোষ স্কলারশিপ’ নিয়ে আলোকচিত্র ও মুদ্রণপ্রযুক্তির ওপর উচ্চতর শিক্ষার জন্য ইংল্যান্ডে যান এবং কালক্রমে ভারতের অগ্রগামী আলোকচিত্রী ও লিথোগ্রাফার হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেন। হাফটোন মুদ্রণ প্রযুক্তির ওপর ১৯১২ সালে তিনি ‘Halftone Facts Summarized’ রচনা করেন যা Penrose Annual-এ প্রকাশিত হয়। এই সময়ে তিনি ইংল্যান্ডের ‘Royal Photographic Society’-র সদস্য নিযুক্ত হন। এরপর ১৯১৩ সালে তাঁর রচিত ‘Standardizing the Original’, ‘Penrose Annual’ – এ প্রকাশিত হয় এবং ‘Pin-hole theory’–র ওপর একটি রচনা ১৯১৩-এর জুলাই মাসে ‘The British Journal of Photography’ – তে প্রকাশিত হয়।
সুকুমারের ইংল্যান্ডে থাকাকালীন সময়েই পিতা উপেন্দ্রকিশোর উন্নতমানের রঙিন হাফটোন ব্লক তৈরি ও মুদ্রণক্ষম একটি ছাপাখানা স্থাপন করেন এবং ছোটদের মাসিক পত্রিকা ‘সন্দেশ’-এর প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত করেন ১৯১৩ সালে। এই বছরের ২৯শে সেপ্টেম্বর সুকুমার স্বদেশে ফিরে আসেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কালীমোহন ঘোষের সাথে। দেশে ফিরেই সুকুমার যোগ দেন ব্রাহ্মসমাজের সংস্কারপন্থী গোষ্ঠীর সাথে এবং ১৯১৪ সালে ‘সাধারন ব্রাহ্মসমাজের’ যুগ্ম সচিব পদে নিযুক্ত হন।পরবর্তীতে উপেন্দ্রকিশোর মারা যাওয়ার পর সুকুমার রায় ‘সন্দেশ’ পত্রিকার কাজ নিজের হাতে তুলে নেন।
“যে আনন্দ ফুলের বাসে, যে আনন্দ পাখির গানে,
যে আনন্দ অরুণ আলোয়, যে আনন্দ শিশুর প্রাণে,
যে আনন্দে বাতাস বহে, যে আনন্দ সাগর জলে,
যে আনন্দ ধূলির কণায়, যে আনন্দ তৃণের দলে,
যে আনন্দে আকাশ ভরা, যে আনন্দ তারায় তারায়,
যে আনন্দ সকল সুখে, যে আনন্দ রক্ত ধারায়,
সে আনন্দ মধুর হয়ে তোমার প্রাণে পড়ুক ঝরি,
সে আনন্দ আলোর মত থাকুক তব জীবন ভরি।”
১৯১৯ সালের ১৩ই ডিসেম্বর কালীনারায়ণ গুপ্তর নাতনি শ্রীমতি সুপ্রভা দাসের সাথে বিবাহ হয় এবং দুই বৎসর পরে ১৯২১ সালের ২য় মে সত্যজিতের জন্ম হয়। ১৯২২ সালে তিনি দ্বিতীয় ভারতীয় হিসাবে ‘Royal Photographic Society’-র সহকর্মী নিযুক্ত হন। এই সময় থেকেই সুকুমার রায় কালাজ্বরে (লেইশ্নানিয়াসিস) আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং এক বছর পরে ১৯২৩ সালের ১০ম সেপ্টেম্বর মাত্র সাঁইত্রিশ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।তাঁর উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি হল ‘আবোল তাবোল’,’পাগলা দাশু’,’হেশোরাম হুশিয়ারের ডায়েরি’,’হ য ব র ল’ তাঁর উল্লেখযোগ্য কাবগ্রন্থ।
“মেঘ মুলুকে ঝাপসা রাতে,
রামধনুকের আব্ছায়াতে,
তাল বেতালে খেয়াল সুরে,
তান ধরেছি কণ্ঠ পুরে।
হেথায় নিষেধ নাইরে দাদা,
নাইরে বাঁধন নাইরে বাধা।
হেথায় রঙিন আকাশতলে
স্বপ্ন দোলা হাওয়ায় দোলে
সুরের নেশার ঝরনা ছোটে,
আকাশ কুসুম আপনি ফোটে
রঙিয়ে আকাশ, রঙিয়ে মন
চমক জাগে ক্ষণে ক্ষণ।
আজকে দাদা যাবার আগে
বল্ব যা মোর চিত্তে লাগে
নাই বা তাহার অর্থ হোক্
নাই বা বুঝুক বেবাক্ লোক
আপনাকে আজ আপন হাতে
ভাসিয়ে দিলাম খেয়াল স্রোতে।”
______________________
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ সুকুমার রায়, জন্মদিনে আমাদের শ্রদ্ধা।
শুভ জন্মদিন সুকুমার রায়। ধন্যবাদ প্রিয় বন্ধু।
ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে গেলো । ছেলেবেলা গেলো আর সুকুমার পড়েনি বাংলা ভাষায় এমন কেউ সম্ভবত নেই।
মার্জিত সমৃদ্ধ ভাষায় সুকুমার রায়কে তুলে ধরলে – খুব ভালো লাগলো ।
ভালো থেকো –
হাহাহা দিদি ভাই। আসলেই তাই।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
অনেক তথ্যবহুল লেখা; মন দিয়ে পড়লাম।
খুব ভালো লেগেছে!
ধন্যবাদ মিড দা।
এরকম একজন সাহিত্যিকের জন্মদিনে আপনার পোস্টখানা সত্যি প্রশংসার দাবি রাখে। তবে সম্মানিত সুকুমার রায়ের যেকোনো একটা বই পড়ার ইচ্ছে ছিল। তা আর হয়ে ওঠেনি ।
ধন্যবাদ নিতাই দা। আপনার আশা পূরণ হতে পারে —
সুকুমার রায় এর কিছু লেখা এখানে পড়ে দেখতে পারেন।
https://mkhokon.blogspot.com/2017/03/sukumar-ray.html
লিংক দেওয়ার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ শ্রদ্ধেয় রিয়া দিদি। আমি বুকমার্ক করে রেখেছি। সময় সময় পড়ে নিতে পারব।
বাহ ! বেশ চমৎকার লেখা।
ছন্দের জাদুকর'কে জন্মদিনে শুভেচ্ছা।
আপনাকেও ধন্যবাদ কবি দিদিভাই,এটা তুলে ধরার জন্য
আপনাকেও ধন্যবাদ কবি জাহিদ দা।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ সুকুমার রায়, জন্মদিনে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা
এবং লেখকের জন্য শুভকামনা…
ধন্যবাদ প্রিয় কবি দা।
ধন্যবা! বাংলা সাহিত্যে সুকুমার রায় অনন্তকাল ধরেই বেচে থাকবেন। খোকা খুকি এবং মা এরা যে সুকুমার রায় ছাড়া ঘুমাতেই পারবেনা!