চিঠি : মেঘ পাহাড়ের রূপকথা ১

প্রিয় মেঘ,
জানতে চাইবো না কেমন আছিস, জানি ভালো থাকবি, ভালো থাকার জন্যই তো পাহাড়ের থেকে দূরে চলে গেলি। জানি আমাকে মনেও পড়বে না তোর। মনে পড়ার কথাও নয়। খেলাধুলার সময় গুলো কি মনে রাখে? রাখে না। কতো মনে রাখা যায়! মনে আছে একটা কবিতা শুনিয়েছিলাম একদিন, অনেক কবিতা ছিলো শুধু তোর জন্য লেখা। তারমধ্যে একটা এইরকম ছিলো, দেখতো চিনতে পারিস কিনা –

‘কিছুদিন পরে জানি আর মনে থাকবে না আমাকে …
এই বিকেলের আলো, এই গোধূলি বেলা, গভীর রাতের কথা, গানের সুর। কিছুই মনে থাকবে না। এই রাত, তারাদের সাথে চলা পথ, চাঁদের আলো, ভালোলাগা সবই ক্ষণস্থায়ী। একা থেকে যাবো আমি, এই হাসি, খেলা, ভোরের শিশির, বাষ্প হয়ে মেঘ হয়ে যাবে। আমার রঙহীন স্বপ্ন গুলো নিয়ে থেকে যাবো।’

কবিতাটার আরও কিছু অংশ আছে, সেগুলো আর দিলাম না। এই কবিতা শুনে তুই কি ভীষণ রেগে গিয়েছিলি! মনে আছে?

এতো সুন্দর অভিনয় তুই কোথা থেকে শিখেছিলি মেঘ? একজন ভেঙে যাওয়া পাহাড়কে আরও ভাঙতে তোর কি বুক কেঁপে ওঠেনি? আমাকে এইভাবে টুকরো টুকরো করে তুই সত্যিই কি সুখের প্রাসাদ গড়তে পারবি? হয়তো পারবি, একটা পাহাড়ের ভেঙে যাওয়ায় মেঘে কি যায় আসে! জানিস মেঘ আমার কাছে আজ, বন্ধু, ভালোবাসা শব্দ অর্থহীন, ভীষণ ভয়ের, ভীষণ ক্লিশে। আমার বন্ধুত্বের হাত কেন ধরেছিলি মেঘ? কেন বলেছিলি ‘ভালোবাসি’? এতো মিথ্যে খেলা তুই কেন খেলেছিলি মেঘ? শুধুই কি সময় কাটানোর জন্য? আর আমি দেখ কি বোকা, ভাবলাম এই নিঃসঙ্গ পাহাড়কে সত্যিই বুঝি তুই ভালোবাসিস!

জানিস মেঘ, আমার প্রতিদিনের ভেসে বেড়াবার জায়গা গুলো, ওই যে রে যেখানে আমরা হাত ধরে মাঝেমধ্যে যেতাম, সেই স্ট্যাচুর পাশে কতো খেলা, আজ যখন সেইসব জায়গা যখন চোখের সামনে আসে, চোখ বন্ধ করে নিই। জানিস তো, শত শত ঝরনা পাহাড়ের বুক চিরে নেমে আসে, সেগুলো আসলে পাহাড়ের কান্না। জানিস, সেদিন যখন সেই বড় মাঠটার আমার চোখের সামনে এসে গিয়েছিল, সেই মাঠ যেখানে একদিন রাতে মেঘ আর পাহাড় ছোঁয়াছুঁয়ি খেলেছিল, চিনতে পেরেই চোখ বন্ধ করে নিয়েছি। আমি চাই না আবার একটা ঝরনার সৃষ্টি হোক।

তোকে সত্যি বন্ধু ভেবেছিলাম মেঘ, উজাড় করে সবটুকু দিয়ে ভালোবেসেছিলাম। এতোটুকু অভিনয় ছিলো না, এতোটুকু ছলনা ছিলো না। বিশ্বাস ছিলো অনেক বেশি। নিজের থেকেও বেশি তোর প্রতি বিশ্বাস ছিলো। আমি জানতাম একদিন প্রবল ঝড় উঠবে। বেসামাল হয়ে পড়বি তুই। কিন্তু মেঘ, তবুও অগাধ বিশ্বাস ছিলো হাতটুকু তুই ধরে থাকবি। পারলি না মেঘ!

যেদিন ভয়ংকর ঝড় উঠলো, তুই চলে গেলি, আর বন্ধ করে দিয়ে গেলি আমার শ্বাস প্রশ্বাসের সব জায়গা। সব দরজাগুলো বন্ধ করে, দম বন্ধ অবস্থায় রেখে গেলি আমাকে। তোর একবারও মনে হয় নি পাহাড় বাঁচবে কিভাবে? সত্যিই কি তুই আমার বন্ধু ছিলি? বন্ধু তো এইভাবে হাত ছেড়ে বন্ধুকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয় না মেঘ। বন্ধু হলে বলতিস অপেক্ষায় থাকিস পাহাড় আমি ঝড় শান্ত হলে আবার তোর কাছে ফিরবো। আবার আমরা একসাথে গান গাইবো, বৃষ্টির রাতে কবিতা শোনাবো, আবার আমরা খেলবো, ঘুরবো।

জানিস মেঘ, আমি এখন আর বৃষ্টি ভিজি না। অথচ তুই জানতিস বৃষ্টিতে ভিজতে আমি কতো ভালোবাসি। তোকে বলেছিলাম, আমরা একসাথে বৃষ্টি ভিজবো। বৃষ্টি হলে সেইসব কথা মনে পড়ে যায়। আমার আর ভেজা হয় না। তুই তো পালিয়ে গেলি মেঘ! চোরের মতো পালিয়ে গেলি। ভাবলি তোকে আমি আর ধরতে পারবো না? কিন্তু আমি হাত বাড়ালেই তোকে ছুঁতে পারতাম মেঘ। কিন্তু আমি তা চাই নি। আমার অহংকার, আমার আত্মসম্মান আমার পথ আটকে দাঁড়িয়েছে।

জানিস, তোকে নিয়ে যে ‘প্রেমের কবিতা’ আমি লিখেছিলাম! সেইসব পাতা একটা একটা করে ছিঁড়ে আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছি। আমার ভালোবাসার চিতা সাজিয়েছি। সেইসব কবিতার বুকফাটা কান্না আমি শুনেছি মেঘ। তোর আর আমার সেই গাছ তলায় বসা যে ছবি এঁকেছিলাম! সেই ক্যানভাসও পুড়িয়ে দিয়েছি। আর একটু একটু করে টুকরো করেছি নিজেকে। কি অপরাধ ছিলো আমার মেঘ? নিঃস্বার্থভাবে, নিঃশর্তভাবে ভালোবাসলে বুঝি এইভাবে অপমান করতে হয়? তোকে আমি বলেছিলাম মেঘ, পাহাড়কে ভালোবাসা যায় না। আমার জন্য ভালোবাসা নয়। কপট রাগ দেখিয়ে তুই বলেছিলি যায়। আমার সব ছিলো মেঘ, ভালোবাসা ছাড়া, আর এটাই তোর কাছে চাওয়া ছিলো। বলেছিলাম ভালোবাসাটুকু দিস, আমার আর কিছুই চাই না। এটুকুই পারলি না মেঘ? খুব বেশি কি চাওয়া ছিলো?

এখন জানি মেঘ ভেসে বেড়ানোই তোর কাজ। এপাড়া, ওপাড়া, এবাড়ি, ওবাড়ি। আমি আরও অহংকারী হয়েছি মেঘ। কেন জানিস, আমার ভালোবাসাই ছিলো আমার অহংকার। যেখানে কোনো অভিনয় ছিলো না, কোনো মিথ্যাচার ছিলো না। তোকে ভালোবাসার থেকেও অনেক বেশি বিশ্বাস করেছিলাম। আর এটাই আমার গর্ব যে আমি তো বিশ্বাস করেছিলাম। তুই সেই বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে পারিস নি, এটা তোর শিক্ষা। তাই আমি পালিয়ে বেড়াই না মেঘ। আজও আমি মাথা উঁচু করে অহংকারের সাথে ওই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি। যেখানে তোর থেকে আলাদা করে আমাকে রেখে গেছিস। তোর গাওয়া গানগুলো আমার কাছে আছে। তোর কথারা আমার কাছে আছে। শুনি তাদের মাঝেমধ্যে। ইচ্ছে হলে। আর এই নিঃসঙ্গ পাহাড়ের বুক চিরে বয়ে যায় নতুন নতুন ঝর্ণা।

আমার ভালোবাসার চিতার ওপরে তোর সুখের প্রাসাদ নিয়ে ভালো থাকিস তুই। তবে সারা জীবনের জন্য আমাকে বুঝিয়ে দিয়ে গেছিস – সত্যিই ভালোবাসা বলে কিছু হয় না। সবকিছুই মিথ্যে, অভিনয় মাত্র। বন্ধুত্বের হাত গুটিয়ে নিয়েছি মেঘ। এ হাত আর কারো দিকে এগোবে না। আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারবে না এই পাহাড়।

তোকে একটা কথা বলতাম মনে আছে? রক্ত কথা বলে। আজ তোর রক্ত তুই চিনিয়ে দিয়ে গেলি। হয়তো তোর পরিবারের শিক্ষা যে এইভাবে বন্ধুকে অপমান করেই চলে যেতে হয়। বন্ধুত্বের কোনো মর্যাদা দেওয়া হয়তো তোর রক্তে নেই। আমি আমার রক্ত নিয়েও অহংকারী। শেষ দিনেও আমি তোকে কোনো কথা না বলেই হাতের মুঠি আলগা করে চলে যেতে দিয়েছি। আর এখানেও আমি অহংকারী।

পাহাড়, মেঘ কখনোই বন্ধু হতে পারে না। আমি জানতাম একদিন আমাদের বন্ধুত্ব শেষ হতোই। কিন্তু এভাবে চাই নি। কিন্তু যদি সত্যিই বন্ধু হতিস কোনোভাবেই আমাকে ভেঙে যেতে দিতিস না। যদি সত্যি বন্ধুত্ব থাকতো তাহলে তা কোনো ঝড়েই পালিয়ে যেতিস না। চিরস্থায়ী হতো আমাদের বন্ধুত্ব।

আমার কোনো ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস নেই। তুই তোর ঈশ্বরকে বল কোনোদিন যেন এই শুকনো, খটখটে পাহাড়কে মেঘের মুখোমুখি হতে না হয়। পাহাড়ের আর ভাঙার ক্ষমতা নেই। সেই পাহাড় আর বেঁচে নেই।

ইতি
একলা পাহাড়।

_________
রিয়া চক্রবর্তী।

22 thoughts on “চিঠি : মেঘ পাহাড়ের রূপকথা ১

  1. অসাধারণ একটি চিঠি এবং ভীষণ মর্মদায়ক এই বাস্তবতা কবি রিয়া চক্রবর্তী।

    1. ধন্যবাদ প্রিয় বন্ধু। বাস্তব একটি জীবনের কাহিনী তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। 

  2. ভীষণ এনার্জি নিয়ে লিখেছেন কবি রিয়া। অসাধারণ এমন লিখায় বলার কিছু থাকে না। অনুভব করা ছাড়া। মগ্ন হলাম। 

  3. লিখাটি পড়ে বিষ্মিত হলাম রিয়া আপু। এতো প্রাণকাড়া হয় কিভাবে !!!

    1. প্রশংসার জন্য ধন্যবাদ প্রিয় কবি দিদি ভাই। 

  4. যে গম্ভীর এক পরিবেশের ছবি ভেসে উঠেলো চোখে, আমি  মুগ্ধ হলাম। তবে এই ক্লাইমেক্স সহসা তো থামবার নয়। আরও পর্ব থাকতে পারে। অনুগ্রহ করে কন্টিনিউ করুন। প্লিজ।

  5. বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লাম আপু। এমনও কি সত্য হয় !! নিয়মিত চিঠি চাই। 

  6.  একা থেকে যাবো আমি, এই হাসি, খেলা, ভোরের শিশির, বাষ্প হয়ে মেঘ হয়ে যাবে। আমার রঙহীন স্বপ্ন গুলো নিয়ে থেকে যাবো।’

     

    * রচনার শৈল্পিকমান যেন আকাশ ছুঁয়েছে….https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    ভালো থাকুন কবি দি। 

  7. "আমি আমার রক্ত নিয়েও অহংকারী। শেষ দিনেও আমি তোকে কোনো কথা না বলেই হাতের মুঠি আলগা করে চলে যেতে দিয়েছি। "

     

    দারুণ লিখেছো দিদিভাই 

  8. ভালো লিখেছেন প্রিয়কবি বোন আমার। সুন্দর প্রয়াস 
    বিষয়বস্তু
    সুন্দর পাঠ করে মুগ্ধ হলাম

    প্রীতি, শুভেচ্ছা আর অভিনন্দন জানাই
    সাথে থাকুন, পাশে রাখুন।
    জয়গুরু!

  9. অসাধারণ লেখা রিয়া আপা। ঝোঁক, টান, প্রেম সবই সাহিত্যের দিকে। শ্রদ্ধা, লাল সালাম। বাঙলার কবিরাও গর্জে উঠুক। kisshttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_Yes.gif.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_heart.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।