প্রিয় বাবা, বাবা দিবস ও আগে পিছের বলা না-বলা কথা!

প্রিয় বাবা, বাবা দিবস ও আগে পিছের বলা না-বলা কথা!

ওয়ালমার্ট সুপার সেন্টারে চাকরী করার সুবাদে আমেরিকার জনগণ, সমাজ, সংস্কৃতি, ভাষা, রাজনীতি থেকে শুরু করে খুঁটিনাটি বিভিন্ন বিষয়ে অল্প-বিস্তর ধারণা হয়েছে। বিশেষ করে ফোন সার্ভিস ডিপার্টমেন্টে প্রতিদিন কত বর্ণের, কত জাতের গ্রাহক আসে, কাজের ফাঁকে ফাঁকে গল্প করার ছলে তাদের কাছ থেকে জীবনের গল্প শোনার সুযোগ হয়, কত অজানাকে জানা হয়।

ওয়ালমার্টে গত বারো বছরের উপর চাকরী করছি, বারো মাসের মধ্যে এগারো মাসই ওয়ালমার্টে উৎসবের আমেজ থাকে। বছরে কতগুলো যে দিবস পালন করা হয়, একেক দিবসের একেক বার্তা, একেক দিবসে একেক উৎসব, আমেরিকার জনগণ উৎসবপ্রিয়, আড্ডাপ্রিয়, জীবনপ্রিয়।

এরা জীবনকে খুব বেশী ভালোবাসে, ধুঁকে ধুঁকে অনেক লম্বা সময় বেঁচে থাকার চেয়েও হাসতে হাসতে-নাচতে নাচতে দশ বছর কম বাঁচাতেই ওদের সুখ। আনন্দ করতে যে কোন একটা উপলক্ষ হলেই হলো, শুরু হয়ে গেলো পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব মিলে আনন্দোৎসব। এই সকল আনন্দোৎসবে খাওয়া-দাওয়ার পাশাপাশি অনেক বেশী গুরুত্ব দেয়া হয় উপহার দেয়া-নেয়ার প্রতি। উপহার আদান-প্রদানের স্বতস্ফূর্ত রীতিকে বাণিজ্যিক রূপ দিতে কর্পোরেট অফিসের কর্তাব্যক্তিগণ মুখিয়ে থাকেন, ফলে ঘরোয়া এবং পারিবারিক ও সামাজিক উৎসবগুলো রূপ পায় বাণিজ্যিক উৎসবে।

এজন্যই আমেরিকায় এত ‘দিবসের’ ছড়াছড়ি। মা-বাবার জন্যও দিবস উৎসব উদযাপিত হয়। অবশ্য বিনা কারণে কোন উৎসবই পালিত হয়না, প্রতিটি উৎসব আয়োজনের পেছনে গল্প আছে। মা দিবস, বাবা দিবস উদযাপনের পেছনেও গল্প আছে।

মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার পালিত হয় মাদার’স ডে, জুন মাসের তৃতীয় রবিবার পালিত হয় ফাদার’স ডে। আমেরিকাতেও মায়েদের কদর বেশী, কারণ আমেরিকাতে সকলেরই যে বাবার ঠিকানা জানা থাকে তা নয়, কিন্তু মায়ের ঠিকানা সকলের জানা। এজন্যই মহা ধুমধামে পালিত হয় মাদার’স ডে, মাদার’স ডে উৎসব ঘিরে সকলের মাঝে কি যে এক স্বর্গীয় আনন্দ, আহ্লাদীপনা, আদিখ্যেতা শুরু হয়, তা চোখে না দেখলে বুঝা যাবেনা। সুপার মার্কেট, শপিং সেন্টারগুলো দেড় মাস আগে থেকে ‘মা’ময় হয়ে উঠে, আমেরিকার সর্বত্র যেন ‘মা’ বিরাজ করে। বাবা দিবসও উদযাপিত হয় ভালোভাবেই তবে মা দিবসের মত হৈ হৈ ভাব থাকেনা।

বাবা’ দিবস পালিত হয় প্রায় খুবই সাদামাটাভাবে। সুপার সেন্টারগুলোতে উপহার সামগ্রীর উপচে পড়া ভাব থাকেনা। সহজবোধ্য কারণটি হচ্ছে, পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে ‘মা’ হওয়া যত সহজ, ‘বাবা’ হওয়া ততই কঠিন।

পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে সন্তান জন্ম দেয়া যত সহজ, সেই সন্তানের পিতা হওয়া ততই কঠিন। ষোলো সতের বছরের ছেলে আনন্দ এবং খেলাচ্ছলে কোন নারীর গর্ভে সন্তান জন্ম দেয়ার ক্ষমতা অর্জন করতেই পারে কিন্তু কিশোর বয়সে পিতা বা বাবা হওয়ার মানসিক যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনা। এক মুহূর্তের আনন্দের ফলে একটি জ্যান্ত মানবশিশু সৃষ্টির ঘটনায় বেশীর ভাগ জন্মদাতা হয়তো কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে, নাহলে ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়, তারা কখনও নিজ সন্তানের কন্ঠে ‘বাবা’ ডাক শুনতে পায়না। এজন্যই ‘মা’ দিবস আর ‘বাবা’ দিবসের আয়োজনে বৈষম্য দেখা যায়।

মা দিবস নিয়ে যতই হই হই রৈ রৈ থাকুক, আমার ভাল লাগে সত্যিকারের ‘বাবা’দের দেখতে। ‘মা’ তো মা, মায়ের কোন বিকল্প নেই। সত্যিকারের ‘বাবা’দেরও বিকল্প থাকেনা।

গত বছর এক মহিলা এসেছিলেন ফোন সার্ভিস চুক্তি নবায়ন করতে, তার হাতে ধরা ছিল খুব সুন্দর একখানা কার্ড, কার্ডের কভারে লেখা আছে, ‘তুমি পৃথিবী শ্রেষ্ঠ বাবা’। ভদ্রমহিলা একটি কলেজে অধ্যাপনা করেন। উনাকেই জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা, মাদার’স ডে নিয়ে চারদিকে এত হই হই, রই রই কান্ড হয়, ফাদারস’ডে নিয়ে কেন কিছুই হয়না?”

ভদ্রমহিলা হেসে ফেললেন, এরপর ধীরে ধীরে বললেন, “কারণ একজন মা’কে যে সকল প্রতিবন্ধকতার ভেতর দিয়ে জীবন পার করতে হয়, বাবাদের তো তার কিঞ্চিৎও পোহাতে হয়না, এইজন্যই বাবাদের নিয়ে তেমন উচ্ছ্বাস হয়না”।
বললাম, “ কিন্তু তুমি তো ঠিকই উচ্ছ্বসিত, তুমি তো ভাবছো, তোমার বাবা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা”।

মাঝবয়সী মহিলাটি হেসে বললেন, “আমার বাবা পৃথিবী শ্রেষ্ঠ বাবা, আমার মা মারা গেছেন আমাকে অনেক ছোট রেখে, সেই থেকে আমার বাবাটি আমাদের সবাইকে বাবার আদর, মায়ের আদর দিইয়ে মানুষ করেছেন, কয়টা বাবা এমন করে”?

বললাম, “আমেরিকায় খুব বেশী বাবা এমন মহান কাজ করেনা, তবে আমাদের দেশে বাবারা এর চেয়েও অনেক বেশী কষ্ট করে ছেলেমেয়ে মানুষ করে। আমাদের দেশের বাবারা হচ্ছে জগতশ্রেষ্ঠ বাবা”।

হয়তো তোমার কথা ঠিক” বলে হাসতে হাসতে ভদ্রমহিলা বিদায় নিলেন।

ভদ্রমহিলাকে বিদায় করার পর মানসপটে ভেসে উঠলো না-দেখা এক নারীর মুখ, সোনোরা স্মার্ট ডড। ছয়টি নাবালক সন্তানকে ছোট রেখে সোনোরার মা পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। সোনোরার বিপত্নীক পিতা সিভিল ওয়্যার ভেটেরান উইলিয়াম স্মার্ট স্ত্রী বিয়োগের পর দ্বিতীয় বিবাহ করেননি, মা-হারা ছয়টি সন্তানকে মায়ের স্নেহে বড় করেছেন। বড় হয়ে সোনোরার মনে হতো, তার বাবা যে অসাধ্য সাধন করেছেন, তার স্বীকৃতি পাওয়া উচিত, শুধু মা্ নয়, সংসারে বাবাদের ভূমিকাও অনেক তাৎপর্য্যময়, অনেক গুরুত্বপূর্ণ! কিন্তু বাবাদেরকে সেই স্বীকৃতি দেয়া হয়না।

১৯০৭ সালের ডিসেম্বার মাসে ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া রাজ্যের মননগাহতে এক কয়লাখনি বিস্ফোরণে ৩৬২ জন শ্রমিক প্রাণ হারায়, যাদের প্রায় সকলেই সংসারের প্রধান ছিল, সন্তানের পিতা ছিল। ঐ দূর্ঘটনায় এক হাজারের উপর শিশু পিতৃহারা হয়। ১৯০৮ সালের ৫ই জুলাই, ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া্র একটি চার্চ-এর পক্ষ থেকে ‘কয়লাখনি বিস্ফোরণে নিহত ৩৬২ জনের’ স্মরণে একটি স্মরণসভার আয়োজন করা হয়েছিল। নিহতদের ঊদ্দেশ্যে স্মরণসভা হলেও ওটা ছিল মুলতঃ নিহত ‘বাবা’দের ঊদ্দেশ্যে আয়োজন, এবং শুধুই বাবাদের ঊদ্দেশ্যে ওটাই ছিল আমেরিকায় প্রথম সম্মাননা অনুষ্ঠান।
সেদিনের ঐ ছোট্ট অনুষ্ঠানের পথ অনুসরণ করে পরের বছর, ওয়াশিংটন রাজ্যের স্পোকেন শহরের অধিবাসী, সোনোরা স্মার্ট ডড, ‘মাদার’স ডে’র অনুকরণে ‘ফাদার’স ডে’ উদযাপণের জন্য উৎসাহিত হন এবং প্রচার শুরু করেন।

আনা জার্ভিস যিনি ‘মাদার’স ডে’র প্রবক্তা, ছিলেন সোনোরার আদর্শ। আনা জার্ভিসের দেখানো পথ অনুসরণ করে, ওয়াশিংটন রাজ্য সরকারের কাছে ‘ফাদার’স ডে’ উদযাপনের দাবীও সর্বপ্রথম সোনোরাই তুলেছিলেন। দাবীর সপক্ষে প্রচারণা চালাতে সোনোরা ওয়াই ডাব্লিউ সি এ, বিভিন্ন চার্চ, সরকারী অফিস, শপিং মল, সর্বত্র ঘুরেছেন, সকলের দ্বারস্থ হয়েছেন। একসময় সোনোরা সফলকাম হন।

১৯১০ সালের তৃতীয় রবিবার, ১৯শে জুন স্পোকেন ‘ওয়াই ডাব্লিউ সি এ’ তে প্রথম ‘ফাদার’স ডে’ উদযাপন করেন, পরে ওয়াশিংটন রাজ্য সরকার জুনের তৃতীয় রবিবার ‘ফাদার’স ডে’ হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন, ধীরে ধীরে বিভিন্ন রাজ্যের অধিবাসীদের মনেও ফাদার’স ডে উদযাপনের আগ্রহ জন্মাতে শুরু করে এবং এভাবেই জনপ্রিয়তাও বাড়ে। শেষ পর্যন্ত ‘ফাদার’স ডে’ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায় ১৯৭২ সালে, তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ‘ফাদার’স ডে’ রাষ্ট্রীয় ছুটি হিসেবে বিল পাশ করেন। সেই থেকে আজও জুন মাসের তৃতীয় রবিবার আমেরিকাসহ পৃথিবীর প্রায় সকল দেশে ‘ফাদার’স ডে’ উদযাপিত হয়ে থাকে।

আমি বাংলাদেশের মেয়ে, বাংলাদেশের জল-হাওয়া, সমাজ, সংস্কৃতিতে জন্ম নেয়া এবং বেড়ে উঠা আমার কাছে জীবনের প্রতিটি দিন বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে। আমাদের এই উপ মহাদেশে বাবা দিবস অথবা মা দিবস নামে আলাদা কিছু ছিলনা। আমরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করি, বছরের প্রতিটি দিনই বাবা এবং মা’ কে ঘিরে আমাদের সুখ-দুঃখ, স্বপ্ন-কল্পনা, ভালো-মন্দ, হাসি-কান্না জড়িয়ে আছে। আলাদা করে বছরের নির্দিষ্ট একটি দিনে বাবা বা মা’কে নিয়ে সমস্ত কর্মকাণ্ড, হাসি উল্লাসের কথা আমাদের ভাবনাতে ছিলনা।

আমেরিকা আসার পূর্বে বাবা দিবস, মা দিবস সম্পর্কে স্বচ্ছ কোন ধারণা ছিলনা। যদিও অস্ট্রেলিয়াতে থাকার সময় মা দিবস উদযাপনের কথা প্রথম জেনেছি, বলাই বাহুল্য, উপলক্ষটি আমার কাছে মোটেও ভালো লাগেনি। প্রথম প্রতিক্রিয়াতে মনে হয়েছিল, বছরের তিনশত পঁইয়ষট্টি দিনই বাবা-মাকে ঘিরে আবর্তিত হয় যেখানে, সেখানে আলাদা করে মা-বাবা দিবস পালনের যৌক্তিকতা কোথায়।

অনেক আগে ঢাকার রাস্তায়, বিভিন্ন হোর্ডিংয়ে বাংলাদেশ বিমানের একটি শ্লোগান শোভা পেতো, ‘ছোট হয়ে আসছে পৃথিবী’, শ্লোগানটি আমার খুব পছন্দের ছিল। পৃথিবী ছোট হয়ে আসা মানে তো সত্যি সত্যিই আয়তনে ছোট হয়ে আসা নয়, এক দেশ থেকে আরেক দেশ, এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে যাতায়াত অনেক সহজ হয়ে এসেছে, সেই সহজ কাজটি আরও সহজ করে দিয়েছে বাংলাদেশ বিমানের এয়ারক্র্যাফটগুলো। চোখের নিমিষে আমাদেরকে পৌঁছে দিচ্ছে ঢাকা থেকে ইউরোপ, আমেরিকা। ইউরোপ, আমেরিকাতে পৌঁছানো যত সহজ হয়েছে, আমেরিকা, ইউরোপের সমাজ, সংস্কৃতি, জনগণের কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ তত বেশী বেড়েছে।

কুড়ি বছর পূর্বে মাদার’স ডে উদযাপন করাকে অনেক কৃত্রিম মনে হতো, জীবন সহজ হওয়ার ফলে এখন মাদার’স ডে, ফাদার’স ডে উদযাপন করাকে কৃত্রিম মনে হয়না, মনে হয় ভীষণ নান্দনিক এক উৎসব। আমার মা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মা, আমার বাবা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা দাবীগুলো যদি মনে মনে উচ্চারণ করতে পারি, দাবীগুলোকে সকলের সামনে নিয়ে যেতে সমস্যা কোথায়।

আমি জানি, আমার বাবা আমার জন্য জীবনে কতখানি ত্যাগ স্বীকার করেছেন, সে জানে তার বাবা তার জন্য কতখানি আত্মত্যাগ করেছেন, বাবাদের এইসব আত্মত্যাগের ফলেই আজ আমরা আলোর সিঁড়ি খুঁজে পেয়েছি। কোন স্বার্থ হাসিলের জন্য নয়, শুধুমাত্র সন্তানের মঙ্গল কামনায় যে সকল বাবা-মা নিরন্তর ত্যাগ স্বীকার করে চলেছেন, সন্তান কি পারেনা বছরের একটি দিনকে বর্ণাঢ্য সাজে সাজিয়ে বাবা-মায়ের চরণে সঁপে দিতে!

উৎসবে আদিখ্যেতা থাকতে পারে, আহ্লাদীপনা থাকতে পারে, তা তো থাকবেই, বাবা-মায়ের সাথেই তো সন্তানের যত আহ্লাদীপনা, যত আদিখ্যেতা! বছরের একটা মাত্র দিনে আমাদের তো ইচ্ছে হতেই পারে, বাবার প্রিয় একটি খাবার রান্না করতে, মায়ের পছন্দের একটি ভর্তা বানিয়ে মা’কে খাওয়াতে, এমন হাজার হাজার দিন বাবা-মা পার করেছেন আমাদের জন্য, বাবা-মায়ের ঋণ তো শোধ করার প্রশ্ন উঠেনা, কিন্তু বাবা-মায়ের প্রতি আমাদের নিরন্তর ভালোবাসার একটি টুকরো খসিয়ে তাঁদের হাতে তুলে দেয়া যায়, সন্তানের ভালোবাসা হাতে নিয়ে জীবন ক্লান্ত বাবা-মা একটুক্ষণের জন্য স্বর্গসুখ পেলে, সমাজের ক্ষতি তো হচ্ছেনা।

পৃথিবী কত ছোট হয়ে এসেছে, আমরা সকলেই কত কাছাকাছি চলে এসেছি। সবচেয়ে জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুকে প্রায়ই দেখা যায়, বাবাগুলো কি পরম মমতায় সন্তানের কৃতিত্বের সংবাদ সকলের সাথে শেয়ার করছে, দাঁত ফোকলা পুত্রের হাসি দেয়া অনিন্দ্য সুন্দর ছবি আমাদের সাথে শেয়ার করছে, কেউবা তার কন্যার ছবি পোস্ট করে ক্যাপশানে লিখছে, “আমার মা”! আহা, কন্যার মাঝে মা’কে খুঁজে ফিরে। কেউ বা তার বৃদ্ধ পিতা-মাতার সাথে তোলা ছবি পরম আনন্দে সকলের সাথে শেয়ার করছে, কেউ বা অতি দুঃখের সাগরে ভেসে গিয়ে বাবার মৃত্যু সংবাদ শেয়ার করছে, মায়ের স্মৃতি রোমন্থন করছে, এভাবেই আমরা সকলে বাবা-মা-সন্তানের মমতার শেকলে বাঁধা পড়ে যাচ্ছি।

আমার এক বন্ধু কিছু দিন পর পর আদরের কন্যার সাথে নানা ভঙ্গিমায় তোলা ছবিগুলো যখন ফেসবুকে পোস্ট করে, আমার চোখে জল আসে। আমার বাবা বৃদ্ধ হয়েছেন, যদি আমার বাবার বয়স পনেরো বছর কম হতো তাহলে উনিও নিশ্চয়ই আধুনিক প্রযুক্তির সুবিধা গ্রহণ করে ফেসবুক করতেন, পুত্র-কন্যার সাথে নানা ভঙ্গিমায় ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করতেন। হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদ সাহেবকে নিয়ে কতজনে কত রকম মন্তব্য করে, কিন্তু একজন মমতাময় ‘বাবা’ এরশাদকে যখন টিভিতে দেখেছিলাম পুত্র এরিকের সাথে, অন্যরকম এক ভালোলাগায় চোখে জল এসেছিল।

আজ বাবা দিবস, বিশ্ব বাবা দিবস, ফাদার’স ডে’ উপলক্ষে পশ্চিমা দেশগুলোতে একমাস আগে থাকতেই সাজ সাজ রব উঠে। কত রকমের উপহার সামগ্রী দিয়ে বিপণী বিতানগুলো সাজানো থাকে। টি শার্টের গায়ে ‘লাভ ইউ ড্যাড’, ‘মাই ড্যাড ইজ মাই হিরো’ কথামালা লেখা থাকে।

বিলিয়ন ডলারের উপহার সামগ্রী ক্রয় বিক্রয় হয়। উপহার দেয়া ছাড়াও এই দিনটিতে ‘বাবা’কে নিয়ে বেড়াতে যাওয়া, মুভী দেখা, ফিশিং করতে যাওয়া, রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাওয়াসহ আরও কত কিছুর আয়োজন থাকে। পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে নিজ বাবা ছাড়াও স্টেপ ড্যাড, ফস্টার ড্যাড, গডফাদার সকলকেই সম্মান জানানো হয়। মাদার’স ডে বা ফাদার’স ডে উপলক্ষে আমেরিকানদের উচ্ছাস, আনন্দ, আবেগের মধ্যে কোন অভিনয় থাকেনা। ওদের উৎসব আয়োজনে থাকে আন্তরিকতার ছোঁয়া। দেখে মন ভরে যায়। প্রবাসীদের মনকেও তা ছুঁইয়ে যায়।

আমরা যারা প্রবাসে থাকি, তারাও আবেগাক্রান্ত হই, ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে দেশে ফোন করি, পরম মমতাভরা কন্ঠে বাবাকে বলি, ” হ্যাপী ফাদার’স ডে বাবা’। ফোনের অপরপ্রান্তে ‘ফাদার’স ডে’ কালচারে অনভ্যস্ত বাবাটিও আহ্লাদে গদগদ হয়ে উঠেন। কোন উপহারের প্রয়োজন পড়েনা, সন্তানের গলার আওয়াজটি পেয়েই বাবা খুশী হয়ে উঠেন, চাপা গর্বে পাড়ার দোকানে হঠাৎ দেখা প্রতিবেশীকে ডেকে হয়ত বলেন, ” আজকে মেয়ে ফোন করেছিল, ফাদার’স ডে জানালো”। এইই হচ্ছে বাবা। বাবা তো এমনই হয়!

কিশোরীবেলায় শোনা হেমন্ত মুখার্জী ও শ্রাবন্তী মজুমদারের দ্বৈতকন্ঠে গাওয়া গান, ” মনে হয় বাবা যেনো বলছে আমায়, আয় খুকু আয়” এখনও আমাকে কাঁদায়। আমার সত্যি সত্যি মনে হয় আমার বাবা পেছন থেকে ডেকেই চলেছেন, আমার যে কোন প্রয়োজনে বাবা যেনো আমাকে এখনও সাহস দিচ্ছেন, ভরসা দিচ্ছেন। মা’কে নিয়ে কত কাব্য রচিত হয়েছে, কত গীত রচিত হয়েছে বহুকাল আগে থেকে। কিন্তু বাবাকে নিয়ে তেমন করে কাব্যগাঁথা রচিত হয়নি। তাই বলে ‘বাবা’রা কি থেমে আছেন!

গতকাল আমাদের কাউন্টারে এক সুদর্শন ভদ্রলোক এসেছেন একখানা ফোন কিনতে, হাতে ধরে আছেন এক কিশোরীর হাত। কিশোরীও অনিন্দ্য সুন্দর, কী নির্মল, পবিত্র মুখখানি। সে কী টানা টানা চোখ, ঠোঁটে লেগে থাকা মুচকী হাসি দেখে মুগ্ধ আমি স্বগতোক্তি করে ফেললাম, “ বাহ! কী সুন্দর মেয়ে”।
কিশোরীর হাত ধরে থাকা ভদ্রলোক খুব গর্বের কন্ঠে বললেন, “ আমি জানি, আমার মামণি বিশ্বসেরা সুন্দরী”।

কিশোরী আরো বেশী করে জড়িয়ে ধরলো তার বাবা’র হাত। অপূর্ব ছবি, আমার মানসপটে মুদ্রিত হয়ে গেলো। বাবা নামের জীবন নৌকার মাঝিটি কিনতু ঠিক কালকের বাবাটির মত করেই শক্ত হাতে সন্তানের জীবন নৌকার হালটি ধরেই আছেন।

সন্তানের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, সম্মান, আদর পেয়ে যে বাবাগুলো আজ পৃথিবীর বুকে ‘বাবাময়’ মানচিত্র আঁকতে সক্ষম হয়েছেন, সেই সকল বাবাকে জানাই, অভিনন্দন, শুভেচ্ছা, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, সম্মান। সবশেষে ‘বাবাময় দিবস সুখের হোক”! এবং আজকের দিনটি হোক শুধুই ‘বাবাময়’!

8 thoughts on “প্রিয় বাবা, বাবা দিবস ও আগে পিছের বলা না-বলা কথা!

  1. সন্তানের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, সম্মান, আদর পেয়ে যে বাবাগুলো আজ পৃথিবীর বুকে ‘বাবাময়’ মানচিত্র আঁকতে সক্ষম হয়েছেন, সেই সকল বাবাকে জানাই,
    অভিনন্দন, শুভেচ্ছা, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, সম্মান। সবশেষে ‘বাবাময় দিবস সুখের হোক”! এবং আজকের দিনটি হোক শুধুই ‘বাবাময়’! ❤ ❤ ❤

    বেশ কিছুকাল আগেও শব্দনীড় এ আপনার লিখার দেখা পাওয়া যেত। তারপর বেশ লম্বা বিরতি। আজ আবার আমাদের মাঝে আপনাকে এবং আপনার লিখাকে ফিরে পেয়ে যারপর আনন্দিত আমি। শব্দনীড় এ আপনাকে স্বাগতম দিদি। ❤

    1. আমার নিজের আনন্দে আপনার আনন্দে আমিও খুশি আজাদ ভাই।

  2. বাবা বা মাকে নিয়ে যখন কোন লেখা পড়ি তখন আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ি। পৃথিবীর এই বুকে আমাদের আগমনের তারা গর্বিত ব্যক্তি।সেই ছোট্ট সময় থেকে আদর, সোহাগ আর ভালবাসা দিয়ে গড়ে উঠান একজন সন্তানকে। যেখানে গৃহে মা ও বাহিরে বাবা হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম আর একরাশ স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকেন ভবিষ্যৎ স্বপ্ন ছুঁতে। সেই বাবা, মা যখন পৃথিবী থেকে স্রষ্টার কাছে চলে যান পরবর্তী সময়টা থাকে সন্তানের জন্য হাহাকার, পিতৃবিয়োগ বা মাতৃবিয়োগ।

    মা-বাবা সবসময়ই শ্রেষ্ঠ যেমনটি আপনার লেখায়ও প্রমাণিত- মা দিবস নিয়ে যতই হই হই রৈ রৈ থাকুক, আমার ভাল লাগে সত্যিকারেরবাবাদের দেখতেমাতো মা, মায়ের কোন বিকল্প নেই সত্যিকারেরবাবাদেরও বিকল্প থাকেনা

    শুভেচ্ছা রইলো আপনার জন্যhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gif

    1. সুন্দর মন্তব্যের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ সাইদুর ভাই। :)

  3. বহুকাল পর যেন আপনার লেখা পড়লাম দিদি ভাই। শব্দনীড়ে নতুন করে আবার দেখা হয়ে গেলো। স্বাগতম জানিয়ে গেলাম। বলে যাই নিয়মিত যেন পাই। হুম। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

    1. মাথা পেতে নিলাম রিয়া বোন। আসবো মাঝে মাঝে।

  4. খুভ ভালো লাগলো দিদি অনেক দিন পর আপনার লেখা পেয়ে।

    আমি মুসলিম হিসেবে শুনেছি, আমাদের নবীর (সাঃ) কাছে এক সাহাবী এসে জিজ্ঞেস করলেন, " আল্লাহ আর তার রাসূলের পর কাকে সবচেয়ে বেশি সম্মান করবো?" আমাদের রসূল উত্তর দিলেন, "মা"। অতঃপর উক্ত সাহাবী জানতে চাইলেন, তারপর কাকে? উত্তর এলো, "মা"। এভাবে তিনবার পর্যন্ত উত্তর এলো, "মা"। তিনবার একই উত্তর পেয়ে উক্ত সাহাবী জানতে চাইলেন, তারপর কাকে? চতুর্থবার উত্তর এলো, "বাবা"।

    বাবা দিবস নিয়ে আপনার লেখা পড়তে পড়তে কেনো যেনো আমার এই ঘটনার কথা মনে পড়ে গেলো। মনে হয় আপনার লেখার সাথে উক্ত ঘটনার বেশ মিল খুঁজে পেলাম।

    আমি অ্যামেরিকার একটি বিখ্যাত এপারেল কোম্পানী "ভি এফ কর্পোরেশনে" ( নর্থ ক্যারোলিনা – হেড অফিস) দীর্ঘ ৭ বছর জব করেছি। ভি এফ এর ব্রান্ডের নাম শুনলে হয়তো চিনে থাকবেন। যেমন, র‍্যাঙ্গলার, লী, নটিকা, নর্থফেস, টি এন এফ ইত্যাদি।

    ওয়ালমার্টেরও এপারেল ষ্টোর রয়েছে বিভিন্ন দেশে।

    বিশেষ ধন্যবাদ! অনেক শুভেচ্ছা ও শুভকামনা আপনার জন্য।https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

     

    1. খুব ভালো উদ্ধৃতি উদ্ধৃত করেছেন ইলহাম ভাই। বাব্বাহ আপনি তো দারুণ নামকরা কোম্পানীতে জব করেছেন। ব্র্যাণ্ডনেম গুলোন আমার ভীষণ পরিচিত। মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ আপনাকে।

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।