ফোনালাপে বঙ্গবন্ধু, স্কাইপালাপে তেঁতুল হুজুর!
আমার বাবার বর্তমান বয়স ৯০ বছর। আজ থেকে পাঁচ বছর আগের কথা। ২০১৩ সালের ১৩ই জুলাই বাবার সাথে ফোনে কথা শেষ করার পর একটি লেখা ফেসবুকে পোস্ট করেছিলাম। তখন বাংলাদেশে চলছে শাহবাগ আন্দোলন, শফি হুজুরের উত্থান। আমার মেজো কন্যা সেবার ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’ এর সাথে সামার প্রোগ্রামে কাজ করার জন্য বাংলাদেশে গিয়েছিল। তখনই মিশা তার ল্যাপটপে বাবার সাথে আমার স্কাইপে সংযোগ ঘটিয়ে দেয়।
বাবার সাথে কথা বললেই আমার মন ভাল হয়ে যেত তখন। মন ভাল থাকলেই ফেসবুকে কিছু না কিছু লিখতে মন চায়। সেদিনও লিখেছিলাম।
আমার বাবার বর্তমান বয়স ৮৬ বছর। গত বছর আমার মা হঠাৎ করেই যেন মারা গেলেন। ঈশ্বরের কৃপায় বাবা এতকাল বেশ ভালোভাবেই, রীতিমত দাপটের সাথে কাটিয়েছেন, ইদানিং বাবার স্বাভাবিক হুংকারময় জীবনে ভাটা পড়েছে, বিপত্তিটা ঘটেছে গত বছর আমাদের মায়ের মৃত্যুর পর। ঝগড়ার সঙ্গী হারিয়ে যেতেই বাবা চুপ হয়ে গেছেন।
মা বেঁচে থাকতে দুই বুড়োবুড়িতে ঝগড়া লেগেই থাকতো, ঝগড়ার বিষয় ছিল টিভিতে প্রচারিত নাটক, সিনেমার কাহিনী, পাত্র পাত্রীদের চালচলন, অভিনয় সম্পর্কিত। দুজনের কেউই কারো সাথে একমত হতে পারতোনা। একটি ব্যাপারে উনাদের মতের মিল ছিল, সে হলো রাজনীতি। আমার মা ৭৫ বছর বয়সী হলেও রাজনৈতিক জ্ঞান ছিল স্বচ্ছ, ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলন নিয়ে মায়ের দূর্বলতা ছিল, আর বাবা তো আগাগোড়াই রাজনীতি সচেতন, বঙ্গবন্ধু ছিল উনার ধ্যান-জ্ঞান, বঙ্গবন্ধুর মেয়ে শেখ হাসিনার রাজনীতিতে নানা ভুল ভ্রান্তি থাকা সত্বেও আমার বাবা তা স্বীকার করতে রাজী নন।
আমি মাঝে মাঝে বাবাকে বলি,
“বাবা, আওয়ামী লীগ এখনও টিকে আছে তোমার মত কিছু অন্ধভক্তের অন্ধভক্তির কারণে। এর প্রয়োজন আছে, কেউ মানুক আর না মানুক, আমি তোমার এই অন্ধ আবেগকে মানি”।
আমার মুখে এমন কথা শুনে বাবা বেশ প্রীত হন। আমার মেজ ভাই যদি শেখ হাসিনার দুই একটি ভুল ধরিয়ে দিতে যায়, বাবা একেবারে তেড়ে মেরে যায়। আমার কাছে হয়তো অভিযোগ করে,
“তোর এই মেজ ভাইটা মানুষ না, পুরা গোয়ার গোবিন্দ, ও বুঝতেই চায় না, একটু একগুঁয়ে হলেও শেখ হাসিনার মধ্যে বাপের তেজ আর সাহস কিছুটা হইলেও আছে, শেখ হাসিনার মত এইরকম তেজী নেত্রীই দরকার”।
আমি বুঝিয়ে বলি, “বাবা, শেখ হাসিনা সাহসী ঠিকই আছে, কিন্তু মাঝে মাঝে বেশী ঠ্যাটামী করে, এইটা কিন্তু ভালো না, মেজদার উপর রাগ করো কেন, ভুল করলে ভুল স্বীকার করা উচিত, শেখ হাসিনা তো মানুষ, ভুল তো করতেই পারে, ভুল স্বীকার করলেই হয়ে যায়”।
বাবা জানে, আমি বঙ্গবন্ধুর ভক্ত, শেখ হাসিনার ভক্ত, তাই আমি যদি শেখ হাসিনার সমালোচনা করি, বাবা মেনে নেয়, কিন্তু আর কারো কথা মানেনা।
যাই হোক, মায়ের মৃত্যুর পর বাবা নীরব হয়ে গেছে। সপ্তাহে একদিন হয়তো আমি ফোন করি, ফোন ধরে বলে, “আমার মনটা ভালো লাগেনা, খাওয়া দাওয়া করতেও ভালো লাগেনা। সময় পার করি, এখনতো আমার বেঁচে থাকার কোন ঊদ্দেশ্য নাই, তোরা বলিস, তোদের জন্য নাকি বেঁচে থাকতে হবে, তাইলে তোরাই বরং ঈশ্বরের কাছে প্রার্থণা করিস, আমাকে বাঁচিয়ে রাখতে, আমি প্রার্থণা করে আয়ু চাইনা।”
এমন কথার কি জবাব দেবো, জানিনা। বলি, “বাবা, তুমি বেঁচে থাকলে তো কারো কোন ক্ষতি হচ্ছেনা, কারো বাড়া ভাতে ছাই পড়ছেনা, বরং তোমার ছেলেমেয়েদের মনে শক্তি থাকে, তারা নিজেদেরকে এতিম ভাবেনা, “আমি এতিম নই’ এই ভাবনাটুকুই অনেক বড় শক্তি।”
আমার মেজো মেয়ে আবার দুই দিনের জন্য দাদুর বাড়ী গেছে। গতকাল মিশা তার ল্যাপটপে স্কাইপ অন করে বাবাকে দিয়েছে, আমার সাথে কথা বলার জন্য। বাবা এখন স্কাইপ বুঝে, মিশা বাড়ীতে আসার সাথে সাথে বাবার চেহারা বদলে গেছে। গলার স্বরও বেশ জোরদার হয়েছে। ল্যাপটপ হাতে নিয়ে বলে,
“মিঠু, তোরে সামনাসামনি তো এত সুন্দর লাগেনা, এইখানে তো অনেক সুন্দর লাগতেছে”।
আমি তো হেসে বাঁচিনা, বলি, “বাবা, আমার রক্তস্বল্পতা আছে, এইজন্য মুখ সাদা দেখা যাচ্ছে।’
বাবা বলে, “তোরে অনেক ছোট দেখা যায়, বাচ্চা মেয়েদের মতো”।
মিশা হাসতে হাসতে দাদুর উপর গড়িয়ে পড়ে, বলে, “দাদু, তোমার মেয়ে ঘরেও সেজেগুজে থাকে, একেবারে ম্যাডাম জিয়ার মত, এইজন্যই ল্যাপটপে সুন্দর দেখা যাচ্ছে”।
আমি বলি, “বাবা, আসল কথা শোন, বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে আমি চিন্তিত, খাওয়া দাওয়া নেই, ঘুম নেই, ওজন কমে যাচ্ছে তো, তাই ছোট দেখা যাচ্ছে। এখন ত্তুমি বলো, তুমি কি মাল্টিভিটামিন খাচ্ছ? তোমার যে খাওয়ায় রুচী নেই, সেটার কি হবে? একটু ব্যায়াম করো, ব্যায়ামে ক্ষিদে বাড়ে।”
বাবার জবাব, “ব্যায়াম করি, ৮৬ বছর বয়সে আর কত জোয়ান থাকবো?”
-বাবা, তুমি কি বলো? আল্লামা শফি হুজুরের বয়স কতো? ৯৪ বছর, শফি হুজুর ৯৪ বছর বয়সে হেলিকপ্টার চড়ে ঢাকা চট্টগ্রাম যাওয়া আসা করে, হেলিকপ্টার ছাড়া চলেননা বলে উনার নাম ‘হেলিকপ্টার হুজুর! আর তুমি ৮৬ বছরের খোঁটা দিতেছ”।
-শফি হুজুরের কথা বলে লাভ নাই রে মা, শফি হুজুর তো জোয়ান পুরুষ, এখনও চাইর বিয়া করার স্বপ্ন দেখে, শফি হুজুর একটাই হয়, দুইটা হয়না।
মিশা আর আমি হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ি। মিশা দাদুর সাথে খুব মাই ডিয়ার সম্পর্ক বজায় রাখে। আমেরিকায় বেড়ে উঠলেও মিশা বাংলাদেশের রাজনীতি, গান ,সিনেমা নাটকের খোঁজ খবর রাখে। দেশপ্রেম যদি বংশ পরম্পরায় রক্তে প্রবাহিত হয়, তাহলে বলবো, মিশার রক্তে মায়ের বাড়ির দিকের দেশপ্রেমের ব্যাপারটা কিছু হলেও আছে।
বাবার কথার উত্তরে মিশা বলে উঠে, “দাদু, শফি হুজুর বলেছে, মাইয়ালোক হইলো পাকা তেঁতুল, দেখলেই নাকি জিভে জল আসে। শফি হুজুরের আরেক নাম কিন্তু ‘তেঁতুল হুজুর।”
নাতনীর কথা শুনে বাবাও হেসে দেয়, বলে, এইটাই ত চিন্তার বিষয়, তোরে তো আর বাংলাদেশে আসতে বলতে পারবোনা, শফি হুজুররা যদি ক্ষমতায় আসে, তাইলে তো সব মাইয়াদের ঘরের ভিতরে থাকতে হইবো। এখন তুই যেইভাবে সারা দেশ চইষা বেড়াইতেছস, তখন আর পারবিনা। কাপড় দিয়া নাক মুখ ঢাইকা থাকতে হইবো, নাইলে তো আবার তেঁতুল দেইখা শফি হুজুরের জিভে জল আসবে। তার চেয়ে তুমি আমেরিকাতেই থাইকো, তেঁতুল হুজুরের দেশে আসার দরকার নাই”।
মিশা বলে, জ্বী না দাদু, আমার হাতে থাকবে ‘আমেরিকান পাসপোর্ট, আমি হচ্ছি আমেরিকান তেঁতুল, শফি দাদু চালাক আছে, কোনটা বাংলাদেশী তেঁতুল, কোনটা আমেরিকান তেঁতুল, ঠিকই বুঝে। আমেরিকান তেঁতুলের দিকে তাকাইলেই ‘চুপ’ মাইরা যাইব। কাজেই চিন্তা করোনা, আমি আবারও আসবো।”
আমার তখন কাজে বেরোবার সময় হয়ে গেছিল, তেঁতুল সংলাপ আর এগোলো না। কথা অসম্পূর্ণ রেখেই কাজে চলে যেতে হলো”
_______________
—১৩ই জুলাই, ২০১৩
অসাধারণ আপনার লিখনী শক্তি। অনায়শে যেন লিখে ফেলতে পারেন অনেক কিছু। পাঠক কখনও দুখী অথবা কখনও হেসে উঠেন মনে মনে। চমৎকার বন্ধু।
ধন্যবাদ আজাদ ভাই।
বাহ্। খুবই মনোগ্রাহী লেখা। অভিনন্দন।
আদাব দিদি। ধন্যবাদ আপনাকে।
শুভেচ্ছা দিদি ভাই। আপনার লেখায় আনন্দ বেদনা'র বুদ্ধিদীপ্ত যে সম্মিলন লক্ষ্যনীয় সত্যসত্যি এমনটা খুব কম দ্যাখা যায়। সব মিলিয়ে আপনি রীতা রায় মিঠু।
কৃতজ্ঞতা রিয়া বোন।
* সুন্দর উপস্থাপনা…
শুভরাত্রি।
ধন্যবাদ ভাই।