সাহিত্যে সাধু-চলিত ও আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার:
অধুনালুপ্ত সংস্কৃতভাষার সন্তানই হচ্ছে বাংলাভাষা। সংস্কৃতশব্দকে বাদ দিলে বাংলাভাষা আর থাকে না। সাধারণত ক্রিয়াপদের ওপর ভিত্তি করেই বাংলাভাষাকে আমরা সাধু ও চলিতরূপেই চিহ্নিত করি।
আমাদের সমৃদ্ধ বাংলাভাষা মূলত তিনপ্রকার, যথা:
১. সাধুভাষা:
আমি তোমাদের বাংলাশিক্ষাদান করিব। এটি সাধুভাষার একটি উদাহরণ। ‘শিক্ষাদান’ আর ‘করিব’ হচ্ছে সাধুশব্দ। ‘করিব’ ক্রিয়াকে চলিতরূপে ‘করবো’ করা গেলেও শিক্ষাদানকে কি সম্পূর্ণ চলিতকরণ করা সম্ভব? ‘শিক্ষাদান করিব’কে বড়জোড়া ‘শিক্ষা দেবো’ করাই যায়। তাই সাধুশব্দ বলে পরিচিত ‘শিক্ষা’শব্দকে চলিতশব্দে রূপান্তরিত করা সম্ভব নয়। সাধুভাষা হচ্ছে বাংলার মাথা। তাই বাংলাভাষায় সাধুশব্দের সংখ্যাধিক্যই বেশি। সাধুশব্দ ব্যতীত আমরা অস্তিত্বহীন। অথচ অনেকেই পদ্যে সাধুভাষাকে ব্যবহার করতে চায় না। কিন্তু তাকি সম্ভব? সাধুভাষামুক্ত পদ্যরচনা আদৌ সম্ভব নয়। তারা যে বিষয়টি গুলিয়ে ফেলে, তাই বলবো আজ।
সাধুভাষার হাজারো শব্দ যেমন গদ্যে ব্যবহৃত হয় তেমনই পদ্যেও। গদ্য-পদ্যে আবার আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহারও আমরা করি। তবে পদ্যে এখন সাধুশব্দের ক্রিয়ারূপ একেবারেই অচল ও পরিত্যাজ্য। অনেকে অতীতের রবীন্দ্র, নজরুলসহ বিখ্যাত কবিদের কাব্যে সাধু-চলিতের মিশ্রণ বা সাধুশব্দের প্রয়োগ দেখে আধুনিক পদ্যেও অবলীলায় তা ব্যবহার করতে চান। শামসুর রাহমান, আল মাহমুদসহ বাংলার দিকপাল কবিরা তা না করলেও তারা তা ভ্রূক্ষেপ করেন না। কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন, কে এই নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন? কিন্তু এই বোকারা ভাষা বা সাহিত্যের বিবর্তনের ইতিহাসসম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ। ভাষা ও সাহিত্যও যে, আমাদের জীবনযাত্রার মতো আধুনিকায়নের পরশে নিয়ত পরিবর্তিত হয় এবং তা আমরা মেনে নিতে বাধ্য হই, তা তারা সবক্ষেত্রে মানলেও সাহিত্যের ক্ষেত্রেই শুধু বেঁকে বসেন! ভাষা ও পদ্যের ব্যাকরণগত শৃঙ্খল থাকলেও তাদের স্বাভাবিক বিবর্তন আইন করে যেমন ঠেকানো যায় না তেমনই তা না মানলেও আধুনিক হওয়া যায় না। ভাষা প্রবহমান নদীর স্রোতের মতোই নিয়ত পরিবর্তনশীল।
এর মানে এ নয় যে, আধুনিক পদ্যে বা গদ্যে মোরা, মোদের, হেরিনু, পশিল ইত্যাদি অপ্রচলিত শব্দের ব্যবহার করা যাবে, যা আমরা ব্যবহারিক জীবনে ব্যবহারই করিনে! আপনি নিরেট সাধুভাষায়, গল্প, প্রবন্ধ, রম্যাদি লিখতেই পারেন, নাটক, গল্প, উপন্যাসের সংলাপছাড়া গানেও আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার করতেই পারেন, আপত্তি নেই। কিন্তু চলিতভাষার পদ্যে সাধু-চলিতের মিশ্রণ বা সাধুভাষা যেমন করিয়া, গড়িব, খাইয়াজাতীয় শব্দের প্রয়োগ আধুনিক যুগে হাস্যকর। বড়বড় আধুনিক কবিরাও তা করেন না, যুগের প্রয়োজনে। এক্ষেত্রে অতীত কবিদের উদাহরণ টানা বোকামো। নতুবা কালিদাস, বাল্মীকির ভাষায় লেখার যুক্তিও সামনে এসে দাঁড়াবেই!
২. চলিতভাষা:
আমি তোমাকে বাংলাশেখাবো। এই হচ্ছে ওপরের সাধুবাক্যটির একটি চলিতরূপ। তাই বলে সাধুভাষার ক্রিয়াপদ ‘শিক্ষা’ শব্দটা কি চলিতভাষায় বা পদ্যে ব্যবহার আমরা করি না নাকি করা যাবে না? এমন হাজারো সাধুভাষার শব্দ আছে, যার চলিতরূপ নেই। এসব শব্দ সাধু-চলিত উভয়রূপেই চালু আছে, যেমন-গমন, প্রস্থান, আগমন, যাতায়াত, অংশগ্রহণ ইত্যাদি। চলিতভাষার আবিষ্কার হয়েছে সাধুভাষার মতো ওজনদার, গাম্ভীর্যপূর্ণ দীর্ঘ-উচ্চারণকে সংক্ষিপ্ত করতেই, কথ্য ও লেখ্যরূপকে চটুল করতেই। তাই এখন আমরা গদ্য-পদ্য উভয়ক্ষেত্রেই চলিতভাষাকেই অগ্রাধিকার দেই। পদ্যলিখতেও এখন কেউই সাধুভাষার ক্রিয়াপদকে আর ব্যবহার করে না। এমনকি সাধু-চলিতের মিশ্রণকেও গুরুচণ্ডালীরূপেই দেখা হয়। পশ্চাৎপদ মনমানসিকতার লক্ষণ মনে করা হয়।
৩. আঞ্চলিক ভাষা:
বাংলাদেশের প্রায় জেলাতেই আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এসব ভাষায় এমনকিছু ক্রিয়াপদ ও শব্দ আছে যা সাধু-চলিত উভয়ভাষাতেই চলে। এসব বহুলপ্রচলিত আঞ্চলিক শব্দও তাই পদ্যে ব্যবহার করতে বাধা নেই। যেমন, তোমার ‘বেবাক’ কথা শুনলাম, আর ‘তর’ সয় না, তোমার মতো মানুষ আজ’তক’ খুঁজে পেলাম না, রংপুরে ‘মঙ্গা’ দেখা দিয়েছে, ‘জাউ’ খেতে মন্দলাগে না ইত্যাদি। অনেকেই বলেন, পদ্যে আঞ্চলিক ভাষার শব্দ আনা যাবে না। তা কি ঠিক? আমরা চলিতভাাষায় কয়জনেই বা কথাবলি? ৯০ জনই আঞ্চলিকে আক্রান্ত আমরা, যা আমাদের মজ্জাগত। তাই সেই ভাষাই হচ্ছে আমাদের মূলমাতৃভাষা, এরপরই চলিত বা সাধুভাষার স্থান।রম্যজাতীয় পদ্য সাধু-চলিত বা আঞ্চলিক ভাষায় লিখতেই পারি আমরা। অধিকাংশ বাংলাভাষীর কাছে পরিচিত যেকোনো আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার পদ্যে বা গদ্যে করাই যায়। এটাই প্রমাণ করবে ভাষার প্রবহমানতা বা গতিশীলতা।
শব্দ মানেই ফুল, পদ্য মানেই শব্দফুলের মালাঃ
ভাষার শব্দভাণ্ডার যার যত সমৃদ্ধ তিনি ততই সমৃদ্ধলেখা লিখতে সক্ষম বিশেষত পদ্য। কারণ পদ্যে শব্দচয়নের গুরুত্ব অপরিসীম। সঠিক শব্দচয়নই পদ্যকে শ্রুতিমধুর ও সাবলীল করতে সক্ষম। শব্দকে আমরা ফুলের সাথেই তুলনা করতে পারি। বিভিন্ন রঙ ও গন্ধের ফুল যেমন আমাদের মনভরিয়ে দেয় তেমনই সেই ফুল চিরস্থায়ী হয় না। আমরা পছন্দের ফুল দিয়ে পছন্দের মালাগাথি। সবফুল যেমন সবার পছন্দ নয়, সবফুল দিয়ে যেমন মালাগাথা যায় না, মালাগাথি না আমরা, তেমনই মালার ফুল একসময় শুকিয়ে যায়। তখন আমরা আবার নতুনফুল খুঁজি এবং নতুন নতুনফুল দিয়ে সুন্দর সুন্দর মালাগাথি।
আমাদের শব্দভাণ্ডার বা অভিধানে তো হাজারো শব্দ থাকে। আমরা কি সবশব্দ জানি বা সবশব্দের ব্যবহার করি পদ্যে নাকি ব্যবহার করা সম্ভব? আমরা ফুলের মালাগাথার মতন পছন্দের শব্দই খুঁজে নিই এবং শব্দের মালাগেথে পদ্যরচনা করি। অভিধানের অনেক শব্দই দুর্বোধ্য, অপ্রচলিত; তাই বলে তারা তো বাতিলশব্দ নয়! তেমনই অতীতের অনেক শব্দ এখন অপ্রচলিত বা পরিত্যাজ্য। এই আমি ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত যেসব শব্দ পদ্যে ব্যবহার করেছি, তার অনেকগুলোই এখন পরিবর্তিত রূপেই চালু হয়েছে। যেমন-পাখী, গাড়ী, বাড়ী, শাড়ী, মত, কোন, গরীব, সরকারী ইত্যাদি শব্দ দিয়ে আমার শতশত পদ্য ছাপা হয়েছে, যা এখন অচল। তাই আমাকেও বাংলা একাডেমির এসবের নতুনশব্দরূপকে মেনে নিয়েই নতুন করেই লিখতে হচ্ছে। এটাই ভাষার আধুনিকতা, প্রবহমানতা। এটা মানতেই হবে, যুগের স্রোতে তালমিলিয়ে চলতেই হবে আধু্নিক লেখকদের।তাই শব্দের রূপ যেমন পালটায় তেমনই ভাষায় নতুন নতুনশব্দের উদ্ভব হয়। আঞ্চলিক শব্দ বা বিদেশাগত শব্দ আমাদের শব্দভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে থাকে। তাই বলে আমি বাংরেজি বা বাংলিশ কিংবা বিকল্পশব্দ থাকতেও কথায় কথায় ইংরেজিশব্দ মিশিয়ে কথাবলার ঘোরবিরোধী।
ভাষার শব্দভাণ্ডার যার যত সমৃদ্ধ তিনি ততই সমৃদ্ধলেখা লিখতে সক্ষম বিশেষত পদ্য। কারণ পদ্যে শব্দচয়নের গুরুত্ব অপরিসীম। সঠিক শব্দচয়নই পদ্যকে শ্রুতিমধুর ও সাবলীল করতে সক্ষম। শব্দকে আমরা ফুলের সাথেই তুলনা করতে পারি।
……………
বেশ মন দিয়েই পড়লাম লেখাটি। ধন্যবাদ।
ভাল্লাগায় অনেক শুভেচ্ছা ভাই
অসাধারণ এই আলোচনা। লিখকদের লিখনরীতি পরিবর্তনে সহায়ক হবে মনে করি। এই ধরণের গম্ভীর অথচ শিক্ষণীয় বিষয়গুলোন যতটা পারা যায় বেশী বেশী করে আনা উচিত। মনের আবেগ আর শব্দগুচ্ছ একত্রিত করলেই সাহিত্য হয় না; এটা সংশ্লিষ্টদের নিশ্চিত মনে রাখতে হবে।
লিখন পরিবেশনা হতে হবে টেবিলে সাজানো পরিপাটি এমন কিছু; যা ভরপেট মানুষকেও আকর্ষণ করে। পলক হলেও দেখে নেবার চেষ্টা থাকবে। ধন্যবাদ কবি।
অনেক কৃতজ্ঞতা মন দিয়ে পড়ার পর সুন্দর মন্তব্যের জন্য। আপনার সাথে সহমত জানাই
আপনার প্রতিও আমাদের অশেষ কৃতজ্ঞতা প্রিয় বাদশা ভাই।
ধীরে ধীরে পুরা লেখাটি পড়লাম। এমন আরো চাই, প্রিয় বাদশাহ ভাই।

গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় তুলে এনেছেন। আশা করছি অনেকেই উপকৃত হবেন। শুভেচ্ছা…
গুরুত্বপূর্ন পোস্ট । ভালো লেগেছে । কিন্তু এখন একদল যে কথ্য ভাষাকে প্রচলিত সাহিত্যের ভাষা হিসেবে প্রচলিত করতে চাইছে সে ব্যপারে আপনার মতামত আশা করছি ।এই ব্যপারে আমি একটা পোস্ট দিয়েছিলাম । একজন কবি এবং লেখক বললেন চেঞ্জ আসবেই । তবু সাহিত্যের ফুল ফুটুক ।
নমুনা দিচ্ছি
“আমি ঘোষণা দিছি অনেক দিন আগেই, কোনো পুরস্কার যাতে কেউ আমারে দেওয়ার স্পর্ধা না করে। এখন দেখতেছি নোটারি বা লিগ্যাল কাগজ কইরা রাখতে হবে যাতে মৃত্যুর পরেও কোনো প্রতিষ্ঠান পুরস্কার দিতে না পারে এই কুত্তার বাচ্চার মত অগণন পুরস্কারের দেশে।
“”ব্রাত্য রাইসু”
আঞ্চলিক ভাষায় যদি আমরা সবাই সাহিত্যচর্চাশুরু করি তবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাসাহিত্য বলে কিছুই থাকবে না। মূলবাংলায় সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি অবশ্যই ৬৪জেলার সাহিত্যিকই এসব আঞ্চলিক ভাষায় সাহিত্যসৃষ্টি করতেই পারে।