ছড়াদাদুর পাঠশালা ৪

আজ ছড়াদাদুর পাঠশালা বসেছে বাড়ির পেছনের মাঠে। সবুজ ঘাসের বিছানায় বসে পড়েছে ছাত্র-ছাত্রিরা।
দাদু বলেন-তাহলে শুরু করা যাক।
মামুন বলে- আজ হবে ছন্দ ও অলঙ্কার।
– হ্যাঁ, প্রথমেই বলি- নতুনদের মধ্যে ছন্দ আর অন্ত্যমিল নিয়ে একটা গোলমেলে ধারনা আছে। ছন্দ বলতে ভাবে দুটি লাইনের শেষে মিল। আসলে সেটি হল অন্ত্যানুপ্রাস বা অন্ত্যমিল। ওটা কখনই ছন্দ নয়।
ছন্দ হল কবিতা বা ছড়ার শব্দচলনের একটি বাঁধাহীন নিয়মনির্ভর গতি। ঘড়ির কাঁটা যেমন একটি নির্দিষ্ট মাত্রা ও পর্বের সমতা মেনে চলে তেমনি আর কি। আর
এই মাত্রাসমতা বজায় রেখে যদি কবিতা বা ছড়া লেখা হয় তবেই সেটি হয় ছন্দবদ্ধ লেখা।
যেমন – ফিটফাট / বাবু সেজে/ পায়চারি/ রাতদিন,
কানাকড়ি / মিলবে না/ পকেটেতে/ হাত দিন।
এই এক একটা ভাগ হল পর্ব। আর প্রত্যেক পর্বে যতগুলো দল আছে সেগুলোর প্রতিটি হল এক একটি মাত্রা। এটি চারমাত্রার মাত্রাবৃত্তে লেখা হয়েছে।
-আচ্ছা দাদু ছন্দ আর লাইনশেষে মিলের পার্থক্য তো বোঝা গেল। এবার বলুন ছন্দের বিভাগ নিয়ে।
– ছন্দ মূলত তিন রকম – স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত আর অক্ষরবৃত্ত। স্বরবৃত্তই প্রধানত ছড়ার ছন্দ। কিন্তু অন্য ছন্দেও যে লেখা যাবে না তা নয়।
ছন্দ আলোচনার আগে তোমাদের জানতে হবে দল বিষয়ে।
অরনি বলে – বলুন
– একটি শব্দের যতটুকু একবারে উচ্চারণ করা যায় সেটাই একটি দল বা সিলেবল বা মাত্রা।
অনিক বলে- একটা উদাহরণ দিন দাদু।
– যেমন ধরো, ছন্দ। একে ভাঙলে পাওয়া যায় ছন্ + দ। এতে দুটি দল আছে। দলকে আবার দুভাগে ভাগ করা হয়। রুদ্ধদল ও মুক্তদল।
যে দল ব্যঞ্জনান্ত সেটি রুদ্ধদল।
আর স্বরান্ত দল হল মুক্তদল।
দীপেন বলে – দাদু একটু উদাহরণ যোগে বলুন না।
– ছন্দ শব্দটির ছন্ হল রুদ্ধ দল আর দ হল মুক্তদল। ছন্ – এর শেষ বর্ণ -ন-তে যদি স্বরধ্বনি যুক্ত হত তাহলে ছনো হত ( ছ+ ন+অ/ও)
যেমন দ +অ/ও হয়েছে।
একইভাবে বিদ্যালয় ভাঙলে পাই বিদ্+দা+লয়। এখানে বিদ্ ও লয় রুদ্ধদল আর দা মুক্তদল। এবার তোমরা দু’একটা দল বিভাজন করো তো। বল – বৃষ্টিপাত কীভাবে ভাঙবে।
আদৃতা বলে- বৃষ্+টি+পাত।
মামুন বলে – বৃ্ষ ও পাত রুদ্ধদল। টি হল মুক্তদল।
দাদু খুশি হয়ে বলেন- একদম ঠিক। তার মানে তোমরা বুঝেছ।
সকলে একসঙ্গেই হ্যাঁ বলল।
দাদু বলেন- এবার আসি ছন্দে। স্বরবৃত্ত ছন্দে রুদ্ধদল দল ও মুক্তদল দুটিই এক মাত্রার মুল্য পায়। আর তোমরা মনে রাখবে স্বরবৃত্ত সবসময় চারমাত্রার চালে চলে। যেমন –
জ্বলছে আগুন/ মনে বনে/
টলছে প্রাণী/কুল,
কীসের পাপে /সৌর তাপে/
ফোটায় বিষের/ হুল!
জ্বল+ছে-আ+গুন/ ম+নে-ব+নে/
টল্+ছে-প্রা+ণী/ কুল,
কী+সের্-পা+পে/সৌ+র-তা+পে/ফো+টায়-বি+ষের/ হুল।
৪+৪+৪+১
৪+৪+৪+১
এইভাবে চরণদুটির মাত্রা বিভাজিত হয়েছে।
অরণি বলে – শেষের একমাত্রা?
– ওটাকে বলে অতিপর্ব। কবিতার প্রতিটি লাইনে সমমাত্রার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশই হলো পর্ব। পঙ্ক্তি শেষের পর্বাংশকে অতিপর্ব বলা হয়। এ ধরনের পর্বাংশ লাইনের শুরুতে থাকলে আমরা তাকে উপপর্ব বলি।
এই অতি বা উপপর্ব এক, দুই, তিন মাত্রার হয়। আবার অতিপর্ব ছাড়াও চরণ নির্মিত হতে পারে। সেক্ষেত্রে চারমাত্রার একটি পর্ব তৈরি হয়।যেমন-
ভুতের ছড়া/ লিখতে হবে/ সম্পাদকের/ ফরমায়েশে… ৪+৪+৪+৪
উপপর্ব হল-
কথা কইতে গেলে দোষ
সাপের বিষাক্ত ফোঁসফোঁস…
এখানে কথা ও সাপের হল দুইমাত্রার উপপর্ব।
এবার আসি স্বরবৃত্তের বৈশিষ্ট্যে। এটি দ্রুত লয়ের ছন্দ।
এই ছন্দের মূলপর্ব বা পূর্ণপর্ব চার মাত্রাবিশিষ্ট। মুক্তদল এবং রুদ্ধদল উভয়ই একমাত্রাবিশিষ্ট। পর্বগুলো ছোট এবং দ্রুতলয়বিশিষ্ট। এই ছন্দে যতি এবং দল ঘন ঘন পড়ে বলে বাগযন্ত্র দ্রুততা লাভ করে। প্রতি পর্বের প্রথম অক্ষর শ্বাসাঘাতযুক্ত।
এই ছন্দের প্রয়োজনে ৫ মাত্রাকে সংবৃত উচ্চারণে ৪ মাত্রার মত আবৃত্তি করা যায়, আবার কোথাও এক মাত্রা কম থাকলে বিবৃত উচ্চারণ করে এক মাত্রাকে দুই মাত্রায় টেনে নেয়া যায়।
আদৃতা বলে – যেমন?
-আগে জেনে নাও -পর পর তিনটি রুদ্ধদল থাকলে চারমাত্রার মর্যাদা পেয়ে যায়। যেমন -ঝম ঝম ঝম / বৃষ্টি পড়ে। ৩+৪
এখানে ঝমঝমঝম তিনটি রুদ্ধদল। কিন্তু চারমাত্রার গতিতে খাপ খেয়ে গেল। মানে ভেতরে ভেতরে ঝমঝমাঝম হলে গেল।

পাঁচমাত্রার স্বরবৃত্তের একটা উদাহরণ দিন দাদু – দীপেন বলে।
– দাঁড়িয়ে আছে /বাড়িয়ে দু’হাত…
দাঁ+ড়ি+য়ে -আ+ছে/ বা+ড়ি+য়ে -দু+হাত ৫+৫। এরকম ইয়ে যুক্ত শব্দ অনেক সময় ৫ মাত্রা হলে পড়ার সময় চারমাত্রার মতই চলনটা পেয়ে যায়।
দাদু একটু থামলেন। তারপর বললেন- এপর্যন্ত যা যা বললাম তোমাদের বোধগম্য হয়েছে তো?
ওরা সবাই হাঁসূচক ঘাড় নাড়ল।
(চলবে)

শংকর দেবনাথ সম্পর্কে

শংকর দেবনাথ জন্মঃ ২১ অক্টোবর, ১৯৭৪ প্রকাশিত গ্রন্থ - কবিতার বইঃ ১) আত্মহনন অথবা মৈথুন ২) শিয়রে নীলাভ জ্বর ৩) পরকীয়া ঘুম ছড়ার বইঃ ১) দুধমাখা ভাত ২) টক ঝাল তেতো কড়া ৩) ফাটকা কথার টাটকা ছড়া ৪) লাগ ভেল্কি লাগ ৫) রসে কষে ভরা প্রবাদের ছড়া গল্পগ্রন্থঃ ১) দুই শালিকের গল্প ২) গাছের জন্মদিন পিডিএফ ছড়ার বই: ১. ফাটকা কথার টাটকা ছড়া ২. সুজন পাখির কূজন ৩. অথৈ প্রাণের ধারা ৪. ছন্দ মাতে বন্দনাতে ৫. কিম্ভুতকিমাকার ৬. অপ্রচলিত ছড়া ৭. আমার সুকুমার ৮. প্রাণের ঠাকুর ৯. গাছপাগলের পদ্য ১০. ছড়ায় পড়া ১১. শব্দ নিয়ে মজা ১২. ভূত আছে ভূত নেই ১৩) ঠাকুরদাদার বউ ১৪) তাই রে না না ১৫) খুশি মনে পুষি ছড়া ১৬) স্বরবর্ণের ঘর সম্পাদিত পত্রিকাঃ ছোটদের ভোরের পাখি ভেল্কি ছড়াপত্র ঠোঁটকাটা মাসিক ছড়াপত্রিকা পুরষ্কার ও সম্মাননাঃ ১। নিখিলবঙ্গ শিশুসাহিত্য সংসদ প্রদত্ত " কবি কৃত্তিবাস সম্মাননা" -২০১৮ ২। দীনবন্ধু রাখালদাস বিভূতি বিনয় একাডেমি প্রদত্ত " কবি যোগীন্দ্রনাথ সরকার সাহিত্য সম্মান -২০১৯

16 thoughts on “ছড়াদাদুর পাঠশালা ৪

  1. স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত আর অক্ষরবৃত্ত এই তিনটা

    ছাড়া কবিতা লেখা যায় না -তাহলে কি কবিতা হবে না———

  2. আজকের পোস্টেও শিক্ষার উপকরণ খুঁজে পেলাম। পাঠক হিসেবে মনের সাথে বুঝলাম। ধন্যবাদ মি. শংকর দেবনাথ। :)

  3. ছড়া দাদু খুব সহজ করে বুঝিয়ে দিয়েছেন আজকের ক্লাসে। :)

    ছন্দ হল কবিতা বা ছড়ার শব্দচলনের একটি বাঁধাহীন নিয়মনির্ভর গতি।

  4. বাহঃ খুব সুন্দর এবং সাবলীল পাঠশালা চলছে।

    অক্ষরবৃত্ত, স্বরবৃত্ত আর মাত্রাবৃত্তের বিশ্লেষণ শেষ হওয়ার অপেক্ষায় আছে, ঐ যে দীপেন, আদৃতা এবং অরুণিমার সাথে যে একজন আছে।

    এগুলো শেষ হলে সে একটি বিশেষ ছন্দের বিষয়ে ছড়া দাদুর কাছে জানতে চাইবে। এখন সে মনে মনেই  রেখেছে বিষয়টা।https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gifhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।