জাবরকাটা ৫

456454

আমাদের ছোটবেলাটা আজকের বাচ্চাদের শৈশবের মতো এমন তুতুপুতু ছিল না। ছিল না এতরকম অনর্থক ‘এটা কোরোনা কার্টসি শেখো, ওটা কোরোনা প্রোটোকল জখম হবে’ র ত্রিবন্ধনী। পড়ার সময় বাদে অন্য সময় চেটেপুটে সদব্যবহার করেছি। দেখেছি দুচোখ মেলে। সেদিনের দেখে শেখা আজও বহু কাজে লাগে। মাঝেমাঝে নিজের মধ্যে নিজে একলা ডুব দিলে দেখা দৃশ্য সিনেমায় রূপান্তরিত হয়ে মনের চোখের পাতায় খেলা করে।

বলতে গেলে ভারতের মোটামুটি প্রায় সব ভাষাভাষী মানুষের সান্নিধ্যে এসেছি। খুব কাছ থেকে দেখেছি তাদের। প্রত্যেক প্রদেশের মানুষের বিভিন্ন অভ্যাসে যে স্বতন্ত্রতা আছে তাকে অনুভব করেছি। উত্তরের খাওয়া আর দক্ষিনী খাওয়া যেমন মেলে না, ঠিক তেমনি দৈনন্দিন আচার, অভ্যাসও আলাদা।
ওড়িয়ারা এমনিতে খুবই শান্ত প্রকৃতির আর স্বভাববাধ্য মানুষ। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে? থাকেও সর্বদাই। কিন্তু শান্ত, সাংঘাতিক কর্মঠ এই মানুষগুলোকে মিশলেই ভালোবেসে ফেলা যায়। ওড়িয়া ভাষাও শিখেছিলাম সেই সময়ে। আজ চর্চার অভাবে ভুলে গেছি।

পখলভাতঅ মানে পান্তাভাত আর রাগঅ মানে ঝাল ওদের খুব পছন্দের খাবার। মাছ বেশি ভালোবাসে মাংসের চেয়ে। সাধারণ নিম্নবিত্তরা গুড়াকুর নিয়মিত নেশা করে। মিষ্টির মধ্যে ওদের প্রিয় মালপোয়া। এটা ওরা প্রত্যেক বাড়ীতেই বানায় উৎসবে, ব্যসনে।

অন্ধ্রের লাগোয়া গঞ্জাম জেলার ওড়িয়ারা তাদের ভাষায়, খাবারে পরিস্কার তেলেগু ছাপ বহন করে। আর মজার ব্যাপার হলো মেয়ের জন্যে ওদের কাছে সবচেয়ে ভালো পাত্র হলো মেয়ের মামা।
আমরা যেমন দোসা খাই ঠিক সেরকমটি তামিল রা খায় না। ওরা নারকেল তেলে ভাজা প্লেন দোসা ভেতরে কোনোরকম পুর ছাড়াই নারকেলের চাটনি দিয়ে খায়। অসম্ভব টক দই ওদের খুব প্রিয়। লুঙ্গির মতো ধুতি যাকে ওরা বলে ভেস্টি, এখনো বহু তামিল, তেলেগু, মালয়ালি পরেন।

গোলগাপ্পা মানে আমাদের ফুচকার ভেতরে গোলাপের পাপড়ি আর বোঁদে দিয়ে কি যে অখাদ্য করে তুলে পরম তৃপ্তিতে পাঞ্জাবীরা খায় সেটা পাঞ্জাবে না গেলে জানতেই পারতাম না। ওদের লস্যির গ্লাস ভারী অদ্ভুত। অনেকটা শঙ্কুর মতো। নীচে সরু ওপরে চওড়া। সাধারণ মানুষেরা কিন্তু খুবই সরল।

বেশিরভাগ রাজস্থানী হিন্দু আর জৈন দু ধর্মই পালন করেন। গরম রুটিতে পাকা ঘি লাগিয়ে উচ্ছে ভাজা আর মাঠঠা মানে ঘোল দিয়ে পরিতৃপ্তির সঙ্গে ওরা খায়। সঙ্গে অবশ্যই লংকা কিম্বা লেবুর আচার আর আগুনে সেঁকা পাঁপড়।

ওই রুটিই আবার গমের বদলে বাজরার আটার হলে গুজরাতিদের প্রিয়। ব্যাসনের লাড্ডু পশ্চিমাঞ্চলের প্রিয় মিষ্টি।

নাগারা শুনেছিলাম কুকুর খায়। সত্যিই খায়। তবে সব নাগারা খায় না। ওদের মধ্যে বিশেষ দু একটা উপজাতি কুকুরের মাংস খায়। এটা ওদের খুব প্রিয় মাংস। তবে কুকুর পুড়িয়ে খাওয়াই ওরা বেশি পছন্দ করে।

বলতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে। এত ছোট্ট পরিসরে এত বলা সম্ভব নয়। কিন্তু, আমি তাদের সেইসময়ে এত কাছ থেকে দেখেছি, খেলেছি, ভাব হয়েছে, ঝগড়া হয়েছে, প্রত্যেক মানুষের মধ্যে অখন্ড ভারত আছে সেদিন বুঝিনি। আজ একান্তে বসে অনুভব করি গান গাইতে গাইতে শীতের দুপুরে পাঁপড় বেলা মধ্যবয়সীনির দল আর আমার মায়ের মধ্যে একটুও তফাৎ ছিল না সেদিন, আজও নেই।

সৌমিত্র চক্রবর্তী সম্পর্কে

পরিচিতিঃ জন্ম বিহারের এক অখ্যাত বনাঞ্চলে বাবার চাকরীস্থলে। রসায়নে স্নাতকোত্তর এবং ম্যানেজমেন্ট পাশ করে কিছুদিন সাংবাদিকতা। বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকারী উচ্চপদস্থ কর্মচারী। একাধারে নাট্যকার, কবি এবং গল্পকার। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, পুস্তক পর্যালোচনা, বিভিন্ন ধরনের লেখা ছড়িয়ে আছে দেশ বিদেশের অসংখ্য পত্র পত্রিকায় ও সংবাদপত্রে। উৎপল দত্ত সহ বহু বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্বের কাছে শিখেছেন থিয়েটার। বহু বিচিত্র ও ব্যাপ্ত ময় তাঁর জীবন। বন, জঙ্গল, পশু, পাখি, বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সাথে তাঁর দীর্ঘকালের নিবিড় ও অন্তরঙ্গ পরিচয়। কবিতা ও বিভিন্ন লেখা লেখিতে তিনি মস্তিস্কের থেকে হৃদয়ের ভুমিকাকে বড় করে দেখেন। কবিতা, গল্প, নাটক এবং মুক্তগদ্য মিলিয়ে এ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা নয়। প্রকাশিত গ্রন্থগুলি হলো বইছে লু, থিয়েটার কথা, তিতলিঝোরা, নীলপাখিকে উড়ো চিঠি, রাত্রি আমার নৈশপ্রিয়া, ব্রিজের নীচে বৃষ্টি, ২ একাঙ্ক, প্রতিলিপি এবং বেবুশ্যে চাঁদ, খণ্ড ক্যানভাস। ইতিপূর্বে অঙ্গন সহ কয়েকটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। বর্তমানে অক্ষর বৃত্ত পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। নেশা ফটোগ্রাফি ও ভ্রমণ।

2 thoughts on “জাবরকাটা ৫

  1. 'আজ একান্তে বসে অনুভব করি গান গাইতে গাইতে শীতের দুপুরে পাঁপড় বেলা মধ্যবয়সীনির দল আর আমার মায়ের মধ্যে একটুও তফাৎ ছিল না সেদিন, আজও নেই। ___ আমার মতো পাঠকের মনের অনুভূতি স্থান কাল বাদ দিলে অনেকাংশেই মিলেই যাবে। অনেক অনেক শুভ কামনা প্রিয় কবি সৌমিত্র চক্রবর্তী। ভালো থেকো। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।