এদেশ ওদেশ ১১

শুরু করেছি ভারত – বাংলাদেশ – পাকিস্তানের ময়নাতদন্তমূলক নিবন্ধ “এদেশ ওদেশ”। লেখাটি আগে এক‌টি কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল। পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। কিন্তু আমার মনে হয় ২০১৫ সালে লেখা এই নিবন্ধ এখনো প্রাসঙ্গিক। আজ একাদশ পর্ব।

৭১ এর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ স্থায়ী হয়েছিল মাত্র ন মাস, আর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ মাত্র ১৩ দিন। মুখে যতই লম্ফঝম্প করুক, পাকিস্তানের সামরিক পরিকাঠামো যথেষ্ট মজবুত ছিল না। অন্যদিকে বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ ক্ষোভের বিস্ফোরণে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তিকামীতায়। মুক্তিবাহিনীর যে দ্বিতীয় শাখা গেরিলা বাহিনী তারা তৈরী করেছিল, তা মূলত ছিল কিশোরদের নিয়ে। রাস্তায়, গলিতে, গ্রামের শুঁড়িপথে, পাহাড়ী এলাকায়, জঙ্গলে পাকিস্তান আর্মিকে আচমকা আক্রমণ করে তাৎক্ষণিক ক্ষয়ক্ষতি সাধণই ছিল এর মুখ্য উদ্দেশ্য। আর সামনে পেছনে আক্রমণ সামলানোর মত অভিজ্ঞতা পাকিস্তানী সেনার ছিল না। এছাড়া পাক শুষ্ক জলবায়ু তে অভ্যস্ত পাঠান ও পাঞ্জাবীরা বঙ্গীয় জলীয় আবহাওয়া বরদাস্ত না করতে পেরে প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ত। আর এর ওপর ছিল ভারতের বেসরকারী বিরোধিতা। ফল যুদ্ধ অচিরেই তাদের হাতছাড়া।

৭১ এর মার্চে যখন পাক সেনা ঝাঁপিয়ে পড়ল, কিম্বা অত্যাচার চালাতে শুরু করল, তখন স্বাভাবিকভাবেই ভারত প্রথমে সরকারীভাবে নাক গলায় নি। আমেরিকা হুমকি দিয়ে রেখেছিল, পাকিস্তানের আভ্যন্তরীন বিষয়ে কেউ যেন নাক না গলায়, বিদ্রোহীদের (গণতন্ত্রের পীঠস্থান ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকা ভোটে জেতাদের বিদ্রোহী আখ্যাই দিয়েছিল।) কেউ যেন সাহায্য না করে। কিন্তু সরকারীভাবে সাহায্য না করতে পারলেও তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ চলছিলই। এই সময়ে পাক সেনা ও তাদের সহযোগীদের অত্যাচারে হু হু করে আসাম, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, ও পশ্চিমবঙ্গের সীমানা পেরিয়ে আসতে শুরু করল বিপুল পরিমাণে শরণার্থী।

এপারের মানুষের সঙ্গে ওপারের বাঙালির আত্মীয়তা কোনোদিনই কোনো সীমানা মানেনি। তাই সবচেয়ে বেশী বাস্তুহারা এলো আসাম আর পশ্চিমবঙ্গে। স্বাধীণতার পরবর্তী বিপর্যস্ত আর্থিক অবস্থার প্রভাব এ বঙ্গেও পড়েছিল। বেকার সমস্যা, মূল্যবৃদ্ধি, শিল্পসমস্যা, ভূমিসমস্যায় এপারের বাঙালির দৈনন্দিন কাঠামো নাজেহাল। তবুও স্বজনের ওপর অত্যাচার দেখে দুহাত বাড়িয়ে তারা ঠাই দিল ঘরহারাদের। এপারের অতিরিক্ত জমিতে তারা বাসা বাঁধতে শুরু করল। মুজিব গ্রেপ্তারের পরে বেশ কিছু প্রথম সারির রাজনৈতিক নেতা এপারে পালিয়ে এসেছিলেন। এখান থেকেই ঘোষিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীণ বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়েছিল কলকাতাতেই। সব জেনেও মানবতার খাতিরে চোখ বন্ধ করে রেখেছিল ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। এপারের বামপন্থী দলগুলো তো সক্রিয় সাহায্যে নেমে পড়েছিল অসহায় সেই মানুষগুলোর পাশে।

ভারতের এই ইনডাইরেক্ট সমর্থন পাক সরকার বা তার গুরু ইয়াংকি সরকার ভালোভাবে মেনে নেয় নি। তাই ডিসেম্বরে পাকিস্তান ভারতের সেনাঘাটিতে আক্রমণ করার পরে ভারত যুদ্ধ ঘোষণা করলে আমেরিকা তার সপ্তম নৌবহর পাঠিয়ে ভারতকে শায়েস্তা করার কথা ঘোষণা করে দিল। এই দুঃসময়ে পাশে দাঁড়াল সোভিয়েত ইউনিয়ন। সোজা তারা আমেরিকাকে হুমকি দিল, যদি আমেরিকা উপসাগরীয় অঞ্চলে বা ভারত মহাসাগর অঞ্চলে নৌবহর পাঠিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার চেষ্টা করে তাহলে রাশিয়াও তাই করবে এবং ফলশ্রুতিতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সব দায়ভার আমেরিকার ওপরেই বর্তাবে। হুমকিতে কাজ হল এবং ইউএসএ পিছিয়ে গেল। দুর্বল পাকিস্তান তেরদিনের বেশী যুদ্ধ টানতে পারল না। কিন্তু নাছোড় আমেরিকা তখন হাতে না মারতে পেরে ভাতে মারার পরিকল্পনা করে ভারত ও সদ্য ভূমিষ্ঠ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আর্থিক অবরোধের প্রাচীর তৈরী করল সহযোগী দেশদের নিয়ে। ফলত যুদ্ধ পরবর্তী এই দুই দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা সঙ্গীন হয়ে উঠল।

আগে থেকেই ভারত বিভিন্ন সমস্যায় বিব্রত ছিল। তার ওপরে এই যুদ্ধ স্থায়ী প্রভাব ফেলল। কিন্তু সদ্যগত যুদ্ধের ফল ঠিক তখনই বোঝা যায়নি। ১৯৭১ এর বিপুল ভোটে জেতা ইন্দিরার অসম্ভব তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা এই জেতার ক্যারিশমাকে কাজে লাগিয়ে ১৯৭২ এর বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন এর প্রক্রিয়া শুরু করে দিল।

(আবার আগামী কাল)

সৌমিত্র চক্রবর্তী সম্পর্কে

পরিচিতিঃ জন্ম বিহারের এক অখ্যাত বনাঞ্চলে বাবার চাকরীস্থলে। রসায়নে স্নাতকোত্তর এবং ম্যানেজমেন্ট পাশ করে কিছুদিন সাংবাদিকতা। বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকারী উচ্চপদস্থ কর্মচারী। একাধারে নাট্যকার, কবি এবং গল্পকার। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, পুস্তক পর্যালোচনা, বিভিন্ন ধরনের লেখা ছড়িয়ে আছে দেশ বিদেশের অসংখ্য পত্র পত্রিকায় ও সংবাদপত্রে। উৎপল দত্ত সহ বহু বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্বের কাছে শিখেছেন থিয়েটার। বহু বিচিত্র ও ব্যাপ্ত ময় তাঁর জীবন। বন, জঙ্গল, পশু, পাখি, বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের সাথে তাঁর দীর্ঘকালের নিবিড় ও অন্তরঙ্গ পরিচয়। কবিতা ও বিভিন্ন লেখা লেখিতে তিনি মস্তিস্কের থেকে হৃদয়ের ভুমিকাকে বড় করে দেখেন। কবিতা, গল্প, নাটক এবং মুক্তগদ্য মিলিয়ে এ পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা নয়। প্রকাশিত গ্রন্থগুলি হলো বইছে লু, থিয়েটার কথা, তিতলিঝোরা, নীলপাখিকে উড়ো চিঠি, রাত্রি আমার নৈশপ্রিয়া, ব্রিজের নীচে বৃষ্টি, ২ একাঙ্ক, প্রতিলিপি এবং বেবুশ্যে চাঁদ, খণ্ড ক্যানভাস। ইতিপূর্বে অঙ্গন সহ কয়েকটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। বর্তমানে অক্ষর বৃত্ত পত্রিকার প্রধান সম্পাদক। নেশা ফটোগ্রাফি ও ভ্রমণ।

2 thoughts on “এদেশ ওদেশ ১১

  1. ঘোষিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীণ বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়েছিল কলকাতাতেই। সব জেনেও মানবতার খাতিরে চোখ বন্ধ করে রেখেছিল ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। এপারের বামপন্থী দলগুলো তো সক্রিয় সাহায্যে নেমে পড়েছিল অসহায় সেই মানুষগুলোর পাশে। ___ আমাদের ইতিহাস। https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_good.gif

  2. যতো পড়ছি, ততই জানছি। লিখুন দাদা, সাথে আছি। 

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।