বঙ্গবন্ধুর শৈশবের সোনাঝরা সময়গুলো
রং তুলির আচঁড়ে যেন ছবির মতো গ্রাম। গাছগুলো সারি সারি। নদীতে পালতোলা পানশি, নৌকা, লঞ্চ ও স্টিমার চলতো। বর্ষায় গ্রামটির চেহারা হতো একখণ্ড জলছবি। গ্রামটির নাম টুঙ্গিপাড়া। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার একটি বনেদী পরিবারের নাম শেখ পরিবার। সেই পরিবারেই জন্মগ্রহণ করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। এদিন শেখ লুৎফর রহমান ও তার সহধর্মিনী সায়রা খাতুনের ঘরে জন্ম নিলো একটি ফুটফুটে চেহারার শিশু। বাবা-মা আদর করে নাম রাখলেন খোকা। এই খোকাই হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জগৎ স্বীকৃত সমগ্র বাঙালির প্রিয় মানুষ। তিনি ছিলেন একজন মাতৃভক্ত সন্তান। শৈশব-কৈশোরে বাবা-মা তাকে আদর করে খোকা বলে ডাকতেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন তাদের তৃতীয় সন্তান। স্বভাবের দিক দিয়ে ছিলেন একটু জেদি, চঞ্চল ও একগুঁয়ে।
বঙ্গবন্ধুর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এ ঘেরা টুঙ্গিপাড়াতেই। পুষ্পভরা শস্য শ্যামলা রূপসী বাংলাকে দেখেছেন। তিনি আবহমান বাংলার আলো-বাতাসে লালিত ও বর্ধিত হয়েছেন।
দোয়েল ও বাবুই পাখি ভীষণ ভালোবাসতেন। বাড়িতে শালিক ও ময়না পুষতেন। আবার নদীতে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার কাটতেন। বানর ও কুকুর পুষতেন বোনদের নিয়ে। পাখি আর জীবজন্তু‘র প্রতি ছিল গভীর মমতা। মাছরাঙা ডুব দিয়ে কীভাবে মাছ ধরে তাও তিনি খেয়াল করতেন খালের পাড়ে বসে বসে। ফুটবল ছিল তার প্রিয় খেলা। এভাবে তার শৈশব কেটেছে মেঠো পথের ধুলোবালি মেখে আর বর্ষার কাদা পানিতে ভিজে।
গ্রামের মাটি আর মানুষ তাকে প্রবলভাবে আর্কষণ করতো। তিনি শাশ্বত গ্রামীণ সমাজের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না ছেলেবেলা থেকে গভীরভাবে প্রত্যক্ষ করেছেন।
বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফর রহমান আদালতে চাকরি করতেন। তার মাতা সায়েরা খাতুন ছিলেন গৃহিনী। পিতা-মাতার স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে তিনি একজন বিজ্ঞ আইনজীবী হবেন। টুঙ্গিপাড়ার সেই শেখ বাড়ির দক্ষিণে ছিল কাছারি ঘর। এখানেই মাস্টার পতি ও মৌলভী সাহেবদের কাছে ছোট্ট মুজিবের হাতেখড়ি। একটু বড় হলে তাদের পূর্ব পুরুষদের গড়া গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তার লেখাপড়া শুরু হয়। এরপর পিতার কর্মস্থল মাদারীপুরের ইসলামিয়া হাইস্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে কিছুদিন লেখাপড়া করেন। পরবর্তীতে তার পিতা বদলি হয়ে গোপালগঞ্জে যোগদান করলে তিনি গোপালগঞ্জ মিশন হাইস্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হন। বিদ্যালয়ের প্রায় প্রতিটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করতেন তিনি।
পছন্দ করতেন ইতিহাসের বই। এসব কারণে প্রধান শিক্ষক গিরিশ চন্দ্রসহ সকল শিক্ষকের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিলেন শেখ মুজিব। শিশুকাল থেকেই শেখ মুজিব ছিলেন পরোপকারী এবং অন্যায়ের প্রতিবাদী। মানুষের দুঃখ-দুর্দশায় যেমন সহযোগিতার হাত বাড়াতেন-তেমনি কারো প্রতি অন্যায় আচরণ দেখলে প্রতিবাদ করতেন। মাত্র তের বছর বয়সে প্রতিবাদের এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন তিনি।
ওই সময় গোপালগঞ্জে স্বদেশি আন্দোলনের এক সমাবেশে জনতার ওপর পুলিশের নির্বিচার লাঠির্চাজ দেখে বিক্ষুব্ধ হয় শিশু মুজিব। ফলে বিক্ষোভকারীরা যখন পুলিশের ওপর চড়াও হয়, তখন তিনিও বন্ধুদের নিয়ে যোগ দেন বিক্ষোভকারীর দলে। পুলিশ ফাঁড়িতে শত শত ইট পাটকেল নিক্ষেপ করে তারা নাজেহাল করে তোলেন পুলিশ সদস্যদের। তার সাহস দেখে অবাক হন থানার বড়কর্তা। তার বয়স যখন চৌদ্দ, তখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়াকালীন তিনি হঠাৎ চক্ষুরোগে আক্রান্ত হন। অনেক চিকিৎসা চলে। কিন্তু অসুখ সারে না। এ কারণে তার লেখাপড়া সাময়িক বন্ধ হয়ে যায়।
তিন বছর পর আবার সুস্থ হয়ে তিনি অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হন। মনোযোগী হন লেখাপড়ায়। তখন ঘটে আরেক ঘটনা। গোপালগঞ্জ মিশন হাইস্কুল পরিদর্শনে আসেন শেরেবাংলা একে ফজলুল হক। তাকে সংবর্ধনা জানানোর ব্যাপারে শহরের হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। বিষয়টি কিশোর মুজিবের ভাল লাগেনি। তাই তিনি আয়োজকদের একজন হয়ে মসজিদ প্রাঙ্গণে সেবার স্কুল ঘর মেরামত করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গীকার আদায় করেন। এসময় বিরোধীচক্রের রোষানলে পড়েন শেখ মুজিব। রাজনৈতিক কারণ দেখিয়ে গ্রেফতার করা হয় তাকে। হাজতবাস করতে হয় সাতদিন। এটিই তার জীবনের প্রথম কারাবরণ।
শৈশব থেকেই তিনি খুব অধিকার সচেতন ছিলেন। অন্যায়ের প্রতিবাদ করা ছিল তার চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সক্রিয়কর্মী হামিদ মাস্টার ছিলেন তার গৃহ শিক্ষক। তার এক স্যার তখন গরিব ও মেধাবী ছাত্রদের সাহায্য করার জন্য একটি সংগঠন করেছিলেন। শেখ মুজিব ছিলেন এই সংগঠনের প্রধান কর্মী। বাড়ি বাড়ি ধান চাল সংগ্রহ করে ছাত্রদের সাহায্য করতেন। তিনি ফুটবল খেলতে ভালোবাসতেন। স্কুল টিমের নেতা হয়ে বেশ কয়েকবার জিতে যায় তার দল।
শৈশব থেকেই তিনি তৎকালীন সমাজ জীবনের জমিদার, তালুকদার ও মহাজনদের অত্যাচার, শোষণ ও প্রজা নিপীড়ন দেখেছেন। গ্রামের হিন্দু মুসলমানদের সম্মিলিত সামাজিক আবহে তিনি দীক্ষা পান অসম্প্রদায়িকতার। আর পড়শি দরিদ্র মানুষের দুঃখ, কষ্ট তাকে সারাজীবন সাধারণ দুঃখী মানুষের প্রতি ভালবাসায় সিক্ত করে তোলে। বস্তুতপক্ষে সমাজ ও পরিবেশ তাকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের সংগ্রাম করতে শিখিয়েছে। তাই পরবর্তী জীবনে তিনি কোনো শক্তির কাছে সে যত বড়ই হোক আত্মসমর্পণ করেননি; মাথানত করেননি।
জীবনে তিনি কোনো শক্তির কাছে সে যত বড়ই হোক আত্মসমর্পণ করেননি; মাথানত করেননি। ___ এই শক্তিই আমাদের বড় শক্তি সুরাইয়া নাজনীন। আমাদের গর্ব।
নম্র শ্রদ্ধা এই মহান পুরুষের প্রতি।
খুউব সুন্দর পোস্ট দিদি ভাই।