“আমি চব্বিশ বছরের কাছে হেরে গেছি”

আজ বড় আশা নিয়ে খুব তাড়াতাড়ি অফিসে এসেছিলো সাজেদ। কিন্তু তার মনটা একটু আগে হঠাৎ খারাপ হয়ে গিয়েছে। সে, যে গ্রুপ অব কোম্পানীতে পাঁচ-বছর যাবৎ চাকরি করছে, আজ সেই কোম্পানীর বার্ষিক সাধারণ-সভা ছিল। সভাশেষে সে জানতে পারলো, আজই কয়েকজনকে হঠাৎ প্রমোশন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেখানে তার নাম নেই।সে আগে থেকে শুনছিল, সে এবার প্রমোশন পাবেই। কারণ, এই পাঁচ-বছরে তার একটি প্রমোশনও হয়নি। এতোদিন সে শুধু শুনেছে, তার হবে-হবে! আর এই আশ্বাসবাণী একসময় তার জীবনে বিশ্বাসে পরিণত হয়েছিলো। সে এই কোম্পানীর জন্য অনেক পরিশ্রম করেছে। তাই, তার এবং তার কয়েকজন সহকর্মীর সাংঘাতিক-রকমের ধারণা ছিল যে, সে এই বৎসর প্রমোশন পাবেই।

তার মনটা খারাপ হয়ে গেল। সে কোম্পানীর মার্কেটিং-বিভাগে কাজ করে। আর এজন্য সে নিজের দেহের রক্ত পানি করে কোম্পানীর স্বার্থে দিনের-পর-দিন, মাসের-পর-মাস, আর বছরের-পর-বছর পার করেছে।

মন খারাপ হয়ে গেলে সে আর অফিসে কাজ করতে পারে না। তবুও সে লাঞ্চের পরে মন দিয়ে কাজ করার চেষ্টা করছিল। হঠাৎ তার রুমে এলো কোম্পানীর জেনারেল ম্যানেজার। সে এসে সাজেদের কাঁধে হাত রেখে বললো, “তোমার এখনও অনেক বয়েস আছে। মন দিয়ে কাজ করে যাও। সামনের বছরে আমরা তোমার নাম আবার “প্রোপজ” করবো। তোমার প্রমোশন এবার নিশ্চিত।”
কথাটা শোনার পর থেকে সাজেদের মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল। তার মনে হলো, এধরনের লোককে আর বিশ্বাস করা যায় না। বিশেষতঃ এই চরিত্রের মানুষ! যে কিনা তার প্রমোশনের নাম “ক্যানসেল” করে দিয়ে মাত্র আটমাস আগে তার সমমর্যাদার পোস্টে জয়েন করা একটা মেয়ের নাম অগ্রাধিকারভিত্তিতে প্রমোশন-লিস্টে দিয়েছে।

সাজেদ এই কথাটা ভাবছিলো, আর লজ্জায় মরে যাচ্ছিলো। দেশে হচ্ছেটা কী?একটা সামান্য মেয়ের জন্য মানুষ নীতি-নৈতিকতা-বিসর্জন দিতে একসেকেন্ড বিলম্ব করছে না।

মেয়েটি সুন্দরী! আর তার বয়স চব্বিশ! আর তার সঙ্গে অসম্ভব আকর্ষণীয় ফিগার। তাই, কী? কিন্তু এই অদ্ভুত-সমীকরণের কাছে ধূর্ত-শিয়ালগুলো সবকিছু জলাঞ্জলি দিয়েছে। সাজেদ কাজ ফেলে, আপনমনে ভাবতে লাগলো, সে এই ভয়াবহ-সমীকরণের কাছে হেরে গেছে। আর অফিসের কিছু কর্তাব্যক্তিদের কাছে এই “সুন্দর!চব্বিশ বছর!আর আকর্ষণীয় ফিগার!” এখন সবচেয়ে দামি।আর এটাই তাদের গবেষণার বিষয়।

কর্তাব্যক্তিদের এহেন লাম্পট্য তাকে ভাবিয়ে তুললো। সে কোনোকিছু বুঝতে না পেরে দ্রুত অফিস থেকে বেরিয়ে এলো। হাঁটতে-হাঁটতে সে অনেকদূরে চলে এলো। তারপর তার মনে হলো গাড়িতে চড়তে হবে। বাসায় ফিরতে হবে। আর-একটা চাকরির জন্য আজ-এখনই দরখাস্ত লিখতে হবে।

সন্ধ্যার আগে সে বাসায় ফিরলো।তাকে দেখে তার স্ত্রী আজ একটু অবাকই হলো।‘আজ এতো সকালে যে’!—স্ত্রীর ভ্রুকুটি এড়িয়ে সাজেদ বললো, “না এমনিতে। আজ অফিসে কয়েকজনের প্রমোশন হয়েছে তো, তাই। একটু আগে ছাড়া পেয়েছি আরকি।” আসল কথাটা স্ত্রীর কাছে চেপে, আর বুকে একটা প্রচণ্ডরকমের কষ্ট নিয়ে সাজেদ সোজা তার কম্পিউটার-টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালো।
সাজেদ কম্পিউটার চালু করেও চাকরির দরখাস্ত লিখতে পারছিলো না। তার মাথায় শুধু নানান কথা ঘুরপাক খাচ্ছিলো। সে কী করবে বুঝতে পারছিলো না। তার কখন্ও বুকে ব্যথা হয়নি।আজ যেন সে হঠাৎ বুকে ব্যথা অনুভব করছে। তার মনটা আসলেই খুব খারাপ।তবে পঁয়ত্রিশ বছরের সাজেদ একেবারে ভেঙ্গে পড়লো না। সে অল্পসময়ের মধ্যেই নিজেকে আবার সামলে নিলো।

একসময় সে কম্পিউটারের কী-বোর্ড চেপে-চেপে কষ্ট করে লিখতে থাকে: আমি চব্বিশ বছরের কাছে হেরে গেছি। আর আজ আমার বয়সটা যদি চব্বিশ হতো! আর আমি যদি আমার অফিস-কলিগ শ্রাবন্তীর মতো ফিগার নিয়ে পৃথিবীতে জন্মাতাম! তাহলে, এই পাঁচ-বছরে আমি হতাম কোম্পানীর হোমরাচোমরা-গোছের একটা-কিছু। আর হয়তো এতোদিনে একজন জেনারেল ম্যানেজার হয়ে যাওয়াও অসম্ভবের কিছু ছিল না।

স্ত্রীর ডাকে তার লেখা থেমে যায় না। কখন যে তার স্ত্রী এক-কাপ চা নিয়ে তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, সে তা খেয়ালই করেনি। তবুও সাজেদ স্ত্রীকে কিছু-না-বলে লিখে চলে, আজ আমার বয়স যদি চব্বিশ বছর হতো!…

সাইয়িদ রফিকুল হক
মিরপুর, ঢাকা, বাংলাদেশ।

সাইয়িদ রফিকুল হক সম্পর্কে

সাইয়িদ রফিকুল হক ( Syeed Rafiqul Haque) তিনি একজন সাহিত্যসেবী, গ্রন্থপ্রেমিক ও রাজনীতি-সচেতন মানুষ। বাংলাদেশ, বাংলাভাষা ও বাংলাসাহিত্য তাঁর কাছে সবসময় প্রিয়, এবং এই তিনটি তাঁর কাছে চিরদিন পবিত্র শব্দ। তিনি বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে সংঘটিত মহান মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষশক্তি। তাঁর লেখালেখিতেও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনার ছাপ সুস্পষ্ট। আর তিনি সবসময় ঘৃণা করেন রাজাকার, ধর্মান্ধ ও ধর্মব্যবসায়ীচক্রকে। ধর্মবিশ্বাসে তিনি ত্বরীকতপন্থী সুন্নীমুসলমান। আর জীবনের সর্বক্ষেত্রে তিনি একজন পুরাপুরি আস্তিক। তিনি জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক। একজন খাঁটি বাঙালি ও বাংলাদেশী। সাহিত্যচর্চা: তিনি নামে-বেনামে ও ছদ্মনামে লেখালেখি করছেন দীর্ঘদিন যাবৎ। মূলত তিনি কবি, লেখক ও ঔপন্যাসিক। তিনি স্কুলজীবন থেকে আপনমনে সাহিত্যচর্চা করছেন। তখন লেখাপ্রকাশের তেমন-একটা সুযোগ না থাকায় তিনি তাঁর লেখাসমূহ প্রকাশ করতে পারেননি। বর্তমানে ‘শব্দনীড় ব্লগ’সহ বিভিন্ন ব্লগে তাঁর লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। তাঁর লেখার মূল বিষয়: মানুষ, মানবতা আর দেশ-জাতি-সমকাল। আত্মপ্রচারবিমুখ এক কবি তিনি। স্কুলজীবন থেকে সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করে অদ্যাবধি কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস ইত্যাদি রচনায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। পনেরো বছর বয়সে কবিতা লেখার মাধ্যমে তিনি সাহিত্যচর্চা শুরু করেন। তিনি লিখেছেন অনেক। কিন্তু প্রকাশ করেছেন খুব কম। ইতঃপূর্বে কয়েকটি সাহিত্যপত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে তাঁর লেখাসমূহ আধুনিক-ব্লগগুলোতে প্রকাশিত হচ্ছে। এজন্য তিনি ব্লগগুলোর কাছে চিরকৃতজ্ঞ। তিনি বাস্তববাদী লেখক। আর তাঁর লেখায় কোনো কৃত্রিমতা নাই। তাঁর প্রায় সমস্ত লেখাই দেশ ও জাতির জন্য নিবেদিত। তাঁর লেখার বিষয়: কবিতা, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস ইত্যাদি। তিনি ‘মানবজীবনের গল্প’ রচনায় যথেষ্ট পারদর্শী। এ পর্যন্ত তাঁর রচিত গল্পের সংখ্যা ৩২টি। আর উপন্যাসের সংখ্যা ১৮টি। ছড়াসাহিত্যেও তিনি সমভাবে পারদর্শী। শিক্ষা: প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রতি তাঁর কোনো আগ্রহ নাই। তাঁর কাছে সার্টিফিকেট-সর্বস্ব সাধারণ শিক্ষার চেয়ে কঠোর সাধনায় অর্জিত প্রকৃত জ্ঞানের মূল্য অনেক বেশি। তিনি নিজেকে সবসময় একজন স্বশিক্ষিত মনে করেন। তবে প্রচলিত প্রথার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেছেন। বর্তমানে তিনি বাংলাভাষা ও সাহিত্যবিষয়ক উচ্চতর গবেষণাকর্মে নিয়োজিত। জন্মস্থান: বাংলাদেশ। তাঁর জীবনের লক্ষ্য: লেখালেখির মাধ্যমে আমৃত্যু দেশ, মানুষ আর মানবতার পক্ষে কাজ করা।

6 thoughts on ““আমি চব্বিশ বছরের কাছে হেরে গেছি”

  1. লিখাটি পড়ে মনটা বিষাদে জড়িয়ে গেলো। তারপরও বলবো …
    সার্থক গল্প। শুভেচ্ছা ধন্যবাদ মি. সাইয়িদ রফিকুল হক।

    1. অনেক ধন্যবাদ দাদাভাই। আপনি গল্পটি পড়েছেন বলে আমি আনন্দিত।
      উৎসাহ পেলাম।
      আপনার জন্য শুভেচ্ছাসহhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_rose.gif

  2. * শুভ কামনা নিরন্তর…
    শুভরাত্রি।

    1. আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। আর সঙ্গে রইলো শুভকামনা। আরhttps://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gif

    1. আমরা জাগলে দেশটা বদলাবে ভাই।

      আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
      আর সঙ্গে শুভেচ্ছা।https://www.shobdonir.com/wp-content/plugins/wp-monalisa/icons/wpml_flowers.gif

মন্তব্য প্রধান বন্ধ আছে।