কেন যেন আজ সাকিরে মনটা ভাল লাগছে না। এশার নামায আদায় করে ঘরে এসে বসলো। ইচ্ছে হলো দেয়ালে ঝুলানো ক্যালেন্ডারটির প্রতি চোখ বুলাতে। আর মাত্র পনের দিন বাকী ঈদের। অনেকদিন যাবত বাবাকে কোন চিঠি লেখা হয়নি। তাই মনে মনে ভাবছে সে, ঈদ তো প্রায় নিকটবর্তী। এবারের ঈদে বাড়িতে যেতে হবে। কাজেই বাবাকে একখানা চিঠি লেখার প্রয়োজন। কলম ও প্যাড নিয়ে বসে পড়লো সে। চিঠি লিখতে লিথতে রাত ১০টা বেজে গেছে তার কোন খেয়াল নেই। কাজেই আর দেড়ী করা যাচ্ছে না, এখনি শুয়ে পড়তে হবে। কারণ ভোর রাতে উঠে পড়তে হবে। সামনে তার দাখিল পরীক্ষা। সে ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করছে। ঈদের পর পরই তার ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হবে। পরদিন সকাল বেলা তাড়াতাড়ি চিঠিটা পোস্ট করে দিল।
দিন যায় রাত আসে এভাবে কেটে গেল ১০দিন।
আজ ডাক পিয়ন এসে আঙিনায় পা রাখতেই তাছলিমা এগিয়ে আসলো। পিয়ন মুচকি হেসে বললো, এই নাও তোমার ভাইয়ার চিঠি। চিঠি পেয়ে তাছলিমা আনন্দে নেচে উঠলো। দ্রুত মা-বাবার কাছে আসলো। মা, ভাইয়ার চিঠি এসেছে।
মা বললেন, কখন এলরে?
এইতো মা এখন পিয়ন চাচা দিয়ে গেল।
মা রহিমা বেগম দেখি বলে চিঠিটা হাতে নিলেন। আনন্দে চোখ থেকে দু’ফোটা অশ্রু খসে পড়লো।
বাবা কবির সাহেব বললেন পড়তো দেখি কি লিখেছে?
তাছলিমা মার হাত থেকে খামটি নিয়ে ছিঁড়ে পড়তে লাগলো।
শ্রদ্বেয় আব্বাজান,
পত্রের শুরুতে আপনার প্রতি রইল আমার ভক্তিপূর্ণ সালাম ও আন্তরিক শ্রদ্ধাবোধ। আশা রাখি মহান প্রভুর অশেষ কৃপায় মা ও বোনকে নিয়ে ভাল আছেন। ভাল থাকাই আমার কামনা। আমিও আপনাদের দোয়ায় বন্ধুদেরকে নিয়ে ভাল আছি।
পরসংবাদ এই যে, আব্বা পবিত্র ঈদুল আযহা উপলক্ষ্যে আমাদের মাদ্রাসা ১০দিন বন্ধ থাকবে। তাই আমি এবারের ঈদ বাড়িতে এসে করব। ঈদের দুদিন পূর্বে বাড়িতে আসব। আমার জন্য কোন চিন্তা করবেন না। আমার লেখাপড়া ভালই চলছে। ইতোমধ্যে পরীক্ষার সিলেবাচ প্রায় শেষ করে ফেলেছি। নামাযান্তে অন্তর থেকে আমার জন্য দোয়া করবেন যাতে আমি পরীক্ষায় কামিয়াবী হতে পারি। মাকে আমার সালাম দেবেন। বোনকে আমার স্নেহ ও ভালোবাসা দিবেন।
আর বিশেষ কি লিখব। পরিশেষে আপনার দীর্ঘায়ু কামনা করে আজকের মতো ইতি টানলাম।
ইতি
আপনার স্নেহের ছেলে
সাকিব
চিঠিটা পড়া শেষ হতেই মা-বাবার চোখে মুখে যেন একটা খুশীর ছাপ ফুটে উঠল। আনন্দ ভরা কণ্ঠে কবির সাহেব স্ত্রী রহিমাকে বললেন, ঈদ কি বারে হবে?
শুক্রবারে।
তাহলে আর কদিন বাকী?
এতো পাঁচদিন।
তাহলেতো ঈদ প্রায় নিকটবর্তীই?
হ্যাঁ।
আর মাত্র দু’দিন বাকী ঈদের। আজই সাকিব বাড়িতে যাওয়ার জন্য রওয়ানা হবে। ইতোমধ্যে মাদ্রাসা ছুটি হয়ে গেছে। ঈদুল আযহা উপলক্ষ্যে এই বিশাল ঢাকা শহর থেকে অধিকাংশ লোকই গ্রামের বাড়িতে ঈদ করতে যায়। প্রতিটা চাকুরীজীবিই তার মা-বাবা, ভাই-বোনের সাথে একত্রে ঈদ করতে চায়। ঘরমুখী যাত্রীরা ঈদের ছুটি কাটানোর জন্য ইতোমধ্যে বাড়িতে চলে যাচ্ছে।
আজ সকাল ১০টায় সাকিব বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিবে। কাজেই আর বিলম্ব না করে সে রিক্সা নিয়ে রওয়ানা হয়ে গেল। সে দুইদিন পূর্বেই টিকেট কেটে রেখেছে। কারণ ঈদে যেই ভীড় তাছাড়া আর কোন উপায় নেই। ঈদ উপলক্ষে ভাড়া দ্বিগুণ। মনে হয় তারা দেশটাকে মগের মুল্লুক পেয়েছে। সাকিব বাসস্টেশন এসে দেখতে পেল প্রচন্ড ভীড়। পিঁপড়া হাঁটার জায়গা পর্যন্ত নেই। নারী-পুরুষ একত্রে লেপটা লেপটি করে গাড়িতে উঠছে। কেউ কেউ বা বাদুরের মতো গাড়ীতে ঝুলে যাচ্ছে। বাংলাদেশে যে সত্যিই ষোল কোটি তা ঈদ না এলে পুরোপুরি বুঝা যায় না।
সাকিবের মনটা ছটফট করতে লাগল কখন বাড়ীতে ফিরবে। সে গাড়িতে উঠার কিছুক্ষণ পর সাকিব গাড়ীতে কান্নার শব্দ পেল। সাকিব সে দিকে খেয়াল করতেই দেখতে পেল কয়েকজন জিন্স প্যান্ট পরিহিত যুবক। দেখতে কলেজ, ভার্সিটির ছাত্রদের মতো। তাদের হাতে অস্ত্র! তারা একজন ভদ্রলোককে লক্ষ্য করে তারা টিকেট কেটে এ বাসে উঠেছে। যুবকগুলোর উদ্দেশ্য ঐ ভদ্রলোককে হত্যা করে তার টাকা-পয়সা সব লুট করে নিয়ে যাওয়া।
একজন ডাকাত বলে উঠলো, সাবধান কেউ চিৎকার করবে না। তাহলে সবাইকে খতম করে ফেলব।
ডাকাতদের কথা শুনে ভয়ে সাকিবের শরীরের লোম কাটা দিয়ে উঠল। আর মনে মনে সে আল্লাহর নাম স্মরণ করল। লোকটির হাতে ছিল একটি ব্রিফকেস। ডাকাতদের মধ্য হতে একজন পিস্তল নিয়ে লোকটির নিকট গেল। পরে তার কাছে টাকার ব্রিফকেসটা চাইল। ভদ্রলোকটি ব্রিফকেসটি দিতে চাইল না। এমন অবস্থায় অন্য একজন ডাকাত লোকটির পেটের মধ্যে চাকু ঢুকিয়ে দিল। ভদ্রলোকটি তখন একটি চিৎকার দিয়ে সাথে সাথে মারা যায়। রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেল গাড়ি। ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়ছে। সমস্ত গাড়ি নিরব নিস্তব্ধ হয়ে গেল। যাত্রীদের কারো মুখে কোন শব্দ নেই। মুহূর্তে শোকের ছায়া পড়ে গেল গাড়িতে।
একজন যুবক ড্রাইভারকে লক্ষ্য করে বললো, সাবধান কোথাও গাড়ী থামানোর চেষ্টা করবে না। তাহলে বুঝতে পারবি পরিণাম কি হয়। তারপর কয়েকজন ডাকাত মিলে ভদ্রলোকের মৃতদেহটি টেনে হেচরে বের করে চলতি গাড়ি থেকে ফেলে দেয়। গাড়ি অল্প কিছুদুর যাওয়ার পর যুবকগুলো ড্রাইভারকে গাড়ি থামানোর কথা বলে। ড্রাইভার গাড়ি থামানোর পর ডাকাতগুলো ব্রিফকেস নিয়ে নেমে পড়ল। সাথে সাথে যাত্রীদের কোলাহল বেড়ে গেল। সবাই লোকটির জন্য আপসোস করতে লাগল।
আজ ছেলে বাড়িতে আসবে তাই রহিমা বেগমের মনটা খুশী লাগছে। কখন ছেলে বাড়ি ফিরবে সেই প্রহর গুনছে পাথের পানে তাকিয়ে। কবির হোসেনও ছেলের প্রতিক্ষায় বসে আছেন।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল। আস্তে আস্তে সূর্যের ত্যাজ কমে এলো। বিকেলের আগমন বার্তা জানিয়ে দিল মসজিদ থেকে মুয়াজ্জিন আযান দিয়ে।
সাকিব বাড়িতে এসে ‘মা’ ডাক দিতেই রহিমা বেগম বললেন, কিরে বাবা কেমন আছিস?
সাকিব মুখ বিবর্ণ করে জবাব দিল বেশী ভাল না।
হ্যাঁ, তাইতো তোর মুখটা ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। কি হয়েছে তোর?
ইতিমধ্যে সাকিবের আগমন বার্তা শুনে তাছলিমা ও কবির হোসেন আসলেন। সাকিব তার বাবাকে লক্ষ্য করে বললো, আব্বা আজ আসার পথে আমার চোখের সামনে এক ভদ্রলোকে খুন করতে দেখলাম।
একথা শুনার সাথে সাথে কবির হোসেনের হৃদয়টা ছ্যাৎ করে উঠল।
রহিমা বেগম চিৎকার দিয়ে বললেন, কি বলিস বাবা! তোর কিছু হয়নিতো?
না মা, আমার কিছু হয়নি। আমাদের চোখের সামনে এ সমস্ত ডাকাতরা বেড়ে উঠছে অথচ আমাদের দেশের সরকার এ ব্যাপারে কোন পদক্ষেপ নিচ্ছেন না।
মা বললেন, চল ঘরে আয়। হাত মুথ ধুয়ে খেয়ে নে।
ছেলে সুস্থ্য দেহ নিয়ে বাড়িতে এসে ফিরছে বিধায় রহিমা বেগম আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করে নিলেন।
আজ সেই প্রতিক্ষিত ঈদ। বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনায় পালিত হচ্ছে ঈদুল আযহা। চারদিকে আনন্দ ছড়িয়ে পড়ল। সাজ সাজ রব। চারপাশে শিশু-কিশোরদের কোলাহল চলছে। বাড়ি বাড়ি ফিরনি সেমাই খাওয়ার প্রতিযোগিতা চলছে। সবার আনন্দে কবির হোসেন পরিবারও আজ আনন্দিত। আতর গোলাপ দিয়ে নানা রঙ বেরঙের পোশাক পড়ে ছেলে-মেয়েরা ঈদগাহের দিকে যাচ্ছে। পায়ে হেঁটে ঈদগাহের দিকে যাচ্ছে সাকিব। যথাসময়ে ঈদের নামাজ আদায় করলো। ঈদগাহে অনেক বাল্য বন্ধুদের সাথে দেখা হলো। নামায শেষে তাদের সাখে কোলাকুলি করল। পরে তার বাবা ও বন্ধুদেরকে নিয়ে দাদা-দাদীর কবর জিয়ারত করে বাড়ি ফিরল।
রচনাকাল-২৮ জুলাই ২০০০ খ্রিস্টাব্দ।
ট্যাগ আর্কাইভঃ আমির ইশতিয়াকের গল্প
অসহায়
এই রিক্সা যাবে।
কৈ যাবেন আফা?
গুলিস্তান।
ভাড়া কত?
৪০ ট্যাহা।
৩০ টাকায় যাবেন।
না, যাব না।
৩১ টাকায় যাবেন।
না- যাব না।
ঠিক আছে, আরো দুই টাকা বাড়িয়ে দিব। ৩৩ টাকা দিব। যাবেন।
আফা এইডা কি মাছের বাজার পাইছেন? ৪০ ট্যাহার নিচে এক ট্যাহা কম হলেও যাব না। এই বলে রিক্সাওয়ালা চলে গেল।
মনিরা সামনে হাঁটছে। কিছুক্ষণ পর আবার আরেক রিক্সাওয়ালা সামনে দিয়ে যাচ্ছেÑ ঐ রিক্সা যাবেন।
কৈ যাইবেন আফা?
গুলিস্তান।
যাবনা।
কেন যাবেন না?
তা ক্যান কমু আপনাকে।
রিক্সাওয়ালার জবাবে মনিরা তখন বেকুব হয়ে গেল। কিছুদূর হেঁটে আবার আরেক রিক্সাওয়ালাকে ডাক দিলো, এই রিক্সা যাবেন।
যামু। কৈ যাবেন?
গুলিস্তান।
আহেন।
ভাড়া কত?
৫০ ট্যাহা। ১০ মিনিটের রাস্তা হেটে চলে আসলাম। ১০ মিনিট আগে একজন বলল ৪০ টাকা আর এখনও তুমি বলছ ৫০ টাকা!
ভাড়া ৫০ ট্যাহাই। তয় ৪৫ ট্যাহা যাবেন।
না।
৩৪ টাকায় যাবেন।
কি কইলেন ৩৪ ট্যাহা! রিক্সাওয়ালা মুখ ভেংচিয়ে বললো, হাইট্টা যান ট্যাহা লাগবে না।
মনিরা আর কোন কথা না বাড়িয়ে হাঁটতে লাগল। আবার সামনে একটি রিক্সাওয়ালাকে পেয়ে জিজ্ঞেস করতেই সে ভাড়া চাইল ৪০ টাকা। এবার মনিরার মেজাজটা চড়া হয়ে গেল। কোথায় বাস করছি আমরা। ১৫মিনিটের রাস্তা হেঁটে আসার পরও ভাড়া কমছে না। তাই এবার মনিরা সিদ্ধান্ত নিল হেঁটেই গুলিস্তান যাবে এবং রিক্সা ভাড়ার টাকা দিয়ে কোন কিছু খেয়ে ফেলবে।
অবশেষে মনিরা শাহবাগ থেকে গুলিস্তানের উদ্দেশ্যে হাঁটতে লাগল। মনিরা হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে পড়ল। দীর্ঘ ৩০ মিনিট হেটে গুলিস্তান এসে পৌঁছল। ৩০মিনিট হেঁটে তার এখন ৩৪ টাকা আয় হলো।
মনিরা এখন কিছু খাওয়ার জন্য সামনেই একটি হোটেলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। এমন সময় পিছন থেকে এক ছিনতাইকারী মনিরার ভ্যানিটি ব্যাগটি ছিনতাই করে দৌঁড় দেয়। ভ্যানিটি ব্যাগটি ধরে যখন ছিনতাইকারী আচমকা টান দেয় তখন মনিরা মাটিতে পড়ে যায়। মাটি থেকে উঠে পিছনে তাকিয়ে দেখে তার ভ্যানিটি ব্যাগ নেই এবং ছিনতাইকারী দৌঁড়ে পালাচ্ছে। এ দৃশ্য দেখে মনিরা চিৎকার করে বলছে, ছিনতাইকারী চলে যাচ্ছে। কে আছেন ভাই ওকে ধরেন। কিন্তু আশে পাশের মানুষজন সিনেমার দৃশ্যের মতো উপভোগ করছে কেউ তাকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেনি। কিছুক্ষণ চিৎকার চেচামেচির পর মনিরা মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়ল। কারণ ভ্যানিটি ব্যাগে ছিল তার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও দুই হাজার টাকা ও মোবাইল। সে এখন ভাবছে এ কোন আজব দেশ। দিনের বেলাও নিরাপদে চলাফেরা করা যায় না। এভাবে সকলের চোখের সামনে আমার টাকাগুলো নিয়ে গেল, কেউ একটু সাহায্যও করল না। এতগুলো লোকের সামনে দিয়ে নিরাপদে ছিনতাইকারী পালিয়ে গেল। এখন আমি কি করব। কিভাবে আমি বাসায় ফিরব। আমার কাছেতো আর কোন টাকা পয়সা নেই। এইসব বিষয় ভাবতে ভাবতে মনিরা কান্নাকাটি করতে লাগল।
এতক্ষণে আশেপাশের অনেক লোক তাকে ঘিরে ফেলল। উৎসুক জনতার কেউ কেউ এখানে হয়তো কোন সুটিং চলছে ভেবে এগিয়ে আসছে। কেউ হয়তো কোন দুর্ঘটনা হয়েছে ভেবে এগিয়ে আসছে। কাছে এসে যখন আসল ঘটনা জানতে পারে তখন সবাই চলে যাচ্ছে। কেউ কেউ যাবার বেলায় বলছে এটা ঢাকা শহরের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এমন চুরি ছিনতাই অহরহ ঘটছে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায়।
এক পথচারী মনিরার সামনে এসে বলছে, এখন কান্নাকাটি করে লাভ নেই বাড়ি ফিরে যান। তানাহলে আরো অন্য কোন বিপদে পড়তে পারেন। এটা ঢাকা শহর। বলতে পারেন বিপদের শহরও!
মনিরা কাঁদো কাঁদো স্বরে বলছে, ভাই এখন আমি কি করে বাড়ি যাব। আমার কাছেতো কোন টাকা পয়সাও নেই। সবইতো ঐ ছিনতাইকারী নিয়ে গেছে।
তাতে কি হয়েছে। রাস্তাঘাটে কতলোকজন আছে। সাহায্য চান। কেউ না কেউ দিবে। এই বলে লোকটি চলে গেল।
এভাবে একে একে সব লোকই পর্যায়ক্রমে মনিরার কাছ থেকে চলে গেলো। অনেকেই সুন্দর সুন্দর পরামর্শ দিয়ে গেছে কিন্তু তার সাহায্যে কেউ এগিয়ে আসেনি। বরং উল্টা তারা মনিরাকে ভয় দেখিয়ে গেছে।
এদিকে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। মনিরা গভীর চিন্তায় পড়ে গেল। কিভাবে বাড়ি ফিরবে। কার কাছে টাকা সাহায্য চাইবে। কিছুই ভেবে পাচ্ছে না। এই শহরের অলিগলি তেমন চেনাজানা নেই। কারণ সে এই শহরে এসেছে বেশী দিন হয়নি। মাত্র এক মাস হয় ঢাকায় এসেছে। তার আত্মীয়র বাসায় থেকে লেখাপড়া করবে বলে ঢাকায় তার আগমন। ইতোমধ্যে একটি কলেজে ইন্টারমিডিয়েট এ ভর্তিও হয়েছে। গুলিস্তান থেকে তার বাসায় হেঁটে যাওয়াও সম্ভব নয়। কারণ তার বাসা মিরপুর। মিরপুর যেতে হলে তাকে বাসে যেতে হবে। বাসে বিনা টাকায় যাওয়া সম্ভব নয়। ইতিমধ্যে অনেক পথ হেঁটে সে এখন ক্লান্ত। অতীতে এতখানি পথ কোন দিন হাঁটেনি। একদিকে সে ক্লান্ত। অন্যদিকে রাত। আবার বাসা অনেক দূরে। আর কিছু ভাবতে পারছে না মনিরা।
মনিরার কাছে এখন কোন মোবাইলও নেই যে বাসার কাউকে ফোন করে বিষয়টি জানাবে। তাছাড়া নতুন বাসায় এসেছে এখানের নাম্বারও মুখস্ত করেনি। তাদের বাড়ির কেউ তার ঐ বাসার কারোর নাম্বারও জানে না যে তাদেরকে জানাবে। এমন বিপদের সম্মুখীন হয়ে মনিরা ভয়ে ভয়ে ধীর পায়ে সামনে এগুচ্ছে। ভাবছে সব লজ্জা ত্যাগ করে কিছু টাকা সাহায্য চাইবে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন পথচারীর কাছে তার বিপদের কথা বলে সাহায্য চেয়েছে। কিন্তু কেউ তার কথায় কর্ণপাত করেনি। সবাই ধুর ধুর করে বলছে, পুরান পাগলের ভাত নেই নতুন পাগলের আমদানী। ক্লান্ত দেহ নিয়ে মনিরা হাঁটতে হাঁটতে শাহবাগ চলে আসল। ইতোমধ্যে রাত ৮ টা বেজে গেছে। আর হাঁটা তার পক্ষে সম্ভব না। শাহবাগ মোড়ে কোন এক দোকানের সামনে মনিরা বসে পড়ল।
কিছুক্ষণ পর মনিরা সিদ্ধান্ত নিল আর এভাবে হাঁটা যাবে না। বাসে উঠে বসবে পরে যা হবার হবে। মিরপুরের বাসে উঠে বসল মনিরা। কিছুক্ষণ পর কনটাক্ট্রর এসে ভাড়া চাইল মনিরার কাছে।
মনিরা তার বিপদের কথা কনটাক্ট্ররকে বুঝিয়ে বলল। কিন্তু বদ মেজাজী কনটাক্ট্রর কিছুতেই তার কথা বিশ্বাস করল না। ধান্দাবাজীর আর জায়গা পাওনা। ভাড়া দাও নইলে বাস থেকে নামিয়ে দিব।
প্লিজ ভাই আমি বড়ই বিপদে আছি আমাকে নামিয়ে দিবেন না। আবার যদি কোনদিন দেখা হয় আমি আপনার ভাড়া দিয়ে দিব।
এসব সিনেমার ডায়লগ ছেড়ে ভাড়া দেন। বেশীক্ষণ আপনার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে পারুম না। অন্যদের ভাড়া কাটতে হবে।
শত অনুরোধ করেও যখন কোন কাজ হলো না তখন কনটাক্ট্রর মনিরাকে টেনে হেঁচরে নামিয়ে দিল ফার্মগেটের ওভারব্রিজের নিকট। এদিকে রাত এখন ৯ টা বাজে। ধীরে ধীরে রাত গভীর হতে লাগল। মনিরা ওভার ব্রীজের নীচে বসে পড়ল। তার চোখে ঘুম আসছে।
এদিক দিয়ে মনিরার পাশ দিয়ে এক লোক হেটে যাচ্ছে। বয়স চল্লিশের উপরে হবে। তাকে দেখে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। ব্যাপার কি দেখতে ভদ্র ঘরের মেয়ে কিন্তু এখানে বসে এভাবে জিমাচ্ছে কেন? একটু কাছে গিয়ে দেখে আসি। ঐ লোক মনিরার কাছে আসল। এ মেয়ে কে তুমি?
মনিরা চমকে উঠল। আমি, আ…মি.।
হ্যাঁ কে তুমি?
আমি মনিরা।
এখানে কি করছ?
জানেন ভাই আমি খুব বিপদে আছি।
বিপদ! কিসের বিপদ!!
আমার ভ্যানিটি ব্যাগ চুরি হয়ে গেছে। টাকা পয়সা, মোবাইল সব নিয়ে গেছে। বাসায় যাওয়ার কোন ভাড়া নেই। তাই এখানে বসে চিন্তা করছি কি করব।
কি বলছ তুমি চুরি হয়ে গেছে! কোন সমস্যা নেই। আমি তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিব।
আপনি আমাকে বাসায় পৌঁছে দিবেন!
হ্যাঁ।
আমিতো আপনাকে চিনি না।
এই দুনিয়ায় কি সবাই সবাইকে চিনে বোন।
বোন! আপনি আমাকে বোন ডাকলেন?
হ্যাঁ তুমি আমার বোন। ভাইয়ের দায়িত্ব বোনের বিপদে সহযোগিতা করা।
সত্যি আমাকে সহযোগিতা করবেন?
অবশ্যই। তোমার বাসা কোথায়?
মিরপুর।
আমার বাসাতো মিরপুর।
কত নম্বর।
১১ নম্বর।
কি কাকতালীয় মিল। আমিও ১১ নম্বর থাকি।
তাই নাকি!
কোন চিন্তা নেই। আমি তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিব।
মনিরা লোকটির মিঠা কথায় একটু আশার আলো খুঁজে পেল। এবার মনে হয় বাসায় যাওয়া যাবে। দুনিয়ায় এত ভালো মানুষ আছে তা ভাবতে পারে না সে। লোকটি যখন আমাকে বোন বলে ঢেকেছে তাহলে তার সাথে চলে যাব। যেই ভাবা সেই কাজ। মনিরা রাজি হয়ে গেল। ঠিক আছে আমি আপনার সাথে মিরপুর যাব। বাসায় গিয়ে আপনার ভাড়া পরিশোধ করে দিব।
ছি: ছি: এ কথা বলে না বোন। সামান্য কটা টাকা বাসায় গিয়ে পরিশোধ করতে হবে কেন? কোন টাকা লাগবে না। কোন ভাই কি ছোট বোনের কাছ থেকে টাকা নিতে পারে।
মনিরার বিশ্বাস আরো বেড়ে গেল।
ঠিক আছে চলুন ভাইয়া।
ঠিক আছে চল।
এবার মনিরা উঠে দাঁড়াল। দু’জন মিরপুরের বাসে উঠে বসল। পাশাপাশি সিটে দু’জন বসল। মনিরা জানে না কোথায় সে পা বাড়াল। তার বিশ্বাস লোকটি তাকে বাসায় পৌঁছে দিবে। কিন্তু না কিছুক্ষণ পরই লোকটি আসল চেহারা উম্মোচিত হলো। সে পকেট থেকে একটি রুমাল বের করে মনিরার নাকে ঘষা দিল। আর অমনি মনিরা অজ্ঞান হয়ে গেল।
এর কিছুক্ষণ পর লোকটি ড্রাইভারকে গিয়ে বলছে, ভাইজান আমার বোন অজ্ঞান হয়ে গেছে তাকে হাসপাতালে নিতে হবে গাড়িটা এখানে একটু থামান। ড্রাইভার গাড়ি থামানোর সাথে সাথে লোকটি মনিরাকে নিয়ে গাড়ী থেকে নেমে পড়ল।
পড়ে লোকটি মনিরাকে একটি যৌন পল্লীতে নিয়ে গেল। যেখানে গ্রামের সহজ সরল ও অসহায় মেয়েদেরকে নিয়ে আসা হয়। মুখোশধারী লোকটি মূলত ঐ যৌন পল্লীর দালাল। তার কাজ সারাদিন শহরে বা গ্রামে ঘুরাঘুরি করে অসহায় মেয়ে খুঁজে বের করে এখানে নিয়ে আসা। আর তাদেরকে পেলে অসায়ত্বকে পূজি করে সরলতার সুযোগে তাদেরকে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে এখানে নিয়ে আসে এবং যৌন পল্লীর মালিকের কাছে বিক্রি করে দেয়। যাদেরকে একবার এখানে নিয়ে আসা হয় তারা আর কোনদিন তাদের আসল ঠিকানা খুঁজে পায় না। হয় তাদেরকে এখানে থেকে যৌনকর্মী হিসেবে জীবন যাপন করতে হয় নতুনা মৃত্যুবরণ করতে হয়। এসব অসহায় নারীদের দিয়ে যৌন পল্লীর মালিকরা ব্যবসা করে। এই কাজের বিনিময়ে তারা কিছু পায় না। শুধু খাবার আর কাপড় চোপড় পায়। মালিক প্রত্যেক খদ্দের থেকে ২০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত নেয়। অনেক অসহায় নারী এখান থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করলেও বেরিয়ে আসতে পারে না। কারণ স্থানীয় লোকজন তাদেরকে বের হতে দেয় না।
মনিরাকে অজ্ঞান অবস্থায় মুখোশধারী দালাল লোকটি যৌন পল্লীতে নিয়ে আসার পর যৌন পল্লীর মালিক খুব খুশী হয়। এই যৌন পল্লীতে আরেকটি অদ্ভুদ কাজ করা হয় তাহলো, যে দালাল যে মেয়েকে এখানে নিয়ে আসবে তাকে প্রথমে সে ভোগ করবে তার ইচ্ছামতো। সেই মতে আজকের রাতটি মুখোশধারী দালালটির জন্য বরাদ্দ হলো। মনিরাকে অজ্ঞান অবস্থায় রেখে সে সারারাত তাকে ভোগ করল। ছিন্নভিন্ন করে দিল মনিরার ফুটন্ত যৌবন। নরপশু সারারাত তার দেহটাকে নিয়ে খেলা করল।
সকাল বেলা মনিরার জ্ঞান ফিরল। চারদিকে তাকিয়ে দেখে এটা তার বাসা নয় অপরিচিত একটি জায়গা। তার চার পাশে অসংখ্য নারী দাঁড়িয়ে তাকে স্বাগত জানাচ্ছে।
চারদিকে তাকিয়ে মনিরা বললো, কে তোমরা?
চার পাশ থেকে হাসির আওয়াজ এল। হা… হা…।
আমরা তোমার বান্ধবী। আমরা এক সাথে থাকব। একসাথে খেলা করব।
এসব কি বলছেন? আমি এখানে কেন? এটা কোন জায়গা?
যৌন পল্লীর মালিক বলল, এটা তোমার শেষ ঠিকানা। এখান থেকে ফেরার কোন পথ নেই। এখানেই তোমাকে এখন থেকে থাকতে হবে।
না না এ হতে পারে না। আমার ভাইয়া কোথায়?
কে তোমার ভাইয়া?
তার নাম জানি না।
ও যে তোমাকে নিয়ে আসছে তাকে খুঁজছ? তাকে আর দেখতে পাবে না। তার কাজ শেষ। এবার যা করার আমরা করব।
না আমি এখানে থাকব না এখনই চলে যাব। এই বলে মনিরা বিছানা থেকে উঠার চেষ্টা করল। কিন্তু উঠতে পারছে না। কোমরের ব্যথায় শরীর অস্তির হয়ে গেছে। সারারাত তার উপর পৈশাষিক নির্যাতন হয়েছে তা সে বলতেই পারবে না। কোন রকমে সে উঠে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে দেখতে পেল বিছানায় রঙের দাগ!
একি এ অবস্থা কেন আমার! চমকে উঠল মনিরা।
দৌঁড় দেয়ার চেষ্টা করল কিন্তু মালিক খপ করে তাকে ধরে বলল, কোথায় যাও। এখানে যে একবার আসে সে আর ফিরে যায় না।
এ কথা বলার সাথে মনিরা আবার অজ্ঞান হয়ে গেল।
রচনাকাল- ১ অক্টোবর-২০১৪খ্রি:
অপেক্ষা
পদ্মা নদীতে এখন যেন কান্নার ঢেউ। চলছে পদ্মাপাড়ে স্বজন হারানো মানুষের আহাজারি। কিছুদিন পূর্বে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া ঘাটের কাছে পদ্মা নদীতে তিন শতাধিক যাত্রী নিয়ে ডুবে যায় পিনাক-৬ লঞ্চ। এই লঞ্চডুবিতে নিহত হয় দিনমজুর খবির উদ্দিনের তিন মেয়েও স্ত্রী। কন্যা ও স্ত্রীর খুঁজে আজ প্রায় এক মাস যাবত পদ্মার পাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন খবির উদ্দিন। ভয়াবহ এ দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে ফিরেছেন যাঁরা, তাঁরা নেহাতই ভাগ্যবান। অনেকেই লঞ্চে উঠেছিলেন পরিবারের সবাইকে নিয়ে। নিজে বেঁচে গেছেন কিন্তু হারিয়েছেন পরিবারের অন্যদেরকে। কিন্তু হতভাগ্য খবির উদ্দিনের পরিবারের কেউ বেঁচে নেয়।
তিন কন্যা ও স্ত্রী নিয়ে ছিল খবির উদ্দিনের পরিবার। তিন কন্যার নাম তিনি আদর করে রেখেছিলেন স্মৃতি, বীথি ও ইতি। ঈদ উপলক্ষে তিন কন্যা তার মাকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকায় চাচার বাড়ীতে বেড়াতে যাচ্ছিল। আর ফিরে আসল না। একটি দুর্ঘটনা মুহূর্তে তছনছ করে দিল খবির উদ্দিনের পরিবারকে। প্রায় একমাস হলো লঞ্চডুবল এখনও তাদের সন্ধ্যান পাননি খবির উদ্দিন। কি হলো তাদের, কোথায় আছে তা কিছুই জানেন না। শুধু অপেক্ষা আর অপেক্ষা। কখন ফিরবে তারা। কখন দেখবে তাদের মুখ। জীবিত বা মৃত অবস্থায় দেখতে চায় তিন কন্যা ও স্ত্রীকে। তিন কন্যা ও স্ত্রীর খুঁজে খবির উদ্দিন প্রায় পাগল হয়ে গেছেন। নাওয়া খাওয়া নেই। চোখ বেয়ে সারাক্ষণ শুধু পানি পড়ে। পাগলের মতো পদ্মার পাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। যতদিন উদ্ধার কাজ চলছিল ততদিন তিনি উদ্ধারকর্মীদের কাছাকাছি থেকেছেন। কিন্তু তার তিন কন্যা ও স্ত্রী লাশ ফিরে পায়নি। দীর্ঘদিন অপেক্ষা করেও তাদের কোন হদিস মেলেনি। যতবারই নদীতে লাশ ভেসে উঠেছে ততই বারই খবির উদ্দিন দৌঁড়ে ছুটে গেছেন লাশের কাছে আর ততবারই নিরাশ হয়ে ফিরেছেন তিনি।
এখন আর উদ্ধার কাজ নেই। কয়েকশ যাত্রী নিখোঁজ রেখে সরকার উদ্ধার কাজ বন্ধ করে দিল। এ কথা ভাবতেই খবির উদ্দিনের বুকটা ছ্যাৎ করে উঠে। আর হয়তো কোনদিন তাদের লাশ দেখাও সম্ভব হবে না। এতদিন আশায় ছিলেন হয়তো তাদের লাশ ফিরে পাবে কিন্তু এখন আর সেই আশাও করতে পারেনি। তাইতো খবির উদ্দিন সিদ্ধান্ত নিল আর বাড়ি ফিরে যাবেন না। মরতে হয় এখানেই মরবেন। যেই নদীতে তার পরিবারের সলিল সমাধী হলো সেখানেই তিনি মরতে চান। কি হবে বাড়ীতে গিয়ে? কার মুখ দেখে তিনি ঘুমাবেন। কোন কিছু তিনি এখন ভাবতে পারেন না।
হাতে গোনা কয়েকটা লাশের সন্ধ্যান মিলল। আর বাকীরা সবাই লঞ্চের ভেতরে অথবা কোথাও না কোথাও ভেসে বেড়াচ্ছে। আজও লঞ্চের সন্ধান মেলেনি। লঞ্চ এখন কোথায় আছে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানে না। খবির উদ্দিনের পরিবারের লোকজন কোথায় আছে তাও আল্লাহ জানেন। তারা কি লঞ্চের ভেতরে নাকি পানির স্রোতে ভেসে গেছে দূরদূরান্তে যা খবির উদ্দিন জানে না।
এমন বিপদের সময় কে দিবে সান্ত¡না খবির উদ্দিনকে। আপনজন বলতে কেউতো তার বেঁচে নেই। যাদেরকে নিয়ে তিনি বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করছিলেন তারাওতো নিষ্ঠুরের মতো না বলে চলে গেল। আল্লাহ ওনাকে তিনটি কন্যা সন্তান দিলেন। কোন ছেলে সন্তান নেই। তাতেও তার কোন ক্ষোভ ছিল না। তাদেরকে নিয়ে তিনি স্বপ্ন দেখতেন। তিন কন্যাকে তিনি সু-শিক্ষায় শিক্ষিত করবেন। তাদেরকে শিক্ষা দেয়ার জন্য সারা জীবন দিনমজুর খবির উদ্দিন খেটেছেন। সাধারণ কৃষি কাজ করে তিনি তিন কন্যাকে লেখাপড়া শিখাচ্ছেন। বড় মেয়ে স্মৃতি এবার অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যায়নরত। মেজ মেয়ে বীথি ইন্টারমিডিয়েট পড়ছে ও ছোট মেয়ে ইতি এবার এস.এস.সি পরীক্ষা দিবে। তিনি স্বপ্ন দেখতেন তিন কন্যাকে এম.এ পাশ করাবেন তারপর তিনি সু-পাত্রের কাছে বিয়ে দিবেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন আর বাস্তবায়ন হলো না। একটি দুর্ঘটনায় ভেঙ্গে গেল তার এতদিনের লালিত স্বপ্ন। পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট পরিবারের চারজনই চলে গেলে দূর অজানায়। তাও আবার তাদের কোন লাশ পাওয়া যায়নি। কবর দেয়ার সুযোগ টুকু পর্যন্ত তিনি পাননি।
সকল প্রাণী মরণশীল। তাই মানুষও মরণশীল। মরার পর তাদের একটি শেষ সমাধিস্থল থাকে। সেই সমাধিস্থলে গিয়ে কবর জিয়ারত করে পারিবারের অন্য সদস্যরা তাদেরকে ভুলে থাকার শান্ত¡না পায়। কিন্তু খবির উদ্দিনের এ কেমন দশা হলো যে, পরিবারের সবাইকে এক সাথে হারাতে হলো এবং তাদের কোন সমাধিস্থলও করতে পারেনি। এমনকি তাদেরকে শেষ দেখাটুকুও দেখতে পারেনি। এমন দুর্ঘটনা কি সহ্য করার মতো। কোন মানুষ কি পারবে এমন দুর্ঘটনা নীরবে সহ্য করতে? খবির উদ্দিন সহ্য করতে পারেনি। তাইতো তিনি এখন বোবা হয়ে গেছেন। কোন কথা নেই তার মুখে। শুধু হতাশার চোখে পদ্মার পাড়ে তাকিয়ে থাকা ছাড়া এখন তার আর কোন কাজ নেই। যেহেতু তাদের কোন লাশ পাওয়া যায়নি। তাই এটাই তাদের সমাধি। এখানে থাকলে তিনি শান্তি পাবে অন্য কোথাও আর তিনি শান্তি পাবেন না। তাইতো তিনি এখানে দিনরাত চব্বিশ ঘন্টা তাদের অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন।
খবির উদ্দিনের একমাত্র বড় ভাই দবির উদ্দিন। যিনি উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন। তিনি ছোট বেলা থেকেই শহরে থাকতেন। গ্রামে তেমন আসতেন না। মাঝে মাঝে ঈদের সময় গ্রামে আসতেন। তার ছেলে-মেয়েরা ও শহরে থাকে। এবার ঈদে তারা গ্রামে আসেনি। দুর্ঘটনার খবর শুনেও তৎক্ষণাৎ তিনি পদ্মার পাড়ে যাননি ছোট ভাইয়ের বউ ও ভাতিজিদের খোঁজে। শুধু দূর থেকে খোঁজ নিয়েছেন। শুধুমাত্র তার বড় ছেলে আলভী গিয়েছিল তাদের খোঁজে। দীর্ঘ এক মাস পড়ে ভাইয়ে কথা মনে পড়ল দবির উদ্দিনের। তাইতো তিনি ভাইয়ের খোঁজে পদ্মার পাড়ে আসলেন। পদ্মার পাড়ে এসে দেখে ঐ দূরে নদীর পাড়ে বসে আছে খবির উদ্দিন। উসখু-খুসকু চুল। নাওয়া খাওয়া নেই। তাই শরীর কঙ্কাল হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন দবির উদ্দিন। পিছন দিক দিয়ে ভাইয়ের কাদে হাত রাখলেন দবির উদ্দিন। ভাইয়ের স্পর্শ পেয়েও খবির উদ্দিনের কোন অনুভূতি নেই। ঘাড় ফিরে তাকিয়ে দেখলেন না কে ধরেছে তার কাদে। তাইতো দবির উদ্দির ইচ্ছে করেই তার সামনে গেলেন। ভাইকে গলায় জড়িয়ে বললেন, ভাই আমার যে চলে যাবার সেতো চলে গেছে। তারা আর ফিরে আসবে না। এখানে বসে থাকলেতো কোন লাভ হবে না। শুধু শুধু কেন এখানে পড়ে আছিস? তাদেরকে এখন পেলেও তাদেরকে চিনতে পারবে না কারণ তাদের লাশ হয়তো এতদিনে পচে গেছে। তাই বলি ভাই বাড়ী চল। আমি তোর দেখাশুনা করব। বাকী জীবন আমার সাথে কাটাবে।
খবির উদ্দিন দবির উদ্দিনের কথার কোন প্রতিউত্তর দিচ্ছে না। কি করে উত্তর দিবে তার মুখের ভাষা যে সেই কবেই হারিয়ে গেছে। তাইতো বড় ভাইয়ের কথায়ও তিনি কোন উত্তর দিতে পারছেন না। বড় ভাইয়ের দিকে শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে চোখের জল ফেলা ছাড়া আর কিছুই করতে পারছেন না খবির উদ্দিন।
কি হলো ভাই কথা বলছস না কেন? তুই এভাবে চুপ থাকলেতো চলবে না। চল বাড়ীতে। আল্লাহ যা করেন সবইতো ভালর জন্যই করেন। তার উপরতো আমাদের হাত নেই।
এতকিছু বলার পরও খবির উদ্দিনের মুখে কোন শব্দ বেড় হচ্ছে না। শুধু মাথা নাড়িয়ে জানান দিলেন তিনি এখান থেকে যাবেন না। মরতে হয় এখানেই মরবেন। তবুও বাড়িতে যাবেন না। এমনকি কারো সাথেও যাবেন না। খবির উদ্দিনকে অনেক বুঝিয়ে ও কাকুতিমিনতি করে দবির উদ্দিন এখান ফিরিয়ে নিতে ব্যর্থ হয়ে ঢাকায় চলে আসলেন।
দবির উদ্দিনের বড় ছেলে আলভী সে এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হিসাববিজ্ঞানে মাস্টার্স পাশ করেছে। চাকুরীর জন্য বিভিন্ন জায়গায় আবেদন করছে। চাকুরীটা হয়ে গেলেই বিয়ে করবে তার চাচাতো বোন স্মৃতিকে। দীর্ঘদিন থেকেই স্মৃতির সাথে ভালোবাসার সর্ম্পক ছিল। পরিবার ও আত্মীয় স্বজন অনেকেই এ খবর জানত। পরিবারের পক্ষ থেকেও তেমন কোন আপত্তি ছিল না স্মৃতিকে বিয়ে করতে। কারণ স্মৃতির বাবা দিনমজুর হলেও স্মৃতি ছিল অসম্ভব সুন্দরী ও মেধাবী। এসএসসি ও এইচসিতে এপ্লাস পেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞানে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছিল। বড় চাচার বাসায় থেকেই পড়ছিল স্মৃতি। তাইতো আলভী ও আলভীর পরিবারের সাথে তার সর্ম্পক ছিল অন্যরকম। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে অঙ্কুরেই সেই ভালোবাসা আজ স্বপ্ন হয়ে রইল।
আলভী যখন লঞ্চ দুর্ঘটনার খবর পেল তখন যেন তার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। মূহূর্তে তার জীবনে কালবৈশাখী ঝড় নেমে আসল। তছনছ হয়ে গেল এতদিনের লালিত স্বপ্ন। ছুটে গেল পদ্মার পাড়ে। পাগলের মতো খুঁজতে লাগল স্মৃতিকে। কোথাও জীবিত স্মৃতিকে খুঁজে না পেয়ে হতাশ হয়ে গেল আলভী। তার শরীর ঘেমে একাকার হয়ে গেল। এই বুজি তার জীবন থেকে স্বপ্নের মানুষ চলে গেল। সে আর ফিরে আসবে না। তাকে আর ভালবাসার কথা শুনাবে না। তাকে আর সংসার গড়ার স্বপ্ন দেখাবে না। এই কথা ভাবতে পারছে না আলভী।
উদ্ধার কাজ শুরু হলো। একে একে মৃত লাশ ভেসে আসছে কিন্তু স্মৃতি ও তার পরিবারের কোন লাশ পাওয়া যাচ্ছে না। তখনই আলভীর মনে জানান দিল স্মৃতির লাশ আর পাওয়া যাবে না। শেষ দেখাটুকু দেখতে পারবে না। স্মৃতি এখন তার মনের মনিকোঠায় স্মৃতি হয়ে থাকবে আজীবন।
স্মৃতি যখন বুঝতে পারল লঞ্চ ডুবে যাচ্ছে, জীবনের প্রদীব নিভে যাচ্ছে। হয়তো আর কারো সাথে দেখা হবে না। তাই মৃত্যুর পূর্বে অনন্ত প্রিয়তম আলভীর সাথে একটু কথা বলে নেই। তখন স্মৃতি আলভীকে ফোন দিল। আলভী ফোন রিসিভ করতেই অপর প্রান্ত থেকে কান্নাভেজা কণ্ঠে স্মৃতি বলছে, আলভী আমরা যে লঞ্চে ঢাকায় আসছি সেই লঞ্চ ডুবে যাচ্ছে।
আলভী আশ্চার্য হয়ে বললো, একি বলছ তুমি!
হ্যাঁ আলভী জীবনের চরম সত্যের মূহুর্তে এখন দাঁড়িয়ে আছি। লঞ্চের ভেতর পানি ঢুকে গেছে।
এ হতে পারে না। আলভী লক্ষ করে শুনছে লঞ্চের ভেতর কান্নার রুল পড়ে গেল। সবাই চিৎকার চেচামেচি করছে। কেউ কালিমা পড়ছে। কেউ আল্লাহকে স্মরণ করছে।
আমি হয়তো বাঁচবো না। আমার সাথে বীথি, স্মৃতি ও মা আছেন তারাও হয়তো বাঁচবে না। তুমি আমার বাবাকে এ খবরটা জানিয়ে দিও। আর যদি পার একবার এসে আমার লাশটা দেখে যেও। যদি আমরা চারজনেই মারা যায় তাহলে গ্রামের বাড়ীতে সবার লাশ এক জায়গায় দাফন করবা। এই আমার অনুরোধ।
আলভী আর কোন উত্তর দিতে পারেনি। ইতোমধ্যে ফোনের লাইন কেটে গেল। হ্যালো হ্যালো বলেও আর কোন সাড়া শব্দ পেল না স্মৃতির। আলভী স্তদ্ধ হয়ে গেল। স্মৃতির কোন সাড়া না পেয়ে আবার আলভী মোবাইল ডায়াল করল। কিন্তু না আর মোবাইলে রিং ঢুকে না। মোবাইল সফটওয়্যার বলছে, এই মুহূর্তে মোবাইল সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। আর আলভী আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। তার পায়ের নিচে এখন আর কোন মাটি নেই। হঠাৎ করে চিৎকার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। আলভীর চিৎকার শুনে তার মা আসলো।
বাবা কি হয়েছে?
মা স্মৃতি, বীথি, ইতি ও তার মা লঞ্চডুবির কবলে পড়ছে।
তুই কেমনে জানলি?
এখন আমাকে স্মৃতি ফোন করল।
ফোনটা দেতো আমার কাছে।
এখনতো আর সংযোগ পাচ্ছে না।
একি বলছিস! সবাই মনে হয় এতক্ষণে মরে গেছে।
আলভী আর বিলম্ব না করে তার চাচাকে খবর দেয়। চাচা এ খবর পেয়ে পাগলের মতো ছুটে চলল পদ্মার পাড়ে। আলভীও সাথে রওয়ানা হলো। ঘটনাস্থলে এসে চাচা ভাতিজা দুজনে এদিক ওদিক ছুটাছুটি করতে লাগল। কোথাও জীবিত অথবা লাশের সন্ধান পেল না। শত শত মানুষ স্বজনের খুজে এখানে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছেন। কেউ হয়তো লাশ পাচ্ছে আবার কেউ হয়তো লাশ পাচ্ছে না। হতভাগ্যদের স্বজনরা লাশ না পেয়ে নিরাশ হয়ে ফিরে গেছে। তেমনি আলভী ও তার চাচা তিন থাকার পরও কোন লাশ পায়নি। আলভী নিরাশ হয়ে ফিরে আসল ঢাকায় কিন্তু তার চাচা খবির উদ্দিন ফিরে আসল না। এখন তিনি সেখানেই আছেন। এভাবেই হয়তো বাকী জীবন তিনি তিন কন্যা ও স্ত্রীর খোঁজে পদ্মার পাড়ে ঘুড়ে বেড়াবেন। আর তাদের অপেক্ষায় থাকবেন কখন পাবে তাদের লাশ। আর আলভী হয়তো অপেক্ষা করবেন অনন্তকাল তার প্রিয়তমার জন্য।
রচনাকাল- ০১-০৯-২০১৪খ্রি:
নাকফুল
প্রতিদিনের মতো আজও পাখির কিচিরমিচির ডাকে জোনাকীর ঘুম ভাঙে। ব্রাশ নিয়ে টিউবওয়েলের কাছে যায়। দাঁত ব্রাশ করে হাতমুখ ধুয়ে আয়নার সামনে আসে। মুখে ক্রিম দিতে আয়নায় চোখ রাখে। তারপর বের হয়ে পড়ে উঠান ঝাড়ু দিতে। বিয়ের পর থেকে সকালে উঠেই আয়না দেখাটা প্রতিদিনের অভ্যাস হয়েছে ওর। আজও এর ব্যতিক্রম হয়নি। আজ আয়নায় মুখ পড়তেই চমকে উঠলো জোনাকী! আঙুলের আগায় আজ আর ক্রিম উঠেনা। নিজের মুখের প্রত্যেকটা ভাঁজ ওর খুব চেনা। এইজন্যই বোধহয় এক পলকেই খালি নাকটা নজড়ে পড়লো। নাক স্পর্শ করে স্তব্ধ হয়ে যায় সে। সোনার নাকফুলটা নাকে নেই!
এইতো এক মাস পূর্বে বিয়ে হল কবিরের সাথে জোনাকীর। লাল বেনারশী শাড়ী পড়ে এই বাড়িতে যখন জোনাকী আসে তখন তার শাশুড়ি পড়িয়ে দিয়েছিল সোনার নাকফুলটি। সেদিন থেকে অন্য একটা জীবন শুরু হলো জোনাকীর। নাকফুলটা পড়িয়ে দিয়ে শাশুড়ি বলেছিলো, মেয়েদের নাকফুল হারালেই স্বামীর অমঙ্গল হয়। দাদীর মুখেও অনেকবার শুনেছে এতে সংসারের অমঙ্গল হয়। বুকের ভেতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে উঠলো ওর। অভাবের সংসার, টানাটানি করে কোন রকমে চলে। এই অবস্থায় এত দামী একটা জিনিস হারিয়ে ফেলেছে সে। একথা কেমন করে জানাবে স্বামী, শাশুড়িকে। পাগলের মতো খুঁজতে থাকে ঘরের কোনায়, বিছানায় সারা উঠোনের ময়লা-আবর্জনার মাঝে। কোথাও খুঁজে না পেয়ে চিন্তায় ভেঙ্গে পড়ে জোনাকী।
এমন সময় কবিরের মায়ের চোখে ধরা পড়ে বিষয়টি। নাকফুল নেই নতুন বউয়ের নাকে। কবিরের মা চড়া গলায় বললো, এই পোড়ামুখী তোর নাকফুল কই?
হঠাৎ শাশুড়ির এমন প্রশ্নে জোনাকী ভয় পেয়ে যায়। আমতা আমতা করে বলতে লাগলো, আম্মা কই পড়ছে, জানি না। সারা বাড়ি খুজছি কোনখানে পাইনি।
– তুইতো আমার পোলার অমঙ্গল ডাইক্কা আনছিস।
– এইসব কি কন আম্মা!
ততক্ষণে পুরো গ্রামের বৌ-ঝিদের মাঝে খবর রটে যায় নতুন বউয়ের নাকফুল হারিয়ে যাওয়ার কথা। গ্রামের লোকেদের প্রাচীন একটি ধারণা নতুন বউয়ের নাকফুল হারিয়ে যাওয়া অশুভ লক্ষণ। এতে অমঙ্গল হয় স্বামীর। ছেলের আশু অমঙ্গলের কথা চিন্তা করে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন কবিরের মা। মায়ের কান্না শুনে ঘুম ভাঙে কবিরের। বাইরে এসে সব কিছু জানতে পেরে নাকফুল খুঁজতে থাকে কবিরও। কোথাও নাকফুল খুঁজে না পেয়ে হতাশায় ভোগছে কবিরও। তার মা জোনাকীকে ইঙ্গিত করে আরো অনেক কথা শুনায়। লজ্জায় অপমানে ঘরের দরজার একপাশে মুর্তির মতো নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে জোনাকী। কবির তাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় ঘরে।
আজ কিছুই মনে পড়ছে না জোনাকীর। এমন অনভুলা কেমনে হল তা ভাবতে পারছে না সে। মনে করার চেষ্টা করছে কখন সে শেষ বারের মতো নাকফুলটাকে দেখেছে? মনে পড়ে জোনাকীর। আগের দিন রাতে গোসলের সময় কবিরের দুষ্টমিতে নাকে আঘাত পেয়েছিল জোনাকী। তখন নাকফুলটা নাকে লেগেছিল। তখন হয়তো টিউবওয়ের পাড় পড়েছিল।
কবিরকে জানায় সে কথা। কবির তখন জোনাকীকে নিয়ে টিউবওয়েলে পাড় খোঁজাখুজি করে। কিন্তু এত ছোট্ট একটি সোনার নাকফুল কি ততক্ষণে টিউবওয়েলের পাড় পড়ে রইছে? কাদা পানিতে ভেসে হয়তো মাটির নিচে কোথাও চলে গেছে।
কবির কিছুক্ষন চুপ করে ভেবে বললো, চল্ আর বিছারতে হবে না। আমি তোরে আবার নাকফুল কিন্না দিমু।
কবির তাদের গ্রামের পাশেই একটি কারখানায় চাকরি করে। অল্প টাকা বেতনে চাকুরি করে কোন রকমে সংসার চালায়। সংসার বলতে মা-বাবা, স্ত্রী ও ছোট্ট একটি বোন।
নাকফুল হারানোর সপ্তাহখানেক পর। অন্যান্য দিনের মতো আজও কাজ করতে কারখানায় যায় কবির। প্রতিদিনই সন্ধ্যার আগে কবির বাসায় ফিরে আসে কিন্তু আজ আর ফিরছে না। রাত আটটা বাজে এখনও বাড়ি ফেরেনি কবির। সেই সকালে জোনাকীকে বলে গিয়েছে আজ বেতন পেলে তার জন্যে সোনার নাকফুল আনবে। কিন্তু না, এখনও ফেরেনি।
এদিকে কবিরের মা চিন্তায় পড়ে গেলেন। নিশ্চয় কবিরের কোন বিপদ হয়েছে। তা না হলে এখনও কেন বাড়ি ফিরেনি। মায়ের মন ছেলের আশু অমঙ্গলের কথা চিন্তা করে বউকে বললেন, এই অপায়া কইছিলাম না, মাইয়া মাইনসের নাকফুল হারাইলে সোয়ামীর অঙ্গল হয়। আজ যদি আমার পোলার কিছু হয় তোরে ছারুম না।
শাশুড়ির কথায় জোনাকীর কান্না আসে। রাত গভীর হলো। ঘরের এপাশ ওপাশ পায়চারি করে জোনাকী। কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। কোথায় খুঁজবে স্বামীকে। জায়নামাজ হাতে নিয়ে দুই রাকাত নামাজ পড়লো জোনাকী। আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করলো, হে আল্লাহ আমার সোয়ামী যেখানেই থাকুক তুমি বালা রাইখ। আমার সোয়ামীকে সহিসালামতে বাড়ি পৌঁছাইয়া দিও। আমীন। ঘড়িতে দেখে রাত এগারটা বাজে। বিছানায় শুয়ে কবিরের কথাই ভাবতে থাকলো জোনাকী। কখনও যে ঘুমে ঢলে পড়লো তাও টের পেল না সে।
রাত বারোটা বাজে। হঠাৎ দরজায় নক করল।
দরজার আওয়াজ পেয়ে জোনাকীর ঘুম ভেঙ্গে গেল। এতো রাতে দরজায় নক করার আওয়াজ পেয়ে ভয় পেয়ে গেলো ও। ভয়ে ভয়ে বললো, কেডা?
আমি কবির। দরজা খোল।
কবির নামটা শুনেই জোনাকীর যেন আত্মা ফিরে আসলো। দৌঁড়ে গিয়ে দরজা খোলে কবিরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। আপনিতো কোন দিন এত রাইত করে বারিত ফিরেন নি। আজকা এমন হইল ক্যান? আপনার কিচ্ছু হয়নিতো?
– না আমার কিচ্ছু হয়নি। সব কথা বলবো আমারে বসতে দাও। মা-বাবা কই, মা-বাবাকে ডাহ।
জোকাকী তার শাশুড়িকে ডাকছে, আম্মা, ও আম্মা, আব্বা ও আব্বা দেখেন আপনার পুলা আইছে।
এত রাতে জোনাকীর ডাকে কবিরের মায়ের ঘুম ভাঙ্গে। কি কইলা আমার কবির আইছে। কই আমার কবির। বলেই দরজা খুলে দ্রুত কবিরের ঘরে চলে আসলো। কবিরের বাবা ও বোন তারাও ঘুম থেকে উঠে এ ঘরে চলে আসলো। কবিরের মা কবিরকে ঝাপটে ধরে বললো, কিরে বাপজান তোর কিছু হয়নিতো?
– না মা আমার কিছু হয়নি?
– কই ছিলি এত রাইত পর্যন্ত?
– বেতন পাইয়া আমি গঞ্জের বাইনার দোকানে গিয়েছিলাম বউয়ের জন্য সোনার নাকফুল বানাইতে। সেইখান থেকে আসার পথে এক বন্ধুর সাথে দেখা হইছে। সে জোর করে তাদের বাড়িতে নিয়ে যায়। আজ ওখানে থাকতে বলছিল। আমি চলে আসছি তাই এত রাত হইয়া গেছে।
– আর আমি কি না কি ভাবছি। তোর বউকে আমি অনেক গাল মন্দ করেছি।
– এসব কি বলছ তুমি মা!
– হ্যাঁ আমি তোর বউকে অপয়া বলেছি।
কবির অশিক্ষিত হলেও কুসংস্কার একদম বিশ্বাস করে না। তার মা সবকিছুতেই কুসংস্কার খুঁজে পান। তাইতো নাকফুলকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রেক্ষিতে কবির মাকে বললো, মা তোকে বলি আর কোনদিন এসব কুসংস্কারে বিশ্বাস করবি না। এইসব কুসংস্কার আমি বিশ্বাস করি না।
কবিরের বাজান বললো, হ বাজান ঠিক কইছোস। তোর মা সারাজীবন এইসব কুসংস্কারে বিশ্বাস করে আমার পরিবারে অশান্তি করছে। তোর মারে বুঝাইয়া ক।
কবিরের মা তখন নরম হয়ে বললো, আমি আর এসব বিশ্বাস করব না। এইসব বিশ্বাস কইরা আমার ফুলের মতো বউটারে গালমন্দ করছি। এই কথা বলেই জোনাকীর দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ও বউ তুমি আমারে মাপ করে দিও।
এ কথা শুনেই জোনাকী বলে উঠলো, ছি মা এসব কি কইতাছেন? আপনি আমার হরি। আপনি আমার মায়ের মতো। আপনারে আমি মাপ করুম কেমনে। আপনি আর এইসব বিশ্বাস না করলেই আমাগোর আর কোন সমস্যা হবে না।
কবিরের মা বললো, ও কবির কই তোর বউয়ের সোনার নাকফুল দেখি।
কবির সোনার নাকফুল পকেট থেকে বের করে বললো, এই নে মা। তুই তোর পুলার বউরে নাকফুলটা পড়াইয়া দে।
কবিরের মা নাকফুলটা হাতে নিয়ে বললো, অহো মা। তোমারে নাকফুল পড়াইয়া দেই। বলে জোনাকীর নাকে নাকফুলটি পড়িয়ে দিল। সবাই তখন খুশি হলো।
তারিখ: ৩০/০১/২০১৭ইং
ময়নার বিয়ে
– ময়নার মা! ও ময়নার মা।
স্বামী গফুর মিয়ার ডাকে তাড়াহুড়া করে ময়নার মা তার কাছে আসলো।
– কি হইছে? এত ছিল্লাচ্ছেন ক্যান?
– আরে হুন না। একটা সুখবর আছে?
– সুখবর! এই ভরদুপুরে আবার কি সুখবর নিয়ে আসলেন?
– আমাগো ময়নার জন্য একটা ভালা পুলা পাইছি। পুলার ম্যালা পয়সা আছে। বিদেশ থাইক্কা আইছে।
– পুলার বাড়ি কই?
– আমাগো পাশের গ্যারাম মেজেরকান্দি। পুলার বাপ আমার বন্ধু।
– আমাগো ময়নার তো সবে চৌদ্দ বছর হইছে! এহনই মাইয়াডারে বিয়া দিয়া দিবেন?
– আমাগো ময়নাতো ম্যালা বড় হইছে। তারতো বিয়ে দেওন লাগবো। সব সময় ভালা পুলা পাওয়া যায় না। কি কও তুমি?
– আপনে যা ভালা মনে করেন তাই করেন।
– আল্লাহর মাল আমাগো মেয়ে তো পাঁচখান। একটা একটা কইরাতো সব্বাইরে বিয়া দিতে হইবো। তাই দেরি করা যাবে না।
– হ ঠিকই কইছেন। তা পুলাডার খোঁজ পাইলেন কই?
– ঐ যে ঘটক বিল্লাল ভাইকে ছিননা?
– হ ছিনি।
– হেই ঘটকের সাথে আজকা বাজারে দেহা হইছে। সেইতো আমারে কইছে পুলার সম্বন্ধে।
– ঠিক আছে। তয় বিয়ে দেওনের আগে পুলাডারে দেইখা নিয়েন।
– পুলা না দেইখা কি আর বিয়ে দিমু।
গফুর মিয়া বাঙালীনগর গ্রামের একজন সাধারণ কৃষক। নিজের যা জমি আছে তা চাষ করে কোন রকমে সংসার চালায়। একটি ছেলের আশায় তার সংসারে এখন পাঁচটি মেয়ে। প্রতি দু’বছর পর পরই একটি মেয়ে জন্ম হয়েছে। এখন সে ছেলের আশা ছেড়েই দিয়েছে। পাঁচ মেয়ে নিয়েই বাকি জীবন পার করতে চায়। সংসারের অভাব অনটনের কারণে মেয়েদেরকে লেখাপড়াও করাতে পারছেন না। গ্রামের প্রাইমারী স্কুলে বড় মেয়ে ময়নাকে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করানোর পর আর পড়ায়নি। অন্য মেয়েরাও কেউ স্কুলে যায় আবার কেউ যায় না। এই নিয়ে তার কোন চিন্তাও নেই। গফুর মিয়া পাঁচ মেয়েকে পর্যায়ক্রমে বিয়ে দিতে পারলেই সংসারের বোঝা থেকে মুক্তি পাবে বলে মনে করে। মেয়েদের বিয়ে দেয়ার পর কি হবে সেটা নিয়ে চিন্তা করে না।
গফুর মিয়া ও তার স্ত্রী জরিনা বেগম একেবারেই নিরক্ষর। ভালো মন্দের পার্থক্য তারা তেমন বুঝে না। অল্প বয়সে একটি মেয়ের বিয়ে দিলে ভবিষ্যৎ কি হবে তা নিয়ে তাদের কোন ভাবনা নেই। তাদের একটিই কথা, বয়স হয়েছে বিয়ে দিতে হবে। বড় মেয়ে বিয়ে দিতে না পারলে ছোট মেয়েকে বিয়ে দিতে পারবে না। ধারাবাহিকভাবে সব মেয়ের বিয়ে দিতে চায় তারা। তাইতো ঘটক বিল্লাল যখন বিয়ের প্রস্তাবের কথা বললো তখন সহজেই রাজি হয়ে গেলো সে।
গফুর মিয়ার সম্মতি নিয়ে আজ ঘটক বিল্লাল আসলো মেজেরকান্দি গ্রামের বাতেন মিয়ার বাড়িতে।
– কালার বাপ! ও কালার বাপ।
– কেডা আইছো এই সাতসহালে?
– আমি ঘটক বিল্লাল ভাই।
– ও চাচা আহেন।
বাতেন মিয়া ঘটক বিল্লাল ভাইকে একটি চেয়ার এনে ঘরে বসতে দিলো। তারপর বললো, কি মনে কইরা গরিবের বাড়িতে?
– ঘটকরা কি মনে কইরা আহে?
– হ বুঝবার পারছি। বিয়া শাদীর আলাপ সালাপ করতে?
– এইতো বুঝবার পারছো। হুনলাম তোমার পুলা কালা মিয়া নাকি বিদেশ থাইক্কা আইছে?
– হ ঠিকই হুনছো।
– তয় কয় দিনের ছুটি নিয়া আইছে?
– তিন মাসের।
– বিয়া শাদী করাইবা নাকি?
– বিয়া তো করামু। তয় ভালা একটা মাইয়া চাইতাছি।
– আমার কাছে একটা ভালা মাইয়া আছে।
– বাড়ি কোন গ্যারামে?
– বাঙালীনগর।
– কার মাইয়া?
– গফুর মিয়ার মাইয়া।
– কি কও। তারেতো আমি চিনি।
– হ সেওতো একই কথা কইছে।
– তার মাইয়া এত বড় অইয়া গেছে তাতো বুঝবার পারি নাই।
– মাইয়া মানুষ বড় হইতে বেশি দিন লাগে না। মাইয়া বিয়ার উপযুক্ত হইছে। দেখতে সুন্দর। গায় গতর নাদুস নুদুস। তোমার পুলাডার সাথে মানাইবো ভালা।
– কালা মিয়া যদি রাজি হয় তাইলে বিয়া করামু।
– রাজি হবে না ক্যান? গফুর মিয়ার কোন ছেলে নাই। সে মইরা গেলে সব জায়গা জমির মালিকতো মাইয়ারাই হইবো।
– বুঝবার পারছি। তয় পুলাডার সাথে একবার কথা কইয়া লই।
– ঠিক আছে ডাহ দেহি তোমার পুলারে। আর তোমার বউরে কও আমারে একখান পান দিতে।
বাতেন মিয়ার বড় ছেলে কালা মিয়া। নামের সাথে হুবহু গায়ের রঙ এর মিল আছে। এমন কালো মানুষ মেজেরকান্দি গ্রামে আর নেই। জন্মের সময় তার চেহারা দেখে সবাই অবাক হয়ে যায়। গফুর মিয়ার ঘরে এমন কালো ছেলে এলো কি করে? তাদের বংশেতো এমন কালো মানুষ নেই! জন্মের সময় তার নাম রহিম মিয়া রাখলেও গায়ের রঙ কালো হওয়ায় সবাই তাকে কালা মিয়া বলেই ডাকতে ডাকতে সে কালা মিয়া নামেই পরিচিত হয়ে আসছে। বাতেন মিয়ার দুই ছেলে দুই মেয়ে। কালা মিয়া তার বড় ছেলে। অন্য ছেলেটা ঠিক বাবার মতো হয়েছে। মেয়ে দুটো মায়ের মতো।
বাতেন মিয়া গ্রামের একজন কৃষক। সারাজীবন কৃষিকাজ করে যা আয় করেছে তা দিয়েই সংসার চালিয়েছে। নিজেও লেখা পড়া করে নাই। ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া করার কথা চিন্তাও করে নাই। গত তিন বছর আগে জমিজমা বিক্রি করে বড় ছেলে কালা মিয়াকে সৌদী আরব পাঠায়। সেই থেকে বাতেন মিয়ার ভাগ্য খুলে যায়। ছেলেটা বিদেশ গিয়ে ভালো পয়সার মালিক হয়েছে। এই তিন বছরে বাড়িতে একটা টিনশেড বিল্ডিং করেছে। ছোট ভাই করিম মিয়াকে বিদেশ নিয়েছে। বেশ কিছু জমিও রেখেছে।
এখন বাতেন মিয়ার ছেলে যেহেতু ছুটিতে বাড়িতে আসছে তাকে বিয়ে করাবে। তাই পাত্রী খুঁজছে। আজ ঘটক বিল্লাল বাড়িতে এসে তারই বন্ধু গফুর মিয়ার মেয়ের কথা বলাতে সে রাজি হয়েছে বিয়ে করাতে কিন্তু ছেলের মতামতের জন্য ছেলেকে ডাকছে।
– কালা মিয়া! ও কালা। কই গেছস?
– কি আব্বা? ক্যান ডাকছেন?
– তোর বিল্লাল দাদা আইছে। একটু কথা ক দেহি।
বিল্লাল ঘটককে কালা মিয়া ছোট সময় থেকেই চিনে। তাই তাকে দেখে সালাম দিলো, আসসালামু আলাইকুম দাদা।
– ওয়ালাইকুম আসলাম। কেমন আছ নাতি?
– ভালা আছি। আপনি কেমন আছেন?
– তোমাগো দোয়াই ভালাই আছি। তয় তোমার সাথে একখান কথা আছিন।
– কি কথা কইবেন কন?
– হুনলাম তুমি নাকি বিয়া করবা?
– হ দাদা।
– আমার কাছে একখান সুন্দর মাইয়া আছিন। তোমার মত পাইলে কাজ শুরু কইরা দিবার পারি।
– আমার আবার কি মত। আব্বা যা ভালা মনে করেন তাই করেন। তয় বিয়ের আগে আমি মাইয়াডারে একনজর দেখতে চাই।
– তাতো অবশ্যই। কবে যাইবা?
– কালই চলেন।
– ঠিক আছে আমি মাইয়ার বাপের সাথে কথা কমু। তুমি এখন যাও।
ঘটক বিল্লাল আজ সকালেই ফোন করে গফুর মিয়াকে জানিয়ে দিলো ছেলেকে নিয়ে তার মেয়েকে দেখতে আসার কথা। ছেলের জন্য ভালো খাবারের আয়োজন করতে গফুর মিয়াকে বলে দিলো। গফুর মিয়া তার সাধ্যমতো খাবারের আয়োজন করল।
এদিকে ময়নাকে দেখতে আসবে এ খবর ময়নার মা ময়নাকে দেয়ার পর সে কিছুতেই বিয়েতে রাজি হচ্ছে না।
– আমি এখন বিয়া বসব না।
– ক্যান বিয়া বসবি না?
– আমার এহন বিয়ার বয়স হয়নি।
– কেডা কইছে তোর বিয়ার বয়স হয়নি?
– কেডায় আবার কইবো? আমি কি বুঝি না?
– ভালা একটা পুলা পাওয়া গেছে।
– পুলার কি অভাব পড়বে মা?
– এমন ভালা পুলা পাওয়া যাইবো না।
– এতসব বুঝি না। আমি এহন বিয়া বসব না।
ময়নার এক কথা এখন সে বিয়ে করবে না। তার এখন বিয়ের বয়স হয়নি। এই কথা ময়না বুঝলেও তার পিতা-মাতা কেউ বুঝতে চাইছে না। তাদের এক কথা মেয়ে হয়ে জন্ম নিয়েছে বিয়ে তাকে দিতে হবেই। এখনই বিয়ের উপযুক্ত সময়।
বিকেল বেলা ঘটক বিল্লাল, কালা মিয়া ও তাদের কয়েকজন মুরুব্বিকে নিয়ে গফুর মিয়ার বাড়িতে আসে। মেয়েকে দেখতে আসবে তাই গফুর মিয়া তার সাধ্যমত তাদের জন্য আপ্যায়নের ব্যবস্থা করলো।
পাশের বাড়ির এক ভাবী ময়নাকে আজ সুন্দর করে সাজালো। তারপর তিনি ময়নাকে ধরে মুরুব্বিদের সামনে নিয়ে আসলো। ময়না সালাম দিয়ে একটি চেয়ারে বসলো। ভাবি ময়নার ঘোমটা খুলে বর পক্ষের সবাইকে দেখালো। ময়না বার বার লজ্জায় ঘোমটা টেনে দেয়। ছেলে পক্ষের মুরুব্বিরা খুটিয়ে খুটিয়ে ময়নার চেহারা দেখে। ঘটক সাহেব ময়নার কথাবার্তা শুনার জন্য কালা মিয়াকে ইশারা দিতেই সে ময়নাকে কিছু প্রশ্ন করল।
– তোমার নাম কি?
ময়না লাজুক ভঙ্গিমায় মাথা নিচু করে আস্তে করে বলল, ময়না।
– তোমরা ক’ভাই বোন?
– পাঁচ বোন, ভাই নেই।
– কোরআন পড়তে জান?
– হে জানি।
পরে সহকারী মহিলাটি ময়নার চুল কতটুকু লম্বা তা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখায়। সে শারীরিক প্রতিবন্ধী কিনা তা দেখার জন্য তাকে হাঁটানো হয়। তার দাঁতগুলো মুক্তার মতো ঝক ঝক করে কিনা নাকি আঁকাবাঁকা তা দেখার জন্য হা করতে বলা হয়। পায়ের আঙ্গুল ঠিক আছে কিনা তা দেখার জন্য পায়ের কাপড় সরিয়ে পা দেখানো হয়। হাতের কবজি পর্যন্ত দেখানো হয়। এমন আরো কত অশুভ আচরণ করা হয় ময়নার সাথে। ততক্ষণে ময়না রাগে ক্ষোভে ফেটে পড়ছে। কিন্তু এই রাগ প্রকাশ করতে পারছে না। পারলে এখনই তাদের সামনে থেকে চলে যেত। তার হাতের লেখা দেখার জন্য তার ঠিকানা লিখতে বলা হয়। ময়না সাদা কাগজে ঠিকানা লিখে দিলো। পরিশেষে কালা মিয়া ময়নার হাতে ৫০০ টাকার একটি নোট দিয়ে বিদায় করে দিল।
ময়নাকে দেখে কালা মিয়ার পছন্দ হলো। ঘটক বিল্লাল এবার খুশি। দু’পক্ষকেই রাজি করাতে পারছে। সে বাতেন মিয়াকে তার ছেলের সম্মতির খবরটি দিলো। দু’পক্ষ আলাপ আলোচনা করে বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করলো। কালা মিয়া ১০০ বরযাত্রী নিয়ে আগামী শুক্রবার ময়নাকে বিয়ে করতে আসবে। দু’পক্ষের আত্মীয়স্বজন সবাইকে ইতোমধ্যে দাওয়াত করা হয়ে গেছে।
আজ ময়নার বিয়ে। বাড়ির আশেপাশের সবাই আনন্দে ভাসছে। কিন্তু ময়নার মনে কোন আনন্দ নেই। সে একা কাঁদছে। তার কান্না কেউ দেখে না। সে এ বিয়েতে রাজী নয়। তাকে জোরপূর্বক এ বিয়েতে রাজী করানো হয়েছে। সে ভাবছে তার ভবিষ্যত নিয়ে। যে বয়সে সে লেখাপড়া করবে, আনন্দ ফূর্তি করে বেড়াবে সে বয়সে তাকে বিয়ে দেয়া হচ্ছে। বিয়ে, সংসার, শ্বশুর-শাশুড়ি এগুলো সে কিছুই বুঝে না। যাদের সাথে চৌদ্দটা বছর থেকেছে তারাও বুঝল না ময়নার মনের কষ্ট।
বরযাত্রী আসল। বিয়ে হল। লাল বেনারশী শাড়ী পড়ে ময়না শ্বশুর বাড়িতে রওয়ানা হলো। যাবার বেলা ময়না কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। আত্মীয়স্বজন সবাই এই কান্নাকে স্বাভাবিক কান্না মনে করলেও আসলে ময়না স্বাভাবিকভাবে কাঁদেনি। নববধূকে যখন কালা মিয়াদের বাড়িতে আনা হল তখন গ্রামের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সকলেই নতুন বউ দেখতে আসল। সারাদিন মেয়েটা কিছু খায়নি। কান্নাকাটি করে একেবারেই শুকিয়ে গেছে। এ অবস্থায় কিছুক্ষণ পর পর সবাইকে ঘোমটা উঠিয়ে দেখানো হচ্ছে। এতে করে তার খুবই বিরক্ত লাগছে।
কালা মিয়ার আজ বাসর রাত। তার মনে দারুন আনন্দ। অল্প বয়সী সুন্দরী বউ পেয়েছে সে। নতুন ঘরে বাসরঘর সাজানো হলো। রাত এখন ১ টা বাজে। কিছুক্ষণ আগে কালা মিয়া বাসর ঘরে ঢুকেছে। ইতিমধ্যে বন্ধু বান্ধব আত্মীয়স্বজন সবাই ঘুমিয়ে গেছে। কালা মিয়া রুমে ঢুকেই দেখল ময়না ঘোমটা দিয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে এবং মৃদুস্বরে কাঁদছে। সে এগিয়ে গেল নববধূর কাছে।
– কি হল ময়না তুমি কানতাছো ক্যান?
কালা মিয়ার এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না ময়না। শুধু কাঁদছে। তার কান্নার আওয়াজ ধীরে ধীরে বাড়ছে।
কালা মিয়া ময়নার থুতনীতে ধরে বললো, কি হলো কানতাছো ক্যান? বল তোমার কি হইছে? বাসর রাতে কেউ কি কান্দে?
এবার ময়না কালা মিয়ার দিকে একনজর তাকাল। ঐদিন সে মুরুব্বিদের সামনে ভালো করে কালা মিয়ার দিকে তাকায়নি। আজ সে ভালো করে তাকিয়ে তাকে দেখে চমকে উঠল। একি দেখছে সে! মানুষ এত কালো হতে পারে। যেমন কালো তেমন মোটা। আর এমন একটা কালো মানুষের সাথে আমার আব্বা আমাকে বিয়া দিল। এ কথা ভাবতেই সে অজ্ঞান হয়ে গেল।
কালা মিয়া এ দৃশ্য দেখে গভীর চিন্তায় পড়ে গেল। এখন কি করব। এ মুহূর্তে কাউকে ডাকা উচিত হবে না। মানুষজন অন্য কিছু ভাবতে থাকবে। যা করার আমাকেই করতে হবে।
– ময়না! ও ময়না উঠো। আমি তোমার সোয়ামী। বাসর রাতে কেউ এমন করে না। এই রাত আর কোন দিন আসবে না।
কিন্তু কিছুতেই ময়নার কোন সাড়া পাচ্ছে না কালা মিয়া। কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছে না সে। কিছুক্ষণ পর বাহিরে বের হয়ে পানি নিয়ে আসল। ময়নার মাথায় পানি ঢালল। হাত পায়ে তেল মালিশ করল। অনেকক্ষণ পরে তার জ্ঞান ফিরে এল।
– কেডা আপনি?
– আমি তোমার সোয়ামী।
– সোয়ামী! আমি আপনেকে চিনি না। আমারে ছুবেন না।
– এসব কি বলছ?
– আপনাকে আমার ভালা লাগেনি।
– ভালা না লাগলেও আমি তোমার সোয়ামী। তুমি আমার বউ। আমাকে তুমি মেনে নাও। বলেই কালা মিয়া ময়নার শরীরে হাত স্পর্শ করে।
– আমি কইছি আমারে ছুবেন না। তাহলে কিন্তুক আমি বাইর হইয়া যামু।
– ছি: ময়না এসব বলে না। গ্যারামের মানুষ তোমারে খারাপ কইবো।
– যা কওয়ার কোউক। তবুও আমি আপনের লগে থাকুম না।
– ক্যান থাকবানা? তাইলে কি তুমি বিয়ার আগে কোনো পুলার লগে পেরেম করছ?
– ছি: এসব কি বলেন। আমার কি পেরেম করার বয়স হয়ছে?
– তাইলে তুমি এই রাতে এমন করতাছো ক্যান?
– কইছি না আপনারে আমার ভালা লাগেনি।
কালা মিয়াকে ময়নার ভালো লাগেনি। তার শরীর স্পর্শ করতে নিষেধ করার পরও এক প্রকার জোর করেই কালা মিয়া ময়নার সাথে শারীরিক মিলন করে। কিশোরী বয়সে তার চেয়ে দ্বিগুণ বয়সের স্বামীর অত্যাচার সারা রাত নীরবেই সহ্য করেছে। এ কোন বাসর রাত নয়। বলতে পারেন জোর পূর্বক একজন কিশোরীকে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে স্বামী নামক ব্যক্তিটি ধর্ষণ করছে।
তারপর থেকে প্রতিদিনই ময়নার সাথে কালা মিয়ার শারীরিক ধর্ষণ হতো। দুই মাস পর কালা মিয়া সৌদি আরবে চলে যায়।
ইতোমধ্যে কিশোরী ময়না তার শরীরে বড় ধরনের পরিবর্তন টের পেল। কিছুদিন যাবত তার পেটে খুব ব্যথা করছে। তার ভয় হচ্ছে তার পেটে হয়তো বাচ্চা এসেছে। আমিতো একটা বাচ্চা মেয়ে; আমার পেট থেকে আরেকটা বাচ্চা বের হবে কি করে? কি করবে বুঝতে পারছে না ময়না। আজ ময়না হঠাৎ করে বমি করলো। সে তার শাশুড়িকে এই ঘটনা বললো। শাশুড়ি তখন বললো, তুমি বাচ্চার মা হতে চলেছো।
এই কথা শুনার পর সে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। এত অল্প বয়সে কিভাবে সে একটা বাচ্চার বোঝা বহন করবে। যেখানে সন্তান পেটে আসলে প্রতিটি মায়ের মনেই আনন্দ লাগে সেখানে ময়না তার উল্টোটা করছে। শাশুড়ি তাকে সান্ত¡না দিয়ে বললো, এত চিন্তা করছ ক্যান। আমরা আছি না? আমরা হগলেতো মা হইছি। সব মাইয়ারাই প্যাটে বাচ্চা লয়।
দিন যায়, মাস যায়। এভাবে নয়টি মাস চলে গেল। ময়নার বাচ্চা প্রসবের সময় এগিয়ে আসল। এতটা সময় একটা বাচ্চা ময়নার পেটে বেড়ে উঠছে। অথচ কালা মিয়ার পরিবার থেকে ময়নার প্রতি কোন যতœ নেয়া হচ্ছে না। এমনকি কোন ডাক্তারি ঔষধ বা পরীক্ষানিরীক্ষাও করা হয়নি। ভালো কোন খাবার তাকে দেওয়া হয়নি। তাকে দিয়ে ময়নার শাশুড়ি ভারী কাজ করাতো আর বলতো, এই সময় ভারী কাজ করতে হয়। তা না হলে বাচ্চা বড় হয়ে গেলে জন্ম নিতে কষ্ট হবে।
প্রসব বেদনায় অস্থির ময়না। কান্নায় ফেটে পড়লো। আর সহ্য হচ্ছে না তার। ময়নার শাশুড়ি পাশের বাড়ির দাই মাকে নিয়ে আসলো যে মেজেরকান্দি ও আশে পাশে গ্রামের সকলের সন্তান প্রসবের সময় হলে এগিয়ে যায়। সন্তান প্রসব করতে গিয়ে তার হাতে অনেক নারী জীবন দিয়েছে। তারপরও অত্র এলাকার ভরসা এই দাই মা।
দাই ও তার একজন সহযোগি নিয়ে ময়নার ঘরে প্রবেশ করল। সাথে আছে ময়নার শাশুড়ি ও বাড়ির আশে পাশের কিছু মহিলা। ময়নার মা-বাবাকে খবর দেয়া হলো। দাই মা দীর্ঘ দুই ঘন্টা চেষ্টা করেও সন্তান প্রসব করাতে ব্যর্থ হয়ে ময়নার শাশুড়িকে বললো, কালার মা। আমি আর পারছি না। আমার জীবনে অনেক বাচ্চা প্রসব করাইছি। এমন অবস্থা দেহি নাই। আমার মনে হয় বাচ্চা উইল্টা আছে।
– এসব কি কন খালাম্মা!
– হ। তোমরা জলদি কোন কবিরাজ ডাইকা আন। তা না হলে বাচ্চার মাকে বাঁচানো যাবে না। কবিরাজ ডেকে ঝাঁড়ফুক করে দেখ বাচ্চা সোজা হয় কিনা।
দাই মার কথা শুনে কালার মা দ্রুত পাশের গ্রামের নিমাই কবিরাজের বাড়িতে গেলো। নিমাই কবিরাজ আসলো। ততক্ষণে ময়না প্রসব যন্ত্রণায় কাতর। কবিরাজ কি যেন পড়ে ময়নার পেটে ফুঁ দিলো। আর কিছু তেল পড়া দিয়ে দাই মাকে বললো, এই তেল পড়া পেটে মালিশ করতে হবে। তিন ঘন্টার মধ্যে বাচ্চা সোজা হয়ে যাবে। এ কথা বলে কবিরাজ চলে গেলো।
কিন্তু তিন ঘন্টা গিয়ে চার ঘন্টা পার হলো কিছুতেই বাচ্চা সোজা হচ্ছে না। যতই সময় গড়াচ্ছে ততই ময়না বেহুশ হয়ে যাচ্ছে।
– মাগো আমি আর পারছি না। আমাকে মেরে ফেল।
ময়নার চিৎকারে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। কিছুক্ষণ পর ময়নার বাবা-মা আসলো। তারাও মেয়ের এই বিপদে কোন সঠিক পরামর্শ দিতে পারছে না। গ্রামের কেউ কেউ বলতে লাগলো, এই মেয়েকে বাঁচাতে হলে গঞ্জের হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। তাতে সবাই সম্মতি দিল। কিন্তু মেজেরকান্দি গ্রাম শহর থেকে অনেক দূরে। প্রায় চার ঘন্টার রাস্তা। ময়নার বাবা-মা ও শ্বশুর-শাশুড়ি একটি সিএনজি ভাড়া করে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। দীর্ঘ চার ঘন্টা জার্নির পর শহরে এসে পৌঁছল। ময়না তখন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। দ্রুত তাকে অপারেশন রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। ডাক্তার দীর্ঘ এক ঘন্টা অস্ত্রোপাচার করে একটি বাচ্চা বের করে ময়নার শাশুড়িকে দিয়ে বললেন, দু:খিত আমরা বাচ্চার মাকে বাঁচাতে পারলাম না। আপনারা অনেক দেরি করে এসেছেন।
এই কথা শুনার সাথে সাথে ময়নার বাবা-মা কান্নায় ভেঙে পড়লো। তাদের কান্না দেখে ময়নার শ্বশুর-শাশুড়িও কাঁদতে লাগলেন।
১৪/০৯/২০১৫ খ্রি:
মর্জিনা বিবি
রাত আনুমানিক বারোটা। খালেদার চোখে ঘুম নেই। মনটা ছট ফট করছে। ইচ্ছে হল বাইরে বের হতে। রুম হতে বারান্দায় আসতেই দেখে কাজের মহিলা মর্জিনা বিবি বারান্দায় বসে আছে। তার চোখে পানি। খালেদা মর্জিনা বিবির দিকে এগিয়ে গেল।
– আচ্ছা দিদি আপনি এখনও ঘুমান্নি!
মর্জিনা বিবি চোখের পানি আঁচল দিয়ে মুছে বললো, ঘুম আইতেছে না তাই এহানে বইসা আছি।
– কি হয়েছে আপনার?
– কিছুই হয়নি। এমনিতেই।
– আপনি কাঁদছেন কেন?
– কই কাঁদলাম।
– আপনি আমার কাছ থেকে কিছু লুকাচ্ছেন। আরো অনেক দিন দেখিছি আপনাকে এভাবে কাঁদতে? এর কারণ কি বলবেন?
– কেরে কাঁদি তা কি হুনবেন?
– হ্যাঁ। কেন শুনবো না? আজ আমি আপনার কান্নার রহস্য জানতে চাই।
– সে এক বিরাট কাহিনী।
– সংক্ষেপে বলেন।
– তাইলে হুনেন।
মর্জিনা বিবি তার জীবনের ইতিহাস বলতে লাগল খালেদা তার পাশে বসে মনোযোগ দিয়ে শুনছে।
আজ থাইকা ৩০ বছর আগের কথা। আমি তহন যুবতী। আপনার এহন যেই বয়সটা তহন আমার এই বয়সটা ছিল। তহন আমার লগে আমাগো গ্র্যারামে একটি পুলার সাথে আমার প্রেরেম হয়। হের নাম ছিল হাসু। সব পোলামাইয়ারা জন্মের সময় কাঁন্দে। হে নাকি জন্মের সময় খুব হাসছিল, এললেগি এর মা এর নাম রাখছিল হাসু। আমাগোর প্রেরেম যহন হয়ে যায় তহন বাড়ির হগলতে জাইন্না ফালায়। আমার মা হাসুকে খুব পরছন্দ করতো। তাই আমাগো প্রেরেমে মা কোনো বাঁধা দিত না। একদিন মা হাসুদের বাড়িতে আমার বিয়ার প্ররস্তাব নিয়া যায়। প্ররথম হাসুর মা-বাপ রাজি হইছিল না। পরে রাজি হইয়া গেছে।
এতটুৃকু বলেই মর্জিনা বিবি থামল।
খালেদা আরো জানার জন্য বললো, তারপর।
আবার মর্জিনা বিবি বলতে লাগল, তারপর বিয়া হল। বাসর রাতে আমি যহন ঘুমডা দিয়ে বসে থাহি তখন হাসু আমার কাছে আহে। হে তহন আমার ঘুমডা ফালাইয়া বললো, এইভাবে ঘুমডা দিয়া আছ ক্যান? মনে হয় আর কোন দিন দেহনি। আমারে দেখে কি তোমার শরম করছে?
আমি তহন বললাম, কি যেন কন শরম কিহের।
কতক্ষণ চুপ থাকার পর হাসু বললো, এই আমারে ফালাইয়া যাইবা নাতো?
– তোমারে ছাইড়া কোত্তাও যাইব না।
তারপর আরো কিছুক্ষণ কথাবর্তা হয়। পরে আমডা দুইজন দুইজনকে ঝাপটাইয়া ধইরা হুইয়া পড়লাম।
এইটুকু বলেই মর্জিনা বিবি বললো, আর কইতে পারুম না। শরম লাগে।
– না দিদি আজ আমি আপনার পুরো কাহিনীটা শুনব।
– আইচ্ছা ঠিক আছে। তাহলে হুনেন।
কিছু দিন পর আসল ঈদ। ঈদের আগে হাসু আমার জন্যে একটা লিপিস্টিক আনল। আমার হাতে দিয়া কইল, এই হচ্ছে তোমার ঈদের উপহার। আর অহন তোমার ঠোঁটে লিপিস্টিক মেখে আমার গালে একটা চুমা দিবা। তহন আমার গালে দাগ বসবে। ফলে আর কেউ আমার দিকে নজর দিতে পারবেনা।
আমিতো তহন শরমে মরি। কি করুম সোয়ামীর কথা কি অমান্য করা যায়। তাই ওরে তহন আমি চুমা দেই।
তারপর থেকে আমাগো সংসার ভালাই চলছিল। কিছুদিন পর হাসুর কলেরা হয়। এই কলেরাই আমার হাসুরে পর পারে নিয়া যায়। আমি তহন হের লাশের উপর পইড়া কাঁনতে থাহি। এমন সময় আমার হরি আইসা আমার চুলের মুঠি ধরে কয়, আহহারে কি রসের কান্না কানতাছে। এই হতভাগিনী আমার পুলাডারে খাইছে। পোড়া কপালী ভাগ আমার বাড়ি থেকে।
আমি তহন যাইতে চাইলাম না। তহন আমার হওর-হরী জোর কইরা আমারে গলা ধক্কা দিয়া ঘর থেকে বাইর কইরা দেয়। আর তহন আবার বলে, আজকে আমার পুলারে খাইছস পরে আবার আমডার মাথা খাইবি। যা ভাগ এ বাড়ি থেকে।
একথা গুলো বলেই মর্জিনা বিবি কাঁদতে লাগল।
খালেদা বললো, তারা আপনাকে এত অত্যাচার করছে? তারা কি মানুষ ছিল না পশু? আচ্ছা দিদি এর পর কি হয়েছিল শুনি।
মর্জিনা বিবি আঁচল দিয়ে চোখ মুছে বললো, তারপর থেকে ৩০ বছর মাইনষের বাড়িতে কাম করি। বাপের বাড়িতেও যাইনা। পরে আপনার বাপ আমারে আপনাদের এনে আনে। জানি না আর কয় দিন এহানে থাকতে হবে।
খালেদা এবার বলল, আপনি কী আর বিয়ে করেন নাই?
– না। আমার বাপ-মাই আমারে বিয়া দিবার লাগি অনেক চেরেস্ট্রা করছে কিন্তু তাগো সব চেরেস্ট্রাই বাদ হইছে।
– কেন বিয়ে করেনি?
– আমি জানি মাইয়া মাইনষের বিয়া একবারই হয়। তাই এইডাকে আমি ভাগ্য বলে মাইন্না নিলাম। আর আমি হাসুকে খুব বেশি ভালোবাসতাম তাই আর কারোর সাথে বিয়া বইতে পারি নাই।
এতটুকু বলে মর্জিনা বিবি বললো, চলেন আজকে আর না। আর একদিন বলমু। এহন মেলা রাইত হইছে। এখন শোওন গিয়ে।
রচনাকাল: ০৫/১০/২০১৫খ্রি:
মায়ের স্বপ্ন
খোদেজা বেগমের দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন তার সন্তান শাকিল এদেশের একজন নামকরা ডাক্তার হবে। গরিব দু:খী মানুষের সেবা করবে। অভাবের সংসারে কত কষ্ট করে খোদেজা তার সংসার চালাচ্ছেন তা শুধু আল্লাই ভালো জানেন। তার সম্পদ বলতে কিছু নেই। রেললাইনের পাশেই এক বস্তিতে তিনি তার সন্তানকে নিয়ে বসবাস করছেন। তিনি অন্যের বাড়িতে কাজ করে নিজে না খেয়ে শাকিলের লেখাপড়ার খরচ যোগাচ্ছেন।
খোদেজা বেগম একজন সহজ, সরল নারী। খুব সাদা-সিধে তার জীবন যাপন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ তিনি পাননি। প্রকৃতি থেকেই শিক্ষা নিয়েছেন তিনি। অভাবের সংসারে বড় হয়েছেন বিধায় শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। নিজে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিতে পারেননি বলে কি সন্তানকে শিক্ষিত করবেন না! তা কিছুতেই হতে পারে না। তিনি উপলব্ধি করেন শিক্ষার মর্ম। তাইতো ছেলেকে নিয়ে তিনি স্বপ্ন দেখেন। তাকে শিক্ষিত করতে হবে। ছেলে শিক্ষিত হলে নিজের সম্মান বৃদ্ধি পাবে। সমাজে ভালো একটা স্থানে যেতে পারবে। ছেলে চাকুরী করবে সংসারের অভাব দূর হবে। তাইতো খোদেজা বেগম খেয়ে না খেয়ে ছেলের লেখাপড়ার খরচ যুগিয়েছেন। স্বপ্ন একটাই ছেলে শিক্ষিত হয়ে ডাক্তার হবে।
খোদেজা বেগম কখনো পেট পুরে তিন বেলা খেতে পারেননি। তিনি স্বামীকে বেশি ভালো বাসতেন। তাইতো অল্প বয়সেই স্বামী তাকে ছেড়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে। শাকিলের বয়স তখন দুই বছর। এমন সময় সড়ক দুর্ঘটনায় তার স্বামী মারা যান। নির্বাক হয়ে গেলেন খোদেজা বেগম। হে খোদা একি করলে তুমি? কেন তুমি আমার নিষ্পাপ সন্তানকে এতিম করলে?
অল্প বয়সে স্বামীকে হারিয়ে ছেলে শাকিলকে নিয়ে বেঁচে আছেন। তাকে নিয়েই তার সমস্ত স্বপ্ন। শাকিল এবার এইচ.এস.সি পরীক্ষায় গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে। শাকিল কি পাড়বে মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে! মাকে খুশি করতে! দীর্ঘ ষোল বছর যাবত খোদেজা বেগম সংসারের ঘানি টানতে টানতে এখন ক্লান্ত। পৌঢ়তা তাকে টানছে মৃত্যুর দিকে। তারপরও ছেলের লেখাপড়ার প্রতি তার অনেক চেষ্টা। এই শাকিলকে নিয়েই তার সব স্বপ্ন। শাকিলই তার পৃথিবী। শাকিলের জন্য তিনি সব ত্যাগ স্বীকার করছেন। তার বিনিময়ে যেন শাকিল একজন শিক্ষিত মানুষ হয়। ভালো একজন ডাক্তার হয়। এই তার স্বপ্ন।
শাকিল চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে। এমন মমতাময়ী মাকে শাকিল কি করে কষ্ট দিবে? শাকিল তার মায়ের স্বপ্ন পূরণে যথেষ্ট চেষ্টা করছে। সেই ছোট বেলা থেকেই শাকিল ছিল পড়াশুনার প্রতি মনোযোগী। অন্য আট/দশটি ছেলেদের মতো শাকিল নয়। সে ছিল খুবই মেধাবী। তাই খোদেজা বেগম এই ছেলেকে নিয়ে গর্ব করেন। তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেন। শাকিল তার মাকে নিয়ে কতটা চিন্তা করে তা কি শাকিলের মা খোদেজা বেগম জানে?
শাকিল অনেক কিছু ভাবে। একদিন সে ডাক্তার হবে। কোন হাসপাতালে তার চাকুরী হবে। তারপর তার মাকে নিয়ে ঢাকা শহরে ফ্ল্যাট বাসা করে থাকবে। মাকে আর অন্যের বাড়িতে কাজ করতে দিবে না। একদিন তার একটি বাড়ি হবে। মায়ের পছন্দ অনুযায়ী সে বাড়ি বানাবে। মায়ের জন্য সুন্দর করে একটি রুম বানাবে। সেই রুমে মা জায়নামাজে বসে নামাজ পড়বে। আর ছেলের জন্য দোয়া করবে।
আজ শাকিলের স্বপ্নের মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষা। শাকিলের জন্য দিনটি স্মরণীয় হতে পারে আবার দু:স্বপ্নও হতে পারে। যদি এখানে চান্স না হয় তবে মাকে আর মুখ দেখাতে পারবে না। মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে না পাড়লে এ জীবন বৃথা যাবে। কিছুতেই মায়ের স্বপ্নকে ধুলিসাৎ করা যাবে না। তাইতো শাকিল দিনরাত পরিশ্রম করে লেখাপড়া করছে। অন্য ছেলে-মেয়েরা যেখানে দেশের নামিদামী কোচিং সেন্টারগুলোতে পড়ছে সেখানে শাকিল অর্থের অভাবে পড়তে পারছে না। শুধুমাত্র নিজের চেষ্টায় এগিয়ে যাচ্ছে। কোন রকম প্রাইভেট ছাড়াই শাকিল এস.এস.সি ও এইচ.এস.সিতে গোল্ডেন এ প্লাস পায়।
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই শাকিল দেখল তার মা জায়নামাজে বসে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছে। হে আল্লাহ তুমি আমার ছেলেকে সমস্ত বিপদ আপদ থেকে রক্ষা কর। তুমি আমার ছেলেকে ডাক্তার হওয়ার সুযোগ করে দাও। আমার স্বপ্ন তুমি পূরণ করে দাও। আমার জীবনের সব কষ্টের বিনিময়ে তুমি তারে ডাক্তার বানিয়ে দাও।
শাকিল তার মায়ের পাশে গিয়ে বসলো। খোদেজা বেগম মুনাজাত শেষে ছেলের দিকে তাকালেন। কি বাবা কিছু বলবি।
শাকিল মাথা নাড়িয়ে বললো, হ্যাঁ মা।
– বল।
– মা তুমি আমার জন্য এত চিন্তা কর কেন?
– বাহরে তুই আমার একমাত্র আদরের ধন, কইলজার টুকরা। তোরে নিয়ে চিন্তা করুমনাতো কারে নিয়া চিন্তা করুম?
– আমাকে নিয়ে তোমার এত চিন্তা করতে হবে না। দেখ মা আমি তোমার স্বপ্ন পূরণ করবই ইনশা আল্লাহ। আল্লাহ যদি সহায় থাকে তোমার স্বপ্ন আমি বৃথা যেতে দিব না। তুমি শুধু আমার জন্য দোয়া কর।
– তাই যেন হয় বাবা।
শাকিল চলে গেলো ভর্তি পরীক্ষা দিতে। যথারীতি পরীক্ষা দিয়ে বের হল। যতক্ষণ সে পরীক্ষার হলে ছিল ততক্ষণ খোদেজা বেগম নফল নামাজ পড়ছেন আর আল্লাহর কাছে দোয়া করছেন। শাকিল পরীক্ষা দিয়ে বাড়িতে আসল। শাকিলে মা জিজ্ঞেস করলো, বাবা কিরুম হইছে পরীক্ষা?
– শাকিল মুখে হাসির রেখা টেনে বললো, মা তোমার দোয়াই আল্লাহর রহমতে ভালো হয়েছে।
শাকিল এখন অপেক্ষার প্রহর গুণছে কখন ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট দিবে। কিছুদিন পরই ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট বের হলো। শাকিল মেডিকেলে চান্স পেয়ে গেল। এ খবর খোদেজা বেগম শুনতে পেয়ে ছেলেকে জড়িয়ে কাঁদতে লাগলেন।
শাকিল বললো, মা তুমি কাঁদছো কেন? আজতো খুশির দিন।
খোদেজা বেগম আঁচল দিয়ে চোখ মুছে বললো, হ্যাঁ বাবা আজ খুশির দিন। অতি দু:খে যেমন মানুষ কাঁদে আবার অতি খুশিতে মানুষ কাঁদে। আমি আজ খুশিতে কাঁদছি।
২৩/০১/২০১৬খ্রি:
কাশফুল
আকাশে শরতের সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। খুব ইচ্ছে করছে শরতের সাদা মেঘগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকি। কিন্তু আকাশের দিকে তাকাতে পারছি না। উপরে আকাশ নিচে নদী মাঝখানে আমি ও রফিক। তিতাস নদীর দুপাশে কাশফুল। খুব ভালই লাগছে। আমি আর রফিক কাশফুল দেখার উদ্দেশ্যে নৌকা ভ্রমণে বের হয়েছি সেই বিকাল বেলা।
ধরাভাঙ্গা গ্রামের পাশেই তিতাস নদী। নদীর পাড়ে সারি সারি কাশফুল ফুটে আছে। এটি বাংলাদেশের আর পাঁচটি গ্রামের মতো নয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার শেষ সীমানায় এই গ্রামটি অবস্থিত। উন্নয়নের তেমন ছোঁয়া লাগে নি। এ গ্রামের মানুষগুলো খুবই সাধা-সিধে, সহজ-সরল। একজনের বিপদে আরেকজন এগিয়ে আসে। বিপদ আপদে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে শত্রুর বিপক্ষে ঝাপিয়ে পড়ে। এক বাড়িতে কোন আনন্দ অনুষ্ঠান হলে সবাই মিলেমিশে সেই অনুষ্ঠান উপভোগ করে। এই গ্রাম থেকে সলিমগঞ্জ বাজারে যাওয়ার একমাত্র রাস্তাটি ভাঙাচোরা। এই রাস্তায় প্রতিদিন শত শত মানুষ কষ্ট করে দেড় কিলোমিটার দূরে সলিম গঞ্জ বাজারে গিয়ে বাজার সদাই করে। এই গ্রামের দক্ষিণ পাশে মস্ত বড় এক বিল। বিলের এক পাশে রফিকদের গ্রাম ধরাভাঙ্গা আর অন্যপাশে আছে মুক্তারামপুর গ্রাম। দুই গ্রামের মাঝখানে এই বিলের অবস্থান। সেই বিলে বর্ষাকালে এক সময় মাছ চাষ করা হতো। আর শীতকালে যখন সেই বিল শুকিয়ে যেত তখন সেখানে বোরো ও এনাম ধান লাগাতো কৃষকরা।
কোরবানীর ঈদ করার জন্য গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে আসছে রফিক। বাড়িতে এসে দেখে সেই বিলের চেহারা অন্যরকম হয়ে গেছে। এমন চেহারা রফিক আর কোন দিন দেখেনি। হঠাৎ করে বিলের দিকে নজর দিতেই রফিক দেখল সমস্ত বিল কচুরী পানায় ভরে গেছে। মনে হয় যেন কচুরী পানার চাষ করা হচ্ছে। সবগুলো কচুরী পানায় ফুল ফুটেছে। এ এক অন্যরকম দৃশ্য। বিলের আশে পাশে ও তিতাস নদীর দুধারে কাশফুল ফুটেছে। এ দৃশ্য দেখার জন্য রফিক আমাকে ঈদ উপলক্ষে তাদের বাড়িতে যাওয়ার জন্য নিমন্ত্রণ করল। আমিও কাশফুল, কচুরী পানা, নদী, গ্রাম এগুলো কখনো দেখিনি। তাই এসব দেখার জন্য রফিকের আমন্ত্রণে আর দেরি না করে ঈদের পরদিন চলে আসলাম তাদের গ্রামে।
রফিক বিকাল বেলায় আমাকে নিয়ে ঘুরতে বেড় হয়েছে। আমাদের উদ্দেশ্য প্রথমে কচুরীপানা দেখব এবং পরে নৌকায় করে কাশফুল ও প্রকৃতি উপভোগ করব। আমিতো এমন সুন্দর পরিবেশ দেখে অবাক। কচুরী পানার ফুল দেখে লোভ সামলাতে না পেরে সাথে থাকা ক্যামেরায় বন্ধি করি সেই চমৎকার ছবিগুলো। বিলের শেষ প্রান্তে আছে ব্রিজ। সেই ব্রিজে দাঁড়িয়ে পুরো বিলের ছবিটি উঠালাম।
কচুরীপানা দেখার পর নৌকায় তিতাস নদীতে গিয়ে ডিঙি নৌকায় উঠলাম। এই প্রথম আমি নৌকাতে উঠলাম। কারণ শৈশব কেটেছে আমার শহরে। গ্রামে আমার কেউ নেই বলে কোনদিন গ্রামে আসা হয়নি। আর নদী, কাশফুল এগুলোতো চোখেই দেখিনি। নৌকা ছুটছে নদীর পাড় ঘেষে। রফিক নিজে মাঝি সেজে নৌকা চালাচ্ছে। নৌকা ছুটছে স্রোতের টানে। আমি আকাশের দিকে তাকালাম। শরতের আকাশ খুব সুন্দর। শরতের সাদা সাদা মেঘ এবার স্পষ্ট করে বোঝা যাচ্ছে। বেশ ভালই লাগছে।
ধরাভাঙ্গা গ্রামের উত্তর পাশেই রয়েছে বিশাল একটি চর। আমরা লক্ষ্য করলাম সেই চরে অসংখ্য কাশফুল ফুটেছে। সেই দৃশ্য উপভোগ করার জন্য ও ছবি তোলার লোভ সামলাতে না পেরে আমি রফিককে বললাম তাড়াতাড়ি নৌকা ঐ চরে নেয়ার জন্য। নৌকা ওপারে এসে থামল। আমরা চরে নেমে পড়লাম। একটু সামনে গিয়ে দেখি কাশফুলে ছেয়ে গেলে পুরো চর।
কাশফুল দেখে আমি আকাশ হাতে পাওয়ার মতো আনন্দিত হলাম। এ রকম আনন্দ জীবনে খুব কমই এসেছে। চারদিকে কাশফুল। যেন কাশফুলের বাগান। যেদিকে তাকাই শুধু কাশফুল আর কাশফুল। উপরে সাদা সাদা মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে আর নিচে এই কাশফুলের বাগান। শরতের যেন অপূর্ব সৃষ্টি। এ দৃশ্য প্রচন্ড ভালো লাগছে আমার। রফিককে ধন্যবাদ দিতে হয় এ রকম পরিবেশে নিয়ে আসার জন্য। কাশফুলের মাঝ দিয়ে হেঁটে চললাম আমরা। ফুলের এলাকা যেন শেষ হচ্ছে না। আশে পাশে তাকিয়ে লক্ষ্য করলাম কয়েক জোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা বসে প্রেমালোচনায় মগ্ন। ওদের যেন ডিস্টাব না হয় সেই ভেবে আমরা অন্যদিক দিয়ে সামনে এগুতে লাগলাম।
কাশফুলের সাথে নদীর একটি সর্ম্পক আছে। তাইতো বেশিরভাগ কাশফুল নদীর তীরেই ফুটে। সাদা সাদা মেঘের মতো বাতাসে দুল খাচ্ছে কাশফুল। এ দৃশ্য দেখে আমি অভিভূত হয়ে গেলাম। এমন চমৎকার নয়নাভিরাম দৃশ্য আর কোনদিন দেখিনি। যেখানে তাকাই শুধু সাদা মেঘের মতো যেন ভেসে বেড়াচ্ছে কাশফুল।
কথিত আছে, নদীর তীরে যে সারি সারি কাশফুল দেখা যায় তা একদা এক অপসরার কেশের মতো ঘনকালো দীঘল ছিল। অপসরার হলো শরৎ ঋতু পরিচালিকা সুরকেশী। শরৎ কাল এলে এই অপসরা স্বর্গ থেকে তার দীঘল ঘনকালো কেশগুলো ছড়িয়ে দিতো কাশফুলের রূপে। কেশগুলো ছড়িয়ে নদীর শারদীয় বাতাস ও রোদে শুকাতো। শারদীয় বাতাসে কাশফুলে একটা নরম সুরের মূর্ছনা উঠতো। রাতেরবেলা সেই সুরের মোহে নদীকূলকর্তী যুবক ও যুবতীরা ছুটে আসতো, প্রণয়ে মত্ত হতো। সেই কথা অনেক আগেই আমি বইয়ে পড়েছি। আজ তা সরাসরি দেখে মুগ্ধ হলাম।
আমি লক্ষ্য করলাম চারিদিকে ঘন কালো দীঘল কাশফুল বাতাসে ঢেউ খেলছে। ঋতু পরিবর্তনের চক্রে সুরকেশী এবার যেন দ্রুত পদক্ষেপেই ধরায় এসেছে। তিতাস নদীর দুই তীর যেন এক অপার বিস্ময়ের রূপ ধারণ করেছে। নদী তীরের বৃক্ষরাজীগুলো ভিন্ন সৌন্দর্যে শোভিত হয়েছে। আমি আরো লক্ষ্য করে দেখলাম নানান পাখি এ গাছ ও গাছে গান গেয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। ফুলে ফুলে প্রজাপতিরা ডানা মেলে ওড়ছে।
অনেকক্ষণ ধরাভাঙ্গার চরে বেড়ালাম। যতই ঘুরছি ততই ভাল লাগল। এখন সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। রক্তিম সূর্যটা টুপ করে আমাদের সামনে ডুবে গেল। সন্ধ্যা হতে না হতেই কাশফুলগুলো যেন বীনের বাজনা শুরু করে দিল। হালকা বাতাসে দুল খাচ্ছে কাশফুল। এবার বিদায়ের পালা। আর এখানে থাকা যাবে না। তাই দুই বন্ধু চলে আসলাম।
রফিকদের গ্রামের পূর্ব পাশে এমপি টিলা খ্যাত একটি স্থান আছে। সেখানে ইদানিং একটি ইটখোলা তৈরি করা হয়। এর পাশেই মেঘনা নদী। সেই ইটখোলা ও এমপি টিলা দেখার জন্য আমরা সেখানে যাই। এই এমপি টিলাটি তৈরির পেছনে একটি ছোট ইতিহাস আছে। এ গ্রামের সাবেক প্রয়াত এমপি ছিল আঃ লতিফ। তিনি নদী ভাঙ্গন রোধ করার জন্য মাটি দিয়ে নদীর পাড় অনেক উঁচু করে দেন এবং এর চারপাশে সিমেন্টের পাটা দেন। এর ফলে নদী ভাঙ্গন রোধ হয়। এই পাড়ে এখন বিভিন্ন গাছ লাগানো হয়। এটা এখন দূর থেকে দেখলে পার্কের মতো মনে হয়। তাই এলাকার মানুষ এই জায়গাটার নাম এমপি টিলা রাখে এবং এই নামেই সবাই ডাকে। প্রতিদিন বিকেল বেলা গ্রামের বিভিন্ন পেশার লোকজন ও অন্যগ্রামের লোকজনও এখানে বেড়াতে আসেন। বিশেষ করে বছরে দুটো ঈদে এখানে বেশি লোক সমাগম হয়। তাছাড়া ইদানিং ইটখোলা তৈরি হওয়ায় দর্শনার্থীদের ভীড় বেড়ে গেছে।
পরদিন বিকাল বেলা সেই এমপি টিলা ও ইটখোলা পরিদর্শনে গেলাম। দেখলাম শত শত নারী-পুরুষ শিশু-কিশোর বুড়া-বুড়ি সবাই এমপি টিলা ও ইটখোলা পরিদর্শনে আসছে। আমরা একে একে ইটখোলার বিভিন্ন দৃশ্য ও এমপি টিলার নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হয়। তারপর সন্ধ্যা লগ্নে বাড়ি ফিরে আসি।
প্রথম বার গ্রামে এসে রফিকের সাথে আনন্দময় কিছু মূহুর্ত কাটিয়ে ফুরফুরে মন নিয়ে আজ আবার ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম।
রচনাকাল: ১৫/০৮/২০১৪ খ্রি:
ফেরা
এক
১৯৯৫ সাল।
শীতের সকাল। চারদিকে কুয়াশা। কুয়াশার জন্য দূরের লোকজন তেমন দেখা যায় না। এখনও সূর্য উঠেনি। জসিম উদ্দিন রেললাইনের পাশ দিয়ে হাঁটছেন। ডাক্তারের পরামর্শে প্রতিদিন ভোরে উঠে তিনি হাঁটেন। কিছুক্ষণ হাঁটার পর তার কাছে মনে হল কোথাও একজন কাঁদছে। কয়েক কদম যাওয়ার পর দেখলো আট-নয় বছরের একটি মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে তার দিকে এগিয়ে আসছে। জসিম উদ্দিন যতই সামনে যাচ্ছে ততই মেয়েটি সামনে আসছে। মেয়েটি ইতোমধ্যে জসিম উদ্দিনের কাছাকাছি চলে আসলো। জসিম উদ্দিন কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই মেয়েটি তাকে ঝাপটে ধরে বললো, আংকেল আমার আব্বু আমাকে রেখে চলে গেছে। আব্বুকে খুঁজে দেন। বলেই সে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো।
মেয়েটি হঠাৎ জসিম উদ্দিনকে ঝাপটে ধরায় তিনি ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলেন। মেয়েটিকে দেখে মনে হলো কোন ভদ্র ঘরের মেয়ে। কিন্তু এই সকাল বেলায় এখানেই বা এলো কি করে? তার বাবাকেই বা তিনি কিভাবে খুঁজে দেবেন। জসিম উদ্দিন মেয়েটিকে দুই হাতে সারিয়ে বললো, এই মেয়ে এসব কি বলছ?
জসিম উদ্দিনের প্রশ্নে সে আরো ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো।
– এই মেয়ে কাঁদছ কেন? বল কি হয়েছে?
মেয়েটি শীতে থর থর করে কাঁপছে আর কাঁদছে। মনে হয় জসিম উদ্দিনকে পেয়ে তার কিছুটা সাহস হয়েছে। তাই আবার বললো, আমার আব্বুকে খুজে দেন আংকেল।
– কি হয়েছে তোমার আব্বুর?
– আমার আব্বু আমাকে রেখে চলে গেছে?
– এতটুকুন মেয়েকে রেখে কোন বাবা চলে যেতে পারে? ঘটনা কি সত্যি করে বল। তুমি তোমার বাবার সাথে রাগ করেছো?
– না আমি রাগ করিনি।
– তোমার নাম কি?
– সাদিয়া।
– কোথায় তোমার বাড়ি?
– ঢাকা আমাদের বাড়ি।
-এখানে আসলে কি করে?
– চট্টগ্রাম থেকে আব্বুর সাথে ঢাকায় যাচ্ছিলাম। কিছুক্ষণ আগে সামনের স্টেশনে ট্রেন থামে। আব্বু তখন ট্রেনে বসে ঘুমাচ্ছিল। তখন আমি ট্রেন থেকে নামি। নামার কিছুক্ষণের মধ্যে ট্রেন আমাকে রেখে চলে গেল। আমি আর ট্রেনে উঠতে পারিনি।
– কেন নামছিলে?
– দেখার জন্য।
– বাবাকে কেন সজাগ করলে না?
– আমি কি জানি ট্রেন আমাকে ছেড়ে চলে যাবে?
– এখন কি করবে কিভাবে তোমার বাবাকে খুঁজে বের করব? ঢাকার কোন জায়গায় তোমাদের বাসা?
– বনানী।
– বাসা নম্বর কত জান?
– না।
– তাহলে তোমার বাবাকে কোনদিনই আমার পক্ষে খুঁজে বের করা সম্ভব হবে না।
– তুমি এক কাজ কর। আমার কোন সন্তান নেই। তুমি আমার বাসায় থাকতে পার। আমাকে তুমি বাবা ডাকবে। আমি মেয়ের মতো তোমাকে লালন পালন করব।
– না আপনাকে আমি বাবা ডাকব না। আপনি আমার বাবাকে বের করে দিন।
– ঠিক আছে আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব তোমার বাবাকে খুঁজে বের করার জন্য। যদি না পাই তাহলে আমার বাসায় থাকবে।
– ঠিক আছে।
সাদিয়া জসিম উদ্দিনের বাসায় থাকতে রাজি হওয়ায় তাকে নিয়ে তিনি বাসায় আসলেন।
জসিম উদ্দিন সাদিয়াকে নিয়ে ঢাকার বনানীর অলিগলি সব জায়গায় ঘুরলো। সাদিয়া তাদের বাসা জসিম উদ্দিনকে চিনাতে পারেনি। তাই তার আপ্রাণ চেষ্টা থাকা সত্ত্বেও তিনি তার আব্বুকে খুঁজে বের করতে পরেননি। সেই থেকে জসিম উদ্দিনের বাসায় সাদিয়া তার মেয়ে হয়ে থাকতে শুরু করলো।
জুলফিকার আলীর একমাত্র মেয়ে সাদিয়া ছিল নয়নের মনি। তাকে হারিয়ে তিনি এখন পাগল। হঠাৎ করে ঘুম থেকে জেগে মেয়েকে না পেয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। মেয়ের খোঁজে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের রেল লাইনের প্রতিটি স্টেশনে তিনি খুঁজেছেন। কোথাও মেয়েকে পাননি। মেয়ের শোকে তিনি পাগল হয়ে গেলেন। রাস্তায় যখন যাকে দেখেন তখনই তিনি তাকে জড়িয়ে ধরে বলেন, আমার মেয়েকে খুঁজে দাও। তিনি আর বাসায় ফিরে যাননি। সেই থেকে তার ঠিকানা হলো রেলস্টেশন।
দুই
২০১৫ সাল।
জসিম উদ্দিন এখন সত্তর বছরের বৃদ্ধ। আর সাদিয়ার বয়স প্রায় ত্রিশ বছর। জসিম উদ্দিন সাদিয়াকে নিজের মেয়ে মনে করে তার জীবনের শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে তাকে পড়াশুনা করিয়েছেন। সাদিয়া এখন দেশের একজন নামকরা ডাক্তার। সাদিয়ার জন্য পাত্র খুঁজছেন জসিম উদ্দিন। শেষ বয়সে তাকে বিয়ে দিয়ে নাতির মুখ দেখে মরতে চান তিনি।
সাদিয়া আজ বড় ডাক্তার। দেশের অসহায় মানুষের চিকিৎসা করেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজেই তার পোস্টিং। প্রতিদিন শত শত অসহায় রোগীর চিকিৎসা করেন। বৃদ্ধ কোন রোগী দেখলেই তার বাবা মায়ের কথা মনে পড়ে যায়।
আজ হঠাৎ করে ৬০/৬১ বৎসরে একটি পাগল তার চেম্বারে এসে হাজির। উসকু খুসকু চেহারা। দাড়ি গোফে সারা মুখ একাকার। মাথায় চুলের ঝটলা। পাগল লোকটি ডা: সাদিয়াকে বললো, এই ডাক্তার আমার মেয়েকে খুঁজে দাও।
পাগলের কথা শুনে ডা: সাদিয়া চমকে উঠলো, আপনি এসব কি বলছেন? আমি আপনার মেয়েকে কোথায় পাব?
– পাবে! রেল স্টেশনে পাবে! ট্রেনের ভেতর পাবে!
– কি বলছেন আপনি? আপনার মেয়ের নাম কি?
– সাদিয়া।
– সাদিয়া!
পাগলের মুখে এ কথা শুনতেই সাদিয়া চমকে উঠলো। কি বলছে ওনি। রেল স্টেশন! সাদিয়া! ট্রেন! তার স্মৃতি নাড়া দিয়ে উঠলো। মনে পড়লো ছোটবেলায় রেল স্টেশন থেকে হারিয়ে যায়। কিন্তু ওনি কে? কে আপনি?
আমি জুলফিকার পাগল।
হ্যাঁ মনে পড়ছে সাদিয়ার। তার বাবার নাম জুলফিকার। তাহলে ওনিই আমার পিতা!
চেহারার দিকে ভাল করে তাকিয়ে দেখল তার বাম গালে বড় একটি তিল আছে। তার স্পষ্ট মনে পড়ছে তার আব্বুর গালেও তিল ছিল। এ আর কেউ নয়। তিনি আমার আব্বু। আমার খুঁজে দীর্ঘ বিশ বছর পাগল অবস্থায় ঘুরে বেড়াচ্ছে।
আর ভাবতে পারছে না। আব্বু বলেই চিৎকার দিয়ে জুলফিকার পাগলকে জড়িয়ে ধরলো।
জুলফিকার পাগল বললো, না তুমি আমার মেয়ে না। আমার মেয়ে ডাক্তার না।
– না আব্বু আমিই তোমার সেই হারানো মেয়ে। দেখ আজ আমি কত বড় হয়েছি। দেশের নামকরা ডাক্তার হয়েছি। আমি আর সেই ছোট্ট খুকিটি নেই।
– সত্যি বলছিস? তুই আমার বুকের ধন। তুই আমার কলিজার টুকরা সাদিয়া। আয় আমার বুকে আয় মা। তোকে পেয়ে আজ আমি জীবন ফিরে পেয়েছি।
– আব্বু তোমার এই অবস্থা কেন?
– শুধু তোর জন্য। তুকে না পেয়ে দীর্ঘ ২০ বৎসর যাবত রেল স্টেশনে থেকেছি। শুধু তুর দেখা পাব বলে। এই বলেই পকেট থেকে সেই ছোট্ট সাদিয়ার একটি সাদাকালো ছবি বের করে বললো, এই দেখ সেই ছোট্ট বেলায় তুকে হারিয়েছি। আজও তোর ছবি বুকে নিয়ে ঘুরছি।
এই ছবি দেখে ডাঃ সাদিয়া অজোর ধারায় কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো।
– এই কাঁদবি না। আজ আর কাদার দিন নয়। চল বাড়ি চলি।
– না বাবা। যার অন্ন খেয়ে বড় হয়েছি। যার আশ্রয়ে আমি আজ ডাঃ হয়েছি তাকে না বলে কিভাবে বাড়ি যাই? যার মায়া মমতায় তোমার কথা আমাকে ভুলিয়ে রাখছে তাকে তুমি দেখে যাবে না?
সাদিয়া তার বাবাকে সেলুন থেকে গোফ দাড়ি কাটালো। নতুন পাঞ্জাবী পড়িয়ে তার বাসায় নিয়ে আসলো। এসেই তার পালিত বাবা জসিম উদ্দিনের রুমে ঢুকলেন।
জসিম উদ্দিন জুলফিকার কে দেখে বললো, সাদিয়া মা উনি কে?
– বাবা এ হচ্ছে আমার জন্মদাতা আব্বু। এই আব্বুর খোঁজে দীর্ঘ ২০ বছর যাবত আমি তোমার বাসায় আশ্রিত হয়ে আছি।
– এসব কি বলছিস মা! তুই আশ্রিত হবি কেন? তুইতো আমার মেয়ে। বুকের ধন। আমি তুকে জন্ম দেইনি ঠিক কিন্তু তুকে আমি আমার নিজের সন্তানের মতো করেই লালন পালন করেছি। তুকে পেয়ে আমি পিতার স্বাদ পেয়েছি। তুকে না পেলে হয়তো এতদিন বেঁচে থাকতাম না।
– এই জন্য বাবা আমি তোমার কাছে চির ঋণী। কিন্তু আজ বাবা আমাকে বিদায় দিতে হবে। আমি আমার আসল ঠিকানায় ফিরে যেতে চাই।
এ কথা শুনার পর জসিম উদ্দিন বললো, একি বলছিস মা। এ আমি পারব না। আমি তোকে ছাড়া থাকতে পারব না।
– কিন্তু বাবা কিছু করার নেই। আমাকে আমার আসল ঠিকানায় ফিরে যেতে হবে।
– না তুই যেতে পারবি না। যেতে হলে আমার বুকের উপর দিয়ে যেতে হবে। এই বলেই জসিম উদ্দিন ডা: সাদিয়ার সামনে শুয়ে পড়লেন।
ডা: সাদিয়া এ দৃশ্য দেখে নির্বাক হয়ে গেলো।
রচনাকাল: ১৫/১১/২০১৫ইং
বোকা
সকাল বেলা ঘুম ভাঙ্গলো একটি মেয়ের মোবাইল ফোনের আওয়াজে। বেশ কয়েকবার মোবাইলে রিং বাজল। বিরক্ত হয়ে মোবাইল রিসিভ করলাম।
– হ্যালো…
– হ্যালো…
– হ্যালো কে বলছিলেন?
– আই আপনার বউ।
– কি বললে, আপনি আমার বউ! আমার বউতো আমার সাথেই ঘুমাচ্ছে।
– আপনার বউ আপনার সাথেই ঘুমাচ্ছে! এসব কিতা বলছেন আপনি?
– সত্যিইতো বলছি।
– আপনি না ঐদিন আ্যারে বিয়া কইরা গেছেন।
– এসব কি আবোল তাবুল বলছেন আপনি?
– আইতো কিছুই বুঝিনি। আপনার বউ কয়টা?
– কেন? আমার বউ একটা।
– ঐদিন আপনি আ্যার মাথায় হাত রেখে বললেন আপনার কোন বউ নেই। আইজকা বলছেন আপনি বউয়ের সাথে ঘুমাচ্ছেন! সত্যি কইরা বলেনতো আপনার বউ কয়টা?
– আচ্ছা আপনি কোথায় ফোন করেছেন বলেনতো?
– আমিতো আ্যার জামাইরে ফোন দিয়েছি।
– তাতো বুঝলাম। আপনার জামাইর নাম কি?
– মাইয়া মাইনসের জামাইর নাম মুখে নিলে পাপ হয়। তাই কওবার পারুম না।
– আমার মনে হয় আপনি রং নাম্বারে ফোন করেছেন।
– জিনা আমি ঠিক নাম্বারেই ফোন করেছি।
– তাহলে বলুনতো এটা কোন জায়গা?
– আপনি বলুন কোন জায়গা?
– আমি কেন বলব? আপনি কাকে, কোন জায়গায় ফোন দিয়েছেন তাতো আপনিই ভালো বলতে পারেন।
– আমিতো আ্যার জামাইরে ফোন দিয়েছি এইডা প্রথমই বললাম।
– যতসব ফালতু প্যাচাল। আমি আপনাকে চিনি না। ফোন রাখুন আমি এখন ঘুমাচ্ছি।
এই বলেই আমি ফোন লাইনটি কেটে দিলাম। কিছুক্ষণ পর সে আবার ফোন দিল।
– এই আপনি আ্যার ফোন কেটে দিলেন কেন?
– আপনি আবার ফোন করেছেন কেন? আমি না বললাম আপনাকে চিনি না।
– কিন্তু আইতো আপনাকে চিনি।
– চিনলে পরিচয় দিচ্ছেন না কেন?
– বললাম না আই আপনার বউ।
– আচ্ছা আপনার মতলবটা কি বলুনতো? কেন আমাকে বিরক্ত করছেন?
– কোন মতলব নেই।
– আচ্ছা আপনি আমার ফোন নাম্বার পেলেন কোথায়?
– আপনিতো আ্যারে নাম্বার দিয়ে বলছেন ফোন করার জন্য।
– কবে কখন?
– হায় আল্লাহ আপনার দেহি কিচ্ছু মনে থাহেনা। হেদিন একলগে পার্কে ঘুরলাম। তারপর বিয়ে করলাম। বাসর হলো। পরে চলে আসলেন। আর বললেন মাঝে মাঝে ফোন দিও। কয়দিন পর আননে আ্যার সাথে দেখা করবেন। আহন দেহি কিচ্ছুই মনে নাই।
– আপনার নাম কি?
– বুজছি। আপনি নতুন বউ পাইয়া আ্যার নামও ভুইলা গেছেন!
– নতুন বউ! আমিতো ছয় বছর আগেই বিয়ে করছি। বউতো কবেই পুরানো হয়ে গেছে।
– হইছে আর মিছা কতা কইতে হবো নে। আননে যে আমারে ভুইলা গেছেন আজকা ফোন না দিলে বুজবার পারতাম না।
– আপনি আর ফোন দিয়ে আমাকে বিরক্ত করবেন না। আমার কোন দ্বিতীয় বউ নেই।
– ঠিক আছে এখন রাখছি। তয় পরে আবার ফোন দিব নে।
এই বলে মেয়েটি ফোন নিজেই রেখে দিলো।
স্ত্রী রাবেয়া আমাদের ফোনালাপ সবই শুনছে। মেয়েটি ফোন রেখে দেওয়ার পরই রাবেয়া বললো, এত সকাল বেলা তোমাকে কে ফোন দিল?
– কি জানি কে? চিনি না। মনে হয় রং নাম্বার।
– রং নাম্বারে এতক্ষণ কথা হয়! তার কথা শুনেতো বুঝতে পারলাম ও তোমার বিয়ে করা বউ।
– ওতো তাই বলল।
– কি বললে! তুমি আরেকটা বিয়ে করছ?
– কি যা তা বল। আমি বিয়ে করতে যাব কেন?
– তা না হলে ঐ মেয়ে তোমাকে এত সকালে ফোন করে বলবে কেন?
– কি জানি। আমিতো ঐ মেয়েকে চিনি না। আর সে বললেই কি আমি তার স্বামী হয়ে যাব?
– সামথিং রং। তুমি ডুবে ডুবে জল খাচ্ছ আর আমি জানি না।
– তুমি কি আমাকে সন্দেহ কর?
– এত দিন সন্দেহ করিনি। কিন্তু এখন করছি।
– কেন সন্দেহ কর?
– বিয়ে না করলে কোন মেয়ে ফোন করে বলতে পারে না ‘আমি তোমার বউ।’
– ভালো মেয়েরা একথা বলে না। কিন্তু ফালতু মেয়েরা ঠিকই শয়তানি করে বলে। এই নিয়ে কেন শুধু শুধু সন্দেহ করছো?
– কোন স্ত্রীই একথা শুনার পর ঠিক থাকতে পারে না।
– তুমি কেন অযথা মাথা ঘামাচ্ছো। এটাতো একটা ফানও হতে পারে। হতে পারে কোন পরিচিত বান্ধবী আমার সাথে দুষ্টুমির ছলে এ কথা বলছে। আবার অপিরিচিত দুষ্টু প্রকৃতির মেয়েরাও ছেলেদেরকে এভাবে ব্ল্যাকমেইল করে প্রেমের ফাঁদে ফালানোর জন্য বলতে পারে। দেখ বাজে চিন্তা করে সংসারে অশান্তি ডেকে আনবে না। আমি তোমারই আছি তোমারই থাকব।
– ঠিক আছে ঐ মেয়ে যদি ফের আবার তোমাকে ফোন দেয় তাহলে কিন্তু খবর আছে।
– ঐ মেয়ে যদি আবার আমাকে ফোন দেয় তাহলে আমি কি করতে পারি। আমিতো তাকে বাঁধা দিয়ে রাখতে পারব না। পারব মোবাইল ফোন বন্ধ করে দিতে।
– প্রয়োজনে তাই করবে।
এই বলেই আজকের মতো রাবেয়ার সাথে মিমাংসা হয়ে গেল। ব্যাপারটা এখানেই শেষ হয়ে যেত যদি না ঐ মেয়েটি রাত বারটার পর ফোন না দিত।
একটি মাত্র মেয়ে হঠাৎ করে আমার সংসারে অশান্তি সৃষ্টি করছে। এবার রাগের সহিত ফোনটি রিসিভ করে বললাম, এই আপনাকে ফোন করতে নিষেধ করছি। তারপরও কেন আবার ফোন করলেন?
– আপনার নিষেধতো আর আই মানিনি। আর মানবই বা ক্যান? বউ তার জামাইর কাছে ফোন করবে এতে নিষেধাজ্ঞার কি আছে?
– আপনি কিন্তু সীমালঙ্গন করছেন। রাত বারটার পর ফোন দিয়ে আমাকে ডিস্টাব করছেন। ভদ্র পরিবারের কোন মেয়ে এত রাতে ফোন করে কোন বিবাহিত পুরুষকে ডিস্টাব করতে পারে না। অভদ্র কোথাকার। ফোন রাখুন।
– এই আপনি কিন্তু আ্যার পরিবারকে নিয়ে গালাগালি করছেন। তা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না। আপনিতো ভদ্র ছেলে তাহলে আ্যার সাথে অভদ্র ব্যবহার করছেন কেন?
– শুধু আপনার কারণে এখন অভদ্র হচ্ছি। আপনি আমার পরিবারে অশান্তি সৃষ্টি করছেন।
– আই আপনার পরিবারে অশান্তি সৃষ্টি করছি!
– হ্যাঁ শুধু আপনার কারনে সকালে আমার স্ত্রীর সাথে ঝগড়া হয়েছে।
– আমি জানি আপনার কোন বউ নেই। আর আমিই আপনার একমাত্র বউ।
– আমার কিন্তু ধৈর্য্যরে বাঁধ ভেঙ্গে যাচ্ছে। আর ফের যদি আপনি আমাকে ডিস্টাব করেন তাহলে আপনাকে আমি পুলিশে দিব।
– পারবেন না।
আমার ফোনে চেচামেচিতে রাবেয়ার ঘুম ভেঙ্গে গেছে।
– এই কি হয়েছে তোমার। আবার কার সাথে কথা বলছো?
– আর বল না। ঐ ফালতু মেয়েটা আবার ফোন করে যা তা বলছে।
– ফোনটা দাওতো আমার কাছে দেখি কার মেয়ের এত বুকের পাঠা আমার স্বামীর সাথে পিরিতের আলাপ করে।
আমি ফোনটা লাউড স্পিকার দিয়ে রাবেয়ার হাতে দিলাম।
– হ্যালো… কে আপনি?
– আপু আমি তোমার ছোট বোন ঋতু।
– ঋতু তুই!
– হ্যাঁ আপু।
– তুই আমার স্বামীর সাথে এসব বলছিস কেন?
– আরে আপু। দুলাভাইয়ের সাথে একটু দুষ্টুমি করলাম। কণ্ঠ ও ভাষা পরিবর্তন করে কথা বলায় বেচারা আমাকে চিনতেই পারল না। দেখলাম আমার আদরের বোন জামাই আমার বোনকে কতটুকু ভালোবাসে। না আপু দুলাভাইকে পটানো সম্ভব নয়। আমি কয়েকবার ফোন দিলাম দুলাভাইতো একবারও আমাকে ফোন দিল না।
এই কথা শুনে দুবোন খিল খিল করে হাসতে লাগল।
আর আমি তাদের কথা শুনে বোকা বনে গেলাম।
১৪/০৮/২০১৬ইং
ফাঁদ
আজ অফিস থেকে বের হতে শাহিনের অনেক দেরি হয়ে গেছে। সারাদিন তার উপর ধকল গেছে। তাছাড়া বাসার বাজার সদাই করতেও অনেক সময় ব্যয় হয়ে গেল। রাত আনুমানিক দশটা বাজে। মতিঝিল শাপলা চত্বরের পাশে রিক্সার জন্য দাঁড়িয়ে আছে শাহিন। কিছুক্ষণ পর একটি খালি রিক্সা আসল।
– এই যাবেন ভাই?
– কোথায় যাবেন?
– শাহবাগ।
– যাব। উঠেন।
শাহিন রিক্সায় উঠতেই অচেনা এক বোরকা পড়া মেয়ে এসে বলল, ভাই আমি বড় বিপদে আছি। ছিনতাইকারী আমার সব কিছু নিয়ে গেছে। আমার কাছে কোন ভাড়া নেই। আমিও শাহবাগ যাব। আপনার সঙ্গে আমাকে নিলে খুব উপকার হতো।
শাহিন বলল, শাহবাগ কোথায় আপনার বাসা?
– শিশু পার্কের পাশেই।
– আমি ভাড়া দিয়ে দিই আপনি চলে যান।
– না আমি একা যেতে পারব না।
– তাহলে আমি কি করব?
– আমাকে আপনার সাথে নিবেন।
– আমি কেন আপনাকে নিব? তাছাড়া আমিতো আপনাকে চিনি না। জানি না।
– ভাই বিপদে পড়েছি। আমি মেয়ে মানুষ একা যেতে পারব না। ভয় করছে। এই উপকারটুকু করেন।
– না আমি নিতে পারব না। আপনি আসতে পারেন।
মেয়েটি এবার শাহিনের হাত ধরে বলল, প্লিজ ভাই। আপনারতো বাড়ীতে মা বোন আছে। তারা বিপদে পড়লে কি এভাবে রেখে যেতেন?
শাহিন পড়ল মহাবিপদে। কি করবে এখন? শাহিন মেয়েটির কথায় চিন্তায় পড়ে গেল। তাইতো একটি অসহায় মেয়ে বিপদে পড়ে আমার সাথে যেতে চাচ্ছে। আমি নিয়ে গেলে অসুবিধা কোথায়? এত রাতে একজন অসহায় মেয়ের আকুতি শুনে শাহিনের মায়া লেগে গেল। প্রথমে শাহিন মেয়েটিকে না করলেও পরে তাকে বলল, ওঠেন।
দুজন একসাথে রিক্সায় উঠল। দুজনেই রিক্সায় উঠে খোশগল্পে মেতে উঠল। রিক্সা যখন শিশু পার্কের কাছাকাছি আসল তখনই মুখোশধারী মেয়েটি শাহিনের গলায় ছুরি ধরে বলল, যা কিছু আছে দিয়ে দিন।
শাহিন হঠাৎ মহিলার পরিবর্তন লক্ষ করে ভয় পেয়ে গেল। তারপরও বুকে সাহস নিয়ে বলল, কি ব্যাপার আপনি এমন করছেন কেন? আপনি কে?
– পরিচয় জানার দরকার নেই।
– জলদি দিয়ে দিন।
– যদি না দিই।
– তাহলে আমি চিৎকার করে বলব, আপনি আমার ইজ্জত নিয়েছেন। আর তখন বুঝবেন পাবলিকের মাইর কারে কয়। পাবলিক সবসময় মেয়েদের পক্ষে থাকে।
শাহিন ভাবতে লাগল। তাতো ঠিকই। এখন কি করা যায়। সেতো আমাকে বিরাট ফাঁদে ফেলে দিল। কিভাবে নিজেকে সেভ করে তার কাছ থেকে বাঁচা যায় সেই চিন্তা করতে লাগল।
– কি হলো দেরি করা যাবে না। চিৎকার করলেও কোন কাজ হবে না। উল্টো গণপিটুনি আপনিই খাবেন। এত রাতে অপরিচিত মহিলার সঙ্গে রিক্সায় উঠেন আবার পাবলিক ডাকবেন। তা হবে না।
শাহিন নিরুপায় হয়ে তার সব কিছু ছিনতাইকারী মেয়েটির হাতে দিয়ে দিল। মেয়েটি সবকিছু নিয়ে দৌঁড়ে পালানোর চেষ্টা করল।
শাহিন তখন রিক্সা থেকে নেমে আশে পাশের সবাইকে বলতে লাগল, এই যে ভাই, ঐ মেয়েকে ধরেন। ও ছিনতাইকারী। ও আমার সব কিছু নিয়ে চলে যাচ্ছে। তার কথায় আশে পাশের লোকজন দৌঁড়াতে লাগল ঐ বোরকা পড়া মেয়ের পিছনে। মেয়েটিও সর্বশক্তি দিয়ে দৌঁড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু পুরুষের কাছে মেয়েটি দৌঁড়াতে না পেরে ধরা পড়ল।
অনেকেই তাকে মারার জন্য হাত তুলল। একজন লোক বলতে লাগল, ভাই মেয়ে মানুষ। গায়ে হাত দিবেন না। উল্টো আপনারা ফেসে যাবেন। আগে কি হয়েছে সেটা জানার চেষ্টা করুন।
আরেকজন বলল, হ ভাই ঠিকই কইছেন।
অন্যজন শাহিনকে দেখিয়ে মহিলাকে জিজ্ঞেস করল, ওনাকে আপনি কি করেছেন?
মেয়েটি ভয়ে থতমত খেয়ে বলতে লাগল, আমি ওনাকে কিছু করেনি।
শাহিন বলল, ভাই ওনি আমার মোবাইল, টাকা সবকিছু নিয়ে গেছে।
আরেকজন বলল, সত্যি কথা বলুন। তা না হলে পুলিশের কাছে দিয়ে দিব।
তখন মেয়েটি নমনীয় হয়ে বলল, প্লিজ আমাকে পুলিশে দিবেন না। আমি সব সত্যি কথা বলে দিব। আমি ওনাকে মিথ্যা কথা বলে আমার সাথে রিক্সায় করে নিয়ে আসছি। তারপর ওনার সব কিছু ছিনতাই করছি। তার জিনিস তাকে ফিরিয়ে দিচ্ছি বলেই সবকিছু শাহীনকে দিয়ে দিল।
শাহিন তার সবকিছু বুঝে পেয়ে ফিরে গেল। আর ছিনতাইকারী মেয়েটিও জানে বেঁচে গেল।
রচনাকাল: ০৯/০৮/২০১৫ খ্রি:
ধান্দাবাজ
সকাল ছয়টা বাজে। আলাল সাহেব সবেমাত্র ফজরের নামাজ পড়ে বাসায় আসলেন। সোফায় বসে চা খাচ্ছেন এমন সময় ওনার মোবাইলে রিং বেজে উঠলো। ফোনটি রিসিভ করতেই অপর প্রান্ত থেকে একজন বললেন, আমি গ্রামীণফোন কাস্টমার কেয়ার থেকে মুরাদ হাসান বলছি।
এত সকাল বেলা আলাল সাহেবের মোবাইলে কাস্টমার কেয়ার থেকে ফোন করায় তিনি বিস্মিত হলেন। তা কি মনে করে এত সকাল বেলায় ফোন করছেন?
– স্যার আপনি এই সিমটি দীর্ঘদিন যাবত ব্যবহার করছেন তাই না?
– হ্যাঁ।
– আপনার জন্য একটি সুখবর আছে।
– সুখবর! কি সুখবর?
– যারা দীর্ঘদিন যাবত গ্রামীণফোন কোম্পানির মোবাইল সিম ব্যবহার করছে তাদের মধ্য থেকে লটারির মাধ্যমে কোম্পানি বিশজনকে পুরস্কারের ব্যবস্থা করছেন। আপনি সেই সুভাগ্যবানদের মধ্যে একজন যিনি পাঁচ লক্ষ টাকা লটারিতে জিতেছেন। অভিনন্দন আপনাকে!
আলাল সাহেব একজন বিচক্ষণ ও শিক্ষিত ব্যক্তি। তিনি আগে থেকেই জানেন দেশে এখন ডিজিটাল ধান্দাবাজ বের হয়েছে। তারা মোবাইলে ফোন করে কাস্টমার কেয়ারের কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে পুরস্কারের প্রলোভন দেখায়। কথার মারপ্যাঁচে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে বিকাশের মাধ্যমে হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়। তাই তিনি ধান্দাবাজ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়ার কৌশলগুলো জানার জন্য কথিত কর্মকর্তা মুরাদ হাসানের কথাগুলো মনযোগ দিয়ে শুনছেন।
– তাই নাকি!
– হ্যাঁ স্যার।
– তা কবে, কখন, কিভাবে এই টাকা পাব?
– এই টাকা পেতে হলে আপনাকে আমাদের কোম্পানির কিছু নিয়ম মানতে হবে।
– বলুন কি নিয়ম। যা বলবেন তাই শুনব। টাকার বড়ই অভাবে আছি। টাকার জন্য মেয়েটার বিয়ে দিতে পারছি না। আল্লাহ মনে হয় এতোদিনে আমার দিকে মুখ তুলে তাকাইছেন। সকাল বেলা সুসংবাদটা দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আলাল সাহেবের মুখে কথিত কর্মকর্তা মুরাদ হাসান এমন কথা শুনে মনে মনে বললেন, যাক এবার একজন মক্কেল পেয়েছি মনে হয় তার কাছ থেকে কিছু হাতিয়ে নেয়া যাবে। তারপর তিনি কোম্পানির নিয়মগুলো বলতে লাগলেন।
– এই কথা এই মুহূর্তে কাউকে বলবেন না। এমনকি আপনার স্ত্রীর কাছেও না।
– ঠিক আছে বলব না।
– এই টাকা আপনাকে অনলাইনের মাধ্যমে ব্যাংকে দেয়া হবে। এই জন্য কোম্পানির কিছু খরচ হবে। আমি আপনাকে একটি বিকাশ নাম্বার দিব। সেই খরচের টাকাটা আপনি এক ঘন্টার মধ্যে পাঠাতে হবে। টাকা পাঠিয়েই আমাকে এই নাম্বারে কল করে নিশ্চিত করবেন এবং আপনার ব্যাংক একাউন্ট নাম্বার দিবেন। কিছুক্ষণ পর আপনার ব্যালেন্স চেক করলেই দেখতে পারবেন আপনার একাউন্টে টাকা জমা হয়ে গেছে। বুঝতে পারছেন স্যার?
– হ্যাঁ বুঝতে পারছি। কিন্তু কত টাকা দিতে হবে?
– মাত্র পাঁচ হাজার টাকা।
– আমার যে একটা সমস্যা আছে।
– কি সমস্যা?
– ঐ যে বললেন, পাঁচ হাজার টাকা আপনার নাম্বারে বিকাশ করতে হবে সেটাতো দিতে পারব না।
– কেন পারবেন না। পাঁচ লক্ষ টাকার জন্য পাঁচ হাজার টাকা খরচ করতে পারবেন না? দেখুন আপনি পুরস্কার না নিলে অন্যজনকে দিয়ে দেওয়া হবে। আপনি পুরস্কার নিবেন কিনা সেটা বলুন। পুরস্কার না নিলে আপনার সাথে আর কোন কথা বলব না। সুযোগ বার বার আসে না। এই সুযোগ হাতছাড়া করবেন না স্যার।
– আমিতো পুরস্কার নেয়ার জন্য রাজি আছি।
– তাহলে আপনাকে এই টাকাটা খরচ করতেই হবে।
– পাঁচ লক্ষ টাকার জন্য পাঁচ হাজার টাকা খরচ করাটা কোন ব্যাপার না কিন্তু এ মুহূর্তে আমার কাছে এত টাকা নেই। আপনিতো আমার সর্ম্পকে জানেন না। আমি একজন সাধারণ কেরানী। অল্প বেতনে চাকরি করে কোন রকমে সংসার চালাই।
– আপনার সর্ম্পকে জানার আমার কোন প্রয়োজন নেই। কোম্পানি আপনাকে ফোন দিতে বলছে আমি ফোন দিয়েছি। আপনি টাকা না নিলে আমি লাইন কেটে দিব।
– না ভাই লাইন কাটবেন না। আমার একটা পরামর্শ শুনুন।
– জি বলুন।
– আমি এ মুহূর্তে বিকাশে আপনাকে টাকা দিতে পারছি না। আবার পুরস্কারের লোভও সামলাতে পারছি না। আমার টাকাটার বিশেষ প্রয়োজন। টাকাটা পেলে আমার বড়ই উপকার হবে।
– কিন্তু খরচ না দিলেতো কোম্পানি আপনাকে টাকা দিবে না।
– আপনি এক কাজ করুন।
– কি কাজ?
– আপনার পকেট থেকে কোম্পানিকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে পাঁচ লক্ষ টাকা আপনি তুলে নেন। তারপর সেই টাকাটা আপনি আমার বাসায় এসে দিয়ে যান। আমি আপনাকে আমার বাসার ঠিকানা দিচ্ছি। এই জন্য আপনাকে আমি পাঁচ লক্ষ টাকা থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা বকশিশ দিব। তাছাড়া বাসায় আসলে আপনি আমার বউয়ের হাতের রান্না করা খাবারও খেয়ে যেতে পারবেন।
আলাল সাহেবের এমন প্রস্তাবে কথিত কর্মকর্তা মুরাদ হাসান বিস্মিত হয়ে বললেন, আপনিতো আমার চেয়েও বড় ধান্দাবাজ! এতক্ষণ যা কথা বললাম তাই লস। বলেই ফোন লাইনটি কেটে দিলেন।
তারিখ: ০৭/০২/২০১৭ইং
অভিমান
এই সবুজ!
আমি পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি ঋতু দাঁড়িয়ে আছে। একটু অবাক হলাম! এ মুহূর্তে ঋতুর এখানে আসার কথা না। কিন্তু কেন আসলো? আমিতো একা থাকতে চেয়েছিলাম। আমিতো তার কাছ থেকে দূরে চলে আসছি। আমি বললাম, কি?
ঋতু বললো, তুমি আমাকে একা রেখে এখানে চলে আসলে কেন?
– কি করবো?
– তুমি জান না আমি তোমাকে কতো ভালোবাসি?
– না।
– তুমি জান না আমি তোমাকে ছাড়া একটি মুহূর্তও থাকতে পারি না?
– কিভাবে জানব? তুমিতো আমাকে ভালোবাস না।
– কে বললো, আমি তোমাকে ভালোবাসি না? ওটাতো আমার মনের কথা ছিলো না।
– আমি কি করে বুঝবো কোনটা তোমার মনের কথা?
– এই জন্যই তুমি অভিমান করে দূরে চলে আসলে?
– হ্যাঁ। এ ছাড়াতো আমার কোন উপায় ছিল না।
– ঋতু আমার হাত ধরে বললো, সবুজ আমি তোমাকে ভালোবাসি।
মনে হলো কতদিন পর ঋতু আমার হাত ধরলো। মুহূর্তে মনটা উষ্ণতায় ভরে উঠলো। ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ বলেই তাকে জড়িয়ে ধরলাম।
– তুমি এখানে কিভাবে এলে?
– তোমার ভালোবাসা আমাকে এখানে টেনে নিয়ে আসছে।
– তাই!
– তুমি জান না মেয়েদের বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না। বলেই ঋতু কাঁদতে লাগল।
ঋতুর চোখের কোনে পানি গড়িয়ে পড়ার আগেই আমি হাত দিয়ে চোখ মুছে বললাম, কে বললো আমি তোমাকে রেখে এসেছি। তুমিতো আমার বুকের ভেতর আছ।
ঋতু তখন ফুফিয়ে কাঁদতে লাগলো। তুমি আমাকে ছেড়ে আর যাবে নাতো?
– না। কোন দিন যাব না।
– ঋতুর মুখে তখন এক ঝলক হাসির রেখা ফুটে উঠলো।
তারিখ: ১২/০১/২০১৭ইং
পুরস্কার
সুবর্ণা ও সজিব ওরা দু’ভাইবোন। সুবর্ণা বড় নবম শ্রেণিতে পড়ে। সজিব ছোট ষষ্ট শ্রেণিতে পড়ে। কয়েকদিন যাবত দু’জনেই পড়ালেখা নিয়ে খুবই ব্যস্ত। কারণ সামনে একটি প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করতে হবে ওদেরকে। প্রতিযোগিতায় দু’জনেরই নাম দেয়া হয়েছে। সুবর্ণা প্রতিযোগিতায় উপস্থিত বক্তৃতা দিবে আর সজিব কবিতা আবৃতি করবে। সজিব সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘লিচু চোর’ কবিতাটি আবৃতি করবে। তাই সজিব বাড়িতে প্রতিদিন ‘লিচু চোর’ কবিতাটি চর্চা করছে। সুবর্ণার জানা নেই ওর ভাগ্যে কোন বিষয় পড়ে। তাই ও অনেক গুলো বিষয় নিয়ে নিয়মিত চর্চা করছে।
১২ জুন প্রতিযোগিতাটি অনুষ্ঠিত হবে। তাই ওরা দু’জনেই সেদিনটির জন্য অধির অপেক্ষা করছে কবে সেই শুভ দিনটি ওদের মাঝে আসবে। যতই দিন ঘনিয়ে আসতে লাগল, ততই তাদের মন উসখুস করতে লাগল। দেখতে দেখতে সেই দিনটি প্রায় নিকটবর্তী হয়ে গেল। আর মাত্র দু’দিন বাকি।
সুবর্ণা তার বাবাকে বলছে, বাবা তুমি কিন্তু আমাদের সাথে অনুষ্ঠানে যাবে।
তার বাবা বললেন, অবশ্যই যাব।
সজিব তার মাকে বলছে, মা তুমিও কিন্তু আমাদের সাথে যাবে।
তার মা বললেন, যাব আমরা দু’জনেই তোদের সাথে যাব। যা এখন গিয়ে কবিতাটি বার বার পড়। পুরস্কার কিন্তু অবশ্যই আনতে হবে।
– মা তুমি দোয়া করিও অবশ্যই পুরস্কার আনব।
সকাল বেলা পাখির কিচিরমিচির ডাকে সুবর্ণা ও সজিবের ঘুম ভাঙ্গল। জলমলে রোদ এসে আঙ্গিনায় পড়ল। দু’ভাইবোন গোসল করে কাপড় পড়ে রেডি হল। দশটা বাজার পূর্বেই তাদেরকে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে হবে।
মা-বাবাকে সঙ্গে নিয়ে স্বুর্ণা ও সজিব যথাসময়ে অনুষ্ঠানে এসে উপস্থিত হল। সেখানে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার ছাত্র-ছাত্রীরা দলে দলে উপস্থিত হচ্ছে। এ মুহূর্তে অনুষ্ঠানস্থল মানুষে জমজমাট হয়ে গেল।
উক্ত অনুষ্ঠানের প্রতিযোগিতার অনেকগুলো বিভাগ করা হয়েছে। ষষ্ট শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ‘ক’ বিভাগ। নবম-দশম শ্রেণি ‘খ’ বিভাগ। কলেজ ও মাদ্রাসার আলিম ও ফাজিল শ্রেণির জন্য ‘গ’ বিভাগ। সেই অনুসারে সজিব ‘ক’ বিভাগে এবং সুবর্ণা ‘খ’ বিভাগে পড়েছে।
দশটা বাজার সাথে সাথে অনুষ্ঠানটি কোরআন তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে শুরু হয়ে গেল। প্রথমে ‘ক’ বিভাগের কুরআন তেলাওয়াত। তারপর ‘খ’ বিভাগের কুরআন তেলাওয়াত। এভাবে পর্যায়ক্রমে অনুষ্ঠানের প্রতিযোগিতা চলছে। সুবর্ণা ও সজিব অপেক্ষা করছে কখন তাদের পালা আসবে। দু’জনেরই মন ছটফট করছে।
অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃতি, রচনা লিখা, উপস্থিত বক্তৃতা, সুন্দর হাতের লেখা, হামদ-নাত, কোরআন তেলাওয়াত কৌতুক, নৃত্য- ইত্যাদি পর্ব করা হয়েছে।
এবার ‘ক’ বিভাগের কবিতা আবৃতির পালা। প্রথমে ভাষ্যকার আশিক নামের একজন ছেলেকে ডাকছেন। সে মঞ্চে গিয়ে একটি কবিতা আবৃতি করল। এভাবে কয়েকজনের নাম ডাকা হল।
সজিব ভাবতে লাগলো, আমিতো এ বিভাগেই আছি। আমি কি পারব সুন্দর করে আবৃতি করতে। পারব কি পুরস্কার ছিনিয়ে আনতে। এমন সময় ভাষ্যকার সজিবের নাম ঘোষণা করল। সজিব চমকে উঠল। তারপর দ্রুত সজিব মঞ্চে চলে গেল। সালাম দিয়ে ওর পছন্দের ‘লিচু চোর’ আবৃতি করতে লাগল।
বাবুদের তাল-পুকুরে
হাবুদের ডাল-কুকুরে
সেকি বাস করলে তাড়া,
বলি থাম একটু দাড়া।
পুকুরের ঐ কাছে না
লিচুর এক গাছ আছে না
হোতা না আস্তে গিয়ে
য়্যাব্বড় কাস্তে নিয়ে
গাছে গো যেই চড়েছি
ছোট এক ডাল ধরেছি,
……………………
এভাবে সজিব কবিতাটি বিভিন্ন ভঙ্গিমায় সুন্দর করে আবৃতি করল।
কবিতা শেষ হওয়ার সাথে সাথে উপস্থিত লোকজন করতালি দিল। তারপর আরও কয়েকজন কবিতা আবৃতি করল।
এবার ‘খ’ বিভাগের উপস্থিত বক্তৃতার পালা। প্রথমে সুবর্ণার নাম ঘোষণা করা হল। সুবর্ণা মঞ্চে চলে আসল।
পাঁচজন বিচারক বসেছেন। বিচারকগণ কয়েকটি কাগজে উপস্থিত বক্তৃতার বিষয়গুলো লিখলেন। সুবর্ণাকে বলা হলো একটি কাগজের টুকরা হাতে নেয়ার জন্যে। সুবর্ণা একটি কাগজ হাতে নিল। কাগজ খুলে দেখে তার বিষয় হলো ‘বাংলাদেশের নারী নির্যাতন’। সময় দেওয়া হল ৫ মিনিট। অতএব ৫ মিনিটের মধ্যে বিষয়ের সাথে মিল রেখে তার বক্তব্য শেষ করতে হবে।
সুবর্ণা তার বক্তৃতা শুরু করলো- উপস্থিত আজকের প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি, উপস্থিত বিজ্ঞ বিচারকমন্ডলী, উপস্থিত শ্রোতা ভাই ও বোনেরা আসসালামু আলাইকুম। ভাগ্যের লিখন যায় না খ-ন। তাই ভাগ্যের চাকা ঘুরতে ঘুরতে আমার বিষয় নির্বাচন হলো ‘বাংলাদেশের নারী নির্যাতন’। আমি একজন নারী। নারী হয়ে নারী নির্যাতনের করুন চিত্রগুলো এখন আপনার সামনে তুলে ধরছি।
প্রিয় ভাই ও বোনেরা আজ আমরা প্রবেশ করেছি একবিংশ শতাব্দিতে। নতুন শতাব্দীতে কেমন আছে বাংলাদেশের নারীরা? এই প্রশ্নের উত্তর সুখকর নয়। কারণ এককথায় বলতে পারি বর্তমানে বাংলাদেশের নারীরা ভাল নেই। বর্তমান সময়ে নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়ছে। বাড়ছে ভয়াবহ নারী নির্যাতন, খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, এসিড নিক্ষেপ ও নারী পাচারের মতো ঘটনা। পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের চেয়ে ঢের বেশি নারী নির্যাতন হচ্ছে পথে, ঘাটে, গৃহে, কর্মস্থলে প্রতিনিয়ত। বিভিন্ন সংস্থা, মানবাধিকার কমিশনের রিপোর্টে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে নারীর করুণ চিত্র। বর্তমানে দেশের সরকার প্রধান ও বিরোধী দলের নেতা দুজনই নারী। কিন্তু এই নারীরা কি পেরেছে সমাজ থেকে যৌতুক প্রথা চিরতরে বন্ধ করতে? পেরেছে কি ধর্ষণের সেঞ্চুরীর হাত থেকে নারীদেরকে বাঁচাতে? পেরেছে কি এসিড নিক্ষেপের হাত থেকে আঁখির মতো অসহায় মেয়েদেরকে বাঁচাতে? পেরেছে কি দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণের সেঞ্চুরী থেকে শিক্ষাঙ্গনকে কলঙ্কমুক্ত করতে?
প্রিয় ভাই ও বোনেরা একটু লক্ষ্য করুন বর্তমানে নারীরা পুরুষ কর্তৃক যত প্রকার নির্যাতিত হচ্ছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি হচ্ছে যৌতুকের শিকার। বর্তমানে এ যৌতুক একটি প্রথা হিসেবে দেখা দিয়েছে। যা নারী সমাজের জন্য এক অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যৌতুকের ফলে কত নারীর সোনার সংসার ভেঙ্গে তছনছ হয়েছে তার কোন হিসেব নেই। কত নারী যে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে তারও কোন পরিসংখ্যান নেই। যুগ যুগ ধরে এ যৌতুক প্রথা আমাদের সমাজে প্রচলিত হয়ে আসছে। আজ যৌতুক নামক এ কু-প্রথাটি ক্রমান্বয়ে সমাজের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে। বাংলাদেশের নারীরা উন্নয়নের পথে অনেক দূর এগিয়েছে কিন্তু যৌতুকসহ বিভিন্ন অশুভ সামাজিক প্রথা সামাজিকভাবে তাদেরকে প্রতিষ্ঠিত হবার পথে এখন প্রতিবন্ধক হয়ে আছে।
প্রিয় ভাই ও বোনেরা এবার আসুন এসিড নিক্ষেপের কথা বলি। সম্প্রতি দেশে হঠাৎ করেই এসিড নিক্ষেপের ঘটনা ঘটছে। কারণে অকারণে নারীর প্রতি এই মরণ এসিড নিক্ষেপ হচ্ছে। এসিড নিক্ষেপের ফলে ঝলছে যায় আক্রান্ত নারীর শরীর। তীব্র যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে অনেক সময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। মানুষ এতোটা পাষাণ হয় কিভাবে? এর উত্তর আমার জানা নেই।
তাছাড়া কর্মসংস্থানের লোভ দেখিয়ে অনেক নারী বিদেশে পাচার করা হচ্ছে। বাজারের পণ্যের মতো নারীকে বিক্রি করা হচ্ছে। অনেক নারীকে অপহরণ করে নিয়ে হত্যা করা হচ্ছে। এর থেকে পরিত্রাণের কি কোন উপায় নেই?
প্রিয় ভাই ও বোনেরা বাংলাদেশের নারী নির্যাতনে আরো অনেক কারণ আছে সময় স্বল্পতার কারণে আর বলতে পারলাম না। পরিশেষে নারী সমাজের প্রতি আমার আহ্বান থাকবে আমাদের অধিকারের জন্য আরো সচেতন হতে হবে। বুঝে নিতে হবে আমাদের হিসাব নিকাশ। পুরুষ শাসিত এই সমাজে আমাদেরকে শিক্ষা-দীক্ষায় অগ্রসর হতে হবে। মুখ বুঝে সহ্য না করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। তাহলে নারী জাতির ভাগ্য পরিবর্তন হবে। ধন্যবাদ সকলকে।
বক্তৃতা শেষ হওয়ার সাথে সাথে উপস্থিত লোকজন করতালির মাধ্যমে তাকে অভিনন্দন জানালো। তারপর ভাষ্যকার পর্যায় ক্রমে আরো কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রীর নাম ঘোষণা করল। কারো ভাগ্যে পড়েছে ‘মাতা-পিতার প্রতি কর্তব্য’, কারো বা ‘ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক’ ইত্যাদি। তারপর পর্যাক্রমে অন্যান্য পর্বগুলো শেষ হলো।
প্রধান বিচারকের নিকট ফলাফল এসে উপস্থিত হল। প্রধান অতিথি বক্তৃতা করলেন। তিনি সকল ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে অনেক মজার মজার ঘটনা শেয়ার করলেন। তাদেরকে ভবিষ্যতে ভালভাবে গড়ে উঠার জন্য উৎসাহ দিলেন।
তারপর প্রধান বিচারক সাহেব ভাষন দেন। তিনি একজন নামকরা লোক। লোকেরা সবাই তাকে ভালোবাসেন।
মধ্যহ্নভোজের পর পুরস্কার বিতরণ শুরু হল। সুবর্ণা ও সজিব অপলক দৃষ্টিতে মঞ্চের দিকে তাকিয়ে রইল।
প্রতি পর্বে তিনজনকে পুরস্কার দেয়া হবে। বিচারক সাহেব প্রথমে কোরআন তেলাওয়াতের পুরস্কার ঘোষণা করলেন। তাদেরকে একটি করে সার্টিফিকেট ও বই উপহার দেওয়া হল। এভাবে পর্যাক্রমে পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে।
এবার ‘ক’ বিভাগের কবিতা আবৃতির পুষ্কার ঘোষণার পালা। সজিবের মনটা উতাল পাতাল হয়ে যাচ্ছে কি জানি তার রেজাল্ট হয়। মনটা ছটফট করতে লাগল।
বিচারক সাহেব তৃতীয় পুরস্কার ঘোষণা করলেন কিন্তু সজিব নয় অন্য একজনের নাম। সজিবের হার্টবিট আরো বেড়ে গেল। তারপর দ্বিতীয় পুরস্কার এখানেও তার নাম নেই। এবার বিচারক সাহেব বললেন, প্রথম পুরস্কার পেয়েছে সজিব আহমেদ।
সজিব তার নাম মাইকে শুনতে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে সুবর্ণাকে জড়িয়ে ধরল। মা আনন্দের সাথে বলছেন, কি হল সজিব তাড়াতাড়ি যা। পুরস্কার নিয়ে আস।
সজিব মঞ্চে চলে আসল। প্রধান অতিথি খুব খুশি হয়ে পুরস্কার ও সার্টিফিকেটটি তার হাতে তুলে দিলেন।
এবার ‘গ’ বিভাগেরর উপস্থিত বক্তৃতার পুরস্কার ঘোষণা করা হচ্ছে। বিচারক সাহেব পর পর তৃতীয় ও দ্বিতীয় পুরস্কার ঘোষণা করলেন। সুবর্ণার নাম না আসায় চিন্তিত হয়ে গেল।
বাবা বললেন, চিন্তা করিসনা মা তুই ফাস্ট হবি।
ইতিমধ্যে বিচারক সাহেব বলতে লাগলেন, খুব আনন্দের সাথে জানাচ্ছি যে, আজকের প্রতিযোগিতায় উপস্থিত বক্তৃতা বিভাগে এবং সকল বিভাগে যিনি সবোর্চ্চ নাম্বার পেয়েছেন তিনি হচ্ছেন…বলে বিচারক একটু থামলেন।
সুবর্ণার হার্টবিট আরো বেড়ে গেল। কি জানি কি হয়।
– … তিনি হচ্ছেন সুবর্ণা আহমেদ। যিনি সকল প্রতিযোগিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হয়েছেন। আপনারা করতালির মাধ্যমে তাকে স্বাগত জানান।
সুবর্ণার নাম ভাষ্যকারের মুখে শুনতে পেয়ে আনন্দে দিশেহারা হয়ে লাফিয়ে উঠলো সে। সজিব ও তার পিতা-মাতাও আনন্দে আত্মহারা।
সজিব বললো, কি আপু মঞ্চে যাও।
সুবর্ণা মঞ্চে গিয়ে তার পুরস্কার গ্রহণ করলো। মুহু মুহু করতালিতে মুখরিত মঞ্চ। চারপাশ থেকে ফুল ছিটানো হচ্ছে। এবার ভাষ্যকার সুবর্ণাকে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করলেন।
সুবর্ণা তখন সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো, সত্যি আমি ভাবতে পারিনি যে এত বড় পুরস্কার পাব। এ পুরস্কার আমার একার নয়। আপনাদের সকলের। আমি পুরস্কার পেয়ে ভীষণ খুশি। আমার জন্য দোয়া করবেন যাতে ভবিষ্যতে আরো ভাল করতে পারি। ধন্যবাদ সকলকে।
তারপর অন্যান্য সকল পুরস্কার বিতরণ করল। সবার শেষে মুনাজাতের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে আসল। রোদের তেজ আস্তে আস্তে কমতে লাগল। সজিব সুবর্ণা ওদের মা-বাবা সবাই আনন্দের সহিত বাড়ি ফিরল।
রচনাকাল- জানুয়ারি ১৯৯৯ খ্রি:।
মা
আমার নানার চার মেয়ে ও দু’ছেলের মধ্যে আমার মা ছিলেন সবার বড়। নানা আমার মাকে খুব ভালোবাসতেন। আমাদের বাড়ি থেকে নানার বাড়ি প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে। গ্রামের নাম চরবাড্ডা মির্জাচর। সবুজ গাছপালা বেষ্টিত গ্রামটি খুবই চৎমকার। মাঝে মাঝে আমার মাকে দেখার জন্য নানা আমাদের বাড়িতে আসতেন। আসার সময় নানা মায়ের জন্য কাঁঠাল, আম, কলা, আনারস, বেদানা, আঙুর আরো কত কি যে নিয়ে আসতেন তার কোন হিসেব নেই। নানা যখন চলে যেতেন, তখন মা প্রায়ই কাঁদতেন আর আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছতেন। তখন প্রিয় বাবা চলে যাওয়ায় নিজের মধ্যে শূন্যতা অনুভব করতেন।
নানাকে দেখার সুভাগ্য আমার হয়নি। আমি দুনিয়াতে আসার পূর্বেই আমার নানা এই দুনিয়া ছেড়ে চলে যান। নানার মৃত্যুতে আমার মা একদম পাথর হয়ে গিয়েছিলেন। সেই মৃত্যুর শোক আজও আমার মা ভুলতে পারেননি। এখনও নানার কথা মনে হলে কেঁদে কেঁদে চোখ ফোলায়। নানার কথা চিন্তা করে আমিও মাঝে মাঝে কাঁদি। আমি দুনিয়াতে এসে নানার স্নেহ, ভালোবাসা হতে বঞ্চিত হলাম। মনভরে নানাকে ডাকতে পারলাম না। তবে নানীর কাছ থেকেই নানার সমস্ত আদর ভালোবাসা পেয়েছি।
আমার বাবা একজন সাধারণ শ্রমিক। আমার জন্মের পরই আমাদের সংসারে অভাব অনটন দেখা দেয়। তখন মা মাঝে মাঝে নীরবে বসে কী যেন চিন্তা করতেন। আর দুচোখের জল ফেলতেন।
আমরা তিন ভাই, এক বোন। এর মধ্যে আমি বড় সন্তান। বাড়ির সমস্ত কাজ আমার মায়ের একা করত হতো। কারণ মায়ের কোন জা ছিল না। বাবা সারাদিন কাজ করার পর রাতে বাড়িতে ফিরতেন। তখন আমার মা বাবার পাশে বসে তাল পাতার পাখায় বাতাস করে ভাত খাওয়াতেন। আর তখন সংসারের সুখ দুঃখ নিয়ে আলোচনা করতেন। কিভাবে আমাদেরকে বড় করবেন তা নিয়ে ভাবতেন। রাতে খাওয়ার পর মা আমাকে সুন্দর সুন্দর গল্প বলে ঘুম পড়াতেন। আমি অসুস্থ্য হলে মায়ের চিন্তার শেষ থাকত না। আমার রোগ মুক্তির জন্য সারাক্ষণ খোদার কাছে প্রার্থনা করতেন। সারা রাত আমার পাশে বসে আমার সেবা যত্ন করতেন। আমার প্রতি একটুও বিরক্ত দেখাতেন না।
আমি যখন একদম ছোট, তখন এক কান্ড ঘটেছিল। আমার মা বাহিরে চুলোয় রুটি খোলা দিচ্ছেন। তখন বাবা ও আমরা চার ভাই-বোন পিঁড়ি নিয়ে চুলোর পাশে বসলাম। মা একে একে সবাইকে ভাগ করে তিনটি করে রুটি দিলেন। আমি তখন রুটি নিয়ে একটু দূরে বসেছিলাম। আমি একটি রুটি খেয়ে অন্য একটি রুটি খেতে যাব এমন সময় একটি কুকুর এসে আমার বাকী রুটিটা নিয়ে দিল দৌঁড়। আমি তখন রুটি আনার জন্যে দৌঁড়ে গিয়ে কুকুরের গলায় জড়িয়ে ধরলাম। ভাগ্যিস কুকুর তখন আমাকে কামড় দেয়নি। কুকুর তৎক্ষনাত রুটি ফেলে চলে গেল। আর তখন আমি কুকুরের কাছ থেকে রুটিটি উদ্ধার করে মায়ের ভয়ে কাঁদতে লাগলাম। আমি ভাবছি মা বুঝি আমাকে মারবে। কিন্ত না আমার মা লক্ষী আমাকে মারেনি বরং আদর করে বুকের কাছে টেনে নিয়ে ভালোবাসার পরশ বুলিয়ে বললেন, ‘তুই আমার লক্ষী ছেলে কাঁদিস না। এটা তোর দোষ না। আর এ রুটি খাসনে। মুরগীকে দিয়ে দে। আমি এক্ষুনি আবার রুটি বানিয়ে দিচ্ছি।’
মা আমাকে তখন আবার রুটি বানিয়ে দিলেন।
সারাদিন কাজ করার পর সন্ধ্যা হলে মা আমাকে পড়াতেন। আমি মায়ের সাথে বসে অ, আ, ক, খ পড়তাম আর মায়ের মুখের দিকে চেয়ে থাকতাম। আমি যখন ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলাম তখন থেকেই মায়ের কাজে একটু একটু সাহায্য করতাম।
ঈদ এলে আমাদের এলাকায় পিঠা বানানোর ধুম পড়ে। বিশেষ করে ঈদ-উল ফিরত এর সময় চাঁদ উঠার একদিন পূর্বে প্রতি ঘরে ঘরে পিঠা বানানো হতো। বাড়ির আশের সবার মতো আমার মাও পিঠা বানাতেন। মা গায়িল, সায়িট দিয়ে গুড়ি কুড়তেন। তারপর পানি সিদ্ধ করে মাধা তৈরি করতেন। পরে পিঠা বানাতেন। আমি তখন আমার মাকে পিঠা বানানোর কাজে সাহায্য করতাম। আমি লতি বানিয়ে দিতাম। মা তখন নিপুণ হাতে সুন্দর করে পিঁড়ির উপর হাত ঘুরিয়ে সেয়ুই বানাতেন। মায়ের সব কাজই আমার খুব ভাল লাগে। মা ঈদের দিন সকালে গুড় দিয়ে সেয়ুই পাক করতেন। ভাই-বোন সবাই মিলে সেয়ুই খেতাম। ঈদগাহে যাওয়ার সময় বাবা আমাকে টাকা দিতেন। মা আদর করে আমাকে জামা কাপড় পড়িয়ে দিতেন। সুন্দর করে আমার চুলগুলো আঁচড়িয়ে দিতেন।
আমি পরিবারের বড় ছেলে তাই বাবা-মার অনেক স্বপ্ন আমাকে নিয়ে। লেখাপড়া করে একদিন অনেক নামি-দামী ব্যক্তি হব। সেই স্বপ্নে বিভোর আমার পিতা-মাতা। মাঝে মাঝে দেখতাম আমার মা পাক ঘরে বসে কাঁদতেন আর কি যেন এক শূন্যতা অনুভব করতেন। আমি তখন মাকে বলতাম, ‘মা তুমি কাঁদছ কেন?’
মা আমাকে দেখে সাথে সাথে আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছে মুখে হাসির রেখা টেনে বলতেন, ‘কই কাঁদিনাতো।’
আমার জন্মের পর থেকেই আমার মায়ের দুঃখ বেড়েছ। প্রায়ই মা আমাকে দুঃখের কাহিনী শুনাতেন। মাঝে মাঝে মা আমাকে নিয়ে নানার পুরানো ইতিহাস বলতেন। এত কষ্টের পরও আমার লক্ষী মা আমার বাবা ও ভাই-বোনদের প্রতি একটুও বিরক্তবোধ করতেন না। শত কাজের মাঝেও পাঁচ ওয়াক্ত নামায ঠিকমত আদায় করতেন।
মমতাময়ী মা তাঁর সমস্ত ভালোবাসা দিয়ে আমাকে বড় করছেন। তাইতো আমার মাকে দেখলে মুহূর্তের মধ্যে সমস্ত দুঃখ, কষ্ট ভুলে যাই। জগতের শ্রেষ্ঠ মায়েদের মধ্যে আমার মা একজন। আমার মায়ের মত এমন মা কয়জন আছে এ পৃথিবীতে? মাগো, তুমিই আমার প্রাণ লক্ষী মা তুমি।
রচনাকাল-জুন-১৯৯৯খ্রিস্টাব্দ।
[জলছবি বাতায়ন নববর্ষ সংকলন ১৪২১ বাংলা এ প্রকাশিত]