ট্যাগ আর্কাইভঃ আমির ইশতিয়াকের গল্প

লাল গরু


ঈদুল আজহার আর মাত্র এক সপ্তাহ বাকি। বড় ভাই কামাল উদ্দিনের মৃত্যুর পর জামাল উদ্দিন কোন ঈদে কোরবানি দিতে পারেনি। আজ থেকে পনের বছর পূর্বে সন্ত্রাসীদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন কামাল উদ্দিন। জামাল উদ্দিন ভাবছে এবার নিজের পোষা লাল গরুটা বিক্রি করে কোরবানিতে শরিক হবে।
রাতে খাওয়া দাওয়ার পর জামাল উদ্দিন ও স্ত্রী জরিনা বেগম তাদের শোবার ঘরে আসলো। জামাল উদ্দিন বালিশটা টেনে হেলান দিয়ে বসলেন। জরিনা বেগম একটি পান মুখে দিয়ে বললেন, কি ব্যাপার আইজকা এতো তাড়াতাড়ি শুইয়া পড়বেন নাকি?
– না। তোমার সাথে কিছু কথা আছে। তার আগে আমারে এক খিলি পান দাও।
জরিনা বেগম সুপারি, জর্দা, খয়ার ও চুন দিয়ে পান বানিয়ে স্বামীর নিকট এসে বললো, নেন আপনার পান।
জামাল উদ্দিন পানটি হাতে নিয়ে মুখে দিল। জরিনা বেগম এবার বললো, বলেন কি বলবেন?
জামাল উদ্দিন পান মুখে দিয়ে চিবাচ্ছে আর বলছে, ভাইয়া মারা যওয়ার পর এ পর্যন্ত কোনদিন কোরবানি দিতে পারি নাই। প্রতিবছরই তো মাংসের জন্য শিহান মাইনষের বাড়িতে গিয়া বইসা থাকে। তাই ভাবতেছি এইবার আমি কোরবানিতে শরিক হইব। এহন তুমি কি কও?
– কোরবানিতে শরিক হইবেন ট্যাহা কোথায় পাইলেন?
– ট্যাহা কোথাও পাইনি। লাল গরুটা বেইচ্ছা কোরবানিতে শরিক হইবো। আল্লাহর রহমে আমাগো গরুতো এখন চাইরট্টা। সামনের বছরটা গেলেইতো বাছুরটা বড় হইয়া যাইবো।
– আমারও তো ইচ্ছে করে কোরবানি দিতে। কিন্তু আপনার সমর্থের কথা চিন্তা কইরা কিছুই বলতে পারি নাই। শিহান প্রতি বছরই কোরবানির ঈদ এলে কাঁইন্দা বেড়ায়। এহন আমার কোন আপত্তি নাই। আপনি গরু বেইছতে পারেন।
স্ত্রীর সম্মতি পেয়ে জামাল উদ্দিন খুশি হয়ে বললো, তাইলে আজ আর কোথাও যাইবো না। এহন ঘুমাইয়া পড়ি। বাতিটা নিভাইয়া আহ।
জরিনা বেগম বাতি নিভিয়ে স্বামীকে নিয়ে শুয়ে পড়লেন। জরিনা বেগম মুহূর্তের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লেও জামাল উদ্দিনের কেন জানি আজ ঘুম আসছে না। হঠাৎ করে তার ভাইয়ের কথা মনে হল।
কামাল উদ্দিন তখন নরসিংদীর ইউ.এম.সি জুট মিলে চাকরি করতেন। তার চাল-চলন, আচার-ব্যবহার এতই ভদ্র ছিলো যে জুট মিলের সকল কর্মচারীরা তাকে শ্রদ্ধা করত। কিন্তু কতিপয় দুষ্ট লোক তার এই ভাল আচরণ মেনে নিতে পারেনি। তারা অনেক চেষ্টা করেছে তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে। কিন্তু যখন তাদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হল তখন তারা সিদ্ধান্ত নিল তাকে মেরে ফেলবে। চাকরিতে যোগদান করার পর থেকেই কামাল উদ্দিন তাঁর স্ত্রী জরিনা বেগমকে নিয়ে জুট মিলের নিকটই বাসা ভাড়া করে থাকতেন।
জামাল উদ্দিন তার ভাইকে দেখার জন্য মাঝে মাঝে নরসিংদী আসতো। তেমনি একদিন সে বাড়ি থেকে ভাইয়ের জন্য শাক সবজি ও কিছু প্রিয় খাবার নিয়ে নরসিংদীর উদ্দেশ্যে রওয়ান হলো। প্রতিমধ্যে খবর পেলো তার ভাই কামাল উদ্দিন সন্ত্রাসীদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হয়। এই খবর শোনার সাথে সাথে তার হাত থেকে সব কিছু পড়ে গেলো।
কামাল উদ্দিনের লাশ বাড়িতে আনা হল। তার লাশ দেখার জন্য গ্রামের মানুষের ঢল নেমেছে। এমনকি অন্য গ্রাম থেকেও মানুষ আসছে। আত্মীয়স্বজনরা সবাই আসল। লাশ নিয়ে যখন গোরস্থানে যাচ্ছে তখন তার বাবা রহম উদ্দিনের চোখ বেয়ে অশ্রু ধারা বইতে লাগল। এ কেমন দৃশ্য! পিতার কাঁধে ছেলের লাশ! এ দৃশ্য কোন বাবা কামনা করতে পারে না। এ শোক কিভাবে সইবে রহম উদ্দিন? সবাই লাশ দেখার পর দাফন করা হয়।
এদিকে জামাল উদ্দিন সবে মাত্র দশম শ্রেণির ছাত্র। তার ভাইয়ের হঠাৎ মৃত্যুতে সে খুবই মর্মাহত। কারণ সংসারের সমস্ত বোঝা তার মাথায় নিতে হচ্ছে। বাবা-মা বৃদ্ধ। তার আর কোন ভাইও নেই যে, তার দায়িত্ব নিবে। তাই ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে জামাল উদ্দিন লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে দু’টো গরু কিনে কৃষি কাজে লেগে যায়।
রহম উদ্দিনের বড় আশা ছিল কামাল উদ্দিন লেখাপড়া করে, চাকরি করে সংসারের স্বচ্ছলতা আনবে। কিন্তু সে আশা পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই আল্লাহ তাকে দুনিয়া থেকে নিয়ে যায়।
কামাল উদ্দিনের মৃত্যুর তিন মাস পর জরিনা বেগমের একটি পুত্র সন্তান জন্ম হলো। রহম উদ্দিন পুত্র সন্তান জন্ম হওয়াতে খুবই খুশি হয়েছে। কারণ তার ছেলের বংশধর তার মাধ্যমে বেঁচে থাকবে। জরিনা বেগম তার সন্তানের নাম রাখলেন রাকিব।
সময় থেমে থাকেনি। দিনের পর রাত আসে। তারপরে সপ্তাহ পার হয়। এভাবে চলে যাচ্ছে মাসের পর মাস। দিনে দিনে বড় হতে লাগল রাকিব। রাকিবের দু’বছর পূর্ণ হল। এদিকে জরিনা বেগম প্রাণের প্রিয়তম স্বামীকে হারিয়ে একমাত্র ছেলেকে নিয়ে পিতৃতুল্য শ্বশুরের অনুরোধে এ বাড়িতে রয়ে গেলেন।
রহম উদ্দিন চিন্তায় অস্থির। এভাবে আর কতদিন বউমা থাকবে? তার একটা ব্যবস্থা করতে হবে। যে নারী কোন দিন শ্বশুরের মনে আঘাত দেয়নি, শশুরের একবিন্দু কষ্ট হতে দেয়নি। সেই নারীকে কীভাবে রহম উদ্দিন বিদায় দিবেন। এমন আদর্শ পরহেযগার সতী নারীকে কিছুতেই হাত ছাড়া করা যায় না। তাকে যেভাবে হোক এ বাড়িতে রাখতে হবে। কামাল উদ্দিনের একমাত্র উত্তরাধিকারী শিশু সন্তান রাকিবকেই বা কি করে দিয়ে দিবে। আর যদি নাতিকে রাখতে চান তাহলে কে করবে তার দেখা শুনা? এসব ভাবছেন রহম উদ্দিন। এবার এও ভাবছেন জামাল উদ্দিন বর্তমানে বিয়ের উপযুক্ত। তাকে তো অন্য জায়গায় বিয়ে করাতে হবে। সে বউতো রাকিবকে অন্য নজরে দেখবে। তার চেয়ে বরং জামাল উদ্দিনকে দিয়ে বউমাকে রেখে দিলে কেমন হয়? হ্যাঁ ভালই হয়। এক ঢিলে দুই পাখি।
রহম উদ্দিন একদিন জামাল উদ্দিনকে ডেকে বললো, বাজান, আমার বয়স তো ফুরাইয়া যাইতেছে। জানি না কোন দিন মইরা যাই। তোকে আমার জীবনের শেষ একটি আবদার রাখতে হবে।
জামাল উদ্দিন নম্র স্বরে বললো, আব্বা আপনার সব আবদার আমি হুইন্না আইছি। আজও হুনবো। বলেন আপনার কি আবদার।
– আমি চাই তুই তোর ভাবিকে বিয়া কর। ও যদি চইলা যায় তাইলে তোর ভাতিজার কি হবে? সে কারে মা ডাকবে? সে জন্ম হয়ে তার বাপকে দেহেনি। এহন যদি মাকেও হারায় তাহলে তার মত অভাগা পৃথিবীতে আর কেউ নেই। কামাল উদ্দিনের অবর্তমানে তুই ওর বাপ। আমার আয়ু তো শেষ হয়ে আসছে। আমি হয়তো আর বেশি দিন বাঁচবো না।
পিতৃভক্ত জামাল উদ্দিন কোন দিন কোন কাজে তার বাবার মনে আঘাত দেয়নি। আজ পর্যন্ত কোন কথা অমান্য করেনি। কি করে পারবে আজ বাবার শেষ আবদার ফেলে দিতে। শত কষ্ট হলেও পারবে না তার বাবার আবদারকে অপমান করতে।
রহম উদ্দিন আবার বলল, আমি জানি বাজান, বউমার চেয়ে তোর বয়স কম হবে। তারপরও সবদিক চিন্তা করে আমি তোকে বিয়া করতে কইছি। তোর ভাল হইবে।
জামাল উদ্দিন তার বাবার কথাগুলো শ্রবণ করে চোখ তুলে তার দিকে তাকিয়ে বললো, দেখেন আব্বা এত কিছু কইতে হইবে না। আপনি যা ভালা মনে করেন তাই করেন। আমার কোন আপত্তি নাই।
রহম উদ্দিন একইভাবে জরিনা বেগমের কাছ থেকে সম্মতি আদায় করেন। জরিনা বেগম শুধু ছেলে ও শশুরের দিকে চেয়ে এ বিয়েতে সম্মতি দেয়।
বিয়ে হয়ে গেল জামাল উদ্দিনর সাথে জরিনা বেগমের। জামাল উদ্দিন তার বাবার কথা রাখতে গিয়ে, ভাতিজাকে মা ডাকার অধিকার দিতে গিয়ে, সদ্য ফুটে উঠা যৌবন খানা বিলিয়ে দিলেন তার চেয়ে বয়সে বড় একটা মহিলার মাঝে। যাকে সে এতদিন ভাবি হিসেবে জানত। আজ সে তার স্ত্রী।
ভাই মারা যাবার পর জামাল উদ্দিনের সংসারে অভাব শুরু হয়। বাবা রহম উদ্দিন বয়সের ভারে দিন দিন বৃদ্ধ হয়ে যাচ্ছেন। এখন তেমন বেশি চলাফেরা করতে পারেনা। এখন শুধু মসজিদ ছাড়া আর কোথাও যেতে পারেন না। তার মা কিছুদিন আগে মারা যায়।
দেখতে দেখতে দু’বছর পার হয়ে গেল। জামাল উদ্দিনের সংসারে একটা কন্যা সন্তান হয়। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে সেই সন্তান দুনিয়াতে বেশিদিন থাকতে পারেনি। হঠাৎ একদিন নিউমোনিয়া হয়ে মারা যায়। দিন মজুর জামাল উদ্দিন তার সন্তানের সু-চিকিৎসা করতে পারেনি। সন্তান হারিয়ে বুকে ব্যথা নিয়ে রাকিবকে সন্তানের মত করে লালন পালন করতে লাগলেন। নিজে একা পরিশ্রম করেন তবু রাকিবকে কাজে নেননি। ওর বয়স যখন ছয় বছর হলো তখন তাকে নরসিংদীর একটি মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিলো।
জামাল উদ্দিনের মেয়ের জন্মের তিন বছর পর শিহানের জন্ম হয়। যে দিন শিহান জন্ম হল সেদিন তার ঘরে এক মুঠো ভাতও ছিলনা। শিহান জন্মের পর থেকে তার সংসারে অভাব বেশি করে দেখা দেয়। যা কিছু জমি জমা ছিল তাও বিক্রি করে শেষ করে ফেলল। এই অভাব অনটনের মধ্য দিয়ে শিহান বড় হতে লাগল। এখন তার নিজের জমি বলতে কিছুই নেই। বর্তমানে চারটি গরু দিয়ে মানুষের জমিতে বর্গা চাষ করে কোন মতে দিন চলছে। এই অভাবের সংসারে শিহানকে লেখাপড়া করানোর সামর্থ হারিয়ে ফেললো সে।
রাকিব একদিন মাদ্রাসা থেকে একা বাড়িতে আসার পথে হারিয়ে যায়। পিতৃহারা সন্তান রাকিবকে হারিয়ে জরিনা বেগম এখন দিশেহারা। প্রাণ প্রিয় প্রয়াত স্বামীর মৃত্যুর শোক ভুলতে না ভুলতেই ছেলে আবার নিরুদ্দেশ। তার কান্না সহ্য করতে না পেরে জামাল উদ্দিন কয়েকবার নরসিংদী এসে খুঁজে যায়। শহরের কোথাও তাকে খুঁজে না পেয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যায় সে।
মুয়াজ্জিনের আজানের সুরে স্বামী-স্ত্রীর দু’জনের ঘুম ভাঙ্গল। জামাল উদ্দিন যথারীতি মসজিদে নামাজ পড়তে গেলো। তার বাবা রহম উদ্দিনও নামাজ পড়তে গেলেন। তিনি এখন দিন দিন দুর্বল হয়ে যাচ্ছেন। মসজিদটা বাড়ির কাছে বলে সেখানে কোন মতে যেতে পারেন। স্ত্রী মারা যাবার পর থেকেই তিনি দুর্বল হয়ে গেলেন। ওনার বয়স এখন ৯০ বছর চলছে। মনে হয় না যে আর বেশি দিন তিনি বাঁচবেন। নামাজ পড়ে এসে রহম উদ্দিন খাটে শুয়ে আছেন। জামাল উদ্দিন তাঁর পাশে গিয়ে বসলেন। রহম উদ্দিন জামাল উদ্দিনের দিকে তাকিয়ে বললো, কিছু কইবি বাজান?
জামাল উদ্দিন মাথা ঝাকিয়ে বললো, হ্যাঁ আব্বা কিছু কথা কমু।
– কি কইবি?
– আব্বা আমি নিয়ত করেছি এইবার ঈদে লাল গরুটা বিক্রি করে কোরবানিতে শরিক হইব। আপনি কি কন?
– আমার কিছু কওয়ার নাই। আমার সময় ফুরিয়ে গেছে। এহন তুই যা ভালা মনে করছ তাই কর।
– আপনার কোন আপত্তি নাই তো?
– না।
জামাল উদ্দিন আর কোন কথা না বাড়িয়ে এখান থেকে চলে গেল।
সকাল বেলা শিহান, জরিনা বেগম ও জামাল উদ্দিন এক সাথে খেতে বসলেন। কোন প্রসঙ্গ ছাড়াই শিহান বললো, আব্বা লাল গরু বেইচ্ছা আমার জন্য কি আনবেন?
জামাল উদ্দিন বললো, তুই ক তোর জন্য কি আনবো?
– আমার জন্য একটা লাল গেঞ্জি ও লাল হাফপ্যান্ট আনবেন। আর একটা লাল কাগজের টুপি।
– আর কিছু লাগবে না?
– না।
– তোর আম্মার জন্য কি আনবো?
– আম্মার জন্য লাল শাড়ী।
– দাদার জন্য?
– লাল পাঞ্জাবী আর লাল পায়জামা।
– তুই শুধু সব কিছুই লাল কিনতে কছ ক্যান?
– আব্বা আপনি জানেন না। আমি লাল গরুকে কত্ত ভালোবাসি। আপনি আমার লাল গরুকে বেইচ্ছা দিবেন। তহন আমি থাকুম কিভাবে? সব গুলান যদি লাল হয় তাইলে আমি লাল দেইখা থাকতে পারুম।
– ঠিক আছে বাজান।
শিহান জামাল উদ্দিনের একমাত্র ছেলে। তার এখন ৮ বছর বয়স। এখনও স্কুলে যায় না। পড়ার কথা বললেই সে গরু নিয়ে মাঠে চলে যায়। তাই সে শিহানকে একটা ছাগল কিনে দেয়। তাদের গ্রামের উত্তর পাশে এক বিরাট চর। তার কাজ এই চরে গরু ও ছাগলকে ঘাস খাওয়ানো। আর মাঝে মাঝে বাবার সাথে খেত নিড়াইতে যায়। বাবা কাজ করতে গেলে চরে বাবার জন্য ভাত নিয়ে যায়। শিহান লাল গরুটাকে খুব বেশি ভালোবাসে। এবার সেই লাল গরুটা বিক্রি করে দিবে তাইতো তার মনে কষ্ট। তারপরও যেহেতু এইবারই প্রথম কোরবানি দিবে। সেই কথা চিন্তা করে সে মহাখুশি।
আজ শুক্রবার। পাশের বাড়ির কয়েকজন মুরুব্বি এসে জামাল উদ্দিনকে বললো, কিরে জামাল, তোর লাল গরুটা নাকি বেইচ্ছা লাইবি?
জামাল উদ্দিন বললো, হ চাচা। ভাবছি এইটা বিক্রি কইরা শরিক হইব।
মুরুব্বিদের মধ্যে একজন বললো, তা ভালা কথা আমডা ছয়জন আছি। আরেক জন লোক চাইতাছি। তুই আমাগো লগে থাকতে পারস। আর তুই রাজি থাকলে তোর লাল গরুটা দাম দর করে কোরবানি দিয়ে দেই। হুদাহুদি বাজারে কষ্ট কইরা নিয়া কোন লাভ নাই।
– আপনারা মুরুব্বি মানুষ। আপনারা যা ভালা মনে করেন তাই করেন।
অন্য একজন মুরুব্বি বললো, তো কত দিতে হবে দাম?
আমি কি কমু চাচা। কতর মাল আছে তা আন্দাজ কইরা দিয়া দেন।
অন্য একজন বললো, আটাশ হাজার ট্যাকা দিমু। তোর কোন আপত্তি আছে?
– চাচা ত্রিশ হাজার দিলে হয় না?
– না আটাশ হাজার ট্যাকা মিল আছে। ৭ জনে চার হাজার ট্যাকা করে পরবে। তুই আর কোন আপত্তি করিস না। আল্লাহ রাস্তার নিজের পালা গরু কোরবানি দিবি আল্লাহ অনেক ছোয়াব দিবে।
– ঠিক আছে চাচা। তাইলে কথা তাই রইল।
– আর হোন তোর চার হাজার ট্যাকা বাদে বাকি চব্বিশ হাজার টাকা কাল্কা দিমু।
– ঠিক আছে।
জরিনা বেগম মুড়ি, চানাচুর নিয়ে এসে বললো, আপনারা হগলতে মুড়ি, চানাচুর খান।
একজন মুরুব্বি বললো, আরে তুমি আবার এইসব আনতে গেলে ক্যান?
জামাল উদ্দিন বললো, গরিবের বাড়িতে আসছেন আর কি দিমু। সামান্য কিছু দিলাম।
মুড়ি, চানাচুর খাওয়ার পর একজন বললো, এহন যাইরে জামাল। কাল্কা সহালেই তোর ট্যাহাটা দিয়া দিমু।
– তাই কইরেন চাচা। কাল্কা শনিবার তো বাজার সদাই করতে হবে।
– ঠিক আছে। এই বলেই মুরুব্বিরা সবাই চলে গেল।
জামাল উদ্দিন স্বপ্ন দেখছে এবারের ঈদটা একটু আনন্দে কাটাবে। শিহান স্বপ্ন দেখছে লাল জামা পড়ে ঈদ করবে। জরিনা বেগমের মনেও আজ আনন্দ।
ফজরের আজান দিতেই জরিনা বেগমের ঘুম ভাঙ্গল। নামাজ পড়ে তিনি গোয়াল ঘরে গেলেন গোবর ফালানোর জন্যে। গোয়াল ঘরে ঢুকতেই দেখে লাল গরুটি নেই।
– হায় আল্লাহ! একি করলা তুমি? বলেই জরিনা বেগম চিৎকার দিয়ে উঠলো।
জামাল উদ্দিন স্ত্রীর চিৎকার শুনে দ্রুত আসলো। লাল গরুটিকে না দেখে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে। কিছুই বলতে পারছে না। জারিনা বেগম কাঁদছেন।
– হে আল্লাহ কি অপরাধ করেছিল আমার সোয়ামী? কি অপরাধ করেছিল আমার শিহান? যার জন্যে তুমি আমাগো প্রতি এমন অবিচার করছো?
শিহান তখনও ঘুমাচ্ছিল। মায়ের চিৎকার শুনে তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। তাড়াতাড়ি মায়ের কাছে আসল।
– আম্মা তুমি কাঁন্দ ক্যান?
– বাজানরে তোর লাল গরুটা চোরে নিয়া গেছে।
– কি কও আম্মা!
শিহান ঘোয়াল ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখে সত্যি লাল গরুটি নেই। তারপর জোরে জোরে কাঁদতে লাগল।
– তাইলে আম্মা আমার আর লাল জামা কিনা হইব না?
জরিনা ও বাবুলের কান্নায় বাড়ির আশে পাশের লোকজন এসে ভিড় জমালো। সবাই গরুটার জন্যে আফসোস করতে লাগল।
শিহান রহম উদ্দিনের কাছে গিয়ে কেঁদে কেঁদে বললো, দাদা আমি আর নতুন জামা পড়ে ঈদে যেতে পারুম না।
রহম উদ্দিন নাতির দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। নাতির কান্না দেখে বৃদ্ধ দাদার চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা জল খসে পড়ল।
জামাল উদ্দিনের কত স্বপ্ন ছিল গরু বিক্রির টাকা দিয়ে নতুন জামা আনবে। কোরবানিতে শরিক হবে। আনন্দে ঈদ করবে কিন্তু তার সেই স্বপ্ন ভেঙ্গে আজ চুরমার হয়ে গেল। যারা গরুর দাম ঠিক করছিল তারাও আসলো। জামাল উদ্দিনকে শুধু সান্ত¡না ছাড়া আর কিছুই দিতে পারলো না তারা।
আজ সারাদিন জামাল উদ্দিন মনমরা হয়ে বসে আছে। কারো সাথে কোন কথা বলেনি। কত লোকজন বাজারে গিয়ে ঈদের কেনাকাটা করল। কোরবানির গরু কিনল। কিন্তু জামাল উদ্দিন কিছুই কিনতে পারলো না। পাশের বাড়ির বিশিষ্ট শিল্পপতি এম.এ মতিন সাহেব ১ লক্ষ টাকা দিয়ে মোটা তাজা দেখে একটি গরু কিনে আনলেন। গ্রামের যুবক-যুবতী, শিশু-কিশোর সবাই ঐ গরু দেখতে গেল। শিহানও তাদের দেখাদেখি গরু দেখতে গেল।
আজ ঈদ। বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে আনন্দের বার্তা বইছে। সবাই আজ ঈদের আনন্দে মাতোয়ারা। কিন্তু জামাল উদ্দিনের পরিবারে নেই কোন আনন্দ। নেই কোন ঈদ। এদিকে রহম উদ্দিনের অবস্থা খুবই খারাপ। তিনি এখন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন। জরিনা বেগম ও শিহান তাঁর পাশে বসে চোখের পানি ফেলছে। যে শ্বশুর কোনদিন জরিনাকে কোন কটু কথা বলেনি। সারাক্ষণ তাকে শধু বউমা বলেই ডেকেছে, সে শ্বশুর আজ মৃত্যু পথের যাত্রী। তা জরিনা বেগম ভাবতেই চোখের জল এসে যায়।
সকাল ৭ টায় রহম উদ্দিন এ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চিরদিনের জন্য পরদেশে চলে গেলেন। যিনি আর এই পৃথিবীতে আসবেন না। এমন একটা ঈদের দিনে, খুশির দিনে তার মৃতুত্যে বাড়িতে কান্নার রুল পড়ে গেল। শিহান দাদা…দাদা… বলে চিৎকার করছে। এ চিৎকার প্রকৃতির সাথে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। পিতার মৃত্যুতে জামাল উদ্দিন একেবারে বোবা হয়ে গেছে। কথায় আছেÑ ‘অভাগা যেদিকে চায় সাগর শুকায়ে যায়।’ বাড়ির আশে পাশে শোকের ছায়া পড়ে গেল। ইমাম সাহেব এসে বললো, ঈদের নামাজের পর ঈদগাহের মাঠে জানাজার নামাজ সম্পূর্ণ করবে। তাই তাড়াতাড়ি গোসল করানোর জন্য বলে গেল। ঈদের দিন মৃত্যুবরণ করায় দূরের আতœীয় স্বজনরা কেউ আসতে পারে নি। নয়টায় ঈদের জামাত হবে। মাত্র দুই ঘন্টা ব্যবধানে তাকে দাফন করানোর জন্য ঈদগাহের দিকে রওয়ানা হল। ঈদের নামাজের পর জানাজা অনুষ্ঠিত হল। হাজার হাজার গ্রামবাসী জানাজায় অংশ গ্রহণ করল। শিহান কালো একটা হাফপ্যান্ট ও শার্ট পড়ে ঈদগাহে আসে। নামাজ শেষে রহম উদ্দিনকে কবর দিয়ে জামাল উদ্দিন শিহানকে নিয়ে বাড়ি ফিরলো।
সবাইতো আজ ঈদের আনন্দে ব্যস্ত। দু’একজন হয়তো তাদের শোকে শোকাহত। হতভাগা জামাল উদ্দিনের জীবনে এমন করুণ পরিণতি আসবে তা সে ভাবতেও পারেনা। জীবনের প্রতিটি পদে পদে তাকে আল্লাহ কষ্ট দিয়েছে। সে যখন জন্ম গ্রহণ করে তখন তার বাবা চাকুরি হারান। আর তখন থেকেই তাদের সংসারে অভাব দেখা দেয়। যখন লেখাপড়া করে ভাল একটি চাকুরী করার স্বপ্ন দেখছিল, তখন সে তার ভাই জামাল উদ্দিনকে হারায়। তারপর আসে তার জীবনে করুণ পরিণতি। জীবনের মোড় ঘুরিয়ে ভাবীকে বিয়ে করে সংসারি হতে হয়েছে তাকে। অভাবের তাড়নায় নিজের ছেলেকেও লেখাপড়া করাতে পারে নি। আজ এমন খুশির দিনেও খোদা তার সুখ সইল না। গরু চুরি হল। বাবা মারা গেল। একি খোদার ইনসাফ! কেন এত বড় শাস্তি দিলো তাকে? কেউ কি দিতে পারবে তার উত্তর? আসলে বিপদ যখন আসে তখন চারদিক থেকে আসে। আজ যেন জামাল উদ্দিনের সেই অবস্থাই হল।
জরিনা বেগম কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। বাঁধভাঙ্গা নদীর জলের মত অশ্রু তার চোখ বেয়ে পড়ছে। বার বার আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছে নেয়।
ইতোমধ্যে গ্রামবাসীরা সবাই যার যার পশু কোরবানি করে নিল। অন্যান্য ঈদের মত শিহান এবার আর অন্যদের গরু জবেহ করা দেখতে যায় না। কারণ আজ যে সে দাদার মৃত্যু শোকে শোকাহত। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল। সবার ঘরে ঘরে মাংস রান্না হচ্ছে। মাংসের গন্ধ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। জরিনা বেগম রান্না ঘরে বাঁশের খুটি ধরে দাঁড়িয়ে আছে। জামাল উদ্দিন বিছানায় শুয়ে আছে।
শিহান এসে বললো, আম্মা আমডা কি গোস্ত খাইতে পারুম না?
জরিনা বেগম নিরুত্তর।
শিহান আবার বাবার কাছে গিয়ে বললো, আব্বা আপনি মতিন সাবের বাড়ি থেকে গোস্ত নিয়া আসেন।
জামাল উদ্দিন বললো, বাজানরে একথা বলে আমারে আর কাঁদাসনে। আমাগো ভাগ্যে আজ গোস্ত জুটবে না। আজ কি করে গোস্ত খামু? আজ যে তোর দাদাকে হারালাম।

২১/০৯/২০১৫খ্রি:

দুষ্টু মিন্টু


আমি তখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি। তখন আমাদের ক্লাসে ছিল এক দুষ্টু ছেলে। তার নাম মনির হোসেন মিন্টু। সে সব সময় স্যারদের ক্লাসে পড়া জিজ্ঞাসা করলে উল্টাপাল্টা জবাব দিত। অবশ্য তার জবাবে যুক্তি থাকে। একদিন ক্লাসে বিজ্ঞান স্যার আমাদেরকে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি সর্ম্পকে বোঝাচ্ছিলেন। তিনি অনেকবার বুঝানোর পর স্যার একে একে সবাইকে বললেন, আম পাকলে আকাশের দিকে না উঠে মাটিতে পড়ে কেন?
আমরা সবাই যে যার মতো বুদ্ধি খাটিয়ে উত্তর দিলাম। যখন স্যার মিন্টুকে প্রশ্ন করলেন মিন্টু তখন জবাব দিল, স্যার আকাশেতো খাওয়ার কেউ নেই, তাই আম আকাশের দিকে না উঠে মাটিতে পড়ে যায়।
তার উত্তর শুনে আমরা সবাই তখন খিল খিল করে হাসতে লাগলাম।
স্যার আর কোন কথা না বলে ক্লাস থেকে চলে গেলেন।
কিছুক্ষণ পর বাংলা স্যার ক্লাসে আসলেন। তিনি আমাদের সবাইকে কাল কত প্রকার ও কি কি বলতে বললেন। আমরা সবাই কালের প্রকারভেদ গুলি বলি। কিন্তু মিন্টুকে বলতেই মিন্টু চট করে উত্তর দিল স্যার ওদের উত্তর হয়নি।
স্যার বললেন, কেন হয়নি?
– কারণ স্যার কাল হচ্ছে ১২ প্রকার। আর তারা উত্তর দিচ্ছে মাত্র ৩ প্রকার। তারা ৯ প্রকার কম বলেছে।
স্যার মিন্টুর কথায় আশ্চার্য হয়ে বললেন, বলতো দেখি তোমার প্রকারভেদগুলো।
– ঠিক আছে স্যার বলছি।
১. অতীত কাল
২. বর্তমান কাল
৩. ভবিষ্যৎ কাল
৪. গতকাল
৫. সকাল
৬. বিকাল
৭. আগামীকাল
৮. ইহকাল
৯. পরকাল
১০. একাল
১১. সেকাল
১২. যৌবনকাল
মিন্টুর এ প্রকারভেদগুলো শুনে স্যারসহ আমরা সবাই খিলখিল করে হাসলাম।
পড়া শেষে আমাদের সাবাইকে উদ্দেশ্য করে স্যার বললেন, তোমরা সবাই মনযোগ দিয়ে শোন, কখনো পরের উপকার করতে ভুলবে না। যে উপকার করে না সে মানুষ না।
মিন্টু তখন জবাব দিল, স্যার আপনার ক্ষেত্রেও কি সেটা প্রযোজ্য?
স্যার বললেন, অবশ্যই। তবে একথা বললে কেন তুমি?
– স্যার, সেদিন পরীক্ষার হলে কি বিপদে পড়েছিলাম। কিন্তু উত্তর বলে দিয়ে আপনি একটুও উপকার করেননি।
– চুপ বেয়াদব, কিসের সাথে কি মিলাচ্ছ।
মিন্টু তখন লজ্জা পেল। চুপ করে মাথা নিচু করে রইল।
পরিশেষে স্যার সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন, দেখ তোমরা জীবনে কু-অভ্যাস, কু-কথা, কু-নেশা কু-পরামর্শ হতে বিরত থাকবে। কারণ এগুলো মানুষকে ধ্বংস করে দেয়।
আমরা সবাই বললাম, ঠিক আছে স্যার। কিন্তু দুষ্টু মিন্টু বলে উঠল, স্যার আমার পক্ষে এক কু-ত্যাগ করা সম্ভব নয়।
স্যার রাগান্বিত স্বরে বললেন, তুমি সব কিছুতেই বাড়াবাড়ি কর, কেন কু-ত্যাগ করা সম্ভব নয়?
– স্যার আমার বাড়ি কুমিল্লা। কু-ত্যাগ করলে বাড়ির ঠিকানাটাই যে ভুলে যাব!
এ কথা শুনে আরেকজন ছাত্র বলে উঠল, স্যার আমার বাড়ি কুষ্টিয়া!
স্যার দুই ছাত্রের কথা শুনে বোকা হয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ পর স্যার বললেন, ঠিক আছে তোমরা সবাই কু-অভ্যাস নিয়েই থাক আমি চললাম। বলেই স্যার ক্লাস থেকে বের হয়ে আসলেন।
স্যার ক্লাস থেকে বের হওয়ার পর নরসিংদীর ছেলে ছোটন বললো, কিরে মিন্টু তুই স্যারদের সাথে এভাবে উল্টাপাল্টা কথা বলছ কেন?
মিন্টু বললো, কেন কি হয়েছে তোর?
– আমার কিছু হয়নি। আমার জানতে ইচ্ছে করছে তোর বাড়ি কোথায়?
– কেন? শুনলি না আমার বাড়ি কুমিল্লা।
– কিন্তু তোর গ্রাম কোথায়?
– শুনবি নাকি আমার গ্রামের নাম?
– হ্যাঁ শুনব।
– আয় দেখিয়ে দিই।
– এখান থেকেই দেখাবি?
– হ এখান থেকেই দেখাব।
– আচ্ছা দেখাতো দেখি তোদের গ্রাম।
এ কথা বলার সাথে সাথে মিন্টু ছোটনকে সজোরে ধাক্কা দিল। ধাক্কা খেয়ে ছোটন মাটিতে পড়ে গেল। তখন তার একটি দাঁত ভেঙ্গে গেল।
ছোটন তখন কাঁদতে কাঁদতে হেডস্যারের কাছে গিয়ে মিন্টুর নামে নালিশ করল।
হেডস্যার ছোটনের অভিযোগ শোনার পর মিন্টুকে স্যারের রুমে ঢেকে আনলেন।
মিন্টু আসামীর মতো হেডস্যারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। হেডস্যার জিজ্ঞেস করলেন, মিন্টু তুমি ওকে ধাক্কা দিয়েছ কেন?
মিন্টু বললো, স্যার ও আমাদের গ্রাম দেখতে চেয়েছিল, তাই।
– তাই বলে কি ধাক্কা মারতে হবে?
স্যার আমাদের গ্রামের নাম ধাক্কামারা। সে আমাদের গ্রাম দেখতে চেয়েছে তাই ধাক্কা দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছি!
মিন্টুর এই খামখেয়ালিপনা কথা শুনে হেডস্যার খুবই রাগান্বিত হলেন। অন্য একজন ছাত্রকে বললেন একটা বেত আনতে। একজন ছাত্র একটি বেত এনে দেয়। হেডস্যার বেত হাতে নিয়ে মিন্টুকে সামনে আসতে বললেন। মিন্টু সামনে আসতেই কয়েকটি বেত মারল আর বললেন, আর কখনো দুষ্টামী করবে?
মিন্টু কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো, না স্যার। এখন থেকে আমি ভাল হয়ে যাব। আর কখনো এমন দুষ্টুমী করবো না। আমাকে মাফ করে দেন স্যার।
হেডস্যার তখন মিন্টুকে মাফ করে দিলেন এবং ছোটনের সাথে মিলিয়ে দিলেন।
সেদিনের সেই ঘটনার পর থেকে মিন্টু আর দুষ্টুমী করে না। এখন থেকে খুব ভাল মানুষ হয়ে গেছে। নিয়মিত ক্লাসে আসে। প্রতিদিনের পড়া মুখস্থ করে আসে। ইতিমধ্যে সকল ছাত্রদের মধ্যে সে একজন প্রিয় ছাত্র হয়ে গেল এবং ছোটন তার প্রিয় বন্ধু হয়ে গেল।

রচনাকাল-১ জুলাই ২০১৩ খ্রি:

মায়ের ভালোবাসা

অনিক খুব চঞ্চল স্বভাবের বালক। সারাদিন এ বাড়ী ও বাড়ী ঘুরে বেড়ানো যার কাজ। লেখা পড়ার দিকে তেমন কোন মনযোগ নেই। বাবা-মা স্কুলের কথা বললেই বন্ধুদের নিয়ে চলে যায় খেলার মাঠে। খেলার ছলে কখনো কাউকে চিমটি কাটে। কখনো বা ব্যাট দিয়ে কারো মাথা ফাঁটিয়ে দেয়। আবার কখনো রাগে কারো জামা ছিঁড়ে দেয়। ফল খাওয়ার লোভ সামলাতে না পেরে কখনো কখনো অন্যের গাছে ঢিল মারে। একদিন পাশের বাড়ীর কুল গাছে ঢিল মেরে তাদের গরুর পানি খাওয়ার গামলা ভেঙ্গে দেয়। এই নিয়ে চলে দু’পরিবারের মধ্যে তুমুল ঝগড়া। সেই থেকে অনিক আর সেই বাড়ীতে যায় না। দিনে অনন্ত ৪/৫টি নালিশ আসে তার বাবা-মার কাছে। বাবার বকুনি ও মায়ের শাসনে দিন কাটছে তার। তাই এখন আর সে অন্যের গাছে ঢিল ছুঁড়ে না কিন্তু অন্য একটি নেশায় পেয়ে বসেছে তাকে। আর তাহলো পাখি শিকার করা। কারণ সে এতদিনে বুঝতে পেরেছে অন্যের গাছে ঢিল ছুঁড়া অন্যায় কিন্তু পাখি শিকার করা অন্যায় না। পাখির বাসা ভেঙ্গে পাখির ছানা ধরা এখন তার নেশা হয়ে গেছে। বনে জঙ্গলে, আশে পাশের ঝোপ ঝাড়, ক্ষেত-খামারে ঘুরে বেড়ানো এখন তার নিত্যদিনের কাজ। এ কাজে কেউ তাকে বাঁধা দেয় না। কেউ আর এখন পাখির বাসা ভাঙ্গার জন্য তার বাবা-মার কাছে নালিশ করে না। তাই মনের আনন্দে নাওয়া-খাওয়া ভুলে পাখির ছানা ধরার নেশায় দিন রাত ঘুরে বেড়াচ্ছে অনিক।

অনিকের দুষ্টুমির সংঙ্গী হিসেবে যোগ দিয়েছে তার প্রতিবেশী রবিন। সেই শিশুকাল থেকেই দু’জনে এক সাথে খেলা-ধূলা, মারা-মারি করে আসছে। একদিন দুজনে এক ঝোপের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। তখন তারা টুনটুনি পাখির ছানার ছিঁ ছিঁ আওয়াজ শুনতে পায়।

চুপ করে দাঁড়িয়ে থাক এখানে কোন কথা বলবি না। টুনটুনির ছানা ধরার সময় কথা বলা নিষেধ। তোর কথার আওয়াজ পেলে ফুরৎ করে টুনটুনির ছানা চলে যাবে। অনিক তার বন্ধু রবিনকে একথা বলেই টুনটুনির বাসার দিকে চুপি চুপি হাঁটতে লাগল। অনিক আগে রবিন পিছনে। অনিক সামনে থেকে দু’হাতে চেপে ধরে বাসাটি গাছ থেকে ছিঁড়ে ফেলে। আর অমনি বাসার ভেতর থেকে টুনটুনির চারটি ছানা ছিঁ ছিঁ করে কাঁদতে লাগল। কিন্তু সেদিকে অনিকের কোন খেয়াল নেই। তার আনন্দ লাগলো এই ভেবে যে, সে আজ বিরাট কিছু জয় করে ফেলছে। অনেক দিনের শখ ছিল সে টুনটুনির ছানা ধরবে এবং সেটি খাঁচায় বন্দি করে লালন পালন করবে।

টুনটুনির ছানাগুলোর ছিঁ ছিঁ আওয়াজ পেয়ে মা টুনটুনিটা বাসার কাছে এসে টুনটুন করে আওয়াজ করছে। সন্তান হারানোর শোকে মা টুনটুনিটা কাঁদছে কিন্তু অবুঝ অনিক তার সেই কান্না বুঝে না। মনের আনন্দে অনিক আর রবিন ছানাগুলো নিয়ে বাসায় ফিরে এল। মা টুনটুনিটা বাচ্চার শোকে কাঁদতে কাঁদতে অনিকের পিছে পিছে তার বাড়ীর সামনে আসছে। একবার মা টুনটুনিটা উড়াল মেরে অনিকের কাছে আসে আবার দূরে চলে যাচ্ছে। আর টুনটুন করে কাঁদছে। টুনটুনি বলছে, ‘অনিক আমার বাচ্চাগুলোকে মেরো না। তাদেরতো কোন দোষ নেই। আমিতো তোমাদের কোন ক্ষতি করি নাই। তাহলে কেন তুমি আমার অবুঝ শিশু বাচ্চাগুলোকে ধরে নিলে?’ কিন্তু সেই বোবা পাখির মনের ভাষা অবুঝ অনিক বুঝে না।

অনিক তার বাবার কাছে বায়না ধরল একটা খাচা এনে দেয়ার জন্য। কারণ সে টুনটুনির ছানাগুলো খাঁচায় বন্দি করে পালবে। অনিকের বাবা চিন্তা করে দেখলো পাখির ছানা লালন পালন করলে হয়তো ছেলের দুষ্টুমিটা একটু কমবে। তাই ছেলের বায়না রাখতে গিয়ে অনিকের বাবা বাজার থেকে খাঁচা কিনে আনলেন। অনিক বাচ্চাগুলো খাঁচায় বন্দি করে রাখল।

এদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। শত চেষ্টা করেও যখন মা টুনটুনিটা তার বাচ্চাগুলোকে রক্ষা করতে পারেনি তখন মনের দুঃখে এ বাড়ি ছেড়ে তার নিজ বাসায় ফিরে গেল।

মা টুনটুনি তার বাচ্চাগুলোকে কোন ধরনের খাবার খাওয়ায় তা অনিকের জানা নেই। টুনটুনির ছানাগুলো নতুন পরিবেশে এসে তাদের কাছে অসহ্য লাগছে। একদিকে মা হারানোর বেদনা অন্যদিকে ক্ষুধার যন্ত্রণা। ক্ষুধার যন্ত্রণায় ছানাগুলো ছিঁ ছিঁ করে কাঁদছে। এ দেখে রাতের বেলা অনিক টুনটুনির বাচ্চাগুলোকে খাওয়ানোর জন্য কিছু চাউল নিল। তাকে দেখে বাচ্চাগুলো হা করল। অমনি অনিক তাদের মুখে চাউল তুলে দেয়। কিন্তু সে চাউল তাদের মুখে ঠিকমত পড়ে না। তাই অনিক বাধ্য হয়ে একটা একটা বাচ্চা ধরে মুখ হা করে টিপে টিপে ইচ্ছে মতো চাউল খাওয়ালো। একটা বাচ্চাকে এমনভাবে খাওয়ালো যে, পেটে আর জায়গা নেই। দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

রাত অনেক হলো। অনিক ঘুমিয়ে পড়েছে। সে স্বপ্ন দেখছে তাকে দুজন সন্ত্রাসী ধরে নিয়ে যাচ্ছে। তার মা-বাবা তার পিছে পিছে কাঁদছে আর বলছে, ‘আমার ছেলেকে তোমরা ছেড়ে দাও। অনিক নিজেও মা মা বলে কাঁদছে। কিন্তু কিছুতেই তারা অনিকের বাবা-মায়ের কথা শুনছে না। এক সময় তারা অনিকের চোখ বেধে এক নির্জন জায়গায় নিয়ে যায়। অনেক রাত হলে তারা তাকে খাবার দেয়। অনিকের পেটে ক্ষুধা থাকা সত্ত্বেও তাদের খাবার খাচ্ছে না। তখন তারা অনিককে গলা টিপে ধরে খাওয়াচ্ছে। এ দৃশ্য দেখে অনিক হাউ-মাউ করে কেদে ঘুম থেকে উঠল। কান্নার আওয়াজ পেয়ে অনিকের বাবা-মাও ঘুম থেকে উঠল। অনিকের বাবা বলল, কি হয়েছো তোর কোন খারাপ স্বপ্ন দেখছিস?

অনিক তখন চিৎকার করছে আর বলছে আমার টুনটুনির ছানা কোথায়? এই বলেই দৌঁড়ে পাখির খাঁচার দিকে ছুটে গেল। খাঁচাটি খুলে দেখলো একটি ছানা মারা গেছে এবং ঐ ছানাটির সারা শরীরে পিঁপড়া কামরাচ্ছে। এ দৃশ্য দেখে সে আরো জোরে হাউ-মাউ করে কাঁদছে।

পরদিন সকাল বেলা তার মামা আমির আসল বেড়াতে। অনিকের মামা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে মাস্টার্স করেছে। অনিক তার পাখির ছানার ঘটনাটি ও স্বপ্নের কথা তার মামার কাছে খুলে বলে। মামা সব ঘটনা শুনে বলল, দেখ অনিক মা-বাবা যে তার সন্তানকে কত ভালোবাসে তা তুমি স্বপ্নে দেখতে পেয়েছো। আজ সত্যি সত্যি যদি তোমাকে কেউ ধরে নিয়ে যায় তাহলে তোমার মা নিশ্চয় কষ্ট পাবে?

অনিক মাথা নাড়িয়ে বললো, হ্যাঁ।
তুমিও তোমার মায়ের জন্য কষ্ট পাবে?
হ্যাঁ।
তেমনি টুনটুনির ছানাগুলো ধরে আনাতে টুনটুনির মা-বাবাও নিশ্চয় কষ্ট পেয়েছে তাই না?
হ্যাঁ মামা।
আর বচ্চাগুলোতো তাদের মায়ের জন্য কষ্ট পেয়েছে।
হ্যাঁ মামা।
অন্য পরিবেশে তাদের খাবার দেয়াতেও খেতে কষ্ট হয়েছে। তুমি জোর করে তাদের খাওয়ানোর ফলে পেট ফেপে একটি বাচ্চা মারা গেল। এই কাজটা কি তুমি ভাল করেছে?
অনিক নিশ্চুপ হয়ে গেল।
কি হলো বলো কাজটা কি ভালো হয়েছে? অন্যকে কষ্ট দিলে নিজেও কষ্ট সহ্য করতে হয়। তোমার যেমন প্রাণ আছে ঐ টুনটুনিরওতো প্রাণ আছে।
অনিক অনুতপ্ত হয়ে বললো, মামা আমার ভুল হয়েছে। আমি কাজটি ঠিক করিনি। আর কোনদিন পাখির ছানা ধরব না।
তাহলে এখন তাদেরকে তার মায়ের কাছে দিয়ে আসো।
ঠিক আছে মামা।

অনিক মৃত ছানাটি ফেলে দেয় আর মামার কথামতো মামাকে সাথে নিয়ে অনিক অন্য তিনটি ছানা নিয়ে টুনটুনির বাসায় রেখে আসে। অনিক ছানাগুলো বাসায় দিতেই মা টুনটুনি বাসায় আসল। এসেই বাচ্চাগুলোকে পেয়ে আনন্দে টুনটুন করে উঠল। আর এ দৃশ্য দেখে অনিক ও তার মামার চোখ বেয়ে আনন্দের অশ্রু ঝড়ে পড়ল।

রচনাকাল-১৭ আগস্ট ২০১৩ খ্রিস্টাব্দ।
[শব্দতরী পঞ্চম বর্ষ, ২০১৪, প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত]

বন্ধু


মোহতেশাম ছোট্ট শিশু। বয়স আট কি নয়। সে তার বাবা-মায়ের সাথে ঢাকায় থাকে। এবার সে তার দাদার বাড়িতে এসে ঈদ করবে। সামনে কোরবানির ঈদ। তাই এ উপলক্ষে সে ঈদের দু’দিন পূর্বেই গ্রামের বাড়িতে চলে আসল। মেঘনার তীর ঘেষে তার দাদার গ্রামের বাড়ি।
মোহতেশামের গ্রাম দেখতে খুব ভাল লাগে। মাঝে মাঝে স্কুল বন্ধ হলে যে চলে আসে দাদার কাছে। তখন আর যেতে ইচ্ছে করে না তার। শহরের মত যানজট নেই এখানে। মুক্ত আবহাওয়ায় ছুটাছুটি করতে পারে। নেই কোন বাঁধা। নদীতে সাঁতার কেটে গোসল করতে পারে। আরও কত্ত কি! তাইতো তার গ্রাম এত ভাল লাগে।
শনিবার দিন শ্রীঘর বাজার থেকে তার দাদা একটা কুরবানির গরু কিনে আনল। দাদা যখন বাজারে যায়, তখন মোহতেশাম তার সাথে গিয়েছিল। সে গরুটি পছন্দ করেছে। কুচকুচে কালো ষাড়। নাদুস-নুদুস শরীর। গরু যখন বাড়িতে আনল তখন তার দাদাকে দিয়ে একটা ছবি তুলে রাখল।
ঈদের দিন সকাল বেলা চারদিকে হৈ চৈ পড়ে গেল। ছেলে-মেয়েদের কোলাহল। কেউতো এ মূহুর্তে বিছানায় নেই। সবাই মেঠে উঠল ঈদের আনন্দ উপভোগ করার জন্য। সবার মনে আজ শুধু আনন্দ আর আনন্দ। মোহতেশাম তার দাদাকে সাথে নিয়ে মেঘনা থেকে গোসল সেরে আসল। মা সেমাই পাক করছে। বাবা-মা, দাদা সবাই এক সাথে মিলে সেমাই খেল।
মা পরিপাটি করে মোহতেশামকে কাপড় পড়িয়ে দিলেন। সুন্দর করে চিরুনী দিয়ে মাথা আচরিয়ে দিলেন। তারপর মোহতেশাম দাদার কাছে এসে বললো, দাদা!
দাদা বললেন, কি দাদা ভাই।
– চল আর দেরি কেন? ঈদগাহে যাই।
– হ্যাঁ চল দাদা ভাই।
– তাড়াতাড়ি চল দাদা নামাজের সময় হয়ে যাচ্ছে।
দাদা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো, হ্যাঁ তাইতো!
মোহতেশাম নামাজের বিছানা হাতে নিল। দাদা-নাতী দু’জনে ঈদগাহের দিকে রওয়ানা হলো। নানা রঙের পোশাক পড়ে কচি কচি ছেলে-মেয়েরা ঈদগাহে যাচ্ছে। মোহতেশাম পড়েছে পাঞ্জাবী ও পায়জামা। দাদা-নাতী যখন ঘর থেকে বের হচ্ছিল তখন একটি গরিব ছেলে এসে মোহ্তেশাম বললো, আমারে একটা ট্যাহা দ্যাও।
ছেলেটির পড়নে একটা অর্ধময়লা শার্ট ও একটা ছেঁড়া হাফপ্যান্ট। মুখটা শুকনা। তাকে দেখে মোহতেশামের মায়া লেগে গেল। সে ছোট থেকেই গরিব দু:খিকে ভালোবাসে। গরিবের দু:খ দেখলে তার চোখ দিয়ে জল এসে যায়।
মোহতেশাম ছেলেটিকে লক্ষ্য করে বললো, আচ্ছা তোমার নাম কি?
ছেলেটি বললো, আমার নাম রফিক।
– তোমার মা-বাবা নেই?
– ছেলেটির চোখ অশ্রুসজল হয়ে গেল। কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো, আমার আব্বা নৌকা ডুইব্বা মইরা গেছে।
– আর তোমার মা?
– মা আমারে ছাইড়া আরেক বেডার লগে বিয়া বইয়া গেছে।
– এখন তোমার বাড়িতে আর কে আছে?
– আমার বুবু আছে। তার সাথে আমি থাহি। বুবু হারাদিন ভিক্ষা কইরা যা আনে তাই দিয়া আমডা চলি।
ছেলেটি মোহতেশামের কথার জবাব দিতে দিতে চোখে জল এসে গেল। মোহতেশামের দাদা এসব দৃশ্য দাঁড়িয়ে দেখছেন।
মোহতেশাম ছেলেটির গায়ে ময়লা জামাটার দিকে তাকিয়ে বললো, তোমার কি আর কোন ভাল জামা নেই?
– না। ভালা জামা কত্তে আনমু। ঠিকমত তো খাইতেই পারি না।
মোহতেশামের এ দৃশ্য দেখে দাদা ভাবছে, এতোটুকু ছেলের গরিবের প্রতি কত দরদ!
মোহতেশাম তার বাবার কাছে এসে বললো, বাবা আমারতো অনেক জামা। একটা জামা ঐ গরিব ছেলেটাকে দিয়ে দেই?
ছেলের মুখে এ কথা শুনে বাবাতো রীতিমতো অবাক! তারপর বললো, তুমি যদি দিতে চাও, তাতে আমার কোন আপত্তি নেই।
মোহতেশাম ছেলেটিকে তার একটা শার্ট ও দশটা টাকা দেয়। ছেলেটি টাকা ও জামা পেয়ে খুশীতে বাহ্ বাহ্ করতে থাকে। সে তার দু’হাত দিয়ে দু:খ ভরা অশ্রু মুছলো। তারপর বললো, আল্লাহ তোমারে অনেক বড়লোক করুক। বলেই ছেলেটি যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। আর অমনি মোহতেশাম বললো, আর শোন! তুমি দুপুরে আমাদের বাসায় খাবে।
– ঠিক আছে। বলেই ছেলেটি চলে গেল।
পরে দাদা-নাতী দু’জনে ঈদগাহে রওয়ানা হল।
সারি বেঁধে মানুষ ঈদগাহে যাচ্ছে। রাস্তায় যেন আজ লোক জনের ঢল নেমেছে। ধীরে ধীরে ঈদগাহ ময়দান কানায় কানায় পরিপূর্ণ হলো। দাদা-নাতী দু’জনে পাশাপাশি নামাজে দাঁড়ালো। নামাজ শেষে যখন ইমাম সাহেব খুৎবাহ পড়ছেন মোহতেশাম তা মনযোগ দিয়ে শুনছে। মুনাজাতের পর শুরু হলো কুলাকুলি পর্ব। সমবয়সী ছেলেরা পরপস্পরের সাথে কুলাকুলি করছে। মোহতেশামের ইচ্ছে দাদার সাথে কুলাকুলি করতে কিন্তু ছোট বলে তার দাদার বুক নাগাল পাচ্ছে না। তাই সে লাফ দিয়ে তার দাদার কোলে উঠে কুলাকুলি করলো। দাদাতো নাতীর বুদ্ধি দেখে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন।
ঈদগাহ থেকে এসেই ইমাম সাহেব গরু জবেহ করার জন্য প্রস্তুত হলেন। মোহতেশামের সমবয়সী ছেলে-মেয়েরা গরু জবেহ দেখার জন্য ইমাম সাহেবের পিছে পিছে ছুটল। মোহতেশামও ইমাম সাহেবের পিছনে ছুটল। কিছুক্ষণের মধ্যেই আল্লাহু আকবার বলে হৈ চৈ শুরু হয়ে গেল। গরুকে যখন মাটিতে শুয়ানো হল তখন সবাই গরুর কাছাকাছি চলে গেল। যখন আল্লাহু আকবার বলে ছুরি চালানো হল; তখন লাফিয়ে দৌঁড়ে চলে আসল মোহতেশাম।
মোহতেশামদের গরুটি জবেহ করার জন্য যখন ইমাম সাহেব তাদের বাড়িতে আসলেন তখন তার গরুটির প্রতি মায়া লেগে গেল। নিরীহ প্রাণীটি আল্লাহর রাস্তায় কুরবানি হয়ে যাবে তা ভাবতেও পারে না মোহতেশাম। গরু জবেহ হয়ে গেল। গোস্ত কাটার কাজে লেগে গেল মোহতেশাম। গোস্ত কাটা শেষে মোহতেশাম বেড়িয়ে পড়লো ঐ এতিম ছেলেটির সন্ধানে। ছেলেটিকে খুঁজে বের করলো। এতিম ছেলেটিকে তাদের বাড়িতে নিয়ে আসল। তাদের গোস্ত রান্না হলে তাকে পেট ভরে খাওয়ালো। তারপর তাকে বললো, আজ থেকে তুমি আমার বন্ধু।
এরপর থেকে যখনই মোহতেশাম গ্রামের বাড়িতে আসত তখনই ছুটে যেত ঐ এতিম ছেলেটির কাছে। হাত বাড়িয়ে দিত বন্ধুত্বের।

টুনি ও প্রজাপতি


টুনি তার নাম। বাবা মায়ের একমাত্র আদরের মেয়ে। সে কেবল অ আ ক খ পড়ে। তার একটা বর্ণমালার বই আছে। বইটি খুবই সুন্দর। ছড়ায় ছড়ায় বর্ণমালা দিয়ে বইটি সাজানো। রঙিন সব ছবি। প্রজাপতির ছবি। পাখির ছবি। ফলের ছবি। ফুলের ছবি। প্রতিদিন জানালার পাশে বসে টুনি বর্ণমালার বই পড়ে।
জানালার পাশেই টুনির বাবা একটি ফুলের বাগান করেছে। সেই বাগানে বিভিন্ন জাতের ফুলের চারা লাগানো হয়েছে। নানা জাতের ফুল ফুটেছে। টুনি প্রতিদিন সেই বাগানের যত্ন করে। বাগানে পানি দেয়।
একদিন টুনি দেখলো, ফুলবাগানে একটি প্রজাপতি আসল। হায়! কি অপরূপ! এমন সুন্দর প্রজাপতি টুনি আগে দেখেনি। কিন্তু এখন দেখামাত্রই সে চিনে ফেলল। কারণ সে তার বর্ণমালা বইয়ে এমন একটি প্রজাপতির ছবি দেখেছে এবং পড়েছে প-তে প্রজাপতি। লাল, নীল, হলুদ, কালো, মেরুনের চমৎকার ছোপ ছোপ সাজের প্রজাপতিটা উড়ছে। ফুল গাছের এ পাতা থেকে ও পাতায় বসছে। উড়ে উড়ে অপরূপ বর্ণচ্ছটাই বিকিরিত করছে দৃষ্টির তরঙ্গে।
হঠাৎ করে প্রজাপতিটা উড়াল দিল। টুনি তাকিয়ে থাকে প্রজাপতি চলে যাওয়া পথের দিকে। ওই তো রঙ্গিন প্রজাপতিটা উড়ে চলে যায় টুনির মাথার উপর দিয়ে অনন্ত পথের পানে। আর তখন টুনি এক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে রইল।

তারিখ: ১৪/০২/২০১৬খ্রি:

নালিশ


মনিষার বয়স এখন তিন বছর। সে এখন কথা বলতে পারে। খেলতে পারে। রাগ করতে পারে। বায়না ধরতে পারে। বিশেষ করে খাবার খাওয়ানোর সময় অনেক বায়না ধরে। কোন কিছুতেই ভুলিয়ে তাকে খাওয়ানো যায় না। তাকে খাবার খাওয়ানোর জন্য রীতিমত তার সাথে যুদ্ধ করতে হয়। তাকে খাবার খাওয়ানো যে কত কঠিন তা মনিষার মা ছাড়া আর কেউ বুঝবে না। কত রূপকথার গল্প ও মিথ্যার ভা-ার সাজিয়ে, ভয় দেখিয়ে তাকে খাওয়াতে হয় তা বলা মুশকিল। কখনো এক লোকমা মুখে দিলে এ রুম ছেড়ে অন্য রুমে চলে যায়। এ নিয়ে তার মাকে সারাক্ষণ তার পিছনে দৌঁড়াতে হয়।
সেদিন অফিস থেকে এসেই দেখি মনিষার মা ফরিদা তাকে সারা ঘর দৌঁড়িয়ে খাবার খাওয়াচ্ছে। আমাকে দেখেই মনিষা দৌঁড়ে এসে আমাকে ঝাপটে ধরে বললো, আব্বু আমি আম্মুর হাতে ভাত খাব না। আম্মু আমাকে বকা দেয়! আমাকে মারে!
– কি বললে! তোমার আম্মু তোমাকে মারে?
– হ্যাঁ আব্বু।
এতটুকুন মেয়ে বাবার কাছে মায়ের নামে নালিশ করায় ফরিদা বললো, কি আমার নামে বাবার কাছে নালিশ! বলি কে খাওয়াবে তুকে? আমি আর পারব না। তোর আব্বুকে বল অফিস থেকে এসে তুকে যেন খায়য়ে দিয়ে যায়।
আমি তখন বললাম, ঠিক আছে আমিই আমার মেয়েকে খাওয়াবো। তোমাকে খাওয়াতে হবে না।
– তুমি বুঝবে কি কত কষ্ট করে এই মেয়েকে ভাত খাওয়াতে হয়। দেখ একদিন খাওয়ায়ে কেমন মজা লাগে।
– আচ্ছা আমি ফ্রেশ হয়ে নিই তারপর খাওয়াচ্ছি।
মনিষাকে নিয়ে ড্রাইনিং টেবিলে বসলাম। তারপর ফরিদাকে বললাম ভাত দেয়ার জন্য। ফরিদা ভাত বেড়ে দেয়ায় আমি মনিষাকে খাওয়ানোর জন্য প্লেট হাতে নিলাম। ভাত মেখে এক লোকমা হাতে নিয়ে বললাম, হা কর আম্মু।
– আব্বু আমি এখন খাব না। পরে খাব। তুমি খাও।
– আমিতো খাবই তুমিও খাবে আমার সাথে।
– খাও আম্মু ডিম দিয়ে খাও।
– আমি ডিম দিয়ে খাব না, মাছ দিয়ে খাব।
– ঠিক আছে মাছ দিয়ে খাও।
– মাছ দিয়ে খাব না, মুরগি দিয়ে খাব।
মনিষার এসব বায়না দেখে আমি তাকে ভয় দেখানোর জন্য বললাম, আম্মুু! ভাত না খেলে কিন্তু কাক আসবে! কাকে ভাত নিয়ে যাবে!! কিন্তু না কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। আমার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। তাই এবার নতুন পন্থা অবলম্বন করলাম।
– শোনো আম্মু! ভাত না খেলে শিয়াল আসবে! শিয়াল তোমাকে নিয়ে যাবে।
শিয়ালের কথা শুনে মনিষা আমার দিকে তাকিয়ে বললো, আব্বু শিয়াল কী?
– আগে ভাত খাও। তারপর বলব।
– না এক্ষুনি বল।
– বলছি তার আগে ভাত খাও।
শিয়াল সর্ম্পকে জানার জন্য এবার মনিষা হা করল। আর অমনি আমি তার মুখে পুড়ে দিলাম এক লোকমা ভাত।
কোনরকম এক লোকমা ভাত মুখে দিয়েই বললো, আব্বু বল না শিয়াল কী?
– শিয়াল মানে এটা দেখতে কুকুরের মতো। দিনের বেলা লুকিয়ে থাকে।
– লুকিয়ে থাকে কেন?
– মানুষের ভয়ে।
– মানুষকে ভয় পায় কেন?
– মানুষ শিয়াল দেখলে মেরে ফেলে তাই।
– মানুষ শিয়াল মারে কেন?
– শিয়াল মানুষকে খেয়ে ফেলে তাই।
– শিয়াল মানুষকে খেয়ে ফেলে! বলেই আমাকে ঝাপটে ধরে আবার বললো, আব্বু আমি শিয়াল দেখব।
– হ্যাঁ আম্মু তোমাকে দেখাবো। আগে খাবার শেষ করে নাও।
– না! আগে শিয়াল দেখাও।
– দেখো! বেশি কথা বলো না! ভাত না খেলে সত্যি সত্যি শিয়াল এসে কামড় দিবে!
– তুমি মিথ্যে বলছো আব্বু! শিয়ালতো দিনের বেলা আসে না। বলেই দিল এক দৌঁড়। এক দৌঁড়ে দাদুর কাছে চলে গেল।
– দাদু! দাদু! আব্বু আমাকে ভয় দেখাচ্ছে।
নাতনীর কথা শুনে আম্মা আমাকে তলব করল।
– কিরে ফয়সাল তুই আমার নাতনীকে ভয় দেখাচ্ছিস কেন?
– কি করব আম্মা? ভয় দেখিয়েতো ভাত খাওয়াতে পারছি না।
– ছোট বাচ্চাকে ভয় দেখাছনে।
– ওতো ভয়ও পায় না। বলে কি সে শিয়াল দেখবে।
মনিষা আবার আমার কাছে এসে বললো, আব্বু আমি শিয়াল দেখে তারপর ভাত খাব।
– ঠিক আছে বলছিতো আমি তোমাকে শিয়াল দেখাব। রাত হলে তারপর দেখাব। এখন তুমি ভাত খাও লক্ষ্মীটি।
– না! না!! না!!! খাব না। বলেই দিল দৌঁড়। আর আমনি আমার সাথে ধাক্কা লেগে হাতের প্লেটটি পড়ে ভেঙ্গে গেল।

রচনাকাল: ১০/০৯/২০১৫খ্রি:

প্রতিজ্ঞা


সেই ছোট বেলা থেকেই আমি খুব চঞ্চল স্বভাবের ছিলাম। সারাদিন বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়াতাম। লেখাপড়ার দিকে তেমন কোন মনযোগ ছিল না। মা-বাবা স্কুলে যাওয়ার কথা বললেই বন্ধুদের সাথে খেলার মাঠে চলে যেতাম। সারাদিন ডাংগুলি, গোল্লাছুট, ফুটবল, হা-ডু-ডু, কানামাছি, বৌছি খেলে দিন পার করতাম। তপ্ত রৌদের সময় মেঘনা নদীতে ঝাপিয়ে পড়ে বন্ধুদের সাথে সাতার কেটে ছুয়াছুয়ি খেলতাম। দুপুরের খাবারের কথা মনে করতাম না। তবে পড়ন্ত বিকেলে পেঠে যখন বেশি ক্ষুধা অনুভব করতাম তখন বাড়িতে ফিরতাম। খাবার দাবার ও পড়াশুনা নিয়ে মা অনেক বকাঝকা করতেন। কিন্তু কে শুনে কার কথা। আমি সারাক্ষণ নিয়ম মতো আমার কর্তব্য পালন করেই যাচ্ছি।
পাখি শিকার করা ছিল আমার আরেকটি নেশা। খেলাধূলার ফাঁকে ফাঁকে যখন অবসর পেতাম তখন পাখি শিকারে বের হয়ে যেতাম। মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ঘরের কোনে চড়–ই পাখির বাসা খুঁজে বের করতাম। বাসা ভেঙ্গে চড়ুই পাখির ছানা নিয়ে আসতাম। আশে পাশের ঝোপÑঝাড়ের পাশে টুনটুনির বাসা খুঁজতাম। কোথায় টুনটুনির আভাস পেলে বাসা ভেঙ্গে টুনটুনির ছানা নিয়ে আসতাম। আরেকটি নেশা ছিল ছাগল পালন করা। পড়াশুনার প্রতি টান না থাকায় বাবা একটি ছাগল এনে দিলেন। সেই ছাগল নিয়ে প্রতিদিন মেঘনার পাড়ে চলে যেতাম। সারাদিন ছাগল ছেড়ে দিয়ে খেলাধূলা ও পানিতে লাফালাফি করে দিন পার করতাম। এভাবেই চলত আমার শৈশবের দিনগুলি।
দিন যায়, রাত আসে। দিনে দিনে বড় হচ্ছি আমি। বয়স আমার ৮ পার হয়ে গেল। আমি পড়াশুনার ধারধারেও নাই। আমার সমবয়ী অনেকেই স্কুলে যায়। আবার অনেকেই আমার মতো সারাদিন দুষ্টুমি করে দিন পার করে। আমার বন্ধু আজহারুল। একই দিনে আমরা জন্মগ্রহণ করেছি। সে এখন ক্লাশ টুতে পড়ে আর আমি কিছুই পড়িনা। এই নিয়ে আমার মায়ের খুব চিন্তা। তাকে দেখিয়ে মা আমাকে তিরষ্কার করে। প্রতিদিন মা আমাকে স্কুলে যাওয়ার জন্য বকাঝকা করেন।
মায়ের বকুনি খেয়ে মাঝে মাঝে স্কুলে গেলেও অন্য ছেলেদের অত্যচারে বেঞ্চে বসতে না পেরে চলে আসতাম। আমাকে দেখতে একটু বড় লাগায় ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা হাসি ঠাট্টা করত। তখন আমি লজ্জা পেতাম। বাড়িতে এসে কেঁদে কেঁদে মাকে বলতাম, মা আমি আর স্কুলে যাব না।
আমার বড় ভাই আকবর হোসেন পড়াশুনায় খুবই ভাল। ক্লাশের ফার্স্ট বয়। ওনি প্রতি দিন প্রাইমারী স্কুলে যায়। রাতের বেলা প্রচুর পড়াশুনা করেন। আমাকে স্কুলে নেয়ার চেষ্টা করেও নিতে পারেন নাই। স্কুলে যাওয়ার জন্য ভাই আমাকে মাঝে মাঝে মারতেন। তারপরও আমি স্কুলে যেতাম না।
ইতোমধ্যে বড় ভাই পঞ্চম শ্রেণি পাস করে ফেললেন। আমার দাদার স্বপ্ন ছিল আমার বড় ভাইকে মাদ্রাসায় পড়াবেন। আলেম বানাবেন। তাই পঞ্চম শ্রেণি পাস করার পর বড় ভাইকে আলীয়া মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিলেন। বড় ভাই ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হলেন। মাদ্রাসার পাশেই এক বাড়িতে বড় ভাইয়ের লজিং ঠিক হলো। ঐ বাড়ির তিনজন ছেলে আব্দুল আলী, মুঞ্জুর আলী ও জমির আলীকে বড় ভাই পড়াতেন। আব্দুল আলী ক্লাশ ফোরে, মুঞ্জুর আলী ক্লাশ থ্রিতে এবং জমির আলী ক্লাশ টুতে পড়ত। তাদেরকে পড়াতে গিয়ে বড় ভাই আমার কথা ভাবলেন। আমাকে ঐ মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিবেন এবং তার ছাত্রদের সাথে আমাকে পড়াবেন। বড় ভাই বাবাকে চিঠি লিখলেন আমাকে মাদ্রাসায় ভর্তি করার কথা জানিয়ে। বাবা-মা ও দাদা সবাই রাজি হলেন। সবাই আমাকে বুঝালেন। আমার মতামত নিলেন। আমিও রাজি হয়ে গেলাম।
তিন মাস পর বড় ভাই বাড়িতে আসলেন। বড় ভাই আমার সম্মতি পেয়ে খুশি হলেন।
দুই দিন বাড়িতে থাকার পর বড় ভাই আমাকে নিয়ে মাদ্রাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। জীবনের প্রথম গ্রাম ছেড়ে নরসিংদী শহরে পা রাখলাম। শহরের চাকচিক্য দেখে খুব ভাল লাগল। বড় ভাই আমাকে নিয়ে বাসে উঠলেন। বাস যখন শেখেরচর আসল তখন আমরা সেখানে নেমে পড়লাম। আমরা বাস থেকে নামার সাথে সাথে একটা আওয়াজ হলো। পিছন ফিরে দেখলাম আমাদের কাছ থেকে ২০০ গজ দূরে দুটো বাস মুখোমুখি সংঘর্ষ হলো। সাথে সাথে বেশ কয়েকজন মৃত্যু বরণ করল। রক্তে রঞ্জিত হয়ে গেল রাজপথ। জীবনের প্রথম শহরে এসেই দুর্ঘটনার মুখোমুখি হলাম। যা হোক পরে আমরা প্রথমে বড় ভাইয়ের লজিং বাড়িতে আসলাম।
পরদিন মাদ্রাসায় যাওয়ার জন্য আমি পাঞ্জাবী, পায়জামা, টুপি পড়ে প্রস্তুত হলাম। বড় ভাই আমাকে নিয়ে মাদ্রাসায় আসলেন। আমি যেহেতু গ্রাম থেকে আসছি। তেমন ভাল পড়াশুনাও করিনি। স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ এখনও সবগুলো পড়তে পারিনি। তাই আমি রিডিং পড়তে পারিনা। সবগুলো অক্ষর এখনও ঠিকমত লিখতে পারিনি। এমন অবস্থায় আমাকে বড় ভাই প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করিয়ে দিলেন। আমার জন্য প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া কঠিন মনে হল। কিন্তু বয়সও বেড়ে যাচ্ছে। বড় ভাই বললেন, কোন চিন্তা করিস না আমি পড়াব। সব পাড়বি।
মাদ্রাসা ১০ টা থেকে শুরু হয়। পরদিন আমি বড় ভাইয়ের সাথে মাদ্রাসায় আসলাম। বড় ভাই আমাকে প্রথম শ্রেণিতে বসিয়ে ওনি ওনার ক্লাশে চলে যান। আমি তখন সবার পিছনে গিয়ে বসলাম। আমাকে দেখে অন্য ছাত্ররা বলাবলি করছে ও নতুন আইছে। যথারীতি আমি বই খুলে পড়তে শুরু করলাম। শ্রেণি শিক্ষক মোতালিব স্যার ক্লাশে আসলেন। সবাই দাঁড়িয়ে সালাম দিল। আমিও সালাম দিলাম। স্যার খুবই রাগি। সবাই এই স্যারকে ভয় পায়। স্যার আমাকে নতুন দেখে বলল, এই ছেলে এদিকে আস।
আমি এগিয়ে গেলাম স্যারের দিকে। স্যার বলল, তোমার নাম কি?
আমি বললাম, আমির।
– আমির অর্থ কি জান?
– না স্যার।
– আমির মানে নেতা। তুমি যদি ভালো করে লেখাপড়া কর। ক্লাশে যদি রোল নং ১ হয় তাহলে এ ক্লাশের নেতা হতে পারবে। কি ভালো করে লেখাপড়া করবে?
– জি স্যার।
– বাড়ি কোথায়?
– ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
– এতদূর থেকে কার সাথে আসলে?
– আকবর ভাইয়ের সাথে।
– ও আচ্ছা।
– ঠিক আছে যাও। প্রতিদিন নিয়মিত মাদ্রাসায় আসবে।
– আচ্ছা স্যার। বলেই আমি আবার সবার পিছনে গিয়ে বসলাম।
আমার নামের অর্থ নেতা। ক্লাশের নেতা হওয়ার জন্য মোতালিব স্যারের কথায় সেদিন থেকেই আমি প্রতিজ্ঞা করলাম আমি ভালো করে লেখাপড়া করব এবং ক্লাশের নেতা হবো। তাই প্রতিদিন নিয়মিত মাদ্রাসায় আসতে লাগলাম। ক্লাশের ফার্স্ট বয় রায়হান আমাকে ভাল চোখে দেখত না। সে আমাকে অবজ্ঞা করে কথা বলত। আমি তাকে বলতাম দেখিস আমার রোল নং ১ হবে। আমার বড় ভাই আমাকে পড়ায়।
বড় ভাই আব্দুল আলী, মঞ্জুর আলী ও জমির আলীর সাথে আমাকেও পড়াতে শুরু করলেন। আমিও মনযোগ দিয়ে পড়ছি। প্রতিদিন আমি পড়া মুখস্থ করে মাদ্রাসায় যাই। ইতিমধ্যে আমি কয়েকজন হুজুর ও স্যারের নজরে পড়ে গেলাম। তখন থেকে সবাই আমাকে আদর করছে। বিশেষ করে যারা জেনেছে আমি আকবর এর ভোট ভাই তারাতো আমাকে আরো বেশি করে আদর করছে। তাঁরা আমার প্রশংসা করছে যে আমি এত ছোট হয়েও মা-বাবাকে ছেড়ে বড় ভাইয়ের সাথে লেখাপড়া করছি।
একদিন আমাদের শ্রেণি শিক্ষক মোতালিব স্যার বললেন, আমির তুমি আর পিছনে বসবে না। এখন থেকে সামনে বসবে। কিন্তু স্যারের কথা ফার্স্ট বয় রায়হান মানতে নারাজ। তার কথা সে ক্লাশের ফার্স্ট বয়। সে ছাড়া অন্য কেউ প্রথম বেঞ্চে বসতে পারবে না। এই নিয়ে আমার সাথে রায়হানের মারামারি হয়। স্যার এই খবর জানতে পেরে রায়হানকে বেত দিয়েছে। সেই থেকে রায়হান আমাকে শত্রুর মতো মনে করত। কোন কিছু জিজ্ঞাস করলে বলতনা। নিজেকে বেশি জ্ঞানী মনে করত।
একবার আলোচনা উঠলো ক্লাশের ফার্স্ট বয় রায়হানকে নিয়ে। সবাই বলাবলি করছে, ও খুব মেধাবী। ওকে ঠেকাতে কেউ পারবে না। আমরা যা পারি না ও না পড়লেও সব পেড়ে যায়।
সুমন বললো, আমারতো মনে হয় না ওকে কেউ পিছনে ফেলতে পারবে।
আরেকজন পিছন থেকে বলে উঠল, আমির ক্লাশের নতুন ছাত্র। সেও কিন্তু কম না। খুব মেধাবী। এই পর্যন্ত যতদিন ক্লাশে এসেছে ততদিন সে পড়া পেড়েছে। কোনদিন স্যারের পিটুনি খায়নি। ছাত্র হিসেবে খারাপ নয়। তা ছাড়া তার স্বভাব-চরিত্রও যথেষ্ট ভাল। সে প্রতিজ্ঞাও করেছে সে ক্লাশ টুতে ফার্স্ট বয় হবেই।
আরেকজন বললো, আসলে সবাই পাড়বে যদি সঠিক মনোবল, সুদৃঢ় আত্মবিশ্বাস ও পর্যাপ্ত পরিশ্রম করে। আমি কিন্তু আমিরের প্রতিভাকে অস্বীকার করছি না।
ততক্ষণে আমি বলে উঠলাম, বন্ধুরা তোমরা চিন্তা করবে না। যে রায়হান আমাকে দেখতে পারে না তাকে আমি বছর শেষে বার্ষিক পরীক্ষার পরই প্রমাণ করে দিব আমিও পারি।
রায়হান বলে উঠলো, পারবি না আমাকে ঠেকাতে। চ্যালেঞ্জ তোর সাথে।
আমি বললাম, ঠিক আছে তোর চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলাম।
দৃঢ় প্রতীজ্ঞা ও চ্যালেঞ্জ নিয়ে আমি এখন আগের চেয়ে পড়ায় বেশি মনোযোগি হলাম। দিন যায় রাত আসে এভাবে চলতে চলতে প্রথম সাময়িক পরীক্ষা চলে আসল। মে মাসের প্রথম সাপ্তাহে প্রথম সাময়িক পরীক্ষা শুরু হল। ক্লাশের সবাই দীর্ঘ চার মাস লেখাপড়া করেছে আর আমি মাত্র এক মাস লেখাপড়া করেছি। এমতাবস্থায় পরীক্ষা আরম্ভ হলো। পরীক্ষা দিলাম। কিছুদিন পর রেজাল্ট দিল। সবগুলো খাতার নম্বর যোগ করে দেখলাম। আমি রায়হানের চেয়ে ১০ নম্বরে পিছিড়ে রয়েছি।
শিক্ষক, ছাত্র/ছাত্রীরা সবাই আমার রেজাল্ট দেখে অবাক হয়ে গেল। এত অল্পদিনে কিভাবে আমি এত ভাল রেজাল্ট করতে পারলাম। সকল স্যার ও হুজুররা আমার জন্য দোয়া করল। তারপর থেকে আমি আরো দ্বিগুন উৎসাহ পেলাম। এদিকে আমার বড় ভাইয়ের ছাত্র আব্দুল আলী, জমির আলী ও মঞ্জুর আলীও মনযোগ দিয়ে পড়ছে। আমাদের চারজনের প্রতি বড়ভাইয়ের একটাই নির্দেশ অবশ্যই মনযোগ দিয়ে পড়তে হবে এবং ক্লাশের ফার্স্ট বয় হতেই হবে। এর কোন বিকল্প পথ খোলা নেই।
দেখতে দেখতে বার্ষিক পরীক্ষা চলে আসল। পরীক্ষা দিলাম। সব পরীক্ষা ভাল হয় আমার। যথারীতি পরীক্ষার রেজাল্ট বের হলে ক্লাসমেটসহ শিক্ষকবৃন্দ তো বটেই আমি নিজেও বেশ অবাক হয়ে গেলাম। রেজাল্ট ভাল হবে শুধু এতটুকুই জানতাম এবং আমি ক্লাশের ফার্স্ট বয় হব সবাই জানত কিন্তু এতটা ভালো রেজাল্ট হবে তা কল্পনাও করতে পারিনি। আমি সারা মাদ্রাসায় গড়ে সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছি। বাংলা, ইংরেজি, গণিত ও আরবি বিষয়ে মোট ৪০০ মার্কের পরীক্ষা হয়েছিল। সবগুলো বিষয়ে ১০০ থেকে ১০০ পেয়েছি। কিন্তু একশ থেকে একশ পাওয়ার বিধান ঐ মাদ্রাসায় না থাকায় প্রতি বিষয়ে ১ করে কম দিয়ে ৩৯৬ নম্বর প্রদান করে আমাকে। যা গড়ে ৯৯% হয়। গড়ে ৯৯% নম্বর একমাত্র আমিই পেয়েছি। আর আমাদের ক্লাশের রায়হান পেয়েছে মাত্র ৮০% নম্বর!
এদিকে আমার রেলাল্ট ভাল হওয়ার পাশাপাশি আরো জানলাম বড় ভাইসহ তার তিন ছাত্র আব্দুল আলী, জমির আলী ও মঞ্জুর আলীসহ সবাই যার যার ক্লাশে ফার্স্ট বয় হয়েছে। এই ঘটনায় মাদ্রাসার সুপার অবাক হয়ে যান যে, তা কি করে সম্ভব! সকল ছাত্রছাত্রী শিক্ষকবৃন্দ আমাদের প্রশংসা করতে লাগলেন।
তারপর থেকে আমি একনাগারে ক্লাশ টেন পর্যন্ত প্রতি ক্লাশে ফার্স্ট বয় ছিলাম। কেউ শত চেষ্টা করেও আমাকে আর পিছনে ফেলতে পারেনি। আমার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ও মনোবল আমাকে সামনের দিকে নিয়ে গেছে। আর অহংকারী রায়হান ক্লাশ ফাইভ পাস করার পর পড়াশুনা থেকে চিটকে পড়ল।

রচনাকাল- ২০/০৯/২০১৪খ্রি: