ট্যাগ আর্কাইভঃ দাউদের লেখালেখি

প্রয়াণের অষ্টম বার্ষিকীতে শিল্প সাহিত্যের জাদুকর হুমায়ুন আহমেদ…

আজ (১৯ জুলাই) বাংলার নন্দিত কথাশিল্পী ও চিত্রনির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী। দেখতে দেখতে কেটে গেল জন নন্দিত এই কথাশিল্পীর প্রয়াণের ছয় ছয়টি বছর। ২০১২ সালের আজকের এই দিনে ক্যান্সার চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি নিউইয়র্কের বেলভ্যু হাসপাতালে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান জোছনার গল্প কথক কিংবা হিমু-মিসির আলির এই স্রষ্টা। তার মৃত্যু শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বব্যাপী সব বাঙালির হৃদয়ে গভীর শোকের অন্ধকার ছড়িয়ে দিয়েছিল।

মাত্র ৬৪ বছরের জীবনে হুমায়ূন আহমেদ তাঁর কীর্তি রেখেছেন শিল্প-সাহিত্যর প্রায় প্রতিটি শাখা প্রশাখায়। বাংলা সাহিত্য, নাটক, চলচ্চিত্র ও গান পালাবদলের এ কারিগর ১৯৭২ সালে প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ দিয়ে নিজের অস্তিত্বের সাক্ষর রাখেন। তার ‘নন্দিত নরকে’ আর ‘শঙ্খনীল কারাগার’ পাঠ করে আবিষ্ট হয়েছিলেন, সেই আবেশ আজও কাটেনি বাংলা ভাষার পাঠকদের। তিনি তাঁর সাহিত্য দিয়ে মন্ত্রমুগ্ধ রেখেছেন বাংলার মানুষকে, তিনি জয় করে গেছেন একেবারে সাদামাটা বাঙ্গালীর মন কে, আবার উন্নত ঐশ্বর্যিক বাঙ্গালিয়ানাকে। নিজেকে তিনি যেভাবে বাংলা কথাসাহিত্যের অঙ্গনে, টেলিভিশন নাটক আর চলচ্চিত্রাঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন তা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক বিরল । তিনি এদেশের সৃজনশীল সাহিত্য প্রকাশনাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন বিপুল পাঠকপ্রিয়তা সৃষ্টির মাধ্যমে। ভারতীয় বাংলা গল্প, উপন্যাসে নিমগ্ন পাঠকদের বাংলাদেশি লেখকদের বই পড়তে বাধ্য করেছিলেন তার আশ্চর্য জাদুকরী গল্পের জালে জড়িয়ে। মোহাবিষ্ট পাঠক হুমায়ূন আহমেদের রচনায় মধ্যবিত্ত জীবনের হাসি-কান্নার এমন নিবিড় পরিচয় পেয়েছেন, যেখানে তাদের নিজেদেরই জীবনের ছবি প্রতিবিম্বিত। এক হুমায়ুন আহমেদের পথ ধরে এগিয়ে এসেছেন অসংখ্য প্রতিভা, অসংখ্য মানুষ তার হাত ধরে হয়েছেন অনন্য, একেবারে সাদামাটা মানুষকে তিনি বানিয়ে দিয়েছেন নন্দিত চিত্রতারকা!তাদের অনেকেই হয়েছেন জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত শিল্পী। আমরা তাঁর সৃষ্টিতে খুঁজে পাই অসাধারণ সব নৈপুণ্য, অনন্য নৈসর্গিক দৃশ্য, জোছনা, খুঁজে পাই আমাদের জীবনের নানান সব ব্যঞ্জনা।
হুমায়ূন আহমেদের অনন্য সৃষ্টি হিমু! সে এক অসাধারণ চরিত্রের নিরন্তর পথ চলা… এক ভিন্ন মেজাজ, ভিন্ন স্টাইল, ভিন্ন রঙ রূপ এর অপূর্ব সমন্বয়, যা আমাদের দেশের বেশিরভাগ তারুণ্য কে ছুঁইয়ে গেছে, আজো ছুঁইয়ে আছে আর আগামী দিনে একিই প্রভাব নিয়ে এই চরিত্রটি টিকে থাকবে।

এদেশে দর্শকনন্দিত নাটকগুলোর একটি বড় অংশ তার সৃষ্টি। তার ছায়াছবিও সমাদৃত হচ্ছে সমানভাবে। প্রয়াণের ছয় বছর পরও বাংলা শিল্প-সাহিত্যের বেশিরভাগ অংশ জুড়ে চলছে তাঁরই আধিপত্য, তারই রাজত্ব, তারই জয়জয়কার! এখনো সমান তালে সমান ছন্দে বিরাজ করছে হুমায়ুন প্রভাব যা রবীন্দ্র নজরুলের পর আর কেউই খাটাতে সক্ষম হয়নি। হুমায়ূন আহমেদ এর পুস্তুক প্রকাশকদের মতে তার নতুন বা পুরনো সব গ্রন্থই সর্বোচ্চ বিক্রিত বইয়ের তালিকায় স্থান করে নেয়। এই হিসেব মতে হুমায়ুন আহমেদ কে আধুনিক শিল্প সাহিত্যের রিদম বলা ভুল হবেনা।
বাংলা টেলিভিশনের জন্য একের পর এক দর্শকনন্দিত নাটক রচনার পর ১৯৯০-এর গোড়ার দিকে চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেন। তাঁর পরিচালনায় প্রথম চলচ্চিত্র ‘আগুনের পরশমণি’ মুক্তি পায় ১৯৯৪ সালে। ২০০০ সালে ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ ও ২০০১ সালে ‘দুই দুয়ারী’ দর্শকদের দারুণ গ্রহণযোগ্যতা পায়। ২০০৩-এ নির্মাণ করেন ‘চন্দ্রকথা’।
এছাড়া ১৯৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ২০০৪ সালে নির্মাণ করেন ছায়াছবি ‘শ্যামল ছায়া’ , ২০০৬ সালে ‘সেরা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র’ বিভাগে একাডেমী পুরস্কারের জন্য বাংলাদেশ থেকে যেটি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। এবং বেশ কিছু আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়। একিই বছর মুক্তি পায় ‘৯ নম্বর বিপদ সংকেত’। ২০০৮-এ ‘আমার আছে জল’ চলচ্চিত্রটি তিনি পরিচালনা করেন। ২০১২ সালে তাঁর পরিচালনার সর্বশেষ ছবি ‘ঘেটুপুত্র কমলা’ মুক্তি পায়। যা দেশ-বিদেশে প্রচুর আলোচনায় আসে। তাঁর চলচ্চিত্রের মৌলিক গানগুলো তিনি নিজেই রচনা করেন, যার বেশিরভাগই পায় তুমুল জনপ্রিয়তা।
১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার কুতুবপুরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জন্মগ্রহণ করেন হুমায়ূন আহমেদ। ডাক নাম কাজল। বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ ও মা আয়েশা ফয়েজের প্রথম সন্তান তিনি। বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। মা ছিলেন গৃহিণী। তিন ভাই দুই বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং জনপ্রিয় শিশুসাহিত্যিক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল তার ছোটভাই। সবার ছোট ভাই আহসান হাবীব নামকরা কার্টুনিস্ট ও রম্যলেখক।

তিনি ১৯৬৫ সালে বগুড়া জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক, ১৯৬৭ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক, ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন শাস্ত্রে স্নাতক ও ১৯৭২ সালে স্নাতকোত্তর পাশ করেন। ১৯৮২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটা ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি গ্রহণ করেন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। ৯০ দশকের মাঝামাঝি তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করে লেখালেখিতে পুরোপুরি মনোযোগ দেন।
১৯৭৩ সালে প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁর নাতনি গুলতেকিন খানের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন হুমায়ূন আহমেদ । হুমায়ূন এবং গুলতেকিন দম্পতির চার ছেলে-মেয়ে। তিন মেয়ে নোভা, শীলা ও বিপাশা আহমেদ এবং ছেলে নুহাশ হুমায়ূন। দীর্ঘ ৩২ বছরের দাম্পত্য জীবনের অবসান ঘটিয়ে ২০০৫ সালে ডিভোর্সের মাধ্যমে তারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। এরপর তিনি অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওনকে বিয়ে করেন। এ দম্পতির দুই ছেলে- নিষাদ ও নিনিত হুমায়ূন।

লেখকঃ দাউদুল ইসলাম
কবি ও প্রাবন্ধিক।

নিয়ত বা দৃষ্টিভঙ্গিই হচ্ছে আসল !…

নিয়ত বা দৃষ্টিভঙ্গিই হচ্ছে আসল !…

এর সাথে দ্বিমত পোষণ করার মত কেউ থাকলে আমি সর্বপ্রথম তাঁকে স্যালুট জানাই।
কারণ দৃষ্টিভঙ্গি যার যার কর্ম তার তার।

আপাত দৃষ্টিতে মসজিদ হচ্ছে উপাসনালয়, বিশ্বাসীরা একে আল্লাহর ঘর বলেন, কিন্তু অসংখ্য
মানুষ আছে যারা মসজিদ কে ব্যবহার করে সেখান কার টয়লেটের জন্য, তা না হলে দেখা যাবে সে কোন দিন মসজিদে প্রবেশ করার প্রয়োজন মনে করে না।
একজন মানুষ কে মানলে ভক্তি করলে বিশ্বাস করলে আপনার চোখে সে অনন্য !
যার একিই মানুষ কে যদি ভিন্ন চোখে দেখেন তাহলে দেখবেন সে-ই মানুষ টাই আপনার কাছে নগণ্য, হীন,নিচ! পৃথিবীতে হাজারো উদহারন আছে বাইজী নৃত্য থেকে তুলে এনে অনেক বহুচারনী কে স্ত্রী’র মর্যাদা দিয়েছেন ,তাও যেই সেই মর্যাদা না একেবারে রাজরানী করে ঘরে তুলেছেন অন্য এক
রাজা মহারাজা, সওদাগর, শিল্পী ……
আবার দেখা গেছে সম্ভ্রান্ত বনেদী পরিবারের কোন মেয়ে কে সামাজিক রীতি নীতি কিংবা সকল আনুষঙ্গিকতা মেনে সমমানের কোন ঘরে বৌ করে নিয়েছে; দু দিন যেতে না যেতে
সেই গৃহের পাটল ধরে, সেই পাটলে বিষাক্ত সর্প বসত বানায়…।

এমন দেখা গেছে সেই বনেদী গৃহের কন্যা আপন গৃহে কয়েদী নয়তো পলক পেলার আগেই
অনায়াসে ভনে গেছে বাইজী পাড়ার রক্ষিতা। পুরুষদের বেলায় ও একি উদাহরণ রয়েছে ভুরি ভুরি
কেউ আছে নারীর সংস্পর্শে নিজেকে মানুষের মত মানুষ বানাতে সক্ষম হয়েছে, আবার কারো জীবন তুষের আগুনের মত অঙ্গার হয়ে আছে, না পারে নেভাতে না পারে জ্বালাতে। এই সব কিছুর অন্তরায় যে বিষয় টি কাজ করে সেটাই হচ্ছে দৃষ্টিভঙ্গি , নিয়ত।
ভালবাসা হচ্ছে সেই দৃষ্টিভঙ্গির মূল শক্তি! নিয়ত আর ভালোবাসা একে অপরের পরিপূরক।

কোন কোন ক্ষেত্রে আমরা যে কাউকেই ইচ্ছা করলে এক মুহূর্তে পর বানিয়ে পেলতে পারি, কিন্তু এক জীবনেও কাউকে আপন করতে সক্ষম হই না। একটা সালাম দু ভাবে দেয়া যায়-
এক- আন্তরিকতার সঙ্গে ভক্তি
আরেক- হচ্ছে ভয়ের সাথে দায়িত্ব!
আবার অনেক কে খুব কড়া করে গালি দেয়া হলেও সেখানে ঘৃণা থাকে নাম ক্ষোভ থাকেনা লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এক টা নিবিড় দাবী, অধিকার, কিংবা এক ধরনের শুভ কামনা কাজ করে সেই গালিতে।
আবার
এমন ও অনেক আছে গালি দিতে হয় না- সাধারণ কোন বাক্যতেই গালি হার মানে। কারণ সেখানে ক্ষোভ থাকে ঘৃণা থাকে।

কোন মানুষ এর মুখে একটু হাসি ফোটানোর জন্য কেউ আছে জীবন ভাজি রাখতে পারে, অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি যে যার জন্য এমন জীবন বাজি অনেক ক্ষেত্রে সে-ই অবলীলায় তাকে পাগল বলে , অথবা রহস্যের গন্ধ খোঁজে কোন কোন ক্ষেত্রে নাটক বা আরো জঘন্য মন্তব্য করতেও দ্বিধা বোধ করে না।

পক্ষান্তরে- এমন ও দেখা যায় যার মনে বক্রের মত চালাকির জাল বিস্তৃত , যাক মনে অতীত কিংবা বর্তমান কোন কালেই এত টুকু সৃজন বোধ ছিলো না সম্মান ছিলো না সেই মুখোশের মানুষ টি অবলীলায় প্রিয় হয়ে উঠে। এই জন্যই –
কোথায় যেন শুনেছিলাম- ” কোন ভাল- নেক বান্দা কে খারাপ বা মন্দ বানানো খুব সহজ, কিন্তু যেসব খারাপ মন্দ মানুষ গুলো ভালোমানুষের অভিনয় করে তাদের কখনো খারাপ বা মন্দ বানানো সম্ভব নয়”

জীবনের বাঁকে বাঁকে আমাদের হাজারো ঘটনা ঘটে যাচ্ছে প্রতি নিয়ত-
কোন টা ইতিবাচক কোন টা নেতিবাচক; আবার কোন কোন ঘটনার রূপ এমন যে আপনি নির্ধারণ করতেই পারবেন না ঘটনা টা নেতিবাচক না কি ইতিবাচক! আর সততা এখানেই মার খায়। বাস্তবতা এখানেই ফেঁসে যায়।

সে যাই হোক এসব তাত্ত্বিক কথা কেউ পড়বে না জনি
পড়লেও মনে মনে হুম বলবে অথবা আড়চোখে প্রোফাইলে থাকা পিকের দিকে তাকাবে আর মনে মনে বলবে” ক ত দে খ লা ম, আর কত দেখব…………

হুম বন্ধু গন
আমি আপনাদের জ্ঞান দিতে আসি নি
সত্য বলতে কি জ্ঞান বা বিবেকের বড্ড অভাব আমার।
ব্যক্তিগত ভাবে আমি অনেক নিচু তলার একজন, ঠিক যেমন রাজধানীর আকাশ চুম্বী ভবনের পাশে ঝুপড়ি তে থাকা কিছু জীবন নিজেদের মানুষ বলে যারা জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে নিভৃতে- নীরবে। রাজধানীর উদহারন টা এই জন্য দিলাম কারণ সেই আকাশ চুম্বী অট্টালিকায় আলিশান ভবনের মানুষ গুলো রাজধানীতে থাকে , আবার একিই ভবনের নিচে ব্যঙ্গের ছাতার মত গড়ে উঠা ঝুপড়িতে থাকা মানুষ গুলোও রাজধানীতে থাকে-
ঠিক এমন সামাজিক ওয়েব সাইড ফেস বুকের মত।
এখানে অনেক বড় মাপের মানুষ, সত্যিকারের মানুষ, ইমানদার, বিশ্বাসী, দয়ালু, ধনী গরীব, লুচ্চা বদমাশ , ভণ্ড, বেশ্যা, দালাল সবাই থাকে। তবে আমি সেই দিক থেকে ভাগ্যবান যে
মানুষ হিসেবে এত ক্ষুদ্র বা নগণ্য হয়েও ফেসবুকের বদৌলতে, ব্লগের বদৌলতে সমাজের অনেক নামী দামী, অনেক বুজুর্গ, অনেক সম্মানী ব্যক্তিত্বের বন্ধু( ফেসবুক বন্ধু) হতে পেরেছি।

আমার বন্ধু তালিকায় বেশীর ভাগই সুনাম অর্জন কারী লেখক, কবি, চিত্র গ্রাহক, ডাক্তার, আইন জীবী, ইত্যাদি সু প্রতিষ্ঠিত মানুষ। আমি যাদের সব সময় আন্তরিক ভাবে সম্মান করে এসেছি, ভালো মন্তব্য করার চেষ্টা করে এসেছি। আলহামদুলিল্লাহ!
এদের অনেকের সাথে এক বেলা খাবার খাওয়ার সুযোগ হয়েছে, অনেক এর সাথে এক বেলা সঙ্গ দেয়া, কারো কারো বাড়ী তে বেড়িয়ে এসেছি, খেয়ে এসেছি
আবার কারো কারো সঙ্গে পারিবারিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে ,কারো কারো সাথে আরেকটু গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। আসলে মানুষ সারা জীবনই সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ, তবু কেউ কেই আছেন যারা এই সম্পর্কের নাজায়েজ ফায়দা লুটে, বন্ধন ও বিশ্বাসের পুঁজি করে চাল চতুরি করে, তাদের কাছে পরিবার ( বাবা, মা, ভাই, বোন, স্ত্রী, সন্তান)গুরুত্বপূর্ণ নয়। অথবা সামাজিক অবস্থান ও জরুরী নয়। তারা যে কোন সময় যে কোন কাজ করতে পারে, বেঈমান বা অকৃতজ্ঞ হতে পারে!

কিন্তু আমি সব সময় শোকর গোজার মানুষ!সম্প্রীতি আর সম্মানের সাথে ভালবেসে যাওয়া আমার চেতনার অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাছাড়া স্রষ্টাতো রয়েছেন। তাঁর উপর আমার পূর্ণ আস্থা বিশ্বাস রয়েছে।

– দাউদুল ইসলাম
(কবি ও প্রাবন্ধিক)

৫১ তম মৃত্যু বার্ষিকী মহান বিপ্লবী চে’গুয়েভারা কে লাল সালাম

১৯৬৭ সালে আজকের দিনটিতে নিরস্ত্র অবস্থায় নয়টি গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল বন্দী চে গুয়েভারাকে। সেই নয়টি গুলিতে মারা যায়নি চে’র মতবাদ। আজন্ম বিপ্লবী চে-স্মরণে এই আয়োজন —–

#চে’র সংক্ষিপ্ত জীবন বৃত্তান্তঃ
এর্নেস্তো “চে” গুয়েভারা (স্পেনীয়: tʃe geˈβaɾa চে গেবারা) (১৪ জুন,

[১] ১৯২৮ – ৯ অক্টোবর, ১৯৬৭) ছিলেন একজন আর্জেন্টিনীয় মার্ক্সবাদী, বিপ্লবী, চিকিৎসক, লেখক, বুদ্ধিজীবী, গেরিলা নেতা, কূটনীতিবিদ, সামরিক তত্ত্ববিদ এবং কিউবার বিপ্লবের প্রধান ব্যক্তিত্ব। তাঁর প্রকৃত নাম ছিল এর্নেস্তো গেবারা দে লা সের্না (স্পেনীয়: Ernesto Guevara de la Serna)। তবে তিনি সারা বিশ্ব লা চে বা কেবলমাত্র চে নামেই পরিচিত। মৃত্যুর পর তাঁর শৈল্পিক মুখচিত্রটি একটি সর্বজনীন প্রতিসাংস্কৃতিক প্রতীক এবং এক জনপ্রিয় সংস্কৃতির বিশ্বপ্রতীকে পরিণত হয়।

[২] তরুণ বয়সে ডাক্তারি ছাত্র হিসেবে চে সমগ্র লাতিন আমেরিকা ভ্রমণ করেছিলেন। এই সময় এই সব অঞ্চলের সর্বব্যাপী দারিদ্র্য তাঁর মনে গভীর রেখাপাত করে।

[৩] এই ভ্রমণকালে তাঁর অর্জিত অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে এই অঞ্চলে বদ্ধমূল অর্থনৈতিক বৈষম্যের স্বাভাবিক কারণ হল একচেটিয়া পুঁজিবাদ, নব্য ঔপনিবেশিকতাবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ; এবং এর একমাত্র সমাধান হল বিশ্ব বিপ্লব।

[৪] এই বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে চে রাষ্ট্রপতি জাকোবো আরবেনজ গুজমানের নেতৃত্বাধীন গুয়াতেমালার সামাজিক সংস্কার আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৫৪ সালে সিআইএ-এর ছকে গুজমানকে ক্ষমতাচ্যুত করা হলে চে-র বিপ্লবাত্মক আদর্শ আরও বদ্ধমূল হয়। পরবর্তীকালে মেক্সিকো সিটিতে বসবাসের সময় তাঁর সঙ্গে রাউল ও ফিদেল কাস্ত্রোর আলাপ হয়। চে তাঁদের ছাব্বিশে জুলাই আন্দোলনে যোগ দেন। মার্কিন-মদতপুষ্ট কিউবান একনায়ক ফুলজেনসিও বাতিস্তাকে উৎখাত করার জন্য গ্রানমায় চড়ে সমুদ্রপথে কিউবায় প্রবেশ করেন।

[৫] অনতিবিলম্বেই চে বিপ্লবী সংঘের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। সেকেন্ড-ইন-কম্যান্ড পদে তাঁর পদোন্নতি হয় এবং বাতিস্তা সরকারকে উৎখাত করার লক্ষ্যে দুই বছর ধরে চলা গেরিলা সংগ্রামের সাফল্যের ক্ষেত্রে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

[৬] কিউবার বিপ্লবের পর চে নতুন সরকারে একাধিক ভূমিকা পালন করেছিলেন। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য, বিপ্লবী আদালতে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্তদের আপিল পুনর্বিবেচনা ও ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড প্রদান।

[৭] শিল্পোদ্যোগ মন্ত্রী হিসেবে খামার সংস্কার আইন প্রবর্তন, কিউবার জাতীয় ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ও সামরিক বাহিনীর ইনস্ট্রাকশনাল ডিরেক্টরের ভূমিকা পালন, এবং কিউবান সমাজতন্ত্রের প্রচারে বিশ্বপর্যটন। এই পদাধিকারের কল্যাণে তিনি মিলিশিয়া বাহিনীকে প্রশিক্ষণ প্রদানের সুযোগ পান; ফলত এই বাহিনী পিগ উপসাগর আক্রমণ করে তা পুনর্দখলে সক্ষম হয়।

[৮] কিউবায় সোভিয়েত পরমাণু ব্যাসিলিস্টিক মিশাইল আনার ক্ষেত্রেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।

[৯] চে ছিলেন এক বিশিষ্ট লেখক ও ডায়েরি-লেখক। গেরিলা যুদ্ধের উপর তিনি একটি প্রভাবশালী ম্যানুয়েল রচনা করেন। তরুণ বয়সে দক্ষিণ আফ্রিকায় মোটরসাইকেলে ভ্রমণের স্মৃতিকথাটিও তাঁর অত্যন্ত জনপ্রিয় রচনা। বৃহত্তর বিপ্লবে অংশ নেওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি ১৯৬৫ সালে কিউবা ত্যাগ করেন। প্রথমে কঙ্গো-কিনসহাসায় তাঁর বিপ্লব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এরপর তিনি বলিভিয়ায় বিপ্লবে অংশ নেন। এখানেই সিআইএ-মদতপুষ্ট বলিভিয়ান সেনার হাতে বন্দী ও নিহত হন চে।

[১০] চে গুয়েভারা একাধারে ইতিহাসের এক নন্দিত ও নিন্দিত চরিত্র। বিভিন্ন জীবনী, স্মৃতিকথা, প্রবন্ধ, তথ্যচিত্র, গান ও চলচ্চিত্রে তাঁর চরিত্রের নানা দিক ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। টাইম পত্রিকার বিংশ শতাব্দীর সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী ১০০ জন ব্যক্তির তালিকায় তাঁর নাম প্রকাশিত হয়।

[১১] আবার গেরিলেরো হেরোইকো নামে আলবের্তো কোর্দার তোলা চে-র বিখ্যাত ফটোগ্রাফটিকে “বিশ্বের সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ ফটোগ্রাফ” হিসেবে ঘোষিত।

#গুয়েভারার প্রতি -সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়
আমার ঠোঁট শুকনো হয়ে আসে, বুকের ভেতরটা ফাঁকা
আত্মায় অভিশ্রান্ত বৃষ্টিপতনের শব্দশৈশব থেকে বিষণ্ন দীর্ঘশ্বাস
চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরধী করে দেয়-
বোলিভিয়ার জঙ্গলে নীল প্যান্টালুন পরা
তোমার ছিন্নভিন্ন শরীর
তোমার খোলা বুকের মধ্যখান দিয়ে
নেমে গেছে
শুকনো রক্তের রেখা
চোখ দুটি চেয়ে আছে
সেই দৃষ্টি এক গোলার্ধ
থেকে চুটে আসে অন্য গোলার্ধেচে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়।

শৈশব থেকে মধ্য যৌবন পর্যন্ত দীর্ঘ দৃষ্টিপাত
আমারও কথা ছিল হাতিয়ার নিয়ে তোমার পাশে দাঁড়াবার
আমারও কথা ছিল জঙ্গলে কাদায় পাথরের গুহায়
লুকিয়ে থেকে
সংগ্রামের চরম মুহূর্তটির জন্য প্রস্তুত হওয়ার
আমারও কথা ছিল রাইফেলের কুঁদো বুকে চেপে প্রবল হুঙ্কারে
ছুটে যাওয়ার
আমারও কথা ছিল ছিন্নভিন্ন লাশ ও গরম রক্তের ফোয়ারার মধ্যে
বিজয়-সঙ্গীত শোনাবার-কিন্তু আমার অনবরত দেরি হয়ে যাচ্ছে!
এতকাল আমি এক, আমি অপমান সয়ে মুখ নিচু করেছি
কিন্তু আমি হেরে যাই নি, আমি মেনে নিই নি
আমি ট্রেনের জানলার পাশে, নদীর নির্জন রাস্তায়, ফাঁকা
মাঠের আলপথে, শ্মশানতলায়
আকাশের কাছে, বৃষ্টির কাছে বৃক্ষের কাছে,
হঠাৎ-ওঠাঘূর্ণি ধুলোর ঝড়ের কাছে
আমার শপথ শুনিয়েছি, আমি প্রস্তুত হচ্ছি, আমি
সব কিছুর নিজস্ব প্রতিশোধ নেবো
আমি আমার ফিরে আসবো
আমার হাতিয়অরহীন হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়েছে, শক্ত হয়েছে চোয়াল,
মনে মনে বারবার বলেছি, ফিরে আসবো!

চে, তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়-
আমি এখনও প্রস্তুত হতে পারি নি, আমার অনবরত
দেরি হয়ে যাচ্ছে
আমি এখনও সুড়ঙ্গের মধ্যে আধো-আলো ছায়ার দিকে রয়ে গেছি,
আমার দেরি হয়ে যাচ্ছেচে,
তোমার মৃত্যু আমাকে অপরাধী করে দেয়!

চে গুয়েভারার প্রতি (#দাউদুল ইসলাম) আমার নিবেদন-

থম থমে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন
বাতাসে ক্ষুধার্তের দীর্ঘশ্বাস
একটি বজ্রপাত সারাদুনিয়া কম্পিত
একটি আর্তনাদ বিদ্যুৎ চমকিত;
একটি কলম বন্দুকের মত সরব গর্জন,
নিরবে নিরবে ছড়িয়ে পড়ে পরম ধর্ম
ঘরে ঘরে জন্ম নে যার আলোকরশ্মি
এসো ফিরে ফিরে
এসো হে চেতনা; এসো নতুন উল্লাসে
হে চে’গুয়েভারা
হে বিপ্লবের পরম্পরা
কলম হাতে নয় বন্দুকের পবিত্র পল্লবে
আজ যে তোমার বড্ড প্রয়োজন
শীতের কনকনে ঠান্ডা
কুয়াশাচ্ছন্ন মাঠে তোমার অগ্নিঝরা বক্তৃতা
রাত্রির ঘাঢ় অন্ধকারে ঢাকা ঘুমন্ত পৃথিবী
দূর্গম পথ পেরিয়ে তোমার দুরন্ত চলাচল
মায়ের বুকে গুজে থাকা শিশুর কান্নার বদলে ক্রোধ
ওরে চে এ’যে সাম্রাজ্যবাদের প্রথম পরাজয়
তুমি আর একবার জ্বালাও সেই চুরুট
আর একবার উঠে বস সেই ঘোড়ায়
আর একবার চুটে চলো অরণ্যে-পথে প্রান্তরে;
আর একবার জাগাও বিপ্লব
আমরা আছি সেই অপেক্ষায় প্রতিটি অহর্নিশ ভরে।

লেখক #দাউদুল ইসলাম (কবি ও প্রাবন্ধিক)

৭৮তম জন্মদিনের শুভেচ্ছা … শুভ জন্মদিন স্যার আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ একজন শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, সুবক্তাসহ বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এক গুণীজন। বাংলাদেশের বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী একজন সমাজসংস্কারক। শিক্ষক হিসেবে তার খ্যাতি কিংবদন্তিতুল্য। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র তার জীবনের শ্রেষ্ঠ কীর্তি যার মাধ্যমে গত চার দশক ধরে ‘আলোকিত মানুষ চাই’ আন্দোলনের পুরোধা-র ভূমিকা তিনি পালন করছেন। তিনি ষাট দশকের একজন প্রতিশ্রুতিময় কবি হিসেবে পরিচিত। সে সময় সমালোচক এবং সাহিত্য সম্পাদক হিসাবেও তিনি অনবদ্য অবদান রেখেছিলেন। সাহিত্যে অবদানের জন্যে লাভ করেছেন র‍্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার, একুশে পদক ও বাংলা একাডেমী পুরস্কার। আজ স্যারের ৭৮তম জন্ম দিন।

১৯৩৯ সালে কলকাতার পার্ক সার্কাসে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস বাগেরহাট জেলার কচুয়া উপজেলার অন্তর্গত কামারগাতি গ্রামে। তাঁর পিতা আযীমউদ্দিন আহমদ ছিলেন একজন স্বনামধন্য শিক্ষক। পিতার শিক্ষক হিসেবে অসামান্য সাফল্য ও জনপ্রিয়তা শৈশবেই তাকে শিক্ষকতা পেশার প্রতি আকৃষ্ট করে।

স্যার আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ শিক্ষক হিসেবে জনপ্রিয়তার সর্বোচ্চ শিখর স্পর্শ করেছেন। অধ্যাপক হিসেবে তাঁর খ্যাতি কিংবদন্তিতুল্য। তিনি শিক্ষকতা জীবন শুরু করেন ১৯৬১ সালে, মুন্সীগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজে খণ্ডকালীন প্রভাষক হিসেবে। পরবর্তীতে তিনি কিছুকাল সিলেট মহিলা কলেজে শিক্ষকতা করেন। ১৯৬২ সালের পহেলা এপ্রিল তিনি রাজশাহী কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে সরকারি চাকুরি জীবন শুরু করেন। সেখানে পাঁচ মাস শিক্ষকতা করার পর তিনি ঢাকায় ইন্টারমিডিয়েট টেকনিক্যাল কলেজে যোগ দেন (বর্তমানে সরকারি বিজ্ঞান কলেজ)। এই কলেজে তিনি দু’ বছর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র তেইশ। এরপর তিনি বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কলেজ ঢাকা কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ জালালউদ্দিন আহমেদের আমন্ত্রণে সেখানে যোগদান করেন। ঢাকা কলেজেই তিনি তাঁর শিক্ষকতা জীবনের স্বর্ণযুগ অতিবাহিত করেন। সে সময় ঢাকা কলেজ ছিল দেশসেরা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মিলনস্থল। অধ্যাপক আবু সায়ীদ যখন ঢাকা কলেজে যোগ দেন তখন কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান ছিলেন বাংলা সাহিত্যের শক্তিমান কথাসাহিত্যিক ও গদ্য লেখক শওকত ওসমান৷ ঢাকা কলেজের শিক্ষকতা জীবন তিনি অত্যন্ত উপভোগ করতেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন-

ছেলেবেলায়, স্কুল থেকে কলেজে উঠে, অর্থনীতির বইয়ে পড়েছিলাম কেন একজন শিল্পপতি, কন্ট্রাক্টর বা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের নির্বাহীর চেয়ে একজন শিক্ষকের বেতন কম৷ যুক্তি হিসেবে সেখানে বলা ছিল একজন শিক্ষকের জীবন কাটে মার্জিত, পরিশীলিত পরিবেশে, বৈদগ্ধময় ব্যক্তিদের সাহচর্যে, উচ্চতর জীবনচর্চার অবকাশময় আনন্দে৷ জীবনের সেই মর্যাদা, তৃপ্তি বা শান্তি ঐ ব্যবসায়ী বা নির্বাহীর জীবনে নেই৷ এই বাড়তি প্রাপ্তির মূল্য দিতে শিক্ষকের আয় তাদের তুলনায় হয় কম৷ ঢাকা কলেজের শিক্ষকতায় ঐ তৃপ্তি আমার এত অপরিমেয় হয়েছিল যে কেবল বেতন কম হওয়া নয়, আমার জন্য হয়ত বেতন না-থাকাই উচিত হত৷ এই পাওয়া যে কতটা তা বুঝেছিলাম কিছুদিনের জন্য অন্য কলেজে গিয়ে৷

তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করবার সুযোগ পেয়েছিলেন, কিন্তু ঢাকা কলেজে প্রাণবন্ত, সপ্রতিভ, উজ্জ্বল ছাত্রদের পড়ানোর তৃপ্তি, শিক্ষক-জীবনের অনির্বচনীয়তম আস্বাদ ছেড়ে তিনি যেতে চাননি ৷তাঁর মতে, বাংলা বিভাগে যোগদান করাটা আমার কাছে সবচেয়ে ভালো ছাত্রদের ছেড়ে সবচেয়ে খারাপ ছাত্রদের পড়াতে যাওয়ার মত মনে হয়েছে।

অধ্যাপক আবু সায়ীদ কখনোই ক্লাসে রোলকল করতেন না। রোলকলকে তার কাছে মনে হতো সময়ের অপব্যয়। তাই বছরের পয়লা ক্লাসেই ঘোষণা করে দিতেন রোলকল না করার ৷ তিনি বলেন, অনিচ্ছুক হৃদয়কে ক্লাশে জোর করে বসিয়ে রেখে কী করব? আমার চ্যালেঞ্জ ছিল এক ধাপ বেশি: কেবল শিক্ষক হওয়া নয়, সব ছাত্রের হৃদয়ের কাছে পৌঁছানো, সব ছাত্রের হৃদয়কে আপ্লুত করা।

ক্লাশের সেরা ছাত্রটাকে পড়ানোর চেষ্টা করার চেয়ে তিনি পড়াতে চেষ্টা করতেন ক্লাশের সবচেয়ে বোকা ছাত্রটাকে। সারাক্ষণ তাকেই বোঝাবার চেষ্টা করতেন, কেননা তার বোঝা মানে ক্লাসের বাকি সবার বোঝা।

স্যারের এরকম আরো অনেক মন্তব্য ও উক্তি রয়েছে যা আসলে একজন মানুষ কে অনায়েষে নাড়িয়ে দিতে পারে, যেমন – “আমি যদি উন্নত জাতের হাস মুরগী পালন, গোখামার তৈরি, এ ধরণের কাজগুলো করতাম তাহলে এতদিনে কত টাকা যে কামিয়ে ফেলতাম। কিন্তু পড়লাম মানুষের উন্নতি নিয়ে- আলোকিত মানুষ। (হেসে) না বুঝি নিজে না পারি অন্যকে বোঝাতে।”
“বুদ্ধিজীবীরা আবার আমাকে বুদ্ধিজীবী মনে করেনা, কারণ আমি হাসি। বিদ্যাবুদ্ধি তো আর কারো চেয়ে কম ছিলনা, শুধু ওই একটা জায়গাতে মার খেয়ে গেলাম, আমার হাসি। হাসলে পরে তুমি আর বুদ্ধিজীবী থাকতে পারবেনা। আপনি হাসেন? তারমানে তো আপনি লাইট!”
“কিন্তু সুন্দর মুহূর্তগুলো আমরা মনে রাখিনা, ভুলে যাই। কে ১০০ দিন রসগোল্লা খাইয়েছিল সেটা আমরা মনে রাখিনা, কিন্তু কে একদিন কান মুচড়ে দিয়েছিল তা মনে রেখে দিয়েছি।”
“আসলে জীবন ছোট নয়, আমাদের সুখের মুহূর্তগুলো ছোট। তাছাড়া জীবন ছোট মনে হওয়ার কারণ হচ্ছে স্মৃতির অভাব। আমরা কখনো বর্তমানে থাকিনা, হয় থাকি ভবিষ্যতে, নাহয় অতীতে। আমরা পাওয়াকে ভুলে যাই বলেই মনে হয় কিছুই পাই নাই। ইত্যাদি…

স্যারের একটি বইএর প্রকাশনা অনুষ্ঠানের কথা মনে পড়ছে। “ভাঙো দুর্দশার চক্র” গ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে স্যারের দে বক্তব্য টি কোয়ান্টাম মেথড ওয়েব সাইড থেকে কপি কর দে হয়েছে-
প্রতিদিনই বহু মানুষ আমাদের দেশ থেকে স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে অন্যান্য দেশে স্থানান্তরিত হচ্ছেন। কিন্তু আমার ধারণা, কোনো মানুষের মধ্যে যদি আলো, শক্তি, প্রতিভা থাকে; তিনি কখনই দেশত্যাগ করেন না। আর করলেও ফিরে আসেন। ফজলে হাসান আবেদ, হুমায়ূন আহমেদ, জাফর ইকবাল; ওনারাও দেশ ছেড়েছিলেন। কিন্তু আবার ফিরেও এসেছেন। তারা অনুভব করতে পেরেছিলেন; তাদের আত্মার যে-আনন্দ, জীবনের যে-পরিচয়; সেটা তাদের মাতৃভূমি।
বিদেশে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে কোনো বড় কাজ করা খুবই কঠিন। আমাদের অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী, আজকের অনুষ্ঠানের যিনি প্রধান অতিথি বিদেশে অনেক সুযোগ পেয়েছিলেন। ইচ্ছে করলেই তিনি সাফল্য অর্জন করতে পারতেন। কিন্তু সেটাকে প্রত্যাখ্যান করে এই গরীব দেশটাকে ভালবেসেছেন। এই দেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণের চেষ্টায় নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। তিনি খুবই অসাধারণ একজন মানুষ। আরো আগেই তাকে আমার বই উৎসর্গ করা উচিৎ ছিল। আমি তাকে কোনো একটি বই উৎসর্গ করতে এত দেরি করায় লজ্জিত ও সংকুচিত বোধ করছি।

একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে আমাদের দেশে যে, নেই দেশে ভ্যারেন্ডা বৃক্ষ। একটি গাছ যতটা বিস্বাদ হওয়া সম্ভব, ঠিক ততটাই বিস্বাদ; এই ভ্যারেন্ডা গাছ। সেজন্যেই অবণীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন; ভ্যারেন্ডা গাছ কি কেউ খায়? খায় না। কিন্তু আখ গাছ খায় কেন? কারণ, ভ্যারেন্ডা গাছের মধ্যে স্বাদ নেই কিন্তু আখ গাছের মধ্যে মাধুর্য আছে। মানুষ সেখানেই যাবে, যেখানে সে মাধুর্য পাবে। যে-দেশে কিছুই নেই, সে-দেশে এতটুকু একটি গাছও বৃক্ষ। আমরা হচ্ছি সেই ধরনের ভ্যারেন্ডা।

আমাদের জাতির মধ্যে অসম্ভব মেধা ও কর্মোদ্দম আছে। তারা এই দেশকে অনেক উপরে নিয়ে যাবে। আরো অনেক বড় বড় মানুষেরা আসবেন। এ দেশ পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দেশে পরিণত হবে। এটা আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি।

গ্রামের দিকে একটা কথা আছে যে, ভিক্ষুকের পায়ে লক্ষ্মী। ভিক্ষা পেতে হলে, হাঁটতে হবে। যে-যত হাঁটবে, তার ভিক্ষা তত বেশি। এটা সাধারণ হিসাব। আমাদের করণীয় একটাই। সেটা হলো জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত কাজ করে যেতে হবে। আমরা কেউই চিরদিন বাঁচব না। কিন্তু যতদিন বাঁচব, আমার একটাই কাজ; আমার এই জীবনকে তার সর্বোচ্চ মহিমা দান করা। সেটা আমাদের সবাইকে করতে হবে। তাহলেই আমরা অশান্তি, দুঃখ, হতাশা ও নৈরাশ্যের হাত থেকে বাঁচতে পারব। একটি আনন্দময় জীবন শেষ করে এই পৃথিবী থেকে চলে যাব।

একটা গাড়ি পাহাড় বেয়ে উপরে উঠার সময় আপনি বলবেন, গাড়িটি উঠছে বা উপরে যাচ্ছে অর্থাৎ উত্থান হচ্ছে। কিন্তু গাড়িটি পাহাড় থেকে নিচে নামার সময় বলতে পারবেন না যে, পতন হচ্ছে। গাড়িটি নিচের দিকে নামলেও তার চাকাটা সামনের দিকে যাচ্ছে। তাহলে তো সে সামনের দিকে এগোচ্ছে। আপাত দৃষ্টিতে যাকে আমরা নৈরাশ্য বা পতন মনে করছি, সেটা আসলে উত্থান। সুতরাং আমরা চিরদিনই উত্থানের মধ্যে আছি। পতন, হতাশা বা নৈরাশ্য বলে কিছু নেই। এগুলো আমাদের মাথার অলীক কল্পনা দিয়ে তৈরি করা বিভ্রম।

দুঃখ-কষ্ট, মৃত্যু আছে কিন্তু কোনোটিই স্থায়ী নয়; সাময়িক। এগুলোকে অতিক্রম করতে হবে। আমি যতবড় আশাবাদীই হই। কেউ ভীষণভাবে আঘাত করলে, আমার অজান্তেই আমার ভেতর থেকে একটা আর্তনাদ শোনা যাবে। কিন্তু সে আর্তনাদই শেষ কথা নয়। কাজ, সংগ্রাম, শ্রম আর আক্রমণের মধ্যেই আমাদের জীবন। আমাদের অনেক দুঃখের কারণ হচ্ছে আশাহীনতা। বাইবেলে একটা কথা আছে, “And whosoever liveth and believeth in me shall never die” যে বিশ্বাস করবে সে বেঁচে থাকবে; সে মরবেনা। বিশ্বাস আর আশাটা যেন সবার মধ্যে থাকে। নৈরাশ্য বলতে কিছু নেই। আমি এই কথাটাই সবাইকে বলব যে, নৈরাশ্যের মত অনস্তিত্বশীল বিভ্রমে বিশ্বাসী হবেন না। এটা আশারই অন্যরূপ মাত্র।

আসলে স্যার কখনোই বন্দিত্ব সহ্য করেন নি। তিনি যেমন উদার তেমনিই মুক্ত, স্বাধীন চেতনার মানুষ। “ভাঙো দুর্দশার চক্র” গ্রন্থের পরতে পরতে সেই বক্তব্যই স্পষ্ট করা হয়েছে।

স্যার সব সময় আত্মমর্যাদা , আত্মসম্মান কে প্রাধান্য দিয়েছেন নিচের উক্তি থেকেই তা অনুভব করা যায়, যেমন- “আমাদের দেশে সবাই একটা ‘পা’ চায়, পায়ের নিচে পড়ে থাকতে চায়।”
“আমি বলি, সম্মান করতে হলে মাথা উঁচু করে কর। তুমি তো নিজেকে ধ্বংস করে ফেলছ। আর যে নিজেকে ধ্বংস করে দিচ্ছে তাকে দোয়া করেই কি লাভ, দয়া করেই কি লাভ।”
“শক্তিমান মানুষের পরিচয় হচ্ছে বাড়াবাড়িতে। এই যে তোমার আশেপাশে এত সমস্যা, এত কিছু হচ্ছে। কই তোমার তো কোন বাড়াবাড়ি দেখিনা।”

আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের জন্মই হয়েছে জাতিকে বাড়িয়ে নেয়ার এগয়ে নেয়ার জন্য, দুর্দশার বৃত্ত ভাঙ্গার জন্য ! এইযে আলকিত মানুষ চাই আন্দোলন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মাধ্যমে ১৯৭৮ সালে যার জন্ম। স্যার আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সবার আগে অনুভব করেছেন যে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে আমাদের প্রয়োজন অসংখ্য উচ্চায়ত মানুষ। আলোকিত মানুষ চাই- সারা দেশে এই আন্দোলনের অগ্রযাত্রী হিসেবে প্রায় তিন দশক ধরে তিনি রয়েছেন সংগ্রামশীল। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র গড়ে উঠেছে একটু একটু করে, অনেক দিনে। এই দীর্ঘ সময়ে বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মুখে নানা উথথান পতনের মধ্য দিয়ে তাঁকে এগোতে হয়েছে। মূলতঃ দেশের আদর্শগত অবক্ষয় দেখে তা থেকে উত্তরণের জন্যে অধ্যাপক সায়ীদ এই প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এ প্রসঙ্গে স্যার বলেন:

দেশের এই সার্বিক অবক্ষয় এবং সম্ভাবনাহীনতার ভেতর সীমিত সংখ্যায় হলেও যাতে শিক্ষিত ও উচ্চমূল্যবোধসম্পন্ন আত্মোৎসর্গিত এবং পরিপূর্ণ মানুষ বিকশিত হওয়ার পরিবেশ উপহার দেয়া যায়, সেই উদ্দেশ্য নিয়েই আমরা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র গড়ে তুলতে চেষ্টা করছি। তিনি অনুভব করতেন- একজন মানুষ যাতে জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার অধ্যয়ন, মূল্যবোধের চর্চা এবং মানবসভ্যতার যা-কিছু শ্রেয় ও মহান তার ভেতর দিয়ে পরিপূর্ণ মনুষ্যত্বসম্পন্ন হয়ে বেড়ে উঠতে পারে- আমরা এখানে সেই পরিবেশ সৃষ্টি করতে চাই। কাজেই আমাদের এই প্রতিষ্ঠানটি একটি প্রাণহীন, কৃত্রিম, গতানুগতিক প্রতিষ্ঠান নয়; এটি একটি সর্বাঙ্গীণ জীবন-পরিবেশ।

এই মহা মনিষীর জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাতে পেরে আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি। ধন্য বোধ করছি। পরিশেষে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সাঈদ স্যারের সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি।

______________________________
লেখকঃ দাউদুল ইসলাম। কবি ও প্রাবন্ধিক।
লেখার সূত্র জোগাড়ঃ কোয়ান্টাম, মুক্ত বিশ্বকোষ,
ভাঙ্গো দুর্দশার বৃত্ত গ্রন্থ, ও স্যারের বিভিন্ন বক্তব্য।

প্রয়াণের ষষ্ঠ বার্ষিকীতে শিল্প সাহিত্যের জাদুকর হুমায়ুন আহমেদ

আজ (১৯ জুলাই) বাংলার নন্দিত কথাশিল্পী ও চিত্রনির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী। দেখতে দেখতে কেটে গেল জন নন্দিত এই কথাশিল্পীর প্রয়াণের ছয় ছয়টি বছর। ২০১২ সালের আজকের এই দিনে ক্যান্সার চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি নিউইয়র্কের বেলভ্যু হাসপাতালে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান জোছনার গল্প কথক কিংবা হিমু-মিসির আলির এই স্রষ্টা। তার মৃত্যু শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বব্যাপী সব বাঙালির হৃদয়ে গভীর শোকের অন্ধকার ছড়িয়ে দিয়েছিল।

মাত্র ৬৪ বছরের জীবনে হুমায়ূন আহমেদ তাঁর কীর্তি রেখেছেন শিল্প-সাহিত্যর প্রায় প্রতিটি শাখা প্রশাখায়। বাংলা সাহিত্য, নাটক, চলচ্চিত্র ও গান পালাবদলের এ কারিগর ১৯৭২ সালে প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ দিয়ে নিজের অস্তিত্বের সাক্ষর রাখেন। তার ‘নন্দিত নরকে’ আর ‘শঙ্খনীল কারাগার’ পাঠ করে আবিষ্ট হয়েছিলেন, সেই আবেশ আজও কাটেনি বাংলা ভাষার পাঠকদের। তিনি তাঁর সাহিত্য দিয়ে মন্ত্রমুগ্ধ রেখেছেন বাংলার মানুষকে, তিনি জয় করে গেছেন একেবারে সাদামাটা বাঙ্গালীর মন কে, আবার উন্নত ঐশ্বর্যিক বাঙ্গালিয়ানাকে। নিজেকে তিনি যেভাবে বাংলা কথাসাহিত্যের অঙ্গনে, টেলিভিশন নাটক আর চলচ্চিত্রাঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন তা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক বিরল । তিনি এদেশের সৃজনশীল সাহিত্য প্রকাশনাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন বিপুল পাঠকপ্রিয়তা সৃষ্টির মাধ্যমে। ভারতীয় বাংলা গল্প, উপন্যাসে নিমগ্ন পাঠকদের বাংলাদেশি লেখকদের বই পড়তে বাধ্য করেছিলেন তার আশ্চর্য জাদুকরী গল্পের জালে জড়িয়ে। মোহাবিষ্ট পাঠক হুমায়ূন আহমেদের রচনায় মধ্যবিত্ত জীবনের হাসি-কান্নার এমন নিবিড় পরিচয় পেয়েছেন, যেখানে তাদের নিজেদেরই জীবনের ছবি প্রতিবিম্বিত। এক হুমায়ুন আহমেদের পথ ধরে এগিয়ে এসেছেন অসংখ্য প্রতিভা, অসংখ্য মানুষ তার হাত ধরে হয়েছেন অনন্য, একেবারে সাদামাটা মানুষকে তিনি বানিয়ে দিয়েছেন নন্দিত চিত্রতারকা!তাদের অনেকেই হয়েছেন জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত শিল্পী। আমরা তাঁর সৃষ্টিতে খুঁজে পাই অসাধারণ সব নৈপুণ্য, অনন্য নৈসর্গিক দৃশ্য, জোছনা, খুঁজে পাই আমাদের জীবনের নানান সব ব্যঞ্জনা।
হুমায়ূন আহমেদের অনন্য সৃষ্টি হিমু! সে এক অসাধারণ চরিত্রের নিরন্তর পথ চলা… এক ভিন্ন মেজাজ, ভিন্ন স্টাইল, ভিন্ন রঙ রূপ এর অপূর্ব সমন্বয়, যা আমাদের দেশের বেশিরভাগ তারুণ্য কে ছুঁইয়ে গেছে, আজো ছুঁইয়ে আছে আর আগামী দিনে একিই প্রভাব নিয়ে এই চরিত্রটি টিকে থাকবে।
এদেশে দর্শকনন্দিত নাটকগুলোর একটি বড় অংশ তার সৃষ্টি। তার ছায়াছবিও সমাদৃত হচ্ছে সমানভাবে। প্রয়াণের ছয় বছর পরও বাংলা শিল্প-সাহিত্যের বেশিরভাগ অংশ জুড়ে চলছে তাঁরই আধিপত্য, তারই রাজত্ব, তারই জয়জয়কার! এখনো সমান তালে সমান ছন্দে বিরাজ করছে হুমায়ুন প্রভাব যা রবীন্দ্র নজরুলের পর আর কেউই খাটাতে সক্ষম হয়নি। হুমায়ূন আহমেদ এর পুস্তুক প্রকাশকদের মতে তার নতুন বা পুরনো সব গ্রন্থই সর্বোচ্চ বিক্রিত বইয়ের তালিকায় স্থান করে নেয়। এই হিসেব মতে হুমায়ুন আহমেদ কে আধুনিক শিল্প সাহিত্যের রিদম বলা ভুল হবেনা।
বাংলা টেলিভিশনের জন্য একের পর এক দর্শকনন্দিত নাটক রচনার পর ১৯৯০-এর গোড়ার দিকে চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেন। তাঁর পরিচালনায় প্রথম চলচ্চিত্র ‘আগুনের পরশমণি’ মুক্তি পায় ১৯৯৪ সালে। ২০০০ সালে ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’ ও ২০০১ সালে ‘দুই দুয়ারী’ দর্শকদের দারুণ গ্রহণযোগ্যতা পায়। ২০০৩-এ নির্মাণ করেন ‘চন্দ্রকথা’।
এছাড়া ১৯৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ২০০৪ সালে নির্মাণ করেন ছায়াছবি ‘শ্যামল ছায়া’ , ২০০৬ সালে ‘সেরা বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র’ বিভাগে একাডেমী পুরস্কারের জন্য বাংলাদেশ থেকে যেটি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। এবং বেশ কিছু আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়। একিই বছর মুক্তি পায় ‘৯ নম্বর বিপদ সংকেত’। ২০০৮-এ ‘আমার আছে জল’ চলচ্চিত্রটি তিনি পরিচালনা করেন। ২০১২ সালে তাঁর পরিচালনার সর্বশেষ ছবি ‘ঘেটুপুত্র কমলা’ মুক্তি পায়। যা দেশ-বিদেশে প্রচুর আলোচনায় আসে। তাঁর চলচ্চিত্রের মৌলিক গানগুলো তিনি নিজেই রচনা করেন, যার বেশিরভাগই পায় তুমুল জনপ্রিয়তা।

১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্বর নেত্রকোনা জেলার কেন্দুয়া উপজেলার কুতুবপুরে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জন্মগ্রহণ করেন হুমায়ূন আহমেদ। ডাক নাম কাজল। বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ ও মা আয়েশা ফয়েজের প্রথম সন্তান তিনি। বাবা ফয়জুর রহমান আহমেদ ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। মা ছিলেন গৃহিণী। তিন ভাই দুই বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং জনপ্রিয় শিশুসাহিত্যিক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল তার ছোটভাই। সবার ছোট ভাই আহসান হাবীব নামকরা কার্টুনিস্ট ও রম্যলেখক।
তিনি ১৯৬৫ সালে বগুড়া জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক, ১৯৬৭ সালে ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক, ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন শাস্ত্রে স্নাতক ও ১৯৭২ সালে স্নাতকোত্তর পাশ করেন। ১৯৮২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটা ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি গ্রহণ করেন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। ৯০ দশকের মাঝামাঝি তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করে লেখালেখিতে পুরোপুরি মনোযোগ দেন।
১৯৭৩ সালে প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁর নাতনি গুলতেকিন খানের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন হুমায়ূন আহমেদ । হুমায়ূন এবং গুলতেকিন দম্পতির চার ছেলে-মেয়ে। তিন মেয়ে নোভা, শীলা ও বিপাশা আহমেদ এবং ছেলে নুহাশ হুমায়ূন। দীর্ঘ ৩২ বছরের দাম্পত্য জীবনের অবসান ঘটিয়ে ২০০৫ সালে ডিভোর্সের মাধ্যমে তারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। এরপর তিনি অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওনকে বিয়ে করেন। এ দম্পতির দুই ছেলে- নিষাদ ও নিনিত হুমায়ূন।

লেখকঃ দাউদুল ইসলাম
কবি ও প্রাবন্ধিক।