ট্যাগ আর্কাইভঃ পহেলা বৈশাখ

প্রাণের আকুতিই হচ্ছে সংস্কৃতির মূল স্পন্দন!

প্রাণের আকুতিই হচ্ছে সংস্কৃতির মূল স্পন্দন!

কি আজব কাণ্ড!
চারদিকে এতো উৎসব এতো ডামাডোল!
এতো আয়োজন, রঙ ঢঙ..
হৈচৈ.. গান
অথচ
কোথাও বঙাব্দের সুর নাই
আবহমান বাংলার ঐতিহ্য নাই
সংস্কৃতির আবেদন নাই!!
একধরনের অপসংস্কৃতির প্রতিযোগিতা সর্বত্রই!
সংস্কৃতির মঞ্চ গুলো ছিনতাই হয়ে গেছে
কোথাও স্বকীয়তা নাই
কোন আত্মিক মমতা নাই
জাতিগত কোন প্রতিচ্ছবির চিহ্ন অব্ধি নাই!
অথচ
সবাই কবি
সবাই সাহিত্যিক, সবাই শিল্পী, সংস্কৃতকর্মী! হাহাহা…
একদিনের বাঙালিয়ানা সাজতে গিয়ে
বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য কে লালিত প্রথা কে ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছে
আঘাত হানতে হানতে বিধ্বস্ত করে পেলেছে জাতিসত্তার শেকড়!
তবুও আমরা মন বোঝাই। মন কে বোঝাতে বৈশাখে ঘরের বাহির হই। নতুন বানী শুনি, স্বপ্ন আকি, আশার বুক বাঁধি।
শংকিত চোখে একদিকে দেখি ধর্মীয় গোঁড়ামি অন্যদিকে দেখি জাতীয়তাবাদের আকুতি
এরিই মাঝে আহত হই, বিভ্রান্ত হই
যখন পুঁজিবাদিরা তাদের অবৈধ অর্থকে হালাল করতে
এধরনের সংস্কৃতির মঞ্চ গুলো কিনে নেয়, ওরা অবলীলায় দখল করে নেয় আমাদের হাজারো ত্যাগ তিতিক্ষার মঞ্চ!..
বশ করে নেয় রাজনৈতিক মাথা গুলো
যাদের অগাধ অর্থ আর ক্ষমতার তেজস্ক্রিয়তায় সংকুচিত হয়ে থাকে আমাদের অজস্র কোমলমতি মন।
সে সব মাথা গুলো বশ করে
পুঁজিবাদেরা ইতিমধ্যে নামের আগে নানান বিশেষণ যুক্ত করেছে, অর্জন করেছে নানারকম বাহবা! হাহাহা..
কারণ আমরা নিজেরা যতোটা না তার অধীক অর্জনের নেশায় বুদ হয়ে আছি। যেহেতু ওদের কালো টাকার অভাব নাই, যেহেতু ওরা ক্ষমতাবান, যেহেতু ওরা শিক্ষা, সংস্কৃতি, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, মসজিদ থেকে শুরু করে পাড়ার ক্লাব অব্ধি আধিপত্যের ক্ষমতা রাখে, সেহেতু
এদেশ, এই জাতিসত্তা এই ঐতিহ্য, এই সংস্কৃতি এখন শুধুই মাত্র একটি সিড়ি, একটি মুখোশ
যার আড়ালে চলছে অবিরাম স্বার্থ সিদ্ধির পাঁয়তারা।

তবুও
বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে আমার শুভেচ্ছা তাদের জন্য
যাদের সুবেহ সাদেকের আগে ঘুম ভাঙে, বিছানা ছাড়ে
যারা মাটি আর কাদাজলে অন্ন খোঁজে
যাদের রক্ত ঘামে আমাদের পাতে ভাত রুটির বন্দোবস্ত হয়। আমার শুভেচ্ছা তাদের জন্য যারা
কবি নয় অথচ কবিতার আকুতিতে দিনিমান নতজানু হয়ে থাকে হৃদয়ের বৃন্তে, যারা আড়ষ্ট শিল্পের কৌমার্য হতে আজো খুজে বের করে জন্ম জন্মান্তরের ইতিহাস!
যারা খরতাপে পুড়ে পুড়ে
এক ঢোক শীতল জলের আশায় ঘরে ফেরে মায়ের আচলে, বধূর কাছে…
যাদের আকণ্ঠ উচ্চারণই এই বাংলার ধ্বনিত সুর
যাদের অবলীলার ভাষাই
এই সংস্কৃতির আদিম শক্তি! আমার শুভেচ্ছা আমার সকল প্রেম সকল ভাষা তাদের জন্যই!…

শুভ নববর্ষ! …

পহেলা বৈশাখের পান্তা ইলিশে হিন্দু মুসলিমের আনন্দ দ্বিখণ্ডিত!

বাংলা নববর্ষ পহেলা বৈশাখের সাথে ইলিশের সম্পর্ক কী?
পহেলা বৈশাখের সঙ্গে পান্তা-ইলিশের কোনও সম্পর্ক আছে বলে আমার মনে হয় না। যেখানে আগেকার সময়ে এই বৈশাখ ছিলো কৃষকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাঁরা চৈত্র সংক্রান্তিতে রাজা-জমিদারদের খাজনা বুঝিয়ে দিতো। রাজা-জমিদাররা তাদের পাওনা বুঝে পেয়ে, পহেলা বৈশাখে কৃষকদের মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করতো। বাড়ি এসে কৃষকরা কাঁচামরিচ দিয়ে পান্তাভাত খেয়ে নতুন করে জমিতে চাষাবাদ শুরু করতো। গরিব কৃষকদের সেই বৈশাখ আজ ধনী-গরিব সবার ঘরে গিয়ে পৌঁছেছে।

একসময় মানুষ বাজার থেকে আটা কিনে লোকলজ্জার ভয়ে খুব গোপনে নিজেকে সামলে বাড়ি ফিরতো। যদি কেউ দেখে ফেলে, সেই ভয়ে। বাজার থেকে আটা কিনে এনেছে– কেউ দেখে বলবে, “লোকটা টাকার অভাবে আটা কিনে খাচ্ছে!” আর এখন সেই আটার দুর্মূল্যের কারণে গরিব মানুষ আটার সামনেও যেতে পারে না। একসময়ের গরিবের খাবার আটা এখন বড়লোকে খায়।

একসময় এদেশের প্রায় নদীতে ইলিশ মাছ পাওয়া যেত। ইলিশের মৌসুমে সস্তা দরের ইলিশমাছ খেয়ে ডায়রিয়া, কলেরা হয়ে গ্রামের পর গ্রাম ছাপ হয়ে যেত। সেই ভয়ে এদেশের ধনী ব্যক্তিরা ইলিশ মাছ খেতো না। ১৯৮৮ সালের বন্যার সময়ও দেখেছি, এদেশের মন্ত্রী এমপি মহোদয় বন্যার্তদের মাঝে ইলিশ মাছ বিতরণ করেছিল। কিন্তু তাঁরা কেউ খায়নি, ডায়রিয়া কলেরার ভয়ে। আর এখন সেই ইলিশ মাছ আন্তর্জাতিক বাজারে। আর মন্ত্রী, এমপি, ডাক্তার, বড়বড় ব্যবসায়ীদের দরবারের খাবারের পরিবেশনে থাকে।

বাংলা পহেলা বৈশাখে ইলিশের সুসম্পর্ক স্বাধীনতার পরবর্তী সময়েও দেখা যায়নি। ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে পহেলা বৈশাখ রূপ নিয়েছে নতুন সাজে। সেই সাথে পহেলা বৈশাখে যোগ হয়েছে গরিবের খাবার পান্তাভাতের সাথে বড়লোকের দামি ইলিশ।

অনেক বছর ধরে দেশের কিছু ব্যবসায়ী সংগঠন বৈশাখের সাথে পান্তা-ইলিশকে পহেলা বৈশাখের অনুষঙ্গ করে তুলেছে। প্রকৃত অর্থে এটি বানোয়াট সংস্কৃতিচর্চা। এর সঙ্গে বাঙালির কোনও সম্পর্ক নেই। পান্তা হচ্ছে গরীবের খাবার। আর যেকোনো উৎসবের সময় মানুষ যেখানে ভালো ভালো খাবার খায়, সেখানে আগেকার বড়লোকের ঘৃণিত খাবার গরিবের পান্তাকে খাওয়ানো হচ্ছে ব্যবসার খাতিরে।


শব্দনীড় প্লাটফরমের সবাইকে বাংলা শুভ নববর্ষের শুভেচ্ছা।

আজ আমরা হিন্দু মুসলিম দ্বিখণ্ডিত!
পহেলা বৈশাখ হলো বাংলা পঞ্জিকার প্রথম মাস। যা বৈশাখ মাসের ১ তারিখ বা বাংলা সনের প্রথম দিন। যাকে আমরা বাংলা ভাষাভাষীরা সাদরে বরণ করি নানা আয়োজনের মধ্যদিয়ে। যাকে বলা হয়, “বাংলা নববর্ষ”। দিনটি বাংলাদেশ এবং ভারতের কয়েকটা রাজ্যে পালিত হয়। আগেও এই পহেলা বৈশাখ খুব জাঁকজমক ভাবে ঢাক ঢোল পিটিয়ে, সবাই একইদিনে বিশেষ উৎসবের সাথে পালন করতো। কিন্তু এখন এই বিশেষ দিনটি দুইভাগে বিভক্ত। কেউ পালন করে ১৪ এপ্রিল, কেউ করে ১৫ এপ্রিল। অর্থাৎ, ১৪ এপ্রিল রাষ্ট্রীয় ভাবে সকল ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের, আর ২৫ এপ্রিল নীরবে পালন করতে হয় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের।

তাই অনেকে অনেকসময় বলেও ফেলে যে, আজকের পহেলা বৈশাখ আমাদের; আগামীকাল হবে আপনাদের। তার মানে হলো, আজ রাষ্ট্রীয়ভাবে মুসলমানদের। আগামীকাল হবে হিন্দুদের। দুঃখ এখানেই, এক দেশে থেকেও একটি ঐতিহ্যবাহী উৎসব দুই ধর্মাবলম্বীদের দুইভাবে দুই দিনে করতে হচ্ছে। তা হয়েছে একটু ব্যবধানের কারণে।

ব্যবধান হলো, সৌরজগতের চাঁদ আর সূর্য, আর আন্তর্জাতিক মানদণ্ড। বাংলা দিনপঞ্জির সাথে হিজরী এবং খ্রিষ্টীয় সনের মৌলিক পার্থক্য হলো, হিজরী সন। যা হয় চাঁদের হিসাবে। আর খ্রিষ্টীয় সন আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী নির্ধারিত হয়। এ কারণে হিজরী সনের নতুন তারিখ শুরু হয় সন্ধ্যা আকাশে নতুন চাঁদ দৃশ্যমান হওয়ার পর। আর খ্রিষ্টীয় সনের নতুন দিন শুর হয়, ইউটিসি ±০০:০০ অনুযায়ী। পহেলা বৈশাখ রাত ১২ টা থেকে শুরু-না সূর্যোদয় থেকে শুরু; এ নিয়ে ভিন্নমত এখনো রয়েছে। ঐতিহ্যগত ভাবে সূর্যোদয় থেকে বাংলা দিন গণনার রীতি থাকলেও, ১৪০২ সালের ১ বৈশাখ থেকে বাংলা একাডেমী এই নিয়ম বাতিল করে, আন্তর্জাতিক রীতির সাথে সামঞ্জস্য রাখতে রাত ১২.০০ টায় দিন গণনা শুরুর নিয়ম চালু করে।

সেই থেকেই আজ আমরা এই পহেলা বৈশাখ দুইভাবে, আর দুইদিনে পালন করে থাকি। যা রাষ্ট্র এবং মুসলমান ধর্মাবলম্বীরা ১৪এপ্রিল। আর সনাতন ধর্মাবলম্বীরা ১৫ এপ্রিল বাংলা নববর্ষ বা পহেলা বৈশাখ পালন করে আসছে। সত্যি আজ আমরা হিন্দু মুসলিম ভাইভাই হয়েও, দুই ধর্মের মানুষ বছরের একটি বিশেষ দিনের আনন্দ দুইভাবে দুইদিনে পালন করতে হচ্ছে। তবু মনে দুঃখ নিয়ে, দুইভাবে দুইদিনে সবাইকে বাংলা নববর্ষ পহেলা বৈশাখের শুভেচ্ছা জানাই। সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন!