ট্যাগ আর্কাইভঃ মেগা সিরিয়াল

নক্ষত্রে গোধূলি-৫০

৬৮।
সকালে সাড়ে দশটার দিকে ঘুম ভাংল, তারপরেও কিছুক্ষণ চুপচাপ শুয়ে রইলেন। ভাল ঘুম হয়েছে কিন্তু তবুও কেন যেন মাথা ঝিম ঝিম করছে। উঠে ওযু করে এসে নামাজ পড়ে ভাবছিলেন কি করবেন তারতো কোথাও যাবার জায়গা নেই। সবাই ঘুমে, এক জানালা ছাড়া আর কোথায় যাবেন? পিছনে একটু হাঁটা যায় কিন্তু ভীষণ ঠাণ্ডা। জানালার পাশে এসেই দাঁড়ালেন। চেয়ারটা এনে কি বসা যায়? চেয়ার টেনে এনে বসলেন, না দাঁড়ানই ভাল বসলে কিছু দেখা যায়না। কীইবা আর দেখবেন দুই এক জন যাতায়াত করছে মাঝেমাঝে গাড়ি আর খোলা আকাশ আর কিচ্ছু নেই। প্রথম দিনের দেখা দোকান গুলিতে কোন মানুষ ঢুকতে বা বের হতে দেখা গেল না এখনও। এগুলি কি বন্ধ নাকি? মানুষই দেখা যায়না তা আর দোকানে আসবে কে? বাইরে বের হতে পারলে আশে পাশে একটু ঘুরে দেখা যেত, কিন্তু বাইরে বের হলে ঢুকবে কিভাবে? চাবির ব্যাপার আছে, থাক পরে সব কিছু জেনে শুনে তখন বেরুনো যাবে। পাবটার গেটের সামনে তাকাল, বন্ধ। অবশ্য এদেশের সব দরজাই শীতের জন্যে বন্ধ থাকে। দরজার সামনে ওপেন/ক্লোজ সাইন দেখে বুঝতে হয় দোকান খোলা না বন্ধ। এখন বন্ধ তাহলে খুলবে কখন? হয়তো সন্ধ্যায় যখন উল্লাস করার জন্য সবাই ছুটে আসবে। আজ রবিবার, আজতো ছুটির দিন শহর বন্ধ থাকার কথা। হ্যাঁ মনে পরেছে এই জন্যেই রাস্তায় মনুষ্য নেই।

খুকু কি করছে, মাঝু কি কলেজে গিয়েছিলো, আর যূথী? যূথীটা যে কেমন শুধু ক্লাস কামাই করার চিন্তা! কবে যে ও বড় হবে? হোক আস্তে আস্তেই হোক। ওর ছোট চাচাও এই রকম ছিলো। মনি কি করছে এখন? এখন দেশে বিকেল পাঁচটা বাজে, হয়তো বিকেলের চা নাস্তা বানাচ্ছে, নিয়ে ছাদে যাবে নয়তো নামাজ পড়ছে। সামনের দোকানের সারির ছাদের চূড়ার দিকে তাকিয়ে রয়েছে রাশেদ সাহেব। যেন মনিকে, যূথীকে, মাঝুকে, খুকুকে সবাইকেই দেখতে পাচ্ছে ওখানে। নীচে কোথায় যেন টেলিফোনের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। অনেকক্ষণ কান পেতে শোনার চেষ্টা করলেন। হ্যাঁ রেস্টুরেন্টের ভিতরেই বাজছে। ওরা কি রেস্টুরেন্টের সময়সূচী জানে না নাকি মনে করেছে সারা দিন রাত খোলা থাকে? রেস্টুরেন্ট এখন বন্ধ কে ধরবে? কত কি মনে আসছে যাচ্ছে কোনটাই স্থায়ী হচ্ছে না। এলো মেলো হালকা মেঘের মত এখান থেকে ওখানে কোথায় ছুটে বেড়াচ্ছে! আসার আগে ঈদের জন্যে কিছু কেনাকাটা করে দিয়ে আসেনি। মেয়েরা তা মেনে নিয়েছে কিচ্ছু বলেনি। সবারই এক কথা তুমি আগে ঠিক হও তখন দেখা যাবে। ঈদের দিন নতুন কাপর না পরলে কি হয়? যারা সারা বৎসরে একটা কাপর পায়না তাদের দিন যায়না? আমাদের কিছু লাগবে না। আমার লক্ষ্মী সোনা মনি বলে তিন মেয়েকেই বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। চোখ ভিজে গিয়েছিলো। ছোট মেয়ে যূথী হাত ছাড়িয়ে বলেছিলো আব্বু আমি তোমার জন্যে চা নিয়ে আসি। মাঝু আর খুকু বললো তুমি এতো চিন্তা করবেনাতো আব্বু। দেখবে একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। মনিকে বলেছিলো তুমি কি যেয়ে ঈদে মেয়েদের কিছু কিনে দিতে পারবে? না আমার মনে হয় তার দরকার হবে না। তার চেয়ে টাকাটা থাকলে কখন কি হয় কাজে লাগতে পারে। ঠিক আছে যা ভাল মনে কর তাই করবে। সংসারের হিসাব নিকাশ সবসময় মনিই দেখে আসছে। রাশেদ সাহেবের মাথায় এগুলি ভালো কাজ করেনা।

নক্ষত্রে গোধূলি-৪৯

৬৭।
শুয়ে শুয়ে সারাদিনের ছবি ভাবতে চাইলেন। না, ভেবে আর কি হবে? এই ভাবেই যখন চলবে চলুক না! কি আছে ভাবার? তার চেয়ে মেনে নেয়াই ভালো। মেনে নিতে না পারলে কষ্ট আরও বাড়বে। মনের মধ্যে কোথায় যেন এই মেনে নেয়াতে একটু দ্বিধা লাগছে। কিন্তু কেন? এতো পরিশ্রম কি পারবো? টিকে থাকতে হবে! এই করে যদি নিজেই শেষ হয়ে যাই তাহলে চলবে কি করে? ডায়াবেটিসটাই তো দিলো আমাকে শেষ করে। মাথা ব্যথা হলে ওষুধ খেয়ে ব্যথা সারাতে হয়, মাথা কেটে আর ব্যথা সারান যায় না। তা হলে কি করা যায়? মারুফ বলেছিলো সামনের কাজ খুঁজে দেখতে, কিন্তু আমি কিভাবে খুঁজবো কাকে চিনি আমি? দেখা যাক কয়েকদিন। শুক্র শনিবার গেলো। সামনের কয়েকটা দিন দেখি কেমন। হাত দু’টার দিকে চোখ পড়ল, সব গুলি আঙ্গুল কাটা কাটিতে ভরা, কয়েকটা নখ ভেঙ্গে গেছে, আঙ্গুল গুলি কালো দাগে ভরা দেখে তাকিয়ে রইলো। রাশেদ সাহেব তুমি কি পারবে এভাবে? গ্রেভির ডেকচি, রাইসের ডেকচি নাড়া চারা করতে হচ্ছে। আজকেই কোমরে টান লেগেছিলো কখন কি হবে বলা যায়? মানুষ কি সবসময় সাবধানে চলতে পারে? ভাল হবে তুমি সামনে কাজের চেষ্টা কর। বুঝলাম, কিন্তু—, আবার ঐ কিন্তু। আচ্ছা দেখিনা কয়েকদিন। দাঁড়াবার জায়গা যখন হয়েছে তখন অবস্থা বুঝে ব্যবস্থাও একটা হবে। কয়েক দিন একটু মেনে নিতেই হবে, উপায় নেই। এখানে আমার কে আছে এমন কেও নেই যে আমাকে সব কিছু করে দিবে। আমিও কিছু জানি না চিনি না একেবারে নতুন, কিছুদিনের অপেক্ষায় থাকতেই হবে। সময়ই বলে দিবে কখন কি করতে হবে। ঘড়িতে পৌনে দুইটা বেজে গেছে। না আর না এবার উঠতে হয়। উঠে নিচে যেয়ে দেখে আলু দিয়ে রুই মাছ রান্না হয়েছে তাই দিয়ে সেহেরি খেয়ে এসে ওষুধ খেয়ে একটা সিগারেট জ্বালিয়ে কাত হয়ে ছাদের দিকে তাকিয়ে একা একা মনে মনে কথা বলছিলেন।
নুরুল ইসলাম এসে বললো -চলেন ভাই সাহেব খেয়ে আসি।
-আমি এইমাত্র খেয়ে আসলাম, রাতে ভাত খাইনি তাই একটু তাড়াতাড়িই খেয়ে নিলাম আপনি যান।
নুরুল ইসলামের সাথে এখনও আলাপ হয়নি। আস্তে আস্তে আলাপটা করে নিতে হবে এক রুমে থাকি দরকার আছে।
-আচ্ছা ভাই এ রুমে হিটার নেই?
-জানি না, আমিও নতুন এসেছি।
-তাই নাকি?
-হ্যাঁ।
-কবে?
-এইতো গত মাসের মাঝামাঝি মানে তিন সপ্তাহ চলছে।
-ও আচ্ছা। তাহলে কি করা যায়? ঠাণ্ডা লাগে একটু একটু শেষ রাতের দিকে। আপনার লাগে না?
-হ্যাঁ লাগে দেখি সেফ এলে বলতে হবে।
-কেন সেফ কেন আপনার সামনেও তো দুইজন মালিক আছে।
-তা থাকলে কি হবে ওরা এসব গুরুত্ব দেয়না। যাই আমি খেয়ে আসি।
-হ্যাঁ আসেন এসে যদি দেখেন আমি ঘুমিয়ে পরেছি তাহলে—
-না না ডাকব না, বুঝেছি ঘুমান আপনে। লাইট নিভিয়ে দিবো?
-হ্যাঁ ভালোই হবে।
হাতের সিগারেট শেষ করে নিভিয়ে ফেললেন।

নক্ষত্রে গোধূলি-৪৮

৬৬।
গতরাতের মত আজও প্রায় সাড়ে এগারোটার পরে আনোয়ার এসে হাঁক দিল মারুফ আটাও আটাও শেষ কর। এবার শুরু হলো গুছানোর পালা। ফ্রিজ থেকে যা যা বের করেছিলো সেগুলি যা রয়েছে তা ছোট ছোট আইসক্রিমের বাক্সের মত কন্টেইনারে ঢেলে বড় ট্রেগুলি সব সিংকে জমা হচ্ছে। ওদিক থেকে কাস্টমারের প্লেট পেয়ালা খালি ডিশ ইত্যাদি জমে পাহাড়ের মত হয়ে গেছে তবুও মাঝে দুইবার বেশ কিছু ধুয়ে দিয়েছে। চামচ, কাটা চামচ, টেবিল ছুরি এগুলিকে বলে সিলভার। সিলভারগুলি পাশে নিচে একটা বালতিতে জমা করে রাখে। সিলভারও এক বালতি ভরে পরি পরি ভাব। মাঝে একবার অর্ধ্বেক বালতির কিছু কম ধুয়ে দিয়েছিলো ওগুলি আবার এখান থেকে ধুয়ে বালতিতে একটু লিকুইড সাবান দিয়ে গরম পানি সহ দিয়ে দেয়। সামনের লোকজন ন্যাপকিন দিয়ে মুছে নেয়। হাতের দিকে দেখে হাত কাল হয়ে গেছে, কত যে কেটেছে তার হিসাব নেই। বেশি বড় না তবে যন্ত্রণাদায়ক। নুরুল ইসলাম ড্রিঙ্কস এনে দেখিয়ে দিল এটা ডায়েট। রাশেদ সাহেব তুলে নিলেন। এক পেয়ালা রাইস নিয়ে একটা চামচ নিয়ে খাওয়া শুরু করেছে ওমনি কবির বললো-
-ভাইছাব একটু পোলাও রাইস গরম করে দেন কুইক।
পেয়ালা রেখে তাকে যোগান দিলেন। কবির বললো –
-আপনে এভাবে খেতে পারবেন না। পাশে রাখেন, চামচ দিয়ে কাজের ফাঁকে ফাঁকে শেষ করবেন। নিশ্চিন্তায় বসে খাবার মত এতো সময় কোথায়?
গতরাতের মতই কবির সাহায্য করছে।
ধোয়া টোয়ার কাজ শেষ। দুইটা বড় বিন ব্যাগ ড্রাম সহ দুইজনে ধরে বাইরে কাউন্সিলের বিন কন্টেইনারে ফেলে এসে দেখে সবার কাজ প্রায় শেষ। আগেই মপের বালতি চুলায় দিয়ে গিয়েছিলো। পানি গরম হয়ে গেছে এবারে ব্লিচ, সাবান আর সুগন্ধি মিশিয়ে ফ্লোর মুছে বালতির পানি বাইরে ফেলে ব্রাশটা যায়গা মত রেখে এসে দেখে সবাই খাচ্ছে।
-আসেন ভাই খেয়ে নেন।
ঘড়ি দেখে একটু চিন্তা করে বললো-
-না আপনারা খান আমি এখন কিছু খাবো না, দুইটার দিকে একেবারে সেহেরি খেয়ে শুয়ে পরবো।
-আরে কি বলেন শরীর খারাপ হবে!
-না তখন যে রাইস খেলাম ওতেই হবে আপনারা খেয়ে নেন আমি উপরে নামাজ পড়ে নিই।
-ঠিক আছে যান রেস্ট করেন।
-আচ্ছা কাল সকালে বারোটায় নামতে হবে তাইনা?
-হ্যাঁ কাল বারোটায় নামলেই হবে।
-তাহলে আমি আসি।

রাশেদ সাহেব উপরে চলে গেলেন। কাপর বদলে কিছুক্ষণ গড়াগড়ি করে উঠে গোসল করে এসে নামাজ পড়ে একটা সিগারেট জ্বালিয়ে জানালার ধারে দাঁড়ালেন। গত রাতের মত একই দৃশ্য। আজ যেটা নতুন লক্ষ্য করলেন তা হলো মহিলাদের পরনের স্বল্প বসন। গরম পোষাক নেইই সাধারণ কাপর যা আছে তাও খুবই সংক্ষিপ্ত। এই শীতের মধ্যে এই কাপর পরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে কিভাবে? অথচ দিব্বি কথা বলছে হাসছে। হাতে প্রায় সবারই একটা করে গ্লাস যাতে রঙ্গিন পানীয়, এখান থেকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। ও হ্যাঁ, পাবে এসেছে আগুন পান করার জন্য! তারপর নাচানাচি। ঠাণ্ডা লাগবে কোথা দিয়ে? পেটে আগুন ভরছে, এখনও হাতে আগুনের গ্লাস। আমাদের দেশে এইরকম সময়ে এই রকম জায়গায় এই বেশে কোন মহিলাকে ভাবাই যায়না! সভ্যতা, এই হলো সভ্যতা! হাতের সিগারেট শেষ হতেই বিছানায় এলিয়ে পরলেন।

নক্ষত্রে গোধূলি-৪৭

৬৫।
এসে কি করতে হবে সব ভুলে গেছেন। মনের যে অবস্থা আর এইমাত্র যে খুকুর দেয়া পেয়ালা রেখে এসেছেন তাতে আর কীইবা মনে থাকবে? সমস্ত কিচেনে ঘুরঘুর করতে লাগলেন কি করি, কি করি? আচ্ছা অন্তত ইফতারের ঝামেলা গুলি ধুয়ে রাখি এর মধ্যে কবির এলে ওর কাছে জানা যাবে কি করতে হবে। একটু পরেই কবির নেমে এলো।
-সালামালেকুম কবির ভাই, আসেন আসেন কি খবর?
-আরে আপনে এগুলি কি করেন ফ্রিজ থেকে মাল বার করেন!
-হ্যাঁ ভাই আসলে আমি ভুলে গিয়েছিলাম কি করতে হবে তাই এইটা করছিলাম।
-ও বুঝছি আসেন আমার সাথে।
দুইজনে মিলে সব মালামাল বের করে যা যা করতে হবে সব গুছিয়ে একেবারে রেডি। মিনিট দশেকের মধ্যেই অর্ডার আসতে শুরু হয়েছে। প্রথম অর্ডার নিয়ে এলো আসাদ। আজকের অর্ডার একটু তাড়াতাড়ি এলো। একের পর এক টেক এওয়ের অর্ডার আসছে আর মারুফের ফ্রাই প্যান, চামচের ঠং ঠং শব্দ, কুকের চিৎকার, কবিরের দৌড়া দৌড়ী, রাশেদ সাহেবের প্যাকেটের গায়ে কারির নাম লেখা, বিল দেখে ব্যাগে ভরা আবার সাথে সাথে মারুফের প্যান ধুয়ে দেয়া, কুককে পোলাও রাইস গরম করে দেয়া, তন্দুরি সেফের নান বানানোর শব্দ। নানের শিক উঠানো নামানোর শব্দ, একটা কিমা নান, একটা পেশোয়ারি নান, দুইটা নানের হাঁক ডাক সব কিছু গতকালের ব্যস্ততাকে ছাড়িয়ে গেলো। এর মধ্যে ঘটনা একটা ঘটে গেলো। ভিতরে চার জনের এক টেবিলের অর্ডারের কারি রাশেদ সাহেব প্যাকেটে ভরে ফেলেছে এখন আসাদ এসে ওই কারি খুঁজে পাচ্ছেনা। মারুফ বললো-
-আমি বানিয়ে সব ডিশে ভরে হট বক্সে রাখতে বলেছি। ভাই সাহেব, ওই যে দিলাম ওটা কি করলেন?
-আমিতো প্যাকেটে ভরে ফেলেছি।
-ইইশ কি করেছেন কি?
-শিগগির বের করেন আবার যেমন ছিলো তেমন করে ডিশে ঢালেন, না না থাক এটা আর দেয়া যাবেনা আমি আবার বানিয়ে দিচ্ছি। এর পর একটু দেখে ভরবেন। নতুন মানুষ নিয়ে কাজ করার কি যে ঝামেলা!
রাশেদ সাহেব মারুফকে বললেন-
-ভাই এই ডেকচিতে কিন্তু সাদা রাইস আর নেই।
-আরে বলেন কি? এই কবির শিগগির সাদা রাইস চড়াও।
-ভাইছাব চার পট রাইস ধুয়ে দেন তাড়াতাড়ি।

এই ভাবে ভুল ঠিক, এলোমেলো, বকাঝকা, গালাগালি, তারা হুড়ো, গুঁতো গাঁতি, চিৎকার, হইচই, চেঁচামেচি সব কিছু মিলিয়ে রাত সাড়ে নয়টার দিকে একটু হালকা হবার পর আসাদ গতকালের মত ট্রে করে চারটা গ্লাসে অরেঞ্জ জুস আর কোক এনে সবার সামনে ধরল। যার যা খুশি তুলে নিয়ে এক চুমুকে শেষ। এর মধ্যে একটু পানি খাবার সময় কেও পায়নি। রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়নি তবে একটু ভিড় কমেছে। তবুও একটু শান্ত পরিবেশ। টেক এওয়ের ভিড়ও কমেছে। এবারে যারা ভিতরে বসে খাচ্ছে তাদের ভিড়। এগুলি মোটামুটি সামাল দেয়া যায়। এখন একটু ধীর গতিতে চলছে। তারপরও কম না, রোজা রাখা শরীর তো এমনিতেই কাহিল তারপর ইফতার আর কি হয় মাঝে একটু পানি খাবার মত সুযোগও পাওয়া যায়না তারপরে নতুন মানুষ। এবার কবিরের একটা মাশরুম রাইসের অর্ডারের সাথে কবির স্টাফের জন্যেও কিছু বানিয়ে কয়েকটা পেয়ালায় রেখে বললো-
-ভাইছাব এই কড়াইটা ধুয়ে দেন তারপরে এই যে এখান থেকে একটা নিয়ে খান।
আসাদ এলো মাশরুম রাইস নেয়ার জন্যে। তখন তাকে বললো-
-ভাই একটু ডায়েট কোক দেয়া যাবে?
-আচ্ছা দিব আর কেও কিছু খাবেন?
-আমাকে একটা, আমাকে অরেঞ্জ, আমাকে পাইন এপল।
-আচ্ছা আনছি, এই টেবিলটা সার্ভ করে নেই।

নক্ষত্রে গোধূলি-৪৬

৬৪।
আবার নিচে এসে চা পর্ব সেরে উপরে এসে এবারে একটা সিগারেট বানিয়ে বিছানায় কাত হলেন।
মেয়েরা কি করছে? নিশ্চয়ই বাবার কথা মনে করছে। মনি আজ কি ইফতার বানিয়েছিলো? নাকি মনিকে আজ মেয়েরা রান্না ঘড়ে ঢুকতে দেয়নি? এতো লম্বা জার্নি করে গেছে। ধকল তো কম না। তাহলে কে ইফতার বানিয়েছে? হয়তো রেখা নয়তো খুকু। মাঝু কি বাবার জন্যে প্লেট সাজিয়েছিলো? না না তা সাজাবে কেন? বাবা নেই সে কথা কি আর মাঝু জানে না? তবে মনে করেছিলো নিশ্চয়। অভ্যস্ত চোখটা বাবাকে খুঁজেছে ইফতারের টেবিলে। বাবা নেই কেমন লাগছিলো তখন মেয়েদের? ইফতারের প্লেটটা বাবার জন্যে মাঝুই সাজাত। বাবা যা পছন্দ করে মা বলে দিতে দিতে কখন যে ওদের তা মুখস্থ হয়ে গেছে তা কি ওরা জানে? তবুও মা মনে করিয়ে দিতেন মাঝু তোমার বাবার প্লেটে পিঁয়াজু কোনটা দিয়েছ? রাশেদ সাহেব কড়া ভাজা পিঁয়াজু খেতে চায়না তার জন্যে আলাদা নরম করে ভেজে দিতো। মাঝু বলতো হ্যাঁ বাবা দিয়েছি, আমার বাবা আমি কি জানিনা আব্বুকে কি দিতে হবে? তুমি তাড়াতাড়ি মরিচ ভেজে দাও। গোলান বেসন মাখা মরিচ ভাজা তার প্রিয়। মাঝু জানে আর কারো জন্যে না হোক বাবার জন্যে অন্তত চারটা মরিচ ভাজতেই হবে। ইফতারের সময় হয়ে যাচ্ছে বাবা আসছে না মাঝু ফোন করে খবর নিতো। আব্বু তুমি কোথায়?
হ্যাঁ আব্বু আমি আসছি, এইতো মসজিদ পর্যন্ত এসেছি। তাড়াতাড়ি আস ঘড়ি দেখেছ?

এক গ্লাস ক্যান্ডিরালের সরবত। ভেজানো চিড়া, বেল, কলা, পেঁপে, তরমুজ, লেবু না থাকলে ছাদের টবের লেবু গাছ থেকে লেবু পাতা এনে তাই শরবতের সাথে ডলে দেয়। মাঝে মাঝে পুদিনা পাতা যখন যা পেতো তাই দিয়ে বাবার জন্যে এক গ্লাস ক্যান্ডিরালের সরবত। যূথী ইফতারে পিঁয়াজু, ঘুমনি, ছোলার চেয়ে আলুর চপ বেশি পছন্দ করে তাই সে সবসময় একটা চপ যূথীকে তুলে দিত। চপ নিয়ে যূথী আর ওর দাদার হইচই। দাদা বলে আমার দাঁত নেই তাই আমি চপ খাই তুমি চপ পছন্দ কর কেন? তুমি পিঁয়াজু খাও সব চপ আমার। টেবিলে প্লেট গ্লাস সাজানোর কাজটা করে যূথী আর মার সাথে থাকে খুকু। আবার ওদিকে ইফতার নামাজ সেরে মা একটু শুয়ে বিশ্রাম না নিলে অস্থির হয়ে পড়ে। এমনিতেই সে শ্বাসকষ্টের রুগী, তার বিছানাটাও যূথী করে রাখে। আজ কি করেছে না কি ভুলে গেছে? মনি কি আজ ইফতারের পরে একটু শুতে পেরেছিলো? ইফতারের পরে নামাজ সেরে সবাই আবার টেবিলে এসে বসতো বড় এক থালায় করে পিঁয়াজু, ঘুমনি, ছোলা, চপ, কুচানো ধনে পাতা কিংবা পুদিনা পাতা যেদিন যা থাকে কাঁচামরিচ, টমাটো রাখা থাকে। এই থালাটাও মনি কিনেছিলো। বড় দেখে, শুধু ইফতারের জন্যে। সবাই খেয়ে যা থাকে তাই দিয়ে এবার মুড়ি মাখানোর পালা। এটা করতো সেঝ ভাই। এইসব মাখামাখি ভর্তা ইত্যাদি ও যা বানায় তা মনে রাখার মত। ও না থাকলে মাঝু। এই থালাটাও মাঝুই গুছিয়ে রাখত। টেবিলের মাখানো মুড়ির গন্ধটা যেন নাকে আসছে। সামনে ওই তো একটা পেয়ালা হাতে খুকু বলে উঠলো আব্বু ধর। তার বিহীন যোগাযোগটা কিভাবে যেন ছিঁড়ে গেলো। হঠাৎ চমকে উঠলেন। সামনের ঘড়ি বলছে আমি আর মাত্র দশ মিনিট সময় দিতে পারি উঠে পর রাশেদ। হাতের সিগারেট দুই আঙ্গুলের ফাঁকেই নিভে গেছে। আবার জ্বালালেন। ছাদের দিকে তাকিয়ে পর পর কয়েকটা টান দিয়ে এ্যাশট্রেতে নিভিয়ে কাপর বদলে নিচে চললেন।

নক্ষত্রের গোধূলি-৪৫

৬৩।
রাশেদ সাহেব উপরে এসে যোহর আসর দুই ওয়াক্তের নামাজ পড়েই বিছানায় গড়িয়ে পরলেন। ক্লান্ত লাগছে। বিছানার সামনে দেয়াল ঘড়িতে দেখলেন তিনটা দশ। কখন যে চোখ বন্ধ হয়ে এসেছে, ঘুম ভাঙল নুরুল ইসলামের ডাকে।
-কি ভাই সাহেব ইফতার করবেন না? উঠেন উঠেন সময় নাই।
লাফ দিয়ে উঠে বাথরুম থেকে ওযু করে নিচে গিয়ে দেখে ইফতারের আয়োজন চলছে। আসাদ বললো-
-ভাই আপনি ওই ওখানে দেখেন গ্লাস আছে. ওই যে ওই বারের ভিতরে। ওখানে সিংক ও আছে ওখান থেকে কয়েক গ্লাস পানি আনেন।
গ্লাস ভরে আনতে যাবে আবার আসাদ বললো –
-আরে ওখানে ট্রে আছে তো! ট্রেতে করে আনেন।
-ওহ! হ্যাঁ হ্যাঁ দেখেছি।
ট্রেতে করে গ্লাস নিয়ে এসে সবার সামনে একটা একটা করে নামিয়ে রেখে নিজে বসল এক পাশে।
-রোজা আজ কয়টা যাচ্ছে?
-২৬টা।
-দেখতে দেখতে চলে গেলো।

রাশেদ সাহেব রোজার দিনে তার বাড়ির ইফতারের টেবিলে সবাইকে নিয়ে বসে এক সাথে রোজা সম্পর্কে কিংবা অন্যান্য ধর্মীয় প্রসঙ্গে আলোচনা করতেন, বিশেষ করে মেয়েদের শিক্ষা দেবার জন্যে। তার কথা হলো ইফতার তৈরি করে অন্তত কিছুক্ষণ আগেই যেন সবাই ধীরে সুস্থে টেবিলে এসে বসে। ইফতারির সময় এত হুলুস্থুল করার কি দরকার? ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন আরও আট দশ মিনিট বাকি আছে। তিনি সবাইকে উদ্দেশ্য করে রোজার শেষ কয়দিনের সম্পর্কে বলতে শুরু করলেন। সবাই কথা থামিয়ে তার দিকে মনোযোগ দিয়ে শুনছে। বলা শেষ করে বললেন আসেন আমরা সবাই এবারে একটু মুনাজাত করি। মুনাজাত শেষ হবার সাথে সাথেই কবির বললো –
-টাইম হয়ে গেছে নিয়ত করেন।
আজকেও গতকালের মত খেজুর, ছোলা ভুনা আর পায়েসের মত দেখতে হলুদ রঙের স্বাদহীন খিচুরি। রাশেদ
সাহেব এই স্বাদ বিহীন খিচুরি খেতে পারলেন না।
মারুফ বললো –
-তাহলে ভাই সাহেব আপনে আর একটু ছোলা নেন।
-তা নেয়া যায়।
-যদি মনে করেন তাহলে ভাত খেয়ে নিতে পারেন তরকারি রেডি আছে।
-না ভাত লাগবে না এতেই হবে।
ইফতার করতে করতে নুরুল ইসলাম বললো –
-ভাই সাহেব খুব সুন্দর মুনাজাত করলেন। যে কয়দিন আছে এইভাবে করবেন। সবাই একসাথে বলে উঠলো হ্যাঁ হ্যাঁ আগে কিছু বলে নিবেন। আজকের মত ইফতারের সময় আর গল্প হবে না। কাল থেকে ভাইছাব মুনাজাত করবে।
-আচ্ছা, নামাজ কি সবাই আলাদা আলাদা পরেন?
-হ্যাঁ অই আরকি যে যেমনে পারে।
-তা কেন, উপরে বেশ জায়গা আছে ওখানে সবাই এক সাথে পড়া যায়। চলেন সবাই এক সাথেই পড়ি এমনিতেই আমরা অনেক কিছু জেনেও না জানার মত চলি। মানার মত ব্যবস্থা থাকলেও মানি না। কত কিছু ইচ্ছা করেই হোক বা অনিচ্ছা করেই হোক ছেড়ে দিই। জামাতে সওয়াব বেশি এটা যদি পারি তাহলে করবো না কেন?
-আচ্ছা চলেন তাহলে আপনে যখন বলছেন।
উপরে এসে নামাজ পড়ে রাশেদ বললো –
-আমার একটু চা লাগবে আমি নিচে যাই আপনারা কেও আসবেন?
-হ্যাঁ আসছি চলেন।

নক্ষত্রের গোধূলি-৪৪

৬১।
যাক, আল্লাহর রহমতে মনি ঠিকভাবে পৌঁছেছে। আলহামদুলিল্লাহ! এসে জানালার পাশে দাঁড়ালো। কাল রাতে যেখানে এতো হৈ চৈ ছিলো এখন সেখানে নীরব। কেও নেই। রাস্তা দিয়ে দুই একটা গাড়ি যাচ্ছে এই শুধু। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল আকাশ মেঘে ঢাকা। কিন্তু বৃষ্টি নেই রাস্তায় লোকজন নেই এ আবার কেমন দেশ? ভাবছিলো রাশেদ সাহেব। এখন কি করবে কোথাও যাবার জায়গা নেই কিছু চেনা নেই। এই ভাবেই চলবে আস্তে আস্তে চেনা জানা হবে হয়তো। কত দিন এখানে থাকতে হবে বা থাকা যাবে তা সে জানে না। তবে এটা জানে যে এদেশের রানী তার জন্য দরজা খুলে বসে নেই। ভিসার মেয়াদ যতদিন আছে ততদিন নিশ্চিন্ত। তারপর কি হবে? কখনো ধরতে পারলে পাঠিয়ে দিবে এইত? তা যদি দেয়ই দিবে। জোড় করে তো থাকা যাবেনা। ভাগ্যকে মেনে নিতেই হবে। কতক্ষণ এই ভাবে দাঁড়িয়ে ছিলো খেয়াল নেই। নুরুল ইসলাম উঠে পড়েছে।
-কি ভাই সাব কি দেখেন?
-না কি আর দেখব এই দাঁড়িয়ে থাকা আর কি, এছাড়া কি করব সবাই ঘুমে।
-হ্যাঁ সবাই সাধারণত সারে এগারোটা পর্যন্ত ঘুমবে। এখন এগারোটা বাজে। আজকে তো আপনাদের সারে এগারোটায় নামতে হবে, সব কিছু আটাইয়ে নিতে হয়তো তাই।
-প্রতিদিন সারে এগারোটায়?
-না শুধু শুক্র শনি বারে, অন্যদিন বারোটার দশ মিনিট আগে নামলেই হয়। আজও কিন্তু কালকের মত কিংবা কালকের চাইতে বেশি বিজি হবে।

৬২।
রাশেদ সাহেব একটু ভয় পেলেন কি ভাবে কুলাবেন বুঝতে পারছেন না। দেখা যাক যা হোক একটা কিছু হবে। এতো ভয়ের কি আছে? এবারে বিছানায় এসে একটু কাত হয়ে শুয়ে পরলেন। কিছুক্ষণ এভাবে থেকে সামনের দেয়াল ঘড়িতে এগারোটা পঁচিশ দেখে উঠে প্যান্ট সার্ট বদলে নিচে নেমে একটা এপ্রণ গায়ে কিচেনে ঘুরে দেখে বুঝার চেষ্টা করে দেখলেন কি কি করতে হবে। রাতের আর সেহেরির তরকারির ডেকচি গুলি ধুয়ে রাখলেন। ছেলা পিঁয়াজের ড্রামটা অর্ধেক খালি হয়েছে। ভাবলেন এক বস্তা এনে রাখি। স্টোর থেকে বের হতেই ঠাণ্ডার একটা ধাক্কা লাগলো গায়ে। মনে হলো সমস্ত শরীরে সুই বিঁধিয়ে দিয়েছে কেও। ঝট পট এক বস্তা পিঁয়াজ এনে রাখলেন কিচেনের সাথের স্টোরে। এসে দেখে মারুফ পিঁয়াজ কাটছে। পিঁয়াজ কাটার ধরনটা তার কাছে বেশ ভাল লাগল। একটা চপিং বোর্ডের নিচে ভেজা কাপর বিছান, তার পাশে টেবিলের উপর প্রায় এক বালতি ছেলা পিঁয়াজ। একটা একটা করে নিয়ে কাটছে আর টেবিলের নিচে বোর্ড বরাবর একটা বালতিতে ছেড়ে দিচ্ছে। রাশেদ সাহেবকে দেখে বললো –
-ভাইছাব এক বস্তা পিঁয়াজ আনতে পারবেন?
হ্যাঁ এইতো নিয়ে এলাম ওপাশে রেখেছি।
-আচ্ছা বেশ, এখন এই যে এ ড্রয়ারের ভিতরে ছুরি ওখান থেকে একটা নিয়ে যান ওগুলি ছিলতে থাকেন। আপনে দুইটা পিঁয়াজ নিয়ে আসেন আমি দেখিয়ে দেই কিভাবে ছিলবেন।
দুই তিন টা পিঁয়াজ নিয়ে এসে মারুফের সামনে রাখতেই এপাশে ওপাশে কেটে দেখিয়ে দিল আবার বললো ওই যে বিন ওইটা নিয়ে যান খোসাগুলি এতে ফেলবেন আর ছেলা গুলি রাখার জন্যে একটা বালতি নিয়ে নেন বালতি ভরলে আমাকে দিয়ে যাবেন। এদেশের পিঁয়াজগুলি বেশ বড় বড়।
রাশেদ সাহেব মারুফ কে বললেন-
-এই এতদিনে ওসি ডিসির মানে বুঝলাম।
মারুফ বললো-
-কিরকম।
-শোনেন তাহলে, ছেলে বিদেশে লাখ টাকা কামাচ্ছে শুনে বাবা খুব খুশী। একবার জানতে চাইলেন বাবা তুমি কি কর, কি কাজ তোমার? তখন ছেলে লিখে পাঠাল বাবা আমি এখানে ওসি ডিসির কাজ করি। তা মারুফ ভাই আপনি আমাকে সেই ওসি ডিসি বানালেন? মানে অনিওন কাটার এন্ড ডিশ ক্লিনার!
-ও আচ্ছা আচ্ছা, হ্যাঁ ভাই কি আর করা যাবে দেখেন না আমরাও তাই করি। আপনি কি মনে করেছেন আমি এসেই সেফ বা তন্দুরি সেফ হয়ে গেছি? না আমিও ওই কিচেন পোর্টার থেকে শুরু করেছি এবং শুধু আমি না এদেশে যত সেফ দেখবেন তা সেফই হোক আর মালিকই হোক সবাই এই একই কাজ থেকে শুরু করেছে। নয়তো কুমি ওয়েটার থেকে। কুমি ওয়েটার কি জানেন?
-না।
-শুধু কুমি ওয়েটার বলি কেন সব ওয়েটারকেই টয়লেট পরিষ্কার করতে হয়।
-বলেন কি সুইপার নেই?
-আরে না সুইপার রাখলে বেতন কত হবে জানেন? তার বেতন দিতে গেলে মালিকের লাভ শেষ আর ব্যবসা চলেনা। মালিক নিজেও করে আপনি যদি সামনের কাজ নেন আপনাকেও করতে হবে। কিচেনের কাজে বেতন বেশি তবে কষ্টও বেশি আপনি কুলাতে পারবেন না। আপনি দেশে কি করেছেন তা না বললেও আমরা বুঝতে পারছি। আমরা কাল রাতে আপনাকে নিয়ে আলাপ করেছি। আপনি এ কাজ পারবেন না আপনার জন্য এ কাজ না। দেখি আমিও দেখছি আপনিও দেখেন সামনে একটা কাজ জোগাড় করে নেন। ওখানে আরামে থাকতে পারবেন নয়তো শেষ হয়ে যাবেন। সামনেও পরিশ্রম আছে তবে কিচেনের মত না। ওখানে সুট টাই পরে সেন্ট মেখে কাজ করবেন সাহেবের মত। সাহেব মেম সাহেবদের সাথে ইংরেজিতে কথা বলবেন।

এমন সময় কবির আর দেলোয়ার কথা বলতে বলতে কিচেনে ঢুকে বললো-
-রাশেদ কার নাম? ভাই সাহেব আপনার নাম রাশেদ নাকি?
-হ্যাঁ আমিই রাশেদ, কেন?
-আপনার ফোন।
-কোথায়?
-ভিতরে যান, না না এভাবে না এপ্রণ খুলে রাখে যান।
-ও আচ্ছা।

এপ্রণটা খুলে দরজার বাইরে হুকে ঝুলিয়ে রেখে ভিতরে গিয়ে ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে ফিরোজের কণ্ঠ-
-কি রাশেদ কি খবর?
-ভাল।
-কাজ শুরু করেছ?
-হ্যাঁ সে তো কাল এখানে আসার সাথে সাথেই শুরু।
-আচ্ছা ঠিক আছে, আমি কাল ফোন করিনি কারণ আমি জানি অবস্থা। যাক কেমন লাগছে কষ্ট হচ্ছে?
-হ্যাঁ তা তো বুঝতেই পার। ডেকচি মাজতে মাজতে হাতের আঙ্গুলে বেশ কেটে কুটে গেছে।
-কেন গ্লোভস নেই? তুমি বল গ্লোভস দিতে, গ্লোভস পরে করবে এসব। এখন কি আর করবে, আপাতত করতে থাক সাবধানে কর কষ্ট তো একটু হবেই। আচ্ছা আমি মাঝে মাঝে ফোন করব। তোমাকে যেদিন অফ দিবে সেদিন ঘরে বসে থাকবে না মন খারাপ হবে। কাপর চোপর ধুবে, বিছানা পত্র ঘর গুছাবে, বাইরে বের হবে, ঘুরবে দেখবে সময়মত এসে খেয়ে যাবে। মন ভাল থাকবে আর দেখবে আসে পাশে লাইবেরি কোথায় যে কোন লোককে বললেই দেখিয়ে দিবে। সেখানে যাবে। তোমার পাসপোর্ট দিয়েই হবে, বলবে আমি ভিজিটর। ইন্টারনেট ব্রাউজ করতে পারবে, বাসায় মেইল পাঠাবে। ভাল কথা, বাসায় ফোন করেছ? ভাবীর খবর কি?
-ও পৌঁছেছে অসুবিধা হয়নি।
-তো ঠিক আছে আজকে রাখি তাহলে। ফোন করবে মাঝে মাঝে। দরকার মনে করলে আসে পাশেই দেখবে কয়েন ফোন বক্স আছে সেখান থেকে তুমিও ফোন করতে পার আমাকে। আমি বাসায় না থাকলে তোমার ভাবী তো থাকবে কি দরকার বলে দিও।
-আচ্ছা।
-ফোন টা রেখে আবার পিঁয়াজ ছেলা শুরু করতেই কুইক করেন ভাইছাব। দেলোয়ারের তাগিদ। পনের মিনিটে এক বস্তা পিঁয়াজ ছিলতে হবে, বুঝলেন? কুইক, কুইক করেন।
-হবে ভাই হবে একটু সময় তো দিবেন।
-কথা বাদ দেন কুইক করেন, হাত চালান।
মারুফের পিঁয়াজ কাটা শেষ। এখানে যে কয়টা ছেলা হয়েছে সেগুলিও শেষ। এবারে মারুফও ছেলার কাজে হাত দিয়ে তাড়াতাড়ি বস্তা শেষ করে আবার কাটা কাটিতে লেগে গেলো।
এবার কবিরের হুকুম-
-ভাইছাব করে থেকে একটা ডেকচিতে করে আট পট চাউল এনে ধুয়ে দেন।
-করে মানে?
-ও! করে মানে পিছনে।
-আচ্ছা।
চাউল এনে ধুয়ে দেয়ার আগেই-
-এই যে ভাই এই কিমা গুলি মাখান তো।
শুধু রাশেদ সাহেব নয় সবাই বিজি কারো নিশ্বাস ফেলার সময় নেই।
মারুফ বললো –
-ভাই এক ফাঁকে রাতে আর সেহেরির জন্যে ওই ফ্রিজ থেকে এক পোটলা মাছ আর এক পোটলা চিকেন বের করে পানিতে ভিজিয়ে রাখবেন আর এখন আমাকে কয়েকটা টমাটো আর দুই তিন টা লাল পিঁয়াজ দেন।

এর মধ্যে বিরাট এক ডেকচিতে সদ্য কাটা সব পিঁয়াজ বিভিন্ন মশলা, লবণ, টমাটো আরও কি কি সব দিয়ে চুলায় দিয়ে দিল।
-এটা কি হবে ভাই?
-এটা হচ্ছে গ্রেভি, এগুলি দিয়েই কারি রান্না হবে।

রাশেদ সাহেব বুঝলেন ফ্রাইংপ্যানে চামচ দিয়ে যে জিনিস দেয়া হয় তাহলে এই সেই। এটা হলো কারির ঝোল। ওদিকে একজন বড় এক গামলায় করে মুরগির মাংস মশলা দিয়ে মাখাচ্ছে। একজন আবার একটা সিংক এর ভিতর দিকটা পরিষ্কার করে তার মধ্যে ময়দা ছেড়ে দিল বস্তা থেকে। তার মধ্যে ডিম, লবণ, চিনি, কালিজিরা, বেকিং পাউডার এসব দিয়ে মাখাচ্ছে।

এই যে ভাই এই গুলি ধুয়ে দেনতো, আরে ভাই দেখে আসেন তো ওই ওখানে কড়াইতে ফুলকপি কত গুলি আছে দেখেন। কুইক করেন। আচ্ছা ভাইছাব এই যে দেখেন এইরকম তিনটা কৌটা নিয়ে আসেন স্টোর থেকে। হ্যাঁ ঠিক আছে। আচ্ছা উপরের টয়লেটের পাশে যে রুম ওখানে দেখবেন এই যে ভিম পাউডার এই গুলি আছে এরকম দুইটা নিয়ে আসেন। ভাইছাব এইগুলি একটু কুইক ধুয়ে দেন। শ্বাস ফেলার সময় নেই। হুলস্থূল ব্যাপার। যাক মোটামুটি দুইটার মধ্যে একটু হালকা হলো। মারুফ বললো-
-ভাই সাহেব রান্না করতে পারেন?
-আসলে রান্না করার তো কখনও প্রয়োজন হয়নি তাই চেষ্টা করা হয়ে উঠেনি।
-আচ্ছা ঠিক আছে শিখিয়ে নিব।
-হ্যাঁ তাতে আপত্তি নেই।
-ঠিক আছে কাল দেখিয়ে দিব আপনে রান্না করবেন। এখন কিচেন টা একটু ব্রাশ করে শেষ করে উপরে চলে যান।
কয়েকটা চুলা সমানে জ্বলছে। কোনটায় গ্রেভি, কোনটায় মুরগী, কোনটায় ভেড়া আরও কি কি যেন। রাশেদ সাহেব বললেন-
-আপনি যাবেন না?
-না আমার যেতে একটু দেরি হবে আপনে যান।
-না কি দরকার চলেন এক সাথে যাই।
-না আপনি টায়ার্ড, নতুন তো রেস্ট নেন।
-না চলেন একসাথে যাই।

এই বলে টেবিলের উপর উঠে বসল।
বাড়ি কোথায়, কবে এসেছে মানে তাকে যা যা বলেছে সবাই সেও তাই জানতে চাইল। মারুফ সুনামগঞ্জ থেকে এসেছে। ওখানে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে বেকার ঘুরছিলো এদেশের এক মেয়ের সাথে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে বাবা। আর দেরি না করে লন্ডনি মেয়ে বিয়ে করে তার আঁচল ধরে চলে এসেছি চার বৎসর আগে, আমরা তো আর অন্য কোন কাজ পারি না লেখাপড়াও তেমন নেই তাই এই কাজই করি। তবে ভালই আছি বাড়ি কিনেছি। না না এক বারে না। মাসে মাসে কিস্তি দেই। গাড়ি কিনেছি।
-ও আচ্ছা, ওই যে পিছনের গাড়িটা?
-হ্যাঁ হ্যাঁ ওইটাই আমার। আমি এইতো সোম বারে রাতে ডিউটি শেষ করে আমার অফ আমি গাড়ি নিয়ে লন্ডন চলে যাব। সেফ আসবে মঙ্গলবারে। আবার বৃহস্পতিবার বিকেলে এসে ডিউটি করব।
-আচ্ছা, আপনার ওয়াইফ তাহলে লন্ডন থাকে, কতক্ষণ লাগে লন্ডন যেতে?
-বেশি না, দেড় ঘণ্টার মত। ওই যে কবির, ওকে দেখছেন ও এসেছে তিন বৎসর আপনার মত টুরিস্ট হয়ে এসেছিলো এখন বেআইনি।

-উনি বেআইনি কেন থাকবে? দেখে টেখে একটা বিয়ে করিয়ে দেন আপনাদের সবাই এদেশে অনেক জানাশোনা। ওর একটা গতি হোক। ওর বাড়ি কি আপনার এলাকায়?
-হ্যাঁ সেই জন্যেই একটু মাথা ব্যথা। খুঁজছি কিন্তু পাইনা সেরকম।
-আর দেলোয়ার?
-না ও টেম্পোরারি। সেফ নেই তাই ওকে আনা হয়েছে। সেফ এলেই ওকে বিদায় দেয়া হবে দেখবেন ওকে কিন্তু আবার একথা বলবেন না। দেখেন না আপনার সাথে কেমন ব্যবহার করে তবুও আমরা কিছু বলি না।
-না আমি আর কি বলতে যাব? আচ্ছা, দুপুরে মালিকেরা কেও আসেনা?
-আসে তো, দেখেন নাই? ও! তখন আপনে স্টোরে ছিলেন। ওরা সামনে কাজ সেরে চলে যায়। সেফ না থাকলে এদিকে খুব একটা আসেনা। দেখি আমার গ্রেভির কি অবস্থা!

টেবিল থেকে নেমে যা যা জ্বাল হচ্ছিল সব কিছু দেখে একটা একটা করে চুলা নিভিয়ে দিয়ে বললো-
-চলেন যাই।
এক সাথেই উপরে চলে এলো দুই জনে।
-আসেন একটু বসেন।
আমতা আমতা করে বললো-
-নামাজ পড়া হয়নি।
-ও না না ঠিক আছে নামাজ পড়েন গিয়ে পরে আলাপ করা যাবে।

নক্ষত্রের গোধূলি-৪৩

৬০।
সকালে নয়টার দিকে ঘুম ভাঙলেও উঠি উঠি করে আবার ঘুমিয়ে পরেছেন। প্রায় ঘণ্টা খানিক পর ঘড়ির দিকে তাকিয়েই লাফ দিয়ে উঠে পরলেন ফজরের নামাজ পড়ার জন্য। নামাজ পড়ে মনে হলো এখন দেশে কয়টা বাজে? হ্যাঁ এখন দুপুর একটা। ফোন করা দরকার। কার্ডটা নিয়ে ফোনের কাছে গিয়ে নাম্বার ঘুরাতেই ওপাশ থেকে খুকুর কণ্ঠ কানে এলো।
-হ্যালো, আব্বু কি খবর তোমাদের?
-হ্যাঁ আব্বু আম্মু এসেছে। সেঝ কাকু এয়ারপোর্টে গিয়েছিলো কিন্তু আম্মু জানে না। আম্মু কায়সার চাচার সাথে বেরিয়ে পড়েছিলো। পরে উনার সাথে উনার বাসায় আজিমপুর পর্যন্ত যায় সেখানে উনি নেমে গেলে আম্মু ওই ট্যাক্সিতেই চলে এসেছে।
-ও আচ্ছা, যাক নিশ্চিন্ত হলাম। তোমার মা কোথায় আব্বু?
-আম্মু খুব টায়ার্ড, এসেই গোসল করে খেয়ে দেয়ে একটু শুয়ে আমাদের সাথে কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পরেছে। তুমি কেমন আছ আব্বু?
-হ্যাঁ আব্বু আমি ভাল আছি।
-কাজ করতে পারছ?
-হ্যাঁ আব্বু করতে হবে তাই পারছি।
-তোমার ঠিকানা কি আব্বু?
-আব্বু আমি ঠিকানা আর সব জানিয়ে মেইল পাঠাব। দেখি ইন্টারনেট কোথায় আছে পাই নাকি, ফোনে তো এতো কথা বলা যাবেনা। এখন রাখি আব্বু?
-ঠিক আছে তবে তুমি সাবধানে থেকো আর খাবার ওষুধ এসব সময়মত খেয়ো মনে করে। দেখো ডায়াবেটিস যেন ঠিক থাকে।
-আচ্ছা আব্বু তোমার মা উঠলে বলবে যেন চিন্তা না করে আর তোমরা সাবধানে থাকবে, রাখি আব্বু আল্লাহ হাফেজ।

নক্ষত্রের গোধূলি-৪৩

৫৮।
হাতের কাপটা নিয়ে বাইরে থেকে শব্দ আসা জানালার পাশে দাঁড়ালেন। তখন দিনের বেলা যে পাব দেখেছিলেন সেই পাবের সামনে মহিলা পুরুষ মিলে দশ বারোজন। এর মধ্যে আবার কেও ভিতরে যাচ্ছে কেও বাইরে আসছে। এদেরই হৈ চৈ। পাবের ভিতর উচ্চ শব্দের বাজনাও শোনা যাচ্ছে। কাল পরশু ছুটি তাই আজ কাজের শেষে পানের উন্মাদনায় মেতে উঠেছে। এই জন্যই তাহলে এখানে শুক্র শনি বারে এতো ব্যস্ত! এই হলো এদের আনন্দ ফুর্তি। এরা তাহলে আনন্দের জন্য ভিড় করে পাব আর নাইট ক্লাবে? আর আমাদের দেশে এমন দুই দিন ছুটি পেলে ভিড় দেখা যায় বাস আর লঞ্চে। সবাই ছুটে যায় নিজ নিজ আপন জনের কাছে। এরা আনন্দ ভোগ করে নিজে নিজে, একা একা আর আমরা করি সবাইকে নিয়ে অন্তত আপনজনকে নিয়ে। এই জন্যেই আমাদের এতো কষ্ট। এদের আঘাত করার কেও থাকেনা আর আমরা আঘাত পাই পায়ে পায়ে। মানে আপন জনের কাছে যেমন করে যা আশা করি ঠিক তেমন করে তা পাওয়া হয়ে উঠে না একটু হয়তোবা এদিক সেদিক হয়ে যায় হয়তো আমি ঠিক যেভাবে যা চাইছি সেভাবে পাইনি তাই বলে একেবারে যে পাইনি তা নয় হয়তো বা বেশিই পেয়েছি তখন ব্যবধানটা হয়ে দাঁড়ায় শুধু অভিমানের। আর এদের বেলায় ব্যাপারটা ভিন্ন এদের তো কারো কাছ থেকে কিছুই পাবার নেই যা করছে তা নিজেই করছে নিজের কাছ থেকেই আনন্দ বা দুঃখ যাই হোক পাচ্ছে। সারা রাত পান করে নিজের অনুভব অনুভূতি হারিয়ে ফেলে ভাবছে সব পেয়েছি, কিছুই অবশিষ্ট নেই।

৫৯।
নিচে থেকে ডাকছে, দুইটা বেজে গেছে! হ্যাঁ তাইতো, ওদিকে পাবের সামনের জটলা কমে গেছে ভিতরের বাজনাও থেমে গেছে। দুই এক জন করে পাব থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। রাশেদ সাহেব নিচে নেমে এলেন সেহেরি খাবার জন্যে। দুই এক জন করে সবাই নেমে এলো। সবাই যা করছে সেফ এর পিছনের লম্বা টেবিলের মত তার নিচের সেলফে ভাত তরকারির ডেকচি ওখান থেকে যার যার মত ভাত তরকারি নিয়ে পিছনের মাইক্রোওয়েভে গরম করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই খাচ্ছে। পানি খাবার কোন গ্লাস নেই। যে কন্টেইনারে করে টেক এওয়ে নিয়ে যাবার ভাত দেয় সেটাতে করে পানি নিয়েছে সবাই। রাশেদ সাহেব গত রাতে যে গ্লাসে কোক খেয়েছিলেন সেখান থেকে একটা গ্লাস ধুয়ে তাতে পানি নিয়ে এক পাশে টেবিলের উপর ভাতের প্লেট নামিয়ে আস্তে আস্তে খেতে শুরু করলেন। কবির বললো –
-কি ভাই বাড়ির কথা মনে হইতেছে? খান না কেন?
-খাচ্ছি তো। আমি এতো তাড়াতাড়ি খেতে পারিনা একটু আস্তে আস্তেই খাই।
-ও আচ্ছা ঠিক আছে খান খাওয়া হলে এগুলি ঢেকে রেখে লাইট নিভিয়ে আসবেন। আমরা তাহলে যাই।

সেহেরি শেষ করে কবির যেভাবে বলেছে সেই ভাবে সব রেখে এক কাপ চা নিয়ে উপরে এসে বিছানার উপর বসে ওষুধের প্যাকেট বের করলেন। ওহ! পানি তো আনা হয়নি! আবার নিচে গিয়ে এক গ্লাস পানি নিয়ে এলেন। একটা জগ বা অন্তত একটা বোতল হলে পানি এনে রাখা যায়। দেখি কাল সকালে কবির বা নুরুল ইসলামকে বলে ব্যবস্থা করা যাবে। এখন এ ভাবেই চলুক। ওষুধ খেয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিলেন। বালিশের নিচে থেকে তামাকের প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট বানিয়ে জ্বালালেন।
বাড়িতে খুকু তার দুই বোনকে নিয়ে কি করছে? না খুকুকে নিয়ে এতো ভাবার কিছু নেই মনে হয়। খুকুর ছোট খালা আর নানুকে রেখে এসেছে তারা ভালই আছে। রাত প্রায় তিনটা বাজে। না এখন ভাবার সময় নেই। চা শেষ, সিগারেটটায় শেষ টান দিয়ে এ্যাশট্রেতে ফেলে দিয়ে শুয়ে পরলেন। কম্বলটা টেনে নিয়ে স্বভাব মত ডান দিকে কাত হয়ে শুয়ে পরলেন। এমন সময় নুরুল ইসলাম এসে বললো –
-কি ভাই ঘুমিয়ে পরেছেন?
-না এখনও ঘুমাইনি।
নুরুল ইসলাম কি যেন বলছিলো কানে ঢুকেছিলো কিন্তু জবাব দেয়া হয়নি। সারা দিনের ক্লান্তি আর অবসাদে কখন যে শ্রান্ত শরীরে ঘুমিয়ে পরেছে তা আর বুঝতে পারেনি।

নক্ষত্রের গোধূলি-৪২

৫৭।
রাশেদ সাহেব উপরে এসে নিজের বিছানায় বসলেন সারা দিনে নামাজ পড়া হয়নি। তাড়াতাড়ি বাথরুমে গিয়ে ওজু করে রুমে আসতে আসতে পানি শুকিয়ে গেছে আর তোয়ালে বের করার দরকার নেই। কিন্তু জায়নামাজটা মনে হয় বের করতে হবে। একটু এদিক ওদিক তাকাতেই চেয়ারের উপর দেখলেন জায়নামাজ। দেখে বুঝলেন নুরুল ইসলামের হয়তো হবে এটা। এখন কেবলা? না এবার তো নিচে যেতেই হবে। নিচে গিয়ে দেখে সবাই তাস নিয়ে বেশ ভাল জমিয়ে নিয়েছে।
-আচ্ছা ভাই কেবলা কোন দিকে?
নুরুল ইসলাম ওই ঘরেই দেখিয়ে দিল এই যে এই দিকে।
উপরে এসে নামাজ পড়ে নিলেন।
এতো রাত হয়েছে তবুও বাইরে নারী পুরুষের হৈ চৈ হাসা হাসির শব্দ শোনা যাচ্ছে। জানালার ডবল কাচ ভেদ করে সে শব্দ আসছে। দেখার মত কৌতূহল নেই। বেশিক্ষণ বসলেন না। উঠে সুটকেসটা খুলে লুঙ্গি আর শোবার কাপর চোপর টুকি টাকি বের করে টেবিলের উপর রাখলেন। কাপর বদলে বিছানায় বসে একটা সিগারেট বানালেন। ঘরটা বেশ ঠাণ্ডা, মনে হয় হিটার নেই। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে তার বেডের পাশেই তো হিটারের রেডিয়েটার। রেডিয়েটার ছুঁয়ে দেখলেন ঠাণ্ডা। তার মানে কাজ করছে না। যাক এ নিয়ে মাথা ব্যথা নেই। তেমন ঠাণ্ডা লাগছে না গায়ে তো থার্মাল পাজামা আর থার্মাল ফুল স্লিভ গেঞ্জি রয়েছে। বালিশে হেলান দিয়ে সিগারেট টানতে টানতে আস্তে আস্তে একটা একটা করে সারা দিনের সব ছবি গুলি মাথায় এসে ভিড় করলো। মনি কোথায়? ঘড়ির দিকে তাকাল। দেড়টা বাজে। মনি এখন কুয়ালালামপুরে। ও কি ঠিক ঠাক মত চেক আউট করতে পেরেছে? হোটেলে যাওয়া এসব কি করতে পেরেছে? প্লেনে কি শ্বাসকষ্ট হয়েছিলো? কি করেছে তা হলে? না কিছুই হয়নি, মনি ভালোই আছে এবং কুয়ালালামপুরে হোটেলে শুয়ে আছে। তবে ঘুমুতে পারছেনা। যাক ও ভাল থাকুক ভাল ভাবে দেশে গিয়ে পৌঁছুক। একটু চা হলে ভাল হোত। আবার নিচে গিয়ে কবিরকে বললো –
-ভাই চায়ের ব্যবস্থা আছে নাকি?
-নিচে যান, লাইট জ্বালাতে পারবেন? নেমেই ডান দিকে সুইচ, লাইটটা জ্বালিয়ে সামনে টেবিলের পাশে দেখবেন কেটলি আর পাতা দুধ চিনি এগুলি আছে। কেটলির নিচের সেলফের ভিতর কফিও আছে যা ইচ্ছা খেয়ে আসেন।
-আপনারা কেও খাবেন?
-এইতো একটু পরেই তো সেহেরি খাবো তখন একবারে খাবো।
-তাহলে আমি এখন একটু খেয়ে আসি তখন না হয় আপনাদের সাথে আবার এক কাপ খাবো।
-তা খাবেন। খাবার ব্যাপারে কোন নিষেধ নেই। যখন যা ইচ্ছা খাবেন তবে একটা কথা মনে রাখবেন এখানে সবাই কাজের জন্য বলবে কিন্তু কেও আপনাকে খেতে বলবে না কাজেই সেটা নিজেকেই করতে হবে।
-হ্যাঁ ঠিক বলেছেন এটাই স্বাভাবিক, ঘরের বাইরে এমনই হয় এতে কিছু মনে করার মত নেই।

আসাদ যে ভাবে বলে দিয়েছে সেভাবেই চা, কেটলি, কাপ সব পেয়ে কেটলিতে পানি দিয়ে সুইচ অন করে দিয়ে কিচেনটা আবার একটু চোখ মেলে দেখে নিলেন। এর মধ্যে পানি ফুটে উঠলে কাপে ঢেলে লাইটটা নিভিয়ে চামচ দিয়ে নারতে নারতে উপরে নিয়ে এলেন। সে ডায়াবেটিস রুগী, সুইট্যাক্স নিচে নিয়ে যায়নি। উপরে এসে ব্যাগ থেকে সুইট্যাক্স বের করে কাপে দিয়ে নেরে নিয়ে চামচটা পিরিচে নামিয়ে রেখে একটা চুমুক দিতেই মনটা বেশ ভাল লাগল।

নক্ষত্রের গোধূলি-৪১

৫৬।
এই হলো অবস্থা। এর পর আর কিছু বলার প্রবৃত্তি হয়নি। দেখা যাক ধীরে ধীরে যদি কিছু বোঝা যায়, যাবেই এক সময়। কাজের যে চাপ, যে অবস্থা তাতে বাংলাদেশ হলে অন্তত আরও চার জন লোক প্রয়োজন হতো। তাছাড়া আজ একেবারে ভিড়ের মধ্যে এসে পরেছে। কেও কিছু দেখিয়ে দিতেও পারছেনা আর তার নিজেরও হঠাৎ পরিশ্রম হয়ে যাওয়ায় কুলিয়ে উঠতে পারেনি। কয়েক দিন গেলে সব কিছু দেখা চেনা রপ্ত হয়ে গেলে মনে হয় ঠিক হয়ে যেতে পারে। দেখা যাক কি হয় কবির তো বলেছে সব কিছু চেনা জানা হলে কষ্ট কম হবে। দেখা যাক। আর কিই বা আছে দেখার, যেভাবেই হোক এর মধ্যেই সব গুছিয়ে নিতে হবে। আর তো কোন বিকল্প নেই। রাশেদ সাহেবের ধৈর্য এবং সহ্য একেবারে খারাপ নয়।
কি খাচ্ছে কেমন হয়েছে সেদিকে মন দেবার মত সময় এটা নয়। পেট ভরছে কিনা এইই যথেষ্ট। আর সবাই চলে গেছে শুধু আসাদ খাওয়া শেষ করে ওর সাথে বসে আছে।
-ভাত তরকারি নেন, সারা দিন তো খুব ধকল গেছে ভাল করে খান কালকে কিন্তু আরও বিজি হবে।
-হ্যাঁ আর একটু ভাত লাগবে এইতো নিচ্ছি।
বিশাল ডেকচির মধ্যে একটা পিরিচ রাখা যেটা দিয়ে প্রথম ভাত নিয়েছিলো ওটা দিয়েই আবার আরও একটু ভাত নিয়ে একটু ভেড়ার মাংসের তরকারি নিয়ে খেতে খেতে কথা বলছিলো।
-আমি তো মনে করেছিলাম এসব খাবার হয়তো এখানে পাওয়া যাবেনা হয়তো ব্রেড বাটার খেয়ে কাটাতে হবে।
-না তা কেন, এই তো রাতে এক দিন ভেড়া এক দিন মুরগি আর দুপুরে প্রতিদিনই মাছ।
-সকালে?
-না সকালের জন্য এমনি কিছু নেই তবে দেখে নিবেন যা আছে এর মধ্যে আপনার যা ভাল লাগে তাই খেয়ে নিবেন।
-না মানে আপনি বা সবাই কি খায়?
-কেও ব্রেড খায় কেও কর্ণ ফ্ল্যাকস আর দুধ যার যা ইচ্ছা।
-ও আচ্ছা। এখন তো রোজা কাজেই সকালের চিন্তা নেই তাই না?
-না রোজা আর কয় দিন এই তো আর মাত্র তিন বা চারটা আছে হয়তো।
-ঈদে কি এখানেই থাকবেন?
-হ্যাঁ, তাছাড়া আর কোথায় যাব?
-ও ভালো কথা, সেহরির কি ব্যাবস্থা?
-আমরা সাধারণত, এই যে এখন সবাই উপরে উঠে গেছে যেয়ে দেখেন সবাই তাস খেলছে। রাত দুইটা বা আড়াইটার দিকে সবাই এসে সেহেরি খাবে। দেখি সেহরির জন্য আজ কি রান্না করেছে, বলেই নিচু হয়ে রাশেদ সাহেব যে টেবিলের উপর বসে খাচ্ছিলেন ওটার নীচে ডেকচি আছে তাই খুঁজে পেয়ে বললো-
-মাছ আর আলু।
-কি মাছ?
-মনে হয় রুই।
-কি শেষ? ও হ্যাঁ প্লেটটা ওই যে ওই সেলফের মত ওই ব্রাকেটের মধ্যে রেখে দেন। বেশ চলেন এবার।
-আপনার বেড কোনটা দিয়েছে?
-ওইতো তিন তলায়, আর আপনার?
-আমার এই যে গোয়াল ঘরে ওই দরজার বাম পাশে যেটা ওটা।

কথা বলতে বলতে সদ্য শোনা গোয়াল ঘরে ঢুকল। আগে আসাদ পিছনে রাশেদ সাহেব।
-এই যে নয়া ভাইছাব আসেন আসেন তাস খেলতে খেলতে মারুফ বলে উঠল আপনার সাথে তো আজ কথাই বলা হয়নি আসলে আপনেও এমন বিজির মধ্যে আসলেন। তা বলেন কেমন লাগলো? এইতো কালকের দিন গেলেই দেখবেন সব ঠাণ্ডা। শুধু শুক্র আর শনি বারেই যা একটু ঝামেলা তারপর এরকম থাকে না। ঠিক হয়ে যাবে।
কবির বললো-
-না আপনে যান গোসল করলে করে নেন এখন একটা বাজে দুইটায় আমরা পতা খাই আপনে ওই সময় চলে আসবেন আর যদি বসতে চান বসেন।
-না আমি না হয় যাই টায়ার্ড লাগছে পরে অবসর মত আলাপ করা যাবে। আচ্ছা ওই যে বললেন পতা, এর মানে কি?
রাশেদ সাহেবের কথা শুনে সবাই হেসে উঠল।
-আরে পতা মানে জানেন না? সেহরি, সেহরি, বুঝলেন?
-হ্যাঁ এখন বুঝলাম। আচ্ছা কাল কখন ডিউটি?
-কাল সকালে সাড়ে এগারটায় নামবেন।
-তাহলে ভাই আমি আসি কিছু মনে করবেন না ভীষণ টায়ার্ড লাগছে।
-না না মনে করার কিছু নাই আজকে যান তবে সবসময় একা থাকবেন না তাহলে খারাপ লাগবে।

নক্ষত্রের গোধূলি-৪০

৫৫।
সবাই রাশেদ সাহেবকে নিয়ে মোটামুটি হাসি তামাশা হৈ চৈ গালা গালি যার যখন যা ইচ্ছা চালিয়ে যাচ্ছিল কিন্তু রাশেদ সাহেব কোন প্রতিবাদ করছে না। আরে এইটা করতে এতক্ষণ লাগে নাকি, ওইটা কোথায় থাকে জানেন না, একটু দেখে নিলেই তো হয়, হা করে কি দেখেন এই ধরনের সব কথার প্রতিবাদ করবেই বা কী। নীরবে শুনে যাওয়াই ভালো। বোবার নাকি শত্রু থাকে না। ঘড়ি দেখার কথা মনে নেই। মারুফ বললো
-ওরে বাবা সারে বারোটা বেজে গেছে? তাড়াতাড়ি কর সবাই। নয়া ভাই সাহেব আপনি মপের বালতি ভরে চুলায় দেন।
মপের পানি গরম হলে বললো-
-ওই যে ওই খানে ব্রাশ আছে ওটা নিয়ে আসেন। পারবেন তো ব্রাশ করতে? দেন আমি দেখিয়ে দেই
বলে বালতিতে গুড়া সাবান, ব্লিচ, এনটি ব্যাকটেরিয়াল সুগন্ধি মিশিয়ে বললো-
-দেখেন কি ভাবে ব্রাশ করবেন।
দেখিয়ে দেয়ার পর রাশেদ সাহেব পুরো কিচেন আর তার পাশের স্টোরে মপ মেরে জিজ্ঞেস করলো-
-এই পানি কোথায় ফেলব?
দেলোয়ার বাইরে নিয়ে গিয়ে একটা ড্রেনের মুখ দেখিয়ে বললো-
-এই খানে ফেলবেন সবসময়। আর ওই বালতি ব্রাশ এই যে এইখানে রাখবেন সবসময়। একই ভাবে করবেন যাতে করে আপনে যেদিন না থাকবেন সেদিন যেন আমাদের কারো খুঁজে পেতে অসুবিধা না হয়।
ফিরে এসে দেখে কাজ কর্ম সব শেষ। কিচেন দেখে মনেই হবে না এখানে এতক্ষণ মহাযজ্ঞ চলেছে। সমস্ত কিচেন চক চক করছে।
-এই যে ভাই সাহেব হাত মুখ ধুয়ে আসেন।
-কেন?
-খাইবেন না?
-ও আচ্ছা, তা হলে আমি কাপর গুলিও বদলে আসি। সিংক থেকে নোংরা পানি ছিটে এসেছে কেমন লাগছে এই কাপর গায়ে খেতে পারবো না।
বলেই রাশেদ সাহেব আর দেরি করলেন না। সারা দিনের এই নতুন ধরনের শারীরিক পরিশ্রম যাতে সে অভ্যস্ত নয়, এর পর বিষণ্ণ মন, অবসাদ আর ক্লান্তিতে সমস্ত শরীর যেন আর চলতে চাইছিলো না। কোন রকম টেনেটুনে তিন তলায় এসে কাপর বদলে বিছানায় একটু বসে মনে হলো কতদিন যেন বসতে পারেনি। মুখে হাত দিয়ে দেখে ঘাম শুকিয়ে লবণ কিচ কিচ করছে। সেই সাড়ে পাঁচটার পর একটা সিগারেট ও টানার সুযোগ পায়নি। আগে একটা সিগারেট বানিয়ে তাড়াতাড়ি দুটো টান দিয়ে এ্যাশট্রেতে ফেলে দিলেন। বেশি দেরি হলে আবার কি বলে এমনিতেই নতুনের দোষ বেশি।

বাথরুমে গিয়ে সাবানের কথা মনে হলো, আগে একেবারে মনেই হয়নি এখন আর অত দূরে সাবান আনতে যেতে ইচ্ছা হলো না। সাবান ছাড়াই মুখ হাত ভাল করে গরম পানি দিয়ে ধুয়ে নিচে এসে দেখে সবাই যার যার মত কিচেনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই খাচ্ছে। মালিকদের অন্য এক অংশীদার ওসমান বললো-
-নেন নেন ভাই তাড়াতাড়ি একটা প্লেট নেন।
রাশেদ সাহেব দেখলেন সে যেখানে প্লেট গুলি ধুয়ে রেখেছে এগুলি সেই প্লেট। সে নিজেও একটা হাতে নিয়ে নিলেন। আসাদ সাহেব ভাতের ডেকচি আর তরকারির হাড়ি দেখিয়ে দিল। মারুফ বললো-
-নিজেই নিয়ে নেন কেও দিয়ে দিবে না।
-ও আচ্ছা, ঠিক আছে নিচ্ছি।
কাস্টমারের জন্যে যে প্লেইন রাইস সেই একই রাইস, তরকারির হাড়িতে দেখে কিসের মাংস যেন।
-এটা কি গরুর মাংস?
-না না এ হলো ল্যাম্ব মানে ভেড়া। কেন খান না নাকি?
-না না সেরকম কিছু না সবই খাই।
-ঠিক আছে, নিয়ে নিবেন যা লাগে।
ওসমান বললো-
-ভাই সাবের সাথে তো কথা বলার সময় পাইলাম না, ঠিক আছে আছেন তো পরে আলাপ করবো।
এর মধ্যে তার খাওয়া শেষ। কোন রকম হাতটা ধুয়ে বললো আচ্ছা আমি আসি, সালামালেকুম বলেই দৌড়।
রাশেদ সাহেব খেতে শুরু করেছেন। আসাদ বললো-
-কি, ঠিক আছে? চলবে তো! না কি?
-হা ভাই চলবে মানে কি চালাতে হবে এছাড়া তো উপায় নেই।
-আচ্ছা আপনি এই কাজ নিলেন কেন? আপনার তো এই কাজের বয়স না। দেশ থেকে কবে এসেছেন, দেশের খবর কেমন, ওখানে কি করতেন ইত্যাদিসহ নানা প্রশ্ন যা এখন রাশেদ সাহেবের কাছে যন্ত্রণার মতো মনে হচ্ছিল। এমনিতেই কথা বলতে ভাল লাগছিলো না তার মধ্যে একই প্যাঁচাল বার বার আর কত! কেন, মানুষের এতো কৌতূহল কেন? আমি কি করতাম তা জানার কি এমন দরকার? কি হবে জেনে? যাই হোক কিছু বুঝতে দিলো না। অবলীলায় তার সব কথার জবাব দিয়ে গে্লেন।
যদিও সে বুঝতে পারছিলো এটা হলো আলাপ করার একটা পদ্ধতি। প্রথম আলাপ আর কি ভাবে শুরু করে তাই এই সব অবান্তর প্রসঙ্গ। তবে যাই হোক লোকটাকে ভালোই লাগলো। নতুন এসেছে এতো বিরক্ত হলে তো চলবে না কিন্তু তার মনের অবস্থা তো তার জানার কথা নয় তাই এই প্রসঙ্গ। কি আর করা যাবে এই ভাবেই তাল মিলিয়ে চলতে হবে। সবার কাছ থেকেই ভাল আশা করা সম্ভব নয়। রান্না খারাপ ভালো দেখার অবস্থা নেই। কোন ফাঁকে যে রান্না করেছে কে করেছে তা রাশেদ সাহেব খেয়াল করতে পারেনি। আর করবেই কখন এক সাথে দুই তিন জনে হুকুম করেছে। কোথায় কি থাকে, কি আছে, কাকে কি বলে এগুলি তো কিছুই জানা নেই। তারপর কিভাবে কি করবে তাও কিছু জানা নেই। কেও যে দেখিয়ে দিবে সে উপায়ও নেই। সবাই যার যার মত ব্যস্ত। আর এক সমস্যা ভাষা। কথাটা শুনেছে কিন্তু বুঝতে পারছেনা, জিজ্ঞেস করেছিলো দুএক বার। জবাব শুনে আর করতে ইচ্ছা হয়নি। যেমন বাংলাটাও শিখে আসেন নাই!! একবার বলেছিলো এটা তো -বাংলার একটা আঞ্চলিক রূপ সে তো আমার সব বোঝার কথা নয়।
-কি বললেন আমরা বাঙ্গালি না?
-না না তা হবে কেন?
-ও! উনি শুদ্ধ ভাষা ছাড়া বুঝেন না তা জানেন না? এখানে সবাই এই রকম কথা বলে তো আপনে এখানে আসলেন কেন?

নক্ষত্রের গোধূলি-৩৯

৫৪।
-কবির ভাই বলেন কি করতে হবে।
-আসেন আমার সাথে।
কিচেনের পাশের রুমে যেখানে আর একটা বড় শুকনো মালামালের স্টোর ওখানে বিরাট দুটা ফ্রিজ খুলে বললো-
-এই যে এই গুলি বের করে নিয়ে আসেন আমার সাথে।
বিভিন্ন সাইজের ট্রে এবং বড় বড় বাটিতে নানান রকমের জিনিষ। এতে আছে আলাদা আলাদা রকমের মশলা দিয়ে সেদ্ধ করা দুই তিন পদের মুরগির মাংস, ভেড়ার মাংস, কোনটা লাল কোনটা হলদেটে কোনটা সাদা। আরও আছে ওই রকম সবজী, আলু, নানা ভাবে কুচানো পিঁয়াজের তিন চার পদ, আদা রসুনের পেস্ট, টক দই, টমাটো আর কি কি সব মশলা দিয়ে বানানো কি কি যেন চিনতে পারল না।
কাটা টমাটো, শসা, লেবু, লেটুস, সেদ্ধ করা নানা সাইজের পিঁয়াজ, কাঁচা মরিচ, ধনে পাতা ইত্যাদি। আবার এর সাথে হলুদ, ধনিয়া, শুকনা মরিচ, জিরার গুরা, শুকনা মেথি পাতা, কুরানো শুকনা নারকেল, লবণ, চিনি, কিসমিস, আলমন্ড বাদামের গুরা, পেস্তা বাদাম এবং আরও কিছু যা চিনতে পারল না এগুলি নিয়ে কিছু সেফ এর পিছনে, কিছু পাশে সাজিয়ে রাখল।
-প্রতিদিন এই ভাবে এসে সব কিছু যেটা যেখানে আজকে রাখলেন সেই ভাবে রাখবেন। আবার বন্ধ হবার আগে যখন সেফ সাহেব বলবে তখন যেখান থেকে যেভাবে এনেছেন সেই ভাবে নিয়ে রাখবেন।

যারা রেস্টুরেন্টে বসে না খেয়ে প্যাকেটে করে নিয়ে যায় তাদের জন্য আগে থেকে সাদা ভাত, পোলাও এসব প্যাকেটে ভরে হট বক্সের ভিতরে রেখে দিতে হবে। যাতে করে তাড়াহুড়োর সময় হৈ চৈ না লাগে। পঁচিশ টা পোলাও এবং চল্লিশটা সাদা রাইস এভাবে ভরে রাখল। আজকে মারুফই সেফ এর কাজ এবং তার নিজের কাজ সহ চালিয়ে যাবে। ঘড়িতে দেখল সারে পাঁচটা বেজে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রথম অর্ডার এলো। কুমি ওয়েটার নুরুল ইসলাম অর্ডার পত্রটা এনে সেফ এর পিছনে একটু উঁচুতে একটা লম্বা কাঠের ফ্রেমের সাথে আটকিয়ে দিয়ে চলে গেলো। শুরু হলো সেফ সাহেবের রান্না। ছোট ফ্রাই প্যান চুলায় চাপিয়ে তাতে একটু তেল দিয়ে কুচানো পিঁয়াজ আর কিছু মশলা দিয়ে নারা চারা করে তার মধ্যে পাশে রাখা ওই যা ডেকচিতে কি যেন জ্বাল দিতে দেখেছিলো তার থেকে চামচ দিয়ে উঠিয়ে ডালের মত কি যেন দিল সেটা ফুটতে আরম্ভ করেছে পিছনে রাখা মাংসের ট্রে থকে গুনে গুনে কয়েক টুকরা মাংস ছেড়ে দিয়ে নারা চারা করে নামিয়ে যে ধরনের অ্যালুমিনিয়ামের ছোট প্যাকেটে ভাত ভরেছিলো তার চেয়ে একটু বড় প্যাকেটে ভরে ফ্রাই প্যানটা সিংক এর মধ্যে ছেড়ে দিয়ে রাশেদ সাহেবকে বললো-
-ভাইছাব এটায় ঢাকনা লাগিয়ে নাম লিখে দেন, তারপর প্যানটা ধুয়ে দিবেন।
-কি নাম লিখব?
-লেখেন চিকেন ভিন্দালু।
এর পর উনি আবার আরও দুইটা প্যান একত্রে উনুনে চাপিয়ে দিল। এবার কি করল তা আর দেখা গেলো না। ওই প্যান ধোয়ার কাজে লেগে গেলেন। কিছুক্ষণ পর আবার বললো-
-এটা চিকেন টিক্কা মাশাল্লা আর এটা ল্যাম্ব কোরমা, এগুলি যখন নিতে আসবে এর সাথে দুইটা বয়েল রাইস আর একটা প্লেইন নান দিয়ে দিবেন। নানটা আমি দিচ্ছি, এই যে এই ব্যাগে ভরে দিয়ে দিবেন। আর আপনে এই যে এই বিল এইটা দেখে নিবেন তাই বুঝতে পারবেন কোন অর্ডারে কি আছে এটা খেয়াল করে ব্যাগে ভরে দিবেন। দেখবেন ভুল যেন না হয় ভুল হলে কিন্তু কাস্টমার ফিরে আসবে এবং তা আমাদের গুড উইল নষ্ট করবে। আমি তো চিল্লাই না। দেখবেন সেফ আসলে কি করে। তার চিল্লানিতে কিচেনে থাকা মুশকিল।

রাশেদ সাহেব আবার ওই দুই প্যাকেটে ঢাকনা লাগিয়ে নাম লিখে নিচের হট বক্সের ভিতর রেখে দিল। আবার ওই দুই প্যান সিঙ্কে জমা হয়েছিলো এখন তা ধুয়ে দিল। এবারে মারুফ বললো-
-ভাইছাব এই যে প্যান ধুইতেছেন দেখবেন যেন এই হ্যান্ডেলের ভিতর পানি না থাকে তা হইলে হ্যান্ডেল গরম হয়ে যায় আর তা ধরা যায়না।
-বেশ।
এর মধ্যেই ফ্রাই প্যান ধোয়ার সময় তারের জালি দিয়ে ডলতে গিয়ে কিছু বুঝে উঠার আগেই হাতে দুএক যায়গায় কেটে গেলো। একটু পরেই আর একটা অর্ডার। এটা দেখে মনে হলো বেশ বড় অর্ডার। হ্যাঁ বেশ বড়ই বটে। মারুফ আবার তার কাজে লেগে গেলো। কবির বললো-
-এইযে নয়া ভাইছাব আমাকে একটু পোলাও রাইস গরম করে দেন, ওই যে মাইক্রোওয়েভ ওইটাতে দুই মিনিট গরম করলেই হবে।
সাথে সাথে দেলোয়ার বলে উঠলো-
-ঢাকাইয়া ভাইছাব আমারে একটা সালাদের প্লেট দিবেননি?
রাশেদ এক এক করে ওগুলি দিয়ে দিল। ওদিকে আবার সিঙ্কে মারুফের দেয়া ফ্রাই প্যান জমে গেছে । ওতে হাত দিতে যাবে এমন সময় সামনে থেকে আসাদ এসে বললো-
-রাশেদ ভাই আমাকে চারটা স্টারটার প্লেট রেডি করে দিবেন।
-এটা আবার কি?
-আচ্ছা আমি দেখিয়ে দিব ভাববেন না।
মারুফ বলে উঠল -ভাইছাব দুইটা প্রন ককটেল গ্লাস লাগান।
হিমশিম অবস্থা। মারুফকে দেখেছিলো যে ডিশ গুলি রান্না করে পেয়ালায় ঢেলে হট বক্সের ভিতর রেখে দিতে। এখন দেখল সামনে থেকে আসাদ একটা ট্রলি নিয়ে এসে তাতে ওই সব পেয়ালা, কয়েকটা প্লেইন রাইসের পেয়ালা দুইটা পোলাও রাইসের পেয়ালা, বড় একটা প্লেটে দুইটা নান রুটি নিয়ে গেলো। এর মধ্যে দেলোয়ার কয়েকটা মুরগির টুকরা টমাটো আর ক্যাপসিকাম সহ শিকে গেঁথে গন গন করে গ্যাসের আগুন জ্বলা তন্দুরের ভিতর ঝলসাতে দিয়েছিলো সেটা উঠিয়ে ছোট একটা লোহার ট্রেতে যেটা আগে থেকে চুলার উপর গরম হতে দিয়েছিলো সেটায় কিছু কুচানো পিঁয়াজ ছেড়ে তার মধ্যে ঢেলে দিতে ছর ছর করে শব্দ আর ধোয়ার সাথে জিবে জল আসা সুন্দর গন্ধ ছড়িয়ে গেলো। আসাদ আবার এসে একটা কাপড়ের ন্যাপকিন দিয়ে ধরে ওটা নিয়ে গেলো। ওদের কথায় জানতে পেল এর নাম চিকেন শাসলিক। রাশেদ বুঝল ভিতরে কাস্টমার এসেছে যাদের জন্য এগুলি যাচ্ছে। একটু পরেই নুরুল ইসলাম এসে বললো-
-ভাইছাব একটা পোলাও রাইস দেন তো!
এইভাবে প্রায় দুই ঘণ্টা চলে গেলো ভীষণ ব্যস্ততার মধ্যে। সময়ের সাথে ক্ষুধায় রাশেদ সাহবে অস্থির হয়ে গেলেন। কি করে, এখন লজ্জায় কাউকে কিছু বলতেও পারছেনা। সবাই ব্যস্ত। না, আর থাকা যায়না। দেয়াল ঘড়িতে দেখল দশটা বাজে। এবার যে করেই হোক কবিরের কানে কানে বললো।
-হা আমাদেরও তো খুধা পেয়েছে একটু অপেক্ষা করেন সবার জন্যই বানাবো।
এতোক্ষণ কি ভাবে যে সময় কেটে গেলো টের পায়নি শুধু লক্ষ করলো হাতের বেশ কতগুলো কাটা যা এখন জ্বলছে। একে একে সামনে থেকে প্লেট পেয়ালা এসেছে সেগুলি রাখার জায়গা কবির দেখিয়ে বলে দিয়েছে।
-প্লেটের উচ্ছিষ্ট গুলি এই বিনে ফেলে এই যে দুইটা সিংক এর এইটা ধোয়ার জন্য আর এই সিংক এর ভিতর প্লেট, হাফ প্লেট, কোয়ার্টার প্লেট, ছোট পেয়ালা, বড় পেয়ালা সুন্দর করে স্ট্যাক করে রেখে দিবেন। যখন সব আসা শেষ হবে তখন সব এক সাথে ধুয়ে ফেলবেন। অবশ্য যদি মাঝে কোনোটার টান পরে তখন এখান থেকে ধুয়ে দিতে হবে।

কবির কিছু পোলাও রাইস আর ওই যে সেদ্ধ করা সবজি ছিলো ওগুলি দিয়ে সাথে কিছু মশলা দিয়ে নাড়াচাড়া করে একটা কি যেন বানিয়ে আট দশটা বাটিতে বেড়ে সবাইকে বললো খেয়ে নিতে। সামনে থেকে সবাই একে একে এসে খেয়ে গেলো। আসাদ একটু পরে একটা ট্রে করে লেবু আর বরফের টুকরো দিয়ে কোক নিয়ে এলো চার গ্লাস। রাশেদের সামনে এসে বললো-
-নেন ভাই আপনি নতুন এসেছেন আপনি আগে নেন।
রাশেদ সাহেব একটা গ্লাস তুলে নিলেন। রাশেদ সাহেবের গলায় টনসিল, বরফ এড়িয়ে চলে তবুও প্রথম বার কোন আপত্তি করলো না। গ্লাসটা পাশে রেখে কবিরের দেয়া নাম না জানা বিলাতের প্রথম ডিশটা তুলে নিয়ে চামচ দিয়ে খেতে আরম্ভ করলো। কাজ চলছে কাজেই নিশ্চিন্তায় খাবার উপায় নেই। তাড়াতাড়ি খেয়ে গ্লাসটা এক চুমুকে শেষ করে মনে হলো শরীরটা একটু স্থির হলো। এই রকম হাঁকা হাঁকি ছোটা ছুটি ব্যস্ততার মধ্যে এক সময় খেতে আসা লোকজনের ভিড় ধীরে ধীরে কমে এলো। রাত এগারোটা বাজল। এবার সব কিছু গুছিয়ে নেবার পালা। বারোটায় রেস্টুরেন্ট বন্ধ। সামনে থেকে আনোয়ার এসে বললো-
-মারুফ, কাস্টমার শেষ। আজকে আর ব্যবসা হইবেনা আটাইয়া লও বাড়ি যাই।
এবার মারুফ কবির কে ডেকে বললো-
-নয়া ভাইছাবকে হেল্প কর।
-আচ্ছা ঠিক আছে, আসেন ভাইছাব।
শুরু হলো আর এক প্রক্রিয়া। প্রায় তিন থেকে চারশত প্লেট বাটি পেয়ালা বিশ পঁচিশটা বিভিন্ন সাইজের ডেকচি ট্রে ইত্যাদি মিলিয়ে আরও চল্লিশ পঞ্চাশটি। এগুলি যখন জমা হচ্ছিল তখনি ভাবছিলো এতো গুলি ধোয়া হবে কিভাবে? এ তো রাত পেরিয়ে যাবে। ভীষণ চিন্তা হচ্ছিল। কবির ওই খালি সিংকটা গরম পানি দিয়ে ভরতে বললো । আঁটান শব্দটি আগে কখন শোনেনি তবে কথার পরিপ্রেক্ষিত অনুযায়ী অনুমান করে নিল মানে কি হতে পারে। সিংক এর মধ্যে তো আর সব বাসন পেয়ালা জায়গা হয়নি, বেশীর ভাগই নিচে নামিয়ে রেখেছিলো। সিংক যেটা খালি ছিলো সেটা সহ দুইটাতেই পানি ভরা হলে পাশে রাখা লিকুইড সাবান ঢেলে দিল। যেটা ভরা ছিলো সেটায় একটু বেশি। এবারে বড় একটা স্পঞ্জের টুকরো দিয়ে এঁটো বাসন বাটি গুলি ভরতি সিংক এর মধ্যে একটা ডলা দিয়েই সাথে সাথে পরিষ্কার সিংক এর মধ্যে ছেড়ে দিল আর রাশেদ সাহেব সেগুলি উঠিয়ে উপরে পাশে পাশে খাঁচার মধ্যে সাজিয়ে রেখে যেতে লাগলেন। এতেই রাশেদ সাহেবের ঘর্মাক্ত অবস্থা। ওই সিংক শেষ হলে রাশেদ সাহেব নিচে থেকে উঠিয়ে আবার ওই নোংরা সিংক এর মধ্যে ছেড়ে দিলেন। আবার সেই একই প্রক্রিয়া। মোটামুটি যা ভেবেছি্লেন রাশেদ সাহেব তার চেয়ে অনেক কম সময়ের মধ্যেই সিংক খালি। অবশ্য রাশেদ সাহেব একা করলে হয়ত সারা রাতেও পারত কিনা সন্দেহ। এই দেখে দেলোয়ার বললো-
-দেখলেন ফাস্ট কারে কয়, এমনে করবেন।
ওদিকে ওই যে উপরে যেগুলি খাঁচায় রেখেছিলো সেগুলির পানি ঝরে শুকিয়ে গেছে। ওগুলি আবার ওখান থেকে নামিয়ে কবিরের দেখিয়ে দেয়া ভিন্ন একটা হট বক্সের ভিতরে রেখে দিল। ওদিকে দেলোয়ার আর মারুফ তাদের চুলা যেটায় এক সাথে ছয় টা বার্নার ব্যাবহার হয় ওটা আর তন্দুর ধোয়া মুছা করছে। জিনিস পত্র গুছিয়ে রাখছে। এমন সময় মালিক আনোয়ার এসে বললো-
-কি নয়া ভাই সাহেব ঠিক আছেন তো? আরও ফাস্ট করবেন।

নক্ষত্রের গোধূলি-৩৮

৫৩।
-আসেন ভাইছাব।
-আমি কি করবো?
-না আজকে কিছু করতে হবেনা আপনি বসেন।
টেবিলে পানির জগ, গ্লাস, খেজুর, আপেল, বড় কাবলি ছোলা ভুনা আর কি যেন এক রকম পায়েস এর মত মনে হলো। ঘড়ি দেখে একজন বললো টাইম হয়ে গেছে পানি মুখে দেন সবাই। ইফতারের ফাঁকে ফাঁকে সবার পরিচয়ের পর্ব শেষ। কবিরের সাথে আগেই আলাপ হয়েছে। কবির কিচেনে কাজ করে, সে কুক। প্রধানত পেঁয়াজ রসুন আদা ছেলা- কাটা, এগুলির পেস্ট তৈরি করা, পোলাও রান্না, মাংস সবজি ডাল ইত্যাদি কাস্টমারের পসন্দ মত তৈরির জন্য সেফকে প্রস্তুত করে গুছিয়ে দেয়া এই হলো তার কাজ। মারুফ তন্দুরে নান বানানো, মুরগি ভেড়ার মাংস, কিমা তন্দুরের আগুনে পুরিয়ে যে সব তৈরি করা হয় তাই করে। সে হলো তন্দুরি সেফ। আর এক জনের নাম দেলোয়ার সে সেকেন্ড সেফ। সেফ সাহেব আজ নেই তার স্ত্রী হাসপাতালে সেজন্য তিন দিনের ছুটি। আগামী সোম বারে আসবে। রাশেদ সাহেব এতক্ষণে একটু স্থির হয়েছেন। যারা উপস্থিত আছে সবার সাথে কথা বার্তা বলে কার কি কাজ মোটামুটি জেনে নেয়ার চেষ্টা করছেন। আর সে নিজে হলো কিচেন পোর্টার। তার কাজ পিঁয়াজ আলু ছেলা, যাবতীয় হাড়ি পাতিল ডেকচি, কাস্টমারের প্লেট বাটি, অন্যান্য ডিশ ধুয়ে পানি ঝরিয়ে শুকিয়ে জায়গা মত রাখা। তবে গ্লাস ধুতে হয়না, ওগুলি ওয়েটাররাই ধুয়ে থাকে।
সরবরাহকারির দেয়া কিচেনের মালামাল উঠিয়ে গুছিয়ে রাখা। সেফ বা কিচেনের অন্যান্য কর্মচারীর হুকুম তামিল করা মানে এটা ধুয়ে দিন, ওটা এনে দিন, স্টোর থেকে পিঁয়াজের বস্তা আলুর বস্তা নিয়ে আসেন, এই আবর্জনা গুলি উঠিয়ে বিনে ফেলেন। বিনটা বাইরে কাউন্সিলের বিন বক্সে ফেলে আসেন। কিচেন ঝাড়ু দিয়ে মপ মেরে দেন। মপ মারা লাঠির মাথায় লম্বা সুতার ব্রাশ দিয়ে বিশেষ ভাবে তৈরি বালতি ভরে গরম পানির সাথে সাবান ব্লিচ এবং এনটি ব্যক্টেরিয়াল সুগন্ধি মিশিয়ে মেঝে ব্রাশ দিয়ে মুছে এনে বালতির উপরে চিপড়ানোর জায়গায় চিপড়িয়ে আবার মুছে এনে বালতির ভিতর ধুয়ে চিপড়িয়ে সমস্ত ঘর মুছে নেয়া। অবশ্য মাঝে মাঝে বেশি বিজি হলে সবাই সাহায্য করে। এরাই হলো কিচেন স্টাফ। কোন কোন ক্ষেত্রে সেফ নিজেই মালিক বা অংশীদার। কিন্তু তা হলে হবে কি তাকেও সবার মত একই কাজ করতে হয় কারণ সেও সবার মত বেতন নেয়।

ওদিকে সামনে যারা কাজ করে তারা হলো ওয়েটার। এখানে তিনজন অংশীদার। একজন সেফ, অপর দুই জন সামনে কাজ করে। শিক্ষানবিশ ওয়েটার হলো কুমি ওয়েটার। এ ছাড়া আরও আছে মিড ওয়েটার এবং ওয়েটার। নুরুল ইসলাম, রেস্টুরেন্টে ঢুকেই যাকে দেখেছিলো সে কুমি ওয়েটার। সে রাশেদ সাহেবের সাথে এক রুমে থাকে। দুপুরে কাজ শেষে কোথায় যেন গিয়েছিলো যার জন্য রুমে দেখতে পায়নি । কাস্টমারের অর্ডারে পাপর থাকলে পাপর এবং তার সাথে চাটনি পরিবেশন করে। খাবার পর হট টাওয়েল এনে দেয়, সাথে একটা ডেসার্ট মেনু আর মৌরি জাতিয় কিছু। টেবিল পরিষ্কার করে, বার থেকে ট্রে করে মদের গ্লাস এনে দেয়, ওয়েটার কাস্টমারকে অভ্যর্থনা জানাবার পর কুমি ওয়েটারকে বলে দেয় একে অত নম্বর টেবিলে বসতে দাও। তাকে এনে সেই অনুযায়ী বসিয়ে দিয়ে খাবার মেনু দিয়ে যায়। যত জন কাস্টমার ততটা মেনু। আবার কাস্টমার যাবার সময় তার কোট বা জ্যাকেট থাকলে যা কিনা ঢোকার সময় খুলে হুকে ঝুলিয়ে রেখেছিলো সেটি এগিয়ে গায়ে দিয়ে দিতে হবে। সদর দরজা খুলে পাশে দাঁড়িয়ে গুড নাইট স্যার/ম্যাডাম, আবার আসবেন বলে বিদায় জানাতে হবে। ওয়েটার বা মিড ওয়েটারদের মধ্যে কেও একজন বারে থকে, সে মদের ধরন অনুযায়ী গ্লাসে মদ ঢেলে দেয়। আবার এরাই কেও কাস্টমার টেবিলে বসার পর অর্ডার বই নিয়ে এসে জানতে চায় তোমরা কি অর্ডার দেয়ার জন্য প্রস্তুত? যদি বলে হা, তখন তাদের দেয়া অর্ডার লিখে একটা কপি কুমি ওয়েটার এর হাতে দিয়ে দেয় তাতে টেবিল নম্বর থাকে। সে ওটা নিয়ে কিচেনে দিয়ে আসে আর একটা কপি বার এর কাউন্টারে দেয়। বারে যে থাকে সে হিসাব নিকাশ এর কাজও করে।
কখনো কাস্টমার অচেনা মেনু দেখে চিনতে পারে না তখন জানতে চায় এটা কি? হ্যাঁ হ্যাঁ এইটা কি? ওয়েটার ব্যাখ্যা করে বলে দেয় এটা এই, ওটা এই, এটায় ঝাল বেশি, ওটায় ঝাল কম। এটা এইভাবে তৈরি, ওটা ওইভাবে। যতটা সম্ভব মনোরঞ্জন করে একটা ভাল দামি অর্ডার আদায় করা। কোন কোন কাস্টমার আবার বলে, দেখ আমার বাদাম বা দুগ্ধজাত খাবারে এলার্জি আছে তা আমি কোন অর্ডার দিতে পারি? তাকে সেরকম মেনু দেখিয়ে দিতে হয়। আসাদ হোসেন ওয়েটার। সে এদেশে সিএ পরতে এসেছে। তার বাড়ি ময়মনসিংহ এছাড়া আর সবাই সিলেটের।

ইফতার কি হলো না হলো সে দিকে খেয়াল করার মত সময় নেই। কোন রকম পেটে ঢোকান। মোটামুটি ইফতার আর পরিচয় পর্ব সেরে আবার উপরে উঠে এলো সবাই। এর মধ্যেই প্রায় পৌনে পাঁচটা বেজে গেছে। আবার পাঁচটায় নামতে হবে।
নিজের বিছানায় এসে একটা সিগারেট জ্বালিয়ে বসে ভাবল মনি ফ্লাই করেছে কথাটা ঢাকায় জানানো দরকার কিন্তু কিভাবে জানাবে? অবশ্য মনিকে বলে দিয়েছে সে ঢাকা এয়ারপোর্টে নেমে আনুষ্ঠানিকতা সেরে বাইরে এসে বাসায় ফোন করবে। তবে কায়সার বেয়াই যদি সাথে এসে অন্তত কল্যাণপুর পর্যন্ত দিয়ে গেলেও হবে তবে তা সে করবে কিনা কে জানে। সে ভরসায় থাকা যায়না। তাছাড়া আগে থেকে বাসায় জানা থাকা আর ফোন পেয়ে যাওয়া তো এক কথা নয়। সামনে বসা নুরুল ইসলামকে বললো-
-ভাই, কি ভাবে একটা ফোন করা যাবে?
-আপনার কাছে ফোন কার্ড আছে?
-হা আছে।
-তাহলে ওই টয়লেটে যাবার পথে দেখেন একটা ফোন আছে ওইটা দিয়ে করতে পারবেন তাড়াতাড়ি করেন ডিউটিতে যাবার সময় হয়ে গেছে।
কথাটা শুনেই তাড়াতাড়ি যেতেই দেখে হ্যাঁ একটা ফোন আছে। সঙ্গে সঙ্গে নম্বর মেলাতেই ওপাশে রিং হবার শব্দ শুনতে পেল। ফোন ধরল ছোট মেয়ে।
-আব্বু! তুমি কেমন আছ?
-হ্যাঁ আব্বু আমি ভাল আছি, শোন তোমার মা কাল সন্ধ্যায় ঢাকা নামছে সে এখান থেকে আজ সকালে ফ্লাই করেছে।
-তুমি কোথায় আব্বু?
-আমি অক্সফোর্ডে একটা রেস্টুরেন্টে কাজ নিয়ে এসেছি আজ দুপুরে, তোমরা ভাল আছ তো আব্বু?
-হ্যাঁ আব্বু আমরা ভাল আছি।
-আচ্ছা আব্বু আজ সময় নেই, এইতো এখনি কাজে যেতে হবে সময় মত আমি কাল আবার ফোন করব। তোমার মা পৌঁছল কিনা শুনব আজ তাহলে রাখি আব্বু তোমরা সাবধানে থেক।
ফোনটা শেষ হতেই দেখে আর সময় নেই রুমে না ঢুকে সরাসরি নিচে নেমে এলো।

[রাশেদ সাহেবের সঙ্গে এই উপন্যাস চলতেই থাকবে]

নক্ষত্রের গোধূলি-৩৭

৫২।
-এখানে লোক জন এই ভাবেই কথা বার্তা বলবে কিছু মনে করবেন না এখানে এই রকমেই চলে।
কবির মালামাল গুলি দেখিয়ে বললো-
-যখন এই সব জিনিস নিতে বলব তখন এখান থেকে নিয়ে যাবেন। আপনাকে দেখেই বুঝেছি আসলে এই কাজ তো আপনার জন্য না কিন্তু কি করবেন এসেই যখন পরেছেন করতে তো হবে। আমি আপনাকে সব দেখিয়ে দিবো আজ তো শুক্র বার আজ কোন রকমে চালিয়ে নেন। শুক্র আর শনি বার এখানে খুব বিজি হয় সবাই ব্যস্ত থাকে সবার মাথা গরম থাকে তাই কে কি বলে না বলে হুস থাকে না। এই দুই দিনেই যত ব্যস্ত সপ্তাহের অন্য দিনে কিন্তু এত ব্যস্ত থাকবেনা।
রাশেদ সাহেব এতক্ষণে শুক্র বারের মহাত্ম বুঝতে পারলেন।
-এই যে দেখে নেন এখানে কি কি আছে। আন্দাজে খোঁজা খুঁজি করবেন না, সময় নষ্ট হবে এতে সেফ বা সবার মেজাজ গরম হবে। ওই যে কিচেনের পিছনে যে স্টোর ওখানে কি থাকে এখানে কি থাকে এগুলি মনে রাখবেন বলার সাথে সাথে নিয়ে দিবেন কাজ সহজ হবে কষ্ট কম হবে সময় কম লাগবে। দেখলেন তো এখন চলেন একটু রেস্ট নিবেন ও হ্যাঁ রোজা আছেন তো? আচ্ছা তা হলে আজকে তো তিনটা তেপ্পান্ন মিনিটে ইফতার তখন নিচে চলে আসবেন ইফতারের জন্য। আর রেস্টুরেন্ট খুলবে সারে পাঁচ টায় আপনি পাঁচ টায় নিচে নেমে আসবেন তখন বলে দিব এসে কি করতে হবে। আমি আপনার কাছেই থাকব।
-ভাই আমাকে বলে দিবেন কি ভাবে কি করতে হবে বুঝতেই তো পারছেন একেবারে নতুন এর আগে তো কখনও এমন কিছু করিনি।
-ভাববেন না এরকম হয় কে আর সব কিছু শিখে আসে এদেশে এখানে এসেই সবাই শিখে আমরা দেশে কি কেও কখন এই সব কাজ করেছি? হ্যাঁ আপনার কষ্ট হবে তবে আবার সুবিধাও আছে।
-কি সুবিধা?
-না মানে আপনি তো ইংরেজি পড়তে পারেন বলতে পারেন ইংরেজি পড়তে পারলে অনেক সুবিধা। চলেন উপরে চলেন ঠিক ঠাক করে নেন আবার কিন্তু পাঁচ টায় নামবেন দেখবেন ডাকাডাকি যেন করতে না হয়।
-আচ্ছা ঠিক আছে চলেন।
উপরে এসে সেই রুমে ঢুকে দেখে সবাই শুয়ে পড়েছে।
-আপনার মাল পত্র নিয়ে চলেন আমার সাথে।
লাগেজ দুটা তখন খুলতে হয়েছিলো সেটা আবার বন্ধ করে নিয়ে কবিরের সাথে উপরে উঠে এলো। এখানে নিচের ওই মাপের আর একটা রুম তবে এটির অবস্থা ওই রকম না। প্রায় খালি আর ওই দুর্গন্ধটা নেই তবে ঘরটা ঠাণ্ডা মনে হলো। যাই হোক, এখানে দুইটা বিছানা।
-নেন এখানে এই বিছানা আপনার, ওই বেডে আমাদের এক ওয়েটার ভাই থাকে আপনি এখানে থাকবেন।
এই বলেই আচ্ছা পরে কথা হবে বলেই কবির চলে গেলো। কবির চলে যাবার পর রাশেদ সাহেব চোখ ঘুরিয়ে ঘরটা দেখে জানালার কাছে দাঁড়ালেন। বাইরেটা দেখা যাচ্ছে, যে রাস্তা দিয়ে সে এসেছেন। রাস্তার ওপাড়ে একটা লন্ড্রি, একটা পাব আর একটা রিয়েল এস্টেটের অফিস। কয়েকটা গাড়ি ডান থেকে বামে, কয়েকটা বাম থেকে ডানে চলে যেতে দেখলেন। না এভাবে দাঁড়িয়ে আমার তামাশা দেখার সময় নেই। ঘরের ভিতর একটা বড় গোল টেবিল আর একটা চেয়ার এই রয়েছে আসবাব। কোন আয়না নেই। ব্যাগ খুলে হেয়ার ব্রাশ, তামাকের প্যাকেট, লাইটার, ক্রিম লোসনের টিউব বের করে টেবিলের উপর রেখেই মনে হলো সিগারেটের ছাই ফেলার কিছু দরকার। এদিক ওদিক তাকাতেই একটা এ্যাশট্রে পেয়ে টেবিলের উপর এনে রেখে দুএকটা প্যান্ট সার্ট রাখার জায়গা খুঁজে না পেয়ে আর কিছু বের করলেন না। শুধু বিছানার ময়লা চাদর, বালিশের কভার বদলে নিলেন। মনি দিয়ে গিয়েছিলো একটা চাদর আর দুই টা বালিশের কভার তাই দিয়ে। এগুলি বদলে একটু বিছানায় বসেছে ওমনি নিচে থেকে ডাক এলো-
-নয়া ভাইছাব নিচে আসেন ইফতারের টাইম হইছে।

রাশেদ সাহেব বের হলেন। কোথায় বাথরুম টয়লেট দেখা হয়নি। দেখা দরকার। একটু চাপ বোধ হচ্ছে। সারাদিনে তো আর মনে হয়নি। রুম থেকে বের হয়ে যে পথে উপরে উঠেছি্লেন তার পাশ দিয়ে দেখে একটা প্যাসেজ। এগিয়ে যেতেই দেখলেন। নাহ, আর যাই হোক অন্তত টয়লেটটা পরিষ্কার আছে। ওখানে কাজ সেরে নিচে নেমে কিচেনে কাউকে দেখা গেল না কিন্তু পাশেই কোথাও কথার শব্দ পেয়ে বুঝল রেস্টুরেন্টের ভিতর হবে হয়ত। হ্যাঁ তাই, ওখানেই একটা বড় টেবিলে পাঁচ/ছয়জন ইফতারের আয়োজন করছে।
[রাশেদ সাহের এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমা যতদিন চলবে ততদিন এই উপন্যাস চলতেই থাকবে, কবে শেষ হবে আমাদের জানা নেই।]