গল্পের চতুর্থ পর্বের শেষাংশ:
গণেশ বাবু বললো, ‘আরে হ, আমিও ত দেখতাছি। আহুক হালার বামনায়। আজগা অর শঙ্খ অর সামনেই আছড়াইয়া ভাঙুম! আগে দেহি বামনায় কী কয়!’
বামনাকে দেখে গণেশ বাবু হাসতে হাসতে বললো, ‘আয় আয়, ভগবান পাগলা আয় ব।’
বামনা গণেশ বাবুর সামনে গিয়ে একটু দূরে বসতে চাইলে গণেশ বাবু বামনাকে বললো, ‘আরে বেডা, তুই আমার লগেই ব। ক, কিল্লাইগা আইছত? টেকা পইসার দরকার আছেনি?’
বামনা গণেশ বাবুর একপাশে বসে বললো, ‘আরে বাবু, আমার টেকা পইসার দরকার অইবো ক্যা? আমিত আর আম্নের মতন অভাববা না।’
গণেশ বাবু বামনার কথা শুনে ধমক দিয়ে বললো, ‘এ-এ-এ, আমার জমিদার রে! তয় কি মনে কইরা এই সাত সকালে আমার বাইত আইলি?’
বামনা রাগ হয়ে বললো, ‘রাইতে চোর পাডাইয়া শঙ্খডা লইয়া আইছেন? শঙ্খডা নিতে আইছি।’
গণেশ বাবু বললো, ‘আমি চোর পাডাইছি তুই কেমনে জানছত?’
বামনা বললো, ‘হুনেন বাবু, আম্নের কেরানি রমেশ বাবু কাইলকা আমার বাইত যাইয়া ভগবানের শঙ্খডা দেইখা আইয়া আম্নের কাছে কইছে। আম্নে শঙ্খের লোভে পইড়া আমার বাইত চোর পাডাইছেন। চোরেরা শঙ্খডা চুরি কইরা আম্নের কাছে আইনা দিছে। এইডা দিয়া কিচ্ছুই করতে পারতেন না, বাবু। এইডা ভগবান নিজের আতে আমারে দিছে। আমার শঙ্খ আমারে দিয়া দেন। আমার বামনী না খাইয়া রইছে। দেন দেন, তাত্তাড়ি কইরা শঙ্খডা দিয়া দেন।’
বামনার কথা শুনে গণেশ বাবু হাসতে হাসতে বললো, ‘তুই বামনা ঠিকই কইছস। আমরা হগলতে হারারাইত তোর শঙ্খডা লইয়া পাড়াপাড়ি করছি। একটা ফুঁও দিতে পারি নাই। এইডা তুই কেমনে ফুঁয়াইছত?’
বামনা বললো, ‘এইডা ত বাবু ভগবান আমারে দিছে। আম্নেরে ত আর দেয় নাই। তয়লে আম্নে এইডারে কেমনে ফুঁ দিবেন? বেশি কথা না কইয়া বাবু আমার শঙ্খডা আমারে দিয়া দেন কইতাছি।’
গণেশ বাবু হেসে বললো, ‘তর শঙ্খ তরে দিমু ঠিকই! কিন্তু এনো দুইডা কথা আছে। কথা অইল গিয়া, আমার লগে তর শত্ত করন লাগবো।’
বামনা জিজ্ঞেস করলো, ‘চুরি কইরা শঙ্খ আনছেন, হেই শঙ্খ নিতে অইলে কী শত্ত করন লাগবো, বাবু?’
গণেশ বাবু বললো, ‘শঙ্খ ফুঁ দিয়া তুই যা চাইয়া আনবি, তর তুনে ডবল আমার বাইত আহন লাগবো।’
বামনা বললো, ‘আরে বাবু, আম্নে বহুত লোভে পইরা গেছেন গা-ও! আম্নেরে অহনে লোভে পাইছে বাবু। লোভ করন ভালা না। আম্নেরে কি ভগবান কম দিছে? এতকিছু থাকতেও আম্নের অন লোভ অইছে ভগবানের শঙ্খের লাইগা। লোভে পাপ অয়। পাপে কইলাম সাজা অয়, বাবু। বেশি লোভ কইরেন না। বাইত বইয়া বইয়া ভগবান ভগবান করেন। ভগবান খুশি অইলে আম্নেরেও একটা শঙ্খ দিয়াঅ দিতে পারে। পরের জিনিসের লাইগা লোভ কইরেন না, বাবু। আমার শঙ্খডা ভালভালাই দিয়া দেন।’
গণেশ বাবু বললো, ‘আইচ্ছা তর মতন ভগবান ভগবান আমিও করুম! আগে তুই আমার লগে ডবল ডবল শত্ত কইরা ল। হের পরে তর শঙ্খ তরে দিতাছি।’
বামনা জিজ্ঞেস করলো, ‘ডবল ডবল এইডা আবার কেমনে,বাবু?’
গণেশ বাবু বললো, ‘আরে বেডা বামনা, তুই ডবল ডবল কেমনে এইডা বুঝছ নাই? শঙ্খ ফুঁ দিয়া কইবি, ভগবান আমার এনো একটা, গণেশ বাবুর বাইত দুইডা। এলা বুঝছত?’
বামনা এবার বুঝে গেল গণেশ বাবুর শর্তের কেরামতি। বুঝেও নিরুপায় হয়ে বামনা ভাবলো, দিবো ত ভগবানই। আমি খালি এট্টু ফুঁ দিয়া সেনা কমু! যাগগা, হের শত্ত মাইনা শঙ্খডা লইয়া লই।’
এই ভেবে বামনা গণেশ বাবুর শর্তে রাজি হয়ে বললো, আইচ্ছা বাবু, ঠিক আছে আমি রাজি অইলাম! অহনে আমার শঙ্খ দেন!’
গণেশ বাবু বামনার হাতে শঙ্খ দিয়ে বললো, ‘অহনে ফুঁ দিয়া ক, ভগবান আমার বাইত একটা বিল্ডিং, গণেশ বাবুর বাইত দুইডা বিল্ডিং। যদি আমার বাইত দুইডা বিল্ডিং অইয়া যায়, তয়লে আমি বুঝুম আমার লগে তর শত্ত করা ভগবানও রাজি অইয়া গেছে। হের পরে তুই তর শঙ্খ লইয়া বাইত যা-গা।’
সরল মনা বামনা চালাক গণেশ বাবুর কেরামতি শর্তে রাজি হয়ে শঙ্খ ফুঁ দিয়ে বললো, ‘বুম-ম-ম-ম ভগবান, আমার বাইত একটা বিল্ডিং, গণেশ বাবুর বাইত দুইডা বিল্ডিং কইরা দেও!’
এই কথা বলতে দেরি, আর বিল্ডিং উঠে যেতে দেরি হয়নি। তা দেখে গণেশ বাবু মহা খুশি হয়ে বামনাকে শঙ্খ দিয়ে বিদায় করলো। বামনাও ভগবানের দেওয়া শঙ্খ হাতে নিয়ে বাড়ি ফিরল।
এদিকে বামনী শঙ্খের শোকে যখন বাড়িতে বসে বসে কাঁদতেছিল, তখন দেখল হঠাৎ ফট করে একটা বিল্ডিং উঠে গেল! তা দেখে বামনী বুঝতে পেরেছে বামনার সাথে গণেশ জমিদার হয়তো কোনও শর্ত করেছে। আর বে-আক্কেল বামনাও হয়তো রাজি হয়ে গেছে। এমন সময়ই বামনা শঙ্খ নিয়ে বাড়িতে আসলো।
বামনা বামনীর সামনে গিয়ে বললো, ‘আরে বামনী তুই কাঁদছ ক্যা? এই দেখ আমি শঙ্খ লইয়া আইছি।’ শঙ্খ দেখে বামনী যতটা-না খুশি হলো, এর চেয়ে বেশি রাগও হলো। কারণ, বামনী তো আগেই টের পেয়েছে গণেশ জমিদার বামনার সাথে একটা চুক্তি করে শঙ্খ দিয়েছে। এছাড়া গণেশ বাবু এমনি এমনি শঙ্খ দিয়ে দেয়নি। তা না হলে আর হঠাৎ করে বাড়িতে বিল্ডিংও উঠেনি।
তাই বামনী বামনাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘শঙ্খ কি তুমি যাওনের লগে লগে দিয়া দিছে? নাকি কোনও শত্ত করছে?’
বামনা সত্য কথাই বামনীর কাছে বললো, ‘হ, বামনী, গণেশ বাবু ত লোভী! খালি মাইনষের জমিজামার দিগে চাইয়া থাহে। আর এইডাত ভগবানের জিনিস। ফুঁ দিয়া কইলেই হগল অইয়া যায়। তয়লে এইডার লোভ হেয় কেমনে ছাড়বো, ক? শত্ত ছাড়া হেয় শঙ্খ দিতে চাই নাই। হিল্লাইগা আমি হের শত্তে রাজি অইয়া শঙ্খডা লইয়া আইছি। ইল্লাইগা কি অইছে? যারে যা দেওনের ভগবান দিবো। এনো আমার কি কিচ্ছু করনের আছে?’
বামনী জিজ্ঞেস করলো, ‘কী শত্ত করছে?’
বামনা বললো, ‘ডবল ডবল শত্ত করছে!’
বামনী জিজ্ঞেস করলো, ‘এইডা আবার কেমনে?’
বামনা বললো, ‘আমার এনো একখান আইলে, গণেশ বাবুর হেনো দুইখান যাইবো!’
তা শুনে বামনী বললো, ‘ভালা কাম করছ, গণেশ বাবুঅ ভালা করছ! শঙ্খডা যে আনছ, এইডাই চালাকের কাম করছ! অহনে দেইক্ক আমি বামনী হেরে কী মজা দেহাই?’
এই বলে বামনী চুপ করে রইল। এদিন বামনার সাথে আর কোনও কথা বলেনি। এভাবে দুইতিন গত হয়ে গেল। বামনা প্রতিদিন শঙ্খ ফুঁ দিয়ে যা আনে আর যা খায়, গণেশ বাবুর বাড়ি তার ডবল চলে যায়। গণেশ বাবুও এখন সকাল দুপুর রাত্র তিনবেলা শঙ্খ হতে আসা খাবার খেয়েই আরামসে দিন পার করতে লাগলো।
একদিন বামনী খুব বায়না ধরলো! বামনী সকাল থেকে কিছুই খাচ্ছে না। তা দেখে বামনার আর ভালো লাগছিল না। বামনা বামনীকে জিজ্ঞেস করলো, ‘ও-ই বামনী, তর কী অইছেরে? তুই আজগা দুইডা দিন ধইরা আমার লগে রাগ কইরা রইছত ক্যা? ক, তর কী লাগবো? তরে সব আইনা দিমু! ক ক, তাততাড়ি কইরা ক দেহি!’
বামনী মুখ কালা করে বললো, ‘আমি ত যা চামু, তুমি ত হেইডা আমারে দিতা না। তয় আর চাইও লাভ নাই! থাকগা, আমার কিচ্ছু লাগত না।’
বামনা বললো, ‘আরে ক, তর কী লাগবো? কী দিলে তুই এট্টু খুশি থাকবি, ক?’
বামনী বললো, ‘আমার যা লাগবো, তুমি হেইডা হাছাই দিবা?’
বামনা বললো, ‘এই ল, তর মাতা’র মাধ্যে আত রাইখা কইলাম, দিমু! ক দেহি কী লাগবো?’
বামনী বললো, ‘আমাগো বাড়ির গেইটের সামনে একখান কুয়া লাগবো! তুমি শঙ্খত ফুঁ দিয়া কও ভগবান আমার বাড়ির সামনে একখান বড় কুয়া কইরা দেও!’
বামনীর কথা শুনে বামনা মাথায় হাত দিয়ে বললো, ‘আরে বামনী, তুই এইডা কছ কী? বাড়ির সামনে কুয়া থাকলে তুই মাইনষের বাইত যাইবি আইবি কেমনে?’
বামনী বললো, ‘আমি কি আর আগের মতন বড়কত্তাগো বাইত যাই? আমি অহনে বাইত তুনে বাইর অইনা। তুমি আমার কথা হুইনা একখান কুয়া কইরা দেও!’
বামনা বললো, ‘আইচ্ছা, ‘তুই যহনে চাইতাছত তয় কি আর না করতে পারি?’
এই বলেই বামনা শঙ্খ হাতে নিয়ে জোরে একটা ফুঁ দিয়ে বললো, ‘বুম-ম-ম-ম ভগবান, আমার বাড়ির সামনে একটা বড় কুয়া কইরা দেও!’
ফুঁ দিয়ে বলতে দেরি, কুয়া হতে আর দেরি হয়নি। একইসাথে ফটাফট ফটাফট গণেশ বাবুর বাড়ির গেইটের সামনেও দুইটা কুয়া হয়ে গেল! রমেশ কেরানি তখন গেইটের সামনেই ছিল। ফটাফট দুইটা কুয়া হতে দেখে রমেশ কেরানি এক দৌড়ে গণেশ বাবুর কাছে গিয়ে বললো, ‘সর্বনাশ বাবু, সর্বনাশ অইয়া গেছেগা ও বাবু! সর্বনাশ অইয়া গেছেগা!’
গণেশ বাবু জিজ্ঞেস করলো, ‘আরে কী অইছেরে রমেশ? ভাইঙা ক দেহি? আমিত কিচ্ছু বুঝতে পারতাছি না!’
রমেশ কেরানি বললো, ‘তাততাড়ি কইরা আইয়া দেহেন, বামনায় কী করছে! আম্নের বাড়ির গেইডের সামনে একলগে দুইডা কুয়া কইরা থুইছে! আম্নে তাততাড়ি কইরা বামনার কাছে মাপ চাইয়া লনগা। নইলে আর উপায় নাই, বাবু! আম্নের এমুন্না লোভে অহনে আমাগো বেরাইয়া মরণ লাগবো!’
গণেশ বাবু রমেশ কেরানিকে ধমক দিয়ে বললো, ‘চুপ থাহ তুমি! খালি আমিই লোভ করি? লোভ ছাড়া কি মানুষ আছে? কেয় কম করে, কেয় বেশি করে। আমি নইলে এট্টু বেশিই করছি! হিল্লাইগা কি বামনার কাছে মাপ চাওন লাগবো? দুইদিন গেলে আস্তে কইরা সবই ঠিক অইয়া যাইবো, রমেশ। অহনে চলো দেহি বামনায় কী কামডা করছে!’
এই বলেই গণেশ বাবু রমেশ বাবুর সাথে ঘরের বাইর হয়ে দেখে, বাড়ির গেইটের সামনেই পরপর একসাথে দুইটা কুয়া! কুয়া দেখে গণেশ বাবু রমেশ কেরানিকে বললো, ‘কয়দিনের লাইগা কুয়ার উপ্রে লম্বা একখান তক্তা হালাইয়া রাইখা দেও। দুইডা দিন পর দেখবা সব ঠিক অইয়া গেছেগা। মনে অয় বামনায় জীবনে কুয়া দেহে নাই। হিল্লাইগা ভগবানের কাছে কুয়া চাইছে। দুইদিন পরে বামনায় নিজেওই কুয়া উডাই হালাইবো।’
রমেশ কেরানি বললো, ‘দেহেন কয়দিন পর বামনায় আবার কোন আকাম কইরা বয়!’
গণেশ বাবু বললো, ‘ধুরও রমেশ, কী আর করবো? কয়দিন ধইরা স্বর্গের খাওন ত আরামসে আইতাছি! যাও অহনে একখান তক্তা কুয়ার উপ্রে দিয়া দেও!’
গণেশ বাবুর কথামতো রমেশ কেরানি তা-ই করলো। কুয়ার উপরে লম্বা একটা তক্তা ফেলে রাখল। যাতে বাড়ির লোকজন কোনরকমভাবে আসাযাওয়া করতে পারে।
এভাবে ক’দিন যেতে-না-যেতেই, বামনী আবার বায়না ধরে বসলো! বামনী বামনার সাথে কথা বলে না! খাবার খেতে চায় না। এমনকি ঘরের লক্ষ্মীপূজাও দেয় না। বামনীর এই অবস্থা দেখে বামনারও ভালো লাগছিল না। তাই বামনা বামনীকে জিজ্ঞেস করলো, ‘কিরে বামনী, দুইদিন ধইরা তর আবার কী অইলো, ক দেহি হুনি? তুই বেজার অইয়া থাকলে কি ভালা লাগে? ক দেহি, ক কি অইছে আর কি লাগবো?’
বামনী বললো, ‘আমি অনেক ধইরা লেংড়া মানুষ দেহি না। আগে কত লেংড়া মাইনষে ভিক্ষার লাইগা আইত। অহনে একজনও দেহি না। আমার একখান মানসী আছিলো। ভগবান আমগো একখান শঙ্খ দিছে। অহনে আমরা ভালভালাই চলতাছি। ইল্লাইগা আমি মানসী কইরা রাখছিলাম একজন লেংড়া ফইররে একবেলা খাওয়ামু।’
বামনীর কথা শুনে বামনা বললো, ‘তয়লে অহনে আমি লেংড়া ফইর কই বিছরাইমু?’
বামনী বললো, ‘তোমার আবর বিছরান লাগবো? তুমি শঙ্খ ফুঁ দিয়া কও, ভগবান আমার একখান পা লুলা কইরা দেও। তয়লে ত অইয়া যায়!’
বামনীর কথা শুনে বামনা বললো, ‘আরে বামনী তুই এইডা কছ কী? আমি লুলা অইয়া যাইতাম? তুই এমনডা চাইতে পারলি?’
বামনা রাগ করেছে দেখে বামনী কাছে এসে বললো, ‘আমার মনসী আছে দেইখা কইছি। তুমিত আবার ভগবানের কাছে কইয়া ভালা অইয়া যাইতে পারবা। আমার মনের আশা পুরা করনের লাইগা কয়ডা দিন লুলা অইয়া থাকতে পারতা না?’ না পারলে থাকগা?’
এই কথা বলেই বামনী মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে চলে যাচ্ছে দেখে বামনা বললো, ‘আরে তুই কই যাছ? আইচ্ছা ঠিক আছে, আমি নিজে লুলা অইয়া তরে দেখাইতাছি। এই বলেই শঙ্খ হাতে নিয়ে একটা ফুঁ দিয়ে বললো, ‘বুম-ম-ম-ম ভগবান, আমার একখান পা ভাইঙা দেও!’
ফুঁ দিয়ে বলার সাথে সাথে বামনার একটা পা অবস হয়ে গেল। সেসময় গণেশ বাবু বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রমেশ কেরানির সাথে কথা বলছিল। হঠাৎ গণেশ বাবু ঠাস করে মাটিতে পড়ে গেল।
রমেশ বাবু জিজ্ঞেস করলো, ‘বাবু কী অইছে? আম্নে খারার তুনে বইয়া পড়লেন ক্যা?’
গণেশ বাবু বললো, ‘রমেশ, আমারে খাইছে!’
রমেশ বাবু জিজ্ঞেস করলো, ‘কেডা খাইছে, বাবু?’
গণেশ বাবু বললো, ‘আরে রমেশ, বামনায় মনে অয় অর নিজের এক পা লুলা কইরা হালাইছে। অহনে আমার দুই পা একলগে লুলা অইয়া গেছেগা রে, বা-বা-বাবা!’ গণেশবাবু এই বলে কাঁদতে লাগলো।
রমেশ বাবু বললো, ‘খাইছে বাবু, ‘কন কী! তয়লে ত সামনে বহুত বিপদ আছে দেখতাছি! বামনা যদি শঙ্খ ফুঁ দিয়া ভগবানের কাছে কয়, ভগবান আমার অর্ধেক জান লইয়া যাও, তয়লে ত বাবু আম্নের পুরা জানই যাইবোগা! তাততাড়ি কইরা বামনার বাইত যাইয়া, বামনার আতে পায় ধইরা মাপ চাইয়া লনগা। নয়লে সামনে বিপদ আছে।’
রমেশ কেরানির কথা শুনে গণেশ বাবু বললো, ‘আরে রমেশ, হগল সুম মাগনা খাওন আইতাছে। দেহি না আর কয়ডা দিন! বামনাই বা কয়দিন লুলা অইয়া থাকবো?’
রমেশ কেরানি আর কিছু না বলে চুপ করে থেকে গণেশ বাবুকে ধরাধরি করে ঘরে নিয়ে গোল।
আবার ক’দিন পর বামনী বায়না ধরলো কানা মানুষ দেখার জন্য। বামনীর ইচ্ছা তাই বামনাও বামনীর কথামতো শঙ্খ ফুঁ দিয়ে বললো, ‘বুম-ম-ম-ম ভগবান, আমার একটা চোখ কানা কইরা দেও! সাথে সাথে বামনার এক চোখ আর গণেশ বাবুর দুই চোখা কানা হয়ে গেল। গণেশ বাবু এখন রমেশ কেরানিকে ডেকে বললো, ‘আরে রমেশ,তাততাড়ি কইরা আমারে বামনার বাইত লইয়া যাও! আমি অহনে চোখে কিছু দেহি না। বামনায় মনে অয় এক চোখ কানা করছে। হিল্লাইগা অহনে আমার দুইডা চোখই কানা অইয়া গেছেগা। আমি অহনে চোখে কিচ্ছু দেখতাছি না। তাততাড়ি কইরা আরে বামনার বাইত লইয়া চলো।’
গণেশ বাবুর কথামতো রমেশ কেরানি তাড়াতাড়ি পালকি খবর দিল। পালকি আসলো। পালকিতে করে গণেশ বাবুকে বামনার বাড়িতে নিয়ে গেলো। বামনার বাড়িতে গিয়ে দেখে বাড়ির সামনে এক মস্তবড় কুয়া। কুয়ার উপরে গনেশ বাবুর মতো তক্তা দেওয়া আছে। সেই তক্তা দিয়েই খুব কষ্টে পালকি নিয়ে বামনার বাড়ির ভেতরে ঢুকলো। ভেতরে ঢুকে রমেশ কেরানি বামনাকে ডাকতে লাগলো, ‘ও-ই বামনা, ও-ই বামনা। এট্টু আহ দেহি! কথা আছে!’
বামনী দেখে রমেশ কেরানির সাথে এক পালকি। বামনী বুঝতে পেরেছে পালকিতে গণেশ জমিদার বসা আছে। তাই বামনা বামনী দুইজনই রমেশ কেরানির ডাক শুনেও শুনছিলো না। আবার না শুনেও পারছিল না। বামনা বামনী দুইজনই সামনে এসে জিজ্ঞেস করলো, ‘কী অইছে রমেশ বাবু? আবার কোন ফন্দি কইরা আমাগো বাইত আইছেন?’
রমেশ কেরানি বললো, ‘কোনও ফন্দি কইরা আহি নাইগো বামনী। আইছি গণেশ বাবুরে লইয়া। দেহেন পালকিতে গণেশ বাবু বইয়া রইছে!’
বামনা বললো, ‘ক্যা, গণেশ বাবুর কী অইছে?’
রমেশ কেরানি বললো, ‘হের অহনে দুই চোখ কানা, দুই পা লুলা। মরা মাইনষের লাহান কোনমতে পালকিত কইরা তোমাগো বাইত লইয়া আইছি।’
বামনি জিজ্ঞেস করলো, ‘আমগো বাইত কিল্লাইগা?’
রমেশ কেরানি বললো, ‘গণেশ বাবু আইছে আম্নেগো কাছে মাপ চাওনের লাইগা।’
গণেশ বাবু পালকি থেকে ভাইগো, বোইনগো ডেকে বলতে লাগলো, ‘তোমরা আমারে মাপ কইরা দেও! আমি আর এই জীবনে ভুল করতাম না। তোমগো শঙ্খ থেইকা আমার বাইত যা গেছে, সব লইয়া যাওগা। খালি আমারে তোমরা মাপ কইরা দেও! আমি আর কারোর জিনিসের লাইগা লোভ করতাম না।’
বামনী বললো, ‘ক্যা,ফাউ খাইতে আর পরের জিনিসের লাইগা লোভ করনের সখ মিট্টা গেছেগা?’
গণেশ বাবু হাত জোর করে আঁকুতি মিনতি করে বললো, ‘আমারে আর শরম দিও না গো বইন! আমারে ভগবানের দিগে চাইয়া মাপ কইরা দেও! আমি আর লোভ করতাম।’
গণেশ বাবুর আঁকুতি মিনতিতে বামনীর মায়া লাগলো! বামনী মনে মনে বললো, ‘থাক, ভুল ত মাইনষেই করে। আবার ভুলের খেসারতও দেয়! গণেশ বাবু ভুল করে লোভ কইরা সাজাঅ পাইছে।অহনে আবার মাপ চাইতে অ আইছে। অহনে হেরে মাপ না দিলে স্বয়ং ভগবানই বেজার অইবো।’
এই ভেবে বামনী বামনাকে বললো, ‘তুমি জমিদার বাবুরে মাপ কইরা দিয়া ভগবানের কাছে কও, আগে কুয়া দুইডা উডাইয়া নিতে। হের পরে তোমার লুলা পা আর চোখ ভালা কইরা হালাতে কও! বামনীর কথামতো বামনা শঙ্খ ফুঁ দিয়ে বললো, ‘বুম-ম-ম-ম ভগবান, আমার বাড়ির সামনের তুনে কুয়া লইয়া যাওগা! বুম-ম-ম-ম ভগবান, আমার লুলা পা ভালা কইরা দেও! বুম-ম-ম-ম ভগবান, আমার চোখ ভালা কইরা দেও!’
বলতে দেরি আর সব ঠিকঠাক হতে দেরি হলো না। গণেশ বাবুও পুরোপুরি সুস্থ হয়ে পালকি থেকে নেমে বামনার হাতে পায়ে ধরে বললো, ‘আমি বামনা লোভ কইরা ভুল করছি। আমারে তুই মাপ কইরা দে! আমি আর পরের জিনিসের লাইগা লোভ করতাম না। আমি অহনে বুঝলাম, লোভেই মানুষ ধ্বংসের পথে চইলা যায়।’
গণেশ বাবুর আঁকুতি মিনতিতে বামনা বামনী দুইজনই শেষমেশ জমিদার গণেশ বাবুকে মাপ করে দিয়ে বললো, ‘গণেশ বাবু, মাইনষেরে মরণের রাস্তায় লইয়া যায় এই লোভ। আজগার তুন আর লোভ কইরেন না। ভালা অইয়া যানগা। লোভ করবেন, তয়লে আবার মরবেন। লোভ করন ভালা না!’ সমাপ্তি!