চন্দন ভট্টাচার্য এর সকল পোস্ট

OBSCENE: from latin obscenus

OBSCENE: from latin obscenus. meaning ill-omened, a sign of fearful future

অবসিন শব্দের অর্থ অশ্লীল। কিন্তু ওপরে দেখা যাচ্ছে, অবসিন এসেছে ল্যাটিন obscenus থেকে, যার মানে “কুলক্ষণযুক্ত”, “এক ভয়জনক ভবিষ্যতের চিহ্ন”।

নগ্নতাকে আমরা অশ্লীল বুঝি, অথচ শুরুতে মানুষ ছিল নগ্ন বা নগ্নপ্রায়, যৌনতা নিয়ে বিধিনিষেধ অনেক সামান্য ছিল, ভাষাকে ভালো-খারাপে ভাগ করে দেওয়া হয়নি। সভ্য-অসভ্যের বাইনারিও তখন অ-তৈরি।

অশ্লীল কী? যা শোভন নয়। কিন্তু অশোভন কিছু আমাদের ভয়ের শাসানি দেবে কেন? বিশেষ করে যখন ওই অবস্থাটার ভেতর দিয়েই এগিয়ে এসে মানুষজাত এ-পর্যন্ত পৌঁছেছে?

সভ্যতা নিয়ে অত বড় ক’রে না ভেবে যদি নিজের বেড়ে ওঠা নিয়েই চিন্তা করি, আমার ন্যাংটো শিশুরূপ সামনে এসে দাঁড়ালে নিশ্চয়ই ভয় পেয়ে ইল-ওমেনড মনে করবো না সেই নগ্নতাকে?

তার মানে, যত দিন গেছে আমরা ভাবতে শিখেছি — অশ্লীলতার বিহার যৌনতাযোগে। সাদা বাংলায়: যে নগ্নতা প্রাপ্তবয়স্কের, যে নগ্নতার যৌনসক্ষমতা আছে, সেটুকুই আসলে অশ্লীল, অথবা — আবার শব্দের মূল মানেতে ফিরে আসি, কুলক্ষণযুক্ত।

এই যুক্তি অনুসরণ করে পাবো: একজন “সুলক্ষণা” নারীর শরীর থেকে পোষাক খসে গেলে সে “কুলক্ষণযুক্তা” হয়ে পড়ছে (পুরুষের বেলাতেও তাই)। মানে, স্বভাবে বা চেহারায় নয়, সুলক্ষণ সুতোর গায়ে লেগে থাকে। সভ্যতা আর অসভ্যতার মাঝখানে এইভাবে পোশাক এসে দাঁড়িয়েছে — থার্ড আম্পায়ার। থার্মোমিটারও বলতে পারি। কিন্তু বিজ্ঞান বা ক্রিকেট খেলার মতো এখানে কোনও পরীক্ষিত নিয়ম বা কর্তৃত্ব নেই ব’লে আমরা প্রত্যেকে নিজের মতো করে বুঝি আর বোঝাতে চাই কতোটা নগ্নতাকে অশ্লীল নাম দেওয়া যাবে। কুড়ি পার্সেন্ট, চল্লিশ নাকি শতকরা ষাট ভাগ?

অবসিনিটি-র ধারণা যৌনতার শক্তির বিরুদ্ধে কাজ করছে। আর কার্য-কারণ নিয়মে ধরে নেওয়া হচ্ছে যে নগ্নতা যৌনতা ডেকে আনবে (যেমন দুর্গন্ধ বমন-উদ্রেককারী)।

আজ পর্যন্ত পৃথিবীর বড় ধর্মমতগুলো যৌনতাকে ঠেকানোর চেষ্টা করে গেছে। ক্বচিৎ দুএকজন ছাড়া আমরা কোনও গুরু পেয়েছি কি যিনি যৌনতার শক্তির কাছে “ঈশ্বর” গোহারা হারবে টের পেয়ে তার পেছনে “নরকের ভয়” নামের তদন্ত সংস্থা লাগিয়ে দেননি? বদনামের বন্যা বইয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা করেননি যে যৌনতার বহি:প্রকাশ হচ্ছে অশ্লীল মানে obscenus মানে “এক ভীতিজনক ভবিষ্যতের স্বপ্ন”, মানে, ধর্মের ভাষাতে “নরকের ভয়”?

নদীর বান সমুদ্রজোয়ার আটকাতে পারে কিনা আমার জানা নেই, তবে ধর্ম-যৌনতার এই মুটভেড়ে আমরা সেই সৌন্দর্যময় ইনোসেন্ট বিষয়টাকে হারালাম — নগ্নতা। ধর্মরাষ্ট্র থেকে রাজনৈতিক রাষ্ট্রে আসার সময় সভ্যতা লাগেজে করে এই বোঝাপড়া খুব দারুণ বয়ে এনেছে। সভ্যতার এক নম্বর অসভ্যতা হয়তো এখানেই: নগ্নতাকে শহীদ বানিয়ে সে যৌনতার কোমর ভেঙে দিতে চেয়েছিল। আর তাই শরীরের ধারণা হয়ে দাঁড়াল একমাত্রিক, বস্তাপচা কিন্তু ভীষণ গোপনীয়! দেহের অধিপতি হয়ে বসলো পোশাক। কোন দেহ? যে চাঁদের আলো মাখে না, বসে না শিল্পীর তুলির সামনে, মাতৃভাষা ভুলেছে… যে দেহের দর্শক তো আছে, কিন্তু কোনও দর্শন নেই!

আর তাই নগ্নতা হয়ে দাঁড়িয়েছে শুধু যৌনতা উৎক্ষেপকারী নকল এক স্পেস শাটল।

টকটাইম

টকটাইম

ধন্যবাদ যে আজ তুমি ফোনের ওপিঠে এসেছিলে

ধন্যবাদ তোমার কথার খই যত মন দিয়ে ফুটতে দেখেছি আমি, অন্য কারও গল্প সেভাবে বুঝিনি — তবু তোমার ফেয়ারি টেলস ফুরলো একদিন

ধন্যবাদ ঠিক দু’শতাব্দী পরে তোমার গলার আস্বাদ পেলাম
ধন্যবাদ তোমার মনের চেয়ে বেশি ধুয়ে ফেলার ক্ষমতা কোনও ডিটারজেন্টের নেই

অথচ তোমার স্বর ছিল স্টুডিয়োর মতো, কাঠচাঁপা গন্ধের! কষ্ট পাচ্ছিলে, না গো?
ধন্যবাদ আবার মনে করিয়ে দাওনি যে সব সময়ই ভুলভাল তত্ব ঘোরে আমার মাথায়!

ধন্যবাদ দুজনেই বুঝতে পেরেছি একশোভাগ বিচ্ছেদকে ইস্তিরি করেই কোঁচকানোহীন প্রেম তৈরি হয়
ধন্যবাদ যে মৃত্যুর পরের দিন পর্যন্ত এই রকম অযত্ন অদেখাশুনো দিয়ে তুমি বাঁচিয়ে রাখবে আমাকে

ধন্যবাদ তুমি ফোন রাখার সময় ধন্যবাদ ব’লে ফেলোনি

ওহ ধন্যবাদ তুমি তো ফোনই তোলোনি আমার…

শীতের দ্বিতীয় শীত

শীতের দ্বিতীয় শীত

ট্রেনের হর্নের গায়ে মাকড়সা-ঝুল লেগে আছে
পঞ্চায়েতে দু’মাসের কাজ পেল আকাশি মেয়েরা:
পায়ে-চলা জ্যোৎস্না দেবে বিলের মাটিতে, বিষধর —
ঝাঁপির পার্বণী পেয়ে হবে গোল সুখিত বেড়াল

বৃদ্ধ দাঁতাল পাখি — ধান কাটতে গিয়ে ক্ষেতওলা
কোলে নেয়, মরাইতে রাখে। ঝরা পোকা, ঝরা ভিড়,
হিমের মশারি…। এই যে দাঁতনফল, আমার ফোকলা
আয়ু মুঠো ক’রে এতদূর ছুটলে, বাবুজি!

মুরগির পিঠ থেকে মায়া ছিঁড়ে নিচ্ছে পিকনিক
সেখানে গাছের মেধা, সেখানে মেঘের পরিষেবা
ধরবো বলে বসে আছি। এ-মহা কন্ডাকটেড ট্যুর
পাহাড়কে ভাঁজ ক’রে পৌঁছে দেবে, মুস্‌কান, তোমায়।

কুয়াশার তৃপ্তি নামছে; আর কেউ ফিরবে? জানি না
শীতের সনেট লিখলে শীত তাকে সঙ্গে নিয়ে যায়…

অস্থায়ী আকাশ

অস্থায়ী আকাশ

আমি যখন জনশূন্য হই, যখন শেষবন্ধু ধুলো উড়িয়ে
কাছে দাঁড়িয়েছে
আমাকেও তুলে কাগজের ঠোঙার মতো অস্থায়ী আকাশে
ঠাশ ক’রে সাপবেলুন ফাটিয়ে তার খোলশ ছেড়ে গেছে
তখন আমি ভূত হই, ভিজে পেছল টালির চালে
রাতে-বসা কাক হই তখন

হিমার্ত রাতকেও বলিহারি, চোখের জলের ছোট ছোট
পিরামিড সাজিয়ে রেখেছে! তাদের পাশ কাটিয়ে,
কোনওটা হয়তো ভেস্তে দিয়ে আমি উড়ন্ত এক হাঁটা শুরু হই
দুদিকে নিজের সমাধির পাশে গালে হাত দিয়ে বসে থাকা মানুষ
সেই যে সমবেত গান হতো, কথা ও সুর: মা মনসা
সেই যে বেড়ার ফাঁক দিয়ে ছিটকে রাস্তায় পড়ত
হারিকেনের গোল গোল ইবন বতুতা, ইলতুতমিস — তাদের সামান্য কাছে
টিনের বাউন্ডারি, ভেতরে যাত্রাদল নেই, ফাঁকা মাঠ
বসে বসে সিগারেট খাচ্ছে, ‘ক্যালিপটাস গাছ উঠে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে
যাত্রা শেষ, তবু লম্বা পথশূন্য পথ পড়ে আছে
পেছন থেকে ভেসে আসে কলের প্রথম জল বালতিতে
রোদের পিরামিড তৈরি হবে, তার খুটখাট ব্যস্ত শ্রমিকেরা
আর ট্রেনশব্দ, মানে চলন্ত বন্ধু কোনও স্থির বন্ধুর
কাছে ঘেঁষে আবার দাঁড়াল

ভেলৌরযাত্রীর ডায়েরি

ভেলৌরযাত্রীর ডায়েরি

আমরা সবাই দেহ দিতে এসেছি। হাসপাতালে। মরণোত্তর নয়, মৃতদেহ অনেক স্বপ্নের জিনিস। ডাক্তারি শরীর আসলে দুরকম হয়: মৃত শরীর — বডি, আর জীবিত শরীর — পেশেন্ট। সেই পেশেন্ট আবার হাসপাতালে ভর্তি হলে হয়ে যাচ্ছে বেড নাম্বার।

কাজেই যতই আপনি বলুন আমি সো অ্যান্ড সো, অমুক চাকরি করি আর তমুক জায়গায় থাকি, উন্মুখ বসে নেই কেউ শোনার জন্যে। ফুলবডি জমা দিন, ওরা সেখান থেকে বাছবে: মাথাটা নেবো, না অণ্ডকোষ। পোশাক ফেলে, চশমা-চপ্পল সরিয়ে কুয়াশামাখা স্বরে পাশ ফিরতে বলে আচমকা পায়ুতে নল চালিয়ে দেবে। ধর্ষণের একশো বাহান্ন উপায় কোঈ সার্জন সে শিখে। আয়নায় দাঁড়ালে দেখতে পাবেন যৌনকেশহীন ১০ বছরের বালক/বালিকা।

হতেই পারে যে, চিকিৎসাবিদ্যা আপনাকে জীবিত বডি (পেশেন্ট) বানায় মৃত বডি থেকে দূরে সরাবে বলে। চেন্নাই আপোলো হাসপাতালের গেটে নীল নিয়ন জ্বলছে: “প্রাইসলেস লাইভস সেভড পঁয়ত্রিশ লক্ষ ছিয়াত্তর হাজার একশো একচল্লিশ” (২০ জুলাই, ২০১৭, রাত আটটা), যা প্রতি মিনিটে জোঁকের মতো ডিঙি পেড়ে বাড়ছিল। খুব কিছুদিনের মধ্যে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যারও বেশি মানুষকে শোচনীয়ভাবে বাঁচিয়ে ফেলবে এরা।

আর লক্ষ করবেন চিকিৎসা সব সময় আপনাকে জানা কোনও নোমেনক্লেচারে ফিট করতে চাইছে। “মাঝে মাঝে অ্যাজমার ওষুধ নিতে হয়? তবে সিওপিডি কেস”। “মাঝে মাঝেই ঘুম হয় না? তার মানে স্লিপ নর্মাল”। আর এদের পরীক্ষাগার সমুদ্রের নিচে নানা গভীরতায় বসানো, আলাদা আলাদা সাগরিক জীব যেগুলো চালাচ্ছে। আপনার ইসিজি করবে লোহার দাঁড়াওলা একটা কালো রোগা অক্টোপাস। ইকো কার্ডিওগ্রাফির দায়িত্বে থাকা বেঁটেমতো বৃষ্টিভেজা শামুক এমন জড়িয়ে ধরে থুতুচুমু খাবে, আপনার বুকে ব্যথাই লাগবে না।

কিন্তু ঈশ্বর এমআরআই প্রদেশকে পৃথিবীর কিছুটা বাইরে সেই সব ডিমড নক্ষত্রে বসিয়েছেন যারা কবেই মরে গিয়ে তেঁতুলটক দাঁতের মতো ঠান্ডা। যেখানে পোশাক পালটে একা অপেক্ষা করতে হয় একার জন্যে, কিছু দূরে তিনজন মুখোশপরা অ্যালিয়েন কলমপিউটার নিয়ে কি সব আঁকছিল। আর দুই নার্স তোমাকে দুই বাজুতে ধরে হাঁটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই ইন্টারোগেশানস্পেসে যেখানে ঘড়ি আছে কিন্তু সময় নেই; রোগ নেই, অসুস্থতা চালু। যেখানে বরফবিদ্যুতের চুল্লিতে শুইয়ে দিয়ে, কর্ণাটকী সংগীতে পোড়ানোর পরে আমার মস্তিষ্কের কমলমুকুলদল খুলিল। খুলে এখানে ওখানে ছিটকে যাচ্ছে, হঠাৎ চোখে ভেসে উঠল এতক্ষণ বসে থাকা ক্লোকরুমের আকাশি দেওয়াল…কে জানে কে, যে সবার জন্যে লিখে গেছে, প্রশংসনীয় পেনসিলে, সুদূর বাংলাধ্বনিতে:
“আমাকে কেউ মারতে পারবে না…”।

ডায়েরি : চিকিৎসালয়শালা

ডায়েরি : চিকিৎসালয়শালা

এক
নগ্ন হও নগ্ন হও — এই শুধু স্লোগান
যেন পোষাকেই সব অসুখ লেগে আছে
“দেখি দেখি” বলে বারবার দেখার নিচে
চলে যাচ্ছে হাঁস-নার্সেরা
যত বলি, লজ্জাই আমার একমাত্র প্রেমিকা,
“না, ভিজিটিং আওয়ার্স ছাড়া কেউ কাছে থাকতে পারবে না।”

দুই
সিডাকটিভ সাদা জোব্বা-পরা আমি
হাঁটু গেড়ে বসে পড়লাম
তরুণীর পায়ের সিঁড়িতে
বললাম, বহু কষ্টে চেতনা পেয়েছি
মাঝামাঝি স্পিডে এবার চালাতে চাই শান্তিজীবন
আমার কাতরোক্তি গির্জার সমবেত সংগীত ছাড়িয়ে উঠছে দেখে
দরজা ঠেলে যাজক ঢুকলেন, দেখতে খ্রিস্টের অপোজিট…
ভেবেছিলাম প্রথম কাব্যগ্রন্থ থেকে আমার মহৎ সূক্তগুলো
আবৃত্তি করি
বলি যে আর একবার জ্ঞান হারালেই আব্বুলিশ, আবার
অন্ধকার গর্ভ থেকে টর্চ হাতে উঠে আসতে হবে…
আমি যত ভেঙে পড়ি, চোখে চোখে ছুরি-বিনিময় করে তারা
ইউরেনিয়ামের অনুরোধ পাঠায় চতুর্দোলায় উঠে আসতে
জোব্বার ফাঁকে বিষণ্ণ পুরুষাঙ্গ দোল খাচ্ছে, দেখি
তার দিকে চিকিৎসার দুই বাচ্চা
থমথমে সূর্যাস্ত মুখে তাকিয়ে রয়েছে

তিন
আমি অ্যান্টিবায়োটিকের সন্তান
আর ব্যাধি ব্রহ্মস্বাদময়
নকুলদানার ভেতরে সরষেবিন্দু যেন।
নিজের বিগ্রহশরীর বয়ে এনেছি হড়হড় বমির আদলে
মাথার ওপর পিছলে যাচ্ছে ছাদের উজ্জ্বল চামড়া
আমি কি এই ইস্তিরি করা পিচে
রক্ষণাত্মক ব্যাট তুলবো অ্যান্ড ইট ড্রপড ডেড ইন ফ্রন্ট
অফ হিম?
না না, এ-বাদাম সে-বাদাম নয়

চার
নিজের মৃত্যুকে শ্রদ্ধা করি
তাই তাকে কোনও আলোচনায় আনব না
পিওন মানিঅর্ডার, তাছাড়া অন্য কারও কাছে
নেবো কেন সোয়ামির নাম?
তোমাদেরও মান্য করি — জমদগ্নি ছেলেমেয়ে,
ডাল ঝুঁকিয়ে নিচু করা থেকে
আঁকশিগুলো খুব ধারালো থেকে
রেডি ওয়ান টু থ্রি-র ঝাঁকুনিতে
আমার সমস্ত শিউলি ঝরে পড়ল তোমাদের কাঁটাচামচ উপচে
স্যুপ বোলের ফাঁকায়…

পাঁচ
ছিনিয়ে নিলে, আমার জঠর থেকে আমার দেহকে…
বানানো করুণায় ভেসে যায় সার্জারির নাট্যশালা
শরীরেরও একটা শরীর থাকে যে জেগে উঠেছে দৃষ্টি-অপমানে
আমিও অবাক দেখি, এই দেহ আসলে কোরাল-দ্বীপ!
নীল মাংসস্রোতের নিচে মাথা ঝুঁকিয়ে দেখছে পাঁচ-ছ’জন ট্যুরিস্ট
তারপর নিষেধাজ্ঞার ভেতরে হাত ডুবিয়ে মুচড়ে ছিঁড়ে নিচ্ছে, আহ্,
দেহের মুকুল!
এ-কায়াভাণ্ডার ফতুর করে ভোরের কুয়াশামুখী প্লেনে চেপে
চলে যাচ্ছে ওরা…

ছয়
হলুদ ভিজিটিং কার্ড হাতে গলি ফুরোচ্ছি…কোনায় কোনায় প্রহরী।
শীতলী প্রাণায়ামের ছায়া পড়েছে নার্সের হেঁটে আসায়,
প্রভুর সেগুন কাঠের ঝকাস গ্যালারিতে।
নিজের অসুখ একটা পুঁটলিতে ফুলগিঁট দিয়ে
মুখে লাঠি পরিয়েছি, কাঁধে ফেলে উঠে যাব ওপরতলায়
তার আগে দেয়ালের অনৈতিক দিক থেকে কেউ এসে
চিনিয়ে দিল দূরের পুরনো ব্লক,
ভেঙে পড়া কিন্তু নির্মীয়মান
লিফটে শোয়ানো সাদা ট্রলি তার পোঁদ-ওলটানো স্যালাইন জানালো সিঁড়ি দিয়ে ওঠো,
অথচ শেষ সিঁড়িটা এখনও তৈরিই হয়নি, দুজন মিস্তিরি
তাড়াহুড়ো করে পাটায় মিক্সচার ঢালতে গিয়ে
নিজেদের গলায় ঢেলে দিচ্ছে আর বলছে দশ মিনিটে হয়ে যাবে

নিজেকে ভিজিট করতে সময়ের দশ মিনিট আগে চলে এসেছি যে…

অগ্নিপাঁচালি

অগ্নিপাঁচালি

মৃত্যু হলে লক্ষণীয় অতীত থাকে না
কুকুর-সন্তান তার দুধস্মৃতি মনে রাখে কিনা
কে জেনেছে? এই রোদ ফার্নেসে গলিয়ে
রাত্রিমণ্ড হল। ঘরে তালা, “অব তো চলিয়ে”
হাঁক দিচ্ছে ঘুমঘুম বিরক্ত পিওন
তবে, সুখঅপমান দু:খঅপমান দুই বোন।
আমি ওই হাত ধ’রে মৃত্যুঅপমানে যেতে যেতে
শালিখপাপিয়া-ফুলে ভরা আয়ুক্ষেতে
শেষবার, ভয়নিঃস্ব, থমকে দাঁড়াই
ওমনি পাঁজরে পিঠে চোঁচ মেরে ঢুকে যাচ্ছে পাপিয়া, চড়াই
ভেঙে পড়ছে মাংসগাছ, ছায়াশূন্য ছায়া — ফিরে চলি
তোমাদের ঠোঁটে চুমু দিয়েছি তো অগ্নিপাঁচালির…

আমি তোমাকে ছোঁব, নভতল

“আমি তোমাকে ছোঁব, নভতল”

যদি তুমি ছোঁও আমাকে
বদ্রিলার ভেঙে পড়বে, পেনরোজ ভুল প্রমাণিত
অস্ট্রেলিয়া ভাসতে ভাসতে এসে বলিভিয়ার গায়ে লেগে যাবে
এই প্রথম দ্যাখা যাবে বাতাসদিগকে — হলুদ, বেগুনি, ভাসমান ওড়নার দল
আর, এমন স্পর্শের উপমা কোনও শব্দে নেই বলে কবিতার বই স্তূপ করে জ্বালিয়ে দেবে কাশ্মীরের লোক

তুমি আমাকে ছুঁলে রিজওয়ান, রাখালছেলে, খুব খুশি হবে
আমি কবিতায় সবক’টা কারেকশান মেনে নেব গোস্বামীজির
এই যে বহুতল খুলে গিয়ে মাছরাঙা-গন্ধের মাঠ, তোমার চুলের থমথমে
ধানগুছির কাছে সেধে বলছি: একবার ছুঁয়েই দ্যাখো না —
সমুদ্রের সব মাছ উঠে এসে এ-চোখের ভিজে মুছিয়ে দেবে
সোনার গৌরাঙ্গ আমি ষোলো আনা প্রণামীতে ভক্তের মাথায় ঘুরব বাকিটা জীবন…

কবি তাড়াতাড়ি মরে যাক

কবি তাড়াতাড়ি মরে যাক

এক.
হোয়্যারঅ্যাজ ইট অ্যাপিয়ারস যে কবিকে পঞ্চাশ বছর বয়েস হলেই মরে যেতে হবে। না মরুক, থেমে যাবে — তার মানেই তাই। সোজা কথা — কবিজনের মধ্যেকার কবি খতম হোক। এবং হোয়্যারঅ্যাজ ইট আবার অ্যাপিয়ারস: কবি যেন তিরিশ বছরের বেশি কাব্যচর্চা না করে (যে সময়সীমা আগে পার হচ্ছে, সেটাই বলবৎ)। নাহলে আনফিট কবি প্রচুর পাতলা লেখে আর রফা করে আর ভাটবাক্য বকে যায়।

লিখতে না পারার কারণ অসংখ্যবিধ। দৃষ্টি মোছে চোখ থেকে, মন নতুন দ্যাখে না, সবচেয়ে বেশি সরু হবে মন:সংযোগ। পুরনো প্যান্টের বোতামের মতো বিস্ময়বাটন খুলে পড়ে গেছে চেতনা থেকে — কাজেই কবিরই সর্বস্ব দ্যাখা যায় ফাঁক দিয়ে, কবিতা ছাড়া। ঘটনার পলেস্তারা খসিয়ে আইডিয়ার গাঁথুনিতে ব্রাশ ছোঁয়াতে পারবে না, শুধু ত্বক থেকে কথা বলা। নিজের পুরনো লেখা পড়ে আর ভাবে, শালা ফাটিয়ে দিয়েছিলুম।
[অ্যানেক্সচার ওয়ান: বাদ যাবে সেই সেই কবি যাদের গুরুতর বীভৎস বেকায়দা প্রতিভা, হুইচ ইনক্লুডস রবীন্দ্রনাথ]।

কবিতার একটা মাথা-ঠেকে-যাওয়া, শ্যাওলাধরা চোরাদরজা আছে — পদ্য। পদ্যকে সিলেবল-এ ভেঙে দেখুন, পায়ুর সঙ্গে মিল পাবেন। কিন্তু পদ্যের পাছদরোজা গিয়ে থেমেছে কবিতার জাঙ্করুমে। ছানা নয়, গাদ থেকে তৈরি হল পদ্য এবং কোনও ট্যারিফ সিস্টেমেই চমচমকে আপনি রসগোল্লা বানাতে পারেন না! তবে এই টি-টোয়েন্টি সমাজব্যবস্থায় পদ্যের একটা ইয়াব্বড়ো ভূমিকা আছে, প্যারাসিটামলের মতো। যারা পদ্য লেখে তারা দীর্ঘজীবী হোক।
কবি মরে যাক।

দুই.
আপনার হার্ট আপনাকে অ্যাটাক করার আগে যেমন একদুবার শাসিয়ে দিয়েছে বুকের মাঝখানে ব্যথার চিউয়িংগাম লাগিয়ে, তেমনি নিজেই নিজের সেকেন্ড-হ্যান্ড হয়ে ওঠা কবিকুল প্রচুর গদ্য লিখতে শুরু করে, ছোটদের জন্যে গল্পছড়া, আর স্বপ্ন দ্যাখে উপন্যাস ছাড়ব বাজারে। ভাবে কিন্তু লেখার সাহস পায় না; ভালোরকম জানা আছে, কবিতা কাঁচি মেরে দেবে বাকি লাইফের মতো। আর লিখেই ফেললে উপন্যাস?
“আমার বিচার তুমি করো”।
[অ্যানেক্সচার টু-এ: আলোচনা থেকে বাদ যাচ্ছে সেই সেই কবি যাদের গুরুতর বীভৎস বেকায়দা মাল্টিপারপাস প্রতিভা, হুইচ ইনক্লুডস রবীন্দ্রনাথ]।

মুশকিল হল, পৃথিবীতে কাউকে এক্স-পোয়েট বলার চল নেই। একবার কেউ কবি, তো চিরকাল এক্সপ্লয়েট করবে তোমাকে।

কবি মরে যাওয়ার দ্বিতীয় লক্ষণ, সে পত্রিকা সম্পাদনা করতে থাকবে, নিজের প্রকাশনীও খুলে ফেলতে পারে। [অ্যানেক্সচার টু-বি: বাদ যাবে ওই ওই কবির নাম যাদের গুরুতর বীভৎস বেকায়দা সাংগঠনিক প্রতিভা, হুইচ ইনক্লুডস রবীন্দ্রনাথ]।
কবিদের তিনটে দশা আছে ব’লে আমার ধারণা। এক: শুধু কবিতা লেখা (সৃষ্টি)। দুই: কবিতা লেখা আর ছাপানো (স্থিতি)। তিন: শুধু ছাপানো (প্রলয়)।
এই প্রলয়কালের আগেই কবিকে রুখে দিতে হবে। সে তো মরা নক্ষত্র। আলো ছড়াচ্ছে মানে বেঁচে আছে ভাবলে এত চরম ভুল হবে, আপনি বিরাট কোহলির মতো সর্বোচ্চ পরিমাণ জিভ কেটে গোটা বাংলাদেশ খেপিয়ে দেবেন। ধরুন, কবি তিনটে কবিতার বই লিখে ফতুর হয়ে গেছে। কিন্তু সুবুদ্ধি করে থামে আর কে? ফুরিয়ে যাওয়ার সিকি শতাব্দী পরে তার প্রথম কবিতার বই নিয়ে নাড়াচাড়া। ওই মরা তারার আলো আসা শুরু হল। কবি উৎসাহিত হয়ে বাইশ নম্বর কাব্য প্রকাশ করে দিলেন, তাতে সবক’টা অপদার্থ কবিতা। জনমনস্তত্বের নিয়মে সেই কিতাব নিয়েও হইচই পড়ে যাবে। ইতিমধ্যে এতদিনে তার দু’নম্বর কবিতার বইও পাঠকদের মনে ধরতে লেগেছে। ব্যস, মরা তারার তেইশতম কাব্যগ্রন্থ পেয়ে গেল অ্যাকাডেমি/জ্ঞানপীঠ/নোবেল, যেকালে একটা পদের পদ্য লেখার ক্ষমতাও তিনি হারিয়ে বসে আছেন।

সার্ত বেনি লেভিকে বলেছিলেন, পুরস্কার কমিটি লেখকের সেই বইটা বেছে নেয় যেখানে লেখকের নাভিশ্বাস উঠে গেছে। তারপর সেটাকে পুরস্কার দিয়ে লেখকের কফিনে পুঁতে দেয় শেষ পেরেক।

প্রায় একশো বছর হয়ে গেল, সাহিত্য সমাজকে আর প্রভাবিত করতে পারে না। সফটঅয়্যার-বিনোদনের যুগে তার অবস্থা সুকিয়া স্ট্রিটের দোতলার লেটারপ্রেস। সাহিত্য-পুরস্কার কথাটারও তাই মানে হয় না কোনও। তবু আমি যদি “বউ নেই শ্বশুরবাড়ি যাই পূর্বের সম্বন্ধে”, তবে ওই বাচ্চা ছেলেটা-মেয়েটাকে তাদের প্রথম বা দ্বিতীয় বইয়ের জন্যে পুরস্কার দিই না কেন? দিয়ে দেখি গলার মালা নিয়ে আর কী গুলদস্তা সে তৈরি করতে পারে, নাকি মালাটি হয়ে ওঠে মালা-ডি? তা-নয়তো মরা বডিতে কোরামিন মারো, সাহিত্য অ্যাওয়ার্ড-এর নাম পালটে সাহিত্যগ্র্যাচুইটি রেখে দাও…
যত্তো ঝামেলি!

তিন.
কবি শুরুতে পয়-পরিষ্কার থাকে। কল্পনার অতিবারিশ, ফুলটু সাহস, মোবাইলে মেসেজ করতে করতে গাড়ির নিচে চলে আসার মতো লেখার আত্মবিনাশী ঘোর, ভাসানো আবেগ, ভাষাআরশির ঝকমকানি, সততা নামের সেরা জীবনবিমা, ছাঁচ ভাঙার মেজাজ — এসবই অল্প বয়েসি লিভার-কিডনির সম্পদ। টাকমাথা ফাটিয়ে দুব্বোঘাস গজাতে পারে, কবিতা কক্ষনো নয়। সবচেয়ে আশার কথা, তরুণ কবিদের কেউ পোঁছে না। নন-এনটিটি না হলে তুমি লিখবে কী করে!

আরও একটা অতিরিক্ত ভালো হচ্ছে, নতুন কবিরা নিজের বাইরে পাঠক খুঁজতে বেরোয়নি। তাই কবিতা-ব্যতিরেকী কিছু তাদের বিরক্ত করতেও পারবে না। হুঁ, জীবনবোধের অভাব আছে বটেক। কিন্তু শিল্প তো আশমানি দুনিয়ার কথা বলে, টাটকা ফ্রেশ এক মহল্লার ইজারা নেয় — পুরনো বই পুরনো হাড়ে যার ইশারা খচিত হয়ে নেই।

পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিন কাজ হল শক্তিকে আটকানো। শক্তি অনেকটা কাপুরের মতো, চান্স পেলেই চরণামৃতকে চুতিয়া বানিয়ে দেবে। এদিকে, শুধু বেঁচে থাকার অভ্যেসই ক্ষমতাবান করে তোলে আমাদের। সেই ক্ষমতাপাথর কিডনি থেকে নিয়মিত গলিয়ে বার করে দেওয়া রামশ্যাম কবির কম্মো না [অ্যানেক্সচার থ্রিঃ ইন্দ্রজিতের তালিকায় আছেন অল্প একমুঠো সু-খতরনাক, বেকায়দা প্রতিভাবান, আড়েবল্লে, আত্মডাক্তার কবি হুইচ ইনক্লুডস রবীন্দ্রনাথ ]।

রাজনৈতিক রাষ্ট্রের ক্যাঙারু-থলিতে যে অনেক পুঁচকে রাষ্ট্র বসত করে, সাহিত্যরাষ্ট্র তাদেরই একজন। আবার সব সাহিত্যরাষ্ট্র মিলে এক আন্তর্জাতিক ইউনাইটেড স্টেটস অফ লিটারেচার। এইরকম বিভিন্ন ইউএসটিআর (ট্যাক্স রিসার্চ), ইউএসপি (শান্তি), ইউএসডিবি (ড্রাগ ব্যারনস), ইউএসবিএম (কালো টাকা) হয়ে থাকে। [দয়া করে ভাববেন না, কবিতালেখা আর সুপারিকিলিং বা শান্তিপ্রচেষ্টা ও নারীপাচারকে পাশাপাশি বসাতে চাইছি। আমি শুধু বিভিন্ন ছোট ক্যাঙারুর সাংগঠনিক জীবন নিয়ে কথা বলছিলাম]।

আমরা জানি, বয়েসের সঙ্গে সঙ্গে ইউরিক অ্যাসিড আর প্রতিষ্ঠা পাওয়ার খ্বাহিশ একই তালে বাড়বে, যেভাবে মানবশরীরের দুই প্রধান অঙ্গ জিভ আর লেজও লম্বায় সমান-সমান। তাছাড়া, জিভ যতখানি ভিজে ওঠে, লেজও নড়ে ততটা। কবির যদি শিয়ালজন্ম হয়, তবে তার গতি: শিয়াল থেকে কমার্শিয়াল, কবি থেকে সম্পাদক, লেখক থেকে নেতা, সংবর্ধনা থেকে সাহিত্যপুরস্কার, দেশ থেকে বিদেশ।

এভাবে পেছল সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে কেউ সাহিত্যরাষ্ট্রপতি পর্যন্ত হড়কে যেতে পারে। তার মানে কবি থেকে কবি-প্রশাসক, যদিও কবি শব্দটা বিশেষ্য থেকে বিশেষণে গিয়ে আরেকটু প্রতিবন্ধী হয়ে পড়ল।

এই ঘনচক্করে কবিতা গেল কোথায়! খোঁজ খোঁজ, এ-পকেট ও-পকেট ট্রলিব্যাগ রুকস্যাক… জিভছোলা ফেসক্রিম এমনকি সাবানমাখা খোসাটা পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে লিস্ট করে গোছানো, কিন্তু যাঃ ট্রেনের টিকিটই আনতে ভুলে গেলাম নাকি! এভাবে জংশন স্টেশনে কবি থেকে কবিতা আলাদা হয়ে যায়, খসে পড়ে — বৃষ্টিথামা মাঝরাতে পারদআলোয় অচেনা প্ল্যাটফর্মে গাছের পাতা থেকে যেভাবে ছিটকে হারায় জলের ফোঁটা।

বুড়ো কবি কিন্তু থানায় একটা ডায়েরিও লেখাতে পারছে না ফতুর-হয়েছি মর্মে, কেননা সে এখন সত্তায় পর্যবসিত এবং এনটিটি-র জীবানু তোমার ভোকালকর্ড নষ্ট করে দেয়। সেই “হোয়্যারঅ্যাজ ইট অ্যাপিয়ারস” কবিকুলকে কেউ বলে দিচ্ছে কি: বয়েস পঞ্চাশ হয়ে গেলে বা তিরিশ বছর ধরে লেখালিখি, হুইচএভার ইজ আরলিয়ার, কবিতা ছেড়ে দিতে হয়? বয়স্ক মুখগুলো দেখছে — নক্ষত্রের ছায়া অনেক দূরে যদিও, তারা নিজেরা পাদপ্রদীপের আলোয় ভাসমান। তখন সবাই এটাও কেন মনে করাতে ভুলে যাবে: পাদপ্রদীপ শব্দের দুটো অংশ খুব স্ববিরোধী, এবং পাদের হাওয়ায় প্রদীপ নিভে যায়!

বাবুইসভ্যতা

বাবুইসভ্যতা

তোমাকে খোঁজা মানে দেখে নেওয়া পুরনো গ্রিস বা মিশরের কতটুকু আকাশ ওই মাথায় ভিড় ক’রে আছে। তো দেখলাম, পেন্ডুলাম একটা মিড় করে আছে মার্লো পন্টি পিকাসোর মধ্যে, ক্লাসিক রোম্যান্টিকের মধ্যে, দিবাকর চৌধুরী সুজিত মিত্রের মধ্যে, আর এইভাবে ক্রমাগত মুড বদলাচ্ছে চিত্রনাট্য।

আরও লক্ষ করেছি তুমি প্রায় পুরোটাই ঢাকা একফালি সাগর বা একটুকরো মরুভূমিতে। এসব নিয়ে বড্ডো অসুবিধে, কারণ শ্যামরঙা মেয়েদের সমুদ্রে ভালো বন্দর থাকে না, উলটে তাদের নদীগুলোতে এত জলপ্রপাত — ক্যানো বাওয়াই মুশকিল!

যেহেতু আমি কোনওদিন গাছকে শুধু কাঠ হিসেবে দেখতে চাইনি, তোমাকে বুঝতে চেয়ে সময়ের অববাহিকায় বহুদূর নেমে যেতে হয়েছিল। সেখানে পনেরোশো সালে তোমার সমুদ্র এক অভিযাত্রী জিতে নেয়, তারও আগে তোমার মরুভূমি পার হয়েছিল কেউ, আমি বালিতে স্পষ্ট পায়ের ছাপ দেখেছি। এরপর অন্তত দশগুণ বেড়ে গিয়েছিল ট্রাফিক, তোমার দক্ষিণ থেকে উত্তরে রপ্তানি হতে শুরু করে মিউচুয়াল ফান্ডের টাকা, ক্রীতদাসদাসী; উত্তর থেকে দক্ষিণে যায় বাংলা কবিতা আর নলেন গুড়ের সন্দেশ।

শেষ পর্যন্ত তুমি তো মানুষ দিয়েই তৈরি, কাজেই আমার জীবনীও তোমার ভেতরে রয়ে গেছে। যে পুরুষ আসুক, তুমি গ্রহণ করে নাও ব’লে গ্রহণেচ্ছা দিয়ে তোমায় চিনতে পারি না। সেই কাছে-টানা মানুষগুলোকে যখন খুব আস্তে ছেড়ে দিচ্ছো, তখন ধরা সহজ বাবুইসভ্যতাকে — যেভাবে তুর্করা কনস্টানটিনোপল আক্রমণ করলে, সেটা মনে হয় চোদ্দশো তিপ্পান্নটিপ্পান্ন, বাইজানটাইন সভ্যতা ল্যাটিনদের ত্যাগ করেছিল। অবশ্য তারপরও আমার মনে হয়েছে যে তুর্ক অথবা ধীমান মজুমদারকে কাছে টানার মধ্যে তোমার সম্পূর্ণ নিজস্ব এক ভঙ্গি ছিল, যেমন পশ্চিম ইয়োরোপের পুঁজিবাদ বাকি সবার চেয়ে আলাদা।

আসলে, তুমি ভূগোলের বাইরে অনেক দূর ছড়িয়ে গেছ, যদি না তারও অতিরিক্তে হারিয়ে গিয়ে থাকো। দেখো, এই কথাগুলো লিখতে লিখতে আমার রাতও রূপকথা হয়ে যাবে, কেননা সভ্যতা সমস্ত গল্পের চেয়ে অফুরন্ত…

আনন্দনির্ভর

আনন্দনির্ভর

ভূমিতে পা রাখা আলতো সেবা হয়ে ওঠে
স্মিত ও টাটকা চপ্পল
জমির প্রতিটা তন্বী অণুর ওপরে,
সুষমা উন্মুক্ত হয়ে যায়

দেখি বাতাসের রোমকুয়োয় ধূপকাঠি গোঁজা
আর শুকনো পাতার নিচে ব্যবহার না হওয়া নিঃশ্বাস
জ’মে থেকে মরে গেছে
মুছে যাওয়া আনন্দনির্ভর…।
রাস্তার পাশের বাড়ি কড়াই-ছাত্র আর উনুন-মাস্টার মিলে
পড়াশোনাগন্ধের “সিরাজ”;
চলৎশক্তি হেঁটে গেল, গতিশক্তি সাইকেলে, সুভাষিত বলো নুড়িপাথরেরা

উঠি ইচ্ছে আমারও যে! গানের মাঝখান থেকে
গল্পের উপকারিতা থেকে, এমনকি পায়েসের কিশমিশ থেকেও লাফ দিয়ে উঠে
সবাইকে গোটো করে তুলতে চাইছি।
হকারের জামায় স্টেশনারি দোকান যেমন,
কবে থেকে গুটিয়ে শিরোধার্য করে রাখা মন আমাদের —
বিছিয়ে দিলে সেগুন কলোনির ভেতর এই
অনন্ত ঘুরকাটা লাল সুরকির পথ হতো…

মৃত্যুর পরে লেখা কবিতা

মৃত্যুর পরে লেখা কবিতা

এক
ও-তুমি যতই তক্ষশীলা বিহারে পাথরের ফুলকাটা জন্মদিন হয়ে থাকো
যতই না বায়ুদূত ফড়িংয়ের মতো রোদ ছেড়ে রাখো শরতের পেটের ওপর
তুমি যতবার ভরপেট খিদের মধ্যে মাতৃশোকেও কুকারের সিটি বাজিয়ে দাও
যদিও তোমার জানা — একটা কান্না কেঁদে মেয়েরা ঘরে মুখ লুকোয়
আর দশটা কান্না কাঁদালে বেরিয়ে আসে আজনবি মানুষ
সে-তুমি যা ভেবে বলো বাঁহাতের কড়ে আঙুল খসে গিয়েও
জীবন মুঠোয় ধরতে অসুবিধে হয়নি

তুমি আজও রাস্তায় হেঁটে যাওয়া পুরনো কফিন, আমি ভেতর থেকে মুখ বাড়িয়ে পৃথিবী দেখছি…

সন্তানপ্রণাম

সন্তানপ্রণাম

তিন
শুরুর পাঁচ ওভারের মধ্যেই থার্টিন ফর টু দেখে আমি হাতের অ্যাটাচি নামিয়ে রাখলাম, এভাবে অসুস্থ ভারতকে ফেলে অফিসে যেতে পারি না! ধড়াচুড়ো ছেড়ে খাটের কোনে বসেছি — এদিকে জলপটির ঝরানো ঘাম ভেদ ক’রে পারদ আটানব্বই থেকে তোল্লা শটে একশো দুই করছে; আর ওপাশটায় বমিতে বিছানা ভাসানো, বাথরুমে মুখ থুবড়ে প’ড়ে রক্তারক্তি ঠোঁটে… ধপাধপ এলিয়ে যাচ্ছে উইকেট। আমি সেই বাথরুমেই পেছছাপ করার ছলে ঢুকে হু-হু কেঁদে আসি, খাটের শিয়রে ফিরে অনুনয়ঃ আর একটাও স্ট্রোক নয়, শুধু মাঠে টিঁকে থাকো ইন্ডিয়া! কালো হয়ে আসা টিভি চোখের শাটার তোলে না, আগুনপোড়া কাঁপা স্বর শুনতে পাই — চেষ্টা চলছে।

শুনে টুপ ক’রে একফোঁটা জল খসল অ্যাম্বুলেন্সের চোখ থেকে — স্যালাইন, ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস স্প্রে করল ভিজে অক্সিজেনও। আমি তো অবাক, বুঝতেই পারিনি ভারতের সঙ্গে কবে ওর সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। কাজেই অ্যাম্বুলেন্সের পেটের মধ্যে পিতৃভূমিকে শুইয়ে আমরা ছুট লাগালাম সুপুরিগাছে বাঁধা লাল পতাকার পাশ দিয়ে মরা নার্সিংহোমের ধার ঘেঁষে রোহিণী নক্ষত্র পর্যন্ত। গোটা রাস্তায় তারাকুচির একটা ক’রে সিঙ্গলস জমা হচ্ছিল ব্যাটসম্যানের শার্টের পকেটে আর শান্ত হচ্ছিল রাত্রিশহর। দু’ব্যথার দূরত্ব সমান হয়ে যখন পারদ নেমে এসেছে মাত্র একটা রান বাকি-তে, আমি ডাকলাম, দেশ? সৌরজগত আমার!

শুনতে যে পেল তার নাম ঘুম, সাড়া যে দিল সে নিঃসাড়। তখন উপশমের ছাউনির নিচে সাদাপাপড়ি থেকে বোঁটাহলুদে জিতে যাওয়ার রান ফুটিয়ে তুলছে আমার ছেলেটা…

সন্তানপ্রণাম ২

সন্তানপ্রণাম

দুই
সব বাবা উঠে দাঁড়াও, আপামর বাবা বুকের বাঁদিকে হাত রেখে বলো, শেষ কবে সন্তান বুকে জড়িয়ে ধরেছ
ছেলেকে মেসেজ করতে গিয়ে যে-চোখ হঠাৎ ঝাপসা হয়ে যায়
মুখ তুলে সেই অপরাধী-দৃষ্টি একবার দেখাও আমাকে

দিন যায়, তোমার পিঠ থেকে খুলে বসন্তের ডানা
উড়ে যাচ্ছে ছেলের শরীরে
হারানোর জিনিসের লিস্ট থেকেও হারিয়েছে ‘নির্ভরতা’

আমি জানি, যেখানে সন্তান থাকে, শুকনো পাতা প্রজাপতি হয়ে ওঠে
যেখানে সন্তান থাকে, পায়রা ময়ূর মনে হয়
ভেবো না ছুটে এলেই কাছে যাওয়া যাবে সময়ের
সে তোমাকে দুঃখপ্রতিভার কোলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে, বাবুজি।
যেন এয়ারপোর্টমুখো একটা মারুতি সিডান, ভেতরের দুর্বোধ্য গান বাজছে

দরজা খুলে নেমে এসো, সি-অফের হাত নামার আগেই আষ্টেপৃষ্ঠে বুকে জড়াও সন্তান
ছেলেও জানুক শার্টের নিচে তুমি কতটা রোগা হয়ে গেছ

শরতের তালা

শরতের তালা

এই শরতের প্রথম কথা সবাই জানে হলুদ বেড়ে ওঠো
আলোর ছোট ছোট স্তনের ওপর চায়ের গরম ফোঁটা,
আঙুলের ডগায় রক্ত তুলে নারকোলপাতার শীর্ষাসন।

সময় আসার আগে বুঝতে পারছি সময় আসবে
মাইক থেমে গিয়ে গান হচ্ছে কলতলাতে, রেললাইনে, পাখির মাথায়
সকালে উঠিয়া আমি শার্ট পরে তার ওপর গরম লাগছে
শ্বেতপাথরের মন্দির, অষ্টভোগ শ্বেতপাথরের
সময় চলে যাওয়ার পর বুঝতে পারছি সময় চলে গেল
কতদিন পর চিলেকোঠায় উঠলাম শরতের তালা খুলবো বলে
নিচে কথা নিজেকে বলতে বলতে যাচ্ছে
যেমন পুজোর সতরঞ্চি এসে পড়ে দিনের মধ্যিখানে;

ভাঙা থাকতেও জোড় খেয়ে যাচ্ছে নতুন ঘোমটা, অর্থাৎ চিল কখনও
শকুন হবে না
যদিও সময়ে বুঝতে পারিনি সময় চলছে
বারুদকে খুশি করতে ফেটে পড়েছে শব্দ
শরতের শেষ-কথা তাহলে ফিরে আসবে কিন্তু রিস্কি হয়ে যায়
জানি, এ-ক’টা লাইনে জীবন খুশি হয় না