চন্দন ভট্টাচার্য এর সকল পোস্ট

হাসি এক ধরণের আর্তনাদ

হাসি এক ধরণের আর্তনাদ

এক-রাত ক্লান্ত মনোমালিন্যের শেষে
বসে আছি, মধুসূদনের মতো নিরাশ্রয়!
বন্ধ ঘরে ঘুষিবস্তু থুতুবস্তু উড়ে
মেরেছে হাওয়াকে। তার পেটে জারুল-নিঃশ্বাস—
আশঙ্কাজনক এক রক্তদলা, ওড়ে না। চমকায়

চোখের দুকোল জুড়ে চম্‌কিলা কাকবস্তি,
গলার ভেতরে খোঁড়া চাপাকল
যত টানো, ঘোলাটে, অজীর্ণ, ছেঁড়া
বৃহংনের শব্দে উঠে আসে অপমানিত।

অপমান জমিয়ে জমিয়ে আমি
তুলে গেছি অজস্র অপারতলা বাড়ি
হেসেওছি — হাসি এক ধরণের আর্তনাদ
জানুসম দুটো মুন্ডু, তার মধ্যে
খ্যাপার মাথাটা চিরক্ষণ তাকিয়ে রয়েছে রাত্রিতে।

এক-রাত দগ্ধ মনোমালিন্যের শেষ
পড়ে আছি, যযাতির মতো কুষ্ঠরোগী
গোটা দেশলাই, কিছুটা টোপাজ ব্লেড
হাতে করে, হাতে নিয়ে দেহ নিরক্ষর

শিরা থেকে শেষ উপাসনাবিন্দু ঝরে যায়
বীর্য থেকে অশ্রু খসে পড়ে…

গল্পছড়া : কবে যেন…

গল্পছড়া : কবে যেন…

অ্যালঝাইমার’স রোগে ভুগছে বন্ধু আমার
স্যাকরা মনের থই পায় না ওষুধ কামার

দেখতে গিয়ে গল্প বানাই এটা-সেটা।
কথার ছলে ওর জীবনের বিশদ ডেটা
শুনিয়ে দিলাম। চোখ নাচিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে
সব স্মরণে; “এবার শুধু জানার ইচ্ছে :
লাস্ট উইকে এ-ঘরে তুই খাটের কোনায়
দুহাত তুলে ভীষণ ক্ষেপে চেঁচিয়েছিলি
নির্বাচন কি আইপিএল বা তারচে’ সিলি —
মনে পড়ে না মাথা কুটেও — কোন ঘটনায়”?

“গত সপ্তায় এসেছিলাম? উঁহু উঁহু
তখন আমি ভ্রমণ মোডে বান্দ্রা, জুহু,
ছত্রপতির স্ট্যাচু দেখছি মেয়ের সাথে।
নাকি সেটা গতবছর?… হঠাৎ লাইট
বন্ধ হ’য়ে সবুজ শিলা, পার্শি গাইড
হারিয়ে গেছ্‌লো ঠিক কবে যে হাতিগুহাতে!”

আবছা ত্রাসে চিবিয়ে চলি বোতাম জামার
অ্যালঝাইমার’স রোগে ভুগছি, বন্ধু আমার?

পয়লা এপ্রিলের ছড়া

পয়লা এপ্রিলের ছড়া

অহনা গলার গহনা নিয়ে বৌবাজারে গেল
স্যাকরা এমন ড্যাকরা সেটি হাপিস করে দিল!
লোকাল থানায় গিয়ে না যেই vocal হল মেয়ে,
দারোগালাঠি বারো-ঘা তার পিঠটি ভ’রে খেয়ে
সোনার দোকান-owner বলে : নিছি, নিইনি তবু…
যেহেতু দিলাম বিলিয়ে, মিলিয়ে দেখে নেবেন প্রভু —

একটু গয়না দিয়ে ময়নার ঠোঁট বাঁধিয়েছি
অল্প সোনায় মাঠের কোনায় সূর্যডোবা টিপ।
হেমের জরিসুতোয় বুনে প্রেমতিজোরি বাড়ি
বাকি কনক টনক-টনক ধুলোয় গড়াগড়ি…

শান্তিপুলিশ ছুঁড়বে গুলিজ — এমনি রাগে গাঢ়:
গয়না ছড়াস পথেঘাটে? ভাটের কথা ছাড়ো!
স্যাকরা অবাক, গবাক্ষে তাক, গলা যাচ্ছে শোনা —
সুখের আড়ত সোনার ভারত গড়তে হবে না?

জীবনের হালকা খাবার

জীবনের হালকা খাবার

মুড়িময় জীবন কাদের?
উঠতে মুড়ি, বসতে মুড়ি
তার সঙ্গে আলুবরবটি
ভাজা নাকি খসড়া তরকারি?!
একবারে এক এক চামচ
পরে দুটো মিষ্টি আছে

ছোট্ট ক’রে কেটে খাও
আমের চতুর্থী ফালি
চৌসা আজকে পঁচাত্তর
নাচিয়ে নাচিয়ে খাচ্ছ
সবটা যেন ফুরোবে একসাথে
মুড়িতে চন্দনের গন্ধ
সোনাল, শুকনো, লালটুশ।
লতায় মুড়ি, পাতায় মুড়ি
জীবনের হালকা খাবার
মুড়িময় জীবনামাদের

ট্রেনভোমরা

ট্রেনভোমরা

ক’হাজার ছুটছে বিছানা?
কতগুলো আবাসিক স্কুল?
নাকি জেল ঠাসা কয়েদিতে‍!
সেল-এর জানলা রাখা ভুল।
ন’ঘন্টায় হেসেখেলে যাব
সেই পথ ডবল-ডবল
“এখনও শিয়ালদা ঢোকেনি?”
সব মোবাইল অবিরল…

রাগ ঠোঁটে শাপমন্যি আনে?
ভাবো এটা জীবনের ট্রেন
লেট করছে পৌঁছোতে মানেই
যমরাজ ঘুমোতে গেছেন!

ছড়া : লিলিপুট

ছড়া : লিলিপুট

তুমি ছিলে আয়লাখেকো
এখন পাঁচমাত্রায় লেখো

আগে ছিলে গো খিটকেল
এখন রাধাকৃষ্ণ ফেল
প্রেমে হাপুসহুপুস হিয়া
প্রেফারেবলি পরকিয়া

সেদিন কলজে ছিল পুঁজি
আজ ডর-কে-পিছে বুঝি?

আগে দুমদাড়াক্কা কথা
হালে “নো কমেন্টো” নেতা
ভাষা জমেই গেছে শীতে?
খুশি ঘনিয়ে আসে চিতে —
খোলো টেকিলা, জিম বিম
পূর্বে কেন্দুলি-ছিলিম
তার ধকটা খাঁটি ছিল
আজ ফ্লেভার টিকোলো

আগে জীবন অবধূত
এখন উটের পিঠে উঠেও তোমার…
পুটের পিঠে পুট

কৃষ্ণকালা

কৃষ্ণকালা

— গান শুনতে যাবি ডোভার লেনে?
— না গো, আমার ফাঁড়া ডোবারম্যানে

— আজ উল্লাস, গাইবে কোশলকর!
— এমন শীতে তুই-ই গোসল কর

— কাল বসছেন পণ্ডিত যশরাজ
— কবিরাও কি বাজায়নি এস্রাজ?

— চৌরাশিয়া অসুস্থ, আসবে না
— বর ইউএসএ, বৌ রাশিয়া — জানা।

— কান বুঝি তোর জাগবে ঘন্টা-কাঁসরে!
— সঙ্গী পেলে যেতাম গানের আসরে…

চন্দ্রকোষ

চন্দ্রকোষ

অটো-সবুজ গাছপালা
মেঘ ভেসে যাওয়ার শব্দে
গৃহে যে শ্যামলী থাকে, চার পা, ডাকছে

যেখানেই জল, সেটি পৃথিবীর শিরা
ফাঁকা মাঠে শস্যের কীর্তন শুরু হল
মিঠে ও শমিত এই বোলে
একদিন, স্তন নিচু, আমাকে কুড়িয়েছিলে, ফুল!

নিজের দীপ্তি নিভে সবচেয়ে শান্ত এই সন্ধে হয়ে যাওয়া,
যখন একটু গলা টানতেই মুখে অস্তিত্ব উঠে আসছে।
রাত দু’ইঞ্চির বেশি অগভীর দেখে
সিঁদূর-ধুতির ছাপে তখনও আকাশ মা-কালী!
এই ক্ষণে কতবার পুব থেকে দক্ষিনপ্রবাসী হল যে সৌমিক

আমার পরেও কত চাঁদ চিরকাল মেঘে লুকোবে…

[“সহ্যকে যন্ত্রণা করি”]

এমন প্রেসটি কোথাও খুঁজে…

এমন প্রেসটি কোথাও খুঁজে…

এ বছর বইমেলায় কবিতার বইটা না বেরোলেই নয় ব’লে প্রুফে নাক গুঁজে বসে আছি আর নাকের ডগা লাল হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ! শেষ সহ্য করতে না পেরে মোবাইলের দিকে হাত বাড়ালাম: ম্যাডাম, এত বানান ভুল? যেখানেই গা লিখেছি, পা কম্পোজ করে দিয়েছেন; কথায় কথায় গায়ে পা তোলাটা কি খুব ভদ্রতার ব্যাপার!

ওপাশ থেকে প্রাণখোলা হাসির আওয়াজ এল।

— কী হয়েছে জানেন দাদা, মেশিনের প্রবলেম। এখন পা-টা আপনার ওখানে তোলাই থাক; চিন্তা করবেন না, সময়মতো মানে ফাইনাল প্রুফে নামিয়ে নেব।

— সে নয় আমি কিছুদিন ভোলেবাবা হয়ে দম আটকে চোখ মটকে চিৎ হয়ে থাকলাম, কিন্তু থাপা’স লজের কথা লিখেছিলাম একটা কবিতায়, সেটাকে করেছেন থাপা’স লেজ! আপনার পাহাড়ে ওঠা চিরকালের মতো বন্ধ হয়ে যাবে, সে খেয়াল আছে? আর জলপাইগুড়িতে আমার মামার বাড়ি, ওখানে গেলে লোকসভা নির্বাচনের মুখে আমি নির্ঘাৎ খুনই হয়ে যাবো! আপনি কিন্তু সমগ্র উত্তরবঙ্গসহ তামিলনাড়ুর সেন্টিমেন্ট নিয়ে খেলছেন, ম্যাডাম!

ডিটিপি এবার আন্তরিকভাবেই অবাক হয়ে গেল।

— আরে দাদা, অত ভয় পেলে সাহিত্যিক হওয়া যায়? আপনারাই তো দেশকে পথ দেখাবেন! মেশিনে লজ নিচ্ছে না তো আমি কী করবো? বিশ্বাস না হয় বাড়ি ব’সে লেজ সরি লজ না নাড়িয়ে প্রেসে এসে দেখে যান একবার। তাছাড়া, এখন লজফজ উঠে গিয়ে হোম স্টে-র জামানা। সময়টাকে ধরার চেষ্টা করুন, আপনি তো মেসোপটেমিয়ার ইতিহাস লিখছেন না, লিখছেন আধুনিক মডার্ন কবিতা!

শুনেছি বিরুদ্ধ পরিস্থিতিতে পড়লে প্রতিভাবান মানুষেরা বজ্রকঠিন হয়ে ওঠে। কিন্তু আমার প্রতিভা হালদার বা বোস বা মুখার্জি কিছুই নেই বলে আরও বেশি নেতিয়ে যাই। তারপর সকাল থেকে আকাশ অংশত বদমায়েসি করে যাচ্ছে, রোদ ওঠার নামই নেই! শীতে কাঁপতে কাঁপতে বললাম:

—- আরও একটা কথা…ভেবেছিলাম চেপে যাব, কিন্তু না বললে বুকের ভাত হজম হবে না…।

— বলুন বলুন আবার কী ভুল পেয়েছেন? বাই দ্য ওয়ে, বুকের ভাত বলে কিছু হয় না।

— ওহ, সরি! ম্যাডাম, বিগত পঞ্চাশ বছরে আমার অন্তরে অনেক মেয়েই আঘাত দিয়ে গেছে, কিন্তু কেউ বলতে পারবে না কমপ্লেন করেছি বা আশা হারিয়েছি কোনওদিন। অথচ আজ আপনি যেভাবে সেই ভালোবাসার অপমান করলেন, তারপর আমার মতো ছোটলোক কবি ইয়ে ছোট কবির পক্ষে নিজেকে সামলে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ছে! এভাবে কেউ কখনও একান্ত গোপন অনুভূতিকে ভেঙে চুরমার করে দেয়নি তো!

— আহা, তলেতলে অনেকখানি এগিয়ে গিয়েছিলেন দেখছি! জানি আপনি ছিটিয়াল, গায়িকা জয়শীলা বাগচি বলে দিয়েছিল; ‘সম্মোহন’ পত্রিকার বীরেশ্বর সমাদ্দারদাও আগাম সাবধান করেছে ওকে আর যাই করো খবরদার ফোন নাম্বার দিও না, কিন্তু এসব বাদে আপনি মানুষটা…।

—ওরে বাবা সেকথা হচ্ছে না! আমার ‘মহাকাশের হেডফোন’ কাব্যগ্রন্থের তেষট্টিটা কবিতার চৌষট্টি জায়গায় (উৎসর্গপত্র ধরে) ‘ভালোবাসা’ শব্দটা প্রয়োগ করেছিলাম, আর আপনি সবগুলোকে কম্পোজ করে বানিয়েছেন ‘বালোবাসা’! দেখে ওভারডোজ কাম্পোজ খেয়ে সুইসাইড করতে ইচ্ছে করছে! আমার প্রেমকে এভাবে দুহাতের দশ আঙুলে পিষে দেওয়ার অধিকার কে দিয়েছে আপনাকে? জানি এখুনি বলবেন, মেশিনের দোষ।

— দূর মশাই, তানসেনের মতো বারবার মেশিন ধরে টানছেন কেন? আমি যা করেছি খুব ভেবেচিন্তে হিসেব কষে আপনার বালোর জন্যেই করেছি। টিভিমিভি দ্যাখেন না নাকি? ‘রানী রাসমণি’ হিট করার পর আজকাল ‘ভালোবাসা’ কেউ বলছে না। ভ আর কোত্তাও নেইকো, তেনার জায়গায় ব এয়েচে। ও বানান পালটানো যাবেনি। অ্যাকোন আমায় না জ্বালিয়ে পোনটা রাকুন দিকি!

সন্তানপ্রণাম … চার

সন্তানপ্রণাম
চার

নিজের ছেলে আর বেড়ালবাচ্চার মধ্যে কাকে বেশি ভালোবাসা উচিত?
হতে পারে দ্বিতীয়জনকে। কেননা সে কোনওদিন নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে না, মাছ ছাড়া মুখে তুলবে না অন্য খাবার… বেড়ালের এমনকি কোনও প্রেমিকাও থাকে না।

ছেলে আজও হাতের কাছে পেলে আমাকে স্পেলিং জিগেস করে নেয়। আমি জ্বর হলে পাই একটা এক্সট্রা ফোন। ওকে কত গাছ আর নক্ষত্র, কত মহামারি আর ভাগ্যবিপর্যয় চেনানো হল না, আমাদের একসঙ্গে ঠাকুর দেখার প্রোগ্রাম দাঁড়াল না মাটির ওপর। শুধু দুজনের মধ্যেকার গল্পের স্টক ফুরিয়ে ফেলা গেছে…।

কাজেই নিজের ছেলে আর বেড়ালবাচ্চার মধ্যে কাকে বেশি ভালোবাসা উচিত? হয়তো যে একটু বোকাসোকা, তাকেই। বেড়ালও বারবার আমার ডানহাতের প্রথম আঙুলটা মুখে পুরে নিয়েছে; কিন্তু ও খুব জানে কতটা কামড়ালে দাঁত ফুটবে না।

ফড়িংভাবনা

ফড়িংভাবনা

নারীপুরুষ সম্পর্ক যখন ভাঙে, সব সময় যে দুহাতে ছুঁতে পারার মতো কারণ লেগে থাকে তাতে, এমন নয়। এক-কলসি ভালোবাসা আর সেই প্রেমেই ডুবে থাকার সাবমেরিন ইচ্ছে সত্ত্বেও প্রতিদিন নানা দুদুভাতু কারণে মনোমালিন্য হতে হতে দুজনে যেন নিজেদের কাছে হেরে গিয়েই অন্যকে হারিয়ে ফেলার সিদ্ধান্তে পৌঁছোয়।

আর ‘বাস্তব’ হেতুসকল, যেমন টাকাপয়সা, নির্যাতন ইত্যাদির সর্বসমক্ষে আসা পল্লব সরিয়ে দিলে চোখে পড়তে পারে, নিচে সুপক্ক পেয়ারাফলের মতো ভুলবোঝাবুঝিই চুপটি করে বসে ছিল।

আমি দেখেছি, সম্পর্ক-বিচ্ছিন্নের একটা বড় মহাদেশ অশনিবেগে, না জাঁক দেরিদা নয়, জ্যোতিষশাস্ত্রের দিকে ছুটে যাচ্ছে। এত ঘনিষ্ঠ মানুষটাকে বুঝতে ভুল হল কেন, সম্পূর্ণ বিশ্বাস রেখেও কেন ঠকলাম, সেই সব গুগলি ‘পড়ে’ নিতে চাইছে তারা। কেননা, ভাঙনকালে তো দুজনেই নিজেকে অন্যের দ্বারা ভিন্ন বা এমনকি একই ইস্যুতে প্রতারিত ভেবে থাকে!

আঘাত আর ব্যথা কার্যকারণ সম্পর্কে বাঁধা আছে। কিন্তু আঘাত যদি তোমাকে আশ্চর্য করে দিতে পারে, তবে যন্ত্রণা শতগুণ হয়ে ধরা পড়বে। কেননা, তখন ওই ব্যথাই ঘুরে গিয়ে আবার আঘাত করে, আঘাত থেকে পুনরায় ব্যথা জন্ম নেয়…ধারাবাহিক, নিউক্লিয়ার ফিশন-এর মত। আর প্রেম ভেঙে যাওয়ার মচমচ শব্দ যখন কানে ধাক্কা মারছে, মনকে তুমি যতই স্কুল ইউনিফর্ম পরিয়ে রেডি রাখো না, বাস এলেই তুলে দেবে, ভেতরের আর একটা অন্তর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বলে যায়, ধুস, এ একটা বিচ্ছিরি দুঃস্বপ্ন, সত্যি হতেই পারে না। কাজেই ভেবে দ্যাখো, বিস্মিত হওয়ার হাত থেকে নিস্তার নেই প্রেমিকের।

তারপর গ্রহমুক্তি হবে একদিন। যদিও মানুষের জন্ম বা মৃত্যুসময়ের মতো সম্পর্কের ভ্রূণধারণ বা দাহকাজের মুহূর্ত চিনে ওঠা যায় না, আশপাশে অনুভবী কেউ থাকলে টের পায়, শোকতপ্তের গলার ধড়া নেমে গেছে, মুণ্ডিত মাথায় জেগে উঠছে নরম কার্পেট।

কিন্তু ওই প্রাণ কি আগের জীয়ন হয়ে ওঠে আর কোনওদিন? বিচ্ছেদ কি বিকৃতি নয়! যেন টাইম মেশিনে চেপে একজোড়া জুতো বিচ্ছিন্নের ছোটবেলায় পৌঁছে তাকে গাছ থেকে খসা জামের মতো থেঁতলে দিয়ে আবার ফিরে এসেছে বর্তমানে। তাই যখন সে প্রেম হারালো, ওই বিকৃতির বীজ ফুটে উঠতে লাগল ভেতর। সবাই দ্যাখে, মানুষটা আগে তো এমন ছিল না!

আমরা কেউ জানি না, ধ্বংস হওয়া সম্পর্কের সুড়ঙ্গ দিয়ে বেরিয়ে না এলে আজ ঠিক কেমন দেখতে হতাম, গলার আওয়াজ কিরকম হতো, হাঁটার ভঙ্গি তো পালটে যেত নিশ্চিত, চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে হাসতাম রাস্তাঘাটে আর সমাজসেবামূলক কাজ; শীতের শ্বাসকষ্ট থাকতো না, পঁচিশ হাজার শব্দে উপন্যাস লিখতাম পুজোসংখ্যায়…আমরা কেউ জানি না, প্রেম ভেঙে সরে না এলে আমাদের প্রেম কি ভালো থাকতো!

মস্তিষ্কের ফাঁকা পাকস্থলী

মস্তিষ্কের ফাঁকা পাকস্থলী

আশি বছর বয়েসে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন “সভ্যতার সংকট”। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই তাকে চেয়ে এসেছে গোটা পৃথিবী, নতুন এক মানবিকতা, এক বিশ্বাসযোগ্য আশাবাদের প্রবক্তা হিসেবে। আইনস্টাইন জানতে চেয়েছিলেন, সত্য ও সুন্দর কি মানুষের মনন-উচ্চতার অনেক ওপরের জিনিস? না — রবীন্দ্রনাথের সপাট উত্তর।

তখন বিপ্লবী চায়না থেকে জাপান, গোটা ইওরোপ ঘুরে বেড়িয়ে বক্তৃতা দিতে হচ্ছে কবিকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এড়ানো যায়নি ঠিকই, তবু রোমা রোলাঁ, এইচ জি ওয়েলস…পৃথিবীর প্রধান চিন্তাবিদরা তার আদর্শবোধে আস্থা রেখে আত্মজিজ্ঞাসু হতে চেয়েছেন। নানা দেশে এমন উদাহরণের অভাব তো নেই। ফরাসি বিপ্লবের তাত্বিক নেতা ছিলেন রুশো, ভোলতেয়ার, দিদেরা আর সেই ফ্রান্সেরই ১৯৬৮-র ছাত্র আন্দোলনের প্রধান আদর্শবাদী মুখগুলো সার্ত, রোলাঁ বার্ত, মিশেল ফুকো…। শুধু রবীন্দ্রনাথকেই, ব্রজেন্দ্রনাথ শীল যেমন লিখেছেন, প্রাচ্য আর পাশ্চাত্য দুই দুনিয়ার দায় নিতে হয়েছিল।

অথচ, আমরা নিজেদের রাজ্যের দিকে একবার ফিরে তাকাতে অনিচ্ছুক, অক্ষম।

নন্দীগ্রাম নিয়ে আন্দোলনের সময় কিছু বাঙালি ভাবুক চিন্তাবিদ একসাথ হন। মনে হয়েছিল, রাজনৈতিক আন্দোলন এক তাত্ত্বিক পটভূমি পাবে, যা ক্ষমতা হস্তান্তর বিষয়টার বাইরে গিয়ে ব্যক্তির সামাজিক ভূমিকা নিয়ে রাখবে আলাদা কিছু প্রস্তাব। সততা আর স্বার্থচিন্তার দ্বন্দ্ব থেকে নতুন এক জীবনপ্রক্রিয়া বেরিয়ে আসবে হয়তো বা। আমরা পরে বুঝেছি, ব্যক্তিগত অ্যাজেন্ডার বাইরে প্রায় কেউ ভাবেননি। যে কয়েকজন দলভাগের বিরুদ্ধে ছিলেন, তাদের মধ্যেও প্রসঙ্গের কন্ঠস্বর হয়ে ওঠার রসদ ছিল না।

এখন অবস্থা আরও করুণ ও বিপজ্জনক। অন্ধকার যেভাবে আলোর অভাব, আজকের দুর্নীতি, ক্ষমতাকে ঘিরে উন্মত্ততা আসলে চিন্তার সার্বিক এক শূন্যতারই ছবি। সেই শূন্যতা শুধু ধর্ষণকারী বা গরীবের অর্থ আত্মসাৎ করা মানুষগুলোরই অসুখ নয়, ঘটনা নিয়ে আলোচনার আসর জমানো টিভি চ্যানেল আর তার সামনে বসে থাকা শ্রোতারও। এক দল যে-কোনও উপায়ে মসনদে টিঁকে যেতে আর অন্য দল যে-কোনওতর কায়দায় কুর্শির দখল নিতে ঝাঁপ দিয়েছে। তাই কোথাও কোনও বদলের আশা থাকে না। সমাজের প্রত্যেকটা এজেন্সি ঠিক ভাড়াটে সৈন্যের মতো নিজের পারফরমেন্স শেষে চুক্তির টাকা গুনে নিয়ে সরে পড়ে। মনে হয়, রাজ্যের সমস্ত মানুষের উচ্চতা একই। অন্যায়, অন্যায়ের খবর, অন্যায়ের প্রতিবাদ, অন্যায়ের তদন্ত, অন্যায়ের বিচার — যেন একই অপরাধের শিমূলবীজ থেকে জন্ম নিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে।

কবি-শিল্পী নয়, একজন চিন্তাবিদ চাই আমাদের এই সময়ে। ফাঁকা, ভিতু, অসহায় মাথাগুলো নতুন কিছু আইডিয়া, আদর্শ, দর্শনতত্ব চায়। মস্তিষ্কের পেট অভুক্ত আছে কতদিন যে!

জীবনের একজন ভাষ্যকার দরকার, এক প্রবক্তা, যিনি এই কর্দমাক্ত অন্ধকার থেকে টেনে তুলবেন আমাদের, মননের আতুর বিছানা থেকে। কিন্তু কাউকে পাওয়া যায় না। এদেশ, ওদেশ…গোটা পৃথিবী আশ্চর্য জনশূন্যতার মধ্যে পড়ে আছে!

কালবর্ষা

কালবর্ষা

ভোর, ঊষাগেট, একটা অটোতে যাওয়া যায়
ঘুমের চৌরাহা থেকে আকাশি বর্ষায়
সেখানে গুচ্ছের মেঘ, সুরজ ট্রেডিং ঝাঁপ বন্ধ রেখেছেন
তবু টুকটাক আসল চন্দন বলবেন

কাজের বিকল্প কাজ কী বা আছে বিড়িটানা ছাড়া
মন্ত্রীর পুলিশ, বেশ্যার মুখখিস্তি পাহারা
মাঝখানে হড়কে যাচ্ছে গঙ্গাসাগরের দিকে সব ড্রেন
ভাই, প্রতিদিন প্রচুর চন্দন বলবেন

শোণিত-কম্বলে শীত ঢেকেঢুকে শুয়েছে জনতা
শিল্প পাতে মারো আর লিফলেট ছড়িয়ে — একই কথা
শোক থেকে শ্লোক হবো, ফুটো হাড়ে ঠোঁট রাখলে বাঁশি
অগুরু আমার গুরুদেব, মম আকাশ কাটা খাসির
মতো ছটফটাচ্ছে…থেমে যাবে এক্ষুনি…আমেন!
পোড়া ডাকলো, অর্জিনাল চন্দন বলবেন

ভেলৌরযাত্রীর ডায়েরি


তখন খাগড়াগড় বিস্ফোরণ সদ্য জন্ম নিল। বাঙালি হিন্দুর ঠোঁট ওলটানো ভুরু কোঁচকানো অংশটা তার রিলিজিয়াস অপোজিটকে মনে মনে ভয়-রাগ-সন্দেহ-ঠাট্টা দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে এমন কিনারাশায়ী করে ফেলেছে, চোখের সামনে তাদের টুপটুপ করে ঝরে পড়তে যে দেখছি না, সে শুধু পৃথিবীটা গোল বলেই।

এমন একদিন অফিস-ফেরতা হানা লাগালাম রাতের বাজারে, ফল কিনবো। দোকানদার বলল, আজ টাটকা পেয়ারা আছে, নিয়ে যান। ওমনি এক মানুষ, দাড়ির ভঙ্গিমাটি যেন মুসলমান, যিনি ওই দোকানের দরজাতেই দাঁড়িয়ে, বাছতে শুরু করলেন। মালিক আবার বলল, ওরই বাগানের পেয়ারা। মুসলিম ভদ্রলোক ৪-৫টা পাল্লায় তুলে দিয়ে আমার দিকে ফিরে বললেন, খেয়ে কাল এখানে বলে যাবেন কেমন টেস্ট। নিজের গাছের ফলের প্রতি বিশ্বাস তার চোখেমুখে খুব স্পষ্ট লেগে আছে। ধন্যবাদ দিলাম, ফল ব্যাগে পুরে চলে আসার সময় আবার বললাম, আসি দাদা।
একগাল হেসে ভদ্রলোক আমার ডান হাতটা কনুই পর্যন্ত জড়িয়ে ধরলেন দুহাতে। মনে হল, আদতে পৃথিবীর কোনও বিপজ্জনক কিনার না থাকলেও তিনি তাকে বর্গ বা আয়তক্ষেত্র বলে অনুভব করেছেন। তার চোখে ছিল বৃত্তাকার ভালোবাসায় আবার গৃহীত হবার কৃতজ্ঞতা।


পকেটে পয়সা থাকলেই আমি গীতাবাক্য না মেনে ফলের আশা করে থাকি, ফলত, ফলের সঙ্গে উপ্রি কিছু ফললাভ হয়েও যায় মাঝেমধ্যে। ভেলোরেই সেদিন যা ঘটল। যে-হোটেলে থাকি তার সামনের দোকান থেকে বেদানা বেছে কেনার জন্যে তিরিশ সেকেন্ড সময় নিয়েছিলাম, দোকানদার বলল, অতো বাছলে বিক্রি নেই, কেটে পড়ুন।

“পো” বলে সংক্ষেপে গেট আউট বুঝিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে তামিল জনজাতি। শুনে ‘পেলাস্টিক’-এ খুবই আঘাত লাগল। রাগ করে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছোলাম ওখানকার প্রাচীন বাজার নেতাজী মার্কেটে। তারপর একটা দোকানে ফেজটুপি মাথায় ফলওয়ালা দেখে সোজা হাজির সেই দরবারে (ছোটবেলা থেকেই মেহেন্দিকরা দাড়ি বা গলায় রুপোলি ক্রশ দেখলেই কেমন যেন চাঁদে হাত পেয়ে যাই)।

তখনও কি জানতাম আগের ভেলোরিয় দোকানদারের অ্যান্টোনিমে পৌঁছে গেছি? নিজেরই দোকানের আপেল, অথচ পৌনে এককেজি বাছতে গিয়ে তার কিছুতেই পছন্দ হয় না। নাহ্, এটা ট্রান্সপোর্টে আসার সময় টোল খেয়ে গেছে, এটায় টোকা মারলে ব্যাটেবলে হওয়ার টং শব্দ উঠছে না…। তিনচারখানা আইটেম হাতে ঝুলিয়ে নাচতে নাচতে হোটেলে ফিরলাম। কয়েকদিন পরে সব সাবাড় হতে ফের সেই দোকানে।

আপেলজহুরি পুনরায় বাছাইব্যস্ত হয়ে পড়েছেন, আমি বললাম (কেন যে বললাম) বেদানাটাও দেখে দেবেন প্লিজ, আগেরদিন একটা পচা বেরিয়েছিল। ব’লে মুখের দিকে তাকিয়ে — এই যাঃ, ইনি তো তিনি নন! ভদ্রলোক হেসে ফেললেনঃ ঠিকই, গত শনিবার দেখেছেন আমার ওপরের ভাই মেহতাবকে। বলতে বলতে অনারের স্তূপ থেকে একটা ডিউস বল তুলে চালান করে দিলেন আমার ফলের ঠোঙায়। হাঁ-হাঁ করে উঠলাম, তারপর ‘অনুনয়-বিনুনয়’ও করতে বাকি রাখলাম কই, কিন্তু ভদ্রলোকের এক কথা, আপনার কাছ থেকে এই বেদানার দাম নিলে আমার ইমান রক্ষা হয় না। বে-ইমানি করতে বলবেন না দয়া করে।

ফিরে আসার আগে আর একবার তাকিয়ে দেখলাম মুখটায় —
এই দুনিয়াদারির মধ্যে দাঁড়িয়ে ইমানদারি দেখাচ্ছো? বাবু, তুমি সত্যিই সংখ্যালঘু…!

পুরনো কান্নারা

পুরনো কান্নারা

সব মেয়ে বন্ধু হয়ে গেল
পৌর্ণমাসী রাত থেকে, যাঃ ফতুর, যত সসাগরা মহিলা রয়েছে
কলেজ-এর গেট খুলে পিলপিল, বাদামের খোলা ভেঙ্গে
ঝুরঝুর; প্রতিটার সঙ্গে তুই করে কথা হল কথা হ’তে গিয়ে

ধারণা আমার শৈশব অবস্থা থেকে শরৎচন্দ্র খেয়ে শক্তিশালী
তাই, ঢুকতে যদি বা পারি তোমার ভেতরে, তৎক্ষণাত
বেরিয়ে আসতে হল বসন পুড়িয়ে, সাতগঙ্গাজলে ডুব, ক্ষৌর না,
সঙ্গম নয়… যে-যেখানে-প’ড়ে ভিত্তিতে বন্ধু হয়ে গেল

যে কারও মিঠাস গলা, যে কোনও সপ্তমে রাগ,
ধারণার মৃত্যু ক’রে আমি তার বুকের ওপর বসে বলছি,
চলে আয় বন্ধুশশী, বন্ধুপ্রভা – আর থিকথিক করে উঠছে
মেয়েবন্ধু… সমস্ত প্রকৃতি, সব আশ্রয়ের পিঠ বা পুরনো কান্নারা
আজ শুধু বন্ধু হয়ে গেল।