চন্দন ভট্টাচার্য এর সকল পোস্ট

ছাইদানি

ছাইদানি

কবিতার চুরমার অ্যাশট্রে ছাড়া আমি আর কীই বা, বলো তো!
পালিয়ে এসেছি তারা-বারান্দায়, মানুষের গন্ধে থতমত

কতবার ফাল্গুনের টিকা চোখে নিয়েছি যে, ভালোবাসাটিকা
গোঘাট-সুবর্ণপুর পারাপারে ব্যস্ত সব মধুমক্ষিকা

জানলা বন্ধ করো , অথবা গলায় ফোটে মৌমাছিপালক
আত্মা-উপুড় দিয়ে শেষ লিখছে একটুতেই মরে যাওয়া লোক!

তবুও অন্ধ-আমি পা-হারা প্রেমের কাঁধে উঠে যাই রোজ একবার
দুজনে কীভাবে যেন পার হবো গিরিখাত — মুক্তজবার…

ছোটদের গল্প : চুরি নামক সমাজসেবা

ছোটদের গল্প : চুরি নামক সমাজসেবা

এক
গামলাটা কোত্থেকে গেঁড়িয়েছিস? গর্জন করে উঠলেন দারোগা নিমাই পাঁজা।
– গামলা না স্যার, জামবাটি। ওটা সাত্তুকি মণ্ডলের। শেষরাতে ওদের বাড়িতে ঢুকেই দেখলাম উঠোনের সাইডে পড়ে আছে।
– গুল মারার জায়গা পাওনি! রাত্তিরবেলা সাত্যকি উঠোনের সাইডে কাঁসার গামলা ফেলে রেখেছে তুমি এসে হাতাবে বলে?
– তাহলে সাইডের পাশে হবে, স্যার। আজকাল অন্ধকারে ভালো ঠাওর হয় না।

পাঁজা দারোগা হতবাক। ‘সাইডের পাশে” আবার কী বস্তু রে বাবা! মাথায় টুপি নেই বলে চকচকে টাক আলো ছড়াচ্ছে। তার পেছনবাগে পালং-আঁটির মতো চুলে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে তিনি শকটা সামলালেন।
– এমনভাবে বলছিস, যেন সরকার তোকে চুরি করার জন্যে মাইনে দেয়, যেমন আমাকে দেয় দারোগাগিরির জন্যে!

সবেধন বুঝল, এরকম কথাবার্তা চলতে থাকলে দারোগাবাবুকে অনেকদিন পর্যন্ত পালংশাকের গোড়ায় ঝাঁকুনি মারতে হবে। তার চেয়ে রহস্য ভেঙে দেওয়াই ভালো।

-আমি তো প্রত্যহ রোজ কাজে বেরোই না, হুজুর। যে ক’টা দিন আকাশ থেকে দৈববাণী শুনতে পাবো, মাত্র সেই ক’টা…।

নিমাই দারোগা বুঝে গেলেন, এ-লোকের ব্যামো হচ্ছে একই শব্দের দুতিনটে প্রতিশব্দ উচ্চারণ করা, পর পর। কিন্তু ভাষাতত্ব না বিচার করে এখন দরকার চোরের প্রতি দারোগার আচরণ, মানে খেঁকিয়ে ওঠা।
– নাম কী তোর?
– আজ্ঞে, নাম বলব, না টাইটেল?
– মানে!
– হুজুর, নাম আমার টাইটেল হয়ে গেছে। বলুন তো কী অন্যায়! বাপ-মায়ে রেখেছিল নীলমণি, শিবপুজোর দিন জন্ম যেকালে। কিন্তু এখন পাড়ার লোকে ডাকে সবেধন নীলমণি।

বলে সে দাঁত ছড়িয়ে হাসে।
– পাড়ার একমাত্র সিঙ্গল চোর আমিই কিনা! বিশ্বাস করুন, বত্রিশ বছর হয়ে গেল এ-লাইনে, চোখের সামনে কত ভালো ভালো ছেলেকে দেখলাম বাপ-ঠাকুর্দার পেশা ছেড়ে ছিনতাইয়ে নেমে গেল। চুরি অনেক সূক্ষ্ম শিল্প স্যার, লেট স্বর্গীয় পি সি সরকার হয়তো মানতে চাইবেন না, কিন্তু আমরা মনে মনে ওনারই একলব্য শিষ্য। রাত্তিরে গিন্নি কর্তার পাশে শুয়েছেন — নাকে নথ, হাতে ছয়-ছয় বারোগাছি, গলায় মটরদানা হার। শুয়েছেন তো? সকালে উঠে দেখলেন গা-টা একটু হালকা ফিল হয়। যে কাতে শুয়েছেন, সে কাতে ঘুম ভেঙেছে, পাশও ফেরাইনি স্যার। নো ঘুমের গ্যাস, নো নকল কিত্তিম উপায়।

তবে আপনাকে তো বললাম, চিরকাল ওই অডারি কাজ ছাড়া অন্য কিছু হাতে নিই না। রাতে সকাল-সকাল লাইটের মধ্যে হালকা কিছু খেয়ে শুয়ে পড়লাম। তারপর যেদিন হবে, ঠিক দুটো থেকে আড়াইটের মধ্যে দৈববাণী। পরশু যেমন শুনলাম সাত্তুকির মা স্বর্গ থেকে বলছে, ওরে সবেধন, আমার অমন সাধের জামবাটিখানা ছোট ছেলে হত্তুকিকে দেয়ে এয়েচিলাম। কিন্তু আমি ঝিঙে তুলতেই (হৈমবালার সোয়ামির ডাকনাম যেহেতু পট্‌লা) সাত্তুকিও ওটা নিজের ঘরে নিয়ে তুলেছে। তা এর একমাত্র শোধ নিতে পারিস তুই, বাবা!

দুই
সবেধনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ভোর হয়ে এল। ঘাসের ওপর ফোঁটা-শিশির, একটা ফিঙে আধো-অন্ধকার শিরীষের ডাল থেকে ডানা মেলল স্লেটরঙ আকাশের দিকে।

মাসখানেক হয়েছে পাঁজা দারোগার আবির্ভাব এই মকরমপুর থানায়। পঞ্চাশ পার হওয়ার পর ইচ্ছে ছিল, রুটিন করে গিন্নিকে নিয়ে একটু মর্নি ওয়াকে বেরোবেন। কিন্তু তার আলস্যময়ী ওজনদার শ্রীময়ী ওই বিশেষ শব্দটাকে একটু বাড়িয়ে নিয়ে উচ্চারণ করেন: মর্নিং-ওয়াক-থুঃ! কাজেই মনের দুঃখে তার একাকী ভ্রমণ গিয়ে দাঁড়িয়েছে নাইট পেট্রলে। তবে দারোগা সাহেবদের একা থাকার সৌভাগ্য বিশেষ হয় না। এই যেমন আজ সবেধন নীলমণি জুটে গেল। আর মকরমপুর বাজারের ভোরের চা দোকান দেখল এক আশ্চর্য দৃশ্য, বেঞ্চে পাশাপাশি বসে থানার বড়বাবু আর এলাকার একমাত্র সিঁদেল চোর চা খেতে খেতে গল্প করছে! শুনল, গদগদ হয়ে সবেধন বলছে –
– সকালের এই প্রথম ফার্স্ট চা খাওয়ার ইমেজই আলাদা।
– তা, গামলার আগে আর কী ঝেঁপেছিস?
– এই তো গত শুক্কুরবার দৈববাণী শুনে পীযূষ সাঁতরার ফ্যাকটিরি থেকে একটা লেদার জাতীয় চামড়ার ব্যাগ তুলে আনলুম। পীযূষের বিরাট কারখানা, অথচ নিজের আপন ভাইপোর ইস্কুলে যাওয়ার ব্যাগ ছিঁড়ে গেছে, সেখেনে কিপটেমি। ওর স্বর্গীয় মৃত ছোটকাকা স্বপ্নে আদেশ দিয়েছিলেন আর কি।
– এসব চোরাই মাল বেচিস কোথায়?
– চুরি করি স্যার, কিন্তু বিক্কিরিতে নেই। বাড়িতেই লোক এসে দশ-বিশ টাকা দিয়ে নিয়ে যায়। ওটা মালের দাম নয়, সমাজসেবার মজুরি।

শুনেই দারোগার হাতে-ধরা বিস্কুট স্বেচ্ছায় আধখানা খ’সে মাটিতে পড়ে গেল! সন্দেহ নেই, সবেধনই সেই একমাত্র তস্কর, যে চুরির মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজের ভেতর দিয়ে নাগাড়ে সোশ্যাল সার্ভিস চালিয়ে যাচ্ছে।

-চল, তোর বাড়িটা দেখে আসি। দেল্‌ফির গুহায় থাকিস তো?
– না হুজুর, দিলখুশপুর। সে পড়ছে গিয়ে আপনার শিবালয়ের দক্ষিণে।
– তার মানেই তাই। শোন, গ্রিস বলে একটা দেশ আছে। আড়াই-তিন হাজার বছর আগে গ্রিসের দেল্‌ফি শহরে ছিল আপোলোর মন্দির। আপোলো গান, কবিতা, ছবি, অসুখ, ওষুধ, আলো, জ্ঞান এসব অনেক কিছুর ঠাকুর। তার আন্ডারে তোমার ওই দৈববাণীও পড়ে। তিনি অনেক দেবাদেশ শোনাতেন, তুই যেমন অল্পস্বল্প শুনতে পাস। তবে তোর কিনা মরা মানুষ নিয়ে কারবার।
– কী জানি স্যার! সবাই তো পরিচয় দেয় না। কোনও কোনও গলা বেশ চেনাও লাগে, রাস্তা-সড়কে শুনিছি যেন। তবে আমার কাছে এরাই ভগবান, মানে আপনার ওই আপেল আর কি।

ঈশ্বরের যাতায়াতের পথটা আবিষ্কার করতে বেশিক্ষণ লাগল না পাঁজা দারোগার। সবেধনের বাড়ির পেছন দিক ঝোপঝাড়ে ঢাকা; তার মধ্যে সরু পায়ে চলা রাস্তা এসে থেমেছে বেড়ার ঘরের ঠিক পেছনে। সেখানে দেওয়ালে একটি মাপসই ফুটো। উঁকি দিলে ওপাশে খাট; বালিশের অবস্থান বলে দিচ্ছে সবেধন এদিকেই মাথা রেখে ঘুমোয়। নাহ, নিদ্রিত হয় আর কোথায়! ঘাপটি মেরে পড়ে থাকে, আর জলজ্যান্ত দেবতারা আকাশবাণী শোনানো মাত্র তড়াক করে লাফ দিয়ে হাতের-কাজ করতে বেরিয়ে যায়।

হঠাৎ সবেধন খেয়াল করল দারোগার পকেট থেকে একখানা পঞ্চাশ টাকার নোট বেরিয়ে তার ডানহাতের তেলো খুঁজে বেড়াচ্ছে।
– সে কী স্যার, আপনি স্বয়ং দারোগা হয়ে চোরকে ঘু…ঘু… মানে অর্থসাহায্য!
– কে বলেছে চোর? তুই না সমাজসেবী!

এতক্ষণে নিজের বয়েসে আর ভয়েসে ফিরে এলেন নিমাইবাবু।
– এক্ষুনি গিয়ে সাত্যকির বাড়িতে গামলা রেখে আয়। বেড়ার দেওয়ালের ফুটোটাও সারিয়ে নিবি দুপুরের মধ্যে। আজ থেকে তোর দৈববাণী শোনা বন্ধ হল। হ্যাঁ, বেলার দিকে একবার থানায় আসিস তো, এমন চমৎকার সুন্দর বিউটিফুল কল্পনাশক্তি যার, একটা কাজে ঠিক লাগিয়ে দেওয়া যাবে।

নীলমণির মনে হল, এ-ভাষা যেন বড্ড চেনা চেনা, নিজের সংলাপের মতোই ঠ্যাকে! গদগদ হয়ে বলল, গরীবের বাড়ি যখন এলেনই হুজুর, এককাপ চা…।

নিমাই দারোগা উঠে পড়েন ব্যস্তভাব দেখিয়ে। না না, স্নান-খাওয়া সেরে কমপ্লিট ক’রে থানায় গিয়ে বসতে হবে ন’টার মধ্যে। হাতে আর সময় নেই।

দেরি করলেই লেট হয়ে যাবে!

সন্তান প্রণাম

সন্তান প্রণাম
এক

পেট থেকে নামাইনি তোকে ক্যাঙারু, শুধু শুনে গেছি
হাতের জলের গ্লাস কেড়ে দূরে রেখে দেওয়া —
সন্তান মানুষ করা বলে

ভোররাত… কাচের বয়েমে নেমেছিল চাঁদের রোদ্দুর
সবাই বলেছে ওকে পোকা লাগতে দাও
বিজনেস চালাতে দাও বাঙালি নদীতে

জয়ব্রত ঘরে ঘরে কান্না রেখে আসে
কেন সোনাকেও সোনা-লোভ শেখায় মানুষ?

আজ দেখি রামধনুর পা-দুটো দুরিয়াঁ মাপছে আমাদের
অচেনা বৃষ্টির ডালে ফুটে আছে মেহগনি বনের বেহালা

তোর সুরে থুতনি রেখে শুই

গানের কাছারি

গানের কাছারি

আমি যদি কোনওদিন মকরসংক্রান্তির পরিত্রাহি শীতে জয়দেব-কেঁদুলির মেলায় না গিয়ে থাকি, রাত জেগে না শুনে থাকি বাউলগান, দাঁত ঠকর-ঠকর হাওয়ায় সোয়েটারের ওপর জ্যাকেটের ততোধিক ওপরে বাংলা তুষের চাদর চাপিয়ে ঠান্ডা নিবারণের ব্যর্থ অব্যর্থ-চেষ্টার পর এক খুরি চায়ের মৌখিক স্টেরয়েডের জন্যে রাত চারটেয় মেলা-মধ্যবর্তী রাস্তায় ফলস হয়ে যাওয়া পায়ে হাঁটতে হাঁটতে নদীর পাড়ের একটেরে কোনে আবিষ্কার না করে থাকি অধীর দাস বাউলের আখড়া, যদি না দেখে থাকি বেনারসী-পরা তার দীঘল শরীর মঞ্চের ওপর সখীপরিবৃত, কেননা তিনি তখন স্বয়ং শ্রীমতি, এবং যদি না শুনে থাকি সেই নিসর্গ-কন্ঠের সুর, দৈবমধুরতা, তবে আমি কী জানলাম পদাবলী কীর্তন!

যদি কাটোয়া স্টেশানে নেমে বাস ধরে উপস্থিতি দিতে না পারি শ্রীখণ্ডের মন্দিরতলে, সেখানে নতুন-রঙিন কাপড় পরা গ্রাম-গরীব মানুষের ভিড়ে চোদ্দ বছরের সাদা-থান কিশোরি গৌরীশ্রী অধূর্য্যকে চার ঘন্টা ব্যাপী নামকীর্তন না গাইতে শুনি, তবে আমি কী সমঝদার হই বাংলা সঙ্গীতের?

যদি গঙ্গা পার হয়ে থানা না গেড়ে থাকি একা অচেনা অগ্রদ্বীপের মেলায়, দোলের আগের রাতে কল্যাণী ঘোষ-পাড়ায় জমায়েতে রেলগাড়ি হতে নেমে পিলপিলিয়ে না ছুটি, যদি শান্তিপুরের ভাঙা রাসের উৎসবে অযাচিত হাজির না হই, যদি বিদ্যাপতি-জয়দেব-চণ্ডীদাসের দুচার পদ চেখে না দেখি ইহজীবনে, যদি বাংলার গ্রামেই না বাস করি… চারিদিকে বৈষ্ণবের ভিড় — যারা বৈশাখের প্রথম দিনটায় ও আরও নানা বাহানাতে সম্বৎসর অষ্টপ্রহর চালু করে দেবেই দেবে, তারপর তিন অহোরাত্রব্যাপী ব্যবস্থার শেষদিন শুধু খেপে খেপে পদাবলী কীর্তন আর সেখানে দুবেলা খিচুড়িভোগ, পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেও জোর করে টেনে বসিয়ে দেয় — তাহলে আমি কী করে বিচার করব সই কুঞ্জভঙ্গ পালা, যদি থাকে আমার ‘কুঞ্জ’ শব্দের মানেই না জানা…!

আমিই সেই আহীরী

আমিই সেই আহীরী

এক
ঘরের দুটো জানলাই কখনও একসঙ্গে খুলে দিই না আমি। সহ্য করতে পারি না প্রেসক্রিপশান-বহির্ভূত অতটা আলো, যারা তাদের দোলখাওয়া সবুজ ঘরবাড়ি থেকে ছুটে এসে আমার চোখের তারাদুটো খেয়ে নেবে, মমি বানিয়ে দেবে মুখটাকে।

কিন্তু আজ নিরপরাধ অঘ্রাণ-সকালের হলুদ দীপ্তির মধ্যে দাঁড়িয়ে আমি হাট করে দিলাম আমার দ্বিতীয় ফুসফুস। হেমন্তের মচকা তাত শরীরে এসে লাগল। সুতো-সুতো খুশি জড়ালো ঘুমহীন হাসপাতালে ছোটা থেকে অফিসের পেপার-ওয়েটের নিচে চাপা পড়া এ-পর্যন্ত আমার সবক’টা আত্মায়।
আমার মনে পড়ল তোমাকে।

নাকি তুমিই ছুটে এলে আমার ভেতরে, অতীতসঞ্চার? যেমন বেড়াতে নিয়ে যাবে শুনলে এ-কোল থেকে ও-কোলে ঝাঁপিয়ে যায় শিশু!

দুই
আজও শেষরাতের ঘুম ভেঙে ভারশূন্য ঋদ্ধিশূন্য মাথা অন্ধকার ঘরে ধড়মড় করে উঠে খাট থেকে পা নামিয়ে চপ্পল খোঁজে। খুব দেরি হয়ে গেল, বুঝি! তোমাকে সকালের ফোন করতে হবে না? তারপর মনে পড়ে, সতীদাহ বা গুটিবসন্তের মতো বহুদিন সে-প্রথা আমরা নির্মূল করেছি। তখন মাথা ঝুঁকিয়ে বসে থাকা কিছুক্ষণ। সকালের চলাফেরা একগাছি খড়ের বাঁধন খোলা পালংপাতার মতো বারবার এলিয়ে যেতে থাকে।

তিন
আজ এই হালকা গলা-ব্যথার রবিবার বাজারে গিয়ে মাংসের দোকানের সামনে দাঁড়ালাম, নতুন ক’রে দেখে নিই ইতরের মুন্ডু ঝরে যাওয়া। তাকে দুজন লোক যখন দোকানের বধ্য-বারান্দায় নিয়ে আসছে, খাসির ভাঙা গলার চিৎকার হ’ল নষ্ট হওয়ার আগে সম্পর্ক তাক করে ছোঁড়া কাচের শেষ বাসনগুলো। এবার ছুরিতে দুফাঁক ক’রে দেওয়ার পর গলার নলির একমুঠো টগর আর চারপাশে রঙ্গনের উৎসারিত ঢেউ তার সারা শরীরে গণবিক্ষোভ ও সত্যাগ্রহের জন্ম দিচ্ছে, মণিপুরী নগ্ন মেয়েদের আইন অমান্যের মতো। এখন শক্ত করে ঠেসে ধরা চাই আমার শরীর — দুটো পা সাইকিয়াট্রিস্টকে দিয়ে দিন, এবং আরেক মনোবিদের কাজ হল নজরে রাখা পেশেন্টের হাত দুখানাও যেন খোলা বাতাসে ছড়িয়ে না যায়।

লক্ষ করুন, এই প্রতিরোধের ডোজ একদম ঠিকঠাক পড়েছে বলেই আমার ক্রমহ্রাসমান তলপেট এখন নিজের রক্তের বিছানায়… যার ওপর ওই রক্তেরই বেডকাভার… আস্তে আস্তে নেতিয়ে পড়তে আগ্রহী। বিড়বিড় করে বলছে ‘শান্তি, আত্মসমর্পণ’, কিন্তু চালচিত্রে একটা সাদা পতাকার অভাবের জন্যে কেউ আমার সন্ত্রাসবিরোধী মনোভাবে খুব একটা আস্থা রাখতে পারল না — না চিকিৎসক, না সাইকোথেরাপিস্ট। শেষপর্যন্ত গায়ের লোম খ’সে, চামড়া খুলে যখন ছাগল থেকে এক নির্মীয়মান খরগোশের দিকে চলে যাচ্ছি, এই প্রাণকে তামাদি ঘোষণা করা হয়। কারণ জীবন মানেই ‘ইশ্‌ছা’, যেমন অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস বলেছিল, সুতরাং অসন্তোষও, আর সেখান থেকে জন্ম নেওয়া পালটা-আক্রমণ। অন্যদিকে অসুস্থতা মোক্ষের কাছাকাছি, এবং মরণ হল পরমগতি। যে মরহুম, ধরে নেওয়া হচ্ছে তার ব্যাধিও মারা গেছে। তাই অভিযুক্ত টেঁসে গেলে প্রশাসন যাবতীয় অপরাধের তালিকা ও শাস্তির সুপারিশ ফিরিয়ে নিয়ে থাকে।

কিন্তু অনেক সময় আলাদা কিছু ঘটে যাওয়াও বিচিত্র নয়। যেমন, আমাকে সুশ্রীমতো ধুয়ে-মুছে উলটো করে বাস্তবের মাটিতে লটকে দেওয়ার পরেও দেখা গেল, যেখানে আগে কলিজা ছিল এবং বর্তমানে লেপচাজগত-এর আচমকা ধসনামা শূন্যতা, তিরতির করে কাঁপছে সেই সিনাঅঞ্চল। কাজেই, শিশুদিবসের সকালের বাচ্চারা তাদের অভিভাবকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে, “দ্যাখো বাপি, কতক্ষণ বেঁচে আছে ছাগলটা”! জীবিত থাকার ছদ্মবেশে এই চিউইংগাম কায়দায় দেহত্যাগ মেগা সিরিয়ালকেও লজ্জা দেবে ব’লে তৈরি, যখন গ্যাস ওভেনের উপর কড়াইতে খাসির ঠ্যাং ছেড়ে দিয়ে সভয়ে পিছিয়ে আসে বাড়ির নতুন বউ, “ও মাগো, এখনও নড়ছে যে”!
এই লেখাটাকেও এক জাতিস্মর স্নায়ুতাড়না ভাবতে পার তুমি।

চার
খুব মনে পড়ে, মনকষাকষি হলেই বলতে: আমাকে তুমি মোটেও ভালোবাসোনি। ভালোবেসেছ শুধু প্রেমের একটা আইডিয়াকে।

কিন্তু প্রেমকে প্রধানত ধারণা ছাড়া আর কীই বা ভাবতে পারি, বলো? যেন নার্সারি থেকে আনা গাঁদাফুলের চারা — মাটিতে বসালে তবেই না সে উদ্ভিদ!
ধারণা আর আধার — এই দুইয়ের যোগসাজসেই হয়তো সম্পর্ক গড়া হতে থাকে। স্বীকার করছি, নিজেকে কোনওদিন একতিল বাস্তবতা ভেবে শান্তি পাইনি, বরং হাতে-ধরা আমি-র চেয়ে আয়নায় প্রতিফলিত ছায়াই চিরদিন বেশি আদরের ছিল নিজের কাছে। এই শরীরকে যখন আত্মপরিচয়ের বদলে অঘ্রাণ মাস ভাবি, পাইনগাছের মাথার কুয়াশাপাগড়ি ভাবি, বা দু’পা পঙ্গু ভিখিরির ময়লা হাতের কয়েন একটাকা-দুটাকা, ফুরফুর করে ওড়ে কপালের ওপর আমার মাথার চুল।

সবাই জেনে গেছে, তোমার সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না কোনওদিন। দুটো মানুষ মনে-মনে ইচ্ছে না করলে তাদের তো ইহজীবনের দোকানদারি হয় না! তবু একটা পছন্দের রূপকথা আছে আমার, প্রেমের পেয়ারাডাল ভেঙে ধরাশায়ী সব প্রেমিকই বুঝি জাতিস্মর মোটর নিউরোনের তাড়নায় কেঁপে উঠে স্বপ্ন দ্যাখে — প্রেমের ওপর সে নিজস্ব কায়দায় শোধ নেবে, ছোটবেলায় পড়া গল্পের গরীব গয়লানির মতো। মাথায় দুধের মট্‌কি নিয়ে মেয়েটা রোজ বাজারে যেত। তো, একদিন হাঁটতে হাঁটতে ভাবছে, এই দুধ বেচে লাভ ক’রে আরও বেশি দুধ কিনে সেই দুধ বিক্কিরি করে অসীম মুনাফা অর্জনের পর সে এমন অনাস্বাদিতপূর্ব বড়লোক হয়ে যাবে যে দেশের রাজপুত্রও বিয়ে করতে চাইবে তাকে। কিন্তু সেই গরবিনী তখন ঘচাং করে খারিজ করে দেবে নবাবজাদাকে। মাথা নাড়িয়ে বলবে, না না না …।

আমিও ভাবি, কস্মিনকালে দেখা না হয়েও একদিন অকস্মাৎ মুখোমুখি পড়ে তো যেতে পারি আমরা। গিরিশ পার্ক মেট্রো স্টেশানে? বেশ, তাই হোক।
তুমি এগিয়ে এসে ইতস্তত গলায় বললে, কেমন আছো!
রোগা হয়ে গেছ এতটা? নিশ্চয়ই এখনও না খেয়ে অফিসে চলে যাও?
আহা, আমার ওপর রাগ করে কবিতা লেখাই বন্ধ করে দিলে!

আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলাম, যদিও আমার স্বভাব সিগারেট ও নীরবতাবিরোধী। তুমি আরও একটু অস্থির: আচ্ছা বাবি, সব ঝগড়া ভুলে আবার প্রথম থেকে শুরু করা যায় না! ধরো (গলা ধ’রে এসেছে) মাঝখানের দশ বছর মিথ্যে, দুজনে ফিরে গেছি শুরুর দিনটায়। তুমি আমার হাতে সদ্য বেরনো কবিতার বই তুলে দিচ্ছ, আর সেই আগের মতো আমি দেমাক দেখিয়ে বললাম, ‘পড়ব নিশ্চয়ই, কিন্তু মতামত দিতে অনুরোধ করবেন না, প্লিজ’!
না গো, বলব না। পুরনো ভুলগুলো আমরা কেউ করবো না আর কখনও, দেখো তুমি।

তখন মনে হল, আমার গায়ের রঙ পরিপক্ক চাপা, টলটলে স্বাস্থ্যের ওপর হলুদ ডুরে শাড়ির গাছকোমর। আমার মাথায় গাগরিভর্তি ছলছলাৎ। আর সামনে তুমি — ফর্সা, উচ্চাকাঙ্খী এক অস্ত্রসমাবেশ! এবার বহু বছর ধরে রিহার্সিত সেই ছোট পংক্তির ডায়লগ বের করে আনছি চিত্রনাট্য থেকে, এক্সপ্রেশানে গন্ডোগোল না করে বসি, যেন প্রতিটা অক্ষরে সমান জোর পড়ে:
না বাবি, আজ আর সেটা সম্ভব নয়”।

বাক্য শেষ। এবার সান্নাটা! ড্রপসিন আপেলের মতো পতনমুখী। “আজ আর সম্ভব নয়” বলতে বলতে আকাশ থেকে পাখির ঝাঁক উধাও হচ্ছে। “সম্ভব নয়” — যাত্রাপালায় ঝাঁঝর বাজল তুলকালাম “ঝং” করে। দন্ত্য স, ম আর অন্তস্থ য়-এর ভেতরের সেলাই খুলে গিয়ে তিনটে পোকায় কাটা আলাদা দাঁতের টুকরো…।

আমার মাথা থেকে খসে প’ড়ে, প’ড়ে চুরমার হয়ে, হ’য়ে ভরপুর মৃত্যুর মধ্যে মিশে যাচ্ছে ওরা দুজন — ধারণাপূর্ণ দুধ আর মাটির কলসাধার।

ছড়া হাতে গড়া

ছড়া হাতে গড়া

বেহালার ছড় বেতালার ছড়া
আনা তড়খড় ডাক-হরকরা

ট্রেন-সিঙ্গার মৌলানা কাজি
আদাজিঞ্জার জাহাজের মাঝি

ঝিঁ ঝিঁ ডাকা রোদ ছাতা-খোলা শীত
আকাশগারদে ফাঁসিসংগীত

গলি-রাজপথ… “বাবু, কই গেলি?”
মুমফলি খেয়ে শোকে মোম ফেলি

সবুজের খোপে জল চারকোনা
এটুকু জগত, বাকি হাতে বোনা

চোখে চিতকার গায়ে বাঘনখ
মুখভরা পেস্ট গলায় পদক

অপমান, আয়ু, বাজারের দেনা
সব শোধ হয়, “বিদায়” ফেরে না

ভূত-ভবিষ্য-রুটি হাতে গড়া
আজ হবিষ্য, কাল লিখি ছড়া

বেতালার ছড় বেহালার ছড়া…

গণসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত আর অরিজিৎসিংগীত

গণসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত আর অরিজিৎসিংগীত
ষোলো (ক)

ইউ টিউবে ভিডিয়োতে একটা কুড়ি-বাইশের মেয়ে, ছোট্ট উত্তরভারতীয়, আহ্লাদে ভাসতে ভাসতে বলেছিল, হি সিংগস হোয়াট উই গার্লস ওয়ন্ট টু হিয়ার।

সেই হঁসমুখ বাক্যের ‘হি সিংগস’ ফলাটা ক্যাঁত করে আমার ঘিলুতে গেঁথে যায় আর ‘ওয়ন্ট টু হিয়র’ তার বদ্রীলেজ কাঁপাতে থাকে জুলাই বাতাসে।

তিরিশ থেকে পঞ্চাশ বয়েসখণ্ড ধরলে ভারতীয় শিক্ষিত মেয়েদের এক প্রস্থচ্ছেদ পাবো যারা পুরুষতন্ত্রের হাত থেকে অনেকখানি ক্ষমতা স্বাধীনতা সমানাধিকার ছিনিয়ে নিয়েছে; চাকরি করেছে, ডিভোর্স করেছে, সিঙ্গল পেরেনটিং, পছন্দসই পেশায় গেছে, অংশ নিয়েছে একাধিক প্রেমে যৌনতায়, নেশা করেছে, একা বেড়াতে গেছে, ইচ্ছেমতো পোশাক পরেছে, সমাজ-আন্দোলনে নেমেছে, অন্যায়কারী পুরুষকে টেনে নিয়ে গেছে পুলিশ-আদালত পর্যন্ত, সংসারে তাদের মতামতকে সমান গুরুত্ব দেওয়াতে বাধ্য করেছে।

এর কিছু কাজ নিশ্চয়ই করতে হয়েছে গুপ্তঘাতকের মতো, ফলস-ইমেজের আড়ালে ব’সে, যেহেতু তারা হাড়েমজ্জায় পুরুষতন্ত্রকে চিনেছিল। যুদ্ধে প্রতিপক্ষকে চেনাটা আসল জরুরি।

তবু চেনা আর জানায় তফাত থেকেই যায়। স্কুলে যৌনশিক্ষার বই পড়ে তো আপনি সহপাঠির মন জানতে পারবেন না।

আরএসএস আর হিন্দু জনতা, মুসলিম ল’ বোর্ড আর মুসলমান সম্প্রদায়, মাওবাদি এবং পশ্চিম মেদিনীপুরবাসীর মতোই পুরুষতন্ত্র আর পুরুষ — একটা এমপ্লয়ার-এমপ্লয়ি সম্পর্ক। মেসমালিক-বোর্ডার রিলেশানশিপও বলতে পারেন। মাড়োয়ারি ফার্মে যখন রাজস্ব দপ্তরের ‘ছাপা’ পড়ে, মাসে ছ’হাজার টাকা মাইনের কেরানি মেয়েটার কোমরে তিনটে কাঁচা চালান-বই গুঁজে পাঠিয়ে দেওয়া হয় বাথরুমে, যেখানে সে অনন্তকাল দরজা টেনে বসে থাকবে। তবু কোম্পানির মালিককে চেনা আর কর্মচারিকে জানা (যে জানা থেকে বোঝা সমাগত) এক জিনিস নয়। এক নয় প্রতিক্রিয়া (reaction) দেখানো আর সাড়া (response) দেওয়া।

তবু ভারতে তিরিশ থেকে পঞ্চাশ উমরকালের মেয়েরা তাদের ঐতিহাসিক ভুরুগুলো কুঁচকে রেখেছে বলেই এখন ‘বচনা অ্যায় হসিনোঁ, লো ম্যায় আ গয়া’-র মতো গান রেকর্ড হয় না বলিউডে। তাদের ‘হর এক কে মুহ মেঁ আধা-আধা লিটার পেট্রোল’; পুরুষের আচরণে ‘কুছ উঁচনিচ হোয়েঙ্গা তো’ অটোমেটিক ভেতর থেকে নির্দেশ আসবে ‘থুক’, সঙ্গে সঙ্গে ‘মাচিস মারকে নিকল লেনে কা’!

এরা সন্দিগ্ধ আর অবিশ্বাসী; নখ মেরুদাঁড়া একসঙ্গে উঁচিয়ে রেখেছে-হেতু সন্তানের জীবনে পুরুষ-অত্যাচারের কোনও লিগ্যাসি-ফাইল বদলি হয়ে আসেনি। প্রজন্ম-পুরনো শোষণের লাগেজ পিঠে হাঁটছে না নতুন মেয়ে।

আর মেধাবী অকৃত্রিম আত্মনির্ভর নারীকে পেয়ে বেঁচে গেছে এখন-পুরুষ। সে তাকে একই সঙ্গে রক্তমাংসে, আবার শরীরের বাইরে গিয়ে আইডিয়া হিসেবেও দেখতে পাচ্ছে, যে যোগসাজশ সম্পর্কের পরিত্রাণের জায়গা।

অরিজিৎ গাইলঃ
তুম হো না হো, লগতা হ্যায়
অব জ্যায়সে কি তুম হী তো হো
(গানের নামঃ লাভ মি থোড়া অর)

অথবা
তূ হী তূ হ্যায় জো হর তরফ মেরে
তো তুঝসে পরে ম্যায় জায়ুঁ কঁহা
(গানের নামঃ ইশক মুবারক)

তো, দুটো গান প্রেমকে অ্যাপ্রোচ করছে পুব আর পশ্চিম, দুই উলটো দিক থেকে। সূর্যাস্তের পরেও সূর্যের থেকে যাওয়া সূর্যনিরপেক্ষ, বোধনির্ভর। তপনজ্যোতি, তুমি আছো নাকি নেই, এই বাস্তবতা একান্তই তোমার বিষয়। কিন্তু আমার কাছে শুধু ‘তুমি’ই আছো, কারণ ‘আমি’ লুপ্ত হয়ে গেছি সেই কবে!

অথবা আমার সমস্ত পাহাড়চুড়োয় তুমি জেগে উঠেছ ভোর পাঁচটায়, আমার বাইনোকুলারে, মাংকিটুপিতেও। বরং আমি দেখছি এখানে তোমার কাছ থেকে পালানোর রাস্তাটাই লা-পতা! তার ওপর কখন রবীন্দ্রনাথও গা-ঘেঁষে দাঁড়িয়ে গেছেনঃ ‘যেথা আমি যাই নাকো/তুমি প্রকাশিত থাকো’ ব’লে। কানের কাছে ঘাড় নামিয়ে ফিসফিসোচ্ছেন — কখনো যদি তার হৃদয় বিপথে যেতে চায়, তৎক্ষণাত লজ্জা পেয়ে সরে আসে।

ভারতীয় মান সে আধ্যাত্মিকতাই অনুভবেই গভীরত ম বিন্দু, কারণ ইশ্বরের চেয়ে বড় ভাবকল্পনা এদেশে আজও কিছু হয় না। ‘সনম বে-ওয়াফা’ ছবিতে লতা গেয়েছিলেন ‘আল্লাহ করম করনা, লিল্লাহ করম করনা’, আর ‘সনম রে’ ছবির অরিজিৎসিংগীত ওই একই পুজোপ্রবচন ব্যবহার করল ভালোবাসাতেও, ‘সনম রে, সনম রে, তেরা মুঝপে করম হুয়া রে’। স্বানন্দ কিরকিরের লেখা ‘ফিতুর’ ছবিতে একটা ভীষণ ইন্টারেস্টিং আর ফাটানো প্রেমের গান ‘পরবরদিগারা’, যে শব্দের মানে, খুব কম করে বললেও, ভগবান। এখানে আবার হালকা রবীন্দ্রনাথ পালন ক’রে নিচ্ছি — ‘এলিজে’ ছবির অরিজিতসংগীতটা দিয়েঃ

প্যার ম্যায়নে জো নিভায়া
তেরে রহতে তেরে সাথ ভী
সচ কহুঁ তো উসসে জ্যাদা
চাহা তুঝকো তেরে বাদ ভী

শুনতে শুনতে আপনি গুনগুনাতেই পারেন—
যে কথাটি বলবো তোমায় ব’লে/কাটলো জীবন নীরব চোখের জলে
সেই কথাটি সুরের হোমানলে/ উঠল জ্বলে একটি আঁধার ক্ষণে
তখন তুমি ছিলে না মোর সনে

ষোলো (খ)
ধুলোকপাল, জটপাকানো চুল, ক্লান্ত কিটোজুতো — ওই দেখুন অফিস-ফেরত পুরুষের কাঁপা কাঁপা হাত উঠছে রাত ন’টার কলিং বেলের দিকে। দরজা খুলতে দু’মিনিট দেরি, কিন্তু সে গলার ভেতর থেকে বাঘ বের করে আনলো না। একবার ফ্যাঁস পর্যন্ত করল না আজও পাঁচফোড়ন আনতে ভুলেছো!-র জবাবে। পুরুষ বিশ্রাম চাইছে, স্বপ্ন দেখছে একটা সহজচেয়ারের যেখানে তার গা ঘেঁষে হোমপোস্টিংয়ে থাকবে অঘ্রাণের রোদ্দুরও।

জো তুম না হোতে
হোতা হী ক্যা হার জানে কো
(গানঃ কভী ইয়াদোঁ মেঁ আয়ুঁ)

হেরে যাওয়ার জন্যে এত যত্ন, এত টেনশান, এত নির্ভরতা, এমন নমনীয় গর্দান…!

ফুটন্ত জলের পাত্রে বুদবুদ ভেসে ওঠে, নিচে নেমে যায়, অরিজিৎ গাইতে শুরু করে ‘তেরা ইয়ার হুঁ ম্যায়’-

“তুই যদি রেগে যাস, কে হাসবে তবে
তুই ছেড়ে গেলে কে থাকে শূন্য বৈভবে

আয় আবার ঝগড়া ক’রে পুতুল কেড়ে নিই
তুই জিতিস,আমি হেরে ভূত হবো
আয় ফের করি আগের সব শয়তানি
তুই পালাস, আমি নয় মারই খাবো
তোর ওই মিষ্টি বকুনি শুনবো ব’লে ছটফটাচ্ছি,
দিব্যি বলছি, কিরে!

তোর বন্ধু আমি রে…”

গানটার ভেতরে একটা দ্বিজনপথ বসানো দেখতে পাই। গানের তরুণতরুণী মাঠের মধ্যে মিশে যাচ্ছে হাঁটতে হাঁটতে…দুপায়ে বাতাসের প্রোটিন, শিশিরের জলসঞ্চয়। দেখি মরা ঘাসে বিখ্‌রে আছে দুটো মুকুট, ফুটো হয়ে যাওয়া পুরুষতন্ত্র আর আধাতৈরি নারীআগম।

(ষোলোকলা)

স্টিফেন হকিং আর লিওনার্দ লোদিনো-র লেখা “দ্য গ্র্যান্ড ডিজাইন”

[স্টিফেন হকিং আর লিওনার্দ লোদিনো-র লেখা “দ্য গ্র্যান্ড ডিজাইন” বইয়ের ‘হোয়াট ইজ রিয়ালিটি’ প্রবন্ধের কিছু অংশের অনুবাদ করেছিলাম দু’তিন বছর আগে। তার অল্প কিছুটা…]

বাস্তবতা কী?

কয়েক বছর আগে ইতালির মোনজা শহরের পৌরসভা গৃহপালিত পশু-পাখির মালিকদের গোল পাত্রে গোল্ডফিশ রাখার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। ব্যবস্থাগ্রহণকারী তার পদক্ষেপের আংশিক ব্যাখ্যা দেন এই বলে যে কোনও মাছকে বক্রতল-বিশিষ্ট পাত্রে রাখা একরকম নিষ্ঠুরতা, কেননা বাইরের দিকে তাকালে মাছ বাস্তবের একটা বিকৃত চেহারা দেখছে।

কিন্তু আমরা কী করে জানতে পারলাম যে আমাদের কাছেই বাস্তবের সত্য ও অবিকৃত চেহারাটাই আছে? এমন নয় তো যে আমরাই রয়েছি বড়ো গোল্ডফিশ-পাত্রের ভেতর আর একটা বিশালাকায় লেন্স আমাদের দৃষ্টি বিকৃত করে দিচ্ছে? গোল্ডফিশের বাস্তবের প্রতিচ্ছবি আমাদের চেয়ে আলাদা, কিন্তু আমরা কি নিশ্চিত হতে পারি যে সেটা কম বাস্তব?

গোল্ডফিশের দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের সঙ্গে মেলে না, তবুও তারা বৈজ্ঞানিক নিয়মের সূত্র আবিষ্কার করতে পারে যার সাহায্যে পাত্রের বাইরে দেখা বস্তুর গতিবেগ শাসন করা যায়। উদাহরণ হিসেবে, বিকৃতির জন্যে একটা স্বাধীন ভ্রমণশীল বস্তু যেটা আমাদের চোখে সরলরেখায় চলছে বলে মনে হয়, ওদের চোখে বক্ররেখা অনুসরণকারী হিসেবে ধরা দেবে। সে যাই হোক না, সোনালিমাছ তাদের বিকৃত দৃশ্য-বাস্তবতা থেকেই বৈজ্ঞানিক সূত্র প্রণয়ন করতে পারে যেটা সবসময় সত্যি হবে এবং যার জন্যে পাত্রের বাইরের বস্তুর ভবিষ্যত গতির ব্যাপারে অনুমান করতেও সক্ষম হবে তারা। আমাদের দৃশ্যজগতের নিয়মগুলো থেকে ওদেরটা আরও জটিল হবে, কিন্তু সরলতা তো কেবলমাত্র রুচির ব্যাপার। কোনও সোনালিমাছ এমন থিয়োরি তৈরি করলে তার দৃষ্টিভঙ্গিকে বাস্তবের অকাট্য ছবি হিসেবে আমাদের মেনে নিতেই হবে।

বাস্তবের পৃথক ছবির একটা উদাহরণ হল মহাজাগতিক বস্তুর গতি বর্ণনার জন্যে ১৫০ খ্রিস্টাব্দে আনা টলেমি-র (৮৫ এ.ডি.-১৬৫ এ.ডি.) মডেল। টলেমি তার আবিষ্কারটি প্রকাশ করেছিলেন ১৩ খণ্ডের ভল্যুমে সাধারণত যা আরবি “আলমাজেস্ট” নামেই পরিচিত। আলমাজেস্ট শুরু হচ্ছে — পৃথিবীর যে গোলকের মতো আকারের, নিশ্চল, ব্রহ্মাণ্ডের মাঝখানে বসে আছে আর মহাকাশের সঙ্গে দূরত্বের তুলনায় তার চেহারা হিসেবে না আসার মতোই ছোট — এর কারণ ব্যাখ্যার ভেতর দিয়ে। আবার কোপার্নিকাস ১৫৪৩ খ্রিস্টাব্দে এমন এক পৃথিবীর বর্ণনা দিলেন যেখানে সূর্য স্থির আর গ্রহগুলো বৃত্তাকার পথে তার চারদিকে ঘুরছে।

এখন, কোনটা বাস্তব, টলেমি না কোপার্নিকাসের নকশা? যদিও মানুষজনের পক্ষে এটা বলা অস্বাভাবিক নয় যে কোপার্নিকাস টলেমিকে ভুল প্রতিপন্ন করলেন, আসলে তা সত্যি নয়। যেমন আমাদের স্বাভাবিক দেখা বনাম সোনালিমাছের দেখা, যে কেউ এর কোনও একটা ছবি ব্যবহার করতে পারে ব্রহ্মাণ্ডের মডেল হিসেবে, কেননা মহাকাশ সম্পর্কে আমাদের পর্যবেক্ষণকে পৃথিবী বা সূর্য, যে কোনও একটিকে কেন্দ্রে রেখেই ব্যাখ্যা করা যায়। আমাদের মহাবিশ্বের প্রকৃতি বিষয়ে দার্শনিক বিতর্কে এর যাই ভূমিকা হোক না কেন, কোপার্নিকাসের ছাঁচের আসল সুবিধে হল স্রেফ এটুকু যে গতিবেগের সূত্রগুলোর সমীকরণ সেই ফ্রেম অফ রেফারেন্সে অনেক সরল যেখানে সূর্য স্থির অবস্থায় আছে।

এক ভিন্ন ধরণের বিকল্প বাস্তবতা দেখা গিয়েছে সায়েন্স ফিকশান সিনেমা “দ্য ম্যাট্রিক্স”-এ, যেখানে মানুষ নিজের অজান্তে বুদ্ধিমান কম্পিউটারের তৈরি এক সিমুলেটেড ভার্চুয়াল বাস্তবতার মধ্যে বাস করছে যাতে তারা শান্ত আর সন্তুষ্ট থাকে আর সেই ফাঁকে কম্পিউটার মানুষের জৈব-বৈদ্যুতিক শক্তি (সে জিনিসটা যাই হোক না কেন) শুষে নেয়। এই ভাবনা হয়তো খুব বেশি কষ্টকল্পিত নয়, কেননা অনেক মানুষ ওয়েবসাইটগুলোর অনুকারক বাস্তবতার মধ্যে সময় কাটাতে পছন্দ করে যেন এটা তাদের দ্বিতীয় জীবন।

কীভাবে জানলাম যে, কম্পিউটারের তৈরি একটা সোপ অপেরাতে আমরা জাস্ট কয়েকটা চরিত্র নই? যদি আমরা একটা কৃত্রিম কাল্পনিক জগতে বাস করতাম, ঘটনার কোনও যুক্তিগ্রাহ্যতা বা ধারাবাহিকতা থাকত না, তারা মেনে চলত না কোনও নিয়মও। ভিনগ্রহের প্রাণী যাদের নিয়ন্ত্রণে আমরা, আমাদের প্রতিক্রিয়া তাদের আরও বেশি মজার লাগত। ধরুন, পূর্ণ চাঁদ ভেঙ্গে অর্ধেক হয়ে গেল অথবা পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষের কলার ক্রিম পি-র ওপর সামলানো-যায়-না এমন এক ভয়ানক লোভ তৈরি হয়েছে। কিন্তু যদি অন্য গ্রহের প্রাণীরা নতুন কোনও নিয়ম প্রণয়ন করে থাকে, আমরা কোনওভাবেই তাদের জানাতে পারব না যে এই ছদ্মবেশী বাস্তবের বাইরেও একটা বাস্তবতা ছিল। অ্যালিয়েনরা যে পৃথিবীতে বাস করে সেটাকেই “সত্যি” বলা ঠিক হবে আর কৃত্রিম পৃথিবীকে “মিথ্যে”। কিন্তু আমাদের মতো সিমুলেটেড জগতের সত্তারা বাইরে থেকে যদি তাদের ব্রহ্মাণ্ডকে দেখতে না পায়, তাদের নিজেদের মনের ছবিকে সন্দেহ করার কোনও কারণই থাকবে না। এটা হল সেই চিন্তার আধুনিক চেহারা যে আমরা প্রত্যেকেই অন্য কারও স্বপ্নের অংশ।

নারীবাদের সাদাকালো

[Ev’ry leaf, and ev’ry whispering breath
Convey’d a foe, and ev’ry foe a death
ওলাদা একুইয়ানো (১৭৪৫-১৭৯৭) একজন
নিগ্রো দাসের লেখা কবিতা]

যদি কোনও মেয়েকে গভীর ঘুম থেকে ঝাঁকুনি দিয়ে জাগিয়ে জিগ্যেস করো, তুমি কে — একজন কালো মেয়ে বলবে ‘আমি কালো মেয়ে’, একজন সাদা মেয়ে শুধুই ‘মেয়ে’, বা তাদের কেউ ‘লেসবিয়ান’; কিন্তু কেউই নিজেকে ‘সাদা মেয়ে’ বা ‘সাদা মানুষ’ বলবে না।

ফেমিনিজমের টুকরো না হওয়ার সমস্যাও এখান থেকে শুরু হয়। ‘রেডস্টকিংস’দের ঘোষণা, যা নারী-আন্দোলনের প্রথম ম্যানিফেস্টোগুলোর একটা, বলেছিল — পুরুষরা মেয়েদের দমন করে আর অল্প কয়েকজন পুরুষ দমন করে বাকি সবাইকে। এই বিশ্লেষণে দুটো সম্ভাবনার কথা ধরা হয়নিঃ সাদা মেয়েরা শোষণ করতে পারে কৃষ্ণাঙ্গ ছেলেদের আর, সাদা ও কালো মেয়েদের মধ্যে জাতিগত দ্বন্দ্বের একটা যথেষ্ট ভূমি রয়েছে।

একদিকে নারী-আন্দোলনের প্রধান ধারা, যা অবশ্যই শ্বেতাঙ্গ নারী অধ্যুষিত, বলেছে যৌনতা জাতিবাদের চেয়ে অনেক মূল বিভাজন আর পুরুষ-নারী সম্পর্ককে একান্তই ‘সেক্সুয়াল পোলিটিক্স’-এর যুক্তিকাঠামোয় বিধৃত করেছে; অন্যদিকে কালো মেয়েরা (অস্তিত্ববাদী ডিকশান ব্যবহার করা যাক) ‘doubly the other’, কেননা তারা যুগপৎ যৌন ও জাতিগত অদৃশ্যতায় ভুগছে। আরও স্পষ্ট বললে, কালো মেয়েদের আগাগোড়া আক্রমণ করে গেছে এই ত্রিশূল সমস্যাঃ কালো পুরুষের যৌনবাদ, সাদা মেয়ের জাতিবাদ আর সাদা পুরুষের জাতি-যৌন রাজনীতি। এর পরিণতিতে ওরা অবিশ্বাসী আর হোস্টাইল হয়ে উঠেছে শ্বেতাঙ্গ মেয়েদের বিষয়ে আর এই Bad Faith জন্ম দিয়েছে এমন ধারণার যে নারীমুক্তি আন্দোলন হল সাদা মেয়েদের ব্যাপারস্যাপার।

এই বিরোধ মেটাতে গিয়ে মেইনস্ট্রিম (সাদা) নারীবাদীরা কিন্তু স্ববিরোধী বক্তব্য রাখছে। ‘সাদা মেয়েদের নারীবাদ’-এর ধারণাকে ‘ছেলেদের সমাজতন্ত্রে’র মতো হাস্যকর বলার পর তাদের বক্তব্যঃ নারী-পুরুষ আর সাদা-কালো এই দুই শোষণের মধ্যে প্রথমটার অস্তিত্ব এই পুরুষ রাষ্ট্রগুলো স্বীকারই করে না, যেখানে পরেরটা সম্পর্কে অপরাধবোধে ভোগে। কাজেই নারীবাদী আন্দোলন আক্রমণের লক্ষ্য করবে যৌনরাজতন্ত্রকেই। নাহলে নারীবাদীদের তো বামপন্থী বক্তব্যকেই সমর্থন করা হল, যারা বলে যৌনতা-বিষয়ক ইস্যুগুলো অপেক্ষা করুক যতদিন জাতি আর দারিদ্র্যের সমস্যা না মেটে [বামপন্থী অ্যাঞ্জেলা ডেভিস-এর বই ‘উইমেন, রেস অ্যান্ড ক্লাস’]। শ্বেতাঙ্গ নারীবাদী এলেন উইলিস যৌন আর জাতিগত সমস্যার মধ্যে প্রায়রিটির প্রশ্নকেই অস্বীকার করেছেন এই ব’লে যে ‘Insistence on hierarchy of oppression never radicalizes people because the impulse behind it is moralistic’ [প্রবন্ধ ‘সিস্টারস আন্ডার দ্য স্কিন?’]।

কিন্তু যৌনশোষণকে শ্বেতাঙ্গ নারী-আন্দোলনে প্রধান গুরুত্ব দেওয়া মানে তো তাকে পূর্ববর্তিতা দেওয়াই। আর নারীবাদী আন্দোলনের মূল ধারা কখনও নৈতিকতার সীমা ছাড়ায় কি? কীভাবেই বা এরা কালো মেয়েদের নিজেদের আন্দোলনের ছাতার নিচে আনতে চান দর্শনগত অবস্থান একটুও না পালটে? ধরা যাক গর্ভপাতের বিষয়টা। রেগন-শাসনের সময় থেকে সঠিকভাবেই আমেরিকার শ্বেত মেয়েরা আবার গর্ভপাতের পক্ষে সোচ্চার। অথচ পরিসংখ্যানই বলছে কালো মেয়েদের জীবনে অভিশাপের নাম অ্যাবরশান। তাদের বিরাট এক অংশের আজও জোর করে পেট খসানো হয় যৌন-শোষণের সুবিধের জন্যে। তবে কি ঐক্যবদ্ধ নারীমুক্তি আন্দোলনের স্বার্থে কৃষ্ণাঙ্গ মেয়েদের এই বুঝে নিতে হবে যে তাদের বর্তমান সমস্যা নিয়ে আর লড়াইয়ের দরকার নেই, কেননা তা কম গুরুত্বপূর্ণ, কেননা কম আধুনিক, কেননা রাষ্ট্র বিষয়টার অস্তিত্ব স্বীকার করে ফেলেছে আর তাই তাদের এ-ব্যাপারে কোনও দুঃখকষ্ট থাকতে নেই? অর্থাৎ শোষণের সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণ মেয়েদের জন্যে বরাদ্দ হচ্ছে হীনমন্যতাবোধও!

প্রত্যেক নারীর সমস্যাই তার নিজের কাছে চরম গুরুত্বের। এই সত্য অস্বীকার গেছে মার্ক্সবাদ, এখন নারীবাদীরা। তাই মার্ক্সসাহেবদের একটাকা সমালোচনাকারী ফেমিনিজমের মূল ধারার শক্তিশালী হয়ে ওঠা যেন এক নতুন মার্ক্সবাদী দলেরই আত্মপ্রকাশ। মার্ক্সইজম জনসংখ্যাকে ভাগ করেছে অনুভূমিকভাবে (নিচে শোষিত, ওপরে শোষক) আর নারীবাদ উল্লম্বভাবে (ডানদিকে পুরুষ, বাঁয়ে মেয়েরা)। এই পাইকারি শ্রেণীবিভাজন — পাইকারি, কেননা পৃথিবীতে বিশুদ্ধ চাকরির মতোই কোনও সমসত্ত্ব শ্রেণী হয় না —নারীবাদীকে সমাজতাত্ত্বিক সমস্ত সূক্ষ্মতা, বৈচিত্র্য ও জটিলতা না মানতে লোভ দেখায় কখনও এক অনমনীয় তত্ত্বের নামে, তো কখনও সাংগঠনিকতার দোহাই দিয়ে। মার্ক্সবাদের মতোই শ্বেতাঙ্গ নারীমুক্তি আন্দোলন জন্ম দেয় হায়ারার্কি নামে এক উচ্চতর ইয়ারকির, ডিসক্রিমিনেশানের, হয়ে ওঠে প্রভুত্বপরায়ণ আর শেষ পর্যন্ত পর্যবসিত হয় ডগম্যাটিকতায়।

আসলে চিরকাল সভ্যতা এক একটা আন্দোলন প্রসব করার পর প্রসন্ন হয়ে দেখেছে লক্ষ্য অর্জনের কিছু আগেই তারা নিঃশেষ হয়ে গেল, প্রতিটা মতবাদ তাৎপর্য হারানোর বহু মুহূর্ত আগে ঢাকা পড়ে গেল নতুন মতবাদের রোদ্দুরে। এভাবেই ব্ল্যাক লিবারেশান মুভমেন্ট অর্ধশেষ পথে কোথায় হারায়, উঠে দাঁড়ায় ফেমিনিজমের সাদাকালো। কোনও আন্দোলন তাই স্থির, সদৃশ ভূমি পায় না ছায়া রেখে দাঁড়ানোর, আর আকাশ যা পায় — অর্ধেক-মরা দর্শন আর সেই সংলগ্ন সমাজ-অবস্থার এক কোলাজ ছাড়া কিচ্ছু নয়।

এমন অবস্থায় নারীবাদকে যদি শুদ্ধ সমাজ-আন্দোলনের চেহারার কাছাকাছিও দাঁড়াতে হয়, তবে তার বিশেষ রূপ হবে খণ্ডিত, সামাজিক ভূগোলের বিভিন্ন দিকে ছড়ানো টুকরো টুকরো অনেক আত্মনিয়ন্ত্রিত নারীমুক্তি আন্দোলন, আর সাধারণ রূপ হবে এগুলোর মধ্যে যোগাযোগ রেখে চলা উপগ্রহের। ভারতে দলিত নারী-আন্দোলন, শ্রীলঙ্কায় তামিল নারী-আন্দোলন… এমন বহু-র পাশে পাশে হয়তো কালো নারীবাদও ভেঙে যাবে একদিন আমেরিকান আর আফ্রিকান ব্ল্যাক নামের দুই দেশিয়তায়। তাতেই মঙ্গল। নয়তো কালো মেয়েদের ভবিষ্যৎ আর বর্তমান আর অতীত সেই রকম হয়ে থাকলো ওলাদা একুইয়ানো যা একটু আগে লিখেছেন তার কবিতায়।

[মন শোকে মন্থর হলে পুরনো বইখাতা হাঁটকাই। তাতেই জালে পড়ল ১৯৯৫ সালের নোটবুক, দু’খান প্রবন্ধিকা আর একগাল গল্প তার পেটে পেটে। দুঃখজনকভাবে প্রথম গদ্যটা এখানে ছাপিয়ে দিলাম ননস্টপ। সুদীর্ঘ তেইশ বছর আগে এত জ্ঞান ছিল আমার! ভেবে ভয় করছে। হাসিও পাচ্ছে একটু]।

গণসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত আর অরিজিৎসিংগীত

গণসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত আর অরিজিৎসিংগীত

পনেরো (ক)

“ট্র্যাডিশান অ্যান্ড দা ইন্ডিভিজুয়াল ট্যালেন্ট” প্রবন্ধে এলিয়টের কথাঃ
The necessity that he shall conform, that he shall cohere, is not one-sided; what happens when a new work of art is created is something that happens simultaneously to all the works of art which preceded it.

অরিজিৎসিংগীত নামের “নিউ ওয়র্ক অফ আর্ট” তার অস্তিত্বের চূড়াবিন্দুতে বসিয়েছে প্রেমকে — নিজেকে ডুবিয়ে মিশিয়ে গুলে সে-দ্রবণ বিকিয়ে দেওয়া প্রেম। তবে কিনা এই অবস্থায় আসতে একটু সময় লাগে, প্রথম স্তরে স্বয়ংকে খুঁজে পাওয়া যায় না — পকেটের পেন বা হাতের ছাতার মতো হারিয়ে বসেছি কোথাও। তখন প্রেমিকাকেই জিগেস করতে হয়, দেখেছ আমায়?

লাপতা সা মিল জায়ুঁ কঁহী তো
মুঝসে ভী মুঝে মিলা দে জরা
(গানঃ ইশক মুবারক)
[অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ জানতে চেয়েছিলেন, একেলা আপন-মনে দিন কি কাটিবে না (গানঃ গেল গো)]

অথবা,
ঢুঁঢলো তুম, খো গয়া হুঁ ম্যায় কঁহি
ঢুঁঢলো তুম, খুদ পে হ্যায় নহি একীঁ
(গানের নামঃ ঢুঁঢলো )
[কবিগুরুর বক্তব্য ছিলঃ পলক পুলকরস-ভরা রেখে যাই, নাহি দিই ধরা (গানঃ কে ডাকে)]

পুনরপি,
ম্যায় চাহুঁ মুঝে মুঝসে বাঁট লে
জরা সা তূ মুঝমেঁ ঝাঁক লে
ম্যায় হুঁ ক্যা
(গানঃ কভী যো বাদল বরসে)
[অথচ রবীন্দ্রনাথ গেয়ে গেছেন, নিমেষের তরে শরমে বাধিল, মরমের কথা হল না (গানঃ নিমেষের তরে)]

এমনও হতে পারে যে, যাকে জিগেস করছি সেও নিজের অস্তিত্বে নেই মোটেই!

তুম থে ইয়েহি ফির ভি তুম গুম থে
অর ম্যায় লা পতা
(গানের নামঃ আজ যাও না)
[কিন্তু গুরুদেবের ধারণা, তোমারে আমি দেখিতে পাই, তুমি পাও না মোরে (গানঃ অনেক কথা যাও যে বলে)]।

এভাবে অরিজিতসিংগীতের মিউজিক টুল ব্যবহার করে আমরা রবি ঠাকুরের প্রেমগীতির নাটবল্টু খোলার চেষ্টা করে যাচ্ছি, যেহেতু আর এক গুরুদেব বলে গেছেন, নতুন কোনও শিল্পকর্ম তৈরি হ’লে যা ঘটে সেটা তার আগের সব শিল্পকর্মের বেলাতেও ঘটে যায়।

পনেরো(খ)
অরিজিতের আগের গানটায় নারীপুরুষ দুজনেই গায়েব ছিল। কাজেই ওদেরই দায়িত্ব নিতে হবে একে অন্যকে খুঁজে দেওয়ার, আর যতক্ষণ না অপরের সন্ধান মেলে — যে “অপর” খুব দ্রুত বিয়িং-এর সমীপবর্তী হয়ে পড়ছে — ততটা সময় নিজেকে অন্বেষণও মুলতুবি।

তুঝমেঁ খোয়া রহুঁ ম্যায়, মুঝমেঁ খোয়ি রহে তূ
খুদকো ঢুঁঢ লেংগে ফির কভি
(গানের নামঃ ফির কভি)

কেন না, নিজের হারিয়ে ফেলার শর্ত একটাই — আত্মকে বিসর্জন দিয়ে তোমায় পেতে চাই। তবেই বাঁচবো আমি।

খুদকো খো কর তুঝকো পায়া
ইস তরহা সে মুঝকো জিনা আয়া
(গানের নামঃ তেরে ন্যায়না জব সে মিলে)

লক্ষ করা যাক, দুটো সত্তার খুদকো-তুঝকো ভেদ মিটে এসে এখানে আত্মবিনিময় উৎসব চলছে। বুকের খাঁচার মধ্যে প্রাণপাখির পালটাপালটি। আমাদের সর্বোচ্চ দূরে থাকা “অপর” তো ঈশ্বরই। প্রেমিকার সঙ্গে হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপন খেলার ভেতর দিয়ে আসলে আমি হৃদয়ে বসিয়ে নিচ্ছি পরমব্রহ্মকে।

এই আভ্যন্তরীণ ট্রান্সপ্ল্যানটেশানের পরে পায়ে পায়ে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালে কাকে দেখবো? তোমাকে, অভিয়াসলি!

আইনা হো কোয়ি, নজর আয়ে মুঝকো তূ হী
ম্যায় ভী তেরা চেহরা হো গয়া
(গানঃ ম্যায় হুঁ সাথ তেরে)

ওই যে প্রেমিক প্রথমে খুব কনফিডেন্স নিয়ে বলেছিল না, “খুদকো ঢুঁঢ লেংগে ফির কভি”, সে এখন নিজের আধার কার্ডটি হারিয়ে ফেলেছেঃ

ঢুঁঢনে সে মিলতে নহী হ্যায় হম
বস আপহী আপ বাকি হ্যায়
(গানের নামঃ দেখা হজারোঁ দফা)

শুধু একটা আলোরশ্মি অথবা এক সুগন্ধের ইশারা ইন্দ্রিয়তে ধরা পড়ে, কিন্তু কার সেই সংকেত, কোত্থেকে আসছে, ব্যোমকেশও ব্যোমকে যাবেন খুঁজতে গিয়ে।

কোই রওশনি সী হ্যায় ইয়া কোই খুশবু হ্যায়
মেরা তন-বদন মেঁ হ্যায় কৌন ম্যায় ইয়া তূ হ্যায়
(গানের নামঃ আলবিদা)

এ-হল নির্ভেজাল সুফিয়ানা, অথচ তৈত্তিরীয় উপনিষদেও কাছাকাছি কথা বলা আছে। সেখানে আত্মার যে পঞ্চকোশের বর্ণনা, যা কিনা আত্মজ্ঞান লাভের পাঁচ উপায়, তার শেষ স্তর আনন্দময় কোশে দ্যাখা যায় ভিন্ন ভিন্ন আত্মার অস্তিত্ব আর তাদের মধ্যে সম্পর্কের মূলে আছে এক অখণ্ড আনন্দময় আত্মা। তিনিই জগতের মূল কারণ। অব্যক্ত অবস্থা থেকে তিনি সৃষ্টিতে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে হলেন সৎ অর্থাৎ ব্যক্ত। তিনি রসস্বরূপ আনন্দ। আনন্দ অভয়ে, আনন্দ পরম সাম্যে [ব্রহ্মানন্দবল্লীঃ দ্বিতীয় অধ্যায়; পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম অনুবাক]।

উল্টোদিকে রবীন্দ্রনাথে প্রেম প্রায়ই অচেনা, উদাসীন, সন্দিগ্ধ, বিদায়প্রবণ — প্রেমিকার মধ্যে ব্রহ্মস্বরূপ দেখা তো দূর, আত্ম-পর অভেদ রচনা নিয়েও হৃদয় ঘামাচ্ছে না। “ধরা দেবার খেলা এবার খেলতে হবে” মর্মে ঘোষণার পর “আমি আমার ভুবন শূন্য করেছি তোমার পুরাতে আশ” ব’লে বিবৃতি, কাউকে ক্ষণকালের আভাস হতে চিরকালের তরে ঘরে ডেকে নেওয়া, অন্ধকারের অন্তরধন-এর কাছে “আমার চোখের জলের দিয়ো সাড়া” ব’লে প্রার্থনা — সবই চমৎকার আত্মনিবেদন, কিন্তু “আমি তোমারই বিরহে রহিব বিলীন, তোমাতে করিব বাস” ব’লে একবার নাভির শেকড় পর্যন্ত চমকে তোলা ছাড়া আর কোনও ফকিরি ভাষ্য নেই ছাড়া রবি ঠাকুরের প্রেমের গানে।

কাজেই, রবীন্দ্রনাথের চরণ থেকে কোনও উত্তরাধিকার বর্তায়নি অরিজিতসিংগীতে, বরং সে পেট থেকে পড়েছে মধ্যযুগে ছড়ানো উত্তরভারতীয় ভক্তি আন্দোলনের — রামানন্দ, নিন্বার্ক, গুরু নানক, দাদূ দয়াল, মীরাবাঈ, সুরদাস, মলুক দাস, সুন্দর দাস, বীরভান, আর…

সন্ত কবিরের এই পদটা তো জানেন সবাইঃ

ইয়হ তট ওয়হ তট এক হ্যায়
এক প্রাণ, দুই গাত
অপনে জীয়ে সে জানিয়ে
মেরে জীয়ে কী বাত
[এই তীর, ওই তীর আসলে তো একই — দুই শরীর, এক প্রাণ। নিজের হৃদয় থেকে জেনে নিও আমার হৃদয়ের ব্যাখ্যান]।

(চলছে… )

গণসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত আর অরিজিৎসিংগীত

গণসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত আর অরিজিৎসিংগীত

চোদ্দ
আমরা জানি যে রবীন্দ্রনাথ কিছু প্রেমপর্যায়ের পূজা-র গানও লিখেছেন। “বাঁশি আমি বাজাইনি কি পথের ধারে ধারে” সেই রকম ম্যান্ডোলিন বাদকের আসরে এক সরোদিয়ার ঢুকে পড়াঃ

“মিলন-ছোঁয়া বিচ্ছেদেরই অন্তবিহীন ফেরাফেরি
কাটিয়ে দিয়ে যাও গো নিয়ে আনাগোনার পারে”

এখানে প্রেমিকা ঈশ্বরী ছাড়া আর কিছুমাত্র নন। এখানে ঝপ করে মনে পড়বে কবীরঃ
প্রেম পন্থ মে পগ ধরৈ, দেত না শীশ ডরায়
সপনে মোহ ব্যাপে নহী, তাকো জনম নসায়

[প্রেমের পথে পা রাখা মানুষের নিজের মাথা কাটা যাওয়ার ভয় থাকে না। সে বিভ্রমের শিকার হয় না স্বপ্নেও, আর তার পুনর্জন্মেরও সমাপ্তি হয়ে যায়]।

উপনিষদ বলছে, প্রকৃতিতে জন্মের গ্রন্থি হল অহংকার। কাজেই অহং নষ্ট হলে তার বেঁচে থাকারও হেতু নেই।

ম্যান্ডোলিন-সাম্রাজ্যে আবার এক পিস সেতার ঘুস্পেঠ ক’রে “ওরে কী শুনেছিস ঘুমের ঘোরে” বানিয়েছে, যেখানে রবীন্দ্রনাথ বললেনঃ

“যেন জীবন মরণ একটি ধারায় তার চরণে আপনা হারায়
সেই পরশে মোহের বাঁধন রূপ যেন পায় প্রেমের ডোরে”।

বলার অপেক্ষা রাখে না, এই প্রেম-অপার্থিবগুলো রবি ঠাকুরের ভালোবাসা পর্যায়ের অন্য সব গানের তুলনায় দলছুট; সীমান্ত পাহারায় একটু হালকা দিলেই ফ্লোর ক্রস করে পূজা-শিবিরে ঢুকে পড়বে।

আত্মনিবেদনের আংশিক তালিকা এখানে টাঙিয়ে দেওয়া হলঃ
“আমার পরাণ লয়ে কী খেলা খেলাবে ওগো”, “আমারে করো তোমার বীণা”, “ওগো কাঙাল আমারে কাঙাল করেছ”, “আজি এ নিরালা কুঞ্জে আমার”, “আমার জীবনপাত্র উচ্ছ্বলিয়া”, “হে সখা বারতা পেয়েছি মনে মনে”, “বড় বেদনার মতো”, “তুমি রবে নীরবে”, “আমার নিশীথ রাতের বাদলধারা”, “বিজয়মালা এনো আমার লাগি”, “তুমি একটু কেবল বসতে দিয়ো কাছে”, “চৈত্রপবনে মম চিত্তবনে”, “নিশি না পোহাতে”, “বলো সখী, বলো তারি নাম”, “এবার উজাড় করে লও হে আমার”, “আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ”, “তারে দেখাতে পারি না কেন প্রাণ”, “আমার এই রিক্ত ডালি”, “এসেছি গো এসেছি”, আমার থাকতে দে না”, অথবা “কাঁদালে তুমি মোরে ভালোবাসারই ঘায়ে”।

নোটিশবোর্ডের গানের কথাগুলো হাতে তুলে একটু নাড়াচাড়া দিলে দেখবেনঃ (ক) প্রায় সবখানে ‘আমি’ আর ‘তুমি’ এই দুই আলাদা সত্তা সমুপস্থিত। তাদের মধ্যে একটা বিভব-প্রভেদ বা পোটেনশিয়াল ডিফারেন্স কাজ করছে এবং পদার্থবিদ্যার সহজ ধারণায় পুরুষ V(A) থেকে নারীর V(B) দিকে ছুটছে সেই সমর্পণের প্রবাহ। কিন্তু আত্মোৎসর্গ অধুরা হয়ে আছে বেশির ভাগ সময়ে, V(A) = V(B) হয়নি যেহেতু!

যেমন, “তারে দেখাতে পারি না কেন প্রাণ”-এ অন্তরার শেষ লাইনে বললেনঃ সে আমার এত সাধ এত প্রেমের অপমান করছে, তবু আভোগে এসে চাইলেন নিজের ভালোবাসাকে প্রেমিকার পায়ে রেখে দিতে। মানে, উৎসর্জনের পায়েসবাটিতে মান-অপমানবোধ নামের দুটো কালোজিরে মাথা তুলেই থাকল।

এভাবে আপনি আমার লিস্টিতে চোখ রাখলে আরও খেয়াল করবেনঃ (খ) নিবেদনের গানগুলো বেশিটা আসছে মেয়েদের বচনে, আর সেই নারীর চেতনায় লেগে থাকছে রাধা-অনুষঙ্গ। বলা যায়, চৈতন্যদেবের ঈশ্বরসাধনার অ্যাপ্লায়েড দিক ছিল ‘রাধাভাবে কৃষ্ণভজনা’। অবিভক্ত বাংলার ট্রাজেডি এই যে আমরা মিনসেরা কখনও হৃদয়ে কৃষ্ণানুভব করে কৃষ্ণকে ডাকতে পারলুম না, নিজেকে সঁপে দিতে গেলে মেয়েদের স্বর নকল করতে হল — যে ব্যর্থতা হয়তো আসলে পুরুষতন্ত্রেরই।

__________
(অশেষ… )

কষ্টপুঁজিপতি

কষ্টপুঁজিপতি

মানুষ মেরে জেতা কি যায় যুদ্ধে?
শান্ত মাথা জিগেস করছে ক্রুদ্ধে

নিজে ঝ’রেও লড়াই রাখা যায় না
যারা উসকে দিল — ভাবুক হায়না

“খাবো না, যাও” — জেদের মাতৃভূমি
এদেশে নেই, ভুল ভেবেছ তুমি

আমার ঘরে সুখের সাদা পুঁতি
অনিকেতরা কষ্ট-পুঁজিপতি

গণসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত আর অরিজিৎসিংগীত

গণসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত আর অরিজিৎসিংগীত

তেরো
রবীন্দ্রনাথ আমার কাছে যতটা প্রিয় শব্দ, রাবীন্দ্রিক ততটাই অপছন্দের। রবীন্দ্রনাথ শিল্পের নাম হলে রাবীন্দ্রিক তার মাথায় পা রেখে দাঁড়ানো সংস্কৃতি। প্রাইমারি টেক্সটকে একা থাকতে দেওয়া খুব জরুরি, যেন একটা পুরনো দুর্গ, চারপাশে গোল করে কাটা পরিখা। তার বাইরে যে এক চিলতে চত্বর সেখানে রবিবারের ভিড়, টিকিট কেটে হুড়মুড় দর্শক ঢুকে প’ড়ে এক একজন গাইডকে ঘিরে মৌচাক বানিয়েছে।

এই পরিচালকেরাই রবীন্দ্রসংস্কৃতির পিলার বা পুরোহিত। কিন্তু আমরা তো বুদ্ধকে চাই, বৌদ্ধদের নয়। দুর্গের দিকে থুতনি তুলে গল্প শোনায় আগ্রহ নেই, গাইড বরং পাটাতন হয়ে শুয়ে পড়ুক, জনগণ পিঠের ওপর দিয়ে পরিখা পার হয়ে যাবে।

অথবা ধরা যাক, বালুচিস্তানের সুলেইমান পাহাড়ের গায়ে এক পুরনো কবরখানা থেকে বা সুইডেনের এরেসান্ড প্রণালীর তীব্র লবণজলে ডুবে যাওয়া জাহাজের খোল থেকে গীতবিতান আবিষ্কৃত হয়েছে। উদ্ধারকারী দলের সদস্য হিসেবে আমি বইটা হাতে পাওয়ামাত্র প্রেমপর্যায় পড়তে শুরু করলাম।

“দুঃখ দিয়ে মেটাবো দুঃখ তোমার
স্নান করাব অতল জলে বিপুল বেদনার।।
মোর সংসার দিব যে জ্বালি, শোধন হবে এ মোহের কালি,
মরণব্যথা দিব তোমার চরণে উপহার।।”
(প্রেম, ১৩৬ নম্বর)

কথা, নাকি হাজার বিভাবে পরিপূর্ণ একটি খতরনাক ব্যাপার! যত পড়ছি, চৌসা আমের মতো ক্যাডবেরি ফাইভ স্টারের মতো চটচটে মিষ্টি লাইনগুলোর মধ্যে এত রাগ-ভয়-অবিশ্বাস-অভিযোগ-অভিমান-সন্দেহ-মোহভঙ্গ-উদ্বেগ দেখে মাথা ঘুরে যাচ্ছে! বেশির ভাগ লেখা থেকে টেনশানের গরম বাষ্প বেরিয়ে গায়ে ছ্যাঁকা লাগায়।

ঘর-বাইরের দ্বন্দ্ব “আমার যেতে সরে না মন”-এ; “গেল গো ফিরিল না চাহিল না”-য় ঝটকা দেওয়া অভিমান; অনাদর আর অবহেলা পাওয়ার স্মৃতি “এই কথাটি মনে রেখো” গানে; “ডেকো না আমারে ডেকো না” বা “যাক ছিঁড়ে যাক”-এ অবহেলা ছলনার অভিযোগ; “আমার প্রাণের মাঝে সুধা আছে চাও কি” জিগেস করেও ঠোঁট ফোলানো; তবু সকল অভিমানের সেরা “সেই ভালো সেই ভালো”। কনফিউশান দ্যাখা দিচ্ছে “যে ছিল আমার স্বপনচারিণী” বা “ও দ্যাখা দিয়ে যে চলে গেল” অথবা “ফিরে যাও কেন ফিরে ফিরে যাও”-তে। আবার কোথাও দুজনের মধ্যে প্রেমের টক্কর লেগেছে — “আহা, তোমার সঙ্গে প্রাণের খেলা”। যদি ভুল করে পস্তানো হয় “হায় হতভাগিনী” বা “সে কোন ঝড়ের ভুল”, কঠিন বিচ্ছেদকষ্ট থাকবে “আর নহে আর নহে” গানে; শেষে যথেষ্ট হয়েছে, থাকলো তোর প্রেম ব’লে আমি “ছিন্ন শিকল পায়ে নিয়ে” কেটে পড়ছি। এই রকমই মুক্তসত্তার দ্যাখা পাবেন “এক রাস্তা হ্যায় জিন্দগী”-সম (সিনেমা কালাপাত্থর) “কে ডাকে। আমি কভু ফিরে নাহি চাই” লিরিকে।

আবার, প্রেমিকার দিকে আঙুল তোলায় শুরু হয়ে শেষে হাহাকারে মিশে যাচ্ছে “গোধূলিগগনে মেঘে ঢেকেছিল তারা”। যদিও রবি ঠাকুর প্রেমে ভুল বোঝাবুঝি ব্যাপারটাকে চিরস্বীকৃতি দিয়েছেন “কেহ কারো মন বুঝে না”-য়, তবু “না বুঝে কারে তুমি ভাসালে” বা “বিদায় করেছ যারে নয়নজলে” অথবা “হল না লো হল না সই”-এর মতো নানা বাণীতে সেই আক্ষেপ-টেনশান। এদিকে অপূর্ণতার বোধ বারবার এসে ছলাৎছল দুলিয়ে দিচ্ছেঃ “আমি যাব না গো অমনি চলে” বা “মম দুঃখের সাধন” গানগুলোয়। অভিমানে টইটম্বুর রবি ঠাকুর — “যদি বারণ কর তবে গাহিব না”; প্রবল অবিশ্বাসী যখন — “না বলে যায় পাছে সে” কিম্বা “তবে শেষ করে দাও শেষ গান”। নাকি অবিশ্বাস নয়, আত্মভরসার অভাব “তবু মনে রেখো”-তে? দ্বিধা জুড়ে আছে মন — “সখী আমারি দুয়ারে কেন আসিল”, অতৃপ্তি এসেছে “আকুল কেশে আসে” গানে, ভয়-সংশয়ের এক্সপ্রেশান “জয় করে তবু ভয় কেন তোর” বা “মুখপানে চেয়ে দেখি”-তে আর যেন কবিকে ডিসিভ করেছে প্রেমিকা “হে ক্ষণিকের অতিথি এলে প্রভাতে কারে চাহিয়া…”।

মিলনের মুহূর্তেও বিচ্ছেদচিন্তা রবীন্দ্রনাথকে পাগল করে রাখেঃ “এই উদাসী হাওয়ার পথে পথে” বা “বসন্ত যে যায় তো হেসে” অথবা “কেন ধরে রাখা, ও যে যাবে চলে” বলেন যখন। কোটি কোটি বিরহ ডানা মেলে ”ও আমার ধ্যানেরই ধন” আরাধনায়। যেন বিচ্ছেদ সত্য, মিলন মিথ্যে, “ওকে বাঁধিবি কে রে” বা সকালবেলার আলোয় বাজে”তে; মিলনে শুরু বিরহে শেষ “শেষ বেলাকার শেষের গানে”। বিদায় জানানোর গান, “জানি, জানি হল যাবার আয়োজন”, নাড়ি-ছেঁড়ার যন্ত্রণা “আমার যাবার বেলা পিছু ডাকে”, বিদায়বাঁশি বাজছে “কেন আমায় পাগল করে যাস”… শেষে বলেই দিলেন, “আজ-শ্রাবণের সজল ছায়ায় বিরহ-মিলন, আমাদের বিরহ-মিলন”। এতদ্বারা প্রেমিকাকে জানানো যাইতেছে, দূরত্বকেই সংলগ্নতার সমশব্দ ভেবে নিতে হবে। কিছু করার তো নেই।

এত সমস্ত না লিখে একটা গোটা গানই তুলিঃ

কোন্‌ বাঁধনের গ্রন্থি বাঁধিল দুই অজানারে
এ কী সংশয়েরই অন্ধকারে।
দিশেহারা হাওয়ায় তরঙ্গদোলায়
মিলনতরণীখানি ধায় রে
কোন্‌ বিচ্ছেদের পারে।।
(শ্যামা, প্রেম ২১৯)

দেখুন, পাঁচ লাইনের প্রেমগীতে সংশয়, অন্ধকার, দিশেহারা(ভাব) এবং শেষে বিচ্ছেদ!

তাহলে রবীন্দ্রনাথের প্রেমের গানে কমেডি নেই, আস্থা নেই, নেই আনন্দ? না না, ভরপুর আছে সমস্ত চ্যানেল। তবে মোটের ওপর সে মিলন পারফোরেটেড, ভরসার পংক্তিগুলো ছোট, আনন্দ বিরহভয়ে সারা। কিন্তু আশা-হতাশা মিলিয়ে শ্রাবণারণ্যে এমন মোহনছায়া বোনা হল যে আমরা কাঁদি-কোঁকাই না, বরং প্রেমিক রবীন্দ্রনাথ বনগাঁ লোকালে জানলার পাশে ফাঁকা সিটের মতো অলৌকিক হাতছানি দেন শ্রোতাকে। যখন গানের ভাব আঘাত করে, তখন আশ্রয় দিচ্ছে শব্দ-ব্যবহার, ইমেজারির প্রয়োগ; যখন লেখাও তার রক্তাক্ত হাতে জড়িয়ে ধরছে না আমাকে, যেমন ওই ১৩৬ নম্বর বা ২১৯, তখন সিওর সাকসেস শান্তি দেয় সুর।

খেয়াল-প্রভাবিত ভারতীয় সংগীতমানস নিয়ম করেছে যে গানের কথা হবে দু’বছরের বাচ্চা আর তার সুর ৪৪ সাইজের পাঞ্জাবি। হয়তো সেখান থেকেই রবীন্দ্রনাথের গান বাণীপ্রধান এমন ধারণা আরম্ভ চালু শুরু হয়ে গেল। উনি কিন্তু ব্যবহার করেছিলেন “ভাবপ্রধান” শব্দটা, বলেছিলেন গানে কথাসুর সমানাংশ নিক। আমি তো প্রেম পর্যায়ের গানে বহু জায়গায় দেখেছি যে ছেলেমানুষ গীতবিতানকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে, উদ্ধার করছে প্রেমিক স্বরবিতান। আমার কাছে অনেক সময় রবি ঠাকুরের গানের কথার চেয়ে সুর বেশি কমপ্লান গার্ল।

মিলন-বিরহে এই যে রবীন্দ্রনাথ বিভাজিত, এটা অ্যাসরটেড সাইজের বিস্কুট নয়, ভাববৈচিত্র‍্যও নয় কবির। সুলেইমান পাহাড় সংলগ্ন এরেসান্ড প্রণালীর মানুষ হওয়ার জন্যে তাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি না, কিন্তু প্রেমের গান ওল্টাতে গিয়ে মনে হল তার একটা ঘটনা ছিল, কোনও প্রাচীন কেস। যেন ওই প্রেম নিয়েই ভূমিষ্ঠ হন গায়ের চামড়ার মতো, তারপর দাড়িগোঁফের মতো বৃদ্ধির মাঝখানে যে হঠাৎ করে গায়েব হয়ে গেছে নেপালের ভূমিকম্পে। এবং যদি আপনি সুপার কোয়ালিটির একটা প্রেম পেয়ে গিয়েও হারিয়ে ফেলেন তবে জিন্দগিভর সে আপনার অবসেশান হবে, হবে বেঁচে থাকার উপায় ও মরে যাওয়ার অনুপ্রেরণা। সমান মূল্যবান কথা এই, ভবিষ্যতের সব সম্পর্ককে ওই শুরুতে সার্থক শেষে ব্যর্থ প্রেমের বাটখারায় মাপবেন আর সীতাহারের মতো ফেলে দেবেন ছুঁড়ে ছুঁড়ে। এগিয়ে যাবেন কিন্তু ভিড়তে পারবেন না, ফলত এই সম্পর্কগুলো হবে বিশ্বাসহারা, অভিযোগময়, হালকা, হতাশাউৎপাদক, অসমাপ্ত।

আন্ডার দ্য অ্যাবাভ, আমরা হয়তো বুঝি প্রেমের গানে কেন রবীন্দ্রনাথ বারবার সমর্পণের দরজা থেকে ফিরে আসেন।

(আরও লিখবো)

গণসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত আর অরিজিৎসিংগীত

গণসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত আর অরিজিৎসিংগীত

বারো
এতক্ষণ যা বলতে চেয়েছিঃ হিন্দি ফিলমি গানে গত তিরিশ বছরে পুরুষের ন্যারেটিভে বড় একটা বদল এসেছে। সে নিজের টিম ছেড়ে যোগ দিয়েছে নারীভাষ্যে আর দুই দলই নৌকোর একই দিকে জড়ো হলে যা দাঁড়াবে, নারীপুরুষের প্রতিতুলনা বিষয়টার সলিলসমাধি হয়ে গেছে। গানের ভাষা লক্ষ করলে দ্যাখা যাবে নায়ক ক্রমাগত নত হচ্ছে পদহস্তাসনে, আগে যা ছিল নায়িকার এক্তিয়ার।
পুরুষ যে নারীর সমতলে নেমে এল, তার কী কী চিহ্ন হতে পারে? এক নম্বর: ছেলেরা কাঁদে না এই মিথ ভণ্ডুল করে দেওয়া।

অরিজিৎ গাইলঃ
ক) জিক্‌র তুমহারা জব জব হোতা হ্যায়
দেখো না আখোঁ সে ভিগা ভিগা প্যার বহ জাতা হ্যায়

(যখনই তোমার প্রসঙ্গ ওঠে, এই দ্যাখো, আমার চোখ দিয়ে বয়ে চলে ভিজে ভালোবাসা। ছবিঃ তেরা চেহরা)।

খ) মেরে আখোঁ মে আকে মুঝে থোড়া রুলা দে
(ছবিঃ বন্দেয়া)।
এবং সর্বোপরি
গ) অগর তূ হোতা তো না রোতে হম (বাগি ছবিতে)

ক্যারাটে ও ডিগবাজি জানা বিদ্রোহী টাইগার শ্রফ (বাগি শব্দের আরেকটা মানে উপেক্ষাকারী পর্যন্ত!) নায়িকাকে বলছে তুমি (পাশে) থাকলে আমি কাঁদতুম না গো এবং তারপরেও ধর্মেন্দ্র, এমনকি সানি দেওল জীবিত — ভাবা যায় না!

দুই নম্বর নিশানী : পুরুষ শরীরকামী না হয়ে যাচ্ছে মনের দিকে। এই দেখুনঃ

তন লড়ে তো তন মুক যায়েঁ
রুহ জুড়ে তো জুড়ি রহ জায়েঁ

(দেহ দেহে মিলিত হলে আশ্লেষের শেষ আছে। কিন্তু আত্মা মিললে সেই আসক্তি চিরকাল)।(গান: রাবতা)।

এছাড়াও, পরিষ্কার জ্ঞানের কথাঃ
রক্তমাংসের পেছনে ছুটে বেড়াচ্ছ, কখনও আত্মায় এসে নেমেছ কি যে জানতে পাবে কাকে প্রেমিক বলে? প্রেম কী জিনিস?
(গানঃ আসান নহি হ্যায় ইঁহা)।

রুহ শব্দের প্রয়োগ হচ্ছে এই সময়ের গানে আকছার, যা কিশোর-কালীন লিরিকে দেখিনি।

তিন নম্বর প্লাগ পয়েন্টঃ
আগে পয়সাওলা বাপের মেয়ে গরীব নায়কের প্রেমে পড়ে বলতো আমি সব মানিয়েগুনিয়ে নেবো গো; এখন উল্টে গেছে ছবি। অরিজিৎ গাইলঃ

শীষমহল আমার সহ্য হয় না, তোর সঙ্গে শুকনো রুটি খেতে ইচ্ছে করি।
(শীষ মহল না মুঝকো সুহায়ে
তুঝ সঙ্গ সুখি রোটি ভায়ে)
(গানঃ মস্ত মগন)।

পয়েন্ট ফোরঃ
নায়ক ফলো করছে, আশ্রয় করছে নায়িকাকে — যেন এক বর্ণবিপর্যয়, উলটো রাজার দেশে…।

জঞ্জীর ফিল্মে রোগা গরীব অনাথ জয়া ভাদুড়ি একগুঁয়ে অনাপোষ এক পুলিশ অফিসারকে মাথায় রেখে গেয়েছিলঃ বনাকে কিঁউ বিগাড়া রে, বিগাড়া রে নসিবা, উপরওয়ালে। আমরা জানি, এই উপরওয়ালা যুগপৎ ঈশ্বর এবং অমিতাভ বচ্চন। নায়ক তাকে পেটের মধ্যে নিয়ে এক আন্তরিক হাগ দিতো নিশ্চয়ই, কিন্তু প্রেজেন্ট না থাকায় জয়া বাড়ির পেছনের কচুবাগানে শাড়ির আঁচল গায়ে জড়িয়ে রবীন্দ্রসংগীতের মতো পুরো গানখানি ঘুরে ঘুরে গেয়ে ফেলে। এটা ১৯৬৬-র ঘটনা।

ওই একই সালে সাধনা গেয়েছিল সুনীল দত্তের জন্যে আনন্দী কল্যাণে, করুণ গলায়ঃ তূ জাহাঁ জাহাঁ চলেগা, মেরা সায়া সাথ হোগা।

১৯৬৬ টু ২০১৭, জঞ্জীর বা তেরা সায়া থেকে ম্যায় হুঁ সাথ তেরে। সেই লম্বা নায়কেরা এতদিন জয় করতে করতে, তার চেয়েও বেশি জয়ের (বা বীরুর) অ্যাকটিং করতে করতে বেঁটে হয়ে আমির খান,তার ব্যারিটোন সরু হয়ে সইফ আলি, গানের গলা কিশোরের ধমকানো বেস ছেড়ে অরিজিতের ফ্যাঁসফেসে সমর্পিত স্বর।

কাজেই নায়ক অবশেষে নায়িকাকে গ্যাস খাওয়ানো ছেড়ে গেঞ্জি খুলে দেখাচ্ছে, ভাই ভেতরে বর্মটর্ম কিছু নেই, কেউ দিতেও ভুলে যায়নি যে দৌড়ে গিয়ে চেয়ে আনবো।

তার চেয়ে বরং “তোমার ছায়ায় চলবো আমি” বলছে নায়ক প্রেমিকাকে, যেভাবে দাশসাহেব লিখেছিলেনঃ যতদিন বেঁচে আছি সূর্যে সূর্যে চলি। পুরো স্তবক তো শুনুন —

শাম সা তূ ঢলতা, তূ সুবহ সা হ্যায় নিকলতা, তেরে সায়ে মে চলতা, ম্যায় হুঁ সাথ তেরে।

হয়তো এই প্রথম হিন্দি ফিল্মি গানের লিরিকে এক নারীকে পুরুষতান্ত্রিক ভাষাবিধি ভেঙে সূর্য বলা হল। আরও সুন্দর ব্যাপার, প্রেমিক সময়চক্রের প্রতীক করে তুলল তাকে, ছেলেটার অস্তিত্বের সত্যের আধিকারিক হয়ে উঠল সেই মেয়ে। এই নতুন রূপককে লজেন্সের মতো মুখে নিয়ে একবার জিভ দিয়ে টাকরায় চেপে ধরুন। সারা গায়ে কাঁটা দিচ্ছে না!

নতজানুতার শেষ উদাহরণ দিয়ে আজকের এপিসোড খতম করতে চাই। অরিজিৎ আর আতিফ আসলাম দুজনেরই রেকর্ড করা গান — হুঁ, “ক্যায়সে, জিয়ুংগা ক্যায়সে-র কথাই বলছি।
এই লাইনদুটো তুলবোঃ

ম্যায় অন্ধেরোঁ সে গিরা হুঁ
আ দিখা দে তু মুঝকো সবেরা মেরা।

বন্ধুগণ, আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, “অন্ধেরোঁ সে গিরা হুঁ”, “অন্ধেরোঁ মে” নয় কক্ষণও, অথচ তাই প্রত্যাশিত ছিল। নায়ক অন্ধকারের ভেতরে ঝরে যায়নি, অন্ধকার থেকে ঝরে পড়েছে ধুলোঝাপটার পৃথিবীতে। গর্ভ থেকে এই বিরুদ্ধ অনাপন ভুবনে নিষ্কাশিত হয়ে সে আশ্রয় করতে চাইছে প্রেমিকাকে — মায়েরও আগে, মায়ের চেয়েও প্রধানভাবে।

আমরা দেখাতে চাইবো, রবীন্দ্রনাথের প্রেমের গানের মনস্তত্বে এই পর্যায়ের সমর্পণ নেই। ইউরোপিয় যুক্তিবাদ, রেনেসাঁসের আলোকজ্ঞান, রোম্যান্টিকতা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র‍্য আর উপনিষদীয় উইজডমের মিশেলের মধ্যে বৈষ্ণব ভক্তিবাদ বা লালনাশ্রিত যে মায়াকল্প, সেখানে প্রিয়কে দেবতা করার ইচ্ছেটা এতটা প্যাশনেট “প্রেজেন্ট প্লিজ” বলতে পারছে না।

(আর দুটো টুকরো)

r: কম্বাইন অ্যান্ড নো রুল?

এক পেটুক সহকর্মী ছিলেন আমার, কোথাও নেমন্তন্ন পেলেই তাকে ছুটতে হবে, আবার সফরের একাকিত্ব কাটাতে সঙ্গে একে-তাকে ধরে নিয়ে যাওয়াও চাই। আমাকে পাকড়াও করার চেষ্টা করলে বলতাম, সুস্থ শরীরের বারোটা বাজাব কেন মিছিমিছি? তিনি যে সমাধান দিতেন তা ঐতিহাসিক! “আরে, শরীর-টরীর কিচ্ছু খারাপ হবে না। প্রাণ ভরে খেয়ে দুটো হজমের ট্যাবলেট গিলে শুয়ে পড়ুন। পেটের মধ্যে ওরা-ওরা মারামারি করবে, আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমোবেন”।

ব্রিটিশ শাসকদের ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি আর কি। হিন্দুু-মুসলিমে ধুন্ধুমার বাধিয়ে দিতে পারলে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ ওদের স্থায়িত্বের আনন্দে বদলে যাবে।

সাধারণভাবে ভারতে সেই “বিভাজন-প্রশাসন” নীতিই শাসকেরা মেনে চলে। শুধু ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার “ওরা-ওরা” স্বাধীন ভারতে এসে “আমরা-ওরা” হল। ইংরেজ আমলে রাষ্ট্র ছিল থার্ড পার্টি, বাইনারির বাইরের লোক, আর স্বাধীন ভারতে শাসকই “আমরা”, স্বয়ং সুবিধেভোগী।

কাজেই প্রশাসনের একটা চলন তৈরি হয়ে গেল, নির্দিষ্ট রাগের যেমন থাকে। ঘটনা যাই হোক, বাদী আর বিবাদী স্বর পাল্টাবে না। একটা অপরাধের স্থানাংক আর মূল্যবিচার, তার বিরুদ্ধে কী পদ্ধতিগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে, সব এই বিভাজন-প্রশাসন তত্বের ওপর দাঁড়িয়ে।

যা বলেছি এতক্ষণ, নতুন কিচ্ছু নয়। এও সবার জানা যে, গণতন্ত্রে রাষ্ট্র জনতাকে একবারই সক্রিয় করে তোলে যখন তাকে লাইন ক’রে ইলেকশান বুথের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হবে। কর্তৃত্বের যে শাসনের অধিকার, তাতে তখন আইনি শিলমোহর লাগানো দরকার। পরের পাঁচ বছর জনগণ নয় ঘুমিয়ে পড়ুক।

এই ঘুম নিশ্চিত করার জন্যেই আইন শৃঙ্খলা। পার্টির নজরদারিও। ক্ষমতায় থাকা দল আর বিরোধীর গুন্ডা/অ্যাক্টিভিস্টদের মধ্যে লড়াই চলতে থাকে, কিন্তু সেখানে লেজটি পেতে না দিলে সাধারণ মানুষ অস্পৃষ্ট থেকে যায়। লেজ না বাড়ানো মানে মাথা নিচু করে ক্ষেতে, অফিসে, দোকানে যাওয়া, দিনশেষে বাড়ি ফিরে আসা মাথা নিচু করে। উল্টো দিকে, কালো টাকার সমান্তরাল অর্থনীতির মতো ক্ষমতার লড়াইয়ের আদত চেহারাটা আন্ডারগ্রাউন্ড গোষ্ঠীজীবনের আদলে গড়িয়ে যেতে থাকে, কখনও সেটা পৃথিবীর ভূত্বকের ওপরে উঠে এলে সাধারণ নাগরিক ভয়ে সিঁটিয়ে যায় (ওয়েলসের “টাইম মেশিন” মনে করুন)।

কিন্তু এখনকার পশ্চিমবঙ্গে একটা নতুন প্রতিবেশ তৈরি হয়েছে যে বিরোধীরা, ভয়ে-ভক্তিতে সরকারি রাজনৈতিক দলের দিকে পা বাড়াচ্ছে আর গৃহীত হয়ে যাচ্ছে। মানে, ডিভাইডের জায়গায় কম্বাইন শব্দটা এসে বসল। এমন চলতে থাকলে “দুইখান কথা” জন্ম নেয়।

ধরুন, ক্ষমতায় যেতে চাওয়া দলগুলোর লড়াই ওজোনস্তর নির্মাণ করে রেখেছিল আর প্রাথমিক শোষণ হল আল্ট্রা-ভায়োলেট রশ্মি। “প্রাথমিক বা প্রত্যক্ষ শোষণ” কী? খুন, ধর্ষণ, চুরি, ছিনতাই, আগুন লাগানো এইসব — আইন-শৃঙ্খলার জাগ্রত অবস্থা যাকে সফল ভাবে প্রতিহত করতে পারে। কিন্তু “কম্বাইন” করার নতুন পরিস্থিতিতে ওই ওজোনমণ্ডলের অস্তিত্ব আর নেই। এবং যেহেতু আমাদের রাজ্যে উৎপাদনের অবস্থা খুব রমরম করছে এমন নয়, রোজগারের সুযোগ সীমিত, সেক্ষেত্রে স্লোগানটা এখানে এসে দাঁড়ায় যে ‘জনগণই অর্থনীতির উৎস’। খুব বিচ্ছিরি অর্থে এও মানব সম্পদের ব্যবহার। তাহলে চ্যাপলিনের ফিলমের দৃশ্যের মতো কামানের নল কি নিজের পাবলিকের দিকেই ঘুরে গেল! ‘আমরা’ হলাম গোটা রাজনৈতিক শক্তিবর্গ আর ‘ওরা’ ঠাওরালাম সাধারণ নাগরিককে?

দ্বিতীয় কথাটা প্রশাসন নিয়ে। তার রাগের চলন এখন স্তিমিত, যেহেতু সবই বাদী স্বর এবং বারোটা স্বর নিয়েই (সবক’টা শুদ্ধ!) গান গাওয়ার চ্যালেঞ্জ। প্রশাসন তবে কার পক্ষ নেয় আর কাকে বঞ্চিত করে? যদি সে মিলিত রাজনৈতিক শক্তির দিকে থাকে তবে তার এতদিনের “ডিভাইড অ্যান্ড রুল” নীতিতে চলার অভ্যেসে একটা বড় বদল আসবে। কেননা সে রঙ দেখে অ্যাকশান নিতে পারছে না, প্রত্যেক অপরাধের ঘটনায় অপেক্ষা করে থাকবে শেষ পর্যন্ত, রাজনীতির কী নির্দেশ? কাজেই নতুন যে পরিস্থিতির উদ্ভব হল তাতে প্রশাসনের এফিকেসি আরও অনেক মার খেতে পারে, সে ভীষণ শ্লথ হয়ে যেতে পারে এবং সাধারণ নাগরিক, যারা প্রত্যক্ষ/প্রাথমিক শোষণের শিকার বা শ্রোতা-দর্শক, তাদের মনে হবে একটা এমন একটা রাজ্যশাসনে এসে পড়লাম যার মূলনীতি “কম্বাইন অ্যান্ড নো রুল”।

তবে যেভাবে অসুখের সংজ্ঞা আর তার চিকিৎসা একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল, যেভাবে কোনও সিনেমাতেই কাঁচি না চললে সেন্সর বোর্ড মুমূর্ষু হয়ে পড়বে, ঠিক তেমনি আইন সব সময় চায় একটা ‘অস্থিতিশীল ভারসাম্য’ (পরিভাষা ইটালো ক্যালভিনো-র, “ইফ অন এ উইন্টার’স নাইট এ ট্র‍্যাভলার”) যেখানে সে শাসনের কারণ তৈরি করতে পারে, যেহেতু ল’ একমাত্র টিঁকে থাকে নিজেকে প্রয়োগ করার ভেতর দিয়েই। সুতরাং আমার আশা যে নতুন সাফলিং হবে, কোনও নতুন বিভাজন বা চিড়-সূত্র — যাতে প্রাথমিক বা প্রত্যক্ষ শোষণ-বিরোধী কামানের নল জনতার উল্টোদিকে ঘুরিয়ে দেওয়া যায়।